পরমা প্রকৃতি ও লোকজীবন।
" গাছ আমাদের মিতা ও ভাই
গাছ আমাদের মিতা
গাছই মাতা পিতা।"
আদিবাসীরা কখনো ধ্বংস করে না। তারা জল,জমি ও জঙ্গল রক্ষার জন্য লড়াই করে আসছে সেই আবহমান থেকেই। নিয়মাগিরী পাহাড় ধ্বংস করে এগোতে চেয়ে ছিল বেদান্ত অ্যালুমিনিয়াম লিমিটেড। ২০০৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট এই কারখানা করার জন্য ছাড়পত্র দেয়। কিন্তু এই ছাড়পত্রের বিরুদ্ধে আদিবাসীরা আন্দোলনে নামে। অবশেষে দু-বছর পর অর্থাৎ ২০১০ সালে বেদান্ত নিয়মাগিরী-র মাটি থেকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হয়। সেসময় ধনকুবের বেদান্তের কোনরকম প্রলোভনে পা দেননি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষগুলি। ঠিক একই ভাবে কর্নাটকের কোকরেবেলুর গ্রামে বিপন্ন প্রজাতির দেশী পাখি পাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান আদিবাসীরা। আজ কোকরেবেলু কর্নাটকের পাখি সংরক্ষণের অন্যতম কেন্দ্র।
আদিবাসীরা কখনো পুঁথিগত বিদ্যা কারায়ত্ত করে শেখেনি কোন গাছ থেকে কি ঔষধ তৈরি হয়? কিন্তু তারা গাছ গাছড়া থেকে আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরি করে নিজেদের রোগ নিরাময়ে ব্যবহার করে এসেছে যুগ যুগ ধরে। আধুনিক ভারতবর্ষেও স্বমহিমায় বিরাজ করছে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা। ভারতবর্ষের অরুনাচল প্রদেশের প্রত্যন্ত আদিবাসী অঞ্চল গুলিতে গাছ থেকে ঔষধ তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছে। তাছাড়া আমাদের রাজ্যের জঙ্গলমহলে আজও সমান ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক ওষুধ। এখন বিভিন্ন উদ্যোগে ভেষজ বাগান তৈরি করা হচ্ছে। এক একটি গ্রামে ভেষজ বাগান নির্মাণের মধ্য দিয়ে ভেষজ গ্রাম নামে চিহ্নিত করা হচ্ছে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থা থেকে।
বিশ্বায়নের যুগেও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষগুলি নিজ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে চলেছে। তারা রাসায়নিক সারের নুন্যতম প্রয়োগ করেই জৈব সার দিয়ে কৃষি কাজের উপর জোর দেয়। জৈব সার দিয়ে চাষ করলে জমির অম্লত্ব বাড়ে না। কিন্তু তারা এটা জানে না যে রাসায়নিক সার জমির অম্লত্ব বাড়ায় বলে।
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ জন পরিবেশ দূষণ সৃষ্টি কারি ইউক্যালিপটাস গাছকে বর্জন করেছে। তারা জানে না যে এই বৃক্ষ রোপন করলে কি ভাবে পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে যাচ্ছে। এই নিয়ে তরুণ পরিবেশ প্রেমী পেশায় শিক্ষক রাকেশ সিংহ দেব বলেন "আদিবাসী সমাজের মানুষ ঐ গাছকে বর্জন করেছে। কারণ এই গাছে পাখি বাসা বাঁধে না, গাছের নিচে ঘাস জন্মায় না।" এই জন্যই আদিবাসীরা ইউক্যালিপটাস গাছকে বর্জন করে। পরবর্তীকালে বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে ইউক্যালিপটাস গাছের ফলে ব্যপক হারে স্থানীয় পরিবেশের অবক্ষয় ঘটছে। একদিকে যেমন জল স্তর নেমে যাচ্ছে, মাটিতে ঘাস না জন্মানোর জন্য ভূমি ক্ষয় হচ্ছে। এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা মহুয়া গাছের রক্ষনাবেক্ষণ বেশি করতো। কারণ এই সব গাছ থেকে আয় হতো। আদিবাসীরা প্রকৃতির পূজারী। তারা শাল গাছকে দেবতা হিসেবে পূজা করে। ফলে আদিবাসীরা এই সব গাছকে কখনো ধ্বংস করে না। পরবর্তীকালে দেখা গেছে এই সব গাছ বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এছাড়াও চৈত্র মাসের শেষের দিকে বা বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে শাল গাছের ডালকে পুতে পূজা করে। যার নাম শারুল বা সারোল বলে থাকে এলাকা ভেদে। আর এই পূজাকে কেন্দ্র করে ধমসা মাদলের শুরে মেতে ওঠে জঙ্গলবাসী তথা আদিবাসী জনজাতির মানুষগুলি। এই উৎসবগুলিই প্রকৃত বনমহোৎসব। আজকের দিনে এই উৎসবের গুরুত্ব কতটা অপরিসীম তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বন দপ্তর থেকে শুরু করে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। নতুন প্রজন্মকে বৃক্ষ রোপন বা রক্ষনাবেক্ষণের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য সরকারি ভাবে একাধিক কর্মসূচি পালন করতে হচ্ছে। কিন্তু আদিবাসীরা এর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল, তাই তারা তাদের সামাজিক ঐতিহ্যের মধ্যে স্থান দিয়ে ছিল।
অধুনা জঙ্গলবাসী তথা সমাজে পিছিয়ে পড়া বর্গের কোল, কড়া, কুড়মী, লোধা-শরব প্রভৃতি জন জাতির মানুষ গুলি সঙ্গে গাছ ও জঙ্গল ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। এই জন জাতির মানুষ গুলির কাছে বিয়ের অনুষ্ঠানেও গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। বরকে বিয়ে করতে যাওয়ার আগে আম বিহা ও কনে মহুল বিহা করতে হয়। আম বা মহুল গাছে আড়াই প্যাঁচ সুতা জড়িয়ে সিঁদুর দিয়ে গাছ দেবতার কাছ থেকে আশির্বাদ চেয়ে নেয়।
এছাড়াও ভাদ্র মাসের একাদশীতে কৃষি দেবতা তথা করমপূজা করে থাকে এখানকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ গুলি। এই পূজাটি মূলত কুড়মীদের হলেও এখন আর কুড়মী জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই সম্প্রদায়ের সঙ্গে সঙ্গেই অন্যান্য সম্প্রদায়েও এই পূজোয় মেতে ওঠে। একাদশীর পাঁচ থেকে সাত দিন আগে অবিবাহিত মেয়েরা জাওয়া দেয় ডালি বা টুপার মধ্যে। যাকে জাওয়া ডালি বলে। এই জাওয়া ডালিকে মাঝে রেখে প্রতিদিন সকালে নাচ গান করে। এছাড়াও জাওয়ার উপর হলুদ জল দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে বিজ্ঞান আবিষ্কার করে গাছকে গান শুনালে দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে। আর হলুদ জল গাছকে পোকা মাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করে। একাদশীর দিন সন্ধ্যা বেলা করম ডাল পুঁতে পূজা উদযাপন করে।
দিন দিন সভ্যতার বিকাশ ঘটছে। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নগরায়ন। যার জন্য নির্বিচারে বৃক্ষ ছেদন চলছে। ফলে গাছের সংখ্যা দিন দিন কমছে এবং পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে। এটা কোন নতুন ঘটনা নয়। অবাঞ্ছিত বৃক্ষ ছেদন বন্ধ ও নতুন করে বৃক্ষ রোপনের জন্য একাধিক কর্মসূচি পালন করছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। যেমন অরন্যসপ্তাহ ও বনমহোৎসব সপ্তাহ পালনের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি কাজ চলছে। কিন্তু আদিবাসী জনজাতির মানুষ গুলিকে কখনো এই বিষয়ে সচেতন করতে হয়নি। তাদের সামাজিক কৃষ্টি কালচারের মধ্যেই এই সংস্কৃতি জড়িয়ে রয়েছে বংশপরম্পরায়। তাই তাদেরকে শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি এই সব নিয়ে। নিজেরদের তাগিদেই তারা একাজ করে আসছে যুগ যুগ ধরে।
আদিবাসীরা তাদের সামাজিক পরিচয় নিয়েই বেঁচে থাকতে গর্বিত বোধ করে। তারা প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল হওয়ার জন্য প্রকৃতির পূজো করে। এরা প্রকৃতই প্রকৃতির সন্তান।
সংগৃহীত।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment