Saturday, 8 May 2021

                 


                    রবীন্দ্রজয়ন্তীর ইতিবৃত্ত 



"হে নূতন, দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ...চির নূতনেরে দিল ডাক পঁচিশে বৈশাখ’

অথবা

"তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন সূর্যের মতন।

রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।

উদয়দিগন্তে ওই শুভ্র শঙ্খ বাজে।

মোর চিত্তমাঝে

চির-নূতনেরে দিল ডাক

পঁচিশে বৈশাখ "

অথবা 

"রাত্রি হল ভোর

আজি মোর

জন্মের স্মরণপূর্ণ বাণী,

প্রভাতের রৌদ্রে-লেখা লিপিখানি

হাতে করে আনি

দ্বারে আসি দিল ডাক

পঁচিশে বৈশাখ। "

                  কবির জন্মদিন প্রথম বার পালিত হয়েছিল তাঁর ২৬ বছর বয়সে, ১৮৮৭ সালে। প্রিয় ভাগ্নী সরলাদেবী ‘জীবনের ঝরাপাতা’য় লিখেছেন, ‘রবিমামার প্রথম জন্মদিন উৎসব আমি করাই। তখন মেজমামা ও নতুন মামার সঙ্গে তিনি ৮৯ পার্ক স্ট্রিটে থাকেন। অতি ভোরে নিঃশব্দে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল ও একজোড়া ধুতি চাদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাকে জাগিয়ে দিলাম’, এর পর সে দিন বাড়িতে সবাই মিলে জন্মদিন পালন হয়েছিল। প্রতি বছর জন্মদিন উপলক্ষ্যে তিনি কিছু লিখতেন। সব কবিতাতেই সেই অনন্ত জিজ্ঞাসা,

 ‘কে আমি ?’ চিরন্তন এই প্রশ্ন থেকে ‘

এই আমি প্রথমজাত অমৃত’ উত্তরে ফেরার চেষ্টা। সে সব কবিতাই আমাদের দলিল দস্তাবেজ। বাংলা ১৩৪৪ সালে আলমোড়াতে বসে ‘জন্মদিন’ কবিতায় লিখছেন -

 ‘দৃষ্টিজালে জড়ায় ওকে হাজারখানা চোখ,

ধ্বনির ঝড়ে বিপন্ন ঐ লোক।

 জন্মদিনের মুখর তিথি যারা ভুলেই থাকে,

দোহাই ওগো, তাদের দলে লও এ মানুষটাকে’।

             বাংলার ১৩৪৬ সালে ‘জন্মদিন’ নবজাতকে অন্তর্ভুক্ত- 

‘তোমরা রচিলে যারে/ 

নানা অলংকারে/

 তারে তো চিনি নে আমি,/

 চেনেন না মোর অন্তর্যামী... 

তোমাদের জনতার খেলা/

 রচিল যে পুতুলিরে/

 সে কি লুব্ধ বিরাট ধূলিরে/ 

এড়ায়ে আলোতে নিত্য রবে।/ 

এ কথা কল্পনা কর যবে..

১৯৪১ সালে অসুস্থ অবস্থায় শেষ জন্মদিন। মে মাসের ছ’তারিখ লিখলেন শেষ জন্মদিনের কবিতা,

 ‘আমার এ জন্মদিন-মাঝে আমি হারা...’।

        যদুনাথ সরকারকে চিঠিতে লিখছেন, ‘এই সমস্ত বাহ্য আড়ম্বরের উদ্যোগ আয়োজনে আমি যে কিরূপ সঙ্কোচ অনুভব করিতেছি তাহা অন্তর্যামীই জানেন।’ 

১৮৮৬ সালে ২৫ শে বৈশাখ শ্রীশচন্দ্র মজুমদার কে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে লিখেছেন -" আজ আমার জন্মদিন পঁচিশেশে বৈশাখ পঁচিশ বছর পূর্বে এই পঁচিশে বৈশাখে আমি ধরণীকে বাধিত করতে অবতীর্ণ হয়েছিলুম। জীবনে এখন আরো অনেকগুলো পঁচিশে বৈশাখ আসে এই আশীর্বাদ করুন। জীবন অতি সুখের।""

আবার 

‘জন্মোৎসব’ প্রবন্ধে, 

"আজ আমার জন্মদিনে তোমরা যে-উৎসব করছ, তার মধ্যে যদি সেই কথাটি থাকে, তোমরা যদি আমাকে আপন করে পেয়ে থাক, আজ প্রভাতে সেই পাওয়ার আনন্দকেই যদি তোমাদের প্রকাশ করবার ইচ্ছা হয়ে থাকে, তা-হলেই এই উৎসব সার্থক। তোমাদের জীবনের সঙ্গে আমার জীবন যদি বিশেষভাবে মিলে থাকে, আমাদের পরস্পরের মধ্যে যদি কোনো গভীরতর সম্বন্ধ স্থাপিত হয়ে থাকে, তবেই যথার্থভাবে এই উৎসবের প্রয়োজন আছে, তার মূল্য আছে।’ 

প্রকৃত অর্থে রবীন্দ্রনাথ জয়ন্তী পালিত হয় ১৯১০ সালে, শান্তিনিকেতনে সার্বজনীন ভাবে। তখন কবির বয়স ৪৯ বছর পূরণ হয়ে ৫০ এ পা দিলেন। পরের ১৯১২ সালে সাড়ম্বরে পালিত হল রবীন্দ্রজয়ন্তী। শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক পরিবেশে। সঙ্গে প্রশান্ত মহালানাবিশ এর নেতৃত্বে কলকাতা থেকে বেশকিছু গুণীজন যোগ দিয়েছিলেন এই অনুষ্ঠানে।  তাদের মধ্যে সত্যেন দত্ত সুকুমার রায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখরা। বেদ উপনিষদ পাঠ করে মালা পরিয়ে কবিকে বরণ করা হয়েছিল। কবি মনের কথা সেদিন অনুচ্চারিত থেকে গেল পরে নেপাল চন্দ্র রায়ের ভাষণ প্রকাশ পেয়েছিল -" তোমরা সকলেই গুরুদেব কে ভক্তি করো কিন্তু তাকে কখনো যেন ঈশ্বরের স্থানে বসিয়ো না."

    " যেথায় থাকে সবার অধম 

দীনের হতে দিন 

সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে 

সবার পিছে সবার নিচে

 সব হারাদের মাঝে। "

১৯৩১ সালে মহাসমারোহে উদযাপিত হলো রবীন্দ্রজয়ন্তী ৭০তম বর্ষে. মুখ্য উপদেষ্টা ছিলেন অমল হোম।  সভাপতি জগদীশচন্দ্র বসু । এছাড়া হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সুভাষচন্দ্র বসু, সিভি রমন, রাজশেখর বসু ,নজরুল ইসলাম, ইন্দিরা দেবী ,কালিদাস নাগ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রশান্ত মহলানবিশ প্রমুখরা। কবি র সংবর্ধনা উপলক্ষ্যে দুটি বই প্রকাশিত হয়েছিল - বাংলা ও ইংরেজিতে. ইংরেজি বইটির নামকরণ করেন রমা রোলা . এর নাম দেন "গোল্ডেন বুক অফ টেগর" বইটিতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখেছিলেন কবির গুণমুগ্ধ আইনস্টাইনসহ     বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিরা। কবির জীবদ্দশায় শেষ রবীন্দ্রজয়ন্তী অত্যন্ত অনাড়ম্বরভাবে পালিত হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। জীবনের শেষ জন্ম দিবস , ১৯৪১ এর  ৮ মে। শান্তিনিকেতনের উদয়নে বসে তিনিই জীবন চর্চার নির্যাস লিখেছিলেন -

 " আমারে জন্মদিন মাঝে আমি হারা 

আমি চাই বন্ধুজন

 যারা তাদের হাতের পরশে

 মর্তের অন্তিম প্রীতি রসে

 নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ 

নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ।"

আবার অন্যত্র তিনি বলেছিলেন -

" 'যা পেয়েছি প্রথম দিনে তাই যেন পাই শেষে

দু হাত দিয়ে বিশ্বরে ছুঁই শিশুর মতো হেসে।'


দৈনিক শব্দের মেঠোপথ

Doinik Sabder Methopath

Vol -366. Dt -08.05.2021

২৪ শা বৈশাখ,১৪২৮. শনিবার

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆


No comments: