Thursday, 3 June 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। ০৩.০৬.২০২১. Vol -392. The blogger in literature e-magazine


অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

১৯২০ সালে ৩রা জুন উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বনগাঁ মহকুমার নকফুলে গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা অক্ষয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতা চারুবালা দেবী। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে তাঁরা হাওড়ায় বসবাস করতে থাকেন। ১৯৩৮ সালে হাওড়া জিলা স্কুল থেকে বাংলায় ৭৭% নম্বর সহ জেলায় এই বিষয়ে প্রথম হয়ে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর রিপন কলেজ (অধুনা সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে আইএ পরীক্ষায় বাংলা ও আসামের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য নিয়ে বিএ ও এমএ পরীক্ষায় (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে) প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন। কলেজ জীবনেই ১৯৪১-৪২ সালে সায়গণ থেকে প্রদত্ত নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বক্তৃতাগুলো বঙ্গানুবাদ করে ফরোয়ার্ড পত্রিকায় ছাপতে থাকেন। ছাত্রাবস্থাতেই তার গল্প দেশ ও অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘নবশক্তি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৪৫ সালে এমএ পাশ করে সেই বছরেই নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। পরে রিপন কলেজে ও ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেন। উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অধ্যাপক হয়েছিলেন তিনি। ১৯৮৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন। ২০০২ সালে অন্নদাশঙ্কর রায়ের মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতির পদে আসীন হন ও আমৃত্যু সেই পদে বহাল থাকেন।তাঁর স্ত্রী হাওড়া গার্লস কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপিকা বিনীতা গঙ্গোপাধ্যায় (২৯/০১/১৯২৫ - ১৫/০৪/২০০৬) ঐতিহাসিক উপন্যাস,গল্প ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন সুকন্যা ছদ্মনামে ।

                          তাঁর বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (১০ খন্ড) বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় অবিস্মরণীয় গ্রন্থ বিশেষ করে সময়কালর প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সমালোচকদের বক্তব্য কে সামনে রেখে এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বাধিক পঠিত। ছাত্রছত্রীসহ গবেষকদের কাছে এগুলি আকর গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। এককথায় বাংলা সাহিত্যকে জানতে গেলে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত সর্বজন স্বীকৃত গ্রন্থ। 

গ্রন্থটির পরিকল্পনা এমনই -

প্রথম খণ্ড - বাংলা ভাষা সাহিত্যের উদ্ভবের পটভূমি, ইতিহাস ও চর্যাপদ, চর্যাপদ এর পর থেকে চৈতন্যদেব-এর আগে অবধি আদি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য। কৃত্তিবাস, মিথিলার বিদ্যাপতি প্রমুখদের নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে এই খণ্ডে।

দ্বিতীয় খণ্ড - ষোড়শ শতাব্দীর চৈতন্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ধারা এখানে আলোচিত। চৈতন্যদেবের জীবন, সাহিত্যে সমাজে তার প্রভাব, চৈতন্য জীবনী সাহিত্য, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস প্রমুখের বৈষ্ণবপদাবলী এখানে বিস্তারিতভাবে আলোচিত। পাশাপাশি রয়েছে মনসামঙ্গলের বিজয়গুপ্ত, নারারণদেব, বিপ্রদাস পিপলাই, চণ্ডীমঙ্গলের দ্বিজ মাধব, মুকুন্দ চক্রবর্তী প্রমুখের আলোচনা।

তৃতীয় খণ্ড - এর প্রথম পর্বে রয়েছে সপ্তদশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের আলোচনা। কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল, দৌলত কাজী সৈয়দ আলাওলের মত মুসলিম কবিদের লেখা প্রণয়কাব্য ও অনুবাদ সাহিত্য, কাশীরাম দাসের মহাভারত নিয়ে আলোচনা পাওয়া যাবে এইখানে।

দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম পর্বের বাংলা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। রামপ্রসাদ, কমলাকান্তের শাক্ত পদাবলী বা ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর নিয়ে আলোচনা এখানে পাওয়া যাবে।

 চতুর্থখণ্ড - এই খণ্ডে আলোচিত বিষয়বস্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পর্ব থেকে ঊনিশ শতকের প্রথম পর্ব পর্যন্ত আখড়াই, হাফ আখড়াই, কবিগান ইত্যাদি প্রসঙ্গ।

পঞ্চম খণ্ড - প্রায় হাজার পাতার সুবিশাল এই খণ্ডটি বাংলা গদ্যের আদিপর্বের ইতিহাস সম্পর্কে এখনো অবধি শ্রেষ্ঠ কাজ। বাংলা গদ্যের প্রাক উনিশ শতকীয় বিভিন্ন নিদর্শন নিয়ে আলোচনার পর পর্তুগীজদের লেখা বাংলা গদ্য, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকদের লেখা গদ্য গ্রন্থ নিয়ে অজস্র অজানা অচেনা তথ্যকে তিনি মহাফেজখানা খুঁড়ে বের করে এনেছেন।

ষষ্ঠ খণ্ড - এই খণ্ডে রামমোহন সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য, বাংলা সাংবাদিকতা ও সাময়িক পত্রের উদ্ভব বিকাশের ইতিহাস পাওয়া যাবে।

 সপ্তম খণ্ড - এই খণ্ডের কেন্দ্রীয় চরিত্র অবশ্যই মাইকেল মধুসূদন ও বিদ্যাসাগর। ঈশ্বর গুপ্ত এবং মহাকাব্যযুগের রঙ্গলাল, হেমচন্দ্র, নবীন চন্দ্রও এখানে আলোচিত হয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর নামে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থও রয়েছে অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

অষ্টম খণ্ড - এই খণ্ডের কেন্দ্রীয় চরিত্র বঙ্কিমচন্দ্র। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাংলা সাহিত্যের পরিচয় রয়েছে এখানে।

নবম খণ্ড - বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন লেখকেরা এখানে আলোচিত হয়েছেন।

দশম খণ্ড - এই খণ্ডটি লিখতে লিখতে অসিত বাবু অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং প্রয়াত হন। রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাহিত্যের আলোচনাটুকুই কেবল এখানে পাওয়া যাবে। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি অন্য গ্রন্থ অবশ্য আগে প্রকাশিত হয়েছিল। সাহিত্য সমালোচক রবীন্দ্রনাথ নিয়ে সেখানে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

এছাড়া তিনি রচনা করেছিলেন - 
       প্রাচীন বাঙালি ও বাংলা সাহিত্য, উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্য, উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ ও বাংলা সাহিত্য , সমালোচনার কথা , উনিশ - বিশ, সাহিত্য জিজ্ঞাসা রবীন্দ্রনাথ, বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর, শরৎ প্রসঙ্গ ও অন্যান্য প্রবন্ধ, দুই নারী ও তিন নায়িকা , কমলাকান্তের বঙ্গদর্শন ,ঊনিশ শতকের আলো শ্রীরামকৃষ্ণ ও   শ্রীরামকৃষ্ণ সংঘ, বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতা, হাওড়া শহরের ইতিবৃত্ত, চিন্তা- বিচিন্তা, ছাত্র সমাজের প্রতি আহবান স্মৃতি-বিস্মৃতির তর্পনে, স্মৃতির উজান প্রভৃতি।
   এই ছাড়াও রয়েছে তাঁর সম্পাদিত বহু গ্রন্থ ।আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান রচনা তিনি নিয়োজিত ছিলেন। 
     বিশেষ করে তার স্বচ্ছ সুন্দর স্বাভাবিক প্রকাশ নৈপুণ্য সবাইকে আকৃষ্ট করত।  প্রতিভার এই মহৎ গুণে তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে হয়ে উঠেছিলেন একজন স্বনামধন্য প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক। দীর্ঘদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুনাম ও খ্যাতির সঙ্গে শরৎচন্দ্র অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বহু প্রতিভাধর ছাত্র-ছাত্রী তৈরি করে তিনি আদর্শ শিক্ষক হয়ে উঠেছেন অসীম ধৈর্য শ্রম নিষ্ঠা অধ্যাবসায় ও পাণ্ডিত্য তার অন্যতম চারিত্রিক গুণাবলী। 


পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতিত্ব করা ছাড়াও তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গবেষক ছিলেন। একাধিকবার সম্মেলন উপলক্ষে ও অতিথি-অধ্যাপনার জন্য বিদেশেও গিয়েছেন। ১৯৮১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক বুদ্ধমহাভাব মহাসম্মেলনে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ সালে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসাবে ভাষণ দেন। চিন্তাবিদ ও গবেষক হিসাবে একাধিক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। 

    ২১ শে মার্চ, ২০০৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆


No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। অশোকবিজয় রাহা । একজন ভারতীয় বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক এবং সমালোচক। তিনি রবীন্দ্র অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘদিন বিশ্বভারতীতে দায়িত্ব পালন করেন। Dt -14.11.2024. Vol -1052. Thrusday. The blogger post in literary e magazine.

অশোকবিজয় রাহা  (১৪ নভেম্বর ১৯১০ – ১৯ অক্টোবর ১৯৯০)  সময়টা ছিল আঠারোশো উননব্বইয়ের অক্টোবর। গঁগ্যার সাথে বন্ধুত্বে তখন কেবল চাপ চাপ শূন্যতা আ...