Saturday, 31 July 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। মুন্সি প্রেম চাঁদ। ৩১.০৭.২০২১. Vol -450. The blogger in literature e-magazine




মুন্সি প্রেম চাঁদ


হিন্দী কথাসহিত্যের এখনাে পর্যন্ত একজন গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসাবে সর্বশ্রেষ্ঠ আসনের অধিকারী । তার ভাষা অত্যন্ত সহজ ও সরল কিন্তু লেখনী বলিষ্ঠ । কথাশিল্পী হিসাবে প্রেমচন্দ তাঁর উপন্যাস এবং গল্পগুলিতে নির্ভীকচিত্তে সমাজের সকল অন্যায় – অত্যাচার , অনাচার , দুর্নীতি , ভণ্ডামি , কুসংস্কার , ধনী ও বিত্তবানদের চালিয়াতি , অনৈতিকতা , অসততা এবং সমাজের দুর্বল ও দরিদ্রশ্রেণীর লােকদের উপর তাদের শােষণের ব্যাপারটি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে প্রাঞ্জল ভাষায় প্রকাশ করে দিয়েছেন । উন্মােচন করেছেন প্রতারক , ভণ্ডদের মুখােশ । 

জন্ম -ধনপত রাই ৩১ জুলাই ১৮৮০লামহি, বাণারস , উত্তর প্রদেশ। মুন্সী আজয়ীব রায় বাবা বাবা ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মী । অনন্দী দেবী মা।মুন্সী প্রেমচন্দের ছেলেবেলা সুখ – দুঃখের মধ্যেই কেটেছিল । আট বছর বয়সে মা মারা গেলেন । মায়ের শােক কাটতে না কাটতেই বাবা আবার বিয়ে করলেন । সৎ মায়ের সঙ্গে শিশু প্রেমচন্দের সম্পর্ক সুমধুর ছিল না । ছেলেবেলায় তার নাম ছিল ধনপত । ডাক নাম নবাব । প্রেমচন্দ নামটি পরবর্তীকালে সাহিত্য সৃষ্টির সময় গ্রহণ করেন । সাত বছর বয়সে এক মৌলবীর পাঠশালায় ভর্তি হলেন প্রেমচন্দ । কিছুক্ষণ পড়াবার পর ছাত্রদের ছেড়ে দিতেন । মৌলবীর সাথে ছাত্রদের সম্পর্ক ছিল অর্থ উপার্জনের সম্পর্ক স্কুল পালিয়ে বেরিয়ে পড়তেন প্রেমচন্দ ।কিছুদিন পর বাবা স্কুলে ভর্তি করে দিলেন প্রেমচন্দকে । তার যখন পনেরাে বছর বয়স সে সময় তার বাবা ছেলের বিয়ে দিলেন । কিছুদিনের মধ্যে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন । বাড়িতে বৌ , সত্য আর দুটি সৎ ভাই । কোনও রােজগার ছিল না । বাবাকে সুস্থ করা গেল না । তিনি মারা গেলেন । সংসারের সব গুরু দায়িত্ব এসে পড়ল তার উপর । বাবার মৃত্যুর জন্য সেই বছর পরীক্ষায় বসতে পারলেন না । পরের বছর দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করলেন । আর্থিক অনটন ও অঙ্কের পরীক্ষায় ফেল করার জন্য কোনও কলেজেই ভর্তি হতে পারলেন না।এক উকিলের বাড়িতে ছেলে পড়াবার কাজ পেলেন । মাইনে পাঁচ টাকা । নিজে দু’টাকা রেখে বাড়িতে তিন টাকা পাঠাতেন । অর্ধেক দিন তার খাওয়া জুটত না । শীতকালেও কষ্ট পেতেন । 

পরে এক ছােট স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে তার পরিচয় হয় । তিনি তাকে আঠারাে টাকা বেতনের শিক্ষকের চাকরি নিজের স্কুলে দিলেন । স্কুলটি ছিল বারাণসী থেকে চল্লিশ মাইল দূরে চুনাৱে । এই শান্ত , নিরীহ মানুষটির মধ্যেই ছিল সাহস ও তেজ। পরে কুইনস কলেজের প্রিন্সিপাল মিঃ বেকনের সাহায্যে একটি সরকারী স্কুলে শিক্ষকতা পেয়ে গেলেন।  দাম্পত্য সঙ্গী -শিবরাণি দেবি সন্তান-  অমৃত রাই। প্রেমচন্দের সজ্ঞা ছিলেন রাগী আর বদমেজাজী । তাকে এড়িয়ে চলার জন্য বাবা বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকতেন । দিদির বিয়ের পর প্রেমচন্দ নিঃসঙ্গ হয়ে গেল । তার জীবনে একমাত্র আনন্দ ছিল বাবার বদলি জীবন । কৈশাের জীবনের এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে তিনি নানান রচনায় প্রকাশ করেছেন । 

বাবা সারাদিন কাজ কর্ম করতেন । আর প্রমচন্দ নিজের মত ঘুরে বেড়াতেন । বই পড়ার নেশা ছিল প্রেমচন্দের । উর্দু ভাষায় যেসব উপন্যাস প্রকাশিত হত তা পাবার সাথে সাথে পড়ে ফেলতেন । 
প্রেমচন্দের সাহিত্য জীবনের সূচনা কিশাের বয়স থেকে । কুড়ি বছর বয়সে উর্দুতে একটি ছােট উপন্যাস লিখলেন — আসরার ঈ মাবিদ ( মন্দিরের রহস্য ) । উপন্যাসটি অসমাপ্ত ছিল । একটি ছােট পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়েছিল । 

অল্পদিনেই’কল্পনা আর রােমান্স – এর পরিবর্তে তার লেখায় ফুটে উঠতে থাকে সৃজনশীল সাহিত্য । মানুষের বাস্তব জীবনের সুখ – দুঃখ আশা – আকাঙ্খ ফুটে উঠেছে তার লেখায় প্রতি ছন্দে ছন্দে । তার জীবনের শৈশব , কৈশাের , যৌবন ছিল কঠোর সংগ্রামের । চরম দারিদ্র আর অভাবের মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছেন জীবনের কঠিন রূপ । সমাজের উপর তলার মানুষদের চেয়ে নিচু তলার মানুষরাই তাকে বেশি আকৃষ্ট করত । সেই তার রচনায় যে বাস্তবতার প্রকাশ দেখা যায় , ভারতীয় সাহিত্যে অন্য কারাে রচনায় তা দেখা যায় না । 

বিশ্বসাহিত্যে ম্যাক্সিম গাের্কির সাথে তাকে তুলনা করা যায় । 

উল্লেখযোগ্য কর্ম -    গোদান, নির্মলা, বাজার-এ-হুস্ন, কর্মভূমি, শাতরাঞ্জ কে খিলাড়ি, গাবান, ঈদ্গাহ। 


মুন্সী প্রেমচাঁদ উর্দু ও হিন্দি সাহিত্যের স্বনামধন্য কথাশিল্পী। তার আসল নাম ধনপত রায়। তবে মুন্সী প্রেমচাঁদ নামেই তিনি পরিচিত। তাকে জীবনবাদী সাহিত্যিক বলা হয়। হিন্দি সাহিত্যে ‘উপন্যাস-সম্রাট’ হিসেবে খ্যাত প্রেমচাঁদকে আধুনিক হিন্দি সাহিত্যের জনক বলেও অভিহিত করা হয়। ১৯১০ সালে বড়ে ঘরকী বেটি প্রকাশিত হলে উর্দু সাহিত্যে তিনি স্থায়ী আসন লাভ করেন। তার সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস গোদান । তার প্রায় যাবতীয় সাহিত্যকর্ম বাংলা ভাষায় অনূদিত ও বহুল পঠিত।
 কর্মজীবন - হিন্দি ভাষার বঙ্কিমচন্দ্র বলা হয়।
১৯০৭ সালে এক বাল্য বিধবার জীবন কাহিনি নিয়ে লেখা উপন্যাস – ‘ প্রেমা ’ রচনা করলেন । ছােটগল্প ছাড়া দুটি উপন্যাস লিখেছিলেন । বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দ মঠ অনুসরণে জছবা – ঈ – ঈশার ( বরদান ) । অন্যটি বাজার ঈ — হুসন ’ ছিল পতিতা বৃত্তি কিভাবে সমাজকে কলুষিত করে তারই জীবন্ত ছবি । 

মুন্সী প্রেমচন্দের কতকগুলি স্মরণযােগ্য উপন্যাস হলাে — গােদান , কয়াকল্প , নির্মলা , প্রতিজ্ঞা , সেবাসদন , প্রেম – আশ্রম , রাঙ্গভূমি , কর্মভূমি এবং মানসসরােবর । মানসসরােবর বৃহদায়তন উপন্যাস । মােট আট খণ্ডে প্রকাশিত হয় । 
মুন্সী প্রেমচন্দের ছােট গল্প বিখ্যাত ছােট গল্প সংকলন ‘ মজ -ঈ – ও তান ’ ( মাতৃভূমির কথা ) । ইংরেজ সরকারের অত্যাচার -অবিচারের বিরুদ্ধে তার সমস্ত অভিব্যক্তি মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে এই রচনায় । এর একটি বিখ্যাত গল্প হল ‘ অমূল্য রত্ন । 

এই বই প্রকাশের সাথে সাথে ইংরেজ সরকারের নজর পড়ল তার এই বই – এর উপর । তার এই বইয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল । তিনি সুস্বাস্থের অধিকারী ছিলেন না । তিনি গভীরভাবে সাহিত্য রচনার কাজে মনােনিবেশ করতে থাকেন । সারাদিন স্কুলে পড়াতেন । বিকেল বেলায় বাড়ি ফিরে সন্ধ্যে বেলায় একটু বিশ্রাম নিয়ে লিখতে বসতেন । সংসারের প্রতি কর্তব্যচ্যুত হন নি । সমস্ত কাজে ছিল শৃঙ্খলাবােধ । 
স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে একটি পত্রিকায় সম্পাদকের চাকরি পেলেন । তাকে সাহায্য করার মত বিশেষ কেউ ছিল না । কাজের চাপ এত বেশি ছিল যে লেখার মত শারিরিক শক্তি থাকত না । বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়ে দিলেন । বারাণসীতে তার একটি ছােট প্রকাশনা সংস্থা ছিল । প্রথমে হংস ’ পরে জাগরণ ’ নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করেন । কিছুদিনের মধ্যেই অর্থের অভাব অনুভব করলেন । 

এত সমস্যার মধ্যেও লেখক প্রেমচন্দ নিজেকে হারিয়ে ফেলে নি । রাতে সমস্ত দৈনন্দিন সমস্যা ভুলে তার মধ্যে জেগে উঠত এক লেখক সত্তা । সমস্ত রাত ধরে তিনি লিখতেন । প্রেমচন্দ লেখালিখি ছাড়াও মর্যাদা এবং ‘ জাগরণ ’ নামক জাতীয় সাময়িক পত্রিকা সম্পাদনা করেন । এছাড়া তিনি হংস ’ নামে নিজেও একটি সাময়িক পত্রিকা বের করেছিলেন । 

প্রেমচন্দকে যশ , খ্যাতি প্রভাবিত করতে পারে নি । তিনি নিজেকে কখনাে বিখ্যাত হিসাবে প্রচার করতে চান নি । সরলতা ছিল তার চরিত্রের একটি বড় গুণ । এই কারনে তিনি সাহিত্যিক হিসাবে নন , ব্যক্তি হিসাবেও মানুষের কাছ থেকে পেয়েছেন শ্রদ্ধার আসন। 

কর্মভূমি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তিনি হিন্দি সাহিত্যের সবচেয়ে বিখ্যাত লেখক হয়ে উঠলেন । প্রথমে উর্দু ভাষায় রচনা করলেও পরে হিন্দিকেই সাহিত্য সাধনার মাধ্যম করেন । বৃহত্তর সমাজের নির্যাতিত মানুষইর্তার কাছে ছিল একান্ত আপন জন । সাধারণ মানুষের প্রতি তার গভীর ভালবাসাই তাকে করে তুলেছিল বাস্তববাদী । তার চিন্তা ভাবনায় সাম্যবাদী আদর্শের প্রকাশ ঘটেছে । তিনি পরে প্রগতিশীল লেখক শিল্পী সংঘের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং এই সংঘের প্রথম অধিবেশন লক্ষ্মেীতে বসেছিল । 

আত্মজীবনীমূলক একটি উপন্যাস রচনার কাজে হাত দেন মঙ্গল সূত্র ’ এই উপন্যাসটি সমাপ্ত করে যেতে পারেন নি প্রেমচন্দ । তার পূর্বেই তার মৃত্যুবরণ করতে হয় । মুন্সী প্রেমচন্দ ১৯৩৬ সালে ৮ ই অক্টোবর ৫৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।


∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆

No comments: