Monday, 31 May 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ও Walter Walt Whitman . ৩১.০৫.২০২১. Vol -389. The blogger in literature e-magazine

                     কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার


"চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে।
কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে
কভূ আশীবিষে দংশেনি যারে।

যতদিন ভবে, না হবে না হবে,
তোমার অবস্থা আমার সম।
ঈষৎ হাসিবে, শুনে না শুনিবে
বুঝে না বুঝিবে, যাতনা মম।"
(বুঝিবে সে কিসে)

১৮৩৪ সালে ৩১ মে, বাংলাদেশের খুলনা জেলার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটিতে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মাণিক্যচন্দ্র মজুমদার। পিতৃহীন হয়ে ঢাকায় অপরের আশ্রয়ে প্রতাপাদিত্যের হন এবং ফরাসি ভাষা শিক্ষা করেন। কৃষ্ণচন্দ্র ১৮৫৪ সালে বরিশালের কীর্তিপাশা বাংলা বিদ্যালয়ের প্রধান পন্ডিতপদে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি ঢাকার নর্মাল স্কুলে যোগদান করেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় চাকরি ছেড়ে তিনি মডেল স্কুলে (১৮৬০) যোগ দেন। এভাবে তিনি বিভিন্ন স্কুলে দীর্ঘ উনিশ বছর শিক্ষকতা করেন।সবশেষে যশোর জেলা স্কুলে প্রধান পণ্ডিতের কাজ করে অবসর নেন। শেষ জীবনে কৃষ্ণচন্দ্র সেনহাটিতে বসবাস করেন এবং বিভিন্ন সঙ্গীত রচনা করে অবসর জীবন কাটান।

তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘সদ্ভাবশতক’ প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালে।  পরিণত বয়সে তিনি ‘রামের ইতিবৃত্ত’ (১৮৬৮) নামে একটি আত্মচরিত রচনা করেন। মহাভারতের ‘বাসব-নহুষ-সংবাদ’ অবলম্বনে রচিত তাঁর অপর গ্রন্থ হলো ‘মোহভোগ’ (১৮৭১) কৈবল্যতত্ত্ব (১৮৮৩) তাঁর একটি দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ। মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় তাঁর নাটক ‘রাবণবধ’। এ ছাড়া তাঁর অপ্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পনেরো। তাঁর রচনা প্রসাদগুণসম্পন্ন এবং তাঁর কবিতার অনেক পঙতি প্রবাদ বাক্যস্বরূপ, 
যেমন: 
চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে’, 

‘যে জন দিবসে মনের হরষে’, ‘

কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন হে’ 
ইত্যাদি। 

এ পঙ্তিধারী কবিতাটি এক সময় স্কুলপাঠ্য বইয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

১৮৬০ সালে মাসিক মনোরঞ্জিকাকবিতাকুসুমাবলী নামক পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৮৬১ সালে ঢাকা প্রকাশ প্রকাশিত হলে তিনি তাাঁর সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর মালিকের সঙ্গে মতানৈক্য হলে তিনি পদত্যাগ করেন এবং ১৮৬৫ সালে বিজ্ঞাপনী নামক পত্রিকার সম্পাদক হন। দেড় বছর পর তিনি আবার ঢাকা প্রকাশ পত্রিকার সম্পাদক পদে প্রত্যাবর্তন করেন। অসুস্থতার কারণে সাংবাদিকতা ছেড়ে তিনি কিছুদিন শিক্ষকতা করেন।

১৮৮৬ সালে যশোর থেকে তিনি সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় দ্বৈভাষিকী নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। কবিতাকুসুমাবলী ছিল পদ্যবহুল মাসিক পত্রিকা। তাাঁর সদ্ভাবশতক কাব্যের অধিকাংশ কবিতাই এ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

উল্লেখযোগ্য কবিতা পাঠ

১.
দুখের তুলনা
একদা ছিল না ‘জুতো’ চরণ-যুগলে
দহিল হৃদয় মম সেই ক্ষোভানলে।
ধীরে ধীরে চুপি চুপি দুঃখাকুল মনে,
গেলাম ভজনালয়ে ভজন কারণে !
দেখি তথা এক জন, পদ নাহি তার,
অমনি ‘জুতো’র খেদ ঘুচিল আমার,
পরের অভাব মনে করিলে চিন্তন
নিজের অভাব ক্ষোভ রহে কতক্ষণ ?।

২.
অপব্যয়ের ফল

"যে জন দিবসে মনের হরষে
জ্বালায় মোমের বাতি,
আশু গৃহে তার দখিবে না আর
নিশীথে প্রদীপ ভাতি।"

৩.
যতদিন ভবে না হবে না হবে তোমার অবস্থা 
আমার সম । ঈষৎ হাসিবে শুনে না শুনিবে 
বুঝে না বুঝিবে , যত .....

৪.
 একদা ছিল না জুতো চরণ যুগলে দহিল হৃদয় 
মম সেই ক্ষোভানলে। ধীরে ধীরে চুপি 
চুপি দুঃখাকুল মনে, সে .....

সাহিত্যিক ও সাংবাদিক কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার সেনহাটি ইউনিয়নের সেনহাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর স্মৃতি বিজড়িত স্থান এবং ব্যবহার্য জিনিস পত্র নিয়ে তৈরি করা হয়েছে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ইনস্টিটিউট জাদুঘর।

-     ১৯০৭ সালের ১৩ জানুয়ারি তার মৃত্যু হয়।

============={==================


Walter Walt Whitman

Literary critic Harold Bloom wrote, as the introduction for the 150th anniversary of Leaves of Grass:

If you are American, then Walt Whitman is your imaginative father and mother, even if, like myself, you have never composed a line of verse. You can nominate a fair number of literary works as candidates for the secular Scripture of the United States. They might include Melville's Moby-Dick, Twain's Adventures of Huckleberry Finn, and Emerson's two series of Essays and The Conduct of Life. None of those, not even Emerson's, are as central as the first edition of Leaves of Grass.
(Literary critic Harold Bloom wrote, as the introduction for the 150th anniversary of Leaves of Grass:)

জন্ম নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ডে ওয়েস্ট হিলসে, ১৮১৯ সালে ৩১ মে .
তিনি ছিলেন বাড়ি নির্মাতা ওয়াল্টার হুইটম্যান এবং লুইসা ভ্যান ওয়েলসারের দ্বিতীয় পুত্র। 
1820 এবং 1830 এর দশকে, নয়টি শিশু নিয়ে গঠিত পরিবারটি লং আইল্যান্ড এবং ব্রুকলিনে বাস করত, যেখানে হুইটম্যান ব্রুকলিন পাবলিক স্কুলে পড়াশোনা করত।
বারো বছর বয়সে হুইটম্যান প্রিন্টারের বাণিজ্য শিখতে শুরু করে এবং লিখিত শব্দটির প্রেমে পড়ে যায়। তিনি বেশিরভাগ স্ব-শিক্ষিত, তিনি খুব জোর করে পড়াশুনা করতে ন এবং হোমার, দান্তে, শেক্সপিয়ার এবং বাইবেলের কাজের সাথে পরিচিত হন।

হিটম্যান নিউ ইয়র্ক সিটিতে প্রিন্টার হিসাবে কাজ করেছিলেন যতক্ষণ না মুদ্রণকারী যন্ত্রটি একটি ধ্বংসাত্মক আগুন শিল্পটি ধ্বংস করে দেয়। 
১৮৩৬ সালে, সতের বছর বয়সে, তিনি লং আইল্যান্ডের এক কক্ষের স্কুল ঘরগুলিতে শিক্ষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। 
তিনি পূর্ণকালীন পেশা হিসাবে সাংবাদিকতার দিকে মনোনিবেশ করার পরে ২৮৪১ অবধি তিনি শিক্ষকতা চালিয়ে যান।
       তিনি দ্য লং-আইল্যান্ডার নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং পরে ব্রুকলিন ডেইলি অগল সহ ব্রুকলিন এবং নিউ ইয়র্কের বেশ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। 
১৮৪৮ সালে হুইটম্যান তিন মাসের জন্য নিউ অরলিন্স ক্রিসেন্টের সম্পাদক হয়ে ব্রুকলিন ডেইলি অগল ত্যাগ করেন। 
নিউ অরলিন্সে দাসপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিলাম প্রত্যক্ষ করার পরে, তিনি ১৮৪৮ সালের  দিকে ব্রুকলিনে ফিরে আসেন এবং "মুক্ত মাটি" সংবাদপত্র ব্রুকলিন ফ্রিম্যানের সহ-প্রতিষ্ঠা করেন।

জাতি সম্পর্কে হুইটম্যানের দৃষ্টিভঙ্গিকে "অস্থির এবং বেমানান" হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। 
তিনি সর্বদা বিলোপকারীদের পক্ষে ছিলেন না, তবুও তিনি মানব মর্যাদাকে উদযাপন করেছিলেন।

ব্রুকলিনে, তিনি কবিতার অনন্য স্টাইলে বিকাশ অব্যাহত রেখেছিলেন যা পরবর্তীতে রাল্ফ ওয়াল্ডো এমারসনকে অবাক করে দিয়েছিল। 
১৮৫৫ সালে, হুইটম্যান গ্রাসের পাতাগুলির প্রথম সংস্করণে একটি কপিরাইট বের করেছিলেন, এতে বারো শিরোনামহীন কবিতা এবং একটি উপস্থাপনা ছিল। 
তিনি নিজেই খণ্ডটি প্রকাশ করেছিলেন এবং ১৮৫৫ সালের জুলাই মাসে এমারসনের কাছে একটি অনুলিপি প্রেরণ করেছিলেন। হুইটম্যান ১৮৫৬ সালে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন, যার মধ্যে বাইশটি কবিতা ছিল. প্রথম সংস্করণের প্রশংসা করছিল এমারসন একটি চিঠিতে এবং হুইটম্যানের একটি দীর্ঘ উন্মুক্ত চিঠির  উত্তরে. তাঁর জীবদ্দশায় হুইটম্যান বইটির আরও বেশ কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশ করে ভলিউমটিকে পরিমার্জন করতে থাকেন। 
বিশিষ্ট হুইটম্যান পন্ডিত, এম জিমি কিলিংসওয়ার্থ লিখেছেন যে "হুইটম্যান যেমন কল্পনা করেছিলেন, তেমনি" মার্জ "হ'ল নৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক সীমানা কাটিয়ে উঠার জন্য ব্যক্তিগত স্বভাবের প্রবণতা।" 
থিম্যাটিক এবং কাব্যিকভাবে, ধারণাটি ১৮৫৫ সালের তিনটি প্রধান কবিতার আধিপত্য বিস্তার করেছে:
 'আমি দেহ তড়িৎ গাইছি,' 
'স্লিপার্স', এবং 
'মাইসেল্ফ অফ মাইসেলফ', 
যেগুলি সমস্তই একক শিরোনামের অধীনে প্রথম সংস্করণে 'একীভূত' হয়েছিল 
গ্রাসের তবে পাঠ্যের স্পষ্ট বিরতি এবং শিরোনামটির পুনরাবৃত্তি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল। "

গৃহযুদ্ধের সূত্রপাতের সময়ে, হুইটম্যান একটি "শুদ্ধ" এবং "শুদ্ধ" জীবন যাপনের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। 
তিনি একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসাবে কাজ করেছিলেন এবং নিউইয়র্ক সিটি-এরিয়া হাসপাতালে আহতদের দেখা করেছিলেন। 
এরপরে তিনি যুদ্ধে আহত হয়ে থাকা তাঁর ভাইয়ের দেখাশোনা করার জন্য ১৮৬২ সালের ডিসেম্বর মাসে ওয়াশিংটন, ডি সি ভ্রমণ করেছিলেন।


ওয়াশিংটনে বহু আহত মানুষের দুর্ভোগ কাটিয়ে হুইটম্যান হাসপাতালে থাকার এবং কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন; 
তিনি এগারো বছর শহরেই শেষ করেন। 
তিনি অভ্যন্তরীণ বিভাগের মধ্যে ভারতীয় বিষয়ক ব্যুরোতে একজন কেরানী হিসাবে চাকরি নিয়েছিলেন, যা শেষ হয়েছিল যখন স্বরাষ্ট্রসচিব, জেমস হারলান, হুইটম্যান গ্রাসের পাতা, যা হারলানকে আপত্তিজনক বলে লেখক বলে আবিষ্কার করেছিলেন। 
হারলান তাকে বরখাস্ত করার পরে তিনি অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে কাজ করতে যান।

Works :

Franklin Evans (1842)
The Half-Breed; A Tale of the Western Frontier (1846)
Life and Adventures of Jack Engle (serialized in 1852)[39]
Leaves of Grass (1855, the first of seven editions through 1891)
Manly Health and Training (1858)[41]
Drum-Taps (1865)
Democratic Vistas (1871)
Memoranda During the War (1876)
Specimen Days (1882)

১৮৭৩ সালে হুইটম্যান একটি স্ট্রোকের শিকার হন যা তাকে আংশিকভাবে পঙ্গু করে দেয়। 
কয়েক মাস পরে তিনি তার মরতে থাকা মাকে তার ভাইয়ের বাড়িতে দেখার জন্য নিউ জার্সির ক্যামডেন ভ্রমণ করেছিলেন। 
১৮২৮ সালের লেভস অফ গ্রাস প্রকাশের আগে পর্যন্ত তিনি তাঁর ভাইয়ের সাথেই শেষ করেছিলেন, যা তাকে কেমডেনে বাড়ি কেনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ এনেছিল।


সহজ দ্বিতল ক্ল্যাপবোর্ডের ঘরে হুইটম্যান তার পতনশীল বছরগুলি গ্রাসের পাতা (ডেভিড ম্যাককে, 1891-92) এর মৃত্যুবরণী সংস্করণে সংযোজন এবং সংশোধনগুলিতে ব্যয় করেছিলেন এবং তাঁর কবিতা ও গদ্যের চূড়ান্ত খণ্ডটি প্রস্তুত করেছিলেন, গুডবাই মাই ফ্যান্সি 
(ডেভিড ম্যাকে, 1891)। 
২৯ শে মার্চ, ১৮৯২-এ তাঁর মৃত্যুর পরে হুইটম্যানকে  নকশাকৃত একটি সমাধিতে সমাধিস্থ করা হয়েছিল .
এমিলি ডিকিনসনের পাশাপাশি তিনি আমেরিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসাবে বিবেচিত হন।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

Saturday, 29 May 2021

চিঠিপত্র বিভাগ। নজরুলের প্রথম ও শেষলেখা চিঠি , প্রথম প্রেম নার্গিস(সৈয়দা)কে । ৩০.০৫.২০২১. Vol -388. The blogger in literature e-magazine.

         

 "বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে, ঝরা বন গোলাপের বিলাপ।"
               বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের এই গানে নার্গিস নামে এক নারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এই নার্গিস হলো নজরুল ইসলামের প্রথম প্রেম।  যার আসল নাম হলো সৈয়দা খাতুন। একদিকে তিনি যেমন বিদ্রোহের আগুনে জ্বলে দগদগে কবিতা লিখতেন তেমনই অন্যদিকে রোমান্টিক আবেগে মিশে যেতেন প্রেমের সঙ্গে ৷ 
  " আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী তন্বী-নয়নে বহ্নি আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম আমি ধন্যি।"


এই জীবনে দুটি নারীর আগমন । প্রথম নারী নার্গিস আর দ্বিতীয় নারী প্রমীলা। নজরুলের প্রথম ভালোবাসার পাত্রী ছিলেন নার্গিস। তাঁর জীবনের প্রথম প্রিয়তমা। কবিকে বলতে শুনি -
"আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি ছল ক'রে দেখা অনুখন 
 আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা তা'র কাঁকন-চুড়ির কন-কন্।"

          সৈয়দার মামা আলী আকবর খান নজরুলের সাথে কলকাতায় পাশাপাশি থাকতেন। তিনি নজরুলকে তাঁর বাড়ি কুমিল্লায় নিয়ে যান ১৯২১ সালে। নজরুল তখন সবে কৈশোর পার করে তরুণ হয়েছে। কুমিল্লাতে থাকাকালীন কবির সাথে পরিচয় হয় সৈয়দার।  কদিনের পরিচয়েই নজরুল সৈয়দার প্রেমে পড়ে যান। ভালোবেসে তিনি সৈয়দাকে নার্গিস বলে ডাকতেন। তাঁর তারুণ্য বন্ধনহারা ষোড়শী কুমারীর প্রেমে উদ্দাম, চঞ্চল মেয়ের ভালোবাসায় প্রস্ফুটিত বর্ষার কদম ফুল। 

           ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ৩রা আষাঢ়, শুক্রবার কবির সাথে নার্গিসের বিয়ের দিন ধার্য হয়। বিয়েতে কাবিননামা সম্পাদনার সময় কবিকে ঘর জামাই হয়ে থাকতে হবে বলে শর্ত দেওয়া হয়।আলী আকবরের এমন শর্তে তিনি ক্ষিপ্ত হন। ঐদিন রাতের বাসরঘরে কুমিল্লা ত্যাগ করেন ,   প্রথম প্রেম ও পত্নী নার্গিসকে একা ফেলে। আলী আকবর খান আর্থিক প্রলোভন দেখিয়ে ফেরানোর চেষ্টা করেন। তাতে তিনি আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। দীর্ঘ পনেরো বছর নার্গিসের সাথে নজরুল কোনোরকম যোগাযোগ রাখেননি। নার্গিস কিন্তু মাঝেমধ্যে নজরুলকে চিঠি পাঠাতো। তাঁর সেই চিঠিগুলোর উত্তর দিলেন পনেরো বছর পর। তিনি নার্গিসকে ঠিক কতটা ভালোবাসতেন -
"সুন্দর যদি করে গো তোমারে আমার আঁখির জল
হারা মোমতাজে লয়ে কারো প্রেম রচে যদি তাজম'ল ".
অথবা 
   " আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ "

সেই এক আবেগঘন চিঠি --


       "  কল্যাণীয়াসু,

তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নব বর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে। মেঘ মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল। পনের বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি এক বারিধারায় প্লাবন নেমেছিল, তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পারো। আষাঢ়ের নব মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার। এই মেঘদূত বিরহী যক্ষের বাণী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে, তার প্রিয়ার কাছে। এই মেঘপুঞ্জের আশীর্বাণী আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চার।

এই আষাঢ় আমায় কল্পনার স্বর্গলোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে। যাক, তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দিই। তুমি বিশ্বাস করো, আমি যা লিখছি তা সত্য।লোকের মুখে শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা করে থাকো,তাহলে আমায় ভুল বুঝবে- আর তা মিথ্যা। তোমার উপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করিনা – এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি, তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না। আমি ধুমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যাণ রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের সে আগুন- বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি।

তুমি ভুলে যেওনা আমি কবি, আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। অসুন্দর কুৎসিতের সাধনা আমার নয়। আমার আঘাত বর্বরের কাপুরুষের আঘাতের মতো নিষ্ঠুর নয়। আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কি জান বা শুনেছ জানিনা) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবীও নেই। তোমার আজিকার রূপ কি জানিনা। আমি জানি তোমার সেই কিশোরি মুর্তিকে, যাকে দেবীমূর্তির মতো আমার হৃদয় বেদীতে অনন্ত প্রেম, অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলেনা।পাষাণ দেবীর মতই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদিপাঠ… জীবন ভ’রে সেখানেই চলেছে আমার পূজা আরতি।আজকার তুমি আমার কাছে মিথ্যা, ব্যর্থ; তাই তাকে পেতে চাইনে। জানিনে হয়ত সে রূপ দেখে বঞ্চিত হব, অধিকতর বেদনা পাব, তাই তাকে অস্বীকার করেই চলেছি।দেখা? না-ই হ’ল এ ধূলির ধরায়। প্রেমের ফুল এ ধূলিতলে হয়ে যায় ম্লান, দগদ্ধ, হতশ্রী। তুমি যদি সত্যিই আমায় ভালবাস আমাকে চাও ওখান থেকেই আমাকে পাবে। লাইলি মজনুকে পায়নি, শিরি ফরহাদকে পায়নি, তবু তাদের মত করে কেউ কারো প্রিয়তমাকে পায়নি।আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরাতন কথা হলেও প্রেম সত্য। আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারেনা। প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাকো, তাহলে তোমার মতো ভাগ্যবতী আর কে আছে ? তারি মায়া স্পর্শে তোমার সকল কিছু আলোয় আলোময় হয়ে উঠবে। দুঃখ নিয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে গেলেই সেই দুঃখের অবসান হয়না। মানুষ ইচ্ছা করলে সাধনা দিয়ে, তপস্যা দিয়ে ভুলকে ফুল রূপে ফুটিয়ে তুলতে পারে। যদি কোনো ভুল করে থাক জীবনে, এই জীবনেই তাকে সংশোধন করে যেতে হবে; তবেই পাবে আনন্দ মুক্তি; তবেই হবে সর্ব দুঃখের অবসান । নিজেকে উন্নত করতে চেষ্টা করো, স্বয়ংবিধাতা তোমার সহায় হবেন। আমি সংসার করছি, তবু চলে গেছি এই সংসারের বাধাকে অতিক্রম করে উর্ধ্ব লোকে। সেখানে গেলে পৃথিবীর সকল অপূর্ণতা, সকল অপরাধ ক্ষমা সুন্দর চোখে পরম মনোহর মূর্তিতে দেখা যায়।…

হঠাৎ মনে পড়ে গেল পনেরো বছর আগের কথা। তোমার জ্বর হয়েছিল, বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তোমার তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজো অনুভব করতে পারি। তুমি কি চিয়ে দেখেছিলে? আমার চোখে ছিলো জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রীবিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুন মিনতি। মনে হয় যেন কালকের কথা। মহাকাল যে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারলেননা। কী উদগ্র অতৃপ্তি, কী দুর্দমনীয় প্রেমের জোয়ারই সেদিন এসেছিল। সারা দিন রাত আমার চোখে ঘুম ছিল না । যাক আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষে রশ্মি ধরে ভাটার স্রোতে, তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করোনা। তোমাকে লিখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক। যেখানেই থাকি বিশ্বাস করো আমার অক্ষয় আশির্বাদ কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে । তুমি সুখি হও, শান্তি পাও, এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস করো, আমি তত মন্দ নই, এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ।

                                ইতি
                           নিত্য শুভার্থী
                           নজরুল ইসলাম ""

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆


জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য ও আলোচনা । রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। ২৯.০৫.২০২১. Vol -387. The blogger in literature e-magazine.



রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়


১৮৬৫ সালে ২৯ মে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার পাঠকপাড়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম শ্রীনাথ চট্টোপাধ্যায় ও মাতার নাম হরসুন্দরী দেবী। তিনি বাঁকুড়া জেলা স্কুল থেকে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স,সেন্ট জেভিয়ার'স কলেজ, কলকাতা থেকে এফ.এ.এবং সিটি কলেজ থেকে ইংরাজীতে অনার্স সহ বি.এ পাশ করেন। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ.পাশ করেন। প্রতি পরীক্ষাতেই বিশেষ কৃতিত্ব দেখান ও বৃত্তিলাভ করেন। তিনি ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের সভাপতি হয়েছিলেন।
তিনি ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদ কায়স্থ পাঠশালায় যোগ দেন। শেষে বিশ্বভারতীর অধ্যাপক ও পরে অধ্যক্ষ হন। নিজে সাহিত্যস্রষ্টা ছিলেন না,কিন্তু সাহিত্যসৃষ্টির পরম সহায়ক ছিলেন। এম.এ পরীক্ষার পরই তিনি ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে 'ধর্মবন্ধু' পত্রিকার সম্পাদনা করেন।১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে মাসিক পত্রিকা 'দাসী' প্রকাশিত হলে তিনি সম্পাদক নিযুক্ত হন। ওই সময়েই নিজস্ব বাংলা ব্রেইল প্রথার উদ্ভাবন করেন। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর সাহায্যে শিশুদের উপযোগী পত্রিকা মুকুল প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হন। শিবনাথ শাস্ত্রী ওই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে মাসিক 'প্রদীপ' পত্রিকার সম্পাদক হন। এলাহাবাদে বর্তমানে প্রয়াগরাজে কর্মরত থাকার সময় ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে (১৩০৮ বৈশাখ,বঙ্গাব্দে) বিখ্যাত ও আধুনিক কালের সর্বাঙ্গসুন্দর মাসিক 'প্রবাসী' পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন। দেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের রচনাসম্ভারে সমৃদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হত। চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের সুন্দর প্রতিলিপিতে বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়।





১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রকাশ করেন ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইংরাজী সাময়িক পত্রিকা "দ্য মডার্ন রিভিউ"। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দি মাসিক "বিশাল ভারত" প্রকাশ ও সম্পাদনা তাঁর আরো একটি স্মরণীয় কীর্তি। জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে প্রণোদিত তিনি দেশের বহু বিখ্যাত ব্যক্তির সংগ্রাম ও সাধনার পোষকতা করে গেছেন তাঁর পত্রিকার মাধ্যমে। সাংবাদিক হিসাবে নির্ভীক,নিরপেক্ষ এবং দৃঢ়চেতা ছিলেন। সাংবাদিকতার এই গুণের জন্য সরকারের কাছে তাঁকে বহুবার জরিমানা দিতে হয়েছে। সমসাময়িক রাজনৈতিক নেতাগণ এবং রবীন্দ্রনাথ, আচার্য যদুনাথ সরকার প্রমুখ প্রায়ই নিজেদের করণীয় বিষয়ে পরামর্শ নিতেন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ও ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের মূল সভাপতি, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো এবং সেকেন্ডারি এডুকেশন রিফর্ম কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি।
           তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন। ভারতবাসীর ঐক্য, অর্থনৈতিক জীবনের উন্নতি,স্বদেশী শিল্পকলা ও সাহিত্যের উন্নতি ছিল তাঁর জীবনাব্যাপী সাধনা। বাংলা ভাষায় অর্থনীতি আলোচনার সূত্রপাত তিনিই প্রথম করেন। প্রতি ইংরাজী বা বাংলা মাসের ১লা তারিখ পত্রপত্রিকা প্রকাশের পদ্বতি এবং ভারতীয় পদ্ধতি অনুসারে অঙ্কিত চিত্রকলার প্রকাশ তিনিই প্রথম প্রচলন করেন। তাঁর রচিত পুস্তক "Towards Home Rule"
সন্তান সন্ততি :
 সীতা দেবী, কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়, শান্তা চট্টোপাধ্যায়, অশোক চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজিনাল্ড ডায়ারের কীর্তি নিয়ে রামানন্দ তাঁর ‘দ্য মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি করেন। এটি কবির চোখ এড়ায়নি। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বয়সে চার বছরের বড় ছিলেন। যদিও তার ছাপ তাঁদের বন্ধুত্বে কখনও পড়েনি। রামানন্দ যেমন রবীন্দ্রনাথের সখ্যতাকে তাঁর জীবনের ‘শ্রেষ্ঠ সৌভাগ্য’ বলে উল্লেখ করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের কাছেও রামানন্দ ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু। আদতে কবির রাজনৈতিক পরামর্শদাতার কাজ করতেন রমানন্দ চট্টোপাধ্যায়।



মৃত্যু: ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৩ (বয়স ৭৮); কলকাতা ।


আলোচনা :

প্রবাসী পত্রিকা ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়

প্রবাসী বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে ব্রিটিশ ভারতবর্ষে প্রবর্তিত একটি সাহিত্য সাময়িকী। এই মাসিক পত্রিকাটি বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হতো। এটির সম্পাদক ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এবং কার্য্যাধ্যক্ষ ছিলে আশুতোষ চক্রবর্তী। ১৩০৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে (এপ্রিল ১৯০১) এর সূচনা সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। এ সংখ্যাটি এলাহাবাদের ইন্ডিয়ান প্রেস থেকে মুদ্রিত হয়েছিল। বার্ষিক মূল্য আড়াই টাকা। ছবি, অলংকরণ প্রভৃতিতে পত্রিকাটি ছিল আকর্ষণীয়। অচিরেই পত্রিকাটি জনপ্রিয়তা অর্জ্জন করে।

প্রথম সংখ্যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ৪০। প্রথম সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ যাদের লেখা ছাপা হয়েছিল তারা হলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, কমলাকান্ত শর্ম্মা, দেবেন্দ্রনাথ সেন, নিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায়, এবং যোগেশচন্দ্র রায়। এতে অজন্তা গুহার ফটো, জীববিজ্ঞানের ওপর নিবন্ধ এবং বিবিধ প্রসঙ্গ মুদ্রিত হয়েছিল। রচনার শেষে লেখকের নাম মুদ্রিত হয়েছিল।

১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু করে প্রবাসী প্রায় ৫০ বৎসর প্রকাশিত হয়েছিল। এর বেশীরভাগ সময় সম্পাদক ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। তিনি নারী-পুরুষের সমানাধিকারে বিশ্বাস করতেন এবং নারী-প্রগতি বিষয়ক লেখা ছাপতেন। অধিকন্তু তিনি নারীদের লেখায় উৎসাহিত করতেন] তার মৃত্যুর পর প্রবাসী টিঁকিয়ে রাখা সম্ভব হয় নি

প্রবাসী পত্রিকা বাংলার লোকসঙ্গীত সংগ্রহে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুপ্রাণনায় ১৩২২ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যা থেকে এতে 'হারামণি' বিভাগ প্রবর্তিত হয়েছিল এতে সারা বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত লোকসঙ্গীত সংকলিত হতো। হারামণি'র প্রথম ভাগে গগন হরকরার আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে এই গানটি মুদ্রিত হয়েছিল।


==================================
'

দাসী পত্রিকা ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়

শম্পা ভট্টাচার্য

সুলেখক ও সমালোচক, জাতীয়তাবাদী নেতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামী, শিক্ষানুরাগী ও প্রকৃতিপ্রেমী রবীন্দ্রনাথের সুহৃদ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদক এবং সাংবাদিক হিসেবে সমগ্র ভারতবর্ষে প্রথম পরিচিতি। এই কৃতী সম্পাদক ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের কৃতী ছাত্র, অধ্যাপনা ও অধ্যক্ষতায় দক্ষ, সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হয়েও ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত, এবং একনিষ্ঠ সমাজ সংস্কারক। 'প্রদীপ' পত্রিকা সম্পাদনাকালে রামানন্দ লিখেছিলেন — 'আমি সম্পাদকের কার্য্যকে শিক্ষক বা অধ্যাপকের কার্য্য অপেক্ষা কম পবিত্র ও দায়িত্ববান মনে করি না।' (প্রদীপ, পৌষ, ১৩০৭ সাল) ফরাসী বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার আদর্শে বিশ্বাসী রামানন্দ মানুষে মানুষে উঁচু নীচু ভেদ যেমন মানতেন না, তেমনি নির্যাতন, নিপীড়ন শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছিলেন মনে প্রাণে। পৈতে ত্যাগ করেছেন। আসামের চা-বাগানের কুলিদের নিদারুণ সমস্যা নিয়ে রামকুমার বিদ্যারত্ন বা দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো রামানন্দও বিচলিত ছিলেন। এই জনসেবা ও লোকহিতের উদ্দেশ্য থেকে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ১৮৯২ সালের জুলাই মাসে 'দাসী' পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বভার নেন। এটি ছিল রামানন্দ সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা।

'দাসী' ছিল দাসাশ্রম এর মুখপত্র। দাসাশ্রম ছিল গরীব মানুষের আশ্রয়, খাওয়া থাকার জায়গা। ১৬৭/২/৩ নম্বর কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটের বাড়িটি দাসাশ্রম। দাসাশ্রম স্থাপন করেছিলেন ১৮৯১ সালে বসিরহাট মহকুমায় জালালপুর গ্রামের মৃগাঙ্কধর চৌধুরী ও ক্ষীরোদচন্দ্র দাস। পরে এটি কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। ১৮৯২ সালের জুলাই মাস থেকে কলকাতায় 'দাসী' পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে।

দাসাশ্রমের সেবিকারা নিজেদের দাস ও দাসী বলে পরিচয় দিতেন। সমাজের শোষিতা নারীদের বিপদমুক্ত করার প্রচেষ্টা, অনাথ ও দরিদ্রদের সেবা, রাস্তায় মরণাপন্ন মানুষের সেবা ছিল দাসাশ্রমের মূল উদ্দেশ্য। যে কাজ গান্ধীজী, মাদার টেরেসা শুরু করেছিলেন, সে কাজের পথিকৃৎ ব্রাহ্মসমাজ এবং দাসাশ্রম। সদস্যরা প্রত্যেকে মনে করতেন তারা দাস অর্থাৎ মানুষের সেবক আর তাদের মুখপত্র হল 'দাসী' পত্রিকা। মহিলাদের সেবামূলক কাজে নিয়োজিত করা দাসাশ্রমের একটা বড় লক্ষ্য ছিল। 'দাসী'-তে বারবার সেজন্য নারীদের আহ্বান করা হয়েছে। তাই জন্য হয়তো পত্রিকার নাম 'দাসী'। মানুষের সেবা করার যখনই সুযোগ পেয়েছেন রামানন্দ তখনই সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন। জনহিতকর কাজে সবসময়ই তিনি প্রবল উৎসাহী ছিলেন। একটা কোনো আশ্রম কিংবা কুলি সংরক্ষণী সভা খোলার ইচ্ছে তাঁর বরাবর ছিল। অর্থাভাবে বালিকা পত্নীকে কলকাতায় আনা সম্ভব ছিল না, তখন ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন — 'মনে হল সেবাব্রতের ক্লান্তি ও কষ্ট সহিতে সমর্থ করিবার জন্য পিতা দাম্পত্য সুখ দিয়াছেন। একত্রে থাকার সুখ কল্পনা করিলাম। অমনি একটি অনাথ নিবাস কিম্বা দরিদ্র ছাত্রাবাস খুলিবার ইচ্ছা জন্মিল।' তাহলে 'দাসী' বা দাসাশ্রমের অন্তরালে রামানন্দ গৃহিণীর যে অবদান ছিল একথা অস্বীকার করা যায় না। কলকাতায় দাসাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হলে মৃগাঙ্কধর রায়চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী কমলা দেবী, ক্ষীরোদচন্দ্র দাস ও তাঁর স্ত্রী প্রভাবতী দেবী, এবং শরৎচন্দ্র রায় জামালপুর থেকে কলকাতায় এসে বাড়ি ভাড়া নেন। এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠিত হলে তার সভাপতি হন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। খোলা হল দাসাশ্রম মেডিকেল হল, চিকিৎসায় সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন নীলরতন সরকার ও প্রাণকৃষ্ণ আচার্য। এর সঙ্গে যুক্ত হল শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'সেবালয়' সংস্থা। সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক দাসাশ্রম চলত স্বেচ্ছামূলক দানের উপর ভিত্তি করে। দাসাশ্রমকে সাহায্য করতেন ডঃ মহেন্দ্রলাল সরকার, রেভারেন্ড কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মৌলভি সিরাজুল খাঁ, আনন্দমোহন বসু, মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন প্রমুখ নানা ধরনের মানুষ। দাসীর প্রথম দুটি বার্ষিক সূচিপত্রে কোনো লেখকের নামোল্লেখ নেই। তাছাড়া প্রথম দিকে সম্পাদকের নামও ছাপা হত না। অথচ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় শুধু পত্রিকা সম্পাদনা করতেন না। নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতেন এখানে। জন হিতৈষণার প্রবর্তন, দাসাশ্রমের মাসিক কার্যবিবরণ প্রচার ও দাসাশ্রমের আর্থিক সাহায্য করার জন্য পত্রিকাটি প্রকাশিত হতে থাকে। কিন্তু কেবল সেবাধর্ম-মূলক প্রবন্ধ লিখে পত্রিকার গ্রাহক সংখ্যা বাড়ানো কঠিন। তাই 'দাসী' পত্রিকা প্রকাশের দেড় বৎসর পরে উপন্যাস, কবিতা, বিজ্ঞান কথা, পুরাতাত্ত্বিক প্রবন্ধ, গ্রন্থ সমালোচনা সবই প্রকাশ করতে থাকে। এই সময় থেকে এ পত্রিকায় রাজনারায়ণ বসু, যোগীন্দ্রনাথ বসু, সখারাম গণেশ দেউস্কর, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, অবিনাশচন্দ্র দাস — এইসব প্রখ্যাত লেখকদের রচনা প্রকাশিত হতে থাকে।

মানুষকে সেবার কাজে প্রাণিত করার জন্য কুমারী ডীন, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, ভগিনী ডোরা, গ্রেস ডার্লিং এইসব পরহিতসাধিনী য়ুরোপীয়ান মহিলাদের জীবনী যেমন 'দাসী'তে প্রকাশিত হত, তেমনই দাসী-সম্পাদক অন্ধ, মূক ও বধিরদের কষ্ট লাঘব করার ব্যাপারে তাদের পক্ষে হিতকর হতে পারে এমন নানা প্রবন্ধ লিখতেন। রামানন্দ কন্যা শান্তা দেবীর মতে — 'তিনিই (রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়) যে বাংলাদেশে অন্ধদের জন্য বাংলার ব্রেইল অক্ষর উদ্ভাবন করেন একথা পঞ্চাশ বৎসর লোকে ভুলিয়াছিল এখন ডঃ সুবোধচন্দ্র রায় নামক অন্ধ-হিতৈষী পুরুষের চেষ্টায় সে তথ্য পুনরাবিষ্কৃত হইয়াছে।' (প্রবাসী, দাসী, শ্রী শান্তা দেবী, ১৩৫১, ভাদ্র) কেবলমাত্র খ্রীষ্টীয় রীতি অনুযায়ী জনহিতকর কাজ নয়, দেশীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী জলসত্র স্থাপন, পুষ্করিণী প্রতিষ্ঠা, ছায়াবৃক্ষ রোপণ এসব কাজের স্বপক্ষেও দাসীতে নানা প্রবন্ধ আছে। 'দাসী' পত্রিকা যার মুখপত্র, সেই দাসাশ্রমের সেবকেরা পথে ঘাটে বিপর্যস্ত অসুস্থ মানুষদের নিয়ে আসতেন এই সেবাশ্রমে। অস্থায়ী রোগীদের দুএকদিন পরে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হত। স্থায়ী রোগীদের আশ্রমে রাখা হত। 'দাসী'তে প্রত্যেক সংখ্যার শেষে প্রকাশিত হত রোগীর পূর্ণ বিবরণ। দেখাশুনার যাতে ত্রুটি না হয় তাই রামানন্দ নিজেই দাসাশ্রমের সঙ্গে একই বাড়ির অন্য অংশে থেকেছেন। কলকাতায় তখন Little Sisters of the Poor ছাড়া আর কোনও destitute home ছিল না। কিন্তু হিন্দু দুঃস্থ বা রোগীরা সেখানে থাকতে চাইত না; তাছাড়া ৬০ বছরের কম বয়স্ক মানুষেরা সেখানে থাকতে পারতেন না। কিন্তু দাসাশ্রম ছিল যে-কোনো বয়সের দুঃস্থ ও রুগ্ন নারী পুরুষের আশ্রয় গৃহ। কমিটিতে প্রাচীনপন্থী নিষ্ঠাবান হিন্দু থাকলেও সেবক-সেবিকারা ছিলেন ব্রাহ্ম। সাধারণত সে-সময়ে বর্ণ হিন্দুরা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে অনাথ আতুরদের নোংরা পরিষ্কার করতে সর্বদা আগ্রহী ছিলেন না। দাসাশ্রমের কাজ শুধু কলকাতাতেই সীমায়িত ছিল না--এদের উদ্যোগে জালালপুর, বাঁকুড়ার সূর্পানগর, নলধা, কোঁড়ামারা, চেরাপুঞ্জী এসব জায়গায় সাতটা দাতব্য চিকিৎসালয় তৈরি হয়েছিল।

'দাসী' পত্রিকার পাতা ওল্টালে আরও নানা খবর চোখে পড়ে। ১৩০০ বঙ্গাব্দে ১৭ নং রঘুনাথ চাটুজ্যে স্ট্রীট মণিকা যন্ত্রে হরিশচন্দ্র পাল দ্বারা প্রকাশিত হওয়ার বিজ্ঞাপন যেমন আছে, তেমনই 'বর্ষ শেষ' শিরোনামে বিজ্ঞাপন — 'আগামী বৎসর হইতে 'দাসী' নূতন আকারে প্রকাশিত হইবে। লেখার উৎকর্ষ সাধনের জন্যও যথাসাধ্য চেষ্টা করা যাইবে। আগামী আষাঢ় মাস হইতে 'দাসী'র দ্বিতীয় বর্ষ আরম্ভ হইবে। দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম হইতেই দাসী প্রতি মাসে ৪০০০ করিয়া মুদ্রিত হইবে।'

তৎকালীন বঙ্গদেশের নারীদের শোচনীয় দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার কথা 'দাসী' পত্রিকা ও দাসাশ্রম বারবার অনুধাবন করেছে। কলকাতায় দাসাশ্রম প্রথম দিকে পতিতা রমণীদের কন্যাদের উদ্ধারের ভার গ্রহণ করে এইরকম কয়েকটি মেয়েকে সেখানে রেখে নানা শিক্ষা দেওয়া এবং রোগীদের জন্য সেবাধর্মে উপযোগী করে গড়ে তোলার কথা ভাবে। কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন। আইনের মারপ্যাঁচে এসব মেয়েদের উদ্ধার করা সহজ কাজ ছিল না। কাজেই উদ্ধার কমিটি উঠে গেল। কিন্তু সম্পাদক রামানন্দ চাটুজ্জে দাসীতে নিয়মিত 'পতিতা রমণীর দুর্দশা মোচন' 'স্ত্রী জাতির দুঃখ বিমোচন' এমনকি 'পতিত পুরুষদের উদ্ধার' বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ভাদ্র, ১২৯৯ সংখ্যায় 'দাসী' পত্রিকায় 'পতিত পুরুষগণের উদ্ধার' প্রবন্ধটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। লেখক সম্পাদকের মতে — 'সকল দেশেই দেখা যায় যে ব্যভিচার দোষে দোষী পুরুষগণের সামাজিক দণ্ড অতি লঘু, কিন্তু ব্যভিচারিণী রমণীর দণ্ড অতি কঠোর। পুরুষ রমণী উভয়েই সমাজ অপরাধী হইলেও রমণী কলঙ্কিতা নামে অভিহিতা এবং সমাজ কর্তৃক পরিত্যক্তা হন। তাহাতে ফল এই দাঁড়ায়, যে নারীর একবার অধঃপতন হইয়াছে, তিনি ক্রমেই গভীরতর পাপপঙ্কে নিমগ্ন হইতে থাকেন। অপরদিকে পুরুষ শত অপরাধে অপরাধী হইয়াও ভদ্রলোকের বেশে সমাজে সর্বত্র অবাধে গতিবিধি করিয়া থাকেন এবং সেই সুযোগে, আরও কত রমণীর সর্বনাশ করেন।' 'ইন্দ্রিয়পরায়ণ পুরুষেরা হিংস্র পশুর ন্যায় নৃশংস' প্রবন্ধে লেখক ইন্দ্রিয়দাস পুরুষের হিতসাধনের জন্য সঙ্ঘ তৈরি করার কথা বলেছেন। ১ম বর্ষ ৩য় সংখ্যায় আছে 'আবাহন' নামে কবিতা — 'আয় লো ভগিনি, সবে মিলি আয়/ জগতের তরে ঢালি গে প্রাণ / এ জীবন কেন, ছেলেখেলা নয় / পাপীতাপী হেরে কাঁদে কি প্রাণ।' রচয়িতার নাম নেই। তবে তা সম্পাদকের নিজের অথবা হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের লেখা হতে পারে। এ-পত্রিকায় বারবার নানা লেখায় আর কবিতায় নারীদের আহ্বান করা হয়েছে সেবামূলক নানা কাজে। আশ্বিন ১২৯৯ সংখ্যায় আছে — 'আমরা প্রথম সংখ্যা 'দাসী'তে প্রকাশ করিয়াছি যে আমরা খুলনা হইতে একজন বিপথগামিনী অল্পবয়স্কা রমণীকে ফিরাইয়া সৎপথাবলম্বন করাইবার জন্য চেষ্টা করিতেছি। এই সংবাদ প্রকাশ হওয়াতে দেখা যাইতেছে যে বহু সংখ্যক হতভাগিনী রমণী আমাদের আশ্রয় পাইবার জন্য আমাদের নিকট সংবাদ পাঠাইতেছে।' এইরকম আটটি রমণীর সংবাদ আছে। কিন্তু এদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য স্বতন্ত্র আশ্রম ও তত্ত্বাবধানের জন্য উপযুক্ত দাসী পাওয়া দুষ্কর ছিল। তাই লেখকের আহ্বান — 'হায় হায়, এই সকল হতভাগিনীদের উত্তপ্ত অশ্রুবিন্দু বঙ্গদেশকে পুড়াইয়া ছারখার করিবে। বঙ্গ মাতার কি কোনও উদারপ্রাণা, প্রেমময়ী কন্যা নাই, যে আপনার প্রেম পক্ষপুটের আচ্ছাদনের নিম্নে রাখিয়া এই হতভাগিনীগণকে পাপের হস্ত হইতে, অপার যন্ত্রণার হস্ত হইতে রক্ষা করেন? কেহ যদি থাক মা এস। অগ্রসর হও।' 'দাসী' পত্রিকায় বরাবর নারীদের সমস্যা, তাদের দুর্বিপাকের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। দাসাশ্রম যেমন সে সমস্যা সমাধানে ব্রতী হয়েছে, অন্যদেরও সে কাজে যুক্ত করতে আগ্রহী হয়েছে।

সে-কালের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পাদক অনেক দুঃসাহসী আলাপ আলোচনা করতে উদ্যোগী হয়েছেন এ পত্রিকায়। বেশ্যাদের প্রভূত সংখ্যাবৃদ্ধি আর সামাজিক দুর্গতির কথা আছে মাঘ ১২৯৯ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত 'স্ত্রী জাতির দুঃখ বিমোচন' প্রবন্ধে। অনিচ্ছাকৃত ভাবে যারা বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে তাদের উদ্ধারের জন্য রামানন্দ অনেক আইনের বই পড়াশুনা করে প্রবন্ধ লিখে পাঠক সমাজকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন--'এই কলিকাতা শহরে, বেশ্যাদের নিজের বাড়ী আর কয়টা আছে? সমুদয় বেশ্যাগৃহই কোন না কোন 'ভদ্র' বাড়ীওয়ালার সম্পত্তি। কি ঘৃণার কথা। জঘন্য পাপে হতভাগিনীগণ শরীর ও আত্মা কলুষিত করিতেছে। আর তাহাদের পাপার্জিত অর্থে এই ভদ্রলোকেরা স্ত্রী পুত্র কন্যার ভরণপোষণ করিতেছে? আমাদের বোধ হয়, এই কলিকাতা শহরের বেশ্যাগৃহ সকলের একটা তালিকা করিয়া কোন বাড়ীটা কোন্‌ ভদ্রলোকের তাহা স্থির করিতে পারিলে খুব ভাল হয়। তাহা হইলে ঐ সকল নীতিজ্ঞানশূন্য লোকদের নাম সহিত ঐ তালিকাটি সাধারণের গোচরার্থে প্রকাশ করা যাইতে পারে।' নিঃসন্দেহে দুঃসাহসী মন্তব্য।

সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় বিশ্বাস করতেন যে নারীর অস্তিত্ব কেবল পুরুষের জন্য এটা অতি ভ্রান্ত বিশ্বাস। নারীর সর্বাঙ্গীণ উন্নতিও তেমনই আবশ্যক, নারী যেমন পুরুষের জন্য সৃষ্ট হয়েছেন, পুরুষও নারীর জন্য। তারা পরস্পরের পরিপূরক। 'দাসী' পত্রিকা নারীদের জন্য ভাবনাচিন্তা করত বলে এখানে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে নারী পুরুষের ভোগ্যবস্তু মাত্র। এটা অতি পাশব ভাব যা সমাজ থেকে সমূলে উৎখাত হওয়া দরকার। এমনকি কলকাতার কোনো কোনো রাস্তায় বেড়াতে গেলে দেখা যায় যে অতি অল্প বয়সী নারীরা পতিতা নারীর বেশে দাঁড়িয়ে আছে এবং এ বিষয়ে কি করা যেতে পারে তার উত্তরও খুঁজতে চেয়েছে।

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এলাহাবাদে চলে যাওয়ার পরেও 'দাসী'র কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা প্রথম ছোটগল্প 'একটি রৌপ্য মুদ্রার আত্মজীবনী' ১৮৯৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এখানে প্রকাশিত হয়। জগদীশচন্দ্র বসুর জনপ্রিয় প্রবন্ধ 'ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে' 'দাসী'তে প্রকাশিত হয়। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের 'চিত্রা' কাব্যের দীর্ঘ সমালোচনা করেন তাছাড়া সোনার তরী কাব্যগ্রন্থ বিষয়ে দাসীতে সৌদামিনী গুপ্তা একটি কবিতা লিখেছিলেন — তার শেষ পাঁচটি লাইন ছিল এইরকম —

প্রকৃতির বিশাল প্রাঙ্গণতলে যারা
ঢালিতেছে স্বাভাবিক সঙ্গীতের ধারা
শতবার শুনেছি সে সকলের সুর;
কিন্তু মম প্রিয়তম-কণ্ঠস্বর ছাড়া
আর কিছু শুনি নাই অমন মধুর।

বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'মাধবিকা'র সমালোচনাও 'দাসী'তে প্রকাশিত হয়েছিল। দীনেন্দ্রকুমার রায়, দীনেশচন্দ্র সেন, জলধর সেন — এরাও ক্রমে 'দাসী'র লেখক হয়ে ওঠেন। 'দাসী'র ৪র্থ ভাগ ১১ ও ১২ নং সংখ্যায় রাজনারায়ণ বসু মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের জীবনী লেখেন। বঙ্কিমের বিবিধ উপন্যাসের ক্রমান্বয়ে সমালোচনা করেন বিভিন্ন সংখ্যায় হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ। 'দাসী' ক্রমশ সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্ম, সমাজ ও অর্থনীতি বিষয়ক কাগজ হয়ে দাঁড়ায়। তবে দক্ষ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় নানা বিষয়ের প্রবন্ধের মধ্যে মানুষের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির কথাটুকু সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তাঁর সম্পাদকীয় কলমের তীক্ষ্ণ নৈপুণ্যে সমস্ত লেখার মধ্যে একটা সাধারণ রচনারীতির বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠত। অনেক সময় সামান্য লেখাকেও কেটেছেঁটে ঘষে মেজে এমন সুছাঁদ করে তুলতেন যে লেখাটি হয়ে উঠতো অনন্য সাধারণ। রামানন্দ সম্পাদিত প্রদীপ পত্রিকায় দীর্ঘ গ্রন্থ-সমালোচনা থাকত। 'দাসী'তে এর সূচনা। 'দাসী'তে রবীন্দ্রনাথের লেখা তেমন চোখে পড়ে না। 'দাসী' প্রকাশিত হবার সাত আট মাসের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ 'সাধনা পত্রিকা' সম্পাদনার দায়িত্বভার নেন। হয়ত সেই কারণে সে সময়ে 'দাসী'তে তাঁর তেমন লেখা প্রকাশিত হয়নি। 'দাসী' ১৮৯৭ সালের মে মাস নাগাদ বন্ধ হয়। শেষ দিকে কিছুদিন গোবিন্দচন্দ্র গুহ 'দাসী'র সম্পাদক ছিলেন।

ফরাসী বিপ্লবের আদর্শে বিশ্বাসী রামানন্দ যখনই যে পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, তখনই মানুষের মৌলিক অধিকারের স্বপক্ষে কথা বলেছেন বারবার। 'দাসী' পত্রিকাও এর ব্যতিক্রম ছিল না।

তথ্যসূত্র

১) 'দাসী' পত্রিকা -- ১৮৯২-১৮৯৭; সম্পাদক - রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়
২) 'দাসী' -- শ্রী শান্তা দেবী, প্রবাসী, ভাদ্র, ১৩৫১
৩) কোরক -- রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা; বইমেলা-- ২০১৫

(পরবাস-৬৫, ডিসেম্বর ২০১৬)

  { সংগৃহীত}

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

Thursday, 27 May 2021

আলোচনা পর্ব। বাংলা গান ও নজরুল গীতি। ২৭.০৫.২০২১. Vol -385 The blogger in literature e-magazine

 দুর দীপবাসিনি আমি চিনি গো চিনি .....

আমি যার নুপুরের ছন্দ ...

পথ চলিতে যদি চকিতে ...

মোদির সপনে মনো মম ভবনে ....

প্রিয় এমনও রাত যেন যায় না বৃথাই....


  বাংলা গান  ও নজরুল গীতি

                                   

                            গান যে শুধু গানই নয় ,তার মর্মবাণীকে বোঝা , অন্তর্নিহিত ভাবকে আপন করা, ভাবের মধ্যে রসের সঞ্চার হওয়া, হৃদয়গত ভাবরস অপর হৃদয়ে সঞ্চারিত করা- এইসবই একজন গান প্রিয় বা গান পাগল মানুষের কাজ। এমনই হৃদয়গত ধারা থেকে গানের শ্রেণি নির্ণয় হয়ে থাকে। অর্থাৎ কথার অন্তর্নিহিত ভাব কোন আবেদন প্রকাশ করছে, সে অনুসারেই সঙ্গীতের শ্রেণীকরণ। যেমন ভক্তিমূলক, আধ্যাত্মিক, বৈষ্ণব, পদাবলী, কীর্তন, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, গজল, প্রেমসঙ্গীত ইত্যাদি। বাংলা গানের বিকাশ ও সমৃদ্ধির ধারায় অন্যতম প্রধান হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন এবং কাজী নজরুল ইসলাম। এছাড়াও বাংলা গানকে যাঁরা সমৃদ্ধ করেছেন, নতুন সুর ও রীতির প্রবর্তন করেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রামপ্রসাদ সেন, রামনিধি গুপ্ত, দাশরথি রায়, হাসন রাজা, লালন ফকির, বিজয় সরকার প্রমুখ। এঁদের প্রত্যেকের গানেই রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। গানের বিষয়, সুর, আবদনে রয়েছে স্বকীয়তা। কিন্তু অনেকের গানেই বিষয়-বৈচিত্র্য নেই। কেউ শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন তো অন্য কোন বিষয়ে লেখেননি। কেউ শুধু অধ্যাত্মিক ভাবের গান রচনা করেছেন। কেউ বাউল বা কেউ আধুনিক প্রেমমূলক গান। আবার কেউ কেউ নানা বিষয় নিয়ে গান লিখেছেন। কিন্তু এত ব্যাপক বিষয়ের অবতারণা নজরুল ছাড়া শ্যামাসঙ্গীতও রচনা করেছেন। রামনিধি গুপ্ত টপ্পা অঙ্গের গান। দাশরথি রায় পাঁচালি গান রচনা করেছেন। হাসন রাজা-লালন ফকির লোকসঙ্গীত, বাউল গান রচনা করেছেন। বিজয় সরকারের গানের বিষয় আধ্যাত্মিকতা। এঁদের প্রত্যেকের গানেই যে কোন একটি বিষয় নির্ভর করেছে। একই বিষয় ও ভাবের গান রচনা করেছেন সারা জীবন ধরে। ব্যতিক্রম রবীন্দ্র, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ ও রজনীকান্ত,। দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ এবং রজনীকান্ত মূলত ভক্তিমূলক, দেশাত্মকবোধক এবং প্রেম বিষয়ক গান রচনা করেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল অবশ্য হাস্যরস বিষয়ে কিছু গান রচনা করেছেন। কিন্তু এ তিন জনের গানেই খুব বেশি বিষয় বৈচিত্র্য নেই। বিষয় বৈচিত্র্য রয়েছে রবীন্দ্র-নজরুলের গানে বেশি। এত বিচিত্র বিষয় নিয়ে বাংলার আর কোন গীতিকার সঙ্গীত রচনা করেননি। নানা বিষয় সঙ্গীত লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ।

                               

                      তেমনিসঙ্গীতের এই নানা শাখায় বিচরণ করেছেন নজরুল। রবীন্দ্রনাথও বিভিন্ন, বহু বিষয়ে গান লিখেছেন। যেমনস ব্রহ্মসঙ্গীত, দেশাত্মবোধক, ভক্তিমূলক, কীর্তন, পদাবলী, প্রেম, প্রকৃতি, সম্প্রীতি, সমাজসচেতনা, আধ্যাত্মিকতা, বাউল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গান রচনা করেছেন। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সুরের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন সুরে। রামপ্রসাদী, কীর্তন, বাউল সুরের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন তাঁর গানে। কিন্তু নজরুল আর একটু এগিয়ে বাংলায় গজল রচনা করেছেন। মধ্যপ্রাচ্য অর্থাৎ আরবীয় সুরে সঙ্গীত রচনা করেছেন। জারি, সারি, মুর্শিদি, মারফতি, ভাটিয়ালি, গান যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন, শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন, ভজন ইত্যাদি গান; আবার আধুনিক মানবীয় প্রেমসঙ্গীত, রাগসঙ্গীত, বিদ্রোহ ও দেশাত্মকবোধক গানও লিখেছেন নজরুল। 

                             

১৯২৮ সালে গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে নজরুল গান লিখেগেছেন। সেই গানের ভাব পরিমাণে যেমন বিপুল, শ্রেণী বিভাগেও তেমনি বিচিত্র। লঘু বাংলা গান থেকেও গুরুগম্ভীর ধ্রুপদ পর্যন্ত বাংলা গানের হেন শাখা নেই যাতে তিনি গান রচনা করেননি। বিদেশি গানের অনুকরণে বিদেশি সুর বসিয়েও অনেক গান রচনা করেছেন তিনি। বৈচিত্র্য ও বিপুলতায় - নজরুলের সঙ্গীত প্রতিভার প্রাচুর্যের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। ’ বাংলা গানের ঐতিহ্য শুধু বহন করেছে তা নয় বাংলা গানের ভান্ডার সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েছে। 

                     প্রায় চার হাজার গান রচনা করেছেন নজরুল। এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। আর নজরুলের গানের কথা, সুর ও বিষয়-বৈচিত্র্য সকলকে বিস্ময়াভিভূত করে। বৈষ্ণব যারা তাঁরা রাধাকৃষ্ণের বাল্যলীলা, প্রেমলীলা ও গোষ্ঠিলীলায় সুর-চিত্র দর্শনের দুর্লভ সুযোগ লাভ করবেন নজরুলের রচনায়। শাক্ত যিনি, তিনি শ্যামামায়ের পায়ের তলায় নিজের মনটিকেও একটি রাঙা জবা করে ধরে দিতে পারেন নজরুলের শ্যামসঙ্গীতের খেয়ায় ভেসে। মুসলমান যিনি, তিনি ঈদের বাঁকা চাঁদ প্রথম দেখার আনন্দে আত্মহারা হবার ভাষা খুঁজে পাবেন এই নজরুল গীতির ভার থেকেই। প্রেমিক যিনি, তিনি প্রেমের বিভিন্ন স্তরের সুখের ও শোকের সাড়া পাবেন নজরুলের গানে। তাঁর হাসির  গানের সংখ্যাও কম নয়। তাঁর দেশাত্মবোধক গান সারা বাংলা তথা ভারতের নিপীড়িত জনগণের অন্তর মথিত বাণী।

                   সারা জীবন নজরুল নানা জায়গা ঘুরছেন, বিচিত্র পেশা গ্রহণ করেছেন, বহু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। নিজে ছিলেন শিল্পী এবং সুর স্রষ্টা। আর তাই অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয়ই তার সঙ্গীতের বিষয় হয়ে উঠেছে। তাঁর কর্ম এবং অভিজ্ঞতা যেমন বিচিত্র ছিল; তেমনি তাঁর গানের বিষয়ও বিচিত্র ছিল। সঙ্গীত ছিল তাঁর একান্ত ব্যক্তিক অনুভূতির পরিম-ল। সঙ্গীত রচনাতেই সম্ভবত তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন বেশি। আর এ কারণেই তার সঙ্গীত এত বিপুল ও বৈচিত্র্যময়। জাত-পাতে তাঁর বিশ্বাস ছিল না। তিনি মানুষ। তিনি সর্ব জাতির, সর্ব ধর্মের। আর এ বোধেরই প্রকাশ দেখা যায় তাঁর বিচিত্র বিষয়ের গানে। এদিকে যেমন লিখেছেন ভজন, কীর্তন, শ্যামসঙ্গীত, অন্যদিকে তেমনি লিখেছেন ইসলামি ভক্তিমূলক গান, জারি, সারি, মুর্শিদি মারফতি।

                                  ৩       

           

                লেটোর দলকে কেন্দ্র করেই কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গীত ও কাব্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে। এখানেই একই সঙ্গে বহু বিচিত্র বিষয়ে গান রচনায় তাঁর হাতে খড়ি হয়। লেটোর দলের জন্য পালা রচনা করতে গিয়ে মুসলিম ও হিন্দু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় ঘটে। তিনি একদিকে যেমন মুসলিম জীবনধারা থেকে কাহিনী ও গীত রচনার উপাদান সংগ্রহ করেন, অপরদিকে হিন্দু পৌরাণিক উপাখ্যানের পটভূমিতেও পালাগান রচনা করেন। তাঁর সে সময়কার রচনাতেই এই দুই ঐতিহ্যর সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়। নজরুলের পরবর্তীকালের বহু রচনায় মুসলিম ও হিন্দু ঐতিহ্যের যে অসামান্য সহাবস্থিত রূপটি প্রকাশ পেয়েছিল, তার সূচনা ঘটে এই পর্বে। তাছাড়া লেটোর দলের সঙ্গে যুক্ত হবার ফলে তিনি বর্ধমান অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়েও সুযোগ পেয়েছিলেন। সে অঞ্চলে বিশেষভাবে প্রচলিত ঝুমুর গানের সঙ্গে সে সময়ই নজরুলের পরিচয় ঘটে। পরবর্তীকালে ঝুমুর অঙ্গে বহু গান রচনা করেছিলেন তিনি। এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার প্রকাশই তাঁর নানা গানে। এমন কোন বিষয় নেই, যে বিষয় নিয়ে তিনি গান রচনা করেননি।

নজরুলের এই ব্যাপক কর্মযজ্ঞ, বিশাল বিষয়-বৈচিত্র্যময় সঙ্গীত ভাব পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বাংলা গানে যে সব ধারা প্রচলিত রয়েছে, নজরুলের গানেও সে সব ধারা রয়েছে। নজরুলের  গানের উল্লেখযোগ্য ধারাগুলো হচ্ছে- ভজন, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, মুর্শিদি, মারফতি, হামদ, নাত, আধুনিক প্রেমসঙ্গীত, গজল, রাগসঙ্গীত, দেশাত্মবোধক, বাউল সঙ্গীত, ঝুমুর, বিদ্রোহমূলক, হাসির গান ইত্যাদি। বাংলার আর কোন সঙ্গীত রচয়িতা এত বিচিত্র বিষয় নিয়ে গান রচনা করেননি। নজরুল গানের এই প্রত্যেকটি শাখায় সফলতা লাভ করেছেন।  এখানেই নজরুলের শ্রেষ্ঠত্ব। 

                          ৪        

                 

               নজরুলের গানে এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে ভজন গান। ভজন এক জাতীয় আরাধনা সঙ্গীত বা ভক্তিগীতি। ঈশ্বর বন্দনাই এ গানের উদ্দেশ্য। অন্য কোন বাংলা গান রচয়িতা নজরুলের মত এত উৎকৃষ্ট, সমৃদ্ধ এবং বিপুল ভজন রচনা করতে সক্ষম হননি। তাঁর ভজন তথা হিন্দুধর্মীয় সঙ্গীত যেমন বিপুল, তেমনি বিস্ময়কর সঙ্গীত যেমন বিপুল, তেমনি বিস্ময়কর রকম বৈচিত্র্যপূর্ণ।

 ‘হে গোবিন্দ রাখো চরণে’, ‘

সখি সে হরি কেমন বল,’ ‘

খেলছি এ বিশ্ব লয়ে,’ ‘

অনাদি কাল হতে অনন্ত লোক গাহে 

তোমারি জয়’, ‘

আহার দিবেন তিনি রে মন,

 জিভ দিয়াছেন যিনি,’ ‘

অঞ্জলি লহৈা মোর সঙ্গীতে’, 

‘কোথা তুই খুঁজিস ভগবান’ ইত্যাদি

 উল্লেখযোগ্য গানসহ বহু ভজন লিখেছেন নজরুল।

                            ৫।   

                   বুলবুলের মৃত্যু নজরুলের জীবনে এক গভীর পরিবর্তনের বীজ বপন করে। অগ্নিগর্ভ কবিতা ও গীত রচয়িতা বিদ্রোহী নজরুল এই শোকের আঘাতে অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েন। এক প্রকার আধ্যাত্মিকতা তাঁকে গভীরভাবে পেয়ে বসে। অন্তর্গত বিষাদ ও আধ্যাত্মিকতাই যেন ছিল তার চৈতন্যের বাদীস্বর। সেই সময় থেকেই নজরুলের ভেতরে ভক্তিমূলক গান লেখার প্রবণতা দানা বাঁধতে থাকে। এবং পরবর্তী সময়ে তিনি ইসলাম ও হিন্দু ধর্মীয় আবেগের পটভূমিতে প্রচুর গান রচনা করেন। ভজনগুলো সেই অনুভূতিরই বহিঃপ্রকাশ। নজরুলের গানের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে এই ভজন জাতীয় গানগুলো। কোন কোন ভজন গানে শিবের আরাধনা ব্যক্ত হয়েছে। কোনটায় কৃষ্ণের কথা। পদাবলী কীর্তনের ঢঙে নজরুল প্রচুর কীর্তন রচনা করেছেন। কথা ও সুরে পুরোপুরি কীর্তন। কিছু গান ভজনও বলা চলে, আবার কীর্তনও বলা চলে; দুইয়েরই প্রভাব রয়েছে। যেমন:

 ‘হৃদি পদ্মে চরণ রাখো, 

বাঁকা ঘনশ্যাম; 

গোষ্ঠের রাখাল বলে দেরে কোথায় বৃন্দাবন ইত্যাদি।

                                ৬        


                        পদাবলী কীর্তন বা কীর্তন গান বাঙালির বহু কালের ঐতিহ্যের ধারক। এগুলো বাঙালির অন্তর-সম্পদে পূর্ণ। বাংলার নিজস্ব ঢঙ, চিরায়ত সুর এ গানে বিধৃত। রবীন্দ্রনাথও বহু কীর্তনাঙ্গের গান রচনা করেছেন। নজরুলের কীর্তন খুবই ঋদ্ধ। কথা ও সুরের সার্থক সমন্বয় ঘটেছে নজরুলের কীর্তনে। আধুনিককালে যাঁরা কীর্তন গান রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে নজরুলের কীর্তনই শ্রেষ্ঠ এবং সংখ্যায়ও প্রচুর। উল্লেখযোগ্য কীর্তনগুলো হচ্ছে- 

‘বাজে মঞ্জুল মঞ্জীর’, ‘

সখি আমিই না হয় মান করেছিনু; 

‘ওরে নীল যমুনার জল, 

আমি সুখে লো গৃহে রব, 

‘না মিটিতে মনোসাধ, 

‘মন মানস মাধবী ফুটিল কুঞ্জে, 

মণি মঞ্জীর বাজে অরুণিত চরণে, 

‘এলো নন্দের নন্দন নবঘনশ্যাম। 

মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলীর চেয়ে নজরুলের এ কীর্তনগুলো শিল্প সফরতায় কোন অংশেই কম নয়।

                                 ৭ 

                   নজরুলের গানের একটা বিশাল অংশ জুড়ে যেমন রয়েছে ভজন এবং কীর্তন গান; তেমিন ব্যাপক অংশ জুড়ে রয়েছে শ্যামাসঙ্গীত। এত বিপুল পরিমাণ শ্যামাসঙ্গীত নজরুল ছাড়া আর কেউই লেখেননি। নজরুল ইসলামি ভাবধারার গানের থেকে অনেক অনেক বেশি তাঁর শ্যামাসঙ্গীত। রামপ্রসাদ শ্যামাসঙ্গীত রচনার সূত্রপাত করেন। নজরুল শ্যামাসঙ্গীতে কোথাও শ্যামা মাতৃরূপিণী, কোথাও কালীর রৌদ্রী রূপের ভয়ঙ্কর বর্ণনা, আবার কোথাও দেশাত্মবোধের প্রেরণা প্রকাশিত। অন্যান্য গানের চেয়ে নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং পরিমাণের প্রচুর বেশি। তাঁর উল্লেখযোগ্য শ্যামাসঙ্গীত হচ্ছে- ‘

বলরে জবা বল;’ 

‘শ্যামা নামের লাগলো আগুন, 

আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায়, 

শ্মশানকালীর রূপ দেখে যা; 

শ্মশানে জাগিছে শ্যামা, 

‘থির হয়ে তুই বস দেখি মা; ‘

ভারত শ্মশান হলো মা তুই; 

আয় মা চঞ্চলা মুক্তকেশি শ্যামা কালী; 

শ্যামা তোর নাম যার জপমালা; 

ওমা খড়গ নিয়ে মাতিস রণে।

                                ৮ 

               নজরুল প্রচুর পরিমাণে জারি, সারি, ভাটিয়ালি এবং পল্লীগীতি রচনা করেছেন। এসব গানেও বাঙালির, আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ধরা পড়েছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আবেগ যেন এসব গানে স্থির হয়ে রয়েছে। ‘পদ্মার ঢেউরে, মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে, যা যারে, এ বিখ্যাত গানটি ভাটিয়ালি গানের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এছাড়াও রয়েছে-

 ‘নদীর এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে, 

এইতো নদীর খেলা; 

আমার গহীন জলের নদী; 

নদীর নাম সই অঞ্জনা; 

বাঁশি বাজায় কে কদম তলায়,

 ওগো ললিতে, 

পথভোলা কোন রাখাল ছেলে’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য গান।

                                  ৯ 


             ভক্তিমূলক গান রচনায় নজরুল অদ্বিতীয়। নজরুলের ইসলামি ভাবধারায় গানগুলোতে মুসলিম ঐতিহ্য ধরা পড়েছে। মুর্শিদি মারফতি হামদ নাত প্রভৃতি বিষয়ে নজরুল ইসলামি ভাবধারায় প্রচুর গান লিখেছেন। ভক্তি, শরণাগতি ও মাহাত্মবোধের প্রেরণা থেকে নজরুল ইসলাম ধর্ম সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয় অবলম্বনে ুদই শতাধিক গান রচনা করেছেন। এই সব গান নজরুলের ইসলামি গান রূপে খ্যাত। বাংলায় ইসলামি ভক্তিগীতির প্রবর্তন নজরুলই প্রথম করেন। তাঁর রচিত ইসলামি গান বাংলা গানের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। বাংলায় ইসলামি গানের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপকারও নজরুল। আল্লাহর প্রশস্তি, রসূল প্রশস্তি, ধর্মীয় বিধান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, উপাসনা, উপাসনালয় প্রভৃতি নানা বিষয় অবলম্বনে নজরুলের ইসলামি গানগুলো রচিত। নজরুলের উল্লেখযোগ্য ইসলামি গানগুলো হচ্ছে- 

‘মহম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে, 

রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ

, এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল, 

তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে;

 খোদার প্রেমেরর শরাব পিয়ে; 

শোনো শোনো ইয়া ইলাহী আমার মোনাজাত; 

মওলা আমার সালাম লহ; 

ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়

; মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই; 

মরু সাহারা আজ মাতোয়ারা; 

মোহাম্মদ মোর নয়ন-মণি; 

তোমার নুরের রোশনী মাখা; 

রোজ হাশরে আল্লাহ আমার করো না বিচার।’

                                ১০ 


                 আধুনিক বাংলা প্রেমগানের বিশিষ্ট রূপকার নজরুল। তৎকালীন ছায়াছবির একটা প্রধান অংশ জুড়ে ছিল নজরুলের গান। আধুনিক গানকে নজরুলই জনপ্রিয়তা দান করেছেন। তাঁর আধুনিক গানের আবেদন আজকে এতটুকু হ্রাস পায়নি। আধুনিক গানের পরিমাণও নজরুলের কম নয়। নজরুলের আধুনিক গানের সুর বৈচিত্র্য আশ্চর্যভাবে বিস্ময়কর। কালজয়ী কিছু গান -

....গভীর নিশীতে ঘুম ভেঙ্গে যায়; 

.....তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি, প্রিয়, 

....জনম জনম গেল আশা পথ চাহি;

.... মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম; 

....আজো মধুর বাঁশরী বাজে; 

......আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো; 

......তবু আমারে দেবো না ভুলিতে; 

......যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই, কেন মনে রাখো তারে; 

.....আমি চাঁদ নহি অভিশাপ; 

.....মনে পড়ে আজ সে কোন জনমে,বিদায় সন্ধ্যা আসিল; 

... মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী; 

......ভীরু এ মনের কলি; 

.....মোর না মিটিতে আশা ভাঙিল খেলা ইত্যাদি।


তাঁর সৃষ্ট রাগগুলি

ব্যবহৃত যন্ত্র সামগ্রিক -


স্বহস্তে লিখিত একটি জনপ্রিয় গানের পান্ডুলিপি -


গ্রন্থসমূহ -

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆


জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। ১২৩তম কাজী নজরুল ইসলাম। ১১ ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৮. ২৬.মে ২০২১.Vol -384 The blogger in literature e-magazine.

"এসো হে 
জৈষ্ঠ্যের ঝড়
আপন কেতন ওড়ে
ধুমকেতু সম ---
তানপুরাটা পড়ে আছে দূরে,
গেয়ে সাম্যের গান।
অশান্ত পৃথিবীর বুকে
ভাগ হয়েছে সবকিছু
হয়নিকো নজরুল।"

কাজী নজরুল ইসলাম


১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪মে (জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া ব্লকে অবস্থিত। পিতামহ কাজী আমিন উল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তার বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাযারের খাদেম। নজরুলের তিন ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন এবং দুই বোনের মধ্যে সবার বড় কাজী সাহেবজান ও কনিষ্ঠ উম্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল “দুখু মিয়া”। নজরুল গ্রামের স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। মক্তবে (মসজিদ পরিচালিত মুসলিমদের ধর্মীয় স্কুল) কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ সালে তার পিতার মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার শিক্ষাজীবন বাঁধাগ্রস্থ হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয় তাকে। এসময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। একই সাথে হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াযযিন (আযান দাতা) হিসেবে কাজ শুরু করেন। এইসব কাজের মাধ্যমে তিনি অল্প বয়সেই ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান যা পরবর্তীকালে তার সাহিত্যকর্মে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। তিনিই বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেছেন বলা যায়।

মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশি দিন ছিলেন না। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমান নাট্যদল) দলে যোগ দেন। তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফার্সি ও উর্দূ ভাষায় তার দখল ছিল। এছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন। ধারণা করা হয়, বজলে করিমের প্রভাবেই নজরুল লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন। এছাড়া ঐ অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর (গোদা কবি) এবং কবিয়া বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন। লেটো দলেই সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। নিজ কর্ম এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন। একইসাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অর্থাৎ পুরাণসমূহ অধ্যয়ন করতে থাকেন। সেই অল্প বয়সেই তার নাট্যদলের জন্য বেশকিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে চাষার সঙ, শকুনীবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের গান, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ এবং মেঘনাদ বধ। একদিকে মসজিদ, মাজার ও মক্তব জীবন, অপর দিকে লেটো দলের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের অনেক উপাদান সরবরাহ করেছে। নজরুল কালীদেবিকে নিয়ে প্রচুর শ্যামা সঙ্গিত ও রচনা করেন, নজরুল তার শেষ ভাষনে উল্লেখ্য করেন – “ কেউ বলেন আমার বানী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিম কে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালি কে গলাগলি তে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। ”

১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। লেটো দলে তার প্রতিভায় সকলেই যে মুগ্ধ হয়েছিল তার প্রমাণ নজরুল লেটো ছেড়ে আসার পর তাকে নিয়ে অন্য শিষ্যদের রচিত গান: “আমরা এই অধীন, হয়েছি ওস্তাদহীন / ভাবি তাই নিশিদিন, বিষাদ মনে / নামেতে নজরুল ইসলাম, কি দিব গুণের প্রমাণ”, এই নতুন ছাত্রজীবনে তার প্রথম স্কুল ছিল রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল, এরপর ভর্তি হন মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে যা পরবর্তীতে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিতি লাভ করে। মাথরুন স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক যিনি সেকালের বিখ্যাত কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তার সান্নিধ্য নজরুলের অনুপ্রেরণার একটি উৎস। কুমুদরঞ্জন স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে নজরুল সম্বন্ধে লিখেছেন,

ছোট সুন্দর ছনমনে ছেলেটি, আমি ক্লাশ পরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই প্রণাম করিত।আমি হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম। সে বড় লাজুক ছিল”

যাহোক, আর্থিক সমস্যা তাকে বেশী দিন এখানে পড়াশোনা করতে দেয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবিদলে। এর পর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তার বাল্য জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ’র’ সাথে তার পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তার প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষার না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। এই স্কুলে অধ্যয়নকালে নজরুল এখানকার চারজন শিক্ষক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এরা হলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী চেতনা বিশিষ্ট নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফার্সি সাহিত্যের হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্য চর্চার নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। উক্ত রেজিমেন্টের পাঞ্জাবী মৌলবির কাছে তিনি ফার্সি ভাষা শিখেন। এছাড়া সহসৈনিকদের সাথে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রাখেন, আর গদ্য-পদ্যের চর্চাও চলতে থাকে একই সাথে। করাচি সেনানিবাসে বসে নজরুল যে রচনাগুলো সম্পন্ন করেন তার মধ্যে রয়েছে, বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী (প্রথম গদ্য রচনা), মুক্তি (প্রথম প্রকাশিত কবিতা); গল্প: হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি ইত্যাদি। এই করাচি সেনানিবাসে থাকা সত্ত্বেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা। এই সময় তার কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং ফার্সি কবি হাফিজের কিছু বই ছিল। এ সূত্রে বলা যায় নজরুলের সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি এই করাচি সেনানিবাসেই। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এর পর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।
              যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তার সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্‌ফর আহমদ এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাঁধন হারা এবং কবিতা বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানি, মোহরর্‌ম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্‌দম্‌, এই লেখাগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। এর প্রেক্ষিতে কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় তার খেয়া-পারের তরণী এবং বাদল প্রাতের শরাব কবিতা দুটির প্রশংসা করে একটি সমালোচনা প্রবন্ধ লিখেন। এ থেকেই দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমালোচকদের সাথে নজরুলের ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয়। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে কাজী মোতাহার হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌, আফজালুল হক প্রমুখের সাথে পরিচয় হয়। তৎকালীন কলকাতার দুটি জনপ্রিয় সাহিত্যিক আসর গজেনদার আড্ডা এবং ভারতীয় আড্ডায় অংশগ্রহণের সুবাদে পরিচিত হন -অতুলপ্রসাদ সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশির ভাদুড়ী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মেলন্দু লাহিড়ী, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ প্রমুখের সাথে। ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে যেয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। কাজী মোতাহার হোসেনের সাথে নজরুলের বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।১৯২০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই ১২ তারিখে নবযুগ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক- এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন। ঐ বছরই এই পত্রিকায় “মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে?” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের উপর পুলিশের নজরদারী শুরু হয়। যাই হোক সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। একইসাথে মুজফ্‌ফর আহমদের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতি বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছিলেন। বিভিন্ন ছোটখাটো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিতা ও সঙ্গীতের চর্চাও চলছিল একাধারে। তখনও তিনি নিজে গান লিখে সুর দিতে শুরু করেননি। তবে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গীতজ্ঞ মোহিনী সেনগুপ্তা তার কয়েকটি কবিতায় সুর দিয়ে স্বরলিপিসহ পত্রিকায় প্রকাশ করছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে: হয়তো তোমার পাব দেখা, ওরে এ কোন স্নেহ-সুরধুনী- সওগাত পত্রিকার ১৩২৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় তার প্রথম গান প্রকাশিত হয়। গানটি ছিল: “বাজাও প্রভু বাজাও ঘন”। ১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন। তার সাথেই তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। আর এখানেই পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সাথে যার সাথে তাঁর প্রথমে পরিণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল।

                  তবে এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস আসার খানমের সাথে। বিয়ের আখত সম্পন্ন হবার পরে কাবিনের নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

               নজরুল সাম্যবাদের একজন অগ্রদূত ছিলেন। তিনি মুসলিম হয়েও চার সন্তানের নাম হিন্দু এবং মুসলিম উভয় নামেই নামকরন করেন। যেমনঃ কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ।

             বিদ্রোহী নজরুলতখন দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। নজরুল কুমিল্লা থেকে কিছুদিনের জন্য দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাড়িতে থেকে আবার কুমিল্লা ফিরে যান ১৯ জুনে- এখানে যতদিন ছিলেন ততদিনে তিনি পরিণত হন একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীতে। তাঁর মূল কাজ ছিল শোভাযাত্রা ও সভায় যোগ দিয়ে গান গাওয়া। তখনকার সময়ে তার রচিত ও সুরারোপিত গানগুলির মধ্যে রয়েছে “এ কোন পাগল পথিক ছুটে এলো বন্দিনী মার আঙ্গিনায়, আজি রক্ত-নিশি ভোরে/ একি এ শুনি ওরে/ মুক্তি-কোলাহল বন্দী-শৃঙ্খলে” প্রভৃতি। এখানে ১৭ দিন থেকে তিনি স্থান পরিবর্তন করেছিলেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে আবার কুমিল্লায় ফিরে যান। ২১ নভেম্বর ছিল সমগ্র ভারতব্যাপী হরতাল- এ উপলক্ষে নজরুল আবার পথে নেমে আসেন; অসহযোগ মিছিলের সাথে শহর প্রদক্ষিণ করেন আর গান করেন, “ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী”- নজরুলের এ সময়কার কবিতা, গান ও প্রবন্ধের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব প্রকাশিত হয়েছে। এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বিদ্রোহী নামক কবিতাটি। বিদ্রোহী কবিতাটি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় এবং সারা ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতিলাভ করে। এই কবিতায় নজরুল নিজেকে বর্ণনা করেনঃ-
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ জ্বালা, চির লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর !
আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল করে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালবাসা তার কাকন চুড়ির কন-কন ।…
মহা- বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়ুগ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।……………………..
আমি চির বিদ্রোহী বীর –
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির !”

১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ই আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করে। এটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। ১৯২০-এর দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন এক সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর পরপর স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের আবির্ভাব ঘটে তাতে ধূমকেতু পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,

কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু।
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।”

পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে এই বাণী লিখা থাকতো। পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জবানবন্দী প্রদান করেন। চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে এই জবানবন্দী দিয়েছিলেন। তার এই জবানবন্দী বাংলা সাহিত্যে রাজবন্দীর জবানবন্দী নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। এই জবানবন্দীতে নজরুল বলেছেন:

আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।… আমি কবি,আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে…।”

১৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। নজরুলকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে যখন বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন তখন (১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি ২২) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এতে নজরুল বিশেষ উল্লসিত হন। এই আনন্দে জেলে বসে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতাটি রচনা করেন।
নবযুগে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নজরুল বেতারে কাজ করছিলেন। এমন সময়ই অর্থাৎ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার অসুস্থতা সম্বন্ধে সুষ্পষ্টরুপে জানা যায় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে। এরপর তাকে মূলত হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু এতে তার অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয়নি। সেই সময় তাকে ইউরোপে পাঠানো সম্ভব হলে নিউরো সার্জারি করা হত। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। এরপর নজরুল পরিবার ভারতে নিভৃত সময় কাটাতে থাকে। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তারা নিভৃতে ছিলেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কবি ও কবিপত্নীকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। এই উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল নজরুলের আরোগ্যের জন্য গঠিত একটি সংগঠন যার নাম ছিল নজরুল চিকিৎসা কমিটি, এছাড়া তৎকালীন ভারতের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি সহযোগিতা করেছিলেন। কবি চার মাস রাঁচিতে ছিলেন।

এরপর ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। মে ১০ তারিখে লন্ডনের উদ্দেশ্যে হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন ছাড়েন। লন্ডন পৌঁছানোর পর বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে ছিলেন: রাসেল ব্রেইন, উইলিয়াম সেজিয়েন্ট এবং ম্যাককিস্ক- তারা তিনবার নজরুলের সাথে দেখা করেন। প্রতিটি সেশনের সময় তারা ২৫০ পাউন্ড করে পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন। রাসেল ব্রেইনের মতে নজরুলের রোগটি ছিল দুরারোগ্য বলতে গেলে আরোগ্য করা ছিল ছিল অসম্ভব। একটি গ্রুপ নির্ণয় করেছিল যে নজরুল “ইনভল্যুশনাল সাইকোসিস” রোগে ভুগছেন। এছাড়া কলকাতায় বসবাসরত ভারতীয় চিকিৎসকরাও আলাদা একটি গ্রুপ তৈরি করেছিলেন। উভয় গ্রুপই এই ব্যাপারে একমত হয়েছিল যে, রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা ছিল খুবই অপ্রতুল ও অপর্যাপ্ত। লন্ডনে অবস্থিত লন্ডন ক্লিনিকে কবির এয়ার এনসেফালোগ্রাফি নামক এক্স-রে করানো হয়। এতে দেখা যায় তার মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব সংকুচিত হয়ে গেছে। ড: ম্যাককিস্কের মত বেশ কয়েকজন চিকিৎসক একটি পদ্ধতি প্রয়োগকে যথোপযুক্ত মনে করেন যার নাম ছিল ম্যাককিস্ক অপারেশন। অবশ্য ড: ব্রেইন এর বিরোধিতা করেছিলেন।

এই সময় নজরুলের মেডিকেল রিপোর্ট ভিয়েনার বিখ্যাত চিকিৎসকদের কাছে পাঠানো হয়। এছাড়া ইউরোপের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও পাঠানে হয়েছিল। জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসার্জন অধ্যাপক রোঁয়েন্টগেন ম্যাককিস্ক অপারেশনের বিরোধিতা করেন। ভিয়েনার চিকিৎসকরাও এই অপারেশনের ব্যাপারে আপত্তি জানান। তারা সবাই এক্ষেত্রে অন্য আরেকটি পরীক্ষার কথা বলেন যাতে মস্তিষ্কের রক্তবাহগুলির মধ্যে এক্স-রেতে দৃশ্যমান রং ভরে রক্তবাহগুলির ছবি তোলা হয় (সেরিব্রাল অ্যানজিওগ্রাফি)- কবির শুভাকাঙ্খীদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাকে ভিয়েনার চিকিৎসক ডঃ হ্যান্স হফের অধীনে ভর্তি করানো হয়। এই চিকিৎসক নোবেল বিজয়ী চিকিৎসক জুলিয়াস ওয়েগনার-জাউরেগের অন্যতম ছাত্র। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর কবিকে পরীক্ষা করানো হয়। এর ফলাফল থেকে ড. হফ বলেন যে, কবি নিশ্চিতভাবে পিক্‌স ডিজিজ নামক একটি নিউরন ঘটিত সমস্যায় ভুগছেন। এই রোগে আক্রান্তদের মস্তিষের ফ্রন্টাল ও পার্শ্বীয় লোব সংকুচিত হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন বর্তমান অবস্থা থেকে কবিকে আরোগ্য করে তোলা অসম্ভব। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর তারিখে কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা ভিয়েনায় নজরুল নামে একটি প্রবন্ধ ছাপায় যার লেখক ছিলেন ডঃ অশোক বাগচি- তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ভিয়েনায় অবস্থান করছিলেন এবং নজরুলের চিকিৎসা সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। যাহোক, ব্রিটিশ চিকিৎসকরা নজরুলের চিকিৎসার জন্য বড় অংকের ফি চেয়েছিল যেখানে ইউরোপের অন্য অংশের কোন চিকিৎসকই ফি নেননি। অচিরেই নজরুল ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে আসেন। এর পরপরই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায় ভিয়েনা যান এবং ড. হ্যান্স হফের কাছে বিস্তারিত শোনেন। নজরুলের সাথে যারা ইউরোপ গিয়েছিলেন তারা সবাই ১৯৫৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর রোম থেকে দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালিদের বিজয় লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে তারিখে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তনে তাকে এই উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। একুশে পদক বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানসূচক পদক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।এরপর যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে কবির সবচেয়ে ছোট ছেলে এবং বিখ্যাত গিটার বাদক কাজী অনিরুদ্ধ মৃত্যুবরণ করে। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। 
মৃত্যু -
১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল তার একটি গানে লিখেছেন, “মসজিদেরই কাছে আমায় কবর দিয়ো ভাই / যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই”;- কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তাঁর সমাধি রচিত হয়।


রচনা কর্ম :
কবিতা

অগ্নিবীণা (কবিতা) ১৯২২
সঞ্চিতা (কবিতা সংকলন) ১৯২৫
ফনীমনসা (কবিতা) ১৯২৭
চক্রবাক (কবিতা) ১৯২৯
সাতভাই চম্পা (কবিতা) ১৯৩৩
নির্ঝর (কবিতা) ১৯৩৯
নতুন চাঁদ (কবিতা) ১৯৩৯
মরুভাস্কর (কবিতা) ১৯৫১
সঞ্চয়ন (কবিতা সংকলন) ১৯৫৫
নজরুল ইসলাম: ইসলামী কবিতা (কবিতা সংকলন) ১৯৮২

কবিতা ও সংগীত
দোলন-চাঁপা (কবিতা এবং গান) ১৯২৩
বিষের বাঁশি (কবিতা এবং গান) ১৯২৪
ভাঙ্গার গান (কবিতা এবং গান) ১৯২৪
ছায়ানট (কবিতা এবং গান) ১৯২৫
চিত্তনামা (কবিতা এবং গান) ১৯২৫
সাম্যবাদী (কবিতা এবং গান) ১৯২৫
পুবের হাওয়া (কবিতা এবং গান) ১৯২৬
সর্বহারা (কবিতা এবং গান) ১৯২৬
সিন্ধু হিন্দোল (কবিতা এবং গান) ১৯২৭
জিঞ্জীর (কবিতা এবং গান) ১৯২৮
প্রলয় শিখা (কবিতা এবং গান) ১৯৩০
শেষ সওগাত (কবিতা এবং গান) ১৯৫৮
সংগীত
বুলবুল (গান) ১৯২৮
সন্ধ্যা (গান) ১৯২৯
চোখের চাতক (গান) ১৯২৯
নজরুল গীতিকা (গান সংগ্রহ) ১৯৩০
নজরুল স্বরলিপি (স্বরলিপি) ১৯৩১
চন্দ্রবিন্দু (গান) ১৯৩১
সুরসাকী (গান) ১৯৩২
বনগীতি (গান) ১৯৩১
জুলফিকার (গান) ১৯৩১
গুল বাগিচা (গান) ১৯৩৩
গীতি শতদল (গান) ১৯৩৪
সুর মুকুর (স্বরলিপি) ১৯৩৪
গানের মালা (গান) ১৯৩৪
স্বরলিপি (স্বরলিপি) ১৯৪৯
বুলবুল দ্বিতীয় ভাগ (গান) ১৯৫২
রাঙ্গা জবা (শ্যামা সংগীত) ১৯৬৬
ছোট গল্প
ব্যাথার দান (ছোট গল্প) ১৯২২
রিক্তের বেদন (ছোট গল্প) ১৯২৫
শিউলি মালা (গল্প) ১৯৩১
উপন্যাস
বাঁধন হারা (উপন্যাস) ১৯২৭
মৃত্যুক্ষুধা (উপন্যাস) ১৯৩০
কুহেলিকা (উপন্যাস) ১৯৩১
নাটক
ঝিলিমিলি (নাটক) ১৯৩০
আলেয়া (গীতিনাট্য) ১৯৩১
পুতুলের বিয়ে (কিশোর নাটক) ১৯৩৩
মধুমালা (গীতিনাট্য) ১৯৬০
ঝড় (কিশোর কাব্য-নাটক) ১৯৬০
পিলে পটকা পুতুলের বিয়ে (কিশোর কাব্য-নাটক) ১৯৬৪
প্রবন্ধ এবং নিবন্ধ
যুগবানী (প্রবন্ধ) ১৯২৬
ঝিঙ্গে ফুল (প্রবন্ধ) ১৯২৬
দুর্দিনের যাত্রী (প্রবন্ধ) ১৯২৬
রুদ্র মঙ্গল (প্রবন্ধ) ১৯২৭
ধুমকেতু (প্রবন্ধ) ১৯৬১
অনুবাদ এবং বিবিধ
রাজবন্দীর জবানবন্দী (প্রবন্ধ) ১৯২৩
দিওয়ানে হাফিজ (অনুবাদ) ১৯৩০
কাব্যে আমপারা (অনুবাদ) ১৯৩৩
মক্তব সাহিত্য (মক্তবের পাঠ্যবই) ১৯৩৫
রুবাইয়াতে ওমর খৈয়াম (অনুবাদ) ১৯৫৮
নজরুল রচনাবলী (ভলিউম ১-৪,বাংলা একাডেমী)১৯৯৩
সঙ্গীত গ্রন্থাবলী
বুলবুল (১ম খন্ড-১৯২৮, ২য় খন্ড-১৯৫২)
চোখের চাতক (১৯২৯)
চন্দ্রবিন্দু (১৯৪৬)
নজরুল গীতিকা (১৯৩০)
নজরুল স্বরলিপি (১৯৩১)
সুরসাকী (১৯৩১)
জুলফিকার (১৯৩২)
বনগীতি (১৯৩২)
গুলবাগিচা (১৯৩৩)
গীতিশতদল (১৯৩৪)
সুরলিপি (১৯৩৪)
সুর-মুকুর (১৯৩৪)
গানের মালা (১৯৩৪)

সম্মাননা ও স্বীকৃতি -

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের চুরুলিয়ায় "নজরুল অ্যাকাডেমি" নামে একটি বেসরকারি নজরুল-চর্চা কেন্দ্র আছে। চুরুলিয়ার কাছে আসানসোল মহানগরে ২০১২ সালে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে।আসানসোলের কাছেই দুর্গাপুর মহানগরের লাগোয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির নাম রাখা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।  উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় অবস্থিত নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রাজধানী কলকাতার যোগাযোগ-রক্ষাকারী প্রধান সড়কটির নাম রাখা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম সরণি। কলকাতা মেট্রোর গড়িয়া বাজার মেট্রো স্টেশনটির নাম রাখা হয়েছে "কবি নজরুল মেট্রো স্টেশন"।

১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বাংলা সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার জগত্তারিণী স্বর্ণপদক নজরুলকে প্রদান করা হয়। ১৯৬০ সালে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণে ভূষিত করা হয়।
কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়।তার রচিত "চল্‌ চল্‌ চল্‌, ঊর্ধগগনে বাজে মাদল" বাংলাদেশের রণসংগীত হিসাবে গৃহীত। নজরুলের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী প্রতি বছর বিশেষভাবে উদযাপিত হয়। নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালে (বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায়) ২০০৫ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় নামক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় কবির স্মৃতিতে নজরুল একাডেমি, বুলবুল ললিতকলা একাডেমী ও শিশু সংগঠন বাংলাদেশ নজরুল সেনা স্থাপিত হয়। এছাড়া সরকারিভাবে স্থাপিত হয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান নজরুল ইন্সটিটিউট- ঢাকা শহরের একটি প্রধান সড়কের নাম রাখা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ।

বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তনে তাকে এই উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। একুশে পদক বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানসূচক পদক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

জীবনী রচনা সমস্যা

          তাঁর সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে পারতেন, এমন কোনো যোগ্য আত্মীয় তাঁর ছিল না। তাঁর দুই ভাই ছিলেন, লেখাপড়া সামান্যই জানতেন। তাঁরা তাঁর জীবন সম্পর্কে নতুন কোনো আলোকপাত করতে পারেননি। তাঁরা দেখেছিলেন বালক এবং কিশোর নজরুলকে, যাঁর বালকসুলভ কাজকর্ম তাঁদের মনে থাকার কথা নয়। সুতরাং তাঁদের কাছ থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়নি। তাঁর পুত্ররা—সব্যসাচী আর অনিরুদ্ধ—কলকাতা-পূর্ব অধ্যায় সম্পর্কে না হলেও, কলকাতা অধ্যায় সম্পর্কে হয়তো তথ্য দিতে পারতেন। কিন্তু নজরুল যখন মানসিক রোগে আক্রান্ত হলেন, তখন তাঁরা বালক মাত্র। তাই তাঁরা কেউ তাঁদের পিতার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু লিখেছেন বলে জানি না। আর লিখে থাকলেও, সেও শোনা কথা। নজরুল সুস্থ থাকা অবস্থায় তাঁর কোনো জীবনী প্রকাশিত হলেও তা নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হতো। সুতরাং যেসব নজরুল-জীবনী লেখা হয়েছে, সেগুলো অংশত কিংবদন্তিমূলক। এবং বীরপূজা বিশেষ।

তিনি যে পরিবারে জন্মেছিলেন, সে পরিবারের বিদ্যা অথবা বিত্ত—কোনোটাই ছিল না। এখন যে সে পরিবারের ওপর গৌরব আরোপ করে তাঁর পূর্বপুরুষদের আয়মাদার এবং কাজী ইত্যাদি বিশেষণে বিভূষিত করা হয়, তার কারণ পরবর্তীকালে তাঁর অসামান্য কীর্তি এবং গৌরব। আমরা ধরেই নিই যে, তিনি যখন অমন বড় হয়েছিলেন, তখন তাঁর পূর্বপুরুষেরাও নিশ্চয়ই অভিজাত ছিলেন। এই সিদ্ধান্ত মাথায় নিয়েই আজহারউদ্দীন থেকে শুরু করে নবীনতম নজরুল-জীবনীকার পর্যন্ত লেখকেরা তাঁদের যাত্রা আরম্ভ করেন। কিন্তু নজরুল যা হয়েছিলেন, তা নিজের প্রতিভা দিয়েই হয়েছিলেন, পরিবারের কারণে নয়। তিনি যে পরিবারে জন্মেছিলেন, সে পরিবারে সন্তানদের জন্মতারিখ পর্যন্ত লিখে রাখার ঐতিহ্য ছিল না। কেউ কি জানে তাঁর বড় ভাই সাহেবজান তাঁর থেকে ক বছরের বড় ছিলেন। অথবা ছোট ভাই আলী হোসেন ক বছরের ছোট ছিলেন? অথবা তাঁর মা কে ছিলেন? পিতা দরিদ্র ছিলেন, কিন্তু কী করে জীবিকা উপার্জন করতেন? এসব তথ্য খোঁজা বাহুল্য।

গুরুত্বপূর্ণ যা, তা হলো: তিনি কী করে হঠাৎ একদিন উল্কার মতো বাংলা সাহিত্য এবং সংগীতজগতের মধ্যগগনে আবির্ভূত হয়ে সমস্ত আকাশকে উজ্জ্বল করে তুলেছিলেন। কী করে তিনি দুখু মিয়া থেকে নজর আলি, নজর আলি থেকে নজরুল এসলাম, নজরুল এসলাম থেকে নজরুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম থেকে কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী নজরুল ইসলাম থেকে হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম, এবং শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম হয়ে উঠলেন, সেই বিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ এবং আগ্রহব্যঞ্জক।
আসলে তিনি ছিলেন এক অসাধারণ প্রতিভা। তাঁকে সাধারণ মানুষের মাপে বিচার করতে গেলে ভুল হওয়ারই কথা। কিন্তু আর পাঁচজন মানুষের মতো তাঁকে চিরাচরিত ছকে গড়ে তুলেছেন জীবনীকারেরা। তিনি যে ব্যতিক্রম, সেটা অনেকেই মাথায় রাখেননি। তাঁর বেলাতে প্রতিষ্ঠিত রীতি যে অচল হতে পারে, তাঁরা সেটাও মনে করেননি।
সঠিক তথ্যের অপ্রতুলতা ছাড়াও নজরুল ইসলামের একটি আদর্শ জীবনী লেখার দ্বিতীয় সমস্যা হলো, একেবারে গোড়ার সমস্যা। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যদেবের কয়েকটি জীবনী রচিত হলেও, অথবা মুকুন্দরাম ও ভারতচন্দ্র তাঁদের জীবনের কয়েকটি তথ্য রেখে গেলেও, বাংলা ভাষায় জীবনী লেখার কোনো ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি। ইরেজি জীবনী-সাহিত্যের আদলে বাংলা ভাষায় জীবনী রচনা আরম্ভ হয় উনিশ শতকে। এবং এর তিনটি মডেল তৈরি হয়। প্রথমত, জন্ম, পরিবার, শিক্ষা, বিবাহ, কর্মজীবন এবং মৃত্যুর মতো একেবারে মৌলিক তথ্যের সংগ্রহ। ঈশ্বর গুপ্ত এ ধরনের জীবনীর সূচনা করেন। নগেন্দ্রনাথ সোম ও যোগীন্দ্রনাথ বসু তাকে উন্নত করেন এবং এর চূড়ান্ত রূপ দেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্য-সাধক চরিতমালায়। কিন্তু জীবনী মানে তথ্যের তালিকা নয়। এমনকি সন-তারিখের তালিকাও নয়।
জীবনী লেখার দ্বিতীয় মডেল প্রবর্তন করেন শিবনাথ শাস্ত্রী—তাঁর রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ গ্রন্থে। সমাজের সমান্তরালভাবে কোনো ব্যক্তির জীবনকে বিচার-বিশ্লেষণ করা নিঃসন্দেহে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ। সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে যাঁর জীবনী লেখা হচ্ছে, তাঁকে দেখার দৃষ্টিকোণ। সমাজের সঙ্গে তুলনা করে তাঁর জীবনের মূল্যায়ন করা। এর ফলে যাঁকে নিয়ে লেখা হচ্ছে, তাঁর জীবন ও প্রবণতা বোঝার বিষয়ে একটা নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। এই মডেলটি পরে অনেকেই গ্রহণ করেন; তবে আজও এই মডেলের সবচেয়ে নামকরা গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয় রামতনু লাহিড়ী। কিন্তু এই জীবনীতে উনিশ শতকের সামাজিক ইতিহাস যতটা চোখে পড়ে, রামতনু লাহিড়ীকে ততটা দেখা যায় না। সেদিক দিয়ে বিচার করলে জীবনী হিসেবে এ বই অসম্পূর্ণ, এমনকি ব্যর্থ। কিন্তু এ গ্রন্থ জনপ্রিয় হওয়ার পর এর অনুকরণে অনেকেই সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে জীবনী রচনা করতে আরম্ভ করেন। এর মধ্যে রামমোহন ও তৎকালীন সমাজ ও সাহিত্য (১৯৭১) গ্রন্থে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় আরও একটা মাত্রা যুক্ত করেন সাহিত্যকে নিয়ে এসে।

বিদ্রোহের বহুমাত্রা

এরপরে আসে বাংলা-পড়ুয়াদের পিএইচডি করার যুগ। সেই সূত্রে অনেকেই জীবনীর কিছু তথ্য এবং সাহিত্যের কিছু আলোচনা দিয়ে ‘অমুকের জীবন ও সাহিত্য’ নামে অসংখ্য কাজ করেন। এর মধ্যে অনেকগুলো কাজ মুদ্রিত হয়ে বই আকারে প্রকাশিতও হয়। মুশকিল হলো, এসব কাজ না সত্যিকার জীবনী, না সত্যিকার সাহিত্য-বিচার। এগুলোকে বলা যায়, জীবনের তথ্য ও সন-তারিখের ফর্দ এবং বিবরণ। সেই সঙ্গে সাহিত্যের খবর। কোন বই কবে প্রকাশিত হয়েছিল, বিষয়বস্তু কী, এবং এখান সেখান থেকে কিছু উদ্ধৃতি। সাহিত্য-আলোচনা একে ঠিক বলা যায় না। কারণ, এতে সাহিত্যের বিশ্লেষণ, রসাস্বাদন অথবা মূল্যায়ন তেমন থাকে না। সবচেয়ে কম মেধা নিয়ে এই ধরনের জীবন ও সাহিত্য মার্কা-মারা গ্রন্থ রচনা করা যায়। বলা যায় যে, এগুলো জীবনী নয়, এগুলো হলো ব্যক্তি বিশেষের পরিচিতিমূলক গ্রন্থ।
তৃতীয় শ্রেণির গ্রন্থগুলো সরাসরি জীবন নিয়ে আলোচনা। যেমন, মুজফ্ফর আহমদের কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা (১৯৬৫) অথবা প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়ের নজরুল ইসলাম (১৯৫৫, ১৯৮৩)। এ–জাতীয় বইকে ঠিক জীবনীগ্রন্থ বলা যায় না। এগুলো জীবনীমূলক রচনা, জীবনী রচনার সহায়ক গ্রন্থ। এ ধরনের বইয়ে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা থাকে না অথবা সামান্যই আছে। কিন্তু নজরুল জীবনী রচনায় এই দুই বই-ই মূল্যবান অবদান রেখেছে। বিশেষ করে মুজফ্ফর আহমদ অসীম নিষ্ঠা নিয়ে তাঁর স্মৃতিকথা রচনা করেছেন। নজরুল-জীবনীগুলোতে যা বিরল জিনিস—মুজফ্ফর আহমদ বহু জনপ্রিয় কিংবদন্তি ভেঙে দিয়েছেন। প্রয়োজনবোধে নজরুলের কড়া সমালোচনা করতেও পিছপা হননি। আরও বিরল: মুজফ্ফর আহমদ ঘটনাবলির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন।
নাম থেকেই বোঝা যায়, আজহারউদ্দীন খানের বাংলা সাহিত্যে নজরুল (১৯৫৪) জীবনীগ্রন্থ নয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এ বইয়ের প্রথম অংশে আছে নজরুলের বংশ পরিচয় থেকে আরম্ভ করে, জীবনসায়াহ্ন পর্যন্ত নানা ঘটনার বিবরণ—একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী। তাঁর এই জীবনী শোনা-কথা-নির্ভর এবং অনেক জায়গায় ভ্রান্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত। তা সত্ত্বেও নজরুলের জীবনী সম্পর্কে একেবারে গোড়ার দিকে যাঁরা কাজ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনি প্রধান। আবদুল কাদিরের নজরুল-প্রতিভার স্বরূপ (১৯৮৯) গ্রন্থটিও আজহারউদ্দীন খানের বইয়ের মতো। এতেও প্রথমাংশে আছে জীবনী। তারপরে আছে নজরুল সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা। শুধু জীবনী নিয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা অরুণকুমার বসুর নজরুল-জীবনী। এতেও সাহিত্যের আলোচনা আছে, কিন্তু লেখকের মূল লক্ষ্য নজরুলের জীবনী। ৪৫টি অধ্যায়ে বিভক্ত করে লেখক বিদ্রোহী কবির জীবনের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরেছেন। অন্য যেসব জীবনী লেখা হয়েছে, সেগুলোর তুলনায় এ বইয়ে বেশি তথ্য আছে। কিন্তু জীবনের ঘটনাবলির মধ্যে যে ঐক্যসূত্র আছে, তা লেখক ধরতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। তথ্যগুলোকে লেখক কোনো ধারণাগত কাঠামোর মধ্যে ফেলে বিচার করতে চাননি। ধারণাগত কাঠামোর কথা তিনি মনে রেখেছিলেন কি না, সে সম্পর্কেও পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে।
বাংলা জীবনী সাহিত্যের আরেকটি সীমাবদ্ধতা এবং দুর্বলতা হলো: যাঁর জীবনী রচনা করা হচ্ছে, তাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত করার প্রয়াস। কিন্তু মানুষ যে কেবল মহৎ হতে পারে না, মানুষ যে দোষে-গুণে মানুষ—জীবনী লেখকেরা সেটা ভুলে যান। 



∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆