Saturday, 31 July 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। মুন্সি প্রেম চাঁদ। ৩১.০৭.২০২১. Vol -450. The blogger in literature e-magazine




মুন্সি প্রেম চাঁদ


হিন্দী কথাসহিত্যের এখনাে পর্যন্ত একজন গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসাবে সর্বশ্রেষ্ঠ আসনের অধিকারী । তার ভাষা অত্যন্ত সহজ ও সরল কিন্তু লেখনী বলিষ্ঠ । কথাশিল্পী হিসাবে প্রেমচন্দ তাঁর উপন্যাস এবং গল্পগুলিতে নির্ভীকচিত্তে সমাজের সকল অন্যায় – অত্যাচার , অনাচার , দুর্নীতি , ভণ্ডামি , কুসংস্কার , ধনী ও বিত্তবানদের চালিয়াতি , অনৈতিকতা , অসততা এবং সমাজের দুর্বল ও দরিদ্রশ্রেণীর লােকদের উপর তাদের শােষণের ব্যাপারটি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে প্রাঞ্জল ভাষায় প্রকাশ করে দিয়েছেন । উন্মােচন করেছেন প্রতারক , ভণ্ডদের মুখােশ । 

জন্ম -ধনপত রাই ৩১ জুলাই ১৮৮০লামহি, বাণারস , উত্তর প্রদেশ। মুন্সী আজয়ীব রায় বাবা বাবা ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মী । অনন্দী দেবী মা।মুন্সী প্রেমচন্দের ছেলেবেলা সুখ – দুঃখের মধ্যেই কেটেছিল । আট বছর বয়সে মা মারা গেলেন । মায়ের শােক কাটতে না কাটতেই বাবা আবার বিয়ে করলেন । সৎ মায়ের সঙ্গে শিশু প্রেমচন্দের সম্পর্ক সুমধুর ছিল না । ছেলেবেলায় তার নাম ছিল ধনপত । ডাক নাম নবাব । প্রেমচন্দ নামটি পরবর্তীকালে সাহিত্য সৃষ্টির সময় গ্রহণ করেন । সাত বছর বয়সে এক মৌলবীর পাঠশালায় ভর্তি হলেন প্রেমচন্দ । কিছুক্ষণ পড়াবার পর ছাত্রদের ছেড়ে দিতেন । মৌলবীর সাথে ছাত্রদের সম্পর্ক ছিল অর্থ উপার্জনের সম্পর্ক স্কুল পালিয়ে বেরিয়ে পড়তেন প্রেমচন্দ ।কিছুদিন পর বাবা স্কুলে ভর্তি করে দিলেন প্রেমচন্দকে । তার যখন পনেরাে বছর বয়স সে সময় তার বাবা ছেলের বিয়ে দিলেন । কিছুদিনের মধ্যে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন । বাড়িতে বৌ , সত্য আর দুটি সৎ ভাই । কোনও রােজগার ছিল না । বাবাকে সুস্থ করা গেল না । তিনি মারা গেলেন । সংসারের সব গুরু দায়িত্ব এসে পড়ল তার উপর । বাবার মৃত্যুর জন্য সেই বছর পরীক্ষায় বসতে পারলেন না । পরের বছর দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করলেন । আর্থিক অনটন ও অঙ্কের পরীক্ষায় ফেল করার জন্য কোনও কলেজেই ভর্তি হতে পারলেন না।এক উকিলের বাড়িতে ছেলে পড়াবার কাজ পেলেন । মাইনে পাঁচ টাকা । নিজে দু’টাকা রেখে বাড়িতে তিন টাকা পাঠাতেন । অর্ধেক দিন তার খাওয়া জুটত না । শীতকালেও কষ্ট পেতেন । 

পরে এক ছােট স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে তার পরিচয় হয় । তিনি তাকে আঠারাে টাকা বেতনের শিক্ষকের চাকরি নিজের স্কুলে দিলেন । স্কুলটি ছিল বারাণসী থেকে চল্লিশ মাইল দূরে চুনাৱে । এই শান্ত , নিরীহ মানুষটির মধ্যেই ছিল সাহস ও তেজ। পরে কুইনস কলেজের প্রিন্সিপাল মিঃ বেকনের সাহায্যে একটি সরকারী স্কুলে শিক্ষকতা পেয়ে গেলেন।  দাম্পত্য সঙ্গী -শিবরাণি দেবি সন্তান-  অমৃত রাই। প্রেমচন্দের সজ্ঞা ছিলেন রাগী আর বদমেজাজী । তাকে এড়িয়ে চলার জন্য বাবা বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকতেন । দিদির বিয়ের পর প্রেমচন্দ নিঃসঙ্গ হয়ে গেল । তার জীবনে একমাত্র আনন্দ ছিল বাবার বদলি জীবন । কৈশাের জীবনের এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে তিনি নানান রচনায় প্রকাশ করেছেন । 

বাবা সারাদিন কাজ কর্ম করতেন । আর প্রমচন্দ নিজের মত ঘুরে বেড়াতেন । বই পড়ার নেশা ছিল প্রেমচন্দের । উর্দু ভাষায় যেসব উপন্যাস প্রকাশিত হত তা পাবার সাথে সাথে পড়ে ফেলতেন । 
প্রেমচন্দের সাহিত্য জীবনের সূচনা কিশাের বয়স থেকে । কুড়ি বছর বয়সে উর্দুতে একটি ছােট উপন্যাস লিখলেন — আসরার ঈ মাবিদ ( মন্দিরের রহস্য ) । উপন্যাসটি অসমাপ্ত ছিল । একটি ছােট পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়েছিল । 

অল্পদিনেই’কল্পনা আর রােমান্স – এর পরিবর্তে তার লেখায় ফুটে উঠতে থাকে সৃজনশীল সাহিত্য । মানুষের বাস্তব জীবনের সুখ – দুঃখ আশা – আকাঙ্খ ফুটে উঠেছে তার লেখায় প্রতি ছন্দে ছন্দে । তার জীবনের শৈশব , কৈশাের , যৌবন ছিল কঠোর সংগ্রামের । চরম দারিদ্র আর অভাবের মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছেন জীবনের কঠিন রূপ । সমাজের উপর তলার মানুষদের চেয়ে নিচু তলার মানুষরাই তাকে বেশি আকৃষ্ট করত । সেই তার রচনায় যে বাস্তবতার প্রকাশ দেখা যায় , ভারতীয় সাহিত্যে অন্য কারাে রচনায় তা দেখা যায় না । 

বিশ্বসাহিত্যে ম্যাক্সিম গাের্কির সাথে তাকে তুলনা করা যায় । 

উল্লেখযোগ্য কর্ম -    গোদান, নির্মলা, বাজার-এ-হুস্ন, কর্মভূমি, শাতরাঞ্জ কে খিলাড়ি, গাবান, ঈদ্গাহ। 


মুন্সী প্রেমচাঁদ উর্দু ও হিন্দি সাহিত্যের স্বনামধন্য কথাশিল্পী। তার আসল নাম ধনপত রায়। তবে মুন্সী প্রেমচাঁদ নামেই তিনি পরিচিত। তাকে জীবনবাদী সাহিত্যিক বলা হয়। হিন্দি সাহিত্যে ‘উপন্যাস-সম্রাট’ হিসেবে খ্যাত প্রেমচাঁদকে আধুনিক হিন্দি সাহিত্যের জনক বলেও অভিহিত করা হয়। ১৯১০ সালে বড়ে ঘরকী বেটি প্রকাশিত হলে উর্দু সাহিত্যে তিনি স্থায়ী আসন লাভ করেন। তার সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস গোদান । তার প্রায় যাবতীয় সাহিত্যকর্ম বাংলা ভাষায় অনূদিত ও বহুল পঠিত।
 কর্মজীবন - হিন্দি ভাষার বঙ্কিমচন্দ্র বলা হয়।
১৯০৭ সালে এক বাল্য বিধবার জীবন কাহিনি নিয়ে লেখা উপন্যাস – ‘ প্রেমা ’ রচনা করলেন । ছােটগল্প ছাড়া দুটি উপন্যাস লিখেছিলেন । বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দ মঠ অনুসরণে জছবা – ঈ – ঈশার ( বরদান ) । অন্যটি বাজার ঈ — হুসন ’ ছিল পতিতা বৃত্তি কিভাবে সমাজকে কলুষিত করে তারই জীবন্ত ছবি । 

মুন্সী প্রেমচন্দের কতকগুলি স্মরণযােগ্য উপন্যাস হলাে — গােদান , কয়াকল্প , নির্মলা , প্রতিজ্ঞা , সেবাসদন , প্রেম – আশ্রম , রাঙ্গভূমি , কর্মভূমি এবং মানসসরােবর । মানসসরােবর বৃহদায়তন উপন্যাস । মােট আট খণ্ডে প্রকাশিত হয় । 
মুন্সী প্রেমচন্দের ছােট গল্প বিখ্যাত ছােট গল্প সংকলন ‘ মজ -ঈ – ও তান ’ ( মাতৃভূমির কথা ) । ইংরেজ সরকারের অত্যাচার -অবিচারের বিরুদ্ধে তার সমস্ত অভিব্যক্তি মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে এই রচনায় । এর একটি বিখ্যাত গল্প হল ‘ অমূল্য রত্ন । 

এই বই প্রকাশের সাথে সাথে ইংরেজ সরকারের নজর পড়ল তার এই বই – এর উপর । তার এই বইয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল । তিনি সুস্বাস্থের অধিকারী ছিলেন না । তিনি গভীরভাবে সাহিত্য রচনার কাজে মনােনিবেশ করতে থাকেন । সারাদিন স্কুলে পড়াতেন । বিকেল বেলায় বাড়ি ফিরে সন্ধ্যে বেলায় একটু বিশ্রাম নিয়ে লিখতে বসতেন । সংসারের প্রতি কর্তব্যচ্যুত হন নি । সমস্ত কাজে ছিল শৃঙ্খলাবােধ । 
স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে একটি পত্রিকায় সম্পাদকের চাকরি পেলেন । তাকে সাহায্য করার মত বিশেষ কেউ ছিল না । কাজের চাপ এত বেশি ছিল যে লেখার মত শারিরিক শক্তি থাকত না । বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়ে দিলেন । বারাণসীতে তার একটি ছােট প্রকাশনা সংস্থা ছিল । প্রথমে হংস ’ পরে জাগরণ ’ নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করেন । কিছুদিনের মধ্যেই অর্থের অভাব অনুভব করলেন । 

এত সমস্যার মধ্যেও লেখক প্রেমচন্দ নিজেকে হারিয়ে ফেলে নি । রাতে সমস্ত দৈনন্দিন সমস্যা ভুলে তার মধ্যে জেগে উঠত এক লেখক সত্তা । সমস্ত রাত ধরে তিনি লিখতেন । প্রেমচন্দ লেখালিখি ছাড়াও মর্যাদা এবং ‘ জাগরণ ’ নামক জাতীয় সাময়িক পত্রিকা সম্পাদনা করেন । এছাড়া তিনি হংস ’ নামে নিজেও একটি সাময়িক পত্রিকা বের করেছিলেন । 

প্রেমচন্দকে যশ , খ্যাতি প্রভাবিত করতে পারে নি । তিনি নিজেকে কখনাে বিখ্যাত হিসাবে প্রচার করতে চান নি । সরলতা ছিল তার চরিত্রের একটি বড় গুণ । এই কারনে তিনি সাহিত্যিক হিসাবে নন , ব্যক্তি হিসাবেও মানুষের কাছ থেকে পেয়েছেন শ্রদ্ধার আসন। 

কর্মভূমি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তিনি হিন্দি সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত লেখক হয়ে উঠলেন । প্রথমে উর্দু ভাষায় রচনা করলেও পরে হিন্দিকেই সাহিত্য সাধনার মাধ্যম করেন । বৃহত্তর সমাজের নির্যাতিত মানুষইর্তার কাছে ছিল একান্ত আপন জন । সাধারণ মানুষের প্রতি তার গভীর ভালবাসাই তাকে করে তুলেছিল বাস্তববাদী । তার চিন্তা ভাবনায় সাম্যবাদী আদর্শের প্রকাশ ঘটেছে । তিনি পরে প্রগতিশীল লেখক শিল্পী সংঘের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং এই সংঘের প্রথম অধিবেশন লক্ষ্মেীতে বসেছিল । 

আত্মজীবনীমূলক একটি উপন্যাস রচনার কাজে হাত দেন মঙ্গল সূত্র ’ এই উপন্যাসটি সমাপ্ত করে যেতে পারেন নি প্রেমচন্দ । তার পূর্বেই তার মৃত্যুবরণ করতে হয় । মুন্সী প্রেমচন্দ ১৯৩৬ সালে ৮ ই অক্টোবর ৫৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।


∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

Friday, 30 July 2021

বিশেষ আলোচনা। বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতিতে পোষা প্রাণী। ৩০.০৭.২০২১. VOL-449 The blogger in literature e-magazine.


                          প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দের্যের লীলাভূমি আমাদের এই বাংলাদেশ। বাংলার প্রকৃতি, বাংলার প্রাণী, বাংলার মানুষ সবর্দাই সর্বকালেই বহু কবি সাহিত্যিকদের আকৃষ্ট করেছে। বাঙালি সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের সাথে প্রাণী ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে আছে। প্রাণীজগতে বৈচিত্র্যের শেষ নেই। তবু মানুষের কল্পনায়, ভাবনায় আর সাহিত্যের পাতায় বারবার ফিরে আসে এমন কিছু জীবজন্তুর নাম, যাদের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ আছে। তবুও দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য উপন্যাসে নানা অচেনা জীবজন্তুর ছড়াছড়ি। সাহিত্যের পাতা থেকে উঠে আসা এসব জীবজন্তু নিয়ে সারা বিশ্বের মানুষের রয়েছে অগাধ কৌতূহলও। এদের কেউ জ্ঞানের প্রতীক, কেউবা জয়ের। এদের মধ্যে কেউ যেমন বন্ধুবৎসল, কেউবা বেশ ভয়ঙ্কর। এরা সহজে ধরা দেয় না, লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতেই ভালবাসে। পৃথিবীর প্রায় সব সংস্কৃতিতেই এদের উপস্থিতি বেশ লক্ষণীয়। গ্রিক সাহিত্যে, পারস্য উপকথায়, চীনা লোকগাঁথা থেকে শুরু করে বিশ্বের প্রাচীন সব সভ্যতার নানা কাহিনীতে সন্ধান পাওয়া অচিন এক প্রাণীজগতের। যেমন- গ্রিক সাহিত্যে হাইড্রা নামের দানব, গালিভার'স ট্রাভেলসের লিলিপুট, লর্ড অব দ্য রিংসের ড্রাগন ইত্যাদি।

শরৎচন্দ্রের মহেশ

চিরায়ত সাহিত্যে 

ইতিহাসের শুরু থেকে  প্রাণী নানা কাজে সহায়ক এবং সহযোগী বলে মানুষের কথায়, কাজে, আচরণে, গল্পে-শিল্পে, ধর্ম-দর্শন-বিজ্ঞান-সাহিত্যসহ সব কায়িক এবং মানসিক, চিন্তাশীল ও সৃজনশীল কাজে এসব প্রাণীর কথা আছে। প্রাচীন ইহুদি ধর্মে উট এবং গরুর কথা বিশেষভাবে রয়েছে। মানুষের ধর্মের অংশ হিসাবে এসব প্রাণী সম্পর্কে কোথাও কৃতজ্ঞতাপ্রসূত প্রশংসা রয়েছে, আবার কোথাও মিথহিসাবে ট্যাবু বা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে উপস্থিত আছে। রামায়ণ, মহাভারত, বেদ, গীতা, পিটক, জাতক, বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট, নিউ টেস্টামেন্ট, কোরআনসহ প্রাচীন প্রায় সমস্ত ধর্মগ্রন্থে জীববৈচিত্র্য রয়েছে।

নন্দলাল বসু

বাংলাসাহিত্যে প্রাণী

প্রাচীন ও মধ্যযুগে

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদে কাক, কোকিলসহ অনেক প্রাণীর কথা কবিরা উল্লেখ করে গেছেন। এর পরে মধ্যযুগের সাহিত্যের প্রায় সবগুলো ধারায় প্রাণীর কথা আছে। মনসামঙ্গল তো সাপ নিয়েই লেখা। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলকাব্যে অনেক প্রাণীর কথা আছে। এ কাব্যটি বিচিত্রজীবের প্রতি প্রেম নিয়েই শুরু হয়। কালকেতু এবং তার স্ত্রী ফুল্লরা নির্বিচারে প্রাণীহত্যা করতে থাকলে অসহায় প্রাণীকুল দেবী চণ্ডীর শরণাপন্ন হলে দেবী মনুষ্যজগতে এসে গ্রামভিত্তিক জীবন থেকে নগর প্রতিষ্ঠা করে নাগরিকজীবনে উত্তরণের পথ নির্দেশ করেন। মুসলমান লেখকদের লেখায় ঘোড়া, উটসহ অনেক প্রাণীর কথা আছে। কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার বর্ণনায় ইমাম হোসেনের প্রিয় ঘোড়া দুলদুলের করুণ ঘটনা আছে।

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মানুষের পাশাপাশি অন্য প্রাণীর কথাও আছে। উনিশ শতকের লেখার মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শকুন্তলা' অনুবাদ হলেও সেখানে শকুন্ত পাখির কাছে বড় হওয়া এক নারীর কথা বলা হয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর কাব্যে অনেক প্রাণীর কথা লিখেছেন। এর মধ্যে 'তপসী মাছ', 'পাঁঠা' ইত্যাদি বিখ্যাত হয়ে আছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাসের জনক, তবে তিনি ছোটগল্প লেখেননি। নকশাজাতীয় লেখা লিখেছেন। 'কমলাকান্তের দপ্তরে' কমলাকান্তের আহার সরবরাহকারী মঙ্গলা নামের একটি গাভীর কথা আছে, বিড়াল নামে একটি রচনাও আছে। প্যারীচাঁদ মিত্রের রচনায় বিড়ালের কথা আছে। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের রচনায় ঝিনুক, বাঘ, ছাগলসহ অনেক প্রাণীর কথা আছে। মীর মশাররফ হোসেনের 'বিষাদসিন্ধু'তে আরবভূমির উট, ভেড়া, ঘোড়াসহ অনেক প্রাণীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এখানেও হোসেনের দুলদুল ঘোড়ার করুণ বর্ণনা আছে।

ছোটগল্প

বাংলা ছোটগল্প উনিশ শতকের শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে পূর্ণতা লাভ করে। বিশ শতকে এসে তা রবীন্দ্রনাথ এবং পরবর্তী কালের প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, জগদীশ গুপ্ত, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (বনফুল) প্রমুখের সযত্নপ্রয়াসে বিশ্বসাহিত্যমানের এবং বিচিত্র হয়ে ওঠে। এ ধারা দেশ বিভাগের পরেও প্রবহমান থাকে। দেশবিভাগের আগে পর্যন্ত কলকাতাকেন্দ্রিক লেখকদের রচনাই এদেশে প্রাধান্য পেত। দেশ বিভাগের পরে পাকিস্তানি আমল থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য ঢাকা এবং কলকাতা দুটি প্রধান শহরকে কেন্দ্র করেই উৎকর্ষতা লাভ করে। তবে দুই বাংলাতেই তরুণ লেখকরা কেন্দ্র ভেঙে নিজ নিজ অবস্থান থেকে রচনা করছেন উন্নত এবং বিচিত্র সাহিত্যকর্ম। বিভাগপূর্ব এবং পরবর্তীকালের উভয় বাংলার ছোটগল্পে জীববৈচিত্র্য সযত্নে স্থান লাভ করে। লেখকদের লেখনীতে এসব প্রাণী পায় যত্ন সহানুভূতি, প্রেম এবং নানা রকম আবেগ। চিত্রায়িত হয় বিজ্ঞানসম্মতভাবে এবং চরিত্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। তাদের ব্যক্তিত্বও গড়ে ওঠে। এদের মধ্যে কিছু রচনা মূলত রূপক হিসাবে লেখা। এগুলোতে প্রাণীকে প্রধান চরিত্র করা হলেও তারা লেখকের আঙুলের ইশারায় অন্য কিছু বোঝাতে চায়। যেমন, হাসান হাফিজুর রহমানের 'একজোড়া পাখি', হাসনাত আবদুল হাইয়ের 'সোয়ালো', হাসান আজিজুল হকের 'শকুন', আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'যুগলবন্দি' সৈয়দ শামসুল হকের 'জেসমিন রোড, ইত্যাদি।

আধুনিক বাংলা ছোটগল্পে প্রাণী: আধুনিক বাংলা ছোটগল্পে আলোচিত প্রাণীবৈচিত্র্যের কয়েকটি শ্রেণি দেখা যায়। যেমন, গৃহপালিত চতুষ্পদী স্তন্যপায়ী পশু ও পাখি, বন্য পশু এবং পাখি, সরীসৃপজাতীয় প্রাণী এবং কীট-পতঙ্গ।

গরু

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'সুভা' গল্পের সুভা একজন বাকপ্রতিবন্ধী মেয়ে। সে তার মতোই অবলা এবং ভাষাহীন দুটি বোবা প্রাণী গাভীর সঙ্গে বেড়ে ওঠে। 
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'মহেশ' কালজয়ী গল্প। 

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প 'বুধীর বাড়ি ফেরা'। 

'কোরবানী' মাহবুব উল আলমের গল্প। এখানে গৃহপালিত একটি গরুর সঙ্গে মানবহৃদয়ের অচ্ছেদ্য বন্ধনের কথা রয়েছে। সত্যেন সেনের 'লাল গরুটা'। নিধিরাম তার বুড়ো গাভীটা বেঁচতে গেলে ছেলে বিশুসহ পরিবারের সবাই অবোধ প্রাণীটার মায়ায় কান্নাকাটি শুরু করে। বনফুলের গল্প 'অংকের বাইরে'তে মঙ্গলা নামের গাভীটা দুইমাস বয়সে মাকে হারানোর পরে অনেক কষ্টে বড় করে তুলেছেন লেখক। বড় হওয়ার পরে অনেকেই বলেছিল বেচে দিতে। কিন্তু লেখক ওকে বেশি ভালোবাসতেন।

ছাগল

পরশুরামের 'লম্বকর্ণ' গল্পে বংশলোচন বাবু খালের পাড়ে বিকালে হাওয়া খেতে গিয়ে একটা বেওয়ারিশ ছাগল পান।

মোষ

পরশুরামের গল্প 'রাজমহিষী'। তিনটি বাড়ির বিনিময়ে একটি গৃহপালিত পশুকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা গল্পটিতে জীবপ্রেমকে মহৎ করেছে। তারাশঙ্কর বন্ধ্যোপাধ্যায়ের 'কালাপাহাড়'ও একটা মোষ নিয়ে রচিত গল্প। বনফুলের 'বুধী' গল্পটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা।

ঘোড়া

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প 'লাল ঘোড়া'। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ে 'গবিন সিংয়ের ঘোড়া' গল্পটিতে একটি প্রবীণ ঘোড়ার মর্মাস্তক ঘটনা রয়েছে।

নন্দলাল বসুর আঁকা হাতি

হাতি

'সৈনিক'  নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের রচিত একটি গল্প। এ গল্পে মূল চরিত্র একটি হাতি লালনপালন করতেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গল্প 'আদরিণী'। অভাবের সংসারে নাতনীকে বিয়ে দেওয়ার জন্য হাতিটি বিক্রি করতে হয়।

কুকুর

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গল্প 'কুকুর ছানা।' লন্ডনপ্রবাসী শরৎকুমার বাগচী শীতের হিমরাতে একটি কুকুরছানা কুড়িয়ে পেয়ে পাঁচ মাস লালনপালন করে। পরে আসল মালিককে বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চেন ছিঁড়ে সে চলে আসে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্প 'দেওঘরের স্মৃতি'। অসুস্থ লেখক হাওয়া বদলের জন্য দেওঘরে যাওয়ার পরে বাড়ির সামনে একটি বেওয়ারিশ কুকুরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে এবং ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। বনফুলের গল্প 'বাঘা'র নায়ক একটি ভীরু, রুগ্ন এবং দুর্বল কুকুর। মোহাম্মদ নাসির আলীর 'কুকুর ছানার কাণ্ড' গল্পে লেবুমামা ঢাকা শহরে গিয়ে বাটপারের পাল্লায় পড়ে সাতটাকা দিয়ে একটা কুকুর ছানা কিনে মহাবিপদে পড়ে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের 'সাপ' গল্পের অন্যতম চরিত্র রেনি নামের একটা কুকুর। গল্পের নাম সাপ হলেও কুকুরটার কথাই মুখ্য। 

আবু কায়সারের গল্প 'লুৎফর রহমানের কুকুর'। মুক্তিযুদ্ধের সময় পদ্মপুর শহরে পাঞ্জাবি সৈন্য আর দেশী রাজাকারদের বাজার লুট করার সময় লুৎফর বস্ত্রালয়ে সমরাস্ত্র দিয়ে আঘাত করার সময় লুৎফর রহমানের কুকুরটি সৈন্যদের রিবুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। সৈন্যদের গুলিতে সে প্রাণ হারায় কিন্তু পালানোর চেষ্টা করে না।

মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে আরেকটি কুকুরের গল্প পাওয়া যায় আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখা 'যুদ্ধ নয়'। এটিতে 'জন' নামের একটি কুকুরের মুখে যুদ্ধ এবং জটিল রাজনীতির বর্ণনা দেওয়ায় কুকুরটি তার চারত্রিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে।

হ‌ুমায়ূন আহমেদের 'কুকুর' একটি পরাবাস্তব গল্প। নিষ্ঠুর কিশোরদের হাত থেকে একটা কুকুরকে বাঁচাতে জামান সাহেব আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। 

বিড়াল

রম্যলেখক শিবরাম চক্রবর্তী বিড়াল নিয়ে অনেকগুলো গল্প লিখেছেন। প্রায় সবগুলো লেখকের উত্তমপুরুষে লেখা। এর মধ্যে একটি 'অথ আয়োডিন ঘটিত'। এটিও হাসির গল্প। এ গল্পে লেখক বিড়াল একেবারেই দেখতে পারেন না। 

'বেড়ালের বই' লীলা মজুমদারের একটি গল্প নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বই। বইটি বিড়াল নিয়ে। তবে কোনো একটি বিড়াল নিয়ে না। প্রথমে লেখকের ছোটবেলার পাহাড়ী শহরের একটি হুলো বিড়ালের কথা লিখেছেন। এর পরে কলকাতা বসবাসের সময়কার আরেকটা বিড়ালের বর্ণনা। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের 'একটা দুটা বেড়াল'। 

বানর

বনফুলের 'তিনটি'নামের গল্পটি বানর নিয়ে লেখা।

হনুমান
 

বনফুলের 'পূর্বপুরুষের কাণ্ড' গল্পটি হনুমান নিয়ে। হনুমানের উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে অন্যের পরামর্শে লেখক মদ খাইয়ে হনুমানকে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন। 

শেয়াল

লীলা মজুমদারের 'কুঁকড়ো' গল্পটা ভিন্ন ধরনের। প্রথমে দেখা যায় মোরগের জন্য গল্পের সবার মনে করুণা জাগে। একদিন দেখা যায় তীরবেঁধা একটা শেয়াল বাড়িতে এসে মরে পড়ে আছে। মৃত মা-শেয়ালটির কোলে একটা ছোট্ট ফুটফুটে শেয়ালছানা। দুধের বাচ্চাটির জন্য সবার হৃদয়ে করুণা জেগে ওঠে। এ গল্প পড়েই মনে হয়, 'জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর' কথাটা কত সত্য।

মোরগ

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প 'ইদুমিয়ার মোরগ'। শওকত ওসমানের গল্প 'রাতা'। এ গল্পে দাদি আর নাতির মধ্যে একটা মোরগ নিয়ে মানসিক লড়াই চলে।

বিনোদবিহারী চৌধুরী

হাঁস

বনফুলের 'হাঁস' গল্পে অধ্যাপক পিতার ছেলে অনার্স পাস করে মিলিটারিতে যাওয়ার আশায় বাবার কাছে আবদার করে। বাবা মিলিটারিতে যাওয়ার আগে হাত পাকানোর জন্য ছেলেকে একটু বন্দুক কিনে দেন। ছেলে বন্দুক নিয়ে হাঁস শিকারে বেরোয় বন্ধুকে নিয়ে। বাদাড়ের মধ্যে সরোবরে একটা বড় শুভ্র হাঁস গুলি করে আহত করে বাড়ি আনে। রাতে দেখা যায় হাঁসটা নেই। ঘরে সরস্বতীর প্রতিমাচিত্রের হাঁসটাও নেই। রাত্রে সে স্বপ্ন দেখে। কয়েকদিন পরে আসামের শিলচরে ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর মিলিটারি গুলি চালায়। ছেলে ঘৃণায় মিলিটারিতে যোগদান না করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে যায়।

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'হাঁস' গল্পে হাঁসশিকারী দুই বন্ধুর কথা বলা হয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে লোভের পরিণাম।

কাক

বনফুলের গল্প 'কাকের কাণ্ড'তে স্বর্ণগর্ভা জননী বাড়িতে অসময়ে কাকের ডাককে অমঙ্গল বিবেচনা করে কাকে তাড়াতে গিয়ে পিছল উঠানে পড়ে গিয়ে ব্যথা পান।

পেঁচা

পরশুরাম ওরফে রাজশেখর বসুর 'লক্ষ্মীর বাহন' গল্পে মুচকুন্দ রায়ের বাড়িতে জানালা দিয়ে একটি পেঁচা চলে আসার পরে গিন্নি তাকে আদর যত্ন করে পোষে। 

চন্দনা

অচিন্ত্যকুমার সেন গুপ্তের গল্প 'তাজমহল'। স্বামী-সন্তান নাতি-নাতি-নাতনি সবার নিষেধাজ্ঞার মুখে বিমলা একজোড়া চন্দনা পাখির ছানা পুষে বড় করেন। 

কোকিল

বনফুলের 'পাখীদের মধ্যে' গল্পটিতে দেখা যায় কোকিল ছানা তার বাবার পাশে বসে থাকে। কিন্তু বাবা তাকে খাওয়ায় না। সে কাকের বাসায় জন্মনেওয়া কোকিলসন্তান। তখন মা কাক এসে তাকে ঠোঁটের মধ্যে ঠোঁট পুরে খাবার খাওয়ায়। নিত্যদিনের  চিরচেনা দৃশ্য নিয়েই গল্পটি লেখা। 

শালিক

বনফুলের 'এক ঝাঁক খঞ্জন' গল্পে কবি শুকদেব জানেন শালিককে সংস্কৃত ভাষায় সারিকা বলা হয়। এই সারকিা নিয়ে সংষ্কৃত সাহিত্যে কত গল্প আছে। সেই সাহিত্যের টানেই শালিকের প্রতি তার আকর্ষণ জন্মেছে। 

বনফুলের আরেকটি গল্প 'দ্বিতীয় শালিকটি'। বিহারের মেয়ে নন্দিনী সোম। সে দেখেছে জীবনে যতবার একটা শালিক দেখেছে ততবারই অলক্ষ্মীর ঘটনা ঘটেছে। আর জোড়া শালিক দেখলে শুভসংবাদ আসে। 

বাঘ

মণীন্দ্রলাল বসুর গল্প 'ডায়না'র প্রধান চরিত্র ডায়না নামের একটি সার্কাসের বাঘ। 

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বাঘিনী'তে মানুষ খেকো বাঘিনীকে হত্যা করার পরে দেখা যায় একটি অরণ্যচারী কিশোর মৃত বাঘিনীকে জড়িয়ে কাঁদে।

ভালুক

ভালুক নিয়ে শিবরাম চক্রবর্তী একাধিক হাসির গল্প লিখেছেন। দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'ভাবা'(ভালুক+বালক) সিরিজ উপন্যাসও রচনা করেছেন। শিবরামের দুটি গল্পের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে একটির 'আমার ভালুক শিকার।

নন্দলাল বসু

সাপ

কাজী নজরুল ইসলামের 'পদ্মগোখরা' গল্পটি পরাবাস্তব। মীর পরিবারের পুত্রবধূ জোহরা একজোড়া পদ্মগোখরা সাপকে বাস্তুসাপ হিসাবে নিয়মিত দুধ খাইয়ে পোষে। 

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নারী ও নাগিনী'তে খোঁড়া শেখ নামের বেদে ইটের ফাঁকে একটি সাপিনী পেয়ে তাকে পেশাগত এবং সখ্যতায় আপন করে নেয়। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গল্প 'বাস্তুসাপ'। হ‌ুমায়ূন  আহমেদের গল্প 'বেবি রুথ'। লেখকের যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসকালে একই বাড়ির বাসিন্দা সত্তর বছরে প্রবীণা এলিজাবেথ এন্ডারসন অজগর সাপ কিনে এনে পোষেন। 

গিনিপিগ

'পিগ মানে শুয়োরছানা' গল্পে শিবরাম চক্রবর্তী হাস্যরসাত্মক ভাষায় লিখেছেন, ব্রিটিশ আমলের আমলাতন্ত্র কতটা জটিল ও কঠিন ছিল। রেলওয়ের ডাকে একাজোড়া গিনিপিগ পাঠানো হলে প্রাপক তা গ্রহণ করতে গিয়েছিলেন।

এ ছাড়া কীট-পতঙ্গ নিয়েও বাংলায় ছোটগল্প লেখা হয়েছে। আবু ইসহাকের 'জোঁক', 'মহাপতঙ্গ,' বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের 'নারায়ণী সেনা'য় পিঁপড়া, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'টিকটিকি', প্রেমেন্দ্র মিত্রের মশা, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মশা, বনফুলের গল্প 'পোকা', হ‌ুমায়ূন আহমেদের 'পোকা' উপন্যাসে তেলাপোকা ইত্যাদি।  বাংলা ছোট গল্প এসব প্রাণী নিয়ে ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে। এদেশের লেখকদের মানুষের অতিরিক্ত প্রাণীবৈচিত্র্যের প্রতি আবেগ ও আগ্রহ প্রকাশ পায়। এসব গল্প শিশু-কিশোর-তরুণসহ সব বয়সী পাঠকের মনে শুধু সাহিত্যরসই সঞ্চার করে না; প্রাণীর প্রতি বিশেষ মনোযোগ স্থাপনে যত্নবান হতে সাহায্যও করে। 

চিত্তবিনোদনে এবং সৌখিনতায় প্রাণী

পোষা প্রানী সেই আদিম কাল থেকে মানুষের জীবনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে  ভাবে জড়িয়ে আছে। পোষা প্রাণী বলতে আমরা বোঝাতে চাচ্ছি সেই সব প্রাণী যা মানুষ শখের বশে লালন পালন করে। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ তার একাকীত্ব থেকে মুক্তি পেতে পোষা প্রানীকে বেছে নিয়েছে। পোষা প্রাণী হিসেবে কুকুর এবং বিড়াল খুবই জনপ্রিয়। এছাড়াও খরগোশ, হ্যামস্টার, সাদা ইঁদুর, গিনিপিগ ও কিছু সরীসৃপ যেমন কাছিম ও পালন করা হয়। 

এছাড়াও বাসা-বাড়ি, অফিস সাজানোর কাজে বিভিন্ন অ্যাকুয়ারিয়াম, গাছ লাগানো হয়ে থাকে। শহরের বিনোদনের একটি অন্যতম স্থান চিড়িয়াখানা, সাফারি পার্ক। এসব স্থান ছোট বড় সকলের বিনোদনের একটি চরম উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন উৎসবের ছুটিতে এসব স্থানে ভীড় করেন সকলে, ক্লান্তিময় জীবনে সামান্য স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে।

ব্যক্তিত্ব বিকাশে  প্রাণী

ছোটোবেলা থেকেই আমরা আমাদের মা, নানা-নানীর, দাদা-দাদির কাছে গল্প শুনে বড় হই। এসব গল্প মুলতই রূপকথার গল্প। রূপকথার গল্পে অসংখ্য পশু পাখির বর্ণনা জানতে পারি। খান মুহাম্মদ মইনুদ্দিনের "কানা বগীর ছা", কিংবা সুকুমার বড়ুয়ার "এমন যদি হতো আমি হতাম প্রজাপতি" রজনীকান্ত সেনের স্বাধীনতার সুখ ছড়ায় বাবুই পাখি আর চড়ুই পাখির কথোপকথন আমাদের ছোটোবেলার স্মৃতিতে গেথে আছে। মা, দাদা-দাদী,নানা-নানীর রূপকথার গল্পের রাজকুমার আসবে পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চেপে এসব গল্প গুলোই মূলত আমাদের ব্যাক্তিত্ব গঠন করেছে। ঈশপের নানা গল্প আমাদের সত্য অসত্য ন্যায় অন্যায়ের শিক্ষা দিয়েছে। ছোটোবেলার মিথ্যাবাদী রাখালের গল্পে বাঘ মিথ্যাবাদীকে কিভাবে মেরে ফেলে এসব গল্প শুনিয়ে মা বাচ্চা সত্য কথা বলার যে শিক্ষা দেয় তাই আজীবন আমরা ধারণ করে চলি। তাই আমাদের ব্যক্তিত্ব গঠনে প্রাণির ভুমিকা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

যাতায়াতে প্রাণী

আদিম যুগ থেকে চাকা আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত বাংলার মানুষ যাতায়াতের জন্য প্রাণীর ওপর নির্ভর করে এসেছে। যাতায়াতের জন্য আমরা গরু, ঘোড়া, মহিষ, উট ব্যবহার করতাম। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত এবং মালামাল বহনের জন্য একমাত্র প্রাণীই আমাদের সহায় ছিলো। গাধা ব্যবহার করে মালামাল বহন করা হতো। এখনও পাহাড়ি এলাকায় গাধার পিঠে চড়ে যাওয়া হয়। মরুভূমিতে যাতায়াতের এখনো একমাত্র যানবাহন উট। তাই যাতায়াতে প্রাণীর ভুমিকা অপরিসীম। 

অর্থনীতিতে প্রাণী

বাংলাদেশে গবাদি প্রাণীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া। এগুলো যেকোন দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, কারণ এসব প্রাণী কৃষি কার্যক্রমসহ বিভিন্ন কাজে চালিকা শক্তি, চামড়া, ও সারের যোগান দেয় এবং জনসংখ্যার বৃহৎ অংশের জন্য মাংস ও দুধের প্রধান উৎস। পরিসংখ্যান অনুসারে মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি'র) প্রায় ২.৯% যোগায় প্রাণিসম্পদ খাত এবং এটির বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৫.৫%। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ২০% গবাদি প্রাণি ও হাঁস-মুরগি পালন ও প্রজনন কর্মসূচির আওতায় জীবিকা নির্বাহ করে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে যাচ্ছে বিকল্প খামার৷ উট, উট পাখি, টার্কি, সাপ, ব্যাং, কুচিয়া, কাঁকড়া, কুমিরের মতো প্রাণির খামার গড়ে উঠছে বাণিজ্যিকভাবে৷

মৎস ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী দেশের ছয়টি জোনে পূর্ণাঙ্গভাবে কুচিয়া ও কাঁকড়া চাষ হচ্ছে৷ বরিশাল, নোয়াখালী, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নেত্রকোণা, শেরপুর, ময়মনসিংহ জেলায় মৎস অনেক খামারি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কুচিয়া ও কাঁকড়া চাষ করছেন৷ 

উটের খামার হয়েছে দেশের ৪-৫টি  স্থানে৷ দেশের সর্বপ্রথম উটের খামার হয় রাজধানী ঢাকার কমলাপুরে৷

অন্যদিকে দিনাজপুরে উটপাখি লালন করে রীতিমতো তারকা বনে গেছেন নারী কৃষি উদ্যোক্তা আনজুমান আরা৷ দেশের দ্বিতীয় উট পাখির খামার রয়েছে খুলনায়৷ সজিব আহমেদ ব্যক্তি উদ্যোগে বাণিজ্যিকভাবে তাঁর সমন্বিত খামারে উট পাখি, গাড়ল (এক প্রজাতির ভেড়া), টার্কি ও ছাগল পালন করছেন৷ এদিকে গত তিন বছর টার্কি চাষে রীতিমতো বিপ্লব এসেছে বাংলাদেশে৷ দেশে প্রায় শতাধিক খামারে টার্কি চাষ হচ্ছে৷ টার্কি চাষের পর বাজারজাতকরণের জন্য গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি সংগঠন৷ এর মধ্যে 'টার্কি মিট বিডি' অন্যতম৷ প্রতি কেজি টার্কি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে৷ ফলে একটি ১০ কেজি ওজনের টার্কির দাম ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা৷ অন্যদিকে কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া একেবারে ব্যক্তি উদ্যোগে দেশে সাপের চাষ হচ্ছে৷  তবে সাপের বাজারজাতকরণ, রপ্তানির কোনো সুযোগ না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন স্থানে খামারিরা সাপের চাষ করে এলেও লাভের মুখ দেখছেন না কেউ৷ তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে সাপ বা বিষ রপ্তানির কোনো সুযোগ নেই৷ অনেক চাষী সাপের পাশাপাশি কেঁচো বা কচ্ছপ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন৷ অন্যান্য বিকল্প প্রাণীর চাষে রাষ্ট্রীয় পৃ্ষ্ঠপোষকতা না থাকলেও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে কাছিম চাষ হচ্ছে৷ এই উদ্যোগে ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছে প্রকল্প মালিকদের৷ বিরল বাটাগুর বাসকা প্রজাতির কচ্ছপ সংরক্ষণের জন্য ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান ছাড়াও বন বিভাগের বর্ধিত আরেকটি প্রজেক্ট রয়েছে সুন্দরবনের করমজলে৷ এছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে অ্যাকুরিয়ামে বিক্রির উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি স্থানে কাছিম চাষ হচ্ছে৷

রামকিঙ্কর বেইজ


সভ্যতা উন্নয়নের ক্রমবিকাশের ধারা থেকে এটা সর্বস্বীকৃত যে, সারা বিশ্বে তথা আমাদের দেশে পশু পাখি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে মানুষের নানাবিধ কল্যাণে দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনে ব্যবহার হয়ে আসছে। এছাড়াও সৌখিন সমাজের বিনোদন, মানুষের পুষ্টিকর ও সুস্বাদু খাদ্যসামগ্রী, কৃষক পর্যায়ে পারিবারিক আয়, বৈদেশিক আয়, বেকার সমস্যা সমাধানে সুলভ সহজসাধ্য কর্মসংস্থান, জ্বালানী ও জমির জৈব সার, কর্ষণ শক্তি ও যানবাহন, পশুপাখির খাদ্য হিসেবে অনেকগুলো কৃষি উপজাত সামগ্রীর পর্যাপ্ত ব্যবহার, ফসল আবাদের অনুপযুক্ত জমির সুস্থ ব্যবস্থা, মানুষ ও প্রাণীর রোগ প্রতিষেধক উদ্ভাবন ও কার্যকারিতা পরীক্ষায় গবেষণাগারের ক্ষুদ্র প্রাণী সামগ্রী, কৃষি শিল্পের কাচাঁমাল ও প্রসাধনী তৈরীর সস্তা উপকরণ এবং দেশ ও অঞ্চলভেদে অপরাপর সহায়ক উৎস্য হিসেবে গৃহপালিত পশুপাখি নিত্য প্রয়োজনে কমবেশি ব্যবহার হয়। 

এছাড়াও বাংলা সংস্কৃতির পাশাপাশি আমাদের সাহিত্যেও প্রাণীর কথা বারংবার উল্লেখিত হয়েছে কখনো মূল চরিত্র হয়ে আবার কখনো বা রূপক চরিত্র হয়ে। যুগে যুগে বহু কবিসাহিত্যিক এ বাংলায় প্রাণীর রূপে বিমোহিত হয়ে নানা সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন। তাই বলা যায়, বাংলা ও বাঙালির অস্তিত্বের  সাথে প্রাণী ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। তাই আজ কবির ভাষায় বলতে ইচ্ছা করে-

"বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি,
তাই আমি পৃথিবীর রূপ  খুঁজিতে যাই না আর"


-জীবনানন্দ দাশ

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆


Thursday, 29 July 2021

ছোটগল্প পর্ব। 'এক ছাতা এক আকাশ" সিরিজ।বিষ্ণু জানা। ২৯.০৭.২০২১. Vol - 448. The blogger in literature e-magazine.

এক ছাতা এক আকাশ। সিরিজ।
                  বিষ্ণু জানা।

১.


 আকাশ মাটিতে নেমে এসেছে। 
বৃষ্টির শব্দ  কান পেতে  শুনছি....
 টুপটাপ ... ঝিমঝিম.....
কালো কালো কাড়ানের মেঘগুলো দৈত্যসম উড়ে চলেছে ---
মেঘমেদুর রোমান্টিক মন ..
বেশ লাগছে।


এক ছাতার নিচে
এমন বাদল দিনে ......

কলেজের করিডোর
বাইরে তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামছে
মাঝে মাঝে ঝড়ো হাওয়া
বৃষ্টির ছাঁট দু'একবার গায়ে এসে লাগছে
যাই যাই করেও .....অপেক্ষমান 
বিকেল আলোর মধুমালতী।

স্টাফ রুম থেকে ভেসে আসছে...
 প্রিয় কণ্ঠস্বর।
 যাব কি একবার দু'পা এগিয়ে দরজার ফাঁকে
 উঁকি দিতে ...

সহসা পিছন থেকে টান .অর্চনা র 
 কিরে, বাড়ি ফিরবি না !

বাহিরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি ..
মন যে ....এক ছাতার নিচে .. দু'পা হাঁটছে।

যদি ছাতা না আজকের এনে থাকেন...
ভিজে ভিজে ফিরবেন।।
আনমনা হয়ে ভাবছে সে।।

সহসা সামনে এসে বললেন.. চলো, 
আর দেরি নয়।
তোমার অনেকটা দেরি করে ফেললাম।

 বেশ ভারী বৃষ্টি তো।
ভিজেছ অনেকটা। 
সরি, আজ একটু বেশি দেরি হয়ে গেল।।

 প্রত্যহ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে 
এমন ঘটনাটা ঘটেছে অনেক বার....

তোমার ছাতায় একটু শেয়ার করবো।

 যা ভাবনা  তাই ঘটলো।।
মনে মনে খুব খুশিতে বললাম ..চলুন।

এক আকাশ ছাতা।
 ছোট্ট দুটি মন।
গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা...

 ঝমঝমিয়ে ভারী বৃষ্টি এলো
সহসা আলোর ঝলকানি ..
 দু'পা পিছিয়ে , হাতে রাখলাম হাত.
শরীরের ছুঁয়েছে দু-একবার‌ও।

ভিজে যাওয়া ঝুমকো লতার মতো কেঁপে ওঠে  মন ....বৃষ্টির ছাঁট মুখে চোখে গায়ে  লাগছে.
ভেজা চোখে তাকিয়ে দেখছি বার বার
আগে তো হয় নি এমন...
হাতটা তেমনি ধরা।

 রাস্তার দু'পাশে বৃষ্টির শব্দ শুনছে মানুষজন
পাশ কাটিয়ে দু-একজন হনহন চলেছে
সহসা মৃদু স্বরে বললাম -
টেকার স্ট্যাণ্ড।

 ফাঁকা, সিট নিয়ে বসেছি 
 ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলো।

 ছাতা টা আজ আপনার হোক....

মনে মনে ভাবলাম ...আমার অনেক কিছুই তো আপনার হতে চায়।

 বললাম-  তুমি ফিরবে তো !
 চলে যাব আমি।।।
বাবা নিয়ে যাবেন।

ভেজা গোধূলির রঙে আঁকা মুখ ম্লান হয়ে এলো

ক্ষণিকের এই ভালোলাগার স্মৃতিটুকু .... 
মনে করতে করতে
পা চালিয়ে চললাম- 
শক্ত করে ছাতাটি ধরা।

সময়ে বাড়ি ফিরে,  ছাতাটি রাখলাম ... 
শোবার ঘরে।
মাটি ভিজে গেছে,  মনের সঙ্গে.
সারারাত বৃষ্টির কান্না নিয়ে. 

 বাহিরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি চললো। 
 বলা হল না .....
এ ..ঘোর ঘনঘটা বরিষায়।...

===========∆∆∆==============

২.

"প্রাণের রাধার কোন ঠিকানা ...........!" 
                    রিংটোন বেজে ওঠে, কানের পাশে থাকা মোবাইলে। গত দুদিনের জ্বরে কাৎ। দুর্বল শরীর ও মনে একটু তন্দ্রা, তাও ভেঙে গেল সুজি'র. এমন গান তো....একজনের রিংটনে ..। 

বেশ কয়েকদিন কাজের চাপে, ওদের কথা হয় নি।
নিয়মিত দীর্ঘ কথালাপে কম্প্রোমাইজ। শর্ট ও ইরেগুলার । মেনে নিয়েছে দুটি মন। যে যখন সময় পাবে, দু'এক কথা। যদি তাও না হয়,  মেসেজে ছোট্ট দুটো শব্দ- বেশ । ভালো আছি। 

সুজি বিছানা ছেড়ে ওঠে। কি হলো আবার !  শরীর না চাইলেও, মনের জোরে ....

কি রে , ফোনটা ধরতে এত দেরি করলি ? 
ঘুমিয়ে ছিলি বুঝি !    চিনুর গলায়..

বাইরে বৃষ্টির শব্দ। সুজি বৃষ্টির শব্দ শুনতে খুব ভালোবাসে। শব্দ শুনতে শুনতে সত্যিই কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছিল...

হ্যাঁ রে। এই একটু....

তা তো ঘুমোবি, তোর আর কি বল ! বিন্দাস আছিস । হাজব্যান্ড বাহিরে ....আর আমি এমন বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গাড়ি চালিয়ে ফিরছি ... দেশের বাড়ি। দায়িত্ব কর্তব্য পালনে ... কপাল একে বলে....

চিনু ,সুজির স্কুল জীবনের প্রিয় বন্ধু। তার চেয়ে হয়তো বেশি কিছু মনে মনে । সে অনেক কিছু ভাবলেও ... সুজিকে মুখ ফুটে কোনদিন বলতে পারেনি। সুজির বিবাহিত সংসার। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে 30 বছর পর দেখা। 

****তোমার সঙ্গে দেখা না হলে ভালোবাসার 
দেশটা আমার দেখা হতো না....
 বেশ কয়েকবার এসেছে বাড়িতে। দুটো হীরের টুকরো ছেলে। নিজের ছেলের মতো ভালোবাসে। ১৮ র রোমান্টিক প্রেম, গভীরতায় আপডেট।

বল, কি বলছিস !
তোর সঙ্গে দেখা করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। প্যান্ডামিক সিচুয়েশন এ কতদিন সেভাবে দেখা হয় নি । মন টা মরুভূমি।  এক পলকে একটু দেখবো বলে . সহজ রাস্তা ফেলে , ঘুর পথে চলেছি। 

সে কি? তোর তো দেরি হবে না তো ।

হোক না। তাতে কি ? 
শোন্ , তুই কি একটু বেরিয়ে আসতে পারবি?  চৌমাথার মোড়।  একঝলক দেখেই চলে যাব...

যাহ্, কী যে বলিস ! কত দূরে আছিস বল। আমি সেভাবেই রেডি হয়ে যাব।।।

বাইরে ঝিম ঝিম বৃষ্টি পড়ছে।
বৃষ্টির ফোঁটা সুজির গায়ে লাগলে বিষময়। তার ওপর জ্বর ঠিক মতো সেরে ওঠে নি। 

আমি ঠিক জানিয়ে দেবো। তুই আসবি তো !

অসম্ভব এক টান উভয়ের মধ্যে। সুজি ঝটপট রেডি হতে থাকে।  অভিসারিকার সাজে রাইকিশোরী । 
তেমন করে সাজতে হয় না সুজিকে। ৫০ বছরের লাবণ্য ২৫ বছর কে হার মানায়। 

 কল করে চিনু জানিয়ে দেয়, ওয়েট করছি।

এমনতর বরষাকে উপেক্ষা করেই ধীর পায়ে অভিসারিকার সাজে সুজি ছাতা মাথায় বেরিয়ে পড়ে প্রিয় মনের সঙ্গে এক পলক দেখা করবে সে 

এই টো টো . টো টো।‌ তুমি বাইপাস যাবে। চৌমাথার মোড়। 

সহসা সূজি উঠে পড়ে। বৃষ্টি ভেজা রাস্তা । ফাঁকা। একা চলেছে টোটো তে। মনে স্বপ্নের অমরাবতী। কেমন করে দেখবে সে ? কি বলবে তাকে? কত কি ভাবতে থাকে. একা একা ....

দূরে চৌমাথার মোড়।  একটি স্কাই কালারের অল্টো।  দাঁড়িয়ে একা ভিজে যাচ্ছে কে !
কালো পাঞ্জাবি পরা ছিপছিপে গড়ন। আগের থেকে রোগা হয়েছে। ফোনে বলেছিল, বেশ কাজের চাপ। ঠিকঠাক খাওয়া নাওয়া হয়ে ওঠেনি প্রতিদিন। 
 সুজি দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলে। মাথায় ছাতা। ভিজে যাচ্ছে যে ...। মুখোমুখি। থমকে দাঁড়ায়। 
আকাশের কালো কাড়ানের মেঘগুলো অন্ধকার ঘনিয়ে আনে। ঝিরঝির বৃষ্টি ঝরে। একদা
একটি ছাতার নিচে দুটি প্রিয় মন। 

আঁধারে আলোর মতো তোর চোখ মুখ চকচক করছে রে। ভালো আছিস তো।  সত্যি ভালো করেছিস তুই।
একমনে সুজি কথাগুলো শুনতে থাকে। কত চেনা জানা এই কথাগুলো। রাতে বিরেতে তার কানে এখনো বাজে। ভেতর থেকে একটি কষ্ট যেন কুরে কুরে খায় তাকে। কিসে কষ্ট মুখ ফুটে বলতে পারে না। 
আসতে আসতে বলে, হ্যাঁ ভালো আছি। তোকে দেখার পর আরো ভালো হয়ে গেছি। আরো ভালো হয়ে যাব। 
আকাশে সহসা আলোর ঝিলিক। উজ্জ্বল মুখ দুটো একে অপরকে দেখে নেয় একবার। ফিরে যায় 30 বছর আগে স্কুল জীবনের ইতিহাস এ। রোমান্টিক আবেশ ঘনিয়ে আসে। 

**"কতদিন পরে এলেন একটু বসুন।।।

আসি রে , ভালো থাকিস। 


সুজি ক্ষণিকের জন্য ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। 

গভীর মনের অনুভূতি নিয়ে ক্ষণিকের এই দেখা , জীবনের বিশেষ মুহূর্ত হয়ে ওঠে। সাক্ষী থাকে রিমঝিম বৃষ্টির ফোঁটা আর গোধূলির রঙ।

 বাড়ি ফিরতে ফিরতে সারা রাস্তায় সুজি স্মৃতিঘন উপলব্ধির গভীরে ডুবেছিলেন যেন। 

 বাড়ির দরজা। ছেলেরা ডেকে ওঠে- মা। । 

কেমন যেন একটা ঘোর পেয়েছে তাকে। সংসারের মায়ায় জড়িয়ে ও ভেতর থেকে সেই ঘোর আর ঘোরে হতে থাকে.... রাত বাড়ে। বাইরে ঝিম ঝিম বৃষ্টি। সারারাত সেই ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেনি সুজি। তার পরের কয়েকদিন ও। 

এই বুঝি গভীর প্রেম ......

 গান বেজে ওঠে ...


আমার স্বপন কিনতে পারে এমন আমীর কই।।।।

===============∆∆∆=============

Wednesday, 28 July 2021

বিশেষ প্রতিবেদন। " আদর্শগত ভাবে জাতীয়তাবাদের প্রচারে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা." 28.7.2021 .VOL-447. The blogger in literature e-magazine.

  

আদর্শগত ভাবে জাতীয়তাবাদের প্রচারে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা । 

১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে মধুসূদন রায় নামের এক ব্যাঙ্কব্যবসায়ী 'বেঙ্গল রেকর্ডার' -এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রীনাথ ঘোষ ও তাঁর ভাই গিরিশচন্দ্র ঘোষকে একটি ইংরাজী সংবাদ পত্র প্রকাশের জন্য প্রস্তাব দেন। স্থির হয় 'বেঙ্গল রেকর্ডার' বন্ধ করা হবে এবং নতুন সংবাদপত্রটির নাম হবে "হিন্দু প্যাট্রিয়ট"। নামটি সম্ভবত গিরিশচন্দ্র ঘোষের দেওয়া। কিন্তু "রেইস ও রায়য়েট" নামক পত্রিকা সূত্রে জানা যায় যে, নামটি ঘোষেদের সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা ক্ষেত্রচন্দ্র ঘোষই দিয়েছিলেন। তদানীন্তন প্রখ্যাত সাংবাদিক  কৃষ্ণদাস পালের মতে যিনি পত্রিকার ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে এর সম্পাদক হয়েছিলেন, নামটি হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের দেওয়া। কিন্তু গিরিশচন্দ্র ঘোষের জীবনীকার ও পৌত্র মন্মথনাথ ঘোষ কৃষ্ণদাস পালের মত খন্ডন করেন, মধুসূদন রায়ের সিদ্ধান্ত অনুসারে "হিন্দু প্যাট্রিয়ট" নামটি গিরিশচন্দ্র ঘোষের নিজের দেওয়া এবং এও উল্লেখ করেন যে, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় অনেক পরে এবং প্রথমদিকে এক অধীনস্থ  কর্মী হিসাবে যোগ দেন। 

হিন্দু প্যাট্রিয়ট ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ ই জানুয়ারি গিরিশচন্দ্র ঘোষের সম্পাদনায় মধুসূদন রায় প্রকাশ করেন এবং এটি প্রতি বৃহস্পতিবার তাঁর কলাকার স্ট্রিটস্থিত প্রেস হতে প্রকাশ হতে থাকে। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে কিছুদিন কাশীতলা হতে মুদ্রিত হয়। সেসময়ের 'বেঙ্গল রেকর্ডার' -এর সংবাদদাতা হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় হিন্দু প্যাট্রিয়টে যোগদেন 

হরিশ্চন্দ্রের সাথে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে । হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকাটির জন্যই মাত্র আট বছরের মধ্যে হরিশ্চন্দ্রের খ্যাতি প্রায় সারা ভারতে ছড়িয়েছিল এমনকি ইউরোপের শিক্ষিত সমাজেও তার নাম প্রচারিত হয়েছিল । আড়াই বছর ধরে হরিশ্চন্দ্র বিনা পারিশ্রমিকে প্রায় একাই হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকা পরিচালনা করেন । এরপর তিনি এই পত্রিকার স্বত্বাধিকারী মধুসূদন রায়ের কাছ থেকে হিন্দু পেট্রিয়ট প্রেস এবং কাগজের স্বত্ব কিনে নেন । হরিশ্চন্দ্র সেই সময় সরকারী কর্মচারী হওয়ায় নিজের নামে এই পত্রিকা কিনতে পারেননি । তিনি তার দাদা হারাণচন্দ্রের নামে এই স্বত্ব কেনেন । হরিশ্চন্দ্র এই কাগজে বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ মারফত বৈদেশিক সংবাদ সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন । এবং তিনি পত্রিকাটিকে একটি আধুনিক পত্রিকায় পরিণত করেন । তবুও ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষ অবধি এই পত্রিকা চালাতে হরিশ্চন্দ্রকে আর্থিক লোকসানের সম্মুখীন হতে হয় ।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার প্রথম থেকেই হরিশ্চন্দ্র সমাজের নিম্নতম শ্রেণির মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই শুরু করেন । তিনি সাধারণ মানুষের উপরে পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হন । বাংলার চাষীদের উপরে নীলকরদের অত্যাচার বন্ধের জন্য তিনি বাংলার উচ্চশ্রেণির মানুষদের এগিয়ে আসতে বলেন । তিনি তৎকালীন সরকারের আমদানি-রপ্তানি নীতিরও তীব্র সমালোচনা করেন । তিনি ভারত থেকে চালচিনি, তৈলবীজের মত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস রপ্তানী করে মদ প্রভৃতি বিলাসদ্রব্য আমদানীর বিরোধিতা করেন । হরিশ্চন্দ্র বিধবাবিবাহ প্রচলন এবং বহুবিবাহ নিরোধ নিয়েও বহু প্রবন্ধ প্রকাশ করেন । তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রস্তাব পুস্তকাকারে প্রকাশের সাথে সাথে এ বিষয়ে জনমত গঠনে সহায়তা করেন । হরিশ্চন্দ্র হিন্দু পেট্রিয়টের সম্পাদক রূপে স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে বহু সংবাদ ও প্রবন্ধ প্রকাশ করেন । তিনি পত্রিকাতে পতিতা সমস্যা এবং সরকারী শিক্ষানীতি নিয়েও আলোচনা করেন ।

তিনি সংস্কৃত ভাষার প্রসার এবং মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব নিয়েও আলোচনা করেন । হিন্দু প্যাট্রিয়টের সম্পাদকীয়তে প্রাচীন বাংলার সাহিত্যের উল্লেখ ও উদ্ধৃতি থেকে প্রমাণিত হয় যে বাংলা ভাষার প্রতি হরিশ্চন্দ্রের অনুরাগ ছিল । সেই সময় যে সব বাংলা বই প্রকাশিত হত তার সমালোচনা হিন্দু পেট্রিয়টে প্রকাশিত হত ।

হরিশ্চন্দ্রের সম্পাদনায় আন্তর্জাতিক খবরও হিন্দু পেট্রিয়টে প্রকাশিত হত। এতে ব্যবসা বাণিজ্য বাজারদর প্রভৃতিও থাকত। সেই সময় দেশীয় পত্রিকাতে বিজ্ঞাপন খুব কম প্রকাশিত হত। কিন্তু হিন্দু পেট্রিয়টে দেশি বিদেশি ব্যবসায়ীরা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতেন। হিন্দু পেট্রিয়ট ধীরে ধীরে বিদেশি পরিচালিত পত্রিকাগুলির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল ।

১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু হয় । ক্রমবর্ধমান সরকারি খাজনার চাপ, জমিদার, জোতদার ও মহাজনদের শোষনের ফলে তারা খুব অসুবিধার মধ্যে পড়েছিল । সাঁওতালরা সংঘবদ্ধ ও সশস্ত্র হয়ে বহু দারোগা ও মহাজনদের হত্যা করেছিল । তাদের দমন করতে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী আসে এবং সাঁওতালদের হাতে বহু ব্রিটিশ সেনা প্রান হারায় । এই বিদ্রোহের নেতা সিধু ও কানুকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে মারা হয়েছিল । পনেরো থেকে পঁচিশ হাজার সাঁওতাল এই বিদ্রোহে মারা যায় । এই সাঁওতাল বিদ্রোহের খবর কলকাতায় পৌছোনোর পর ইউরোপীয় সংবাদপত্রগুলি সরকারকে কঠোরভাবে এই বিদ্রোহ দমন করার পক্ষে রায় দিয়েছিল । কিন্তু হরিশ্চন্দ্র এই মত দেন যে কঠোর শোষনের ফলেই সাঁওতালরা বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়েছে । তিনি উপদ্রুত অঞ্চলে সামরিক শাসন জারিরও তীব্র বিরোধিতা করেন । হিন্দু পেট্রিয়ট ছাড়া সেসময় কোনো সংবাদপত্রই সাঁওতাল বিদ্রোহীদের প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখায়নি । কিন্তু একমাত্র হরিশ্চন্দ্র তাদের প্রতি সহানুভূতি এবং সরকারের কড়া সমালোচনা করে সাহসের পরিচয় দেন ।


হরিশ্চন্দ্র লর্ড ডালহৌসির রাজ্যগ্রাসনীতির কঠোর সমালোচনা করেন । গভর্নর জেনারেল ডালহৌসির সমালোচনা করার এই দুঃসাহস সরকারি ও বেসরকারি মহলকে চমকে দিয়েছিল । বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে লর্ড ডালহৌসি হরিশ্চন্দ্রের মুখ বন্ধ করবার জন্য তাকে লোভনীয় সরকারি চাকরির উৎকোচ দিতে চান । কিন্তু হরিশ্চন্দ্র এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন ।

ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম কর্মকর্তা হিসাবে অনেকে হরিশ্চন্দ্রকে জমিদারি স্বার্থের পৃষ্ঠপোষক রূপে চিহ্নিত করেন । কিন্তু হিন্দু পেট্রিয়টে জমিদারি শোষন এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধেও অনেক খবর প্রকাশিত হত ।

হিন্দু পেট্রিয়ট সম্পাদনার ভার পেয়েই হরিশ্চন্দ্র বাংলার কৃষকদের অবস্থা পর্যালোচনা করেন । শুধুমাত্র অত্যাচারী জমিদাররাই যে কৃষকদের একমাত্র শত্রু নয় তা তিন লক্ষ্য করেন । তিনি খোঁজখবর নিয়ে জেনেছিলেন বাংলার চাষীদের সবচেয়ে বড় শত্রু নীল ব্যবসা এবং নীলকর । হিন্দু পেট্রিয়টের শুরু থেকেই তিনি নীলচাষীদের স্বার্থরক্ষায় মনোযোগ দিয়েছিলেন । ১৮৫৪ থেকে হরিশ্চন্দ্র নীলকরদের বিরুদ্ধে চাষীদের পক্ষ নিয়ে লেখা শুরু করেন । ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষ থেকে তিনি নিয়মিতভাবে নীলকরদের বিরুদ্ধে লিখতে থাকেন । তিনি বাংলার নানা জায়গায় এই সম্পর্কে খবর সংগ্রহের জন্য সংবাদদাতা নিয়োগ করেন । তিনি নীলচাষ প্রথা এবং নীলকরদের সম্পর্কে জ্বালাময়ী সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখতে থাকেন । তাদের অত্যাচারের বহু বিবরণও হিন্দু পেট্রিয়টে প্রকাশিত হয়েছিল । নিজস্ব সংবাদদাতা ছাড়াও বেশ কিছু শিক্ষিত ব্যক্তি এবং শ্বেতাঙ্গ পাদ্রীও নীলকরদের অত্যাচারের খবর হিন্দু পেট্রিয়টে প্রকাশের জন্য পাঠাতেন । হিন্দু পেট্রিয়ট অনেক শিক্ষিত ইংরেজই পড়তেন । এই পত্রিকার পাঠক ইংল্যান্ডেও ছিল । ফলে ইংরেজদের মধ্যেও নীলকরদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয় ।


গ্রাম বাংলার বহু নিপীড়িত নীলচাষীরা কলকাতার ভবানীপুরে হরিশ্চন্দ্রের বাড়িতে এসে ধরনা দিত । অপরিচিত কলকাতা শহরে এদের আহার এবং থাকার কোন ব্যবস্থা না থাকায় এরা হরিশ্চন্দ্রের বাড়িতেই আহার এবং আশ্রয় পেত । হরিশ্চন্দ্রের বহু অর্থ এই মানুষদের আহার এবং আশ্রয় দিতে খরচ হয়ে যেত । হরিশ্চন্দ্র প্রতিটি চাষীর ব্যক্তিগত সমস্যা শুনে তাকে উপযুক্ত পরামর্শ দিতেন । অনেকসময়ে নিজেই তার দরখাস্ত লিখে দিতেন এবং যেখানে আদালতে যাওয়া দরকার সেখানে স্থানীয় কোন মোক্তারকে চিঠি লিখে দিতেন । এই মোক্তারদের পারিশ্রমিকও অনেকসময় হরিশ্চন্দ্র দিতেন । 

১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অকাল মৃত্যুতে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা আর্থিক দুরবস্থায় পড়ে। কালীপ্রসন্ন সিংহের আর্থিক সহায়তায় রক্ষা পায়। [৫] গিরিশচন্দ্র ঘোষ তিন বৎসর আগে হিন্দু প্যাট্রিয়টের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেও, তিনি হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের শোকাহত মা ও অসহায় বিধবা পত্নীর জন্য পুনরায় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পুনরায় ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে তিনি হিন্দু প্যাট্রিয়ট ত্যাগ করলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংবাদপত্রের মালিকানা নেন এবং কৃষ্ণদাস পাল (১৮৩৮ - ১৮৮৪) সম্পাদক হন। 

১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে কিশোরীচাঁদ মিত্র প্রতিষ্ঠিত "ইন্ডিয়ান ফিল্ড" নামের ইংরাজী সংবাদ সাপ্তাহিকটি ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে "হিন্দু প্যাট্রিয়ট" এর সাথে মিশে যায়  ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণদাস পালের মৃত্যুর পর লখনউ-এর দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত লখনউ টাইমস্-এর সম্পাদক রায়বাহাদুর রাজকুমার সর্বাধিকারী (১৮৩৯-১৯১১) এর সম্পাদক হন। পত্রিকাটি ৭১ বৎসর চলেছিল। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে এর প্রকাশনা বন্ধ হয়।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সময় হিন্দু প্যাট্রিয়ট বিদ্রোহের যাবতীয় খবর গুরুত্ব সহকারে নিয়মিত  প্রকাশ করত। পত্রিকার  তৎকালীন সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয়েছিল যে, বিদ্রোহীরা মুঘলদের নেতৃত্বের উপর আস্থা রেখে প্রকৃতই নিজেদের ক্ষতিই হয়েছিল। তাঁতীয়া টোপিকে যখন ফাঁসি দেওয়া হয় হিন্দু প্যাট্রিয়ট তাঁকে শহীদের শ্রদ্ধা জানায় এবং লক্ষ্মীবাঈ এবং কুঁয়র সিং প্রচেষ্টার জন্যও তাঁদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে। 


হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সক্ষম ও বলিষ্ঠ সম্পাদনায় মূলত "হিন্দু প্যাট্রিয়ট" শাসকের অন্যায় আচরণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রধান মুখপত্র হয়ে ওঠে। পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে "হিন্দু প্যাট্রিয়ট"-এই নীলকর সাহেবদের দ্বারা ভারতীয় নীলচাষিদের উপরে উৎপীড়ন ও অকথ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে  সরব হন। বাংলার উচ্চশ্রেণীর মানুষদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাতেন।

১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা হাইকোর্টের লব্ধপ্রতিষ্ঠ উকিল জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে প্রিন্স অব ওয়েলস পদার্পণ করলে, বাড়ির মহিলারা  তাঁকে ভারতীয় প্রথায় শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনিতে বরণ করে। এই ঘটনাটি জাতীয়স্তরে যে ক্ষোভের সঞ্চার করে, তার উপর হিন্দু প্যাট্রিয়ট যথাযথ মন্তব্য করে। 


প্রথমদিকের সম্পাদনার পর কৃষ্ণদাস পাল একাধিক্রমে তেইশ বছর সম্পাদনায় তৎকালীন রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব বিস্তার করে। 'ইলবার্ট বিল', 'ইমিগ্রেশন বিল', 'ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট' ইত্যাদি আইন প্রনয়ণের সময় হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় চা-শ্রমিকদের পক্ষে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়ে ও দেশীয় ডেপুটি ম্যাজিসেট্রটদের সপক্ষে বিস্তর প্রবন্ধ রচনা করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। তিনি  'ইমিগ্রেশন বিল' দ্বারা চা-শ্রমিকদের নির্যাতন ব্যবস্থার প্রতিবাদে কৃষ্ণদাস এই বিলকে "দ্য স্লেভ ল' অফ ইন্ডিয়া" বলে অভিহিত করেন। 


∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆