Sunday, 8 August 2021

বিশেষ আলোচনা। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর আগের দিন গুলো এবং পারিবারিক মৃত্যু মিছিল। ০৮.০৮ ২০২১. Vol - 458. The blogger in literature e-magazine

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর আগের দিনগুলো পারিবারিক জীবনে মৃত্যুর মিছিল।



১৯৪১ সালে জীবনের শেষ দিনগুলোয় অসুখে ভুগছিলেন কবি। সারা জীবন চিকিৎসকের কাঁচি থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছেন, এবার বুঝি আর তা সম্ভব নয়। হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি চলছেই। কিন্তু কিছুতে কিছু হচ্ছে না। শান্তিনিকেতনে ছিলেন তখন। এরই মধ্যে অবনীন্দ্রনাথ বেশ কিছু গল্প লিখেছেন। সেগুলো পড়ে দারুণ আনন্দ পেলেন কবি। বললেন, আরও লিখতে। অবন ঠাকুর রানী চন্দকে গল্প বলে যান, রানী চন্দ সে গল্প শুনে লিখে ফেলেন। তারই কিছু আবার দেওয়া হলো রবীন্দ্রনাথকে। তিনি পড়লেন, হাসলেন এবং কাঁদলেন। রানী চন্দ এই প্রথম এমন করে রবিঠাকুরের চোখ থেকে জল পড়তে দেখলেন।
রানী চন্দ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয়ভাজন, শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থী ও চিত্রশিল্পী এবং রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সচিব অনিল চন্দের স্ত্রী।
চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারের কথাই বললেন। রবীন্দ্রনাথের তাতে মত নেই। তিনি বললেন, ‘মানুষকে তো মরতেই হবে একদিন। একভাবে না একভাবে এই শরীরের শেষ হতে হবে তো, তা এমনি করেই হোক না শেষ। মিথ্যে এটাকে কাটাকুটি ছেঁড়াছেঁড়ি করার কি প্রয়োজন?’
কিন্তু যে যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছেন তিনি, তার উপশমের জন্য দেহে অস্ত্রোপচার করতেই হবে—এই হলো চিকিৎসকদের মত। আর সেটা করতে হলে শান্তিনিকেতনকে বিদায় জানিয়ে চলে আসতে হবে কলকাতায়। তাই শেষবারের মতো শান্তিনিকেতন ছাড়লেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ২৫ জুলাই বেলা তিনটা ১৫ মিনিটে রবীন্দ্রনাথ এলেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে।
খবরটা গোপন রাখায় স্টেশনে কিংবা বাড়িতে ভিড় ছিল না। পুরোনো বাড়ির দোতলায় ‘পাথরের ঘর’-এ তিনি উঠলেন। স্ট্রেচারে করে দোতলায় নিতে হলো তাঁকে। ২৬ জুলাই রবিঠাকুর ছিলেন প্রফুল্ল। ৮০ বছরের খুড়ো রবীন্দ্রনাথ আর ৭০ বছর বয়সী ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ অতীত দিনের নানা কথা স্মরণ করলেন। হাসলেন প্রাণখুলে। ২৭ জুলাই সকালে রবীন্দ্রনাথ মুখে মুখে বললেন একটি কবিতা, টুকে নিলেন রানী চন্দ। কবিতাটির প্রথম কয়েকটি পঙ্ক্তি হলো: ‘প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল সত্ত্বার নতুন আবির্ভাবে, কে তুমি, মেলে নি উত্তর।’ ৩০ জুলাই ঠিক হয়েছিল তাঁর দেহে অস্ত্রোপচার হবে। কিন্তু সেটা তাঁকে জানতে দেওয়া হয়নি। তিনি ছেলে রথীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবে অপারেশন হবে’। রথীন্দ্রনাথ বললেন, ‘কাল-পরশু’। আবার রানী চন্দকে ডাকলেন কবি, লিখতে বললেন: ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে/ হে ছলনাময়ী।’ ডা. ললিত এলেন একটু পরে। বললেন, ‘আজকের দিনটা ভালো আছে। আজই সেরে ফেলি, কী বলেন?’ হকচকিয়ে গেলেন কবি। বললেন, ‘আজই!’ তারপর বললেন, ‘তা ভালো। এ রকম হঠাৎ হয়ে যাওয়াই ভালো।’
বেলা ১১টায় স্ট্রেচারে করে অপারেশন-টেবিলে আনা হলো কবিকে। লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে অপারেশন করা হচ্ছে। ১১টা ২০ মিনিটের দিকে শেষ হলো অস্ত্রোপচার। ভারী আবহাওয়া উড়িয়ে দেওয়ার জন্য কবি রসিকতা করলেন, ‘খুব মজা, না?’
শরীরে যথেষ্ট যন্ত্রণা হয়েছিল অপারেশনের সময়। কিন্তু তা বুঝতে দেননি কবি। সেদিন ঘুমালেন। পরদিন ৩১ জুলাই যন্ত্রণা বাড়ল। গায়ের তাপ বাড়ছে। নিঃসাড় হয়ে আছেন। ১ আগস্ট কথা বলছেন না কবি। অল্প অল্প পানি আর ফলের রস খাওয়ানো হচ্ছে তাঁকে। চিকিৎসকেরা শঙ্কিত। ২ আগস্ট কিছু খেতে চাইলেন না, কিন্তু বললেন, ‘আহ! আমাকে জ্বালাসনে তোরা।’ তাতেই সবাই খুশি। ৩ আগস্টও শরীরের কোনো উন্নতি নেই। ৪ আগস্ট সকালে চার আউন্সের মতো কফি খেলেন। জ্বর বাড়ল। ৫ আগস্ট ডা. নীলরতন বিধান রায়কে নিয়ে এলেন। রাতে স্যালাইন দেওয়া হলো কবিকে। অক্সিজেন আনিয়ে রাখা হলো। ৬ আগস্ট বাড়িতে উৎসুক মানুষের ভিড়। হিক্কা উঠছিল কবির। পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী ডাকছিলেন, ‘বাবা মশায়!’ একটু সাড়া দিলেন কবি। রাত ১২টার দিকে আরও অবনতি হলো কবির শরীরের। ৭ আগস্ট ছিল ২২ শ্রাবণ। কবিকে সকাল নয়টার দিকে অক্সিজেন দেওয়া হলো। নিশ্বাস ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে থাকল কবির। দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে তা একেবারে থেমে গেল।
জনারণ্যে পরিণত হয়েছে তখন ঠাকুরবাড়ি। কবিকে বেনারসি-জোড় পড়ানো হলো। কোঁচানো ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি, চাদর, কপালে চন্দন, গলায় মালা দিয়ে সাজানো হলো। রানী চন্দ কবির বুকের ওপরে রাখা হাতে ধরিয়ে দিলেন পদ্মকোরক। কবি চললেন চিরবিদায়ের পথে।



মৃত্যু মিছিল



কলকাতার জোড়াসাঁকোর জমিদার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭–১৯০৫) ও সারদা দেবীর (১৮২৩–১৮৭৫) চতুর্দশ সন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জমিদার পরিবারের আভিজাত্য আর শানশওকতে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ এ কথা কে না জানে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, রবীন্দ্রনাথ মাতৃস্নেহ ভালোবাসা শিশুকালে খুব একটা পাননি। বাড়ির চাকর বাকরদের কাছেই মানুষ তিনি। পনের ভাইবোনের বড় সংসারে একান্ত আপন করে বাবা মায়ের স্নেহ ভালোবাসা তিনি পাননি। ১৮৭৫ সালে স্নেহময়ী জননীর মৃত্যু হয় তখন কবির বয়স মাত্র ১৪ বছর। মায়ের মৃত্যুতে কিশোর কবি বিমর্ষ হয়ে পড়েন। ৮০ বছরের জীবনে একের পর এক নিকটাত্মীয় ও স্ত্রী পুত্র কন্যাদের মৃত্যুর পরম্পরা কবির জীবনকে বিষাদময় করে তোলে।

দেবেন্দ্রনাথ এবং সারদা দেবীর পনেরো সন্তানের মধ্যে দু‘চারজন ছাড়া বেশির ভাগ সন্তানই দীর্ঘজীবী ছিলেন না। প্রথম কন্যা সন্তানের জন্ম হয় ১৮৩৮। জন্মের পরপরই তার মৃত্যু হয়। তৃতীয় ছেলে হেমেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় ৪০ বছর বয়সে ১৮৮৪ সালে। তৃতীয় কন্যা সুকুমারী দেবীর মৃত্যু হয় মাত্র ১৪ বছর বয়সে ১৮৬৪ সালে। ৬ষ্ঠ ছেলে পুণ্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু হয় মাত্র ৭ বছর বয়সে ১৮৫৭ সালে। ৪র্থ কন্যা শরৎকুমারীর মৃত্যু হয় ১৯২০ সালে ৬৬ বছর বয়সে। ৭ম ছেলে সোমেন্দ্রনাথ মারা যান ১৯২২ সালে ৬৩ বছর বয়সে। সর্বকনিষ্ঠ ছেলে বুধেন্দ্রনাথ মারা যায় ১৮৬৪ সালে মাত্র ১ বছরে।

এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে দ্বিপেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় ১৯২২ সালে ৬০ বছর বয়সে, মেজভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট ছেলে কবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় ১৮৭৯ সালে মাত্র ৪ বছর বয়সে। তৃতীয় ভাই হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে প্রতিভা ঠাকুরের মৃত্যু হয় ১৯২২ সালে ৫৭ বছর বয়সে, ৪র্থ ভাই বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের একমাত্র ছেলে বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় ১৮৯৯ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে। সেজ বোন সৌদামিনীর কন্যা ইরাবতীর মৃত্যু হয় ১৯১৮ সালে তখন তার বয়স হয়েছিল ৫৭ বছর। ৫ম ভগি্ন স্বর্ণকুমারীর ২য় কন্যা উর্মিলার মৃত্যু হয় ১৮৭৯ সালে মাত্র ৬ বছর বয়সে।

প্রিয়জনের মৃত্যুই কষ্টের, যন্ত্রণার সন্দেহ নাই কিন্তু কিছু প্রিয়জনের মৃত্যু বুকের গহ্বরে যে গভীর দগদগে ক্ষত সৃষ্টি করে তা যুগের পর যুগ ধরে সে ক্ষতের দাগ বহন করে চলতে হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজ বৌদি সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুতে কবির সে দশাই হয়েছিল। তার মৃত্যু কবিকে শোকাহত করেছিল মারাত্মকভাবে। ১৮৮৪ সালে কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করে মারা যান। তখন তার বয়স হয়েছিল মাত্র ২৫ বছর। আর এই বৌদি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত কাছের আপনজন, খেলার সাথী, হৃদয়ের একান্ত সুহৃদ। বৌদির সঙ্গে তার বয়সের ব্যবধান ছিল মাত্র ২ বছরের। বৌদি ছিলেন তার দু‘বছরের বড়। স্বামী সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর ১৭ বছরের বড়। কাজেই বোঝাপড়ার দিক দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার সমিল ছিল অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। বৌদি ছিলেন তার সৃষ্টিশীল কর্মের প্রেরণা, নিখাঁদ ভালোবাসার একমাত্র আশ্রয়স্থল। তার মৃত্যু ও শূন্যতা রবীন্দ্রনাথ ব্যথিত চিত্তে বয়ে বেড়িয়েছিলেন যুগ থেকে যুগান্তরে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজ কন্যা রেকুনা (১৮৯০–১৯০৩) ডাক নাম রানী। কবি এ মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে। প্রায় দু বছরের সংসার জীবনে তাঁরা নিঃসন্তান ছিলেন। ছোট বোন মীরা দেবীর ‘স্মৃতিকথায়‘ জানা যায় মায়ের মৃত্যুতে রেনুকা ভীষণভাবে শোকাহত হয়েছিল তার পর স্বামী বাপের টাকায় আমেরিকায় উচ্চতর ডিগ্রি আনতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসায় মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল সে। মনের ব্যথা পরিণত হয় বুকের ব্যথিতে। শেষতক রেনুকার যক্ষ্মা রোগ ধরা পড়ে। কোনো চিকিৎসাতেই রোগের উপশম হচ্ছিল না। দুই বছরের বিবাহিত জীবনে মাত্র বার বছর সাত মাস বয়সে ১৯০৩ সালে রেনুকার মৃত্যু হয়। ‘রেনুকার জীবনে তাঁর বাবাই ছিলেন সব, তাই মৃত্যুর হাতে যখন আত্মসমর্পণ করতে হলো তখন তিনি বাবার হাত ধরেই দরজাটুকু পার হতে চেয়েছিলেন‘

স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর নয় মাস পরে রানীর মৃত্যু হয়। পর পর দুটি মৃত্যুর শোক কাটিয়ে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে স্কুল গড়ার কাজে কেবলই মনোযোগী হয়েছেন তখনই আরেকটি মৃত্যু কবির দিকে ক্রম অগ্রসরমান। হঠাৎ কলকাতা থেকে সংবাদ আসল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ (১৮১৭–১৯০৫) ভীষণ অসুস্থ। কবি দ্রুত ছুটে গেলেন কলকাতায়। কোনো চিকিৎসাতেই তার স্বাস্থ্যের উন্নতি হলো না। অবশেষে তিনি অসুস্থ অবস্থায় ১৯০৫ সালে মারা যান। বরীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৪৪ বছর। কবি এ বয়সে বাবা মা দু‘জনকেই হারান।

রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বেশি আদরের ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ (১৮৯৬–১৯০৭)। কবি আদর করে তাকে ডাকতেন শমী ঠাকুর বলে। চেহারাটা দেখতে অবিকল বাবার মতো। উঁচু নাক, লম্বা মুখ। বাবার ইচ্ছা সে তার মতোই একদিন মস্তবড় কবি হবে। কিন্তু বিধিবাম, সে ইচ্ছা পূরণ হলো না। কুঁড়িতেই একটি ফুল ঝরে গেল, ফুল হয়ে ফোটার সুযোগ আর হলো না। শমী বাবার বন্ধু শ্রীশচন্দ্রের ছেলে সরোজচন্দ্র ওরফে ভোলার সঙ্গে মুঙ্গেরে তার মামার বাড়িতে বেড়াতে যান। ভোলা শমীরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেখানেই কলেরায় শমীর মৃত্যু হয়। ১৯০৭ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান। শমীর মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ এতটাই দুঃখ পেয়েছিলেন যে তার গায়ের রং পর্যন্ত পাল্টে গিয়েছিল। কবি প্রিয় সন্তান শমীকে হারিয়ে কতটা শোকে মূহ্যমান হয়েছিলেন প্রবাসী বন্ধু মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিকট লেখা একটি চিঠিতে প্রকাশ পেয়েছে। ‘ভোলা মুঙ্গেরে তাহার মামার বাড়িতে গিয়াছিল, শমীও আগ্রহ করিয়া সেখানে বেড়াইতে গেল তাহার পর আর ফিরিল না।‘

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে এবং প্রথম সন্তান মাধুরীলতা (১৮৮৬–১৯১৮), কবি তাকে আদর করে বেলা বেলু এবং বেলবুড়ি বলে ডাকতেন। তিনি এ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন ভোরের পাখি খ্যাত কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীও ছেলে শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে। জামাতা মজফরপুরে ওকালতি করেন তবু কবির ইচ্ছা ব্যারিস্টারি পাস করলে কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করতে পারবে। উপার্জন ভালো হবে, জামাই মেয়ে সুখেই থাকবে। সে কারণে জামাইকে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলেতে পাঠালেন। শরৎ বাবু ব্যারিস্টারি পাস করে জোড়াসাঁকো শ্বশুরালয়ে এসে ওঠেন। এ বাড়িতে ১৯০৯ থেকে ১৯১২ এই চার বছর স্ত্রীক বাস করেন।

শ্বশুরালয়ে ভায়রা নগেন্দ্রনাথের (মীরার স্বামী) সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় চরম অশান্তির মধ্যে শরৎ স্ত্রী মাধুরীলতাকে নিয়ে ডিহি শ্রীরামপুরে নিজের বাড়ি চলে যান। অপরিসীম দুঃখ কষ্ট ও যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বেলা পিতৃগৃহ বিচ্ছেদ যন্ত্রণা অন্য দিকে স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য কলহ তাকে মৃত্যুর দুয়ারে নিয়ে যায়। তারও যক্ষ্মা রোগ ধরা পড়ে। কবি শরতের অগোচরে মেয়েকে দেখতে যেতেন ঠিক দুপুরে। শরৎ এ সময় কোর্টে থাকতেন। কদাচ তার সঙ্গে দেখা হলে শ্বশুরকে অপমান করতে তার বুকে এতটুকু বাঁধেনি।

‘অত আদরের মেয়ে বেলা তার মৃত্যু শয্যায়, সব অপমান চেপে তিনি দেখা করতে যেতেন। শরৎ তখন টেবিলের উপরে পা তুলে দিয়ে সিগারেট খেত। পা নামাত না পর্যন্ত এমনি করে অপমান করত। উনি সব বুকের মধ্যে চেপে মেয়ের পাশে বসতেন, মেয়ে মুখ ফিরিয়ে থাকত।‘

কবি শত অপমান অবজ্ঞা উপেক্ষা করে প্রায়ই মেয়েকে দেখতে যেতেন। একদিন দুপুরে তিনি বাড়ির কাছে পৌঁছাতেই খবর পেলেন বেলার মৃত্যু হয়েছে। তিনি আর দোতলায় মৃত মেয়ের মুখ দর্শন করলেন না। দীর্ঘ বিষাদের যন্ত্রণা বুকে চেপে নিশ্চুপ ফিরে এলেন। ১৯১৮ সালের ১৬ মে মাধুরী লতা বেলার মৃত্যু হয়। দাম্পত্য জীবনে তিনি নিঃসন্তান ছিলেন।

একে একে স্ত্রীপুত্র কন্যাদের হারিয়ে নিঃস্ব প্রাণ কবি রবীন্দ্রনাথ। শেষ ভরসা বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথ (১৮৮৮–১৯৬১) এবং তৃতীয় কন্যা মীরা (১৮৯৪–১৯৬৯) ডাক নাম অতসী। রবীন্দ্রনাথ এই মেয়েকে বিয়ে দেন মাত্র তের বছর বয়সে নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলির সঙ্গে। কবি ছেলে রথীন্দ্রনাথের মতো জামাতা নগেন্দ্রনাথকেও আমেরিকা পাঠিয়েছিলেন কৃষি ও গো–পালন তত্ত্ব শিক্ষার জন্য। নগেন্দ্রনাথ গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে জোড়াসাঁকো বাড়িতে ওঠেন। কয়েক বছরের দাম্পত্য জীবনে তাদের এক পুত্র ও এক কন্যার জন্ম হয়। পুত্র নীতিন্দ্রনাথ (১৯১২–১৯৩২) আর কন্যা নন্দিতা (বুড়ি) (১৯১৬–১৯৬৭)। কিছু দিনের নগেন্দ্রনাথের মতিভ্রম ঘটে, তিনি খ্রিস্টান হয়ে ঠাকুর বাড়ি ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যান। নানা রবীন্দ্রনাথ নাতি নীতিন্দ্রনাথকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন এবং স্নেহ করতেন তাঁকে মুদ্রাযন্ত্র ও প্রকাশনা শিল্প শিক্ষার জন্য জার্মানিতে পাঠান। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সে ইচ্ছা পূরণ হলো না। জার্মানিতে নীতিন্দ্র রাজরোগে (যক্ষ্মারোগে) আক্রান্ত হন। মাত্র ২০ বছর বয়সে ১৯৩২ সালে তার ইহলীলা সাঙ্গ হয়।

দৈব–দুর্বিপাকে এবং নিয়তির ক্রুর পরিহাসে রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনীর দাম্পত্য জীবনে প্রিয় সন্তানদের অকালে মৃত্যু দীর্ঘ সুখ ও প্রশান্তি কখনো ধরা দেয়নি বরং একটি মৃত্যু শোক যন্ত্রণা প্রশমিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই আরেকটি মৃত্যু দোরগোড়ায় উঁকি দিয়েছে বারবার। তবু শোক সন্তপ্ত হৃদয়ে অসাধারণ মনোবল এবং ধৈর্য নিয়ে মোকাবিলা করেছেন ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ বিষাদসিন্ধুময় প্রিয় সন্তানদের এক একটি মৃত্যু এক একটি চিরবিচ্ছেদ। জমিদারি পরিচালনায় ব্যর্থতা, ব্যবসায় লালবাতি এবং পরিবারের প্রিয়জনদের এক এক করে মৃত্যুর মিছিল রবীন্দ্রনাথকে সাময়িক বিপর্যস্ত করলেও তিনি দৃঢ় মনোবলে তার সৃষ্টিকর্মের সাধনায় নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন ঠিকই। ছেলে রথীন্দ্রনাথের ভাষায়: ‘ভাগ্যের উত্থান–পতন, দুঃখ কিংবা ক্লেশ কোনো কিছুই অবশ্য বাবার চিত্তের প্রশান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারত না। মহর্ষির মতোই তিনিও সর্বাবস্থায় অবিচলিত থাকতেন। বেদনা যতই পীড়াদায়ক হোক না কেন, তা তার ভেতরের শান্তিকে নষ্ট করতে পারত না। সবচেয়ে দুঃখের দুর্ভাগ্যকে সইবার মতো এক অতিমানবিক শক্তি ছিল তার।‘ তার জীবনে নিয়তির নিষ্ঠুরতার যে উদ্ভাস তা অন্য কোনো ব্যক্তি, কবি সাহিত্যিকদের জীবনে পরিদৃষ্ট হয় না।

∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆


No comments: