পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বর্ধমানে বসেই বর্ণপরিচয় (প্রথম ভাগ ) রচনা করেছিলেন। বিদ্যাসাগর তখন দক্ষিণবঙ্গের বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবে বর্ধমান শহরে পার্কাস রোড ও প্যারীচাদ মিত্র লেনের সংযোগস্থলে বাস করতেন। এখানে দক্ষিণবঙ্গের বিদ্যালয় পরিদর্শকের হেড অফিস ছিল। তিনি থাকতেন এখানকার বাসিন্দা লেখক প্যারীচঁাদ মিত্রের বাড়িতে। এখান থেকেই বিদ্যাসাগর বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবে বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুর, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ-সহ দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলার স্কুলগুলি পরিদর্শন করতেন। কখনও তিনি পায়ে হেঁটে, আবার কখনও গরুর গাড়িতে এবং পালকিতে চেপে দূর-দূরান্তে বিদ্যালয় পরিদর্শকের কাজে যেতেন।
ডক্টর অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “শোনা যায়, প্যারীচরণ সরকার এবং বিদ্যাসাগর একদা সিদ্ধান্ত করেন যে, দু’জনে ইংরেজি ও বাংলায় বর্ণশিক্ষা বিষয়ক প্রাথমিক পুস্তিকা লিখবেন। তদনুসারে প্যারীচরণ First Book of Reading এবং বিদ্যাসাগর ‘বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ’ প্রকাশ করেন।” বিহারীলাল সরকারের রচনা থেকে জানা যায় মফস্বলে স্কুল পরিদর্শনে যাওয়ার সময় পালকিতে বসে পথেই বর্ণপরিচয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন বিদ্যাসাগর। ১৮৫৫ সালের এপ্রিলে (১৩ এপ্রিল,১৮৫৫ প্রকাশিত হয় বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ এবং ওই বছরেই জুনে প্রকাশিত হয় বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ। বিহারীলাল আরও লিখেছেন, “প্রথম প্রকাশে বর্ণপরিচয়ের আদর হয় নাই। ইহাতে বিদ্যাসাগর মহাশয় নিরাশ হন; কিন্তু ক্রমে ইহার আদর বাড়িতে থাকে।” প্যারীচরণের ইংরেজি গ্রন্থখানিও বাঙালি সমাজে দীর্ঘকালের আদরের বস্তু ছিল। তবে আজকের বিশ্বায়নের যুগে এই গ্রন্থটির শিক্ষামূল্য কিছুই অবশিষ্ট নেই। অথচ বিদ্যাসাগর মহাশয়ের গ্রন্থটি আজও বাঙালি সমাজে শিশুদের বাংলা শিক্ষার প্রথম সহায়ক হয়ে রয়ে গেছে।
বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগে তাই বর্ধমানের বহু ঘটনা যুক্ত করেছিলেন বিদ্যাসাগর। যেমন রসুলপুরে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে তিনি গ্রামের উমেশ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে যেতেন। একদিন তঁার সামনেই উমেশবাবুর হাত ছুরিতে কেটে যায়। সেখান থেকে ফিরে তিনি বর্ণপরিচয় বইয়ে লিখেছেন, 'উমেশ ছুরিতে হাত কাটিয়া ফেলিয়াছে।' ঠিক তেমনই মেমারির পাঠশালার তারক, ঈশান, কৈলাশ —এই তিন ছাত্রের নাম তিনি উল্লেখ করেছেন। এছাড়া খণ্ডঘোষের পাঠশালার গোপাল যেমন সুবোধ বালক, রাখাল তেমন নয় —এই দু'জনের নামও তুলে ধরেছেন।
বর্ধমানের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ-লেখক সুধীরচন্দ্র দঁায়ের লেখা একটি প্রবন্ধ থেকে এইসব উদ্ধৃতি করা হয়েছে। প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাগে তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায় বিভিন্ন শব্দ যুক্তি-সহ লিখেছিলেন, যা প্রত্যেকের কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। বহু লেখকের বহু বই ও গল্পের পরিবর্তন ঘটলেও প্রাথমিকে কিন্তু আজও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় বাঙালি সমাজের কাছে শিক্ষার প্রথম ধাপ হিসেবেই রয়ে গেছে। তাই জনপ্রিয়তায় বর্ণপরিচয় আজও সবার ঊর্ধ্বে। পরিদর্শনকালে তিনি গ্রামগঞ্জে যেখানেই সুযোগ পেতেন, সেখানেই কোনও সরকারি দপ্তরে অথবা ধনী ব্যক্তির বারান্দায় বা বৈঠকখানায় একটি করে পাঠশালা বা প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলে দিতেন। তঁার পকেটের পয়সা খরচ করে সেখানে স্থানীয় আগ্রহী যুবককে ধরে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করতেন।
বর্ণপরিচয় যে অত্যন্ত কার্যকর হয়েছিল তা এর কাটতি ও জনপ্রিয়তা দেখেই বোঝা যায়। ১৮৫৫ থেকে বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত (১৮৯১) মোট ৩৫ বছরে বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ-এর ১৫২টি মুদ্রণ সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম তিন বছরে ১১টি সংস্করণে ৮৮ হাজার কপি মুদ্রিত হয়েছিল। পাঠকের কৌতূহল নিবৃত্ত করার জন্য বলা যায়, এ বইয়ের প্রথম সংস্করণ ছাপা হয়েছিল ৩ হাজার কপি। সেকালের হিসাবে যথেষ্ট বলতে হবে এ সংখ্যাকে। ১৮৬৭ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে ১২৭টি সংস্করণে এ বই মুদ্রিত হয়েছে ৩৩ লাখ ৬০ হাজার কপি। অর্থাৎ এ সময় বছরে গড়ে বর্ণপরিচয় মুদ্রিত হয় ১ লাখ ৪০ হাজার কপি। বলাবাহূল্য, এ কাটতি বা জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারেরও একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে।
রাধাকান্ত দেব রচিত বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ (১৮২১), স্কুল বুক সোসাইটি প্রকাশিত বর্ণমালা প্রথম ভাগ (১৮৫৩ ?) ও বর্ণমালা দ্বিতীয় ভাগ (১৯৫৪),
ক্ষেত্রমোহন দত্ত কর্তৃক তিন ভাগে রচিত
শিশুসেবধি (১৮৫৪),
মদনমোহন তর্কালঙ্কার রচিত
শিশুশিক্ষা গ্রন্থগুলির
ঐ সময়ের তবে এই সব পুস্তিকা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। বাংলা বর্ণমালায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার ক্ষমতাও এগুলির রচয়িতাদের ছিল না বলেই অনেক মনে করেন।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik Sabder Methopath
Vol -341. Dt -13.4.2021
৩০ চৈত্র, ১৪২৭. মঙ্গলবার
=================================
No comments:
Post a Comment