প্যারীচাঁদ মিত্র
১৮১৪ সালের ২২ জুলাই কলকাতায় তাঁর জন্ম। প্যারীচাঁদের পিতা রামনারায়ণ মিত্র প্রথম জীবনে হুগলি জেলার পানিসেহালা থেকে কলকাতা
আগমন । আঠারো শতকে ইউরোপীয় বণিকদের তাবেদারির মাধ্যমে যেসকল ভারতীয় বেনিয়া নিজেদের ভাগ্যোন্নয়ন করেন, রামনারায়ণ মিত্র ছিলেন তাঁদেরই একজন। প্যারীচাঁদ মিত্রের শিক্ষাজীবন শুরু হয় পারিবারিক পরিমন্ডলে। তিনি পন্ডিত ও মুনশির নিকট যথাক্রমে বাংলা ও ফারসি শেখেন। ১৮২৭ সালে তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন এবং খ্যাতিমান শিক্ষক হেনরি ডিরোজিওর তত্ত্বাবধানে থেকে শিক্ষা সম্পন্ন করেন।। কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান হিসেবে ১৮৩৬ সালে প্যারীচাঁদ মিত্রের কর্মজীবন শুরু হয়। ক্রমান্বয়ে তিনি লাইব্রেরিয়ান এবং উক্ত প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারি পদে অধিষ্ঠিত হন। পাবলিক লাইব্রেরির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এবং অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি প্যারীচাঁদ অত্যন্ত সফলভাবে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়িক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি কয়েকটি বিনিয়োগ কোম্পানির অংশীদার ও পরিচালক ছিলেন। সেগুলির মধ্যে ছিল গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল কোম্পানি লিমিটেড, পোর্ট ক্যানিং গ্র্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি এবং হাওড়া ডকিং কোম্পানি। একজন সমাজহিতৈষী ও সংস্কৃতিসেবী হিসেবে বাঙালির জাগরণে তাঁর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালি সমাজের হিতার্থে তিনি বহু সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। জ্ঞানোপার্জিকা সভা (১৮৩০), বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি (১৮৪৩), ডেভিড হেয়ার মেমোরিয়াল সোসাইটি (১৮৪৪), রেস ক্লাব (১৮৪৭), এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড হর্টিকালচারাল সোসাইটি (১৮৪৭), বেথুন সোসাইটি (১৮৫১) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
প্যারীচাঁদ মিত্র বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সম্মানসূচক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। যেমন: জাস্টিস অব পিস (১৮৬৩), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো (১৮৬৪), জেল ও কিশোর অপরাধীদের সংশোধন কেন্দ্রের পরিদর্শক (১৮৬৪), কলকাতা হাইকোর্টের গ্র্যান্ড জুরি (১৮৬৮-১৮৭০), বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য (১৮৬৮-১৮৭০), কলকাতা মিউনিসিপ্যাল বোর্ডের অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট প্রভৃতি।
পরবর্তীকালে সাংবাদিকতা ও বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্যই প্যারীচাঁদ বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। তিনি দি ইংলিশম্যান, ইন্ডিয়ান ফিল্ড, হিন্দু প্যাট্রিয়ট, ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া এবং বেঙ্গল স্পেক্টেটর পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৭), মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায় (১৮৫৯), রামারঞ্জিকা (১৮৬০), কৃষিপাঠ (১৮৬১), ডেভিড হেয়ারের জীবনচরিত (১৮৭৮) এবং বামাতোষিণী (১৮৮১)। ইংরেজি গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: A Biographical Sketch of David Hare (১৮৭৭), The Spiritual Stray Leaves (১৮৭৯), Stray Thought of Spiritualism (১৮৭৯), Life of Dewan Ramkamal Sen (১৮৮০) এবং Life of Coles Worthy Grant (১৮৮১)।
সাহিত্যক্ষেত্রে প্যারীচাঁদের সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব আলালের ঘরের দুলাল যা বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হিসেবে খ্যাত। রচনারীতি ও ভাষাগত দিক থেকে এ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারার সূচনা করে। এ উপন্যাসে প্যারীচাঁদ প্রথমবারের মতো বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত গদ্যরীতির নিয়ম ভেঙ্গে চলিত ভাষারীতি প্রয়োগ করেন। সাধারণ মানুষের মুখে ব্যবহূত কথ্য ভাষা আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাসের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে পরিচিত ছিলেন।
================================
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়।
হাতি ধরা দলের সঙ্গে মিশে চলে গিয়েছিলেন নাগপুরের বনে!খিদের জ্বালায় কখনও তেঁতুল পাতা চিবিয়ে দিন কাটিয়েছেন। কখনও সারাদিনে শুধু এক লোটা জল। কোনও দিন তাও জোটেনি।
মাত্র ন’বছর বয়েসে নিজে এক লিপিমালা আবিষ্কার করে মাটির চাকতি আর কাঠের ফলকে লিখে রাখতেন।
আশ্চর্যের কথা, তাঁর ছোটবেলার সৃষ্টি ওই বর্ণমালার সঙ্গে ‘শর্টহ্যান্ড রাইটিং’-এর জনক পিটম্যানের হরফের অদ্ভুত মিল!ভাবতে কোথায় বোধ হয় একটু হলেও অসুবিধে লাগে, ইনিই লুল্লু-ডমরুধর চরিতের স্রষ্টা, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়!
জন্ম: ২২ জুলাই, ১৮৪৭, ২৪ পরগনা জেলায়।
তিনি চুঁচুড়ার ডাফ সাহেবের স্কুলে এবং ভদ্রেশ্বরের কাছে তেলিনীপাড়া বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। সংসারের অসচ্ছল অবস্থার জন্য ১৮৬৫ সালে বাড়ি থেকে রোজগারের জন্য চলে যান এবং নানা দেশ ভ্রমণ করেন। প্রথমে দ্বারকা (বীরভূম) উখড়া (রাণীগঞ্জ) এবং শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রভৃতি স্থানে শিক্ষকতার কাজ করেন। কিন্তু কোথাও কাজ পছন্দ না হওয়ায় কটকে চলে যান। ১৮৬৮ সালে কটকে জেলার পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর হন। কটকে ওড়িয়া ভাষা শিখে ওড়িয়া ‘উৎকল শুভকরী’ নামে মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন। পুলিশের চাকরি করাকালীন বিখ্যাত স্যার উইলিয়াম হান্টার সাহেবের সঙ্গে পরিচিত হন। হান্টার সাহেব এঁর কথাবার্তা এবং অগাধ পান্ডিত্যে সন্তুষ্ট হয়ে ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় নিজের বেঙ্গল গেজেটিয়ার সংকলন অফিসে কেরানীর পদে নিযুক্ত করেন। এরপর ইনি উত্তর পশ্চিম প্রদেশের কৃষি ও বাণিজ্য বিভাগের অফিসে প্রধান কেরানীর পদে নিযুক্ত হন। পরে বিভাগীয় ডাইরেক্টরের একান্ত সহকারী হন।
"তখন যৌবনের প্রারম্ভ। অতিশয় ক্ষুধা। একেকদিন সন্ধ্যাবেলা এরূপ ক্ষধা পাইতো যে, ক্ষুধায় দাঁড়াইতে পারিতাম না। মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া যাইবার উপক্রম হইত। তখন পেট ভরিয়া কেবল এক লোটা জল খাইতাম। তাহাতে শরীর কিঞ্চিৎ স্নিগ্ধ হইত। এরূপ করিয়া যাহা কিছু যৎসামান্য রাখিতে পারিতাম দুর্ভিক্ষ পীড়িত নরনারীদের দুঃখমোচনের চেষ্টা করিতাম ও বাড়িতে পাঠাইতাম। সেই সময় হইতে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলাম ভবিষ্যতে যাহাতে এই স্বর্ণভূমি ভারতভূমিতে দুর্ভিক্ষ উপস্থিত না হইতে পারে এইরূপ কার্যে আমার মনকে নিয়োজিত করব”।
১৮৭৭-১৮৭৮ সালে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হলে তিনি প্রান বাঁচানোর জন্য গাজর চাষ করার জন্য সরকারকে উপদেশ দেন। তার কথানুযায়ী সরকার ১৮৮৭ সালে কয়েকটি জেলায় গাজরের চাষ করার বন্দোবস্ত করেন। এর ফলে দু বছর পরে রায়বেরিলী ও সুলতানপুর জেলায় দুর্ভিক্ষের সময় তার প্রস্তাবিত গাজর চাষের জন্য বহু প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল।
১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে ভারত সরকারের রাজস্ব বিভাগে বদলী হন। সেই সময় ইনি উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের শিল্পোন্নতির জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেন এবং বিশেষ কৃতকার্যও হন। ১৮৮৩ সালে কলকাতায় আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে কয়েকটি বিষয়ে অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাজ্যে প্রদর্শনী আরম্ভ হয় তখন ত্রৈলোক্যনাথকে সেখানে পাঠানো হয়। সেই সময় তিনি ইউরোপের নানা জায়গায় ভ্রমণ করেন এবং এ ভিজিট টু ইউরোপ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। এই বইটিতে তার সমস্ত কাজ ও ভ্রমণ বৃত্তান্ত রয়েছে।
১৮৮৬ খ্রীষ্টাব্দে এই বিভাগ ত্যাগ করে কলকাতা মিউজিয়ামে সহকারী কিউরেটর হন । ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে দেশীয় শিক্ষা বাণিজ্যে যাতে উন্নতি হয় তার যথেষ্ট চেষ্টা করেন। কলকাতা, বোম্বে প্রভৃতি বড় বড় শহরে এবং বড় বড় রেলস্টেশনে ভারতীয় কারুকার্যের যে সকল দোকান দেখতে পাওয়া যায় তা এঁর উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সময় ইনি সরকারের অনুমতিক্রমে আর্ট ম্যানুফ্যাকচারারস অফ ইন্ডিয়া নামক একটি বই লেখেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে যে সব শিল্প দ্রব্য নির্মিত হত সেই সব শিল্প দ্রব্যের একটি তালিকা ইংরাজীতে প্রকাশ করেন। ত্রৈলোক্যনাথ বর্ধমানে থাকাকালীন ফার্সি ভাষা শিক্ষা করে অভূতপূর্ব নাম করেছিলেন।
সাহিত্যিক হিসাবেই বিখ্যাত। তিনি বাংলা সাহিত্যে এক নতুন রকমের উদ্ভট হাস্যরসের প্রবর্তক ছিলেন। বঙ্গবাসী অফিস থেকে প্রকাশিত জন্মভূমি মাসিক পত্রিকায় ইনি অনেক ভালো ভালো প্রবন্ধ লিখেছিলেন। বিশ্বকোষ নামক অভিধান এঁর চেষ্টাতেই আরম্ভ হয়। বিশ্বকোষ অভিধান রচনায় ভাই রঙ্গলালকে প্রচুর সাহায্য করেছিলেন । এছাড়া জন্মভূমি সাপ্তাহিক পত্রিকাতেও ইনি নিয়মিত লিখতেন। ওয়েলথ্ অফ ইন্ডিয়া নামক মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা কাজেও তিনি সাহায্য করতেন।তাঁর রচিত ডমরু চরিত এবং কঙ্কাবতী খুবই বিখ্যাত। কঙ্কাবতী উপন্যাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন “এইরূপ অদ্ভুত রূপকথা ভাল করিয়া লেখা বিশেষ ক্ষমতার কাজ। ...এতদিন পরে বাঙ্গালায় এমন লেখকের অভ্যুদয়...যাঁহার লেখা আমাদের দেশের বালক বালিকাদের এবং তাঁদের পিতামাতার মনোরঞ্জন করিতে পারিবে।“
১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে ইনি পেনসন গ্রহণ করেন। এবং ৭২ বছর বয়সে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়।
গ্রন্থতালিকা
ফোকলা দিগম্বর
পাপের পরিণাম
ডমরু-চরিত
বাঙ্গাল নিধিরাম
বীরবালা
লুল্লু
নয়নচাঁদের ব্যবসা
কঙ্কাবতী
সোনা করা যাদুগরের গল্প
ভানুমতী ও রুস্তম
জাপানের উপকথা
পূজার ভূত
পিঠে-পার্বনে চীনে ভূত
বিদ্যাধরীর অরুচী
মেঘের কোলে ঝিকিমিকি সতী হাসে ফিকিফিকি
এক ঠেঙো-ছকু
মুক্তা-মালা
এ ডেসক্রিপটিভ ক্যাটালগ অফ প্রোডাক্টস
এ হ্যান্ডবুক অফ ইন্ডিয়ান প্রোডাক্টস
এ লিস্ট অফ ইন্ডিয়ান ইকনমিক প্রোডাক্টস।
মৃত্যু: ৩ নভেম্বর ১৯১৯ ,বয়স ৭২ বছরে।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment