Saturday, 14 August 2021

বিশেষ প্রতিবেদন। লৌকিক দেবদেবীর অধিষ্ঠান সুন্দরবন। ১৪.০৮.২০২১. Vol -464 The blogger in literature e-magazine.

লৌকিক দেবদেবীর অধিষ্ঠান সুন্দরবন


সুন্দরবন এলাকার সমাজজীবন গ্রামপ্রধান। সমুদ্র, নদী-খাল আর বাদাবন দিয়ে পরিবেষ্টিত এই অঞ্চলের মানুষ প্রধানত কৃষিজীবী, বন এবং জলের উপর নির্ভর। ঝড়-বন্যা, মারি-মড়ক এবং শ্বাপদ-সঙ্কুল প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই চলে প্রতিনিয়ত। প্রাকৃতিক সম্পদই এখানকার মানুষের জীবনধারণের একমাত্র রসদ। তাই এখানকার মানুষ জীবন থেকে মৃত্যু সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করতে নির্ভর করে বনদেব-দেবী এবং পীর-গাজীদের ওপরই।

দেবদেবী এবং পীর-গাজীদের কাছ থেকে এই মানুষরা যে শক্তি পায়, তাই দিয়ে সে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হিংস্র কুমির-কামট, বিষাক্ত সরীসৃপ এবং ভয়াল জঙ্গলের সব ভয়কে উপেক্ষা করার সাহস পায়। দেবতার ধ্যান, জ্ঞান, পূজা, শিরণি, উরস, মেলা ইত্যাদির মাধ্যমেই সাহস অর্জন করে সুন্দরবনের মানুষজন। তাই এখানকার লোকধর্মে বিরল-বিচিত্র রূপ দেখা যায়। সুন্দরবনের দেবতারা একই সঙ্গে নানা ধর্মের লোকদের নৈবেদ্য পেয়ে থাকেন।

এখানকার মানুষেরা নিজ নিজ ধর্মের বাইরেও কিছু লৌকিক দেব-দেবী এবং পীর গাজীর আরাধনা করে থাকে। পালন করে বহু ব্রত বা নিয়ম-কানুন। প্রতিটি দেব-দেবীকে নিয়ে রয়েছে কিছু গল্প বা উপাখ্যান, যার ওপর ভিত্তি করে কাব্য, পুঁথি, গান ইত্যাদি রচিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।

কুমির দেবতা কালু রায় :


সুন্দরবনের মূর্তিমান যমদূত কুমিরের হাত থেকে রক্ষা পাবার বিশ্বাসে জল ও বনজীবী মানুষের কুমির দেবতা কালু রায়ের পূজা করে। দক্ষিণ রায়ের মতো এর মূর্তি একেবারে মানবীয়। পোশাক পৌরাণিক যুদ্ধ-দেবতার মতো। দুই হাতে টাঙ্গি ও ঢাল, কোমরবন্ধে নানা রকম অস্ত্রশস্ত্র ঝোলানো, পীঠে তীর ধনুক। আরণ্যক দেবতার প্রাচীন পূজা পদ্ধতি মেনে কালু রায়ের পূজায় বনঝাউ ফুলের নৈবেদ্য সাজিয়ে দেয়া হয়।

 আটেশ্বর :

সুন্দরবন অঞ্চলের আমি আরণ্যক লোকদেবতা আটেশ্বর। বনজঙ্গল সমাকীর্ণ গ্রাম সমাজের ইনি দেবতা জ্ঞানে উপাসিত হন। ক্ষেত-খামারে আবাদকারী কৃষিজীবী, জেলে ও বনজীবী প্রভৃতি লোকসমাজের মানুষের কাছে দক্ষিণ রায়, নারায়ণী, বনবিবি, গাজী সাহেবের মতো আটেশ্বর সমান শ্রদ্ধা, ভক্তি ও পূজা পান। আটেশ্বরের মূর্তি পূজার প্রচলন ব্যাপক। বেশির ভাগ থানে মূর্তিপূজা হয় নিয়মিত। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, বনরক্ষক আটেশ্বর জঙ্গল সংলগ্ন গ্রামের মানুষ ও গৃহপালিত পশুদের রক্ষা করেন।

জ্বরনাশক জ্বরাসুর :


জ্বররোগ নাশক রূপে পূজিত বিচিত্র দেবতা জ্বরাসুর। অনুররূপী এই জ্বরের দেবতার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য লোকসমাজ এর পূজা করেন। এই দেবতার দেহাবয়ব বিচিত্র ধরনের। গায়ের রঙ ঘন নীল। তিনটি মাথা, নয়টি চোখ, ছয়টি হাত ও তিনটি পা নিয়ে জ্বরাসুর অসংখ্য থানে শীতলা, মনসা, দক্ষিণ রায়, আটেশ্বর, প্রভৃতি লৌকিক দেবদেবীর সঙ্গে পূজা পান। এর মূর্তি পূজার প্রচলন খুব বেশি এবং শীতলার থানে বা মন্দিরে জ্বরাসুর নিত্যপূজা পান।

সর্পদেবী মনসা :


সুন্দরবন অঞ্চলে মনসা পূজা হয় অতি সাধারণ থান ও মন্দিরে। অনেকে পারিবারিক গৃহদেবীরূপে মনসার প্রতীক ঘট অথবা মূর্তি প্রতিষ্ঠা পুরুষানুক্রমে করে আসছেন। সম্পন্ন কৃষিজীবী পরিবারে প্রতিবছর ভাদ্র মাসে মনসার ভাসান, পদ্মপুরাণ ও মনসামঙ্গল কাব্য পাঠের ব্যবস্থা থাকে। ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে বার্ষিক পূজা করা হয়। বার্ষিক মনসা পূজাকে চলতি কথায় বলা হয় রান্নাপূজা।

জঙ্গল জননী বিশালাক্ষী :


কৃষিজীবী, জলজীবী ও বনজীবী লোকসমাজে জঙ্গলজননী বিশালাক্ষীর প্রভাব অসীম। এক সময় সুন্দরবনের জঙ্গলমহল যত প্রসারিত হয়েছে; বিশালাক্ষী পূজার ক্ষেত্র ততই বিস্তৃত হয়েছে। কৃষক, জেলে, মৌয়ালি-বাওয়ালি প্রভৃতি পেশার মানুষের নয়নের মণি ইনি।

ভাঙ্গড় পীর :


ভাঙ্গড় পীর মধ্যযুগের বলিষ্ঠ ইসলাম প্রচারক। তার মাহাত্ম্য কথা প্রচারিত হয়েছে তৎকালীন নিম্নবঙ্গ জুড়ে। মুন্সী মোহাম্মদ খাতের, মোহাম্মদ মুন্সী ও মুন্সী বয়নন্দীন রচিত বনবিবির জহুরানামা পুঁথিতে পীর ভাঙ্গড় শা’র পরিচয় পাই। আল্লাহ রসুলের আজ্ঞায় বনবিবি ও শা জাঙ্গলী ভাটির দেশে এসে প্রথমেই ভাঙ্গড় পীরের আস্তানায় গিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন।


গ্রামজননী বিবি মা :


বিবি মা! এই শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে ভক্তি, ভালোবাসা ও নির্ভরতা। জাতি, ধর্ম ও সম্প্রদায়ের কোনও রূপভেদ এখানে নেই। লোকধর্মে বিবি মা খুব সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর ভাবে স্থান পেয়েছেন। বিবি মা নামটি আবেগ প্রসূত এবং মাতৃত্ববোধক। কিন্তু বিবি মা একক ব্যক্তিত্ব নন। বিবি মা’দের মধ্যে ওলাবিবি মা সর্বজ্যেষ্ঠ। সাত বিবিদের মধ্যে তিনি অধিক সমাদৃত। অন্য ছয়জন তাঁর প্রিয়তমা ভগ্নী। ওলা উঠা রোগের অধিষ্ঠাত্রী বিবি হিসেবে তিনি সর্বজন পরিচিত। অন্য ছয়জন বোনদের নাম হল ঝোলাবিবি,  আজগৈবিবি,  চাঁদবিবি,  বাহড়বিবি,  ঝেটুনেবিবি ও আসানবিবি। মতান্তরে আর একজন আছেন, তার নাম মড়িবিবি। এদের মধ্যে ঝোলাবিবি বলে মানুষের বিশ্বাস। মাটির স্তূপের প্রতীকে এবং মাটির প্রতিমা মূর্তিতে সর্বত্র এরা পূজিত হন। বালি-সিমেন্টে জমিয়েও এদের স্তূপ বানানো হয় কোথাও কোথাও। তবে ছোট-বড় মাঝারি মাটির মূর্তিতে পূজা-হাজত দেয়া হয় প্রায় সর্বত্র।

পশুরক্ষক মানিক পীর :


মানিক পীর গোরক্ষক দেবতারূপে চাষী হিন্দু গৃহস্থ পরিবারে পুজা করা হয়। এর ব্যক্তি-পরিচয় অন্যান্য পীর-গাজী-বিবিদের মতো রহস্যাবৃত। ভক্তজনের বিশ্বাস, ইনি ছিলেন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন কোনও হেকিমী চিকিৎসক ও সাধক। গৃহপালিত পশুপক্ষীর রোগ নিরাময়কারী ছিলেন বলে এক সময় শ্রদ্ধাভক্তির প্রাবল্যে লৌকিক দেবতায় উন্নীত হয়েছেন। সেবা পূজার ব্যাপকতায় মানিকপীর লৌকিক দেবদেবীর সঙ্গে একই থানে বা দেবালয়ে পূজা পান।

মাছের দেবতা মাকাল ঠাকুর :


সুন্দরবনের জেলেদের সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতা হলেন ‘মাকাল ঠাকুর’। তার মূর্তি মানবাকৃতি নয়, বরং ছোট একটি বা একসঙ্গে দুটি স্তূপের মতো। এই স্তূপটি মাটির তৈরি ওল্টানো গ্লাস বা কতকটা টোপরের মতো দেখতে। মাকাল ঠাকুরের পূজার কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই। সুন্দরবনের জেলেরা মাছ ধরতে যাওয়ার আগে নদী বা খালের পাড়ে পূজা করে থাকে। পূজার জায়গা পরিষ্কার করে নিয়ে মাটি দিয়ে বেদি তৈরি করে তাতে মূর্তি বসানো হয়। বেদির চারপাশে তীরকাঠি পুঁতে বেড়া দেয়া হয়। সিঁদুর মাখানো ফুল, বেল পাতা ও তুলসিপাতার সঙ্গে নৈবেদ্য হিসেবে আতপচাল, পাকা কলা, বাচ্চাদের চকলেট ইত্যাদি দিয়ে মাকাল ঠাকুরের পূজা হয়। ভক্তদের বিশ্বাস পূজায় ঠাকুর সন্তুষ্ট হলে প্রচুর মাছ পাওয়া যাবে।

বনবিবি :


বনবিবি অরণ্যের দেবী রূপে পূজিতা। লোক বিশ্বাস অনুযায়ী কোথাও তিনি মুরগির রূপ ধারণ করেন, কোথাও বাঘের। বনবিবি অন্য কোনও দেব-দেবীর মতো উগ্র বা প্রতিহিংসাপরায়ণ নন। বরং সুশ্রী, লাবণ্যময়ী ভক্তবৎসলা দেবী। বনের সমস্ত সৃষ্টিতে রয়েছে তার মমতা। তিনি মানুষকে ভালোবাসেন। তেমনি ভালোবাসেন প্রকৃতিকে। বনবিবির মাহাত্ম্যের মহিমায় মুগ্ধ হয়ে আছে সুন্দরবন অঞ্চলের কৃষিজীবী, ক্ষেতমজুর, বাওয়ালী, মৌওয়ালী, কাঠুরে, জেলে, আদিবাসী মুন্ডা, শিকারী প্রভৃতি গরিব মানুষ। এরা নিত্য স্মরণে রাখেন, মা বনবিবিকে। প্রতি বছর জানুয়ারির মাঝামাঝিতে বনবিবির প্রধান পূজা হয়।

গাজীপীর :


গাজী-কালু চম্পাবতীর পুঁথির কাহিনী যাই থাকুক না কেন হিন্দু-মুসলমান অধ্যুষিত সুন্দরবনের সবাই তাকে স্মরণ করে। যে কেউ সুন্দরবনে ঢুকবার আগে হাতজোড় করে বনবিবির পাশাপাশি গাজীর নামে দোহাই দিয়ে ঢোকে। সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়গুলোতে সাদা বর্ণের মুখে দাড়িসহ কোথাও জামা-পায়জামা-পাঞ্জাবিসহ মূর্তি, কোথাও লুঙ্গি পরা ঘাড়ে গামছাসহ মূর্তি পূজিত হয়। এই পূজার নিরামিষ নৈবেদ্য হলো বাতাসা, পাটালি, আতপচালের শিরণি ইত্যাদি। গ্রামের সাধারণ লোকেরা জঙ্গলে প্রবেশ ছাড়াও গৃহপালিত পশুপাখির কামনা করেও গাজী সাহেবকে স্মরণ করে থাকে।

বনদেবী নারায়ণী :


কৃষিজীবী ও বনজীবী মানুষের মধ্যে এক উচ্চ আসন পেতে বসে আছেন এই দেবী। ইনিও বাঘের দেবতা বলে পরিচিত। তবে কিছুটা বাড়তি মাতৃত্বের অধিকারিণী। বিভিন্ন বাড়ির আশপাশের বনবাদড় অথবা ঝোপঝাড় সংলগ্ন স্থানে বনদেবী নারায়ণীর থান রয়েছে। বেশিরভাগ থান হল মাটির দেয়াল খড় অথবা টালির ছাউনি দেয়া ঘর। তালপাতার ছাউনি দেয়া ছোট্ট কুঁজিঘরের থান চোখে পড়েছে। সুন্দরবনের আরণ্যক সভ্যতার অন্যতম সাক্ষী হয়ে মা নারায়ণী মধ্যযুগ থেকে বিরাজ করছেন।

সন্তান রক্ষক পাঁচু ঠাকুর ও পেঁচো-পেঁচি :


পাঁচু ঠাকুর শিশুসন্তান রক্ষক দেবতা। শিশুসন্তান হারানোর ভয় বাবা ও মাকে চিরদিন কাতর করে রাখে। শিক্ষা ক্ষেত্রে অনগ্রসরতা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো না থাকায় সুন্দরবন অঞ্চলে কয়েক দশক পর্যন্ত শিশু মৃত্যুর হার ছিল ভয়ানক। লৌকিক দেবতা পাঁচু ঠাকুরের জনপ্রিয়তা হয়েছে সন্তান হারাবার ভয় থেকে। গৃহস্থের বাসস্থান থেকে কিছু দূরে পুকুর অথবা খালের পাড়ে তালগাছ, বটগাছ তলায় উন্মুক্ত স্থানে পাঁচু ঠাকুরের উপাসনা ক্ষেত্র বলে চিহ্নিত হয়। কোথাও গ্রামের বাইরে মাটির ছোট্ট ঘরে পাঁচু ঠাকুর, স্ত্রী দেবতা পাঁচি ঠাকুরানী পূজিত হন। অনেক মা আছেন, যারা শারীরিক কারণে বারবার মৃত সন্তান প্রসব করেন। এই মায়েরা পাঁচু ঠাকুরের থানে পুজো দেন। সন্তান রক্ষা হল পাঁচু ঠাকুরের থানে মাটির মূর্তি বা ছলন প্রতিষ্ঠা করে পূজা দেন।


=========∆∆∆∆∆∆∆∆∆==========




No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। পশুপতি ভট্টাচার্য । খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। Dt -15.11.2024. Vol -1053. Friday. The blogger post in literary e magazine

পশুপতি ভট্টাচার্য  ১৫ নভেম্বর ১৮৯১ -  ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৮   একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। জন্ম  বিহার রাজ্যে পিতার কর্মস্থল আরায়। তাদ...