।২৫০তম জন্মদিন।
রাজা রামমোহন রায়
মে ২২, ১৭৭২, মতান্তরে ১৭৭৪ সালে হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে রামমোহন রায় জন্মগ্রহণ করেন এক সম্ভ্রান্ত ও ব্রাহ্মণ পরিবারে। প্রপিতামহ কৃষ্ণকান্ত ফারুখশিয়ারের আমলে বাংলার সুবেদারের আমিনের কার্য করতেন। সেই সূত্রেই 'রায়' পদবীর ব্যবহার বলে অনুমান করা হয়। কৃষ্ণকান্তের কনিষ্ঠ পুত্র ব্রজবিনোদ রামমোহনের পিতামহ। পিতা রামকান্ত। রামকান্তের তিন বিবাহ। মধ্যমা পত্নী তারিণীর এক কন্যা ও দুই পুত্র : জগমোহন ও রামমোহন। এঁদের বংশ ছিল বৈষ্ণব, কিন্তু রামমোহনের মাতা ছিলেন ঘোর তান্ত্রিক ঘরের কন্যা। রামকান্ত পৈতৃক এজমালি ভদ্রাসন ছেড়ে পার্শ্ববর্তী লাঙ্গুলপাড়া গ্রামে স্ব-পরিবারে উঠে যান। তার পিতা রামকান্ত রায় ছিলেন বৈষ্ণবী এবং মাতা তারিণী দেবী ছিলেন শাক্ত। পনেরো-ষোলো বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে নানা স্থানে ঘোরেন। কাশীতে ও পাটনায় কিছুকাল ছিলেন এবং নেপালে গিয়েছিলেন। এর আগে তার সঙ্গে তন্ত্রশাস্ত্রবেত্তা সুপণ্ডিত নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কারের
যোগাযোগ হয়। রামমোহনের সংস্কৃতে ব্যুৎপত্তি, তার বেদান্তে অনুরাগ নন্দকুমারের সহযোগিতায় হয়েছিল। ব্রাহ্ম উপাসনালয় প্রতিষ্ঠায় হরিহরানন্দই তার দক্ষিণ-হস্ত ছিলেন। বারাণসী থেকে প্রথাগত সংস্কৃত শিক্ষার পর তিনি পাটনা থেকে আরবি ও পারসি ভাষা শেখেন। পরে তিনি ইংরেজি, গ্রিক ও হিব্রু ভাষাও শেখেন।
তরুণ বয়সে তিনি কলকাতায় মহাজনের কাজ করতেন। ১৭৯৬ সালে রামমোহন অর্থোপার্জন শুরু করেন। ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন। কলকাতায় প্রায়ই আসতেন এবং কোম্পানির নবাগত অসামরিক কর্মচারীদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাদের নানা বিষয়ে সাহায্য করেন। এই সুযোগে ভালো করে ইংরেজি শিখে নেন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজে সিভিলিয়ান কর্মচারীদের মধ্যে জন ডিগবির সঙ্গে তার সর্বাধিক ঘনিষ্ঠতা হয়। কোম্পানির কাজে ডিগবির অধীনে তিনি দেওয়ানরূপে রংপুরে কাজ করেন ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে তিনি দু'বার ভুটান সীমান্তে যান কোম্পানির হয়ে দৌত্যকার্যে ডিগবির সাহচর্যে তার সমস্ত নতুন চিন্তা এই সময়ের মধ্যেই পরিপক্কতা লাভ করে। ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে রামমোহন কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হন, এখন থেকেই প্রকাশ্যে তার সংস্কার-প্রচেষ্টার শুরু।
তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ফারসি ভাষায় লেখা (ভূমিকা অংশ আরবিতে) তুহফাতুল মুহাহহিদিন। বইটিতে একেশ্বরবাদের সমর্থন আছে। এরপর একেশ্বরবাদ (বা ব্রাহ্মবাদ) প্রতিষ্ঠা করার জন্য বেদান্ত-সূত্র ও তার সমর্থক উপনিষদগুলি বাংলার অনুবাদ করে প্রচার করতে থাকেন। ১৮১৫ থেকে ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে প্রকাশিত হয়
বেদান্তগ্রন্থ, বেদান্তসার, কেনোপনিষদ, ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ, মাণ্ডূক্যোপনিষদ ও মুণ্ডকোপনিষদ। রক্ষণশীল ব্যক্তিরা ক্রুদ্ধ হয়ে তার লেখার প্রতিবাদ দেখাতে লাগলেন। এই সব প্রতিবাদ কটূক্তিপূর্ণ এবং বিদ্বেষ ভাবাপন্ন। রামমোহনও প্রতিবাদের প্রতিবাদ করলেন যুক্তি দিয়ে ও ভদ্রভাষায়। প্রতিবাদ-কর্তারা অবিলম্বে থেমে গিয়েছিলেন। প্রতিবাদ-কর্তাদের মধ্যে প্রথম ও প্রধান ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, এঁর গ্রন্থের নাম 'বেদান্তচন্দ্রিকা'। বেদান্তচন্দ্রিকা'র প্রতিবাদে রামমোহন ভট্টাচার্যের সহিত বিচার লিখে প্রতিবাদীদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। 'বেদান্ত গ্রন্থ' প্রকাশের সঙ্গে তিনি ব্রহ্মনিষ্ঠ একেশ্বর উপাসনার পথ দেখালেন আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করে। এই আত্মীয় সভাকেই পরে তিনি ব্রাহ্মসমাজ নাম ও রূপ দেন। সাহেবদের বাংলা শেখানোর জন্য তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে ব্যাকরণ রচনা করেন।
১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ নভেম্বর তিনি কলকাতা থেকে বিলেত যাত্রা করেন। দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর তাঁকে 'রাজা' উপাধি দিয়ে ভার দেন বিলেতে গিয়ে রাজদরবারে বাদশাহের ভাতা বৃদ্ধির সুপারিশ করার। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ এপ্রিল রামমোহন লিভারপুলে পৌঁছলেন। সেখানে সম্ভ্রান্ত ও বিদ্বৎসমাজে তাঁর প্রচুর সমাদর হয়েছিল। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে কিছুদিনের জন্য তিনি ফ্রান্সেও গিয়েছিলেন।
রামমোহন রায় একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করতেন। এই বিশ্বাস থেকে তিনি ব্রাহ্মসমাজ ও ব্রাহ্মধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন।
রামমোহন রায় সকল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান মানতেন না ও তা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতেন। তিনি মনে করতেন সকল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়।
পারিবারিক জীবনে তিনি চোখের সামনে দেখেছিলেন তাঁর বৌদিকে আগুনে পুড়ে যেতে, প্রিয় দাদার মৃত্যুর পর। জলন্ত আগুনে বৌদিকে তুলে দেয়া হয়েছিল সতীদাহ প্রথা মেনে। মর্মাহত রামমোহন এই সামাজিক নৃশংস প্রথার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। সমাজে সমাজে পাড়ায় পাড়ায় এমনই স্বামীর মৃত্যুর পরে মেয়েদের জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারার যে পৈশাচিক নীতি এই নীতির শেষ কোথায় তিনি দেখতে চেয়ে ছিলেন। একত্রিত সংগঠিত এই প্রথার প্রতিবাদ তিনি এনেছিলেন বিভিন্ন পর্বে। এমন একটা সময় সতীদাহ প্রথা রদ করা হয়েছিল।স্মৃতিবিজড়িত সেই সতীদাহ স্থানটি এখনো ঐতিহাসিক স্থান হয়ে আছে।
তাঁর আরেকটি বড় আমুদে বিষয় ছিল তিনি আম খেতে খুব ভালোবাসতেন তাই তিনি আমাদের বাগান তৈরি করেছিলেন কমবেশি প্রায় ২৫ টি জাতের আম গাছ সহ বাগান। বিস্তৃত এই বাগানে সারা বছর ধরেই আম হত. আমের বাগান এখনও স্মৃতি বহন করে।
তিনি ব্রাহ্ম ধর্মের বিশ্বাসীও উপাসক ছিলেন। তার স্মৃতি বিজড়িত রামমোহন লাইব্রেরী নামে রাধানগরে যে গ্রামের লাইব্রেরি আছে সেই লাইব্রেরীর গঠন ধর্মনিরপেক্ষ ভাবেই তৈরি করা হয়েছে। হিন্দু-মসলিম ধর্ম মত নির্বিশেষে সবাই লাইব্রেরীর মেম্বারশিপ নিতে পারেন। এখন সকলের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে।
রামমোহন রায়ের শেষ বিলেত যাত্রা ১৮৩০ সালের ১৯ নভেম্বর খেজুরি বন্দর থেকে। কলকাতা বন্দর থেকে দ্রুতগামী ফোবর্স স্টিমারে এসে খেজুরি বন্দরে অবতরণ করেন। খেজুরি বন্দর থেকে তিনি পরের দিন ২০ নভেম্বর হাজার হাজার খেজুরি বাসর বিদায় অভিনন্দন গ্রহণ করে আলবিয়ন নামক পালতোলা জাহাজে চড়ে ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। এবং এটাই ছিল তাঁর শেষ যাত্রা। ইতিহাসের পাতা তাই বলে। খেজুরি হেরিটেজ সুরক্ষা সমিতি সেই স্মৃতির উদ্দেশ্যে খেজুরি বন্দরে রামমোহন রায়ের মর্মরমূর্তি নির্মাণ করেছেন এবং ওই দিনটি ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর বিকাল ২.০০ টায় যথোচিত মর্যাদায় পালন করে। মর্মর মূর্তির আবরণ উন্মোচন করেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী ভারত সরকার এবং কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ মাননীয় শিশির অধিকারী মহোদয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন খেজুরি হেরিটেজ সুরক্ষা সমিতির সভাপতি শ্রদ্ধেয় ড. অসীম কুমার মান্না অধ্যক্ষ খেজুরি কলেজ। সংস্থার সম্পাদক সম্মাননীয় কৃষি বিজ্ঞানী প্রাক্তন বিধায়ক প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ খেজুরি কলেজ ড. রাম চন্দ্র মন্ডল মহোদয়। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন খেজুরি বিধানসভার বিধায়ক মাননীয় শ্রী রনজিত মন্ডল মহোদয়।উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক সম্মাননীয় শান্তিরাম দাস মহোদয় বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক ডঃ প্রবাল কান্তি হাজরা লেখক সম্পাদক পার্থ সারথি দাস সুমন নারায়ন বাকরা আঞ্চলিক গবেষক সুদর্শন সেন স্বপন কুমার মন্ডল বিশিষ্ট প্রধান শিক্ষক বিষ্ণুপদ জানা প্রধান শিক্ষক কীরিটি ভূষণ মন্ডল জেলা পরিষদ সদস্য বিমান নায়ক শিক্ষক মিহির কুমার প্রধান জয়দেব মাইতি শ্যামল বাকড়া , সমুদ্ভব দাস সহ এলাকার মানুষজন এছাড়া উপস্থিত ছিলেন ওই গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত প্রধান মাননীয়া রেহেনা খাতুন। এই সংক্রান্ত বিষয়ে একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয়। যা সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন ড.বিষ্ণুপদ জানা. রামমোহন রায়ের মূর্তি নির্মাণে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছেন মাননীয় স্বপন কুমার মন্ডল মহোদয়।
রামমোহন রায় ১৮৩১ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের দূত হিসেবে যুক্তরাজ্য ভ্রমণ করেন, তিনি ফ্রান্সও পরিদর্শন করেছিলেন। ১৮৩৩ সালে মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়ে ব্রিস্টলের কাছে স্টেপল্টনে মৃত্যুবরণ করেন। ব্রিস্টলে আর্নস ভ্যাল সমাধিস্থলে তাঁকে কবর দেওয়া হয়।
১৯৯৭ সালে মধ্য ব্রিস্টলে তাঁর একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment