ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড

১৭৫১ সালের ২৫ মে লন্ডনের এক উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে হ্যালহেডের জন্ম। তাঁর পিতা উইলিয়ম হ্যালহেড (William Halhed) ছিলেন একজন ব্যাংকার। ন্যাথানিয়েল ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে। তিনি বিখ্যাত পাবলিক স্কুল হ্যারোতে (১৭৫৮-৬৮) পড়াশোনা করেন। সেখানে তাঁর যোগাযোগ হয় Richard Brinsley Sheridan, Samuel Parr এবং উইলিয়ম জোনস-এর (১৭৪৭-১৭৯৪) সঙ্গে। হ্যারো থেকে হ্যালহেড অক্সফোর্ডে গিয়ে Christ College-এ ১৭৬৮ থেকে ১৭৭০ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। সেখানে জোনসের সঙ্গে তাঁর পুনরায় সাক্ষাৎ ঘটে। জোনস তাঁকে আরবি শিখতে উৎসাহিত করেন। কিন্তু হ্যালহেড এ ব্যাপারে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি। এর পরিবর্তে তিনি বরং গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষা চর্চা করেন এবং গ্রিক ভাষায় যথেষ্ট দক্ষতাও অর্জন করেন। তিনি শেরিডনের সঙ্গে যৌথ প্রচেষ্টায় The Love Epistles of Aristaenetus শীর্ষক গ্রন্থটি গ্রিক ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে বেশ খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেন। অনুবাদ এমনই অনবদ্য ও জনপ্রিয় ছিল যে, চার বছরে গ্রন্থটির তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়।তাঁর মধ্যে এ সময় সাহিত্য-সম্ভাবনা প্রকাশ পায়, কিন্তু একটি অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার হয়ে তাঁকে দেশ ত্যাগ করতে হয়। হ্যালহেড এবং শেরিডন উভয়ই একই সময়ে Miss Linley নামে এক মহিলাকে ভালোবাসতেন। শেষাবধি এতে শেরিডনের জয় হয়। এ নিয়ে পিতার সঙ্গে হ্যালহেডের মনোমালিন্য হয়। তাই সমসাময়িক অনেকের মতো তিনিও ভগ্ন হূদয়ে সাফল্য ও শান্তির সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমান। এভাবে তিনি ১৭৭২ সালে কলকাতায় এসে পৌঁছান এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে রাইটার হিসেবে প্রাথমিক পর্যায়ের চাকরি নেন। হ্যারো ও ক্রাইস্ট কলেজের ছাত্র হিসেবে এবং সাহিত্যিক গুণের অধিকারী হওয়ার কারণে হ্যালহেড অচিরেই গভর্নর Warren Hastings-এর বন্ধুতে পরিণত হন। হেস্টিংস Westminster পাবলিক স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন এবং প্রাচ্যবিদ্যার একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। পাবলিক স্কুলে পড়াশোনা করার সুবাদে হ্যালহেডও প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার জীবন বেছে নেন। হেস্টিংসের অনুরোধে তিনি এক বিশাল আইনগ্রন্থ রচনা করেন: A Code of Gento Laws, or Ordinations of the Pundits। গ্রন্থটি ১৭৭৬ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয়। এটি মূলত হিন্দু আইনশাস্ত্রের একটি সারসংকলন, যা এগারোজন ব্রাহ্মণ পন্ডিত সংস্কৃত ভাষায় সংকলন করেন। পরে একজন মুন্সি এটি প্রথমে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন এবং সেখান থেকে হ্যালহেড ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। কাজেই এটি ছিল একটি ত্রি-স্তরীয় কাজ, যদিও প্রথম দুই স্তরের পন্ডিতদের নাম গ্রন্থে উল্লিখিত হয়নি। পরবর্তী দশকে এ গ্রন্থটির কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ফরাসি ও জার্মান ভাষায়ও এর অনুবাদ হয়। এর মাধ্যমেই বয়স তিরিশে পৌঁছার আগেই হ্যালহেডের খ্যাতি ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।

ওয়ারেন হেস্টিংসের অনুরোধে হ্যালহেড তাঁর দ্বিতীয় প্রকল্প বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনায় ব্যাপৃত হন। তাঁর A Grammar of the Bengal Language গ্রন্থটি ১৭৭৮ সালে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থ প্রকাশের পর হ্যালহেড লন্ডনে ফিরে যান এবং ১৭৮৪ সালে আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। ততদিনে কলকাতার সামাজিক দৃশ্যপট অনেকটাই পাল্টে যায় এবং হেস্টিংস কোম্পানির কোর্ট অব ডিরেক্টরদের রোষাণলে পড়েন। হেস্টিংসকে এক সময় পদত্যাগ করতে বলা হয় এবং তিনি পদত্যাগও করেন। এ ঘটনায় হ্যালহেডও চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ওই বছরই লন্ডন ফিরে যান।

দেশে ফিরে হ্যালহেড বেশ কিছু অনুবাদের কাজ সম্পাদন করেন। ১৭৮৭ সালে তিনি দারাশিকোর ফারসি অনুবাদ অবলম্বনে ইংরেজিতে উপনিষদ অনুবাদ করেন। তিনি ১৭৯১ সালে পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল বিচারে হেস্টিংসকে সহায়তা করা এবং এ কাজটি তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই করেছিলেন। কিন্তু অচিরেই ব্রিটিশ চিন্তাবিদরা হ্যালহেডের মতামতের নিরপেক্ষতায় সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেন, কারণ তিনি যোগ ও সুফি মতবাদে বিশ্বাস করতেন। বস্ত্ততপক্ষে হ্যালহেড তখন চিন্তাভাবনা করছিলেন কীভাবে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ভাবনার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা যায়। তিনি নিজেকে ঈশ্বরের দূত হিসেবে ঘোষণাকারী জনৈক Richard Brothers-কে সমর্থন করেন। এর ফলে প্রাচ্যবিদ হিসেবে তাঁর সামাজিক মর্যাদা অনেকাংশে ক্ষুণ্ণ হয়। ফরাসি বিপ্লবের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করার কারণে লন্ডনবাসীরা তাঁকে ঘৃণার চোখে দেখত। ফরাসি বিপ্লবের নীতির প্রতি তাঁর বিশ্বাস এতই গভীর ছিল যে, তিনি তাঁর সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ নিরাপত্তা ও অধিক লাভের আশায় ফ্রান্সে স্থানান্তরিত করেন। এটা তাঁর একটা নির্বুদ্ধিতার কাজ হয়েছিল, কারণ পরে তিনি তাঁর সব অর্থ হারান। 

বন্ধুবিবর্জিত ও অর্থশূন্য অবস্থায় হ্যালহেড ১৮৩০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মারা যান।


অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় 

তিনি ২৫ মে ১৯০২ জলপাইগুড়ি তে জন্মগ্রহণ করেন । খ্যাতনামা অধ্যাপক ও–সাহিত্যিক। নন-কলেজিয়েট ছাত্র হিসাবে ইংরেজীতে পদকসহ প্ৰথম শ্রেণীতে এম.এ. পাশ করেন। বি. এ. পরীক্ষায় বাংলায় প্রথম স্থান অধিকার করায় তাঁকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্কিমচন্দ্র স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। ১৯৩০ খ্রী. ‘Principles of Bengali Prosody’ গবেষণাপত্রের জন্য প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি ও মোয়াট মেডেল লাভ করেন। দুবছর এজিবেঙ্গলের অডিটর পদে নিযুক্ত থেকে পরে অধ্যাপনাকে বৃত্তি হিসাবে গ্ৰহণ করেন। ১৯২৭-৩৮ খ্রী. রংপুর কলেজে,

 ১৯৩৮-৬৫ খ্রী. কলিকাতা আশুতোষ কলেজে এবং সেখান থেকে অবসর গ্রহণের পর 

১৯৬৫-৭০ খ্ৰী. যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীর অধ্যাপক হিসাবে কাজ করেছেন। 

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক’ দ্বারা সম্মানিত হন (১৯৬৮)। ইংরেজী ও বাংলা সাহিত্য, বাংলা ও সংস্কৃত ছন্দ সম্পর্কে গবেষণামূলক প্ৰবন্ধ ও পুস্তক তিনি লিখেছেন। বাংলায় বৈজ্ঞানিক প্ৰণালীতে ছন্দ-চর্চার তিনি প্রবর্তক। বাংলা ছন্দে পূর্ব-পূর্বানুবাদের আবিষ্কর্তা। 


 রচনা কর্ম :

‘বাংলা ছন্দের মূলসূত্র’, 

‘কবিগুরু’, 

‘আধুনিক সাহিত্য জিজ্ঞাসা’,

 ‘Sanskrit Prosody, its Evolution’ প্রভৃতি।   

                এছাড়া তিনি ছোটদের জন্য মজার মজার গল্প ও বড়দের জন্য ‘বেতালভট্ট’ ছদ্মনামে রম্যরচনা লিখেছেন। শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত তাঁর রঙ্গব্যঙ্গ-রচনা ‘কাব্যের উপেক্ষিতা’, ‘আমরা ও তোমরা’, ‘পূজার ছুটি’ প্রভৃতি।

                            তিনি বেতাল ভট্ট ছদ্মনামেও লিখতেন।  এই ছন্দকবিকে আমরা খুব কমই জেনেছি। বিংশ শতাব্দির সাহিত্যিক হওয়ার পরও আমরা অনেকে তার নাম জানি না।  বাংলা কবিতার বিবর্তন নিয়ে যে ক’জন সাহিত্য সমালোচক লিখেছেন, তাদের প্রতেক্যেই অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় সর্ম্পকে আলোচনা করে গেছেন। কবিতার ছন্দ নিয়ে অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়ের লেখা সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থের নাম ‘আধুনিক সাহিত্যে জিজ্ঞাসা’। এতে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য সমালোচনা রয়েছে, প্রকারান্তরে বাংলা সাহিত্য সমালোচনাই রয়েছে। তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘মানসী’। এটি কাব্য সমালোচনার গ্রন্থ। এছাড়া অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় যে কাজটির জন্য সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও নন্দিত হয়েছিলেন, তা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে আলোচনা করা। তিনি তার ‘কবিগুরু’ গ্রন্থে এই কাজটি করেছেন। অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়ের লেখা আরো একটি বইয়ের খোঁজ পাওয়া যায়, যার নাম ‘নবাব কাহিনী ও অন্যান্য’। তার প্রতিটি বই প্রকাশ করেছেন দে’জ পাবলিশিং (ভারত)। ছন্দবিদ অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন যে, বাঙালির সহজাত আলস্যপ্রবণতার একটি জনপ্রিয় প্রকাশ জীবনানন্দের ছড়ানো অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। কথাটি অন্তত এইদিক থেকে ভাবাতে পারে, যে একটি জাতির মনের ব্যাকরণ ধরতে চাওয়া হচ্ছে একজন কবির কবিতার প্রকরণ থেকে। বিশ শতকের প্রথমার্ধেই ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয় অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়ের ‘বাংলা ছন্দের মূলসূত্র’। এর মাধ্যমে তিনি প্রচলিত ছন্দের সংযুক্তি করেন এবং কিছু যুক্তি-তর্কও উপস্থাপন করেন। বাংলা কবিতা লিখতে সাধারণত যে তিনটি ছন্দের ব্যবহার হয়, অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় এই তিনটি ছন্দেরই আলাদা নামকরণ করেছিলেন যুক্তি সহকারে। বিশ শতকে রবীন্দ্রপরবর্তী সময়ে অমূল্যধনের যে সব নামকরণ ও যুক্তি বেশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। যার কারণে তিনি ছন্দবিদ হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছিলেন। ছন্দ ছাড়া কবিতা কখনোই সম্ভব নয়। কবিতাকে একসময় পদ্য নামেই অভিহিত করা হতো। এখন অবশ্য পদ্য না বলে আধুনিক নামকরণ করা হয়েছে কবিতা। পদ্য বা কবিতার আলাদা নামকরণের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন কেউ কেউ। পদ্য কিংবা কবিতা যে নাম ধরে ডাকা হোক না কেন, উভয়ের মধ্যেই ছন্দের প্রয়োগ রয়েছে। কবিতার আধুনিক সময়ের আগ পর্যন্ত কবিতায় ছন্দ বলতে যে ধরনের ছন্দকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হতো কিংবা যে ধরনের ছন্দের বেশি প্রয়োগ হতো কবিতায়, তা আজ সেভাবে প্রয়োগ হচ্ছে না। কবিতায় সেই ধরাবাঁধা নিয়মের যে ছন্দ, সে ছন্দ থেকে কবিরা কবিতাকে মুক্তি দেওয়ার পথ খুঁজেছেন মাত্র। এখন কথা হচ্ছে, ছন্দ আসলে কী? ছন্দ হচ্ছে ঢং কিংবা রীতি। কবিতার শরীরে দোলা লাগানোর যে কায়দা, তাই মূলত ছন্দ। কবিতাকে নানান দোলায় দোলানো যায়। তেমনি কবিতায় ছন্দও নানারকমের। এই নানারকমের ছন্দ দিয়েই কবিতাকে নানান দোলায় দোলাতে হয়। কবিতায় ছন্দকে মোটামুটিভাবে ছন্দবিশেষজ্ঞরা তিন ভাগে বিবেচনা করে থাকেন। যেমন- ১। অক্ষরবৃত্ত ২। মাত্রাবৃত্ত ৩। স্বরবৃত্ত। এই নামগুলো দিয়েছেন প্রখ্যাত ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন। অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে প্রবোধচন্দ্র সেন পরে যৌগিক ছন্দ, মিশ্রকলাবৃত্ত বা মিশ্রবৃত্ত ছন্দও বলেছেন। অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় অক্ষরবৃত্ত ছন্দের নাম দিয়েছিলেন ‘তানপ্রধান’। মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় নাম দিয়েছিলেন ‘ধ্বনিপ্রধান’। স্বরবৃত্ত ছন্দকে তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘শ্বাসাঘাতপ্রধান ছন্দ’। এই তিনটি ছন্দকে নানা সময়ে নানা রকম নামে অভিহিত করা হয়েছে। এছাড়া পরে আরো দুটি ছন্দের সৃষ্টি হয়েছিল- গদ্য ছন্দ ও মিশ্রছন্দ। গদ্য ছন্দ ও মিশ্রছন্দ আসলে কবিতার মধ্যে মানুষের প্রাত্যহিক স্বাভাবিকতাকে আহরণ করারই এক-একটি উদ্যম। আধুনিক সময়ে এসে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা ছন্দে অমিত্রাক্ষর ছন্দ বা মুক্তক ছন্দের প্রয়োগ করে ইতিহাসে যুগান্তর আনলেন। এসবই অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় বা বেতাল ভট্ট পরবর্তী আবিস্কার। তাই এসব নিয়ে তার কোনো ব্যাখ্যা বা নামকরণ পাওয়া যায়নি। বর্তমানে কবিতায় যে ছন্দ বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে, তা হলো অক্ষরবৃত্ত ছন্দের প্রয়োগ। তা ছাড়া গদ্য ছন্দ ও মুক্তাক্ষর ছন্দও বর্তমান সময়ের কবিতায় ব্যবহার হতে দেখা যাচ্ছে। এভাবেই চিরাচরিতভাবে বাংলা কবিতায় ছন্দের ব্যবহার ছিল, ছন্দের ব্যবহার বর্তমানেও হচ্ছে, সুদূরেও ছন্দের ব্যবহার থাকবে বা ব্যবহার হবে। হোক না তা যে কোনো ছন্দে বা নতুন কোনো ছন্দ সৃষ্টি প্রয়োগের মাধ্যমে। বাংলা কবিতায় ছন্দ বেঁচে আছে এবং বেঁচে থাকবে। 

১৯৮৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।


=========|||||||||||||||||||||||||||||||||||========



রামকিঙ্কর বেইজ


"ছোটবেলা থেকেই বড় ইচ্ছে ছিল, যেখান দিয়ে যাব, রাস্তার ধারে ধারে মূর্তি রচনা করে চলব। সূর্যের আলো, চাঁদের আলো আর বর্ষাতুর আকাশের তলায় বড় মূর্তি দেখতে ভালো লাগে। "

            জন্ম ১৯০৬ সালের ২৫ মে। তবে তার জন্মসাল আর জন্মতারিখ নিয়ে ব্যাপক বিভ্রান্তি আছে। অনেকে ২৫ এর বদলে ২৬ মে তার জন্মদিন দাবি করেন। আবার এ-ও শোনা যায়, একবার মদ্যপ হয়ে তিনি বলেছিলেন ১৯১০ সালে তার জন্ম। তবে শান্তিনিকেতনসহ অন্য পণ্ডিতরাও ২৫ মে-কেই আধুনিক ভাস্কর্য ধারার এই পথিকৃৎ শিল্পীর জন্মদিন বলে গণ্য করেন। ২৫ হোক আর ২৬, তা নিয়ে বিতর্ক আর গবেষণায় না গিয়ে বরং একটাকে ধরে নিয়ে তার বৃহৎ জীবনের গল্পটা শুনি, চলুন। 


ব্রিটিশশাসিত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার যোগীপাড়া গ্রামে তার জন্ম। বাঁকুড়া ছিল প্রত্যন্ত গ্রাম। সেখানকার বেশিরভাগ মানুষই ছিল দিনমজুর পেশার। রামকিঙ্কর বেইজের পিতা চণ্ডীচরণ, আর মাতা সম্পূর্ণা। পিতা ছিলেন পেশায় একজন নাপিত। ক্ষৌরকর্ম ছিল তাদের পারিবারিক পেশা। চার ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ডানপিটে আর পাগলাটে স্বভাবের ছিলেন রামকিঙ্কর; বেইজ পদবী তিনি নিজে দিয়েছিলেন। পারিবারিক পদবী ছিল প্রামাণিক। শান্তিনিকেতনে তার এ নাম নিয়ে ব্যাপক ঠাট্টা-মশকরার প্রচলন ছিল। এমনকি কবি নিশিকান্ত তার নাম নিয়ে ছড়া কেটেছিলেন পর্যন্ত- 

রামকিঙ্কর প্রামাণিক,

নামটা বড়ই হারমোনিকা।

          পরবর্তী সময়ে তিনি সংস্কৃত 'বৈদ্য' আর প্রাকৃত 'বেজ্জ'-এর পরিবর্তিত রূপ হচ্ছে বেইজ পদবী জুড়ে দেন নিজের নামের সঙ্গে। প্রামাণিক পদবী সরে গিয়ে তার পরিবার পায় বেইজ পদবী। রামকিঙ্করকে অনেকেই আদিবাসী বলে থাকেন এবং মনেও করেন তাই। আদতে তিনি তা নন। মূলত আদিবাসীদের নিয়ে ব্যাপক শিল্পচর্চার কারণে মানুষের মনে এমন ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। জাতিগতভাবে তিনি একজন খাঁটি ভারতীয় বাঙালি ছিলেন। 



শৈশবেই তার ভাস্কর্যের সঙ্গে প্রেম গড়ে উঠেছিল বাঁকুড়ার কুমোরদের কাজ দেখে। তাদের মূর্তি গড়ার কাজ তাকে বেশ আনন্দ দিত। সে আনন্দের বশেই বাল্যকালেই কুমোরদের দেখাদেখি কাদামাটি দিয়ে মূর্তি গড়েছেন তিনি। সেই বালখিল্যতাই যে তাকে আজীবন সৃষ্টির আনন্দ দেবে, তা কে-ইবা জানত? রামকিঙ্কর বেইজ সুশিক্ষিত নয়, ছিলেন স্বশিক্ষিত একজন শিল্পীপড়ার কপাল নিয়ে জন্মাননি, তা যেন একদম শৈশবেই টের পেয়ে গিয়েছিলেন এই গুণী শিল্পী। যদিও জীবনের শেষ বয়সে এসে স্বীকার করেছেন যে, কেবল মার খাবার ভয়েই পড়ালেখাটা করতে হয়েছিল তার। বাড়ির পাশের অনন্ত কাকাই হয়ে উঠেছিলেন তার শিল্পগুরু। অনন্ত সূত্রধর প্রতিমা গড়ার কাজ করতেন। সে কাজে সাহায্য করতেন কিশোর রামকিঙ্কর। ভাস্কর্য গড়ার সহজপাঠ ছিল নিষিদ্ধ পল্লীর রমণীদের মূর্তি গড়ার মধ্যে দিয়ে; তাও দু’চার আনার বিনিময়ে করতেন সেসব কাজ। কিশোর বয়সেই মূর্তি গড়ার পাশাপাশি প্রচুর ছবি এঁকেছেন রামকিঙ্কর। কিন্তু ছবি আঁকতে যে সরঞ্জামের প্রয়োজন পড়ে। ক্ষৌরকর্ম করে সংসার চালানো পিতার কাছে ছিল না ছেলেকে ছবি আঁকার সরঞ্জাম কিনে দেবার মতো অর্থ। কিন্তু তা বলে কি থেমে থাকবে শিল্পীর শিল্পক্ষুধা? সবুজ রঙের জন্য শিম গাছের পাতার রস, হলুদ রঙের বাটনা বাটা শিলের হলুদ, মেয়েদের পায়ের আলতা, মুড়ি ভাজার ভুষোকালি আর পুঁইশাক থেকে বেগুনি রঙ বের করে ছবি আঁকতেন তিনি। ছাগলের ঘাড়ের লোম কেটে বাঁশের কাঠির ডগায় বেঁধে নিয়ে চলত তুলির কাজ। এর সঙ্গে চলত মূর্তি গড়ার কাজ, যা তাকে ধীরে ধীরে ভাস্কর্যশিল্পের প্রতি আগ্রহী করে তোলে না। জাতীয় কংগ্রেসের পোস্টার এঁকেছিলেন তেলরঙে, যা তাকে শিল্পের প্রতি আরো নিবিষ্ট করতে সাহায্য করেছিল। নিজের দেশে পরাধীন হয়ে থাকার যন্ত্রণা, বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ আর আত্মদান এবং নিজের ভেতরকার শিল্পীসত্ত্বার হাহাকার- এসবই তার নরম মনটাকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল বারংবার, তার অন্তরাত্মাকে করেছিল রক্তাক্ত, তাকে বাধ্য করেছিল নিজের ভাষায় প্রতিবাদ করতে; তাও সেই কিশোর বয়সেই। শিল্পীসত্ত্বা কি আর বয়সের ফারাক মানে? তার যখন আত্মপ্রকাশের ইচ্ছে, তখনই যেন দুনিয়া দেখতে বেরিয়ে পড়ে স্বেচ্ছায়। রামকিঙ্কর এর জ্বলন্ত উদাহরণ। 


প্রতিবাদ করার ঝোঁকটা তাই চেপে বসল সেই কিশোরের। হাতে তুলে নিলেন রং-তুলি। ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুললেন আন্দোলনের না-বলা আর অদেখা মুহূর্তগুলো, রং চাপিয়ে ক্যানভাসে দিলেন আন্দোলনের অভিব্যক্তি, প্রচুর বিপ্লবীদের পোর্ট্রেট করলেন। নিজের এই প্রতিবাদের ভাষাটা যে অন্যের কাছে রত্ন মনে হবে, তা জানা ছিল না তার। তবে এই রত্নকেই চোখে লেগে গেল রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের। যুগীপাড়ার রাস্তা থেকে তুলে এনে 'প্রবাসী' পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চ্যাটার্জি রামকিঙ্করকে দাঁড় করালেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সামনে। 

১৯২৫ সাল। রামকিঙ্করের বয়স তখন সবে ১৯। প্রাপ্তবয়স্কের সীমানা পেরিয়ে সদ্য উত্তাল যৌবনে পা রাখা এক যুবক। শান্তিনিকেতনে পা রেখেই যেন বুঝতে পারলেন, এতদিন এই আলকেমির সন্ধানেই ছিল তার অন্তরাত্মা। রামানন্দের সহায়তায় ভর্তি হয়ে গেলেন বিশ্বভারতীর কলাভবনে। নন্দলাল বসু এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে স্নেহধন্য হলেন।


পাঁচ বছরের অধ্যয়নপর্ব শেষ করে, ১৯৩০ সালে রামকিঙ্কর কলাভবনে যোগ দেন খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। তবে পেশাগত জীবনে পদার্পণ করেন ১৯৩৪ সালে। তখন কলাভবনের স্থায়ী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। পরবর্তী সময়ে তিনি ভাস্কর্য বিভাগের প্রধানও হয়েছিলেন। সেই চল্লিশ দশক, যখন ভারতবর্ষ উপনিবেশবাদে নিমজ্জিত। নিজের সংস্কৃতির অস্তিত্ব যখন চাবুকের আঘাতে আর ঘোড়সওয়ারের ধুলোয় লুটোপুটি খাচ্ছে। তখন শান্তিনিকেতনকে শিল্প-সাহিত্য চর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন ত্রয়ীখ্যাত রামকিঙ্কর বেইজ, নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারী মুখার্জী। তাদের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি আর নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে চিন্তাভাবনা এবং শিল্পচর্চার ফল হচ্ছে- শান্তিনিকেতনকে ভারতের শিল্প-সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা।

"দেখো বিয়ে করব, সংসার করব- এমন ইচ্ছে আমার কোনোকালেই ছিল না। আমার কেবল একটাই লক্ষ্য ছিল, সকল ধরনের ঝক্কি-ঝামেলাকে দূরে ঠেলে দিয়ে কেবল আর্টওয়ার্কের মধ্যে ডুবে থাকব; ব্যস আর কিছু চাই না আমার। এই যে এতকাল ধরে যে মূর্তি আর ছবির কাজ করেছি- সংসারধর্ম গ্রহণ করলে কি তা পারতাম? আর্টওয়ার্ক এতটাও সোজা নয়, যতটা তোমরা ভাবো। বিয়ে করার সুখ বলতে যা বোঝাও তোমরা, সেটা আমি আমার আর্টওয়ার্কের মধ্যেই পাই। হ্যাঁ, জীবনে অবশ্যই নারীর প্রয়োজন আছে। প্রকৃতির আসল লীলাই তো পুরুষ আর নারীর লীলা। জীবনে অনেক নারীই এসেছে; কেউ এসেছে দেহ নিয়ে, কেউবা মানসিক শান্তি নিয়ে। সবই হজম করেছি। কিছুই ছাড়িনি। এসবের মানেটা তোমরা ঠিক বুঝবে না। তোমরা আধুনিক আর আমরা অর্বাচীন, এই-ই পার্থক্য।"

রামকিঙ্করের সবচাইতে বিখ্যাত এবং পূর্ণাঙ্গ দুটি শিল্পকর্মের নাম হচ্ছে 'সাওতাল পরিবার' (১৯৩৮) এবং 'কলের বাঁশি' (১৯৫৬)। শান্তিনিকতনের পাশেই ছিল পিয়ার্সন পল্লী। সেখানে ছিল সাঁওতালদের বাস। তারা প্রতিদিন সকালে কাজে বের হয়ে যেত আর ফিরে আসত সন্ধ্যায়। প্রতিদিনই তাদের দেখতে পেতেন শিল্পী। এভাবে তারাও হয়ে ওঠেন রামকিঙ্করের মডেল।

শান্তিনিকেতনে তিনিই প্রথম তেলরঙের চিত্রকর্মের কাজ শুরু করেছিলেন। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা আর বিতর্কেরও শেষ ছিল না। প্রথম প্রথম তো তার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক নন্দলাল বসুও আপত্তি করেছিলেন। পরে ছাত্রের কাজের ধরন দেখে তার আপত্তি 'নেই' হয়ে যায়। পিকাসো আর সেজানের চিত্রকর্মগুলো তাকে ব্যাপক আগ্রহ জাগাত। তার চিত্রকর্মে পিকাসোর কিউবিস্ট ধারার একটা ছাপ লক্ষ করা যায়, তবে সেটা একদমই আলাদা আর স্বতন্ত্র ধারার। প্রকৃতির অপার রহস্যের প্রতি যে তার মোহ ছিল, তা বোঝা যায় তার কথাবার্তাতেই- 

"প্রকৃতিতে আমরা দুটি আকৃতি পাই, পুরুষ আর নারী। তৃতীয়টি হচ্ছে তার প্রজনী- বাচ্চা। এই অদ্ভুত আর রহস্যমাখা থিমেই তো কত শত কাজ করা যায়। কত আনন্দ; কত সৌন্দর্যের খেলা এর মধ্যে নিহিত।"

১৯৭০ সালে ভারত রাজ্য সরকার তাকে রাষ্ট্রীয় খেতাব পদ্মভূষণে ভূষিত করে। ১৯৭৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকাও তাকে সংবর্ধনা দেয়। আকাদেমির ফেলো হন পরের বছর, মানে ১৯৭৬ সালে। ১৯৭৭ সালে রবীন্দ্রভারতী তাকে দেয় দেশিকোত্তম সম্মাননা। আর ১৯৭৯ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে সম্মানজনক ডি.লিট সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।

১৯৮০ সালের ২৩ মার্চ তাকে ভর্তি করা হয়েছিল হাসপাতালে। আর একই বছরে আগস্টের ২ তারিখ তিনি পরলোকগমন করেন। 

"আমি যখন শান্তিনিকেতনে কিছু ভাস্কর্য গড়া নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম, তখন আমার মা মারা যান। মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়েও আমি দেখতে যেতে পারিনি। বড্ড খারাপ লেগেছিল। কিন্তু মায়ের মৃত্যু আমার শিল্পের ছায়াকে স্পর্শ করতে পারেনি। সবাই মারা গেছে, আমার দাদা-বোন-বাবা-মা— সবাই, সবাই।... মৃত্যু সম্পর্কে আমি সব সময়ই উদাসীন। একজন শিল্পী যতক্ষণ সৃষ্টির নেশায় মাতাল হয়ে থাকেন, ততক্ষণ পর্যন্ত মৃত্যু কোনোভাবেই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। "


 ∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆