Monday, 28 June 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। গোকুল চন্দ্র নাগ। ২৮.০৬.২০২১. VOl -417 The blogger in literature e-magazine.


গোকুলচন্দ্র নাগ


জন্ম কলকাতায় ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ শে জুন। পিতা মতিলাল নাগ মাতা কমলা দেবী। আদি পৈত্রিক নিবাস ছিল বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. কালিদাস নাগ তাঁর অগ্রজ। শৈশবেই মাতৃপিতৃহীন হয়ে মানুষ হন মাতুলালয়ে গোঁড়া ব্রাহ্ম পরিবারের আবহাওয়ায়। অতি অল্প বয়সে চিত্রাঙ্কন ও সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। কৃতি ফটোগ্রাফার ছিলেন তিনি।


, গোকুল তখন স্কুলের ছাত্র। নাগদের পৈতৃক নিবাস ছিল অক্রুর দত্ত লেনে। মতিলালের ছিল তিন পুত্র ও দুই কন্যা - বিভাবতী (মিত্র), কালিদাস, গোকুলচন্দ্র, প্রভাবতী (মিত্র) ও রামচন্দ্র।  পিতৃমাতৃহীন গোকুলচন্দ্র মামা বিজয় বসুর কাছে মানুষ হতে থাকেন।গোকুলচন্দ্রের পড়াশোনা বেশীদূর এগোয় নি। ছোটবেলা থেকেই তার স্বাস্থ্য ভাল ছিল না। সাউথ সুবার্বন স্কুলে পড়েছেন, কিন্তু পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়ায় প্রধান শিক্ষকের বকুনি খেয়ে পড়া ছেড়ে দেন। ঘাটশিলায় কিছুদিন পড়ার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছু হয় নি। ছবি আঁকার দিকে গোকুলচন্দ্রের ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই, তারই রেশ ধরে তিনি সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। তখন ছবি আঁকার পেশাকে খুব ভাল চোখে দেখা হত না, মামা বিজয় বসুও খুব সন্তুষ্ট ছিলেন না। আর্ট স্কুলেই গোকুলচন্দ্রের সঙ্গে শিল্পী অতুল বসু, যামিনী রায় ও ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। পার্সি ব্রাউন ও যামিনীপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে তিনি ছবি আঁকা শিখেছিলেন। আর্ট স্কুলের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ছবি এঁকে কিছু কিছু রোজগার করতে থাকেন, তবে তা সামান্যই।


১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রত্নতত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধীনে ভারতীয প্রত্নতত্ব বিভাগের ওয়েস্টার্ন সার্কেলে কাজে যোগ দেন গোকুলচন্দ্র, কিন্তু ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য কাজ ছেড়ে দিতে হয়। গোকুলচন্দ্রের মামা বিজয় বসুর ভাই সুরেন বসুর নিউ মার্কেটে একটি ফুলের দোকান ছিল; সেখানে সকালে বসতেন সুরেন বাবু আর বিকালে ভার নিতেন গোকুলচন্দ্র। কেনা বেচার সময় যখন ফুল টানাটানি হত গোকুলচন্দ্র তখন বুকে ব্যাথা অনুভব করতেন। অচিন্ত্যকুমার লিখেছেন -"যে দোকান নিয়ে বসেছে সে ব্যবসা করতে বসে নি এমন কথা কে বিশ্বাস করতে পারত? কিন্তু সেদিন একান্তে তার কাছে এসে অনুভব করলাম, চার পাশের এই রাশিকৃত ফুলের মাঝখানে তার হৃদয়ও একটি ফুল। আর সে ফুলটি সে অকাতরে বিনামূল্যে যে কারুর হাতে দিয়ে দিতে প্রস্তুত।" এ থেকেই গোকুলচন্দ্রের মনের কিছুটা পরিচয় মেলে। ফুলের দোকানে কাজের মাঝেই চলতে থাকে ছবি আঁকার কাজ। তেল রঙের পোর্ট্রেট ছিল তার সবচেয়ে বেশি প্রিয়। সুদূর বম্বে ও পুণা থেকে অর্ডার পেতেন গোকুলচন্দ্র।


সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ থাকলেও গোকুলচন্দ্র তখনও তাতে মন দিতে পারেন নি। ফুলের দোকানে ফুল কিনতে আসা দীনেশরঞ্জনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। গোকুলচন্দ্র, দীনেশরঞ্জন দাশ, মণীন্দ্রলাল বসু ও সুনীতি দেবীকে নিয়ে তৈরী হয় 'ফোর আর্টস ক্লাব'। গোকুলচন্দ্রের মামাবাড়ি ছিল আলিপুর চিরিখানায়; তারাই প্রাঙ্গণে বসেছিল ক্লাবের প্রথম সমাবেশ। প্রত্যেকের একটি করে মোট চারটি গল্প নিয়ে বই প্রকাশিত হয়েছিল 'ঝড়ের দোলা'। এর মধ্যে গোকুলচন্দ্রের লিখিত গল্পের নাম ছিল 'মাধুরী'। চিত্র, সাহিত্য, সঙ্গীত ও অভিনয়-এই চারটি ক্ষেত্রেই গোকুলচন্দ্রের প্রবেশ ঘটেছে। তিনি বেহালা খুব খারাপ বাজাতেন না। দীনেশরঞ্জন দাশ বন্ধু গোকুলচন্দ্র সম্বন্ধে লিখেছেন -"কণ্ঠস্বর খুব সুন্দর না হইলেও তাহার গানে এমন একট গম্ভীর সুর ধ্বণিয়া উঠিত যে, তাহাতে শ্রোতার মনকে একান্ত আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিত। গোকুল যখন বেহালা বাজাইত তখন ও অত্যন্ত মনযোগের সহিত বাজাইত। বাজাইতে বাজাইতে গায়কের মুখের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাইয়া থাকিত।"


গোকুলচন্দ্র কিছুদিন অভিনয়ের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। Photo Play Syndicate of India নামে একটি সিনেমা কোম্পানী গড়ে উঠেছিল; উদ্যোগক্তারা ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী, প্রফুল্ল ঘোষ, কানাইলাল দাশ প্রমুখ ব্যক্তিরা। এই প্রতিষ্ঠানের একমাত্র নির্বাক চিত্র 'সোল অফ এ স্লেভ' বা 'বাঁদীর প্রাণ' খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের তক্ষশীলার প্রণয় কাহিনীকে উপজীব্য করে তৈরী হয়েছিল। নায়ক 'ধর্মপালে'র ভূমিকায় ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী আর সহচর 'বাহুসেন' হয়েছিলেন গোকুলচন্দ্র। চলচ্চিত্রে তিনি সম্ভবতঃ আর অভিনয় করেন নি, তবে মাঝে মাঝে নাট্যাভিনয়ে অংশ গ্রহণ করেছেন।

চিত্র, সঙ্গীত বা অভিনয়ের জন্য নয় গোকুলচন্দ্র স্মরণীয় থাকবেন তার প্রকাশিত 'কল্লোল' পত্রিকার জন্য। চিরাচরিত গণ্ডী ও অনুশাসন উপেক্ষা করে বাংলা সাহিত্যে 'আধুনিকতা'র প্রবেশ ঘটে 'কল্লোলে'র হাত ধরেই। এ জন্য পত্রিকাটিকে কম সমালোচনা সহ্য করতে হয় নি। ১৩৩০ বঙ্গাব্দের বৈশাখে প্রকাশিত হয় পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা। তার নাম সহ-সম্পাদক হিসাবে থাকলেও সজনীকান্তের মতে গোকুলচন্দ্রই ছিলেন 'আসল কর্ণধার'। লেখা যোগাড় করা, প্রুফ দেখা, প্রচ্ছদ পরিকল্পনা, চিঠিপত্র লেখা ইত্যাদি কাজে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হত গোকুলচন্দ্রকে। তার স্বাস্থ্য কোনদিনই ভাল ছিল না। ১৯২৫-এর শুরু থেকেই অবিরাম জ্বরে ভুগতে থাকেন। যক্ষারোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। রোগমুক্তির আশায় তাকে দার্জিলিং-এ নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর তিনি পরলোকে যাত্রা করেন।


গোকুলচন্দ্র বেঁচেছিলেন মাত্র ৩১ বছর। তার মধ্যে কঠিন জীবন সংগ্রামে, জীবিকা অর্জনের চেষ্টায় তিনি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। সাহিত্যানুরাগী হলেও খুব বেশী লেখা তিনি লিখে যেতে পারেন নি। 'প্রবাসী' পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে; যেমন - 'শিশির' (আষাঢ়, ১৩২৬) ; 'বাতায়ন' (মাঘ, ১৩২৬) ; 'দুই সন্ধ্যা' (চৈত্র, ১৩২৬)। 'ভারতবর্ষ', 'ভারতী', 'নব্যভারত' পত্রিকাতেও তিনি লিখেছেন। তার রচিত গ্রন্থ -


(১) 'ঝড়ের দোলা' (১৯২২)। 'ফোর আর্টস ক্লাবে'র চারজনের চারটি গল্প নিযে বইটি রচিত হয়। গোকুলচন্দ্র লিখেছিলেন 'মাধুরী' গল্পটি।

(২) 'রাজকন্যা' (১৯২২)। টেনিসনের লেখা 'দি প্রিন্সেস' অবলম্বনে ছোটদের জন্য রচিত বই।

(৩) 'রূপরেখা' (১৯২২)। 'মালিনী', 'শিশির', 'বাতায়ন', 'জলছবি', 'মা', 'আলো', 'ছায়া', 'দুই সন্ধ্যা', 'পুজারিণী', 'অনন্ত' ও 'আশা' - এই দশটি রচনা গ্রন্থবদ্ধ হয়ে 'রূপরেখা' প্রকাশিত হয়। এই লেখাগুলি 'প্রবাসী', 'ভারতবর্ষ', 'নব্যভারত' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

(৪) 'সোনার ফুল' (১৯২২)। এটি 'বঙ্গবাণী' পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, শেষের কযেক অধ্যায় বাদ দিযে। কারণ হিসাবে লেখক নিজেই বলেছেন -"কারণ তাতে যা লেখা আছে তা মাসিক পত্রে ছাপবার উপযুক্ত নয়, এবং অনেকে বলেছেন যে ও ভাবে লেখা অন্যায়, ওতে "নীতির কোন আভাস নেই", এবং "কুরুচির" প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ওতে সমাজের বিশেষ ক্ষতি হতে পারে।" ... ইত্যাদি। এ থেকেই কিছুটা আঁচ করা যায় 'কল্লোল' তখন কেন এত কলরোল তুলেছিল।

(৫) 'পরীস্থান' (১৯২৪)। মেটারলিঙ্কের 'ব্লু বার্ড' নামক নাটকের কিছু নির্বাচিত অংশ নিয়ে ছোটদের জন্য রচিত হয়েছে এই গন্থটি।

(৬) 'পথিক' (১৯২৫)। এই উপন্যাসটি 'কল্লোল' পত্রিকায় ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা (১৩০০ বঙ্গাব্দ, বৈশাখ) ২য় বর্ষ ৭ম সংখ্যা পর্যন্ত (১৩৩১-এর জ্যৈষ্ঠ ও আশ্বিন বাদে) ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৫ খ্রীষ্টাব্দে।

(৭) 'মায়ামুকুল' (১৯২৭)। তিন খণ্ডে মোট ১৯টি গল্প নিয়ে এই গ্রন্থটি রচিত। লেখকের মৃত্যুর সময় এটি প্রকাশের কাজ চলছিল। সম্পূর্ণ গ্রন্থটি গোকুলচন্দ্র দেখে যেতে পারেন নি।


অকালে বিদায় নেওয়া গোকুলচন্দ্রের সম্বন্ধে তার অভিন্নহৃদয় বন্ধু 'কল্লোল'-সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ লিখেছেন -"তাঁর চেহারায় অগ্রজ কালিদাসের মত জৌলুস ছিল না। তাঁর ছিল বেহালা-বাজিয়ের মত লম্বা চুল, চোখে সেকেলে চশমা, শরীর বেশ দুর্বল, স্বাস্থ্য বরাবর খারাপ। সব সময় মুখে থাকত সিগারেট, কথা বলতেন কম। দূর থেকে দেখলে কেমন যেন দাম্ভিক মনে হত। কিম্বা নিরাসক্ত উদাসীন। সেই উদাসীনতা কতকটা নিস্তেজ শরীর ও স্বপ্নাভিলাষের দান। কিন্তু কাছে গেলে পাওয়া যেত একটা উত্তপ্ত সান্নিধ্য, কণ্ঠস্বরে অন্তরঙ্গতা।"


যে স্বপ্ন গোকুলচন্দ্র দেখেছিলেন, তা হয় ত পূরণ হয় নি; তবে যতদিন 'কল্লোল' পত্রিকা সাহিত্যের জগতে সজীব থাকবে ততদিন গোকুলচন্দ্রের মৃত্যু নেই।


∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

No comments: