Wednesday, 29 September 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়। ৩০.০৯.২০২১. Vol -511. The blogger in literature e-magazine

অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়


 অজিতেশের শিল্পীসত্তার বিস্তার ছিল বটবৃক্ষের মতো। ফলে কোনও একটা শিল্পমাধ্যমে তিনি নিজের প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটাবেন, এমনটা কিছুতেই সম্ভব হত না। ষাটের দশক নাগাদই সিনেমায় কাজ করা শুরু করে দিয়েছিলেন অজিতেশ। প্রায় পঞ্চাশটা ছবিতে কাজ করে ফেলেছিলেন তিনি, যার মধ্যে হিন্দি ছবির সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ‘কুহেলী’র সত্যভূষণ বা ‘হাটে বাজারে’র লছমনলালকে কে ভুলতে পারে? তরুণ মজুমদার যখন তারাশঙ্করের উপন্যাস থেকে পর্দার জন্য ‘গণদেবতা’ করেন, অজিতেশ তো সেখানেও থাকেন! আবার থিয়েটারের চ্যালেঞ্জ এবং সিনেমার গ্ল্যামারের মাঝে মুখ লুকনো যাত্রাতেও অবাধ বিচরণ করেছেন তিনি। কিন্তু বন্ধুর ছবি করা বা যাত্রা করা নিয়ে রুদ্রপ্রসাদ কী ভাবেন? ‘‘অজিতেশ তখন সদ্য দ্বিতীয় সংসার শুরু করেছে, নানা কারণে ওর টাকার দরকার। ফলে সিনেমা করছে, যাত্রা করছে, থিয়েটারটাও করছে। "

‘উ বুড়ার কথা বাদ দেন, ডাক্তারবাবু। উ ঠিক করেছে, আমাকে দিয়ে কাজ করাবেকই। আর আমিও ঠিক করেছি শালা কাজ করিবক নাই। ঘরে যখন এতগুলান পয়সা আছে, তখন লতুন করে আর পয়সা করার দরকার কী, আপনিই বলুন। আমি বাবা দুনিয়া ভোগ কইরতে এসেছি। যদ্দিন বাঁইচব, ভোগ করি যাব, বুঝলেন। উ ত্যাগ-ট্যাগ আপনার সাধু-সন্নিসিরা করুক। সবাই যদি দুনিয়ায় সাধু-সন্নিসি হবেক, তবে দুনিয়াটা বাঁইচবেক কীকরে, বলুন তো! একী, আপনি হুইস্কি খেইলেন না যে বড়!’


পশ্চিমের একটা ছোট্ট পাহাড়ি গঞ্জের স্থানীয় জমিদার ছবিলালের ছেলে লছমনলাল এই কথাগুলো বলছে গঞ্জের মানুষ যাঁকে ভগবান মানে, সেই ডাক্তার অনাদি মুখার্জিকে। ডাক্তারবাবু মদ খান না শুনে তার ব্যঙ্গোক্তি ঠিকরে আসে-‘সবাই শালা সতী রে!’ তারপরেই উচ্চৈঃস্বর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ার পালিশ করা মাস্তানি। জ্বলন্ত চোখ, সঙ্গে এমন চেবানো ডায়লগ থ্রোয়িংয়ের কাল্ট ক্যারেক্টারাইজেশন। সহকর্মীরা কি আর সাধে বলতেন, অজিতেশ চরিত্রে পুরোপুরি নিমজ্জিত হয়ে যান!

 ১৯৩৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পুরুলিয়া জেলার জয়পুর ব্লকের রোপো গ্রামের মামার বাড়িতে তাঁর জন্ম। তার পৈতৃক বাড়ি ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান জেলার রাণীগঞ্জ অঞ্চলের অন্তর্গত কেন্দাতে। তাঁর বাবার নাম ভুবনমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম লক্ষ্মীরাণী৷ ১৯৫৭ সালে কলকাতার মণীন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ইংরেজি ভাষায় অনার্স সহ পাশ করেছিলেন। ওই বছরেই ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।

শোনা যায়, ছাত্রদের উপর যাতে খারাপ প্রভাব না পড়ে, তাই লছমনলাল চরিত্রটি করার জন্য সাউথ পয়েন্ট স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার দর্শক তাঁকে মনে রেখে দেবে নাট্যজগতের সংগ্রামী সম্রাট রূপে। নাটকের আঙিনায় তাঁর কর্মকাণ্ড সেই স্মৃতিরক্ষার ক্ষেত্রে অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। গণনাট্য সংঘের সঙ্গে মতবিরোধে দল ছেড়ে এড়িয়ে আসা, তারপর ‘নান্দীকার’, সেখানেও কয়েক বছরের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের ছেড়ে চলে যাওয়া, আবার নতুন করে গড়ে তোলা, তারপর আবার ভাঙন, আবার নতুন এক দল প্রতিষ্ঠা, এইভাবেই তো চলেছিল তাঁর কর্মজীবন।

১৯৫৮ তে গণনাট্যে যুক্ত থাকাকালীন ‘চার অধ্যায়’-এর নাট্যরূপ দিতে চাওয়া বছর পঁচিশের তরুণটিকে হতাশ হতে হয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিক মতাদর্শের সীমাবদ্ধতায়। রক্ষণশীল সাম্যবাদীরা তখনও বিশ্বাস করতেন, রবীন্দ্রনাথ প্রতিক্রিয়াশীল। ‘চার অধ্যায়’-এ সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে যে দূরদর্শিতা রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছিলেন, তা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চোখ তৈরি হয়নি তাঁদের। গণনাট্য সংঘ থেকে শীঘ্রই বেরিয়ে এসেছিলেন অজিতেশ। তারপর ১৯৬০-এ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন মিত্র, অজয় গঙ্গোপাধ্যায়, মহেশ সিংহ, রাধারমণ তপাদার, চিন্ময় রায়দের নিয়ে ‘নান্দীকার’। পরের বছর যোগ দিলেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। অজিতেশের সঙ্গে রুদ্রপ্রসাদের বন্ধুত্ব সেই মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজের কমন রুম থেকে। সেই বন্ধুত্ব গড়িয়েছিল একসঙ্গে ঘরভাড়া নেওয়া অবধি।

রুদ্রপ্রসাদকে খোকন বলে ডাকতেন অজিতেশ। পড়াশোনার তুখোড় খোকন তখন স্কটিশচার্চে উচ্চশিক্ষা করছেন। এক বন্ধুর সঙ্গে নোবেলজয়ী ইতালিয়ান নাট্যকার লুইগি পিরানদেল্লোর ‘সিক্স ক্যারেক্টার্স ইন সার্চ অফ অ্যান অথর’-এর বঙ্গীয়করণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্চস্থ করার সুযোগ পাননি। অজিতেশ সেই চিত্রনাট্য পড়েছিলেন সারারাত ধরে। ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র’ নান্দীকারকে যে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল, তারপর আর জনপ্রিয়তা নিয়ে তেমন পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁদের। কিন্তু পিরানদেল্লোর ফ্যাসিস্ট-সংযোগ তৎকালীন বঙ্গের বামধর্মী আবহাওয়ায় উস্কে দিয়েছিল বিতর্কও। স্বয়ং উৎপল দত্ত নাটকটিকে বয়কট করেছিলেন। কিন্তু সেই বিতর্কই উল্টে দর্শককে প্রেক্ষাগৃহে আকৃষ্ট করে। সিনেমা হলের সামনে মানুষের মধ্যে লিফলেট বিলি করতেন অজিতেশ ও অসিত। আর তার পরের নাটক ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’ (আন্তন চেখভের ‘চেরি অর্চার্ড’-এর বাংলা নাট্যরূপ) তো নান্দীকারকে বাংলা নাট্যজগতে বিদেশি নাটকের বঙ্গীয়করণের ক্ষেত্রে সুউচ্চ আসন দিয়েছিল। নিন্দুকদের অভিযোগও ছিল, নান্দীকার কেবল বিদেশ-নির্ভর নাটক ছাড়া করতে পারে না। অজিতেশের সাফ বক্তব্য-‘বিদেশ থেকে নেওয়া এই নাট্য-অভিজ্ঞতাগুলি আমাদের নাট্যজগতে নতুন কোনও বোধের দিকে নতুন কোনও পরীক্ষার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না কি? নিছক অনুবাদেই থমকে না থেকে যদি তাকে মিলিয়ে দেওয়া যায় নিজেদেরই প্রতিবেশীর মধ্যে?’

ছ’বছরের মধ্যেই বারোজন শিল্পী বেরিয়ে গিয়েছিলেন দল থেকে। যোগ্য পরিবর্ত নেই। কতকগুলো একাঙ্কিকার পর ‘শের আফগান’ মঞ্চস্থ হল মাত্র বারোটা মহড়ায়। নকশাল আন্দোলনের গনগনে পরিস্থিতিতেও টিকিট বিক্রির জন্য ধুম পড়ে গিয়েছিল। মঞ্চে ফিরে এল সুপারহিট ‘যখন একা’, ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’। একে একে ‘তিন পয়সার পালা’, ‘হে সময়, উত্তাল সময়’, ‘বিতংশ’। আবার নিজেদের জাত চেনাতে আরম্ভ করেছিল অজিতেশের দল। পরীক্ষা-প্রিয়, লড়াকু, ক্ষণজন্মা, স্বল্পায়ু অভিনেতাটিকে তাই নাটকের দর্শক চিরকাল মনে রেখে দেবে, এ আর অস্বাভাবিক কী!কিন্তু নাটকের বাইরে চলচ্চিত্র ও বেতার-নাটকেও যে মুন্সিয়ানা তিনি দেখিয়েছিলেন, তা যেন তাঁকে কেবলমাত্র অভিনেতা নয়, একজন অভিনয়শিল্পী হিসাবে পূর্ণতা দিয়েছিল। এমনকি যাত্রার জগতেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনন্য। তবে, যাত্রার প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে এখানে আরও একজন অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলতে হয়। কারণ, দুই অজিতের (কলেজের খাতায় অজিতেশের নাম ছিল অজিত) মধ্যেই নাম ছাড়া আরও বেশ কিছু মিল রয়েছে। দুজনেরই জন্মদিন সেপ্টেম্বর মাসে। অজিতের ২৭, অজিতেশের ৩০। দুজনেরই প্রিয় ক্ষেত্র ছিল মঞ্চাভিনয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় মিল হল, দুজনের কেউই যাত্রার অতি-অভিনয়ে যেতে চাননি।আমি যাত্রায় এসেছি যাত্রার অভিনয়ের ধারাটিকে বদলে দেবার জন্যে লোভনীয় বেতন সত্ত্বেও অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় তো কোনোদিন ও পথই মাড়াননি। অজিতেশও মাত্র দুই থেকে তিন বছরের জন্য যাত্রার জগতে প্রবেশ করে আবারও নিজের জগতে ফিরে এসেছিলেন। প্রথম যে বছর তিনি যাত্রায় যোগ দেন, সেবছর মেদিনীপুরের একটি গঞ্জে ‘রাবণ’ পালায় রাবণের চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়েছিলেন তিনি। পালার শেষে মাঝরাতে মেক-আপ তুলছেন, এক ভদ্রলোক এসে তাঁকে বলেছিলেন, রাবণের পালা তাঁর যাচ্ছেতাই লেগেছে, অজিতেশ যেন সত্বর নামকরা যাত্রাভিনেতা মোহন চট্টোপাধ্যায়ের থেকে যাত্রার অভিনয় শিখে আসেন। আপাদমস্তক ভদ্রলোক অজিতেশ তাঁর কথায় এতটুকু না রেগে গিয়ে তাঁকে দশ-বারো রকমের হাসি হেসে দেখিয়ে তারপর জিজ্ঞাসা করেন - ‘এইরকম হাসি হলে চলবে আপনার?’ হতভম্ব লোকটি যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন যে, এতরকম জানা সত্ত্বেও তিনি অভিনয়ে তা দেখালেন না কেন, অজিতেশ তাঁকে বলেন - ‘এসব ম্যাজিক আমি জানি। কিন্তু করব না। আমি যাত্রায় এসেছি যাত্রার অভিনয়ের ধারাটিকে বদলে দেবার জন্যে। সুতরাং আমি আমার মতোই অভিনয় করব।’ কারণ, অজিতেশের যুক্তি ছিল, সময় বদলাচ্ছে, যে জিনিস একশো বছর আগে ছিল, তা আর এখন চলতে পারে না। অজিতেশের এমন চাঁচাছোলা যুক্তির পর আর কথা বলতে পারেননি ভদ্রলোক।

না, যাত্রার ধারা অজিতেশ বদলাতে পারেননি। তাঁকে নিজেকেই সরে আসতে হয়েছিল যাত্রার পৃথিবী থেকে। কিন্তু তাঁর আপসহীন ব্যক্তিত্বের সার্থক পরিস্ফুটন এই ঘটনায় অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তবে এক্ষেত্রে হয়ত বলতে হবে তাঁর লেখাদের কথাও। যে মানুষের কলম থেকে উদ্ধত চাবুক বেরিয়ে আসে - ‘দেশের প্রায় সবাই এখন সাদাপোশাকে ঘুরছে/লাথি খেয়ে বলছে/তবু তো প্রাণটা রক্ষে পাচ্ছে/ধীরে ধীরে এ লাথিও অভ্যাস হয়ে যাবে।’, আবার সেই তিনিই লিখে ফেলেন - ‘রেল লাইনের প্রত্যেকটি পাথর আমার শৈশব।/কোনটা সেজকাকার বকুনি, কোনটা বা রমার চোখ/কোনটা মায়ের কড়ি আঙুল, বন্ধুর মুখ থেকে শোনা/প্রথম অশ্লীল শব্দ বা।’ আসলে, দীর্ঘদেহী মানুষটির ব্যক্তিত্বের বিশালত্ব তাঁকে কখনও থেমে যেতে শেখায়নি।


১৯৮৩-র ১৪ই অক্টোবরের মধ্যরাত। দুর্গাষ্টমীর উৎসবমুখর কলকাতা। সপ্তমীর সন্ধেয় সুজাতা সদনে ‘এই অরণ্যে’-র দুটো শো করে বাড়ি ফিরে নৈশভোজ সেরেছিলেন। বুকের যন্ত্রণার পর কয়েকটা মিনিট। অকালবোধনের অষ্টমীর রাত বড় অকালেই যেন টেনে নিয়েছিল সদ্য পঞ্চাশ-অতিক্রান্ত তাঁকে। ওই বোধহয় একবারই থেমেছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।  

"আসলে আমরা সকলেই কিলার। আমরা সকলেই সকলকে খুন করি। কিন্তু এটুকুই বলার, যে হি ওয়াজ় আ জায়ান্ট অ্যামং আস!’’

যার ছায়াটা হয়তো সরে যায়, ছোট হয় না!" (রুদ্রপ্রসাদ )

 ১৩ অক্টোবর, ১৯৮৩ সালে কলকাতায়  আকস্মিকভাবে মারাা যান।

===========∆∆∆∆∆=========

২০২ তম জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। ( বিদ্যাসাগর).১২ আশ্বিন, ১৪২৮. ২৯.০৯.২১ । Vol - 510.. The blogger in literature e-magazine




জীবনস্মৃতি’র বর্ণনা অনুযায়ী, সে সাক্ষাৎকার খুব বেশি উৎসাহ ব্যঞ্জক হয়ে ওঠেনি। জীবনের সেই পর্বে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের “শিশুশিক্ষা-১” ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রথম ‘প্রাইমার’, পাশাপাশি, বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়-১ম ভাগও যে পাঠ করেছিলেন তার প্রমাণ রয়েছে নিজের লেখাতেই। “তখ্ন ‘কর’ ‘খল’ প্রভৃতি বানানের তুফান কাটাইয়া সবেমাত্র কূল পাইয়াছি। সেদিন পড়িতেছি ‘জল পড়ে’ ‘পাতা নড়ে’। আমার জীবনে এইটেই আদিকবির প্রথম কবিতা।”

অবশ্য ঠিক এই কথাগুলি এই ভাবে বিদ্যাসাগর লেখেননি। তৃতীয় পাঠে ‘জল পড়ে’ কথাটি থাকলেও ‘পাতা নড়ে’ কোথাও লেখা নেই, বরং আছে ‘জল পড়িতেছে, পাতা নড়িতেছে’। বর্ণযোজনা শিখতে গিয়েই ‘বর্ণপরিচয়’ পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং পরিচিত হয়েছিলেন শব্দগুলির সঙ্গে। রবীন্দ্র গবেষক প্রশান্ত পালও জানাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথ ‘জল পড়িতেছে, পাতা নড়িতেছে’- এটাই পড়েছিলেন, কিন্তু “ভাবী মহাকবির ‘সমস্ত চৈতন্য’ গদ্যের সেই সাদাসিধে রূপের অন্তরে নিহিত ছন্দটুকু আবিস্কার ক’রে গদ্যের ঘটমান বর্তমানকে কবিতার নিত্য বর্তমানে পরিণত করেছে।”



‘হে নূতন,

দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ

তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন

সূর্যের মতন।’

শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আনুষ্ঠানিক সংগীত’-এর তিনটি লাইন লিখলাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০২ তম জন্মদিন স্মরণে। গানের এই কথাগুলো রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন নিজের জন্মদিন উপলক্ষ্যে।

আজ এই লেখায় রবীন্দ্রনাথের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিচারণায় মূর্ত হয়ে ওঠা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ আলোচনা করব। ‘রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাসাগর’ শিরোনামাঙ্কিত এ লেখায় ঈশ্বর ও রবি ভাস্বর হয়েছেন স্মৃতিকথা ও স্মরণ-বক্তৃতার আলোকে। সে জন্য ১২ আশ্বিন; ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ এবং ২৫ বৈশাখ; ৭ মে ১৮৬১-এর ছেদ ঘুচিয়ে প্রবেশ করছি রবীন্দ্রচেতনার আয়নায় উদ্ভাসিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর—প্রসঙ্গ-জগতে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনস্মৃতি বইটিতে ‘শিক্ষারম্ভ’ ও ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায় দুটিতে শিশু-বালক রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উদ্ভাসিত হয়েছেন শিশু-মন আবিষ্ট করা, শিশু-পাঠ রচয়িতা একজন অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বরূপেএ

রবীন্দ্রনাথের পাঠশিক্ষা হয়েছিল গৃহশিক্ষক গুরুমহাশয়ের কাছে—অতি শৈশবে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় বইটি পড়ার স্মৃতিচারণায় তিনি বলেছেন, ‘কেবল মনে পড়ে; “জল পড়ে পাতা নড়ে।” তখন “কর, খল” প্রভৃতি বানানের তুফান কাটাইয়া সবেমাত্র কূল পাইয়াছি। সেদিন পড়িতেছি, “জল পড়ে পাতা নড়ে।” আমার জীবনে এইটেই আদিকবির প্রথম কবিতা।’

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে আদিকবির সম্মানে ভূষিত করেছেন বিদ্যাসাগরের জীবন অবসানের (২৯ জুলাই ১৮৯১) ২১ বছর পর প্রকাশিত বই জীবনস্মৃতিতে। আরও পরে বাংলা ১৩০২ সালের ১৩ শ্রাবণ বিদ্যাসাগরের স্মরণ সভায় সাংবাৎসরিক অধিবেশনে এমারল্ড থিয়েটার রঙ্গমঞ্চে পাঠ করেছিলেন ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ শিরোনামে প্রবন্ধটি। এটি গ্রন্থিত আছে চারিত্রপূজা গ্রন্থে।

আলোচ্য দুটি বইয়ের সূত্রে ‘রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাসাগর’ আমার মনে গুঞ্জরিত হতে শুরু করে। সাহিত্যসাধক, শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর সময়েও দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য, সামাজিক-পারিবারিক অধঃপতন, আর্থিক কৃচ্ছ্র সাধনের মধ্য দিয়ে অসীম কষ্ট ও ধৈর্যসাধনার পথে বিরুদ্ধ স্রোতে সাঁতার কেটেছেন। এসব তথ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিদ্যাসাগর-স্মৃতিচারণায় লিপিবদ্ধ আছে।

সামাজিক-পারিবারিক প্রতিকূলতার মধ্যেও বিদ্যাসাগর ব্যাপিত ছিলেন সমাজ সংস্কার ও সাহিত্যচর্চায়। এ ছাড়া শিশুর পাঠচর্চা, বাংলা অভিধানের প্রাথমিক গবেষণা, আইনি প্রক্রিয়ায় নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সূচনাও করে গেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের বিদ্যাসাগরবিষয়ক চর্চায়, লেখায়, বক্তৃতায় সেসব তথ্য নিপুণ বিন্যাস-বিশ্লেষণে—উপরন্তু তাঁর কথোপকথনে, গল্পে-উপন্যাস-প্রবন্ধেও এর সাক্ষ্য পাওয়া যায়। এমনকি বিদ্যাসাগরের আত্মকথা বিদ্যাসাগরচরিত (স্বরচিত)-এর প্রসঙ্গ টেনেও কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

শিশু রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, তাঁর গৃহশিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ইংরেজি বই বাংলা করে বলে যেতেন এবং শিশু-ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে সেই সব মৌখিক গদ্য অনুবাদ থেকে কবিতা-কাব্য লেখার জন্য তাগাদা দিতেন। আর শিক্ষক সেসব অনুবাদের ভাষা, বানান পরীক্ষা করতেন। এই পদ্ধতিতে শিশু রবীন্দ্রনাথকে শেক্​সপিয়ারের ম্যাকবেথ চর্চা করতে হয়েছিল। সেখানেই ঘটনার সমাপ্তি ঘটেনি। রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছিলেন মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনের হেডপণ্ডিত। তিনি ছাত্র রবীন্দ্রনাথকে ম্যাকবেথ বাংলায় অনুবাদ করে বলতেন বাংলা ছন্দে তার তরজমা করতে। সেই তরজমা শেষ না হওয়া পর্যন্ত রবিকে ঘরে বন্ধ করে রাখতেন তিনি।

ম্যাকবেথ তরজমা শেষে শিক্ষক রামসর্বস্ব ভট্টাচার্য ছাত্র রবীন্দ্রথাকে নিয়ে গেলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছে। সেখানে বাংলা ছন্দে লেখা ম্যাকবেথ পড়ে শোনানোর দায়িত্ব পালন করলেন রবীন্দ্রনাথ। জীবনস্মৃতির ‘ঘরের পড়া’ অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন:

‘তখন তাঁহার কাছে রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় বসিয়াছিলেন। পুস্তকে-ভরা তাঁহার ঘরের মধ্যে ঢুকিতে আমার বুক দুরু দুরু করিতেছিল—তাঁহার মুখচ্ছবি দেখিয়া যে আমার সাহস বৃদ্ধি হইল, তা বলিতে পারি না। ইহার পূর্বে বিদ্যাসাগরের মতো শ্রোতা তো আমি তো পাই নাই—অতএব, এখান হইতে খ্যাতি পাইবার লোভটা মনের মধ্যে খুব প্রবল ছিল। বোধকরি কিছু উৎসাহ সঞ্চয় করিয়া ফিরিয়াছিলাম।’

শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনযাত্রা দেশে-বিদেশে এবং বহুদিকে বিস্তৃত হয়েছিল। শান্তিনিকেতন গড়ে তোলা, অকাতরে অব্যাহতভাবে কাব্যচর্চা, নাট্য অনুশীলন, ইত্যকার নানা সৃজনশীল কর্মধারায় প্রবাহিত হয়ে চলেছিল তাঁর জীবন। দীর্ঘ জীবনে কর্মব্যস্ত রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন মনীষীর জীবন, সাহিত্য ও কর্মসাধনা নিয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। চারিত্রপূজা তাঁর সেই সব বক্তৃতার সংকলন।

চারিত্রপূজায় মুদ্রিত ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ নামের বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাসাগরকে পরিচিত করিয়েছেন ‘যথার্থ সম্পূর্ণ মানুষ’ বলে। তাঁর ভাষায়:

‘বিদ্যাসাগরের জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করিয়া দেখিলে এই কথাটি বারবার মনে উদয় হয় যে, তিনি যে বাঙালি বড়লোক ছিলেন তাহা নহে, তিনি যে রীতিমত হিন্দু ছিলেন তাহাও নহে—তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশি বড়ো ছিলেন, তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন।’

রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন এখানে শব্দচয়নে তা উল্লেখ করছি: ‘তাহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা’; ‘বাংলা ভাষার বিকাশে বিদ্যাসাগরের প্রভাব’; ‘বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন’; ‘তিনি বাংলা গদ্যে কলা নৈপুণ্যের অবতারণা করেন’; ‘বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা দান করিয়াছেন’; ‘বিদ্যাসাগর...বঙ্গসমাজের মধ্যে নিজের চরিত্রকে মনুষ্যত্বের আদর্শরূপে প্রস্ফুট করিয়া যে এক অসামান্য অনন্যতন্ত্রত্ব প্রকাশ করিয়াছেন তাহা ইতিহাসে অতিশয় বিরল।’

রবীন্দ্রনাথ আলোচ্য এই বক্তৃতায় বিদ্যাসাগরের পারিবারিক, ঠাকুরদা, ঠাকুরমা, ভ্রাতৃজায়াসহ অনেকের মিলিত একান্নবর্তী পরিবারের সূত্রে বলেছেন:

‘বিদ্যাসাগরের জীবনে তাঁহার মাতার জীবনচরিত কেমন করিয়া লিখিত হইয়াছে তাহা ভালোরূপ আলোচনা না করিলে উভয়েরই জীবনী অসম্পূর্ণ থাকে।’

আবার বিস্তারিত আলোচনায় বলেছেন বিদ্যাসাগর তাঁর শিশু চরিত্র সুবোধ গোপালের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, কিন্তু তিনি শিশুকালে তেমন ছিলেন না। তাঁর লেখা ‘দুষ্টু ছেলে রাখাল’-এর সঙ্গেই বিদ্যাসাগরের নিজের মিল ছিল। তিনি কীভাবে পড়তেন, গৃহকর্ম করতেন সেসবও লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন: ‘বিদ্যাসাগর সম্বন্ধীয় ক্ষুদ্র প্রবন্ধে তাঁহার জননী সম্বন্ধে এতখানি আলোচনা কিছু পরিমাণ বহির্ভূত হইয়া পড়িতেছে। কিন্তু একথা তাঁহারা স্থির জানিবেন—এখানে জননীর চরিতে এবং পুত্রের চরিতে প্রভেদ নাই, তাঁহারা যেন পরস্পরের পুনরাবৃত্তি। তাহা ছাড়া, মহাপুরুষের ইতিহাস বাহিরের নানা কার্যে এবং জীবনবৃত্তান্তে স্থায়ী হয়, আর মহৎ নারীর ইতিহাস তাঁহার পুত্রের চরিত্রে, তাঁহার স্বামীর কার্যে রচিত হইতে থাকে, এবং সে লেখায় তাঁহার নমোল্লেখ থাকে না। অতএব বিদ্যাসাগরের জীবনে তাঁহার মাতার জীবনচরিত কেমন করিয়া লিখিত হইয়াছে তাহা ভালোরূপ আলোচনা না করিলে উভয়েরই জীবনী অসম্পূর্ণ থাকে।’

বিদ্যাসাগরের জীবনী-বর্ণনায়, তাঁর শিক্ষা ও সমাজকর্মের বিবরণে রবীন্দ্রনাথ বিশদভাবে জানিয়েছেন নারীপ্রগতির আন্দোলনের প্রধান ভূমিকা তিনি কীভাবে বাস্তবায়িত করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: ‘বিদ্যাসাগর এই বঙ্গদেশে একক ছিলেন।’ দুঃখ ভারাক্রান্তভাবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছেন: ‘তাঁর সমযোগ্য সহযোগীর অভাবে আমৃত্যুকাল নির্বাসন ভোগ করিয়া গিয়াছেন। তিনি সুখী ছিলেন না।...প্রতিদিন দেখিয়াছেন—আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না। যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না ও যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না।...এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক ও তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল।’

রবীন্দ্রনাথের প্রত্যয়ভরা লেখনীতে আরও জানা যায়, বিদ্যাসাগরকে কেবল বিদ্যা ও দয়ার আধার বলে আমরা প্রচার করি। কিন্তু সেটা ঠিক না। তাঁর প্রধান গৌরব তাঁর অজেয় পৌরুষ ও মনুষ্যত্ব।

রবীন্দ্রনাথ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, ঈশ্বরচন্দ্রের বিধবা বিবাহ আন্দোলন, বাল্যবিবাহ বন্ধ, পণপ্রথা রোধের সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়েছিল সাহিত্যে, সামাজিক ও শিক্ষা আন্দোলনে। পাশাপাশি এটি গুরুত্ব পেয়েছিল রামমোহন-পরবর্তী সমাজ-অগ্রগতির জন্য নারী আন্দোলনেও।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে দৃষ্টিতে, যে গভীর প্রত্যয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবন, তাঁর কর্ম ও সাহিত্যসাধনা নিজের লেখা ও বক্তৃতায় আলোকপাত করেছেন, সেই প্রত্যয়সমূহ বিদ্যাসাগরের ২০০তম জন্মদিনে আমাদের দৃষ্টি ও মননচর্চাকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মানবপ্রেমী, নারীপ্রগতির ধ্বজাধারী, বাল্যবিবাহ বন্ধে নারী আন্দোলনের পথপ্রদর্শক, দৃঢ়চিত্তেই এ কথা বলা যায়।


======{{{{{{{{{{{{{{{{{{{{{{{{{{{{{{{{{{{{======


Tuesday, 28 September 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। নলিনী কান্ত সরকার। ২৮.০৯.২০২১. Vol 509 The blogger in literature e-magazine.

তিনি নজরুলের স্বরলিপির সংকলন সুরমুকুর এর স্বরলিপিকার। নলিনীকান্ত সাংবাদিকতার হাতেখড়ি শরৎচন্দ্র পণ্ডিত বা দাদাঠাকুরের 'জঙ্গীপুর সংবাদ' পত্রিকায়। শরৎচন্দ্রের পণ্ডিতের জীবিত থাকার অবস্থাতেই তার লেখা 'দাদাঠাকুর'বইটি চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল। ছবি বিশ্বাস দাদাঠাকুরের ভূমিকায় অভিনয় করেন।


          নলিনীকান্ত সরকার

জন্ম ২৮ শে সেপ্টেম্বর ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ ।  পিতা ছিলেন মালদহ জেলার কালিয়াচকের নিকুঞ্জবিহারী সরকার। নলিনীকান্তর শৈশব ও কৈশোর কাটে পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার নিমতিতা এলাকার জগতাই গ্রামে। বিপ্লবী দলের সাথে জড়িত ছিলেন। বরদাচরণ মজুমদারের অধীনে তিনি কিছুদিন লালগোলা রাজাদের গ্রন্থাগারে কাজ করেন।

তিনি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা বেশ কিছু গান বেতার ও গ্রামোফোনে গেয়েছেন। নজরুলের প্রথম স্বরলিপির সংকলন সুরমুকুর এর স্বরলিপি তার করা। এতে নজরুলের ২৭টি গানের স্বরলিপি রয়েছে। বইটি ডি এম লাইব্রেরি থেকে ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হয়। মূলত তারই আগ্রহে নজরুল রেকর্ডিংয়ের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন।এছাড়া কৌতুক অভিনেতা শরৎ পণ্ডিতের জীবদ্দশায় তার জীবনীগ্রন্থ দাদাঠাকুর রচনা করেন নলিনীকান্ত সরকার।

ভক্ত ও বৈষ্ণব পরিবারের সন্তান তিনি শৈশব থেকেই আধ্যাত্মিকতার দিকে আকৃষ্ট ছিলেন। পরবর্তীকালে বহু সাধু মহাপুরুষের সান্নিধ্যে আসেন। গৃহীযোগী বরদাচরণ মজুমদার, যোগীর কালীপদ গুহরায় প্রভৃতির প্রিয়পাত্র ছিলেন। ১৯২১ খ্রি. পণ্ডিচেরিতে তিনি প্রথম শ্রীঅরবিন্দকে দর্শন করে যোগ সাধনা গ্রহণের সুযোগ পান। পরে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে সপরিবারে পণ্ডিচেরি আশ্রমবাসী হন। 


১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ই মে প্রয়াত হন।


  • সুরমুকুর (১৯৩৪)
  • শ্রদ্ধাস্পদেষু
  • দাদাঠাকুর
  • কান্তপদলিপি
  • হাসির অন্তরালে
  • আসা যাওয়ার মাঝখানে


সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কবি, গায়ক,সাহিত্যবোদ্ধা ও ছন্দশ্রী ছিলেন.


Monday, 27 September 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য । সতীনাথ ভাদুড়ী। ২৭.০৯.২০২১. Vol -508. The blogger in literature e-magazine


    বিলুর জীবন দর্শন ও সতীনাথ ভাদুড়ী 

মাঝবয়সি এক বাঙালি ঘুরছেন ফ্রান্সের রাস্তায়। সিন নদীর পাড়ে পুরনো দোকানে প্রাণ ভরে গন্ধ নিচ্ছেন উইপোকায় খাওয়া বইয়ের। দেখছেন ফরাসিদের। আর তাদের দেশে আসা ধরাধামের লাখো মানুষকে। সেই প্রতিটি মানুষের দিকেই হয়তো ‘অনন্তযৌবনা প্যারিস পাতলা ফরাসি সিল্কের আধাঘোমটার ভিতর দিয়ে চোখ ইসারা করে।’— ‘ইসারা’য় ধরা দেন কেউ কেউ।

ধরা হয়তো দিতে চাইলেন ওই বাঙালি ভদ্রলোকটিও। এ ইশারার বার্তা এসেছে ফরাসি তন্বীরূপে নয়, বরং এক হিটলারি জার্মানি থেকে বিতাড়িত (সম্ভবত ইহুদি বলে) এক মহিলার চোখে। যাঁকে ওই বাঙালি দেখাতে চান তাঁর দেশ, মহা-ভারত। বাঙালিটি সতীনাথ ভাদুড়ী। মহিলাটি হোটেলের পরিচারিকা। নাম অ্যানি। অ্যানি এমন এক জন, যাঁর কথা ‘একসঙ্গে বেশিক্ষণ ভাবতে’ পারা যায়। ভাবনার সূত্রেই জড়িয়ে পড়ে ‘অবিচ্ছেদ্য’ সতীনাথ-কথাও।

কিন্তু দেশ দেখানো হল কই? সতীনাথ জানলেন, অ্যানির স্বামী-পুত্র নিয়ে ভরা সংসার। তবুও... নোটবইয়ের পাতায় অন্য অ্যানি বেঁচে থাকেন। পাতা ওল্টালে ভেসে আসে অ্যানির হাতের লেখা ঘরকন্নার গন্ধ। আর সতীনাথ প্রশ্ন করেন নিজেকেই, ‘মানুষ অতৃপ্ত— কী যেন খুঁজছে সারা জীবন— কী সেই জিনিস?’ 

বিলু চরিত্রের মধ্য দিয়ে সেই অন্বেষণ যেন সারাজীবন তিনি করেছেন, পারিপার্শ্বিক অবস্থা কে সামনে রেখে -

 ” যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে

আমি বাইব না, আমি বাইব না মোর খেয়া তরী এই ঘাটে।”

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে এহেন মর্মবিদারী অনুভূতির রসে জারিত চরিত্রটি জাগরী উপন্যাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্র -বিলু।  ৩৩বছর বয়সী পূর্ণ সান্যাল বা বিলু (জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র) নীতি-আদর্শে, আচার- ব্যবহারে, উদারতায়- মহানুভবতায়, মাতৃভক্তিতে-ভ্রাতৃ প্রীতিতে,একনিষ্ঠ দেশসেবক ও নেতা হিসাবে এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। রাষ্ট্রীয় পরিবারের চারজন সদস্যের মধ্যে প্রেম- ভক্তিতে, সেবায় ত্যাগে সে অনন্য। তার চরিত্রে রাজনীতি ও পরিবার একসূত্রে গাঁথা। সেই উপন্যাসের প্রধান আকর্ষণ। তার আত্মকথন (ফাঁসি সেল বিলু) দিয়েই উপন্যাসটি শুরু হয়েছে।আগস্ট আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে গ্রীষ্মকালীন ১০ ঘন্টা রাত্রি শেষে বিলুর ফাঁসি হবে। এই রোমহর্ষক ও পীড়াদায়ক ঘটনাকে কেন্দ্র করে সে নিজে এবং আপার ডিভিশন ওয়ার্ডে বাবা, আওরাত কিতায় মা, জেলগেটে ছোটভাই নিলু সবাই চিন্তায় বিভোর হয়েছে। অতীত ও বর্তমানকে নিয়ে তাদের সমবেত চিন্তার স্রোত ক্রমশ গাঢ় হয়েছে চরম মুহূর্তের জন্য।জীবন-মৃত্যুর টানাপোড়েনে সবাই বিলুর কথাই ভাবছে।Doing ও Suffering-এর মধ্য দিয়ে সে এক নায়কো- পম চরিত্রে পরিণত হয়েছে।

মায়ের আত্মকথন থেকে জানা যায়,

“… বিলু যখন হয় তখন দিব্যি মোটাসোটা ছিল–এত বড় কল জোড়া ছেলে…।”(পৃঃ ৯৬)কিন্তু ডবল নিমোনিয়ায় তার শরীর ভেঙে যায় আড়াই বছর বয়সে। মাথায় কোঁকড়া চুল ,ফর্সা রং ,লম্বাটে মুখ, ভাবুকতায় ভরা দুটি চোখ নিয়ে জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র অনেকটা মেয়েদের মতো দেখতে। তাই বিলুর মা ভাবেন–
“…যখনই মেয়ের কথা মনে হয়, তখনই মনে হয় বিলু আমার মেয়ে নিলু আমার ছেলে। বিলুর স্বভাব মেয়েরই মতো নরম;ওর ব্যবহার সেইরকম দরদ ভরা; মেয়ের মত ওর সহ্য করবার ক্ষমতা, আর সেই রকমই ওর চোখে একটু তে জল আসে।” (পৃষ্ঠা ১০৪)

এতে বিলুর স্বভাব- প্রকৃতির কোমল দিকটি ফুটে ওঠে।কিন্তু পাশাপাশি বাবা তার চরিত্রে কোমল রূপের -
“আমার সম্মুখে আসিলেই জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র দেখি সংকুচিত হইয়া যায়,কেমন যেন জড়সড় ভাব।…. ও চিরকালই কুনো।”( পৃষ্ঠা ৫৬) সঙ্গে কঠোর রূপকেউ কেউ তুলে ধরেন। তারের ওপর চড়ে সাহেব- মেমদের উৎসব দেখা নিয়ে বিলুর বাব বিলুকে শাসন করলে বিলু বাবার মুখের উপর বলেছ-

“কেন,ওখানে গেলে কী হয়েছে?”( পৃষ্ঠা ৬৩)

মার কাছে সে একই ভাবে তর্ক করেছে —–

“কেন?,আমাদের জমি থেকে সাহেব- মেমর মেলা দেখছিলাম তাতে হয়েছে কী?…” (পৃষ্ঠা ৬৩)

তাই বাবা তার চরিত্রের কঠোর দিক লক্ষ্য করে বলেন-

“জোর করিয়া বিলুকে দিয়া কেহ কিছু করাইয়া লইবে তাহা হইতে পারে না।…গায়ের জোর দেখাও, বিলু রুখিয়া দাঁড়াইবে।মুহূর্তের মধ্যে স্বাভাবিক নমনীয়তা কোথায় চলিয়া যায়।” (পৃষ্ঠা ৬৩)

এমন কি ছোটভাই নীলুর চোখেও বিলুর কঠোরতা

“… প্রীতি, সৌজন্য ও নমনীয়তার মধ্যে তাহার দৃঢ়তা অসীম।…”পৃষ্ঠা-১৩৮) ধরা পড়ে।

স্কুলশিক্ষক বাবা ও গৃহবধূ মায়ের মাঝখানে ছোটবেলা থেকেই জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র বড় হয়ে ওঠে। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে শিক্ষা-সংস্কৃতির ঘোরা টোপে বিলুর মন ও মনন ঋদ্ধ হয়। জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র বৃদ্ধ বদমেজাজি দাদুর স্নেহ-ভালোবাসা পেলেও বাবার আদর- স্নেহ থেকে বঞ্চিত। আপার ডিভিশন ওয়ার্ডে বন্দী পিতা যথার্থই ভেবেছেন-

“…তখন হইতে যদি ছেলেদের সহিত একটু মেলামেশার সম্পর্ক রাখিতাম, তাহা হইলে আজ তাহাদের সহিত সম্বন্ধে হয়তো স্নেহভালোবাসার , ভয় ও সমীরের নয়।”(পৃষ্ঠা৫৭)।


বেলুর মত বিলুর স্রষ্টা ঔপন্যাসিক সতীনাথ - রাশভারী,গম্ভীর পিতা ইন্দুভূষণ ভাদুড়ীর স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এ সম্পর্কে কল্যাণ মন্ডল কোরক সাহিত্য পত্রিকা বলেন—
“বাবাকে শিশুবেলা থেকে ভয় পেয়ে এসেছেন তিনি। ফলে ইন্দুভূষণের সঙ্গে সতীনাথের মানুস- দূরত্ব ছিল চিরকাল।” (পৃষ্ঠা—১৮০)
বিলুর মত সতীনাথের আশ্রয় স্থল হলো তাঁর মার রাজবালা দেবী। বিলুর শৈশব -বাল্যের সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশার একমাত্র উৎস হলো তার মা। ছোটবেলায় মা স্নান করে এলেই জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র মাকে জড়িয়ে ধরে বলতো—” তুমি স্নান করে এলেই তোমার গায়ে মার গন্ধ পাই।” (পৃষ্ঠা ১০৭)

আবার জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র বারান্দায় বসে পড়ার সময় পিছন থেকে পা টিপে টিপে হেঁটে গেলে বিলুর তীক্ষ্ণ অনুভূতিশীল মন তা বুঝতে পেরে বলে ওঠে—-
“মা মা গন্ধ পাচ্ছি।” (পৃষ্ঠা ১০৭)এ থেকে বিলুর মাতৃ প্রীতি ও অনুভূতিশীল মনের পরিচয় পাই। মাও বদরাগী ছোট ছেলে নীলু অপেক্ষা বিলুকে বেশি ভালোবাসেন। এমনকি উদাসীন বাবাও যে নীলু অপেক্ষা বিলুকে বেশি পছন্দ করেন, তা তাঁর কথায় প্রকাশ পায়—

“…বিলু মুখ ফুটে কিছু বলবে না– কিন্তু হয়তো উহার চোখে জল আসিয়া যাইবে। আর নিলু— নিলু তো আমার প্রাণে আঘাত দিবার সুযোগ পাইলে ছাড়ে না।…” (পৃষ্ঠা ৭৮)

শুধু বাবা-মা নয় সবার কাছে প্রিয় ঘরে ও বাইরে তার জনপ্রিয়তা অটুট। জ্যাঠাইমা অসুখে পড়ে তার সমস্ত সম্পত্তি জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র কে দিয়ে যেতে চায়। জরদাবাজারের কংগ্রেস কর্মী দুবেজীও মরার আগে তার কয়েক বিঘা জমি বিল্টুকে উইল করে দিতে চায়; জিতেনের মা বিলু বলতে অজ্ঞান; জিতের মা বৌঠাকরুন তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিলুও হোলির পর প্রণাম করা, আশ্রমের লেবু পাঠিয়ে দেওয়া,কারও ছেলের পড়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে সবার কাছে আদরণীয় হয়ে ওঠে।

ছোটবেলাতে যে জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র টেপীর মা, দুর্গার মা, জিতেনের মা দিদিদের সামনে রামায়ণ-মহাভারত পড়ে শুনিয়েছে; পৈতা গ্রহণ করেছে, আশ্রমের প্রার্থনায় যোগ দিয়েছে, দেবভক্তি -পূজে আচ্চায় ঝোঁক দেখিয়েছে, শ্লোক- মন্তর মুখস্ত করেছে, সে বড় হয়ে একে একে সব কিছু ছেড়ে নাস্তিক হয়েছে। বাবার পাঠানো একটি গীতা অ্যাসিস্ট্যান্ট জেলার তাকে দিতে গেলে তা না নিয়ে কমরেড বিলু বলেছে–

“এ বইয়ের দরকার নাই অন্য ভালো বই-টই দেন তো পড়িতে পারি।”(পৃষ্ঠা ৭৩)

অর্থাৎ ভগবানে অবিশ্বাসী কমরেড জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র জেলের ভিতর ধর্মীয় গ্রন্থ বাদে অন্য গ্রন্থ পড়তে আগ্রহী। পড়া ও পড়ানো দুটোতেই অন্যান্য কমিউনিস্টদের মত তার আগ্রহ। বরঞ্চ এ বিষয়ে তার স্থান উঁচুতে। কমরেড বাণারসীও চুরুট টানতে টানতে বিলুর বাবাকে জানায়–

“বিলু বাবুর মত আমাদের দলে আর কেহ পড়াতে পারে না ।সেই জন্যই সেবার যখন শোনপুরে আমাদের প্রাদেশিক সামারক্যাম্প খোলে– সেখানে বিলু বাবুর উপর ‘ডায়ালেকটিকাল- মেটিরিয়ালিজম’ পড়াইবার ভার পড়িয়াছিল। অপরচুনিস্ট-দের ছাড়িয়া দিয়া যদি কেবল যথার্থ কর্মীদের কথা ধরা যায়,তবে আমাদের দলের ইন্টেলেকচুয়ালস-এর মধ্যে বিলু বাবুর স্থান খুব উচ্চে। ” (পৃষ্ঠা-৬৭)

এর থেকে সুশিক্ষক বিলুর উচ্চ প্রশংসার কথা প্রকাশ পায় । বাবা স্বীয় অনুভূতির আলোকে প্রায় একই সুরে জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র সম্পর্কে বলেন শিক্ষকতা লাইন ছাড়া অন্য কোন দিকে থাকলে সে খুব একটা সাফল্য অর্জন করতেপারতো না ।
গান্ধীবাদী পিতার সংস্পর্শে থেকে জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র ১৯৩০-৩২ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসে থেকেছে ।ক্যাম্প জেলে থাকার সময় কংগ্রেস পার্টির ব্যর্থতার কথা ভেবে কংগ্রেসী ঘরানা থেকে বেরিয়ে বিলু কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টিতে যোগ দেয় ।বিলুর এহেন দল পরিবর্তনের সঙ্গে ঔপন্যাসিক সতীনাথ ভাদুড়ীর ব্যক্তিজীবনের মিল খুঁজে পাওয়া যায় । সতীনাথও ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর পূর্ণিয়া কংগ্রেসের সর্বোদয় নেতা বৈদ্যনাথ চৌধুরীর টিকাপট্টি আশ্রমে যোগ দিয়ে জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত জড়িয়ে পড়েন।


কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৪৮খ্রিষ্টাব্দের গোড়ার দিকে তিনিও কংগ্রেস পার্টি ত্যাগ করে কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টিতে যোগ দেন ।যদিও এই পার্টিতে তিনি বেশিদিন থাকতে পারেননি। স্রষ্টা সতীনাথের মত জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র ও ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন।

পূর্ণিয়া জেলা কংগ্রেস সম্পাদক সতীনাথ সংগঠনের তহবিলের হিসাবরক্ষা, রিভলবার পিস্তলআদান-প্রদান, পায়ে হেঁটে রাতের অন্ধকারে জলকাদা ভেঙ্গে দূরবর্তী জায়গায় গোপনে সভা -সমিতি পরিচালনা, বিয়াল্লিশের আন্দোলনে অংশ নেওয়া নেতা হিসেবে অনেকের সঙ্গে পূর্ণিয়া সেন্ট্রাল জেলে বন্দী হওয়া ইত্যাদি ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের মধ্যেও এর অনেক কিছু উপস্থিত।

নিলু,সহদেওকে সঙ্গে নিয়ে বকড়িকোলে মিটিং করা, গাছের গুঁড়ি ও গাছ কেটে পূর্ণিয়া গ্রামের রোডে ও রহুয়া গ্রামের রাস্তা আটকানো, থানা জ্বালিয়ে দেওয়া, কৃত্যানন্দ নগর রেল স্টেশন বন্ধ করা ইত্যাদি নানা কাজে জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র ব্যস্ত থাকে। গান্ধীজীর জয়ধ্বনির সঙ্গে জনতা তাকেও জয়ধ্বনি দিয়ে নেতা বানাতে চায়। চোখে -মুখে স্বাধীনতার স্বপ্ন।

দেশভক্তি,জনসেবা তার অস্থি -মজ্জা মিশে থাকে ।সে প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যেখানে বৈষম্য, অবিচার সেখানেই তার প্রতিবাদ। রাজবন্দীদের মধ্যে শ্রেণীভেদকে সহজে মেনে নিতে না পেরে সে বলেছে —

“কেন তাহারা সকল রাজবন্দীদিগের একটিমাত্র শ্রেণী করেন নাই?
উচ্চশ্রেণী ও নিম্নশ্রেণীর রাজবন্দী রাখিবার অর্থ কী?…”

রাজনীতি মানে যে নিজের আখের গোছানো নয়– ত্যাগ ও সেবার মাধ্যমে দেশ ও জাতির কল্যাণ – বিধান, তা বিলুর সত্যদৃষ্টিতে ধরা পড়েছে। সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠা রাজনীতিবিদের মত পরাধীন ভারতবর্ষের একজন রাজনৈতিক কর্মীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মন্তব্য —

“…আশা রাখিবে ফাঁসির রজ্জুর, হয়তো গৌরবের রাজমুকুট পাইতেও পারো। অপার ক্লেশের জীবন।”

এহেন ভাবনার অনুষঙ্গে জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র মার্কসবাদের ও কমিউনিস্টদের মতাদর্শের কাছাকাছি চলে আসে। সর্বোপরি বিলুর পার্টির (কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টি )মধ্যেও সমাজতন্ত্রের ভাবনা ক্রিয়াশীল। আর এই ভাবনা কিছুটা জওহরলাল নেহেরুর মধ্যেও উপস্থিত ছিল।


ব্যক্তিজীবনে সতীনাথও ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টিতে যোগদানের সূত্রে এই ভাবনার শরিক হয়ে পড়েন। মার্কসবাদী পার্টির সংগঠন সততা- ন্যায়পরায়নতা, নিয়ম-নীতির কঠোরতা বিলুকে মুগ্ধ করত ।তাই সে বলেছে–

“…আমার যদি অনেক টাকা থাকিত, তাহা হইলে আজ উইল করিয়া যাইতাম ।অনেক কোটি টাকা। তাহা দিয়া মার্কসবাদের প্রচারকার্য চলিত। ভারতের প্রতি গ্রামে গ্রামে বালক ও কিশোরদের সঙ্ঘের ন্যায় দলের সংগঠন হইতে পারিত।”(পৃষ্ঠা-৪৬)

বিলুর আত্মসম্মানবোধ প্রবল। জেলের ভিতর ওয়ার্ডার তাকে “আসামী” বললে জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র তাতে আঘাত পায় ।তার মনে হতে থাকে –“ইহা অপেক্ষা ভদ্র ভাষা তাহারা ব্যবহার করা উচিত ছিল।”(পৃষ্ঠা১৭)

জেলের সুপারিনটেনডেন্ট এসে বিলুকে কোন জিনিসের দরকার আছে কিনা জানতে চাইলে বিলু মনে মনে একটা মশারির কথা ভেবেও বলতে পারেনি ।সে বলেছে—” ধন্যবাদ, আমি বেশ আরামেই আছি । কোনো জিনিসের দরকার নাই।”( পৃষ্ঠা -৯)

এতে আত্মসম্মানী বিলুর রূপ ফুটে ওঠে। সহানুভূতি বা করুণার পাত্রও নয় জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র। ওর্ডারের কাছ থেকেও সে প্রশংসা দাবী করে–

“আমি তাহার নিকট হইতে আশা রাখি প্রশংসার– কথাই না হউক অন্তত হাবভাবে, আমার ত্যাগের জন্য।” (পৃষ্ঠা-১৭)

একজন ওয়ার্ডার বিলুকে’আসামী’ বললেও অন্য আর একজন ওয়ার্ডার তার মাথার সরিষার তেল জোগাড় করা, তার গায়ের কাপড় কেচে পরিষ্কার করার মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা জানায়। দুই নম্বর ওয়ার্ডে চন্দ্রিমা বিলুর ত্যাগের কথা,দেশ ভক্তির কথা প্রচার করে। গোরে সিং তার বক্তৃতায় বিলুর ত্যাগ- তিতিক্ষার প্রভাবের কথা তুলে ধরে ।এভাবে দিকে দিকে বিলুর প্রশংসাছড়িয়ে পড়ে।


আত্মসমালোচক বিলু মাঝে মাঝে নিজের কাজের সমালোচনা করেছে–
” চিরকাল আমার মনের এই অদ্ভুত গতি আমি লক্ষ্য করিয়াছি প্রয়োজনীয় অপেক্ষা অপ্রয়োজনীয় বিষয়েই আমার আকর্ষণ বেশি ।”(পৃষ্ঠা১০)
জীবনের পথে সঠিকভাবে চলার জন্য এর প্রয়োজন আছে আত্মসমালোচক বিলুর মধ্যে আবার চেতনার প্রবাহ বা চিন্তার স্রোত সুন্দরভাবে কাজ করেছে ।সুপারিনটেনডেন্টকে জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র গর্বের সঙ্গে কোনো জিনিসের দরকার নেই জানানোর পর ঐ বিষয় সংক্রান্ত ভাবনার স্রোতে মশগুল থাকতে থাকতে (শুকদেও পর্যন্ত ) ওয়ার্ডার _এর–” বাবু বিজে ভৈল বা? (বাবু খাওয়া হইয়াছে ?)”–এই কথার সূত্র বিলু ভাবনার নতুন স্রোতে ঢুকে পড়ে ।জেল ওয়ার্ডারদের আচরণ নিয়ে ভাবনার স্রোত।

পরে আবার ভোজনের কথায় আসা। দই-এর প্রসঙ্গে তৃতীয় শ্রেণীর রাজবন্দীদের( নিম্নশ্রেণীর রাজবন্দী) প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের বিষয়ে ভাবনার স্রোতে ভেসে চলা, ইত্যাদি। Stream of consciousness-এর এহেন সুন্দর ব্যবহার শিল্পী সতীনাথের আঙ্গিক সচেতন মনের উৎকর্ষের পরিচয় দেয় । এরই সঙ্গে ফাঁসীর আসামী বিলুর মনের চঞ্চলতা ও গতি -প্রকৃতি ধরা পড়ে।
রক্ত -মাংসে গড়া মানুষ মাত্রেই প্রেম- ভালোবাসা থাকে । জৈবিক সত্ত্বার অধিকারী বিলুর ক্ষেত্রেও তা স্বাভাবিক। সরস্বতীর সঙ্গে নিবিড় রোমান্টিক সম্পর্ক। জ্যাঠাইমা সরস্বতী ও বিলুকে এক থালা কাটা আম দিলেন বসে খাওয়ার জন্য। পিঁড়ি পেতে দু জনে বসেছে।

সরস্বতী বলে —

“কাটা আম কি এঁর মুখে রুচবে,–ওকে আস্ত আম দেন।”( পৃষ্ঠা ৪৬)

একথা শুনে জ্যাঠাইমা সরস্বতীকে ঠাট্টা করে বলেন–‘ ওমা এরই মধ্যে এত’ বিলু গোটা আমের নিচটা ফুটো করে চুষে চুষে খায়। বোঝা যায় একে অপরকে কতটা জানে ও চেনে। বিলুর বাবা ও মা দুজনেই বিলুর সঙ্গে স্বরস্বতীর বিবাহের কথা ভাবেন ।বাবা মনে করেন-

“… সরস্বতীর সহিত বিলুর বিবাহ দিলে বেশ হইত ।দুজনেই সুখী হইতে পারিত। বেশ মেয়ে সরস্বতী।… লেনিনও তো বিবাহ করিয়াছিলেন ।….”
(পৃষ্ঠা ৭৭)

মাও মনে করেন –সরস্বতীর শহিত খাসা মানাইত। আজকালকার মধ্যবিত্ত ঘরের বাঙালি মেয়ে অপেক্ষা সরস্বতী অনেক বেশি কাজের।”( পৃষ্ঠা ৭৭)

কিন্তু শেষপর্যন্ত বিলুর মার আপত্তিতে সরস্বতীর সঙ্গে বিলুর বিয়ে হয়নি। কপিলদেও-এর বংশে কিছু গোলমাল ,অবাঙালি Culture ও বিলু রাজনৈতিক কর্মী হওয়ায় তার কারণ। অন্যদিকে বন্ধু নরেশের বিধবা ছোট্ ঠাক্ মা যৌবনের ও হিল্লোলে ও প্রাণচাঞ্চল্যে বিলুর জীবনে অনাস্বাদিতপূর্ব রোমাঞ্চকর অনুভূতি সৃষ্টি করে। চিড়িয়াখানায় ছোট্ ঠাক্ মা বাঘের ভয়ে বিলুকে জড়িয়ে ধরলে বিলুর সমস্ত শরীরে শিহরণ জাগে।

সেই মুহূর্তটিকে সামনে রেখে জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র মনে মনে কত স্বপ্ন রচনা করে। এমনকি দেশে ফেরার সময় ট্রেনে জানলার ধারে ছোট্ ঠাক্ মা বিলুর হাতের উপর হাত রেখে আস্তে আস্তে বলেছিল — “সন্ন্যাসী ঠাকুর, আমাদের ওখানে একবার যেও ।”সেই স্মৃতি বিলুর মনের মধ্যে ভাস্বর হয়ে থাকে। ফাঁসীর প্রাক্- মুহুর্তে এইসব মমতা মাখানো রোমান্টিক বিলু মানবিকতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

জীবনের রং ধূসর নয় – গাঢ় সবুজ। প্রাণবন্ত মানুষ তাই শ্যামলিমাময় প্রকৃতিরানীর হাতছানিতে বারবার ধরা দেয় । মুক্তিপিপাসু মানুষের মধ্যে প্রকৃতি -ঘনিষ্ঠতা আরও বেশি। জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বিলুর মধ্যেও জেগে ওঠে প্রকৃতিকে একান্ত রূপে কাছে পাওয়ার অনুভূতি–।

“আকাশের ঐ ফালিটুকু আমার একান্ত আপন — ও যে আমার নিজস্ব জিনিস।যতক্ষণ দেখা যায় ঐ স্বচ্ছ নীল রং দেখিয়া লইয়াছি । এমন করিয়া, আমার মত করিয়া, আকাশের ঠিক ওই অংশটুকুকে কি আর কেহ পাইয়াছে ?…”(পৃষ্ঠা ৮)
অতঃপর বিলুর অনুভূতিতে ধরা পড়ে সবুজ- নীলের সঙ্গে ধূসর রং -এর তাৎপর্য গত বৈষম্যের দিকটি–

“ওই গাছের সবুজটুকু ও আকাশের টুকরোটি ছাড়া, এখান হইতে যাহা কিছু দেখা যায়,তাহা কেবল লোহা, ইট আর সিমেন্ট –সিমেন্ট,ইট আর লোহা।উহা চক্ষুকে প্রলুব্ধ করে না– দৃষ্টিকে প্রতিহত করে মাত্র, তাহাকে ঠিকরাইয়া ফিরাইয়া দেয়।” (পৃষ্ঠা৮)

 

শিল্পী সতীনাথ এখানে জাগরী উপন্যাসের জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র চরিত্র এর মনস্তত্ত্বের সঙ্গে সাযুজ্য বজায় রেখে প্রকৃতি ও পরিবেশের ছবি এঁকেছেন– যেখানে রং বিশেষ ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে উঠেছে। এখানে –গাছের সবুজ ও আকাশের নীল– সতেজ প্রাণবন্ত জীবনের প্রতীক ।ধূসর সিমেন্ট ইট- লোহা– অন্ধকার মৃত্যুর প্রতীক। জীবন-মৃত্যুর প্রদীপ জ্বালিয়ে ঔপন্যাসিক এখানে ফাঁসী সেলের কয়েদী বিলুর অন্তিম জীবন পিপাসাকে বাণীরূপ দিয়েছেন।

“মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।”

__এই ভাবনাকে , স্বীকরন করে উপন্যাসের শেষের দিকে বিলু আদর্শ মানব চরিত্র থেকে মানবিক চরিত্রের দিকে যাত্রা করেছে ।এই পর্বে এসে মুক্তিপিপাসু বিলুর কন্ঠে হতাশার সুর, বুকে গভীর উদ্বেগ। অস্তিত্বের সংকটে জীর্ণ বিলু ভেবেছে–

“এখন বিলু আছে, আর কিছুক্ষণ পরে থাকিবে না ।রক্তমাংসে গড়া সুখ- দুঃখে ভরা বিলু বলিয়া কিছু নাই ;আর সরকারি স্ট্যাটিসটিকসের একটি সংখ্যা মাত্র।… আমি পূর্ণিয়া জেলের ১১০৯ নম্বর ফাঁসীর আসামী –ফাঁসীর শতকরা হার একটি দশমিক ভগ্নাংশের পরিমাণ বাড়াইয়া দিব ।…ইহাই আমার জীবনের মূল্য জাতীয় ইতিহাসে বিলুবাবুর দান।”
(পৃষ্ঠা ৫৩)’

বিলুর দ্বন্ধক্ষুব্ধ হৃদয়ের কাতরোক্তি বিজড়িত এই মন্তব্য সত্যিই হৃদয়বিদারক জীবনমুখী জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র জীবনের শেষ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ভেবেছে–

“…ইচ্ছা করে বাঁচতে, ইচ্ছা করে বাকি দুই ঘণ্টার স্বপ্নবিলাসের মধ্যে দিয়া জগতকে নিঙড়াইয়া যাহা কিছু ভোগের জিনিস আছে ,একত্র করিয়া লইতে। যদি এই শেষ মুহূর্তে আমার ফাঁসি রদ করার হুকুম আসে। এমনও তো হয়।…” (পৃষ্ঠা-৪৭)

এহেন তীব্র জীবনাকুতি বিলুকে মানবিক করে তুলেছে। হাসির কথা চিন্তা করে হত -বিহ্বল মনে মনে যন্ত্রণা অনুভব করেছে –“কী ভীষণ যন্ত্রণা হইবে তক্তা সরাইয়া লওয়ার মুহূর্তে। অসম্ভব তীব্র যন্ত্রণা।… (পৃষ্ঠা ৪৮) মৃত্যুর ভয় –মৃত্যুকালীন যন্ত্রণার ভয় বিলুর দেহ -মনকে অবশ-অসাড় করে তোলে ।জীবন-মৃত্যুর এই টানাপোড়েনের সময় তার নীলুর কথা মনে পড়েছে। নীলুর প্রতি তীব্র ঘৃণায় বিলু ভেবেছে–

“… দাদা বলিতে অজ্ঞান নিলু– সে কিনা আমার সঙ্গে এই ব্যবহার করিল ।…এত ঘৃৃন্য পরিবর্তন হইয়াছে তাহার মনের! ছি !”(পৃষ্ঠা ৫০)

এ ভাবনা স্বাভাবিক। কিন্তু সতীনাথের জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র পরক্ষনেই যখন ভাবে–

“নিলু আসিয়াছে তাহার দাদার সহিত সাক্ষাৎ করিতে তাহার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক পার্টির স্থানীয় নেতা বিলুবাবুর সহিত নয় ।কি ভাগ্য যে সেদিন তাহার সম্মুখে আমার মানসিক দ্বন্দ্বের আভাস ফুটিয়া উঠে নাই।…”( পৃষ্ঠা ৫১)

তখন পাঠক কিছুটা আহত হয়। কেননা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র কি করে নীলুর সামনে নিরুদ্বেগে ও নির্লিপ্তভাবে দাদার মতো আচরণ করল ?কেন নীলুর কৃতকর্মের কথা তার মুখের উপর সাপটে ছুঁড়ে মারলো না ?রক্তমাংসে গড়া মানুষের পক্ষে এতটা উদার হওয়া কি সম্ভব ? নাকি বিলুর এই মহত্ব নীলুকে ছোট করার জন্য ?–এসব প্রশ্ন সঙ্গত ও স্বাভাবিক অনেক সমালোচকও এ বিষয়ে সহমত পোষণ করেন ।বিষয়টি মে সত্যিই ন্যায়সঙ্গত তার প্রমাণ পায় বিলুর অন্তিম কথায়–

“জ্যাঠাইমা! সরস্বতী! মা! নীলু !নীলু তুই একি করলি ?একটি লোহার Horizontal bar- এ, আমার আসার মৃতদেহটি ঝুলিতেছে।…”( পৃষ্ঠা -৫৩)

পরিশেষে জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র সৃষ্টির মূলে ঔপন্যাসিক সতীনাথের মধ্যবিত্ত ঘরোয়াপরিবারে বেড়ে ওঠা; উদাসীন বাবার অভাব পূরণে মা-এর( রাজবালা )উপর অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়া ;পুরুলিয়ার নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্তের পুত্র বিভূতি দাশগুপ্তের কথা স্মরণে রাখা; অন্তর্মুখী ও কৃচ্ছসাধনেরআদর্শকে বরণ করে নেওয়া; ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া; খোকা ডাক্তারের মা কুসুমকুমারী দেবী- কে ‘মা ‘ বলে ডাকা ইত্যাদি ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতাঋব্ধ ঘটনাসমূহের কথা বিশেষভাবে স্মরণে রাখতে হয় .

===={{{======={{{{{{======{{{{{{{===