জীবনেও চাই
"যে একবার চলে যায়,
সে কি বার বার ফিরে আসে?
পাহাড়ের বুক থেকে তীব্র জলপ্রপাতের
অজস্র ঝর্ঝর,
একঘেয়ে নামতা পড়ার সুরে বৃষ্টি টিপটিপ,
জুঁইফুল ফুটে ওঠবার কান্না,
আর
আমার রক্তের স্রোতে তাকে শুনতে পাই।
শব্দে আসে, দৃশ্যে তো আসে না।
আমি তাকে স্পর্শে, গন্ধে, নীলাকাশে, সমীরণে—
জীবনেও চাই।"
১২ ই এপ্রিল,১৯৪৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনা যোগমায়া দেবী কলেজ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।। বৈবাহিক সম্পর্কে কবি মণীন্দ্র গুপ্ত হলেন স্বামী।
উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ :
অন্ধ স্কুলে ঘন্টা বাজে, আমার পুতুল, যুবকের স্নান, কবিতা সমগ্র, তুন্নুর কম্পিউটার, দেবারতি মিত্রের শ্রেষ্ঠ কবিতা। খোপা ভরে আছে তারার ধুলোয় ,ভূতেরা ও খুকি প্রভৃতি।
কথিত আছে জীবনানন্দ দাশের অন্যতম ভক্ত ও কবি কালিদাস রায়ের প্রশংসা ধন্য কবি দেবারতি মিত্র। ছোটবেলা থেকেই কবিতা রচনা আর হাত বলিষ্ঠ বিশেষ করে তার গদ্য রচনা কালিদাস রায় পড়ে মুগ্ধ হয়েছেন কবিতা সুভাষ মুখোপাধ্যায় মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার কৃত্তিবাস পত্রিকা কবিতা ছাপিয়েছেন। এমনি কবির কবিতা প্রসঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন -" গ্রন্থ থেকেই তার সব অভিজ্ঞতা কবিতা লিখতে এবং কবিতাকে ভালোবাসতে শিখেছে পূর্ববর্তী কবিদের কাব্যগ্রন্থ থেকেই সেজন্য তার শব্দ ব্যবহারের কোন দুঃসাহসিক নতুনত্ব নেই আঙ্গিকের আধুনিকতা পরীক্ষা নেই পংক্তিগুলো বিপন্ন নিঃসঙ্গতা এবং বিরল উদ্ভাসিত আন্তরিক স্পষ্টভাবে বলা সে সে নিশ্চিত আধুনিক।"
তার কবিতার ধারায় আমরা স্পষ্টভাবে আন্তরিক সত্যকে উপলব্ধি করি আধুনিক কবি হিসেবে "চাঁদের ক্ষণিক মৃত্যু" কবিতা জীবনানন্দ
সুররিয়ালিস্টিক চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন হৃদয়গ্রাহী অনুভূতি দিয়ে -
" ঈশ্বর তুমি যে মাঝে মাঝে
গভীর বনের মধ্যে শেওলায় সৃতির
শীতল হ্রদের মতো হও
বিকেলের সুগম্ভীর অরণ্য তরুর
অশরীরী গাঢ় রক্ত ছায়া
তোমার অস্পন্দ জলে অনেক মুহূর্ত থেমে থাকে।"
অথবা
নতুন চাঁদের দেশ নির্মাণ করতে গিয়ে ভাঙ্গা পুতুলের চাঁদ কবিতা বলেছেন -
"আমি মূর্তি আধখানা পোঁতা আছি
নিশ্চুপ পাঁচিল ভাঙ্গা ছাদে
চশমাহীন প্রসাধনহীন
চাঁদে গড়া গাছপালা বরফের মতো জল
চেয়ে আছে অলীক বাতাসে
এ যে এক অন্য গ্রহ
জ্যোৎস্নার পঞ্চশগুন আলো
এ কোথায় ?"
** ১৯৬৯ সালে তরুণ কবি হিসেবে কৃত্তিবাস পুরস্কার পেয়েছেন
**** ১৯৯৫ সালে আনন্দ পুরস্কার পান।
উনিশশো একাত্তরে প্রকাশিত হয়েছিল দেবারতি মিত্রের ‘অন্ধস্কুলে ঘণ্টা বাজে’(১ম কাব্যগ্রন্থ) তখনও তিনি কলেজের গণ্ডি পেরোননি। বাংলা কবিতায় সেই থেকেই তাঁর অবিসংবাদিত প্রতিষ্ঠা। প্রথম দিকে তাঁর কবিতায় ছিল নিঃসঙ্গ তরুণীর লাবণ্য ও বিষাদ। তখন, তাঁর প্রেম ছিল ইন্দ্রিয়াতুর ও বেদনাঘন। ক্রমশ পরবর্তী কবিতায় তাঁর প্রেমে এসে মিশেছে স্নেহ আর নিঃশর্ত মমতা। কাছের চেনা-অচেনা সহজ প্রকৃতি তাঁর অনুভূতিতে হয়ে ওঠে গহন ও নিবিড়—তাদের ওপর এসে পড়ে সুদূর আকাশের নিরবচ্ছিন্ন আলো ও অন্ধকার। এই সম্পূর্ণ জগৎকে মনে হয় মায়া, রহস্যে আচ্ছন্ন। ইতিমধ্যে তাঁর বইয়ের সংখ্যা দশ পেরিয়ে গেছে। তাঁর চেতনা যেন নতুন ছায়াপথে বিস্তৃত হচ্ছে—শুধু নিজের সুখ দুঃখ নয়, পৃথিবীর মানুষ, প্রাণিকুল, গাছপালাদের সুখ-দুঃখ তাঁর কাছে সত্য হয়ে উঠছে। সজীব এক আস্তিক্যবোধে তাঁর কবিতা উজ্জ্বল।
" সাতষট্টি বছরের পরে আর এখন বছর নেই,
তবু লোভ, শুধু লোভ ঐ কাঞ্চনফুলের গাছ
থোপা থোপা সাদা, বোধ হয় জন্মের ও আগে,
মনে আসতে গিয়ে আসতে চায় না –
অমনি ছিল আমার মা।
বলিস নি, কাঞ্চন গাছ ছাড়তে বলিস নি আমাকে।‘'
(ফুল গাছে যক ; ভুতেরা ও খুকি )
নিরলস কাব্য সাধনার মধ্য দিয়ে কবিতার শরীর গড়ে চলেছেন এই আধুনিক কবি শব্দচয়নের কল্পলোক নির্মাণে চিত্রকল্প উপমা প্রয়োগের স্বাতন্ত্র্য সর্বদা পরিলক্ষিত আধুনিক কবিতার কবি হলেও অপূর্ব কল্পনার জাল বিস্তার করেছেন পৃথিবীর সৌন্দর্য একাকী মুখমণ্ডল মাখামাখি উজ্জল আমলকি বাগানে পরিণয় আলতো সবুজ ঝিঝি পোকার ডাকে জ্যোৎস্নার আলোতে যেমন আকাশ দেখে পৃথিবী ছেড়ে কার্পেটে ভেসে অজ্ঞতার ঘুমিয়ে শরীরের চোখে ঘামে রক্তে প্রাণ জুড়াতে চান, ভরা চাঁদ ভাঙ্গা হাটে - যথার্থ আধুনিক কবি। তাঁর জন্মদিনে আমরা শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে সত্যিই আনন্দিত।
কবিতা পাঠ
নীল আরো কত
এখন আমাকে ডেকো না,
এখন আমাকে কিছু বলতে বোল না।
এবার সন্ধ্যা আমাকে ভর করবে,
এরপর আমাকে সন্ধ্যায় পাবে।
অপরাজিতা ফুল হালকা হ’তে হ’তে
কুমারীর নিঃসঙ্গতা,
তারপর উলুঘাসের বনে গোপনচারী সাপ,
নীল আরো কত যে!
কতরকম জীবন---
নীলবর্ণ ওঙ্কারের শব্দ সমস্ত প্রান্তর জুড়ে।
তোমার চোখের মণি যেন
স্বপ্নে, প্রেমে, কান্নায় মজে যাচ্ছে।
কথা দিয়ে যা গড়ে তুলেছি, তা মুছে যাক,
ছায়ার বর্ষণে ডুবন্ত দ্বীপের মতো নিশাকাল
আকাশ, সমুদ্র যেন বা আমার ভুরুর মধ্যিখানে ।।
.
মা থাকো
কলঘরে ভিজে মেঝে - বসে বসে চুল ছড়িয়ে কাঁদি -
তাও যদি ছিঁড়ে যায় আমার একটিমাত্র রক্তের বন্ধন !
মা, তুমি দাঁড়িপাল্লার যেদিকে রয়েছ, তার অন্য দিকে ব্রহ্মাণ্ড
সম্পূর্ণ ওজনশূন্য, ফাঁকা।
সমুদ্র-ঝিনুকে জন্ম, পড়ে আছি শুয়োরের পায়ের কাদায়।
জন্ম ও কর্মের হাত পাল্লা কষে -
নীল বাষ্পে সব রক্তকোষ ফেটে যায়
আমি যেন আকাশের বহুতলা উঠে গেছি
আলোয় যেন চির আকস্মিক।
রাক্ষস খোক্কস নেই এই দেশে,
রাক্ষসের ছেলে এসে বলবে না - দেখা আলজিভ।
পরি চাঁদ টি দিয়েছে, আহ্লাদ-কাজল দেবে মেঘ,
মা-গান শুনতে শুনতে তারাদের মধ্যিখানে তারা হয়ে কাঁপি।
মা থাকো মা থাকো মা থাকো
পরলোক কোনদিকে - সে জগতে
হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে একা অন্ধকারে হেঁটে
তোমাকে, যদি না খুঁজে পাই ।
লালটিপ সাদাটিপ
কচুর পাতায় আঁকা লালটিপ,সাদাটিপ
ব্যাঙের বাসাটি তার কাছে।
শালিখের বউ বলছে কিচমিচ —
এ সংসার থেকে মণ তুলে নাও,
পোকাটোকা পড়ে থাক, চল,
চল না দুজনে আমরা ওড়ি।
ছেলেবেলাকার সেই বাগানে কষ্টও ছিল,
ব্লেড দিয়ে নিজের আঙুল কেটে
কাঁঠাল পাতায় লাল দাগ।
কোন কিশোরের কাছে চির অঙ্গীকার,
ভয়মেশা কতদূর স্বপ্নরেখা, ধবধবে রোদ্দুর
সাদা ময়ূরের পাখা যেন ভুতগ্রস্থ,
আকাশে তখন অভিসার সূর্যের একাকী।
কচুর পাতায় আঁকা সাদা টিপ, লালটিপ,
ছেলেবেলা এখনো কি বাকি?
নিশানা চেয়েছি
আপনার, তোমার, তোর, আমার চারদিকে
পাকিয়ে উঠছে ধোয়া-
প্লাস্টিক জ্বালানো হচ্ছে নাকি পাতা পোড়াচ্ছে লোকেরা?
পাতা কই?
এখানে তো গাছ নেই, কেবল গাছের স্মৃতি।
তবে কি ভিতর থেকে আমাদের দীর্ঘশ্বাস
ব্যথিত, ধূসর আকাশের দিকে যাচ্ছে,
বাতাসকে মুখে মারছে আলগা থাপ্পড়।
কি হয়েছে, কেউ কি রয়েছে পাশে
ঘাসের সবুজ বউ, সমুদ্র দোলানো বৃষ্টিঝড়,
যে উড়িয়ে নেবে কালি, অশ্রু, পাপ, নির্যাতন?
বাড়ির গম্বুজে নীল কবুতর যেমন আকাশ দেখে,
বোঝে মাপ, জানে নির্মলতা কতটুকু আছে আজও।
মানুষের দিশেহারা শহুরে বিকেলে
তবে কে দেখাবে পথ।
পৃথিবী ও জীবনকে এখনও বলছি ডেকে,
এই ধোঁয়া, এই আবিলতা তোমার অন্তরে নেই,
তুমি যাকে চাও তাকে
পাবার নিশানা বলে দাও।
পদাবলি
কোথায় সূর্যাস্ত - দেবারতি মিত্র
দুঃখের বিনুনি খুলে বাঁধের জলের ধারে
বসে আছে সূর্যাস্ত,
তাকে দেখিনি আজ কতকাল৷
এখানে দক্ষিণ, পুব, উত্তর খোলা,
পশ্চিম দিকে শুধু বাড়ির পর বাড়ি৷
বিকেল কি সোনার কড়ায় উথলে ওঠা
এক রঙ, দু রঙ, সাত রঙের দুধ?
গোধূলি কি রাজপুতানি মেয়ের
বৃষ্টিতে ভেজা হাঁটু ছাড়ানো রঙচঙে ঘাঘরা?
তুমি আমার বন্ধুর বন্ধু,
তোমার ঘরে গেলে একমাত্র সূর্যাস্ত দেখা যায়
কিন্তু একটু দূর থেকে বুঝি
ওখানে ছায়া, ছায়ার পর ছায়াক্ট
আরো মন খারাপ হবে, ভয় হয়৷
তোমাকে জাগিয়ে দেব, তোমার ক্ষতি করে দেব
ভেবে ব্যথা পাই৷
দুঃখের বিনুনি খুলে বাঁধের জলের ধারে
সূর্যাস্ত যে আজ কত যুগ৷
আমি পুব দিকে প্রতিফলিত তাকে দেখে
দীর্ঘশ্বাস ফেলি, করুণ গান গাই৷
সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে কবি দেবারতি মিত্র জানিয়েছেন -
দেশ-কাল, প্রতিবেশ, পরিবেশ, বাদ দিয়ে জীবন কাটানো সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে। নির্জন দ্বীপে বসে কবিতা চর্চা করতে তিনি চান না। কবিতা নিয়ে আলোচনা করার চেয়ে কবিতা নিয়ে একা একা ভাবতেই তিনি বেশি ভালবাসেন বেশী। কবিতা নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি দাবী করেন যে তিনি দেখেছেন কবিতাকে "না পারছি ঠিকমতো বুঝতে, না পারছি বোঝাতে, কবিতার ভাব ও মর্ম কেমন ফিকে হয়ে যাচ্ছে"। তিনি অন্য কবির কবিতা প্রচুর পড়ে তা থেকে সবটুকু রস নিংড়ে নিতে চান। তাঁর ভাষায় "যেসব ধাত্রী অন্যের সন্তান প্রতিপালন করেন, নিজের ছেলেমেয়ের প্রতি কি তাদের মায়া ও টান একটু কমে যায়?"
কবিতার জন্ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন -
"আমাকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়মিত সংসারের কাজকর্ম করতে হয়, ব্যাঙ্ক পোস্ট অফিসে যেতে হয়, সামাজিক দায়িত্বও পালন করতে হয়, সেগুলো আমার খারাপও লাগে না। কিন্তু কী করে জানি না, তারই মধ্যে চলে একটা স্পন্দন কবিতার আবছা বিচ্ছুরণ, আড়মোড়া ভাঙা, নানারকম ছেড়াখোঁড়া হাসি ও বেদনা। আবার অনেকসময় বাজার করতে গিয়ে, ডাক্তার দেখাতে গিয়েও পেয়ে যাই কবিতার বীজ। কখনও কখনও তা থেকে গাছ জন্মায়, আর কখনও তা বৃষ্টিজলে, অশ্রুতে ধুয়ে যায়, কোনও চিহ্নই থাকে না। তবু বেশ লাগে। অনেকদিন কবিতা লিখতে না পারলে একটু হতাশ হয়ে পড়ি তো বটেই............ঘটনাচক্রে ছেলেবেলায় অনেক কবিতা এবং নানারকম বাংলা গান শুনেছি। তার কিছুদিন পরে কবিতা পড়তে পড়তে নিজেরও কবিতা লেখবার ইচ্ছে হল, বড়দের দেখে যেমন একদিন শাড়ি পরার সাধ হয়েছিল............কবিতা এবং সবরকম শিল্পই সম্ভব-অসম্ভব, বাস্তব-অবাস্তব, উচিত-অনুচিতের বাইরে হয়ে ওঠাই তার একমাত্র শর্ত। কবিতা যদি উতরে যায় তবেই তা সত্যে পৌঁছতে পারে। আমি সত্য বা মিথ্যে কোনওটাই লেখবার চেষ্টা করি না। শুধু এক অনর্গল চিরনতুন চিরপ্রাচীন প্রবাহকে কবিতায় ধরতে চাই.....নিজেকে মেয়ে-লেখক হিসেবে আমি নিজেকে আলাদা করে ভাবি না। আমি নারীত্বের পক্ষে, কিন্তু মেয়েলিপনার
বিপক্ষে ".
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
দৈনিক শব্দের মেঠোপথ
Doinik Sabder Methopath
Vol -340. Dt -12.04.2021
২৮ চৈত্র,১৪২৭. সোমবার
=================================
No comments:
Post a Comment