১৮৭১ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তাঁর জন্ম। তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রপৌত্র এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র ও গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র । দাদা গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র হলেন অবনীন্দ্রনাথ।
১৮৭৬ সালে নর্মাল স্কুলে অবনীন্দ্রনাথের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। তারপর কিছুদিন তিনি সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করেন, কিন্তু এন্ট্রান্স পরীক্ষার পূর্বেই কলেজ ত্যাগ করেন (১৮৯০)। পরে তিনি নিজ চেষ্টায় ইংরেজি, ফরাসি, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষা-সাহিত্য এবং সঙ্গীতে দক্ষতা অর্জন করেন।
১৮৮১ থেকে ১৮৮৯ পর্যন্ত সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করেন। '৮৯ সালেই সুহাসিনী দেবীর সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৮৯০-এ গড়া রবীন্দ্রনাথের খামখেয়ালি সভার সভ্য হয়ে তিনি কবিতা পড়েছেন; নাটক করেছেন। ১৮৯৬ সালে কোলকাতা আর্ট স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম এই মর্যাদা লাভ করেন। ১৯১১ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানি মেরি ভারত ভ্রমণে এলে আর্ট গ্যালারি পরিদর্শনের সময় তাঁদেরকে ওরিয়েন্টাল আর্ট সম্পর্কে বোঝাবার দায়িত্ব পান। ১৯১৩ সালে লন্ডনে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়; এবং তিনি ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে সি আই ই উপাধি লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডক্টর অফ লিটারেচার ডিগ্রি প্রদান করে ১৯২১ সালে। ১৯৪২ সালে শিল্পীপত্নীর মৃত্যু হয়। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর আচার্যরূপে দায়িত্ব পালন করেন।
ছবি আঁকার প্রতি অবনীন্দ্রনাথের আগ্রহ ছিল প্রবল। প্রথমে পাশ্চাত্য এবং পরে প্রাচ্য রীতিতে তিনি ছবি আঁকেন। ইতালিয়ান গিলার্ডি, ইংরেজ পামার, জাপানি টাইকান প্রমুখ চিত্রশিল্পীর নিকট তিনি চিত্রাঙ্কন বিষয়ে শিক্ষালাভ করেন। তবে ভারতীয় চিত্ররীতিতেই তিনি সমধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন এবং তাঁর হাতেই ভারতীয় শিল্পকলা নতুন প্রাণ পায়। ‘নির্বাসিত যক্ষ’, ‘ভারতমাতা’ ও ‘সাজাহানের মৃত্যু’ তাঁর অমর শিল্পকীর্তি। Indian Society of Oriental Art (১৯০৭) তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। লন্ডন, প্যারিস ও জাপানে তাঁর চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয়।
অবনীন্দ্রনাথ ১৮৯৮ সালে কলকাতার আর্ট কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। দীর্ঘকাল এ পদে দায়িত্ব পালনের পর ১৯২১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বাগেশ্রী অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলন, বিদেশি পোশাক বর্জন, রাখিবন্ধন উৎসব, স্বদেশী শিল্পের উন্নয়ন ইত্যাদি জাতীয় কর্মকান্ডে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
অবনীন্দ্রনাথের চিত্রকলার পাঠ শুরু হয় তৎকালীন আর্ট স্কুলের শিক্ষক ইতালীয় শিল্পী গিলার্ডির কাছে। তাঁর কাছে অবনীন্দ্রনাথ শেখেন ড্রয়িং, প্যাস্টেল ও জলরং। পরবর্তীতে ইংরেজ শিল্পী সি এল পামারের কাছে লাইফ স্টাডি, তেলরং ইত্যাদি শিক্ষা অর্জন করেন। ভারতীয় রীতিতে তাঁর আঁকা প্রথম চিত্রাবলি ‘কৃষ্ণলীলা-সংক্রান্ত’। এই রীতি অনুসারী চিত্রশিল্পের তিনি নব জন্মদাতা। ১৮৯৫ সালের দিকে অবনীন্দ্রনাথ প্রথম নিরীক্ষা শুরু করেন। ১৮৯৭ সালে আঁকলেন শুক্লাভিসার- রাধার ছবি মাঝে রেখে উৎকীর্ণ কবি গোবিন্দ দাসের পঙ্ক্তিমালা, যা ছিল পাশ্চাত্য নিয়মের সাথে ভারতীয় রীতির নবতর সংশ্লেষণ; যোজন-বিয়োজন। ১৯০০ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে কৃষ্ণলীলা সিরিজ প্রদর্শিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ই বি হ্যাভেলের উদ্যোগে লর্ড কার্জনের দিল্লি দরবারে আরো দুটি প্রদর্শনী এবং লন্ডনের ‘স্টুডিও’ পত্রিকায় চিত্রালোচনা প্রকাশিত হলে অবনীন্দ্রনাথের ছবি শিল্পরসিকদের মাঝে আগ্রহের জন্ম দেয়। তাঁর শাজাহানের অন্তিমকাল মোঘল মিনিয়েচারের এক লোকায়ত নিরীক্ষা,যেখানে শাজাহানের অন্তিম সারবত্তা করুণ রসের.
রচনা কর্ম :
|
|
চিত্র কলা :
|
|
""মন যৌবনের শেষ চাইল না, নতুন থেকে নতুনতর আনন্দে আপনাকে ' হারিয়ে ফেলেই চলল, এই হল রূপদক্ষের কথা, রূপ সাধনার চরম্ সিদ্ধি । আয়নাতে যেমন নিজের নিজের চেহারা তেমনি মনের দর্পণেও আমরা প্রত্যেকে নিজের নিজের মনমতকে সুন্দরই দেখি । কারু কাছ থেকে ধার-করা আয়না এনে যে আমরা সুন্দরকে দেখতে পাবো তার উপায় নেই।"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্রশিল্পী হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। অবনীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যরীতি অনুসরণে ইটালিয়ান গিলার্ডি এবং ইংরেজ শিল্পী পামার-এর কাছে প্যাস্টেল, জলরং, তেলরং এবং প্রতিকৃতি অঙ্কন শেখেন। কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি ভারতীয় চিত্রাঙ্কনরীতি পুনরুদ্ধারের সাধনা শুরু করেন। ভারতীয় রীতিতে আঁকা তার প্রথম দিকের বজ্রমুকুট, ঋতুসংহার, বুদ্ধ, সুজাতা, কৃয়লীলা প্রভৃতি বিষয়ক ছবিতেও ভারতীয় আঙ্গিকের অনুকরণ প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে হ্যাভেল সাহেবের আগ্রহে অবনীন্দ্রনাথ কলকাতার আর্ট কলেজের উপাধ্যক্ষ হন। তিনি জাপানি শিল্পী টাইকানের কাছে জাপানি অঙ্কনরীতি শিক্ষা করেন, যার প্রভাব ওমর খৈয়াম চিত্রাবলিতে দেখা যায়।
শিক্ষকরূপে সারা ভারতে ভারতীয় চিত্রাঙ্কন রীতি পুনরুদ্ধারের যে ব্যাপক আন্দোলন অবনীন্দ্রনাথ শুরু করেন, তার মাধ্যমেই ভারতীয় শিল্প নবজন্ম লাভ করে। শেষ জীবনে তিনি কুটুম-কাটাম' নামে বিখ্যাত আকারনিষ্ঠ বিমূর্তরূপ সৃষ্টি করেন। ভগিনী নিবেদিতা, স্যার জন উডরক, হ্যাভেল প্রমুখের উদ্যোগে অবনীন্দ্রনাথের শিল্পাদর্শ জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ওরিয়েন্টাল আর্ট সােসাইটি’ স্থাপিত হয়। ভারত ছাড়াও লন্ডনে, প্যারিসে, জাপানে তাঁর ছবির প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর আঁকা বিখ্যাত কিছু ছবির নাম- সাহাজাদপুর দৃশ্যাবলি, আরব্যোপন্যাসের গল্প, কবিকঙ্কন চণ্ডি, প্রত্যাবর্তন, জারনিস এন্ড, সাজাহান প্রভৃতি। এ ছাড়াও তিনি বহু মুখােশের পরিকল্পনাও রচনা করেছিলেন.
১৯৫১ সালের ৫ ডিসেম্বর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয় .
===========||||||||||||||||==========
"অন্ধকারের একটা অটল সৌন্দর্য আছে এবং তার অন্তরের গুপ্ত শক্তি নিহিত থাকে । ☞ সকলেই মরে, কিন্তু সকলেই আর প্রেমে পড়ে না । ".
১৮৬৮ সালের ৭ আগস্ট যশোরে তাঁর জন্ম। পিতা দুর্গাদাস চৌধুরী ছিলেন জমিদার। প্রমথ চৌধুরী কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দর্শনে অনার্সসহ বিএ (১৮৮৯) এবং ইংরেজিতে এমএ (১৮৯০) পাস করেন। ১৮৯৩ সালে প্রমথ চৌধুরী বিলেত যান এবং ব্যারিস্টারি পাস করে দেশে ফিরে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায়ে যোগদান করেন। অবশ্য এ ব্যবসায়ে তিনি বেশিদিন যুক্ত থাকেননি।
প্রমথ চৌধুরী ১৮৯৯ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ইন্দিরা দেবীকে বিবাহ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজে কিছুকাল অধ্যাপনা করেন এবং ঠাকুর এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। পরে তিনি সাহিত্যচর্চায় পরিপূর্ণভাবে মনোনিবেশ করেন।
১৯১৪ সালে মাসিক সবুজপত্র প্রকাশনা এবং তার মাধ্যমে বাংলা চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। একে কেন্দ্র করে তখন একটি শক্তিশালী লেখকগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। প্রমথ চৌধুরী ‘বীরবল’ ছদ্মনামে এ পত্রিকায় ব্যঙ্গরসাত্মক প্রবন্ধ ও নানা গল্প প্রকাশ করেন। তাঁর এ ছদ্মনাম থেকে তখন বাংলা সাহিত্যে বীরবলী ধারা প্রবর্তিত হয়। তাঁর সম্পাদিত অন্যান্য পত্রিকা হলো বিশ্বভারতী (১৩৪৯-৫০), রূপ ও রীতি (১৩৪৭-৪৯) এবং অলকা।
সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রমথ চৌধুরীর প্রধান খ্যাতি মননশীল প্রবন্ধলেখক হিসেবে। তবে তিনি উচ্চমানের গল্প ও কবিতাও রচনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম বিদ্রূপাত্মক প্রবন্ধ রচনা করেন। বুদ্ধিদীপ্ত তির্যকভঙ্গি তাঁর গদ্য-পদ্য সব রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। শাণিত যুক্তি ও আলঙ্কারিক ভাষা প্রয়োগেও তিনি দক্ষ ছিলেন। তিনি ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্যে সুপন্ডিত ছিলেন। ফরাসি সনেটরীতি ট্রিয়লেট, তের্জারিমা ইত্যাদি বিদেশি কাব্যবন্ধ বাংলা কাব্যে তিনিই প্রবর্তন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: তেল-নুন-লাকড়ি (১৯০৬), সনেট পঞ্চাশৎ (১৯১৩), চার-ইয়ারি কথা (১৯১৬), বীরবলের হালখাতা (১৯১৬), The Story of Bengali Literature (১৯১৭), পদচারণ (১৯১৯), রায়তের কথা (১৯২৬), নীললোহিত (১৯৩২) ও আত্মকথা (১৯৪৬)।
প্রমথ চৌধুরী ১৯৩৭ সালে কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত একবিংশ বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষ-বক্তারূপে বঙ্গ সাহিত্যের পরিচয় তুলে ধরেন। ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক জগত্তারিণী স্বর্ণপদকে ভূষিত হন।
১৯৪৬ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে তাঁর মৃত্যু হয়।
=============∆∆∆∆∆∆============
No comments:
Post a Comment