মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত (শ্রীমা)
জন্ম ১৮৫৪ সালের ১৪ জুলাই কলকাতার বিখ্যাত বৈদ্য পরিবারে। তাঁর বাবা মধুসুদন গুপ্ত এবং মা শ্যামাময়ী দেবী। মহেন্দ্রনাথের পড়াশোনা কলকাতার হেয়ার স্কুল এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে। একসময় ব্রাহ্ম সমাজে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। খুব অল্পবয়সে মাকে হারান মহেন্দ্রনাথ। সংসারে হাজারো জটিলতা পারিবারিক অশান্তিতে একসময় আত্মহত্যার কথাও ভেবেছেন। পরবর্তীকালে বলতেন, তাঁর জীবন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হলো শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখার পর।শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ে তিনি বিদ্যাসাগরের শ্যামপুকুর ব্রাঞ্চ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ১৮৭৫ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত নানা স্থানে শিক্ষকতা করে জীবনের শেষ পাঁচ বছর নকড়ি ঘোষের কাছ থেকে ঝামাপুকুর মর্টন ইন্সটিটিউশন (বর্তমানে আমহার্স্ট স্ট্রীটের হিন্দু অ্যাকাডেমি) কিনে তার অধ্যক্ষ এবং পরিচালক হন। এই স্কুলই কিছু দিন পরে ৫০ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রিটে স্থানান্তরিত হয়।
অদ্ভুত ত্যাগের জীবন মাস্টারমশায়ের। তিনটি স্কুলের তিনটি উপার্জন যেত তিন জায়গায়— একটি বরাহনগর মঠে সংসারত্যাগী গুরুভাইদের সেবায়, আর একটি সারদাদেবী ও সন্ন্যাসীদের সেবায় এবং তৃতীয় মাইনে থেকে চলত নিজের সংসার।
একদিকে স্বামী বিবেকানন্দ সারা পৃথিবী জুড়ে প্রচার করেছেন শিব জ্ঞানে জীব সেবার আদর্শ। আর মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের লেখায় একে একে পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত।
ভারতবর্ষে আঠারোটা পুরাণকাহিনির মধ্যে ভাগবত পুরাণ অত্যন্ত জনপ্রিয়। বলা হয় ১৮ পুরাণ রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস সব পুরাণ লিখেও শান্তি পাননি। ভাগবৎ পুরাণ রচনা করার পর তাঁর অন্তরে শান্তি আসে। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষও এই পুরাণকথা পড়ে বা শুনে তপ্ত জীবনে শান্তির বারি পেয়ে থাকেন। এই পুরাণকাহিনি শুনলেও মঙ্গল হয়। মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত শ্রীমদ্ভাগবত-এর এই শ্লোকটি রামকৃষ্ণ কথামৃতের সূচনায় উদ্ধৃত করেছেন। সকলেই জানেন ‘তব কথামৃতম তপ্তজীবনম্…’ এই শ্লোকটি। পৃথক পৃথক সময় হলেও পাঁচ খণ্ডে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত প্রকাশিত হয়েছে। শ্রীম উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়া কালিবাড়ির কাছে থাকতেন। তাঁর বাড়ির নাম কথামৃত ভবন। এখান থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত। পরে রামকৃষ্ণ মিশন-সহ বহু প্রকাশক এই বই প্রকাশ করেছেন। বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় সম্ভবত এই বইটি। হিন্দু-মুসলমান, শিখ-খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষ এই বই পড়ে আনন্দ পান। এই বইয়ের ছত্রে ছত্রে রয়েছে জীবনকে ঘিরে গভীর সব প্রশ্ন আর সর্বধর্মসমন্বয়ের চিরায়ত বাণী। এ কথা কে না জানে যে শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘যত মত, তত পথ’। বহু গুরুত্বপূর্ণ কবি-লেখকরাও শ্রীম বা মহেন্দ্রনাথ গুপ্তের আশ্চর্য লিখনশৈলী উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। যাঁরা বিশ্বাসী ভক্ত কিংবা আধ্যাত্ম জিজ্ঞাসু তাঁরা তো শিয়রের কাছে রেখে দেন এই পাঁচ খণ্ড। শ্রীসারদা মা বলেছিলেন মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত সম্পর্কে, উনি সারা জগতের উপকার করলেন।
গঙ্গাতীরে, দক্ষিণেশ্বর কালিবাড়িতে মাস্টার এসেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে দেখা করতে। ১৮৮২ সালে বসন্ত কালের কথা। মন্দিরের কাছে শ্রীরামকৃষ্ণের ঘর। সেখানে কাজ করেন বৃন্দা নামের এক পরিচারিকা। তাঁকে মাস্টার জিজ্ঞেস করছেন, আচ্ছা এই সাধু কি খুব বইটই পড়েন। বৃন্দা বলছেন, আর বাবা বই-টই! সব ওঁর মুখে! পরে মাস্টার কথা বলছেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের সঙ্গে। মাস্টার বলছেন, যাঁরা মাটির প্রতিমা পূজো করেন, তাঁদের তো বুঝিয়ে দেওয়া উচিত যে মাটির প্রতিমা ঈশ্বর নয়, আর প্রতিমার সামনে ঈশ্বরকে উদ্দেশ করে পূজা করেন, মাটিকে পূজা করা উচিত নয়। এ কথা শোনামাত্র বিরক্ত শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, তোমাদের কলকাতার লোকের ওই এক। কেবল লেকচার আর লেকচার। লেকচার দেওয়া আর বুঝিয়ে দেওয়া। আপনাকে কে বোঝায় তার ঠিক নেই। তুমি বোঝাবার কে? যাঁর জগৎ তিনি বোঝাবেন। যিনি জগৎ করেছেন, চন্দ্র, সূর্য, ঋতু, মানুষ, জীব-জন্তু করেছেন, সকলের খাবার উপায় করেছেন তিনিই বোঝাবেন। ‘তিনি এতো উপায় করেছেন, আর এ উপায় করতে পারেন না’। হতভম্ব মাস্টার ভাবছেন ইনি যা বলছেন তা তো ঠিক। আমি কি ঈশ্বরকে জানি যে তাঁর কথা লোককে বোঝাবো। এর পর থেকে নিয়মিত দক্ষিণেশ্বর আসা যাওয়া। কিন্তু কে এই মাস্টার?
অপরের মঙ্গল নিয়ে সদাবিব্রত মহেন্দ্রনাথ নিজের পারিবারিক অশান্তি থেকে মুক্তি পাননি , তার বিবরণ রয়েছে তাঁর শিষ্য নিত্যানন্দের ১৬ খণ্ডের ‘শ্রীমদর্শন’-এ। প্রথম ছেলে নির্মলের অকালমৃত্যুর সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণের আশ্রয় মহেন্দ্রনাথের কাজে লেগেছিল। তৃতীয় পুত্র চারু বয়ে গিয়েছিল। আদরের কন্যা হাঁদুর বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি, তাঁর অকালমৃত্যু ২২-২৩ বছরে। চিরকুমার কনিষ্ঠ পুত্রের সঙ্গে পিতার সম্পর্ক বেদনাদায়ক । সে রেসকোর্সে ঘোড়দৌড় ও জুয়াখেলায় আকৃষ্ট। এই পুত্রকে গৃহ থেকে বিতাড়িত করলেন দ্বিধাহীন মহেন্দ্রনাথ। ১৯২৪ সালে সেই পুত্র ‘আশ্রয়হীন ও অন্নবস্ত্রহীন হইয়া খুবই দুর্দশায় পতিত হইলেন।’
টাকা কিছু দেবেন, কিন্তু পুত্রকে ঘোড়দৌড়ে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। পুত্র সেই চিঠি পড়লেন, কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থ গ্রহণ করলেন না। অনাহারে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও নিজের বাবাকে প্রবঞ্চিত তিনি করতে চাইলেন না। স্নেহে অন্ধ হয়েও আমাদের শ্রীম নিজের নিয়মকানুন বিন্দুমাত্র শিথিল করেননি। এই বিপথগামী পুত্রকে দেখা যায় ১৯৩২ সালে কলকাতায়। পিতার দাহকার্যের সময়ে।
মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত মাস্টার মশায় নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সন্ন্যাসী শিষ্যদের কেউ কেউ তার শিষ্য এবং তার ছাত্ররা অনেকে পরে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। অনেকে তাকে তাই ছেলে ধরা মাস্টার আখ্যা দিয়েছিলেন।[১] উল্লেখযোগ্য সন্ন্যাসী ছাত্ররা হলেন স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী প্রেমানন্দ (বাবুরাম ঘোষ) , স্বামী সুবোধানন্দ (সুবোধ চন্দ্র ঘোষ) প্রমুখ ।
রামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ — ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৮২, রবিবার দক্ষিণেশ্বরে। এই ঠাকুরই তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে।
ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ ১৮৮৬-র অগস্ট মাসে আর মহেন্দ্রনাথের সাহিত্যযাত্রার সময় ১৮৯৭ থেকে ১৯৩২— অর্থাৎ ৩৫ বছর।গবেষক স্বামী প্রভানন্দ (বরুণ মহারাজ) জানিয়েছেন, কথামৃতের শতকরা আশি ভাগ রচনা শ্রীম শেষ করেছিলেন ১৮৯৭ থেকে ১৯১০-এর মধ্যে। তখন তাঁর বয়স ৪৪ থেকে ৫৬।
ঠাকুরের মহাসমাধির দু’বছর পরে রথযাত্রার পরের দিন (১১ জুলাই ১৮৮৮) নীলাম্বরবাবুর ভাড়াবাড়িতে মহেন্দ্রনাথ তাঁর পাণ্ডুলিপির একাংশ শুনিয়েছিলেন জননী সারদামণিকে।
১৮৯৮ থেকেই বাংলায় তাঁর লেখা বেরোচ্ছে, কিন্তু ‘কথামৃত’ শব্দটি প্রথমে ছিল না। তত্ত্বমঞ্জরী পত্রিকায় নাম ছিল ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলামৃত’। পরে নাম হল ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণপরমহংসের কথা’। ১৮৯৯ থেকে ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতম্’।
বাংলায় ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয় ১৯০২ সালে, দ্বিতীয় ভাগ ১৯০৫, তৃতীয় ভাগ ১৯০৮, চতুর্থ খণ্ড ১৯১০ এবং শেষ খণ্ড মাস্টারমশায়ের মৃত্যুর পরে (১৯৩২)।
ঠাকুরের প্রথম দর্শনলাভের পরে অর্ধশতাব্দী বেঁচে থেকে, ১৯৩২ সালের ৪ জুন কলকাতায় তাঁর দেহাবশেষ। তার পূর্বরাত্রে ন’টার সময়ে পঞ্চমভাগ ‘কথামৃত’র প্রুফ দেখা শেষ হয়।
ঠাকুরের সঙ্গে মহেন্দ্রনাথের ৭১টি সাক্ষাৎকার দক্ষিণেশ্বরে, ২৫৫ জন ভক্ত ও আগন্তুকের নাম উল্লেখ আছে মহেন্দ্রনাথের সুবিশাল রচনায়।
মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত সারা পৃথিবী জোড়া পরিচিতি পেয়েছেন ওই মাস্টার বা শ্রীম নামে। তাঁর লেখা শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের মুখের কথা লোকের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল। মহেন্দ্রনাথ নিজেকে বলতেন শ্রীরামকৃষ্ণের স্টেনোগ্রাফার।
No comments:
Post a Comment