Friday, 21 May 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। ২১মে ২০২১. Vol -379. The blogger in literature e-magazine

"এসেছিলে শুধু গায়িতে প্রভাতী
না ফুটিতে ঊষা না পোহাতে রাতি
আঁধারে আলোকে প্রেমে মোহে গাঁথি
কুহরিলে ধীরে ধীরে
ঘুমঘোরে প্রাণী ভাবি স্বপ্ন বাণী
ঘুমাইলো পার্শ্ব ফিরে।।"



আধুনিক বাংলা কাব্য কবিতার জগতে রঙ্গলাল থেকে মধুসূদন হেমচন্দ্র নবীনচন্দ্র পর্যন্ত সমস্ত কবিরাই পরাধীন ভারতবর্ষের স্বদেশ অনুরাগ মূলক কাব্য রচনায় নিমগ্ন ছিলেন ব্যতিক্রমী ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিশেষ করে তার সৃষ্টির সমীক্ষায় যে সুর ধ্বনিত হয়েছিল একান্ত মহাকাব্যিক হেমচন্দ্র নবীনচন্দ্রের মহাকাব্যের প্রয়াস অন্তরের প্রবনতার সুরে ঝংকৃত হলেও নবীনচন্দ্রের প্রতিভা ছিল লিরিক ঘেঁষা। এমনই ধারার গীতি প্রাণতাকে সঙ্গী করে বাংলা কাব্য কবিতার জগতে আবির্ভূত হলেন ভোরের কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী ্। জনাকীর্ণ জীবনের সংগ্রাম রত বাংলার কাব্য ভাবনার জগতে মন্ময় কল্পনার প্রথম সংবাদ মৃদু কণ্ঠে ভোরের শান্ত কমল পরিবেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্য গুরু বিহারীলাল চক্রবর্তীকে ভোরের পাখি আখ্যা দিয়েছিলেন। অপরদিকে নব্যভারত পত্রিকায় ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন  -"ধ্যান‌ই এই কবির কবিত্বের প্রাণ ,পরমাত্মা।" অর্থাৎ গীতিকবিতার যে ধানতলা থেকে জনতা তাতার গীতি প্রবণতাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
        রেনেসাঁসের যুগে তপ্ত যন্ত্রণা যখন মধুসূদনের কাব্য স্বাভাবিকভাবে আচ্ছন্ন তখন বিহারীলালের রচনায় এই প্রথম বাংলা কবিতায় কবির নিজের সুর ধ্বনিত হয়েছে। রেনেসাঁস যুগের পরস্পর বিরোধী কাব্য ভাবনার অন্ধ আলোড়ন থেকে কবিসত্তার এই মুক্তিতে বাংলা কাব্যের যৌবন মুক্তি আভাসিত হয়েছে যার জন্য বিহারীলাল আধুনিক গীতি কবিতার ক্ষেত্রে ভোরের পাখি।।


তিনি ২১ মে, ১৮৩৫ তারিখে কলকাতার নিমতলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দীননাথ চক্রবর্তী। তিনি মুখ্যত পৌরহিত্যের কাজ করতেন ।মাত্র চার বছর বয়সে মা মারা যান। কবিরা আসল চট্টোপাধ্যায় বংশজাত কিন্তু কবির প্রপিতামহ হালিশহরে কোন এক স্বর্ণ বণিকের দান গ্রহণ করায় সেই সমাজে বিধান অনুযায়ী তিনি ব্রাত্য বা পতিত হন। সেই থেকে তিনি জীবনে অনেক উপেক্ষার শিকার হয়েছেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ পাননি বিদ্যাসাগর এর সঙ্গে পড়াশোনা করেও রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এর শিক্ষক ছিলেন তার পিতার দুই পুত্রের অকাল মৃত্যুর পর বিহারীলালের জন্ম তারপর তিনি সংস্কৃতি ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে মেধাবী ছাত্র হয়ে ওঠেন অল্প বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেন কৃষ্ণ কমল এর বড় ভাই কবিকে নতুন কবিতা লেখার জন্য উৎসাহ দিতেন তার বয়স যখন ১৯ বছর তখন বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন তিনি।
তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজে তিন বছর অধ্যয়ন করেন। উনিশ বছর বয়সে অভয়া দেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। অল্পকাল পরে অভয়া দেবী মারা গেলে কাদম্বরী দেবীকে বিবাহ করেন।
রচনা সমগ্র।
            তাঁর রচনাবলীর মধ্যে স্বপ্নদর্শন, সঙ্গীত শতক (১৮৬২), বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০), নিসর্গসন্দর্শন (১৮৭০), বন্ধুবিয়োগ (১৮৭০), প্রেম প্রবাহিনী (১৮৭০), সারদামঙ্গল (১৮৭৯), মায়াদেবী, ধুমকেতু, দেবরাণী, বাউলবিংশতি, সাধের আসন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। পূর্ণিমা, সাহিত্য সংক্রান্তি, অবোধবন্ধু ইত্যাদি তার সম্পাদিত পত্রিকা। সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন।

            সারদামঙ্গল কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ কাব্য। আখ্যানকাব্য হলেও এর আখ্যানবস্তু সামান্যই। মূলত গীতিকবিতাধর্মী কাব্য এটি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কাব্য সম্পর্কে লিখেছেন, “সূর্যাস্ত কালের সুবর্ণমণ্ডিত মেঘমালার মত সারদামঙ্গলের সোনার শ্লোকগুলি বিবিধরূপের আভাস দেয়। কিন্তু কোন রূপকে স্থায়ীভাবে ধারণ করিয়া রাখে না। অথচ সুদূর সৌন্দর্য স্বর্গ হইতে একটি অপূর্ণ পূরবী রাগিণী প্রবাহিত হইয়া অন্তরাত্মাকে ব্যাকুল করিয়া তুলিতে থাকে।” সমালোচক শিশিরকুমার দাশের মতে, “মহাকাব্যের পরাক্রমধারার পাশে সারদামঙ্গল গীতিকাব্যের আবির্ভাব এবং শেষপর্যন্ত গীতিকাব্যের কাছে মহাকাব্যের পরাজয়ের ইতিহাসে সারদামঙ্গল ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ কাব্য।

তাঁর লেখা  বিখ্যাত চরণ -

সর্বদাই হু হু করে মন,
বিশ্ব যেন মরুর মতন।
চারি দিকে ঝালাফালা।
উঃ কী জ্বলন্ত জ্বালা,
অগ্নিকুণ্ডে পতঙ্গপতন।

তাঁর প্রথম স্বার্থক গীতিকাব্য বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০)।
স্বপ্নদর্শন (১৮৫৮)
সঙ্গীতশতক (১৮৬২)
বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০)
নিসর্গ সন্দর্শন (১৮৭০)
বন্ধুবিয়োগ (১৮৭০)
প্রেমপ্রবাহিনী (১৮৭০)
সারদামঙ্গল (১৮৭৯)
সাধের আসন (১৮৮৯)
মায়াদেবী (১৮৮২)
ধূমকেতু (১৮৮২)
নিসর্গসঙ্গীত (১৮৮২)
বাউল বিংশতি (১৮৮৭)
গোধূলি (১৮৯৯)

১৮৯৪ সালের ২৪ মে বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত হয়ে দেহত্যাগ করেন। রেখে যান ৬ পুত্র ও ৬ কন্যাকে.

         "বিহারীলাল যদি ভাবের নেশায় মশগুল হইয়া নিজেকে বিশ্বজগৎ হইতে একেবারে একান্ত নিভৃতে আপনার ভেতরেই গুটাইয়া না লইয়া কাব্যের এই ভাষা এই কলা কৌশল সম্বন্ধে আরো একটু অবহিত হইতে পারেন তবে তাহার বিরাট কবিমন লইয়া তিনি বাংলা সাহিত্যের গগনে হয়তো আরও উজ্জ্বল নক্ষত্রের দীপ্তি পাইতে পারি তেন। "  শশীভূষণ দাশগুপ্ত।

যে গীতি প্রাণতা যা বাঙ্গালীর স্বভাব সিদ্ধ এবং যা পুরাতন কাল থেকে নানা ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যেই সাধন ভজনের গানের মধ্য দিয়ে চলে আসছিল উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে থেকে তাতে মানবিক আবেগ এর দ্বারা যুক্ত হলো এক অভূতপূর্ব মুক্তির নির্বাধ আনন্দলাভ। বিহারীলাল চক্রবর্তী সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার দেবেন্দ্রনাথ সেন অক্ষয় কুমার বড়াল কবি দ্বিজেন্দ্রনাথ স্বর্ণকুমারী গিরীন্দ্রমোহিনী মানকুমারী বসু কামিনী রায় কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কবি মোশাররফ হোসেন প্রমূখ গীতিকবিতা তাদের ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতিকে পাঠকের অন্তরে সঞ্চারিত করতে চাইলেন। আবেগময় হৃদয় গত উচ্ছ্বাসে গীতিকবিতার প্রাণ এই মত ও পথ কে কাব্য কবিতার ধারায় প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন এ যেন বাংলা গীতি কবিতার ইতিহাসে বাঙালির একান্ত হৃদয় গত অনুভূতির ইতিহাস। যে প্রত্যুষে অধিক লোক জাগে নাই এবং সাহিত্য কুঞ্জে বিচিত্র কলগীত কুঞ্জিত হইয়া উঠে নাই সেই ঊষালোকে কেবল একটি ভোরের পাখি সুন্দর সুরে গান ধরিয়াছিল সে সুর তাহার নিজের। এই একান্ত সুরের সাধক বিহারীলাল চক্রবর্তী।

উল্লেখযোগ্য কয়েকটি লাইন ।
১) 
 "মধুর তোমার ললিত আকার
মধুর তোমার চাঁচা র কেশ
মধুর তোমার পারিজাত হার
মধুর তোমার মানের বেশ।।"
২) 
" তোমারি হৃদয়ে রাজে ইংল্যান্ড দ্বীপ
হয়েছে জগত- মন যাহার মাধুরী
শোভে যেন  রক্ষ  কুল উজ্জ্বল প্রদীপ
রাবণের মোহিনী কনক-লঙ্কাপুরী।।"

৩)
" আকাশে কেমন ওই
নবঘন যার
যেন কত কু-বলয়
শোভে সব গায়ে।
মধুর গম্ভীর স্বরে
ধীরে ধীরে গান করে
সুধা ধারা বরষিয়ে
রসায় বসায়।"

৪)
" আজি বিশ্ব আলো কার কিরণ নিকরে
হৃদয় উথলে কার জয়ধ্বনি করে
ক্রমে ক্রমে নিবিতেছে লোক কোলাহল
ললিত বাঁশরী তানে উঠিছে কেবল।"

৫)
" হে যোগেন্দ্র যোগাসনে
ঢুলু ঢুলু দু নয়নে
বিভোর বিহ্বল মনে কাঁহারে ধেয়াও।"



∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆


No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। অশোকবিজয় রাহা । একজন ভারতীয় বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক। তিনি রবীন্দ্র অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন বিশ্বভারতীতে দায়িত্ব পালন করেন। Dt -14.11.2024. Vol -1052. Thrusday. The blogger post in literary e magazine.

অশোকবিজয় রাহা  (১৪ নভেম্বর ১৯১০ – ১৯ অক্টোবর ১৯৯০)  সময়টা ছিল আঠারোশো উননব্বইয়ের অক্টোবর। গঁগ্যার সাথে বন্ধুত্বে তখন কেবল চাপ চাপ শূন্যতা আ...