""বর্ষে-বর্ষে দলে-দলে আসে বিদ্যামঠতলে,
চলে যায় তারা কলরবে,
কৈশোরের কিশলয় পর্ণে পরিণত হয়
যৌবনের শ্যামল গৌরবে |
ভালোবাসি, কাছে ডাকি, নামও সব জেনে রাখি,
দেখাশোনা হয় নিতি-নিতি,
শাসন-তর্জন করি শিখাই প্রহর ধরি,
থাকেনাকো, হায়, কোনো স্মৃতি!
ক-দিনের এই দেখা— সাগর সৈকতে রেখা
নূতন তরঙ্গে মুছে যায় |
ছোট-ছোট দাগ পার ঘুচে যায় একাকার
নব-নব পদ-তাড়নায় |""
(সংক্ষিপ্ত )
কালিদাস রায়।
১৮৮৯ সালের ২২ জুন বর্ধমান জেলার কড়ুই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন চৈতন্যদেবের জীবনীকার লোচনদাসের বংশধর। কালিদাসের শৈশব কেটেছিল মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে। সেখান থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি শিক্ষকতার বৃত্তি গ্রহণ করেন। কলকাতার ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালে টালিগঞ্জে 'সন্ধ্যার কুলায়' নামক নিজস্ব বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কালিদাস রায়।
১৯১৩ সালে রংপুরের উলিপুর মহারানী স্বর্ণময়ী হাইস্কুলের সহশিক্ষক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়। পরে ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন সাত বছর। তারপরে (১৯২০-৩১) দক্ষিণ চবিবশ পরগনার বড়িশা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করার ১১ বছর পর রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেনের সহায়তায় তিনি কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনের ভবানীপুর শাখায় সহকারী প্রধান শিক্ষকরূপে যোগদান করেন এবং ১৯৫২ সালে অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।তিনি রবীন্দ্র-ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে তিনি কাব্যচর্চা শুরু করেন। এরপরে কবিতা, ছোটগল্প, রম্য সাহিত্য ইত্যাদি রচনা করেন। 'বেতালভট্ট' ছদ্মনামে লিখিত বহু রসরচনা পাঠক সমাজে সমাদৃত ।
কাব্য
- কুন্দ(১৯০৭),
- পর্ণপূট (১৯১৪ প্রথম খন্ড,১৯২১ দ্বিতীয় খন্ড),
- ব্রজবেণু(১৯১৬),
- বল্লরী(১৯১৫),
- ক্ষুদকুঁড়া(১৯২২),
- লাজাঞ্জলি(১৯২৪),
- রসকদম্ব(১৯২৩),
- হৈমন্তী(১৯৩৫),
- বৈকালী(১৯৪০),
- গাথাঞ্জলি(১৯৫৮),
- সন্ধ্যামণি(১৯৫৮),
- পূর্ণাহুতি(১৯৬৮),
- দিন ফুরানোরর গান(১৯৮৪),
- তথাগত (১৯৯৪)।
প্রবন্ধ
- পদাবলী সাহিত্য,
- প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্য পরিচয়,
- সাহিত্য প্রসঙ্গ,
- প্রাচীন বঙ্গসাহিত্য,
- শরৎ সাহিত্য
- চনক সংহিতা
- চালচিত্র
- রঙ্গচিত্র
শিশু সাহিত্য
- গাথাঞ্জলি(১৯৬১),
- গাথাকাহিনী(১৯৬৪),
- তৃণদল(১৯৭০),
- গাথামঞ্জরী(১৯৭৪),
- মণীষী বন্দনা(১৯৭৬),
- গাথাবলী(১৯৭৮)।
পল্লীপ্রকৃতি তাঁর কবিতায় ঘুরে ফিরে এসছে। তিনি তাঁর "স্মৃতিকথা'য় লিখেছেন,
"কেবল পল্লীর আবেষ্টনী ও পল্লীর নরনারীর আচরণই যথেষ্ট নয়, পল্লীর চোইন্যব্যথা, পাপ্তাপ, অনাচার, সরলতা সমস্তই আমার চিত্তকে বিচলিত করত। ...গ্রামের উৎসব পার্বণের মধ্যে আমি প্রাথমিক উপাদান-উপকরণ পেয়েছি।'
"পল্লীবধু' কবিতায় লিখেছেন,
উঠান ছাড়িয়া না উঠিতে রোদ ঘরের পৈঠা 'পরে,
কলস ভরিয়া জল লয়ে কেবা স্নান করে ফিরে ঘরে ?
কিংবা "আহরণ' কবিতায় লিখেছেন,
বাংলার দীঘি গভীর শীতল কবির স্বপ্নে ঘড়া
ছলছল কল জল চঞ্চল মাতৃমমতা ভরা।
রঙ্গব্যঙ্গের কবিতায়ও তিনি যথেষ্ঠ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, "নেশাখোরের অভিধান' কবিতায় তিনি লিখেছেন,
গাঁজা খেলে গেঁজেল' যদি, মদ খেলে হয় "মাতাল,
নস্যি নিলে "নেসেল' তবে, চা-খোরেরা "চাতাল'
প্রমথনাথ বিশী তাঁর কবিতার সমালোচনা করে লিখেছিলেন,
"কবিশেখর পাঠ্যপুস্তকের কবি নন, বাংলা কাব্যের একটি চিরন্তনী ধারাশ্রয়ী এ যুগের একজন Major বা প্রধান কবি, রবীন্দ্রপ্রভাব সত্বেও যিনি চিরকাল নিজ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন।'
রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ পড়ে "কাঁচা হাতের লেখা' বলে সমালোচনা করেছিলেন কিন্তু পরে লিখেছিলেন,
"তোমার কবিতা বাংলাদেশের মাটির মতোই স্নিগ্ধ ও শ্যামল। বাংলাদেশের প্রতি গভীর ভালোবাসায় তোমার মনটি কানায় কানায় ভরা।'
সাহিত্যকর্মের অবদানের জন্য কালিদাস অনেক সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। তিনি রংপুর সাহিত্য পরিষদ ‘কবিশেখর’ উপাধি (১৯২০), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ (১৯৫৩) ও ‘সরোজিনী স্বর্ণপদক’, বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ (১৯৬৩) এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি (১৯৭১) প্রদান করেন।
তিনি ১৯৭৫ সালের ২৫ অক্টোবর কলকাতায় মারা যান।
কবিতা।
শরতে
ছুটির খবর এসেছে আজ নীল আকাশের পথে !
ও ভাই ছুটী – ছুটী – ছুটী,
আয়না – চোখে দেখনা – ওকে অরুণ আলোর রথে
সোনা – ছড়ায় মুঠি – মুঠি !
তরু লতায়, পাখীর নীড়ে, হর্ষে জড়াজড়ি
সারং – বাজছে বনে বনে,
নূতন নূতন পোষাক পরে’ মেঘ আকাশের পরী
কেমন – সাজছে খনে খনে |
খবর আসার আগেই এল গুপ্ত সুড়ং ধরি’
ছুটী – আজ যে মনে মনে,
কে জানালো ফুলকলিদের, ফুট্ ল কানন ভরি’
যারা-করত ফুটি-ফুটি–
ও ভাই – ছুটী – ছুটী – ছুটী |
কোণা হতে আয় বেরিয়ে সোনা কুড়াই ভাই,
আয় – গায়ে মাঠে মাঠে,
বাতাবি-বন মাতাবি-কে ? শিউলি বোঁটা চাই ?
আয়-বনের বাটে বাটে |
ঢেউয়ের তালে দুবল আজি, কলার ভেলা বাই,
আয় – নদীর ঘাটে ঘাটে,
কাশের বনে হাঁসেন সনে কণ্ঠ ছেড়ে গাই,
আয় – করব লুটোপুটি
ও ভাই – ছুটী – ছুটী – ছুটী |
চাইনা মোরা পায়ে জুতো – চাইনা মাথায় ছাতা,
বনে – ঘুরবো ছায়ে ছায়ে,
সাঁতার কেটে দীঘির জলে মুছব না আজ মাথা,
রোদে – শুকাক্ বায়ে বায়ে |
ফেলবো ছুঁড়ে আজকে শেলেট অঙ্ক কষার খাতা
তারা – লুটুক পায়ে পায়ে,
সরল-ভূগোল, নীতিকুসুম, ধারাপাতের পাতা
ছিঁড়ে – করব কুটি কুটি
ও ভাই – ছুটী – ছুটী – ছুটী |
আয়না সবাই দেখনা ও ভাই কে ওই অরুণ রথে
সোনা – ছড়ায় মুঠি – মুঠি |
ছুটির খবর পেয়েছি আজ নীল আকাশের পথে
ও ভাই – করব ছুটোছুটি —
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment