মাঝবয়সি এক বাঙালি ঘুরছেন ফ্রান্সের রাস্তায়। সিন নদীর পাড়ে পুরনো দোকানে প্রাণ ভরে গন্ধ নিচ্ছেন উইপোকায় খাওয়া বইয়ের। দেখছেন ফরাসিদের। আর তাদের দেশে আসা ধরাধামের লাখো মানুষকে। সেই প্রতিটি মানুষের দিকেই হয়তো ‘অনন্তযৌবনা প্যারিস পাতলা ফরাসি সিল্কের আধাঘোমটার ভিতর দিয়ে চোখ ইসারা করে।’— ‘ইসারা’য় ধরা দেন কেউ কেউ।
ধরা হয়তো দিতে চাইলেন ওই বাঙালি ভদ্রলোকটিও। এ ইশারার বার্তা এসেছে ফরাসি তন্বীরূপে নয়, বরং এক হিটলারি জার্মানি থেকে বিতাড়িত (সম্ভবত ইহুদি বলে) এক মহিলার চোখে। যাঁকে ওই বাঙালি দেখাতে চান তাঁর দেশ, মহা-ভারত। বাঙালিটি সতীনাথ ভাদুড়ী। মহিলাটি হোটেলের পরিচারিকা। নাম অ্যানি। অ্যানি এমন এক জন, যাঁর কথা ‘একসঙ্গে বেশিক্ষণ ভাবতে’ পারা যায়। ভাবনার সূত্রেই জড়িয়ে পড়ে ‘অবিচ্ছেদ্য’ সতীনাথ-কথাও।
কিন্তু দেশ দেখানো হল কই? সতীনাথ জানলেন, অ্যানির স্বামী-পুত্র নিয়ে ভরা সংসার। তবুও... নোটবইয়ের পাতায় অন্য অ্যানি বেঁচে থাকেন। পাতা ওল্টালে ভেসে আসে অ্যানির হাতের লেখা ঘরকন্নার গন্ধ। আর সতীনাথ প্রশ্ন করেন নিজেকেই, ‘মানুষ অতৃপ্ত— কী যেন খুঁজছে সারা জীবন— কী সেই জিনিস?’
বিলু চরিত্রের মধ্য দিয়ে সেই অন্বেষণ যেন সারাজীবন তিনি করেছেন, পারিপার্শ্বিক অবস্থা কে সামনে রেখে -
” যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
আমি বাইব না, আমি বাইব না মোর খেয়া তরী এই ঘাটে।”
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে এহেন মর্মবিদারী অনুভূতির রসে জারিত চরিত্রটি জাগরী উপন্যাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্র -বিলু। ৩৩বছর বয়সী পূর্ণ সান্যাল বা বিলু (জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র) নীতি-আদর্শে, আচার- ব্যবহারে, উদারতায়- মহানুভবতায়, মাতৃভক্তিতে-ভ্রাতৃ প্রীতিতে,একনিষ্ঠ দেশসেবক ও নেতা হিসাবে এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। রাষ্ট্রীয় পরিবারের চারজন সদস্যের মধ্যে প্রেম- ভক্তিতে, সেবায় ত্যাগে সে অনন্য। তার চরিত্রে রাজনীতি ও পরিবার একসূত্রে গাঁথা। সেই উপন্যাসের প্রধান আকর্ষণ। তার আত্মকথন (ফাঁসি সেল বিলু) দিয়েই উপন্যাসটি শুরু হয়েছে।আগস্ট আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে গ্রীষ্মকালীন ১০ ঘন্টা রাত্রি শেষে বিলুর ফাঁসি হবে। এই রোমহর্ষক ও পীড়াদায়ক ঘটনাকে কেন্দ্র করে সে নিজে এবং আপার ডিভিশন ওয়ার্ডে বাবা, আওরাত কিতায় মা, জেলগেটে ছোটভাই নিলু সবাই চিন্তায় বিভোর হয়েছে। অতীত ও বর্তমানকে নিয়ে তাদের সমবেত চিন্তার স্রোত ক্রমশ গাঢ় হয়েছে চরম মুহূর্তের জন্য।জীবন-মৃত্যুর টানাপোড়েনে সবাই বিলুর কথাই ভাবছে।Doing ও Suffering-এর মধ্য দিয়ে সে এক নায়কো- পম চরিত্রে পরিণত হয়েছে।
মায়ের আত্মকথন থেকে জানা যায়,
এতে বিলুর স্বভাব- প্রকৃতির কোমল দিকটি ফুটে ওঠে।কিন্তু পাশাপাশি বাবা তার চরিত্রে কোমল রূপের -
“আমার সম্মুখে আসিলেই জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র দেখি সংকুচিত হইয়া যায়,কেমন যেন জড়সড় ভাব।…. ও চিরকালই কুনো।”( পৃষ্ঠা ৫৬) সঙ্গে কঠোর রূপকেউ কেউ তুলে ধরেন। তারের ওপর চড়ে সাহেব- মেমদের উৎসব দেখা নিয়ে বিলুর বাব বিলুকে শাসন করলে বিলু বাবার মুখের উপর বলেছ-
“কেন,ওখানে গেলে কী হয়েছে?”( পৃষ্ঠা ৬৩)
মার কাছে সে একই ভাবে তর্ক করেছে —–
তাই বাবা তার চরিত্রের কঠোর দিক লক্ষ্য করে বলেন-
এমন কি ছোটভাই নীলুর চোখেও বিলুর কঠোরতা
স্কুলশিক্ষক বাবা ও গৃহবধূ মায়ের মাঝখানে ছোটবেলা থেকেই জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র বড় হয়ে ওঠে। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে শিক্ষা-সংস্কৃতির ঘোরা টোপে বিলুর মন ও মনন ঋদ্ধ হয়। জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র বৃদ্ধ বদমেজাজি দাদুর স্নেহ-ভালোবাসা পেলেও বাবার আদর- স্নেহ থেকে বঞ্চিত। আপার ডিভিশন ওয়ার্ডে বন্দী পিতা যথার্থই ভেবেছেন-
“…তখন হইতে যদি ছেলেদের সহিত একটু মেলামেশার সম্পর্ক রাখিতাম, তাহা হইলে আজ তাহাদের সহিত সম্বন্ধে হয়তো স্নেহভালোবাসার , ভয় ও সমীরের নয়।”(পৃষ্ঠা৫৭)।
বেলুর মত বিলুর স্রষ্টা ঔপন্যাসিক সতীনাথ - রাশভারী,গম্ভীর পিতা ইন্দুভূষণ ভাদুড়ীর স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এ সম্পর্কে কল্যাণ মন্ডল কোরক সাহিত্য পত্রিকা বলেন—
“বাবাকে শিশুবেলা থেকে ভয় পেয়ে এসেছেন তিনি। ফলে ইন্দুভূষণের সঙ্গে সতীনাথের মানুস- দূরত্ব ছিল চিরকাল।” (পৃষ্ঠা—১৮০)
বিলুর মত সতীনাথের আশ্রয় স্থল হলো তাঁর মার রাজবালা দেবী। বিলুর শৈশব -বাল্যের সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশার একমাত্র উৎস হলো তার মা। ছোটবেলায় মা স্নান করে এলেই জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র মাকে জড়িয়ে ধরে বলতো—” তুমি স্নান করে এলেই তোমার গায়ে মার গন্ধ পাই।” (পৃষ্ঠা ১০৭)
আবার জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র বারান্দায় বসে পড়ার সময় পিছন থেকে পা টিপে টিপে হেঁটে গেলে বিলুর তীক্ষ্ণ অনুভূতিশীল মন তা বুঝতে পেরে বলে ওঠে—-
“মা মা গন্ধ পাচ্ছি।” (পৃষ্ঠা ১০৭)এ থেকে বিলুর মাতৃ প্রীতি ও অনুভূতিশীল মনের পরিচয় পাই। মাও বদরাগী ছোট ছেলে নীলু অপেক্ষা বিলুকে বেশি ভালোবাসেন। এমনকি উদাসীন বাবাও যে নীলু অপেক্ষা বিলুকে বেশি পছন্দ করেন, তা তাঁর কথায় প্রকাশ পায়—
শুধু বাবা-মা নয় সবার কাছে প্রিয় ঘরে ও বাইরে তার জনপ্রিয়তা অটুট। জ্যাঠাইমা অসুখে পড়ে তার সমস্ত সম্পত্তি জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র কে দিয়ে যেতে চায়। জরদাবাজারের কংগ্রেস কর্মী দুবেজীও মরার আগে তার কয়েক বিঘা জমি বিল্টুকে উইল করে দিতে চায়; জিতেনের মা বিলু বলতে অজ্ঞান; জিতের মা বৌঠাকরুন তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিলুও হোলির পর প্রণাম করা, আশ্রমের লেবু পাঠিয়ে দেওয়া,কারও ছেলের পড়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে সবার কাছে আদরণীয় হয়ে ওঠে।
“এ বইয়ের দরকার নাই অন্য ভালো বই-টই দেন তো পড়িতে পারি।”(পৃষ্ঠা ৭৩)
“বিলু বাবুর মত আমাদের দলে আর কেহ পড়াতে পারে না ।সেই জন্যই সেবার যখন শোনপুরে আমাদের প্রাদেশিক সামারক্যাম্প খোলে– সেখানে বিলু বাবুর উপর ‘ডায়ালেকটিকাল- মেটিরিয়ালিজম’ পড়াইবার ভার পড়িয়াছিল। অপরচুনিস্ট-দের ছাড়িয়া দিয়া যদি কেবল যথার্থ কর্মীদের কথা ধরা যায়,তবে আমাদের দলের ইন্টেলেকচুয়ালস-এর মধ্যে বিলু বাবুর স্থান খুব উচ্চে। ” (পৃষ্ঠা-৬৭)
কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৪৮খ্রিষ্টাব্দের গোড়ার দিকে তিনিও কংগ্রেস পার্টি ত্যাগ করে কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টিতে যোগ দেন ।যদিও এই পার্টিতে তিনি বেশিদিন থাকতে পারেননি। স্রষ্টা সতীনাথের মত জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র ও ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন।
নিলু,সহদেওকে সঙ্গে নিয়ে বকড়িকোলে মিটিং করা, গাছের গুঁড়ি ও গাছ কেটে পূর্ণিয়া গ্রামের রোডে ও রহুয়া গ্রামের রাস্তা আটকানো, থানা জ্বালিয়ে দেওয়া, কৃত্যানন্দ নগর রেল স্টেশন বন্ধ করা ইত্যাদি নানা কাজে জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র ব্যস্ত থাকে। গান্ধীজীর জয়ধ্বনির সঙ্গে জনতা তাকেও জয়ধ্বনি দিয়ে নেতা বানাতে চায়। চোখে -মুখে স্বাধীনতার স্বপ্ন।
“কেন তাহারা সকল রাজবন্দীদিগের একটিমাত্র শ্রেণী করেন নাই?
উচ্চশ্রেণী ও নিম্নশ্রেণীর রাজবন্দী রাখিবার অর্থ কী?…”
“…আশা রাখিবে ফাঁসির রজ্জুর, হয়তো গৌরবের রাজমুকুট পাইতেও পারো। অপার ক্লেশের জীবন।”
ব্যক্তিজীবনে সতীনাথও ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টিতে যোগদানের সূত্রে এই ভাবনার শরিক হয়ে পড়েন। মার্কসবাদী পার্টির সংগঠন সততা- ন্যায়পরায়নতা, নিয়ম-নীতির কঠোরতা বিলুকে মুগ্ধ করত ।তাই সে বলেছে–
বিলুর আত্মসম্মানবোধ প্রবল। জেলের ভিতর ওয়ার্ডার তাকে “আসামী” বললে জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র তাতে আঘাত পায় ।তার মনে হতে থাকে –“ইহা অপেক্ষা ভদ্র ভাষা তাহারা ব্যবহার করা উচিত ছিল।”(পৃষ্ঠা১৭)
জেলের সুপারিনটেনডেন্ট এসে বিলুকে কোন জিনিসের দরকার আছে কিনা জানতে চাইলে বিলু মনে মনে একটা মশারির কথা ভেবেও বলতে পারেনি ।সে বলেছে—” ধন্যবাদ, আমি বেশ আরামেই আছি । কোনো জিনিসের দরকার নাই।”( পৃষ্ঠা -৯)
এতে আত্মসম্মানী বিলুর রূপ ফুটে ওঠে। সহানুভূতি বা করুণার পাত্রও নয় জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র। ওর্ডারের কাছ থেকেও সে প্রশংসা দাবী করে–
“আমি তাহার নিকট হইতে আশা রাখি প্রশংসার– কথাই না হউক অন্তত হাবভাবে, আমার ত্যাগের জন্য।” (পৃষ্ঠা-১৭)
একজন ওয়ার্ডার বিলুকে’আসামী’ বললেও অন্য আর একজন ওয়ার্ডার তার মাথার সরিষার তেল জোগাড় করা, তার গায়ের কাপড় কেচে পরিষ্কার করার মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা জানায়। দুই নম্বর ওয়ার্ডে চন্দ্রিমা বিলুর ত্যাগের কথা,দেশ ভক্তির কথা প্রচার করে। গোরে সিং তার বক্তৃতায় বিলুর ত্যাগ- তিতিক্ষার প্রভাবের কথা তুলে ধরে ।এভাবে দিকে দিকে বিলুর প্রশংসাছড়িয়ে পড়ে।
আত্মসমালোচক বিলু মাঝে মাঝে নিজের কাজের সমালোচনা করেছে–
” চিরকাল আমার মনের এই অদ্ভুত গতি আমি লক্ষ্য করিয়াছি প্রয়োজনীয় অপেক্ষা অপ্রয়োজনীয় বিষয়েই আমার আকর্ষণ বেশি ।”(পৃষ্ঠা১০)
জীবনের পথে সঠিকভাবে চলার জন্য এর প্রয়োজন আছে আত্মসমালোচক বিলুর মধ্যে আবার চেতনার প্রবাহ বা চিন্তার স্রোত সুন্দরভাবে কাজ করেছে ।সুপারিনটেনডেন্টকে জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র গর্বের সঙ্গে কোনো জিনিসের দরকার নেই জানানোর পর ঐ বিষয় সংক্রান্ত ভাবনার স্রোতে মশগুল থাকতে থাকতে (শুকদেও পর্যন্ত ) ওয়ার্ডার _এর–” বাবু বিজে ভৈল বা? (বাবু খাওয়া হইয়াছে ?)”–এই কথার সূত্র বিলু ভাবনার নতুন স্রোতে ঢুকে পড়ে ।জেল ওয়ার্ডারদের আচরণ নিয়ে ভাবনার স্রোত।
পরে আবার ভোজনের কথায় আসা। দই-এর প্রসঙ্গে তৃতীয় শ্রেণীর রাজবন্দীদের( নিম্নশ্রেণীর রাজবন্দী) প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের বিষয়ে ভাবনার স্রোতে ভেসে চলা, ইত্যাদি। Stream of consciousness-এর এহেন সুন্দর ব্যবহার শিল্পী সতীনাথের আঙ্গিক সচেতন মনের উৎকর্ষের পরিচয় দেয় । এরই সঙ্গে ফাঁসীর আসামী বিলুর মনের চঞ্চলতা ও গতি -প্রকৃতি ধরা পড়ে।
রক্ত -মাংসে গড়া মানুষ মাত্রেই প্রেম- ভালোবাসা থাকে । জৈবিক সত্ত্বার অধিকারী বিলুর ক্ষেত্রেও তা স্বাভাবিক। সরস্বতীর সঙ্গে নিবিড় রোমান্টিক সম্পর্ক। জ্যাঠাইমা সরস্বতী ও বিলুকে এক থালা কাটা আম দিলেন বসে খাওয়ার জন্য। পিঁড়ি পেতে দু জনে বসেছে।
সরস্বতী বলে —
“কাটা আম কি এঁর মুখে রুচবে,–ওকে আস্ত আম দেন।”( পৃষ্ঠা ৪৬)
একথা শুনে জ্যাঠাইমা সরস্বতীকে ঠাট্টা করে বলেন–‘ ওমা এরই মধ্যে এত’ বিলু গোটা আমের নিচটা ফুটো করে চুষে চুষে খায়। বোঝা যায় একে অপরকে কতটা জানে ও চেনে। বিলুর বাবা ও মা দুজনেই বিলুর সঙ্গে স্বরস্বতীর বিবাহের কথা ভাবেন ।বাবা মনে করেন-
“… সরস্বতীর সহিত বিলুর বিবাহ দিলে বেশ হইত ।দুজনেই সুখী হইতে পারিত। বেশ মেয়ে সরস্বতী।… লেনিনও তো বিবাহ করিয়াছিলেন ।….”
(পৃষ্ঠা ৭৭)
মাও মনে করেন –সরস্বতীর শহিত খাসা মানাইত। আজকালকার মধ্যবিত্ত ঘরের বাঙালি মেয়ে অপেক্ষা সরস্বতী অনেক বেশি কাজের।”( পৃষ্ঠা ৭৭)
কিন্তু শেষপর্যন্ত বিলুর মার আপত্তিতে সরস্বতীর সঙ্গে বিলুর বিয়ে হয়নি। কপিলদেও-এর বংশে কিছু গোলমাল ,অবাঙালি Culture ও বিলু রাজনৈতিক কর্মী হওয়ায় তার কারণ। অন্যদিকে বন্ধু নরেশের বিধবা ছোট্ ঠাক্ মা যৌবনের ও হিল্লোলে ও প্রাণচাঞ্চল্যে বিলুর জীবনে অনাস্বাদিতপূর্ব রোমাঞ্চকর অনুভূতি সৃষ্টি করে। চিড়িয়াখানায় ছোট্ ঠাক্ মা বাঘের ভয়ে বিলুকে জড়িয়ে ধরলে বিলুর সমস্ত শরীরে শিহরণ জাগে।
সেই মুহূর্তটিকে সামনে রেখে জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র মনে মনে কত স্বপ্ন রচনা করে। এমনকি দেশে ফেরার সময় ট্রেনে জানলার ধারে ছোট্ ঠাক্ মা বিলুর হাতের উপর হাত রেখে আস্তে আস্তে বলেছিল — “সন্ন্যাসী ঠাকুর, আমাদের ওখানে একবার যেও ।”সেই স্মৃতি বিলুর মনের মধ্যে ভাস্বর হয়ে থাকে। ফাঁসীর প্রাক্- মুহুর্তে এইসব মমতা মাখানো রোমান্টিক বিলু মানবিকতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
জীবনের রং ধূসর নয় – গাঢ় সবুজ। প্রাণবন্ত মানুষ তাই শ্যামলিমাময় প্রকৃতিরানীর হাতছানিতে বারবার ধরা দেয় । মুক্তিপিপাসু মানুষের মধ্যে প্রকৃতি -ঘনিষ্ঠতা আরও বেশি। জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বিলুর মধ্যেও জেগে ওঠে প্রকৃতিকে একান্ত রূপে কাছে পাওয়ার অনুভূতি–।
“আকাশের ঐ ফালিটুকু আমার একান্ত আপন — ও যে আমার নিজস্ব জিনিস।যতক্ষণ দেখা যায় ঐ স্বচ্ছ নীল রং দেখিয়া লইয়াছি । এমন করিয়া, আমার মত করিয়া, আকাশের ঠিক ওই অংশটুকুকে কি আর কেহ পাইয়াছে ?…”(পৃষ্ঠা ৮)
অতঃপর বিলুর অনুভূতিতে ধরা পড়ে সবুজ- নীলের সঙ্গে ধূসর রং -এর তাৎপর্য গত বৈষম্যের দিকটি–
“ওই গাছের সবুজটুকু ও আকাশের টুকরোটি ছাড়া, এখান হইতে যাহা কিছু দেখা যায়,তাহা কেবল লোহা, ইট আর সিমেন্ট –সিমেন্ট,ইট আর লোহা।উহা চক্ষুকে প্রলুব্ধ করে না– দৃষ্টিকে প্রতিহত করে মাত্র, তাহাকে ঠিকরাইয়া ফিরাইয়া দেয়।” (পৃষ্ঠা৮)
শিল্পী সতীনাথ এখানে জাগরী উপন্যাসের জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র চরিত্র এর মনস্তত্ত্বের সঙ্গে সাযুজ্য বজায় রেখে প্রকৃতি ও পরিবেশের ছবি এঁকেছেন– যেখানে রং বিশেষ ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে উঠেছে। এখানে –গাছের সবুজ ও আকাশের নীল– সতেজ প্রাণবন্ত জীবনের প্রতীক ।ধূসর সিমেন্ট ইট- লোহা– অন্ধকার মৃত্যুর প্রতীক। জীবন-মৃত্যুর প্রদীপ জ্বালিয়ে ঔপন্যাসিক এখানে ফাঁসী সেলের কয়েদী বিলুর অন্তিম জীবন পিপাসাকে বাণীরূপ দিয়েছেন।
“মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।”
__এই ভাবনাকে , স্বীকরন করে উপন্যাসের শেষের দিকে বিলু আদর্শ মানব চরিত্র থেকে মানবিক চরিত্রের দিকে যাত্রা করেছে ।এই পর্বে এসে মুক্তিপিপাসু বিলুর কন্ঠে হতাশার সুর, বুকে গভীর উদ্বেগ। অস্তিত্বের সংকটে জীর্ণ বিলু ভেবেছে–
“এখন বিলু আছে, আর কিছুক্ষণ পরে থাকিবে না ।রক্তমাংসে গড়া সুখ- দুঃখে ভরা বিলু বলিয়া কিছু নাই ;আর সরকারি স্ট্যাটিসটিকসের একটি সংখ্যা মাত্র।… আমি পূর্ণিয়া জেলের ১১০৯ নম্বর ফাঁসীর আসামী –ফাঁসীর শতকরা হার একটি দশমিক ভগ্নাংশের পরিমাণ বাড়াইয়া দিব ।…ইহাই আমার জীবনের মূল্য জাতীয় ইতিহাসে বিলুবাবুর দান।”
(পৃষ্ঠা ৫৩)’
বিলুর দ্বন্ধক্ষুব্ধ হৃদয়ের কাতরোক্তি বিজড়িত এই মন্তব্য সত্যিই হৃদয়বিদারক জীবনমুখী জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র জীবনের শেষ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ভেবেছে–
“…ইচ্ছা করে বাঁচতে, ইচ্ছা করে বাকি দুই ঘণ্টার স্বপ্নবিলাসের মধ্যে দিয়া জগতকে নিঙড়াইয়া যাহা কিছু ভোগের জিনিস আছে ,একত্র করিয়া লইতে। যদি এই শেষ মুহূর্তে আমার ফাঁসি রদ করার হুকুম আসে। এমনও তো হয়।…” (পৃষ্ঠা-৪৭)
এহেন তীব্র জীবনাকুতি বিলুকে মানবিক করে তুলেছে। হাসির কথা চিন্তা করে হত -বিহ্বল মনে মনে যন্ত্রণা অনুভব করেছে –“কী ভীষণ যন্ত্রণা হইবে তক্তা সরাইয়া লওয়ার মুহূর্তে। অসম্ভব তীব্র যন্ত্রণা।… (পৃষ্ঠা ৪৮) মৃত্যুর ভয় –মৃত্যুকালীন যন্ত্রণার ভয় বিলুর দেহ -মনকে অবশ-অসাড় করে তোলে ।জীবন-মৃত্যুর এই টানাপোড়েনের সময় তার নীলুর কথা মনে পড়েছে। নীলুর প্রতি তীব্র ঘৃণায় বিলু ভেবেছে–
“… দাদা বলিতে অজ্ঞান নিলু– সে কিনা আমার সঙ্গে এই ব্যবহার করিল ।…এত ঘৃৃন্য পরিবর্তন হইয়াছে তাহার মনের! ছি !”(পৃষ্ঠা ৫০)
এ ভাবনা স্বাভাবিক। কিন্তু সতীনাথের জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র পরক্ষনেই যখন ভাবে–
“নিলু আসিয়াছে তাহার দাদার সহিত সাক্ষাৎ করিতে তাহার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক পার্টির স্থানীয় নেতা বিলুবাবুর সহিত নয় ।কি ভাগ্য যে সেদিন তাহার সম্মুখে আমার মানসিক দ্বন্দ্বের আভাস ফুটিয়া উঠে নাই।…”( পৃষ্ঠা ৫১)
তখন পাঠক কিছুটা আহত হয়। কেননা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র কি করে নীলুর সামনে নিরুদ্বেগে ও নির্লিপ্তভাবে দাদার মতো আচরণ করল ?কেন নীলুর কৃতকর্মের কথা তার মুখের উপর সাপটে ছুঁড়ে মারলো না ?রক্তমাংসে গড়া মানুষের পক্ষে এতটা উদার হওয়া কি সম্ভব ? নাকি বিলুর এই মহত্ব নীলুকে ছোট করার জন্য ?–এসব প্রশ্ন সঙ্গত ও স্বাভাবিক অনেক সমালোচকও এ বিষয়ে সহমত পোষণ করেন ।বিষয়টি মে সত্যিই ন্যায়সঙ্গত তার প্রমাণ পায় বিলুর অন্তিম কথায়–
“জ্যাঠাইমা! সরস্বতী! মা! নীলু !নীলু তুই একি করলি ?একটি লোহার Horizontal bar- এ, আমার আসার মৃতদেহটি ঝুলিতেছে।…”( পৃষ্ঠা -৫৩)
পরিশেষে জাগরী উপন্যাসের বিলু চরিত্র সৃষ্টির মূলে ঔপন্যাসিক সতীনাথের মধ্যবিত্ত ঘরোয়াপরিবারে বেড়ে ওঠা; উদাসীন বাবার অভাব পূরণে মা-এর( রাজবালা )উপর অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়া ;পুরুলিয়ার নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্তের পুত্র বিভূতি দাশগুপ্তের কথা স্মরণে রাখা; অন্তর্মুখী ও কৃচ্ছসাধনেরআদর্শকে বরণ করে নেওয়া; ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া; খোকা ডাক্তারের মা কুসুমকুমারী দেবী- কে ‘মা ‘ বলে ডাকা ইত্যাদি ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতাঋব্ধ ঘটনাসমূহের কথা বিশেষভাবে স্মরণে রাখতে হয় .
===={{{======={{{{{{======{{{{{{{===
No comments:
Post a Comment