১৮৫০ সালের ৫ আগস্ট। ফ্রান্সের এক ছোট্ট শহরে নরম্যান্ডি। তাঁর পিতার নাম গ্যুস্তাভ দ্য মোপসঁ এবং মায়ের নাম লোর ল্য পোয়াতভাঁ। জন্ম নিলেন আধুনিক ছোট গল্পের জনক গী দ্য মপাসাঁ। লরা ছিলেন অভিজাত পরিবারের সন্তান। তাঁর সমস্ত আচার আচরণ এবং চিন্তাভাবনায় সেই আভিজাত্য আর পরিশীলিত রুচির ছাপ ছিলো স্পষ্ট।
মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান বলে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন কিছুটা।১৯৬৭ সালে তিনি একটি নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৬৯ সালে মোপাসঁ প্যারিসে আইন বিষয়ে লেখাপড়া শুরু করেন।
ভালোবেসে গুস্তাভকে বিয়ে করলেও পরবর্তীতে স্বামীর পরনারী প্রীতি আর লাগামছাড়া উশৃংঙ্খল আচরণ সহ্য করতে না পারায় সন্তানদের নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। তাই মপাসাঁর শৈশবের প্রায় পুরোটাই কেটেছে মায়ের কাছে। শিল্প-সাহিত্যপ্রেমী মায়ের সাহচর্য তাঁর শিশুমনে দারুণ প্রভাব ফেলেছিলো। ছোটবেলা থেকেই মনের মধ্যে সাহিত্যের জন্য আলাদা জায়গা তৈরী হয়ে গিয়েছিলো। প্রচুর বই পড়তেন। ভালোবাসতেন উন্মুক্ত প্রকৃতি, উদার আকাশ আর নিঃসঙ্গ সময়।
মপাসাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি মায়ের কাছেই। এরপর তাকে ভর্তি করে দেওয়া হয় স্থানীয় এক মিশনারী স্কুলে। কিন্তু মিশনারী স্কুলের বাঁধাধরা পরিবেশে তার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছিলো। এরই মাঝে মপাসাঁ অভিযুক্ত হলেন অশ্লীল কবিতা লেখার দায়ে। স্কুল ছাড়তে হলো। মপাসাঁর রচিত কবিতার মধ্যে তখন দেহজ কাম আর প্রেমের প্রভাব ছিলো স্পষ্ট। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, বাবা গুস্তাভের কাছ থেকে এই স্বভাব জন্মগতভাবেই পেয়েছিলেন মপাসাঁ।
স্কুলে পড়াকালীন সময়ে যে শিক্ষক মপাসাঁকে সবচেয়ে বেশী উৎসাহ দিয়েছিলেন তার নাম বোলহেতের। বোলহেতের মপাসাঁর সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মপাসাঁর সাহিত্য প্রতিভাকে। প্রায়ই দুজনের মাঝে সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হতো।
এরই মাঝে মপাসাঁ স্কুলের পড়ার পাট চুকালেন। আইন পড়ার ইচ্ছা থাকলেও অর্থাভাবে তা আর হয়ে উঠলো না। পেটের দায়ে চাকরি করার কথা চিন্তা করলেও নাম লেখাতে হলো সেনাবাহিনীতে। কারণ তখন প্রুশিয়ার সাথে ফ্রান্সের যুদ্ধ চলছে। সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে না থাকলেও এর সাথে ওতপ্রোতভাবেই জড়িত ছিলেন মপাসাঁ। যুদ্ধের ভয়াবহতা আর অস্থির পরিস্থিতি তাকে বেশ ভালোমতনই স্পর্শ করেছিলো। এই অভিজ্ঞতা থেকেই লিখেছিলেন তাঁর প্রথম স্বার্থক ছোটগল্প ‘ Boule de suif’ বা ‘একতাল চর্বি’।
‘একতাল চর্বি’র গল্পটি মূলত ফ্রান্স আর জার্মানির যুদ্ধের আবহে লেখা। গল্পের নায়িকা একজন অত্যধিক স্বাস্থ্যবান বারবণিতা। যুদ্ধের সময় দশজন ফরাসী যাত্রী রুয়েন ছেড়ে হাভারের দিকে যাচ্ছিলেন। সকলেই সম্ভ্রান্ত আর অভিজাত পরিবারের। অভিজাত যাত্রীরা বারবণিতাকে তাচ্ছিল্য করছিলো বারবার। কিন্তু একসময় খাদ্যাভাব দেখা দিলে সেই বারবণিতার দেওয়া খাবারই গ্রহণ করতে হলো সবার।
পথ চলতে চলতে একসময় জার্মান সেনাপতির আয়ত্বে চলে আসলো দলটি। বারবণিতাকে আদেশ করা হলো সেনাপতির ঘরে রাত কাটাতে। রাজি হলো না সে। আদেশ দেওয়া হলো সব যাত্রীকে বন্দি করার। সকলের ভালোর কথা চিন্তা করে বারবণিতা রাজি হলো সেনাপতির সাথে রাত কাটাতে। পরদিন সবার মুক্তি মিললেও সবাই সেই স্বাস্থ্যবতী বারবণিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। একটু খাবার কিংবা সমবেদনা তো সে পেলোই না, বরং পাপী বলে সবাই তিরস্কার করলো। ‘একতাল চর্বি’ গল্পের মূল কাহিনী অনেকটা এরকমই। এই গল্প প্রকাশের সাথে সাথে চারদিকে মপাসাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিলো। চাকুরি ছেড়ে মপাসাঁ নাম লেখালেন পুরোদস্তুর সাহিত্যিকের খাতায়।
মপাসাঁর সাহিত্যিক হয়ে ওঠার পেছনে যে মানুষটির কথা না বললেই নয় তিনি হলেন ফরাসি সাহিত্যের আরেক দিকপাল গুস্তাভ ফ্লবেয়ার। ফ্লবেয়ারের সাথে মপাসাঁর মা লরার আত্মীয়তার সূত্রে পরিচয় ছিলো। ছেলের শিল্প সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ আর ভালোবাসা দেখে লরা ভাবলেন ফ্লবেয়ার হয়তো মপাসাঁকে সাহায্য করতে পারেন। তখন সবে মাদাম বোভারী প্রকাশিত হয়েছে। সমগ্র ইউরোপ জুড়ে এই বই নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তখন তুঙ্গে। এমন সময় একদিন বিশ-একুশ বছর বয়সী এক ছেলে এসে হাজির হলো। পরিচয় জানতে চাইলে ছেলেটি ফ্লবেয়ারের হাতে একটি চিঠি তুলে দিলো। চিঠিটি লিখেছিলেন লরা।
“আমার ছেলেকে তোমার কাছে পাঠালাম। ও লেখক হতে চায়। তোমার সাহায্য পেলে ও নিশ্চয়ই সফল হবে।”
কিছুটা হাসিই পেয়েছিলো ফ্লবেয়ারের। লেখক হওয়া নিশ্চয়ই ক্লাসের পড়া শেখার মতো কিছু নয়, পড়ালাম আর শিখে নিলো। আগে-পরে এমন অনুরোধ যতবার পেয়েছেন, তাদের ফিরিয়ে দিতে সামান্যতম দ্বিধাবোধ করেননি ফ্লবেয়ার।
এবার আর না করতে পারলেন না। ইয়া মোটা এক অভিধান ছেলেটির হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “এই বইটা ভালোমতন পড়লেই তুমি লেখক হতে পারবে“। ফ্লবেয়ার ভেবেছিলেন ছেলেটি কখনোই এই বইটি পড়ে শেষ করতে পারবে না। কিন্তু তাঁকে চমকে দিয়ে মপাসাঁ ওই অভিধান নিয়ে তাঁর কাছে হাজির হলেন এবং গোটা অভিধানটাই তাঁর মুখস্থ। এবার ফ্লবেয়ারের মনে হলো, ছেলেটার মাঝে অধ্যবসায় আছে। কথায় কথায় মপাসাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “ঐ জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে কী দেখছো?”
মপাসাঁ বললেন, “একটি গাছ“।
-“শুধুই একটি গাছ“?
– “নাহ। এর সাথে আছে একটি বাড়ি, আকাশ, পাখি“।
উত্তরে ফ্লবেয়ার খুশি হলেন। বোঝালেন, আমরা যা দেখি তা কখনোই একা না, চারপাশটা নিয়েই প্রতিটি বস্তুর অস্তিত্ব বিরাজমান। সাহিত্য ও অনেকটা তেমনই। এভাবেই গুরুর সাথে মপাসাঁর পরিচয়। প্যারিসে ফ্লবেয়ারের বাসায় আলোচনা হতো দুজনের। ফ্লবেয়ারই মপাসাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ইভান তুর্গেনেভ, হেনরি জেমস আর এমিল জোলার মতো তুখোড় সাহিত্যিকদের রচনার সাথে। ফ্লবেয়ার মপাসাঁকে বিশেষ স্নেহ করতেন। ফ্লবেয়ার বলেছিলেন, “মপাসাঁ আমার শিষ্য, আমি তাকে ছেলের মতোই ভালোবাসি“। ১৮৮০ সালে ফ্লবেয়ারের অপ্রত্যাশিত মৃত্যু মপাসাঁকে ভীষণ রকমের ব্যথিত করেছিলো।
১৮৮০ থেকে ১৮৯০, এই দশ বছরে প্রায় তিনশরও বেশি ছোটগল্প, ছয়টি উপন্যাস, তিনটি ভ্রমণকাহিনী লিখেছিলেন মপাসাঁ! লেখার সংখ্যা অধিক হলেও মানের সাথে কখনোই আপস করেননি তিনি। মপাসাঁর বেশিরভাগ সৃষ্টিকর্মের জন্মকাল মূলত এই দশ বছরে। সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের সাথে মিশতেন। কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করতেন তাদের জীবনযাত্রাকে। এরাই যে তাঁর গল্পের মূল উপজীব্য।
মপাসাঁ রচিত ছোটগল্পগুলোর মাঝে দ্য নেকলেস, মরোকা, দ্য হোরলা, ল্যা মসিয়েন তেলিয়ের, ম্যাডময়েস ফিফি, ইউজলেস বিউটি ইত্যাদি খুবই বিখ্যাত। মপাসাঁর ছোটগল্পগুলো বাংলাসহ বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। মপাসাঁর গল্পগুলোর মাঝে স্বাদ আর শিল্পের ভিন্নতা ছিলো। রাজসভার মন্ত্রী থেকে শুরু করে সমাজের নিচুতলায় বসবাসকারী একজন কেরানীকেও তাঁর গল্পের চরিত্র হতে দেখা গিয়েছে।
মপাসাঁ রচিত উপন্যাসগুলোর মাঝে বেল আমি, স্ট্রং অ্যাজ ডেথ, জোয়েত, একটি জীবন, আমাদের হৃদয়, পীয়ের, মতঁ ওরিয়েল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এর মাঝে ‘বেল আমি’ তাঁর সবচেয়ে বহুল পঠিত উপন্যাস। ছোটগল্পে মপাসাঁ নিজেকে যতটা তুলে ধরতে পেরেছিলেন, উপন্যাসগুলোতে তেমন একটা দেখা যায় না। অনেকে মনে করেন, ‘বেল আমি’ ছাড়া বেশিরভাগ উপন্যাসই মপাসাঁ লিখেছিলেন প্রকাশকদের তাগিদে।
একদিকে লেখালেখিতে মপাসাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ছিলো, অন্যদিকে শরীরে বাসা বাঁধছিলো ভয়ঙ্কর সিফিলিস আর গনোরিয়ার জীবাণু। প্রথম যৌবনের অত্যাচারই এই রোগের মূল উৎস। যৌনবাহিত এই ভয়াবহ রোগের কোনো কার্যকরী ঔষধ তখনো আবিস্কৃত হয়নি। প্রচুর জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও মপাসাঁ ছিলেন আমৃত্যু একাকী এক বিষাদগ্রস্থ মানুষ।
একদিকে সিফিলিস, গনোরিয়া, অন্যদিকে একাকীত্ব থেকে দেখা দিয়েছিলো মানসিক অসুস্থতা। মানসিকভাবে ভীষণ রকমের ভেঙ্গে পড়েছিলেন। একদিন রিভালবার দিয়ে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন। পরিচারক আগেই ঘটনা আন্দাজ করতে পেরে রিভালবার থেকে গুলি সরিয়ে রেখেছিলো। তাই গুলিতে কাজ না হওয়ায় ধারালো ছুরি দিয়ে কণ্ঠনালিতে আঘাত করলেন। ডাক্তার এসে রক্তপাত বন্ধ করলেও কমলো না মানসিক অসুস্থতা। একপর্যায়ে মপাসাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো মানসিক হাসপাতালে।
দিনটা ছিলো ১৮৯৩ সালের ৬ই জুলাই। তেতাল্লিশতম জন্মদিনের কিছুদিন আগেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলেন ছোটগল্পের এই জাদুকর। মাত্র ৪৩ বছরেরও কম সময় পৃথিবীর বুকে তাঁর সাহিত্যের জাল বিস্তারের সময় পেয়েছিলেন মপাসাঁ। কিন্তু যতদিন ছোটগল্প থাকবে, ততদিন লেখক পাঠকদের মনে তাঁর কাজ দিয়ে চির অমর হয়ে থাকবেন আধুনিক ছোটগল্পের জনক গী দ্য মপাসাঁ।
বিশ্বসাহিত্যের সেরা ছোটগল্প লেখকদের নাম নিতে গেলে একেবারেই প্রথম সারিতে যে নামগুলো চলে আসে, তাদের মাঝে গী দ্য মপাসাঁ অন্যতম। মূলত ফরাসী ভাষায় সাহিত্য রচনা করলেও মপাসাঁর সৃষ্টিগুলো সমগ্র বিশ্বসাহিত্যের সম্পদ।
∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆
No comments:
Post a Comment