অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়
অজিতেশের শিল্পীসত্তার বিস্তার ছিল বটবৃক্ষের মতো। ফলে কোনও একটা শিল্পমাধ্যমে তিনি নিজের প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটাবেন, এমনটা কিছুতেই সম্ভব হত না। ষাটের দশক নাগাদই সিনেমায় কাজ করা শুরু করে দিয়েছিলেন অজিতেশ। প্রায় পঞ্চাশটা ছবিতে কাজ করে ফেলেছিলেন তিনি, যার মধ্যে হিন্দি ছবির সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ‘কুহেলী’র সত্যভূষণ বা ‘হাটে বাজারে’র লছমনলালকে কে ভুলতে পারে? তরুণ মজুমদার যখন তারাশঙ্করের উপন্যাস থেকে পর্দার জন্য ‘গণদেবতা’ করেন, অজিতেশ তো সেখানেও থাকেন! আবার থিয়েটারের চ্যালেঞ্জ এবং সিনেমার গ্ল্যামারের মাঝে মুখ লুকনো যাত্রাতেও অবাধ বিচরণ করেছেন তিনি। কিন্তু বন্ধুর ছবি করা বা যাত্রা করা নিয়ে রুদ্রপ্রসাদ কী ভাবেন? ‘‘অজিতেশ তখন সদ্য দ্বিতীয় সংসার শুরু করেছে, নানা কারণে ওর টাকার দরকার। ফলে সিনেমা করছে, যাত্রা করছে, থিয়েটারটাও করছে। "
‘উ বুড়ার কথা বাদ দেন, ডাক্তারবাবু। উ ঠিক করেছে, আমাকে দিয়ে কাজ করাবেকই। আর আমিও ঠিক করেছি শালা কাজ করিবক নাই। ঘরে যখন এতগুলান পয়সা আছে, তখন লতুন করে আর পয়সা করার দরকার কী, আপনিই বলুন। আমি বাবা দুনিয়া ভোগ কইরতে এসেছি। যদ্দিন বাঁইচব, ভোগ করি যাব, বুঝলেন। উ ত্যাগ-ট্যাগ আপনার সাধু-সন্নিসিরা করুক। সবাই যদি দুনিয়ায় সাধু-সন্নিসি হবেক, তবে দুনিয়াটা বাঁইচবেক কীকরে, বলুন তো! একী, আপনি হুইস্কি খেইলেন না যে বড়!’
পশ্চিমের একটা ছোট্ট পাহাড়ি গঞ্জের স্থানীয় জমিদার ছবিলালের ছেলে লছমনলাল এই কথাগুলো বলছে গঞ্জের মানুষ যাঁকে ভগবান মানে, সেই ডাক্তার অনাদি মুখার্জিকে। ডাক্তারবাবু মদ খান না শুনে তার ব্যঙ্গোক্তি ঠিকরে আসে-‘সবাই শালা সতী রে!’ তারপরেই উচ্চৈঃস্বর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ার পালিশ করা মাস্তানি। জ্বলন্ত চোখ, সঙ্গে এমন চেবানো ডায়লগ থ্রোয়িংয়ের কাল্ট ক্যারেক্টারাইজেশন। সহকর্মীরা কি আর সাধে বলতেন, অজিতেশ চরিত্রে পুরোপুরি নিমজ্জিত হয়ে যান!
শোনা যায়, ছাত্রদের উপর যাতে খারাপ প্রভাব না পড়ে, তাই লছমনলাল চরিত্রটি করার জন্য সাউথ পয়েন্ট স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার দর্শক তাঁকে মনে রেখে দেবে নাট্যজগতের সংগ্রামী সম্রাট রূপে। নাটকের আঙিনায় তাঁর কর্মকাণ্ড সেই স্মৃতিরক্ষার ক্ষেত্রে অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। গণনাট্য সংঘের সঙ্গে মতবিরোধে দল ছেড়ে এড়িয়ে আসা, তারপর ‘নান্দীকার’, সেখানেও কয়েক বছরের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের ছেড়ে চলে যাওয়া, আবার নতুন করে গড়ে তোলা, তারপর আবার ভাঙন, আবার নতুন এক দল প্রতিষ্ঠা, এইভাবেই তো চলেছিল তাঁর কর্মজীবন।
১৯৫৮ তে গণনাট্যে যুক্ত থাকাকালীন ‘চার অধ্যায়’-এর নাট্যরূপ দিতে চাওয়া বছর পঁচিশের তরুণটিকে হতাশ হতে হয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিক মতাদর্শের সীমাবদ্ধতায়। রক্ষণশীল সাম্যবাদীরা তখনও বিশ্বাস করতেন, রবীন্দ্রনাথ প্রতিক্রিয়াশীল। ‘চার অধ্যায়’-এ সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে যে দূরদর্শিতা রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছিলেন, তা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চোখ তৈরি হয়নি তাঁদের। গণনাট্য সংঘ থেকে শীঘ্রই বেরিয়ে এসেছিলেন অজিতেশ। তারপর ১৯৬০-এ অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন মিত্র, অজয় গঙ্গোপাধ্যায়, মহেশ সিংহ, রাধারমণ তপাদার, চিন্ময় রায়দের নিয়ে ‘নান্দীকার’। পরের বছর যোগ দিলেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। অজিতেশের সঙ্গে রুদ্রপ্রসাদের বন্ধুত্ব সেই মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজের কমন রুম থেকে। সেই বন্ধুত্ব গড়িয়েছিল একসঙ্গে ঘরভাড়া নেওয়া অবধি।
রুদ্রপ্রসাদকে খোকন বলে ডাকতেন অজিতেশ। পড়াশোনার তুখোড় খোকন তখন স্কটিশচার্চে উচ্চশিক্ষা করছেন। এক বন্ধুর সঙ্গে নোবেলজয়ী ইতালিয়ান নাট্যকার লুইগি পিরানদেল্লোর ‘সিক্স ক্যারেক্টার্স ইন সার্চ অফ অ্যান অথর’-এর বঙ্গীয়করণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্চস্থ করার সুযোগ পাননি। অজিতেশ সেই চিত্রনাট্য পড়েছিলেন সারারাত ধরে। ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র’ নান্দীকারকে যে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল, তারপর আর জনপ্রিয়তা নিয়ে তেমন পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁদের। কিন্তু পিরানদেল্লোর ফ্যাসিস্ট-সংযোগ তৎকালীন বঙ্গের বামধর্মী আবহাওয়ায় উস্কে দিয়েছিল বিতর্কও। স্বয়ং উৎপল দত্ত নাটকটিকে বয়কট করেছিলেন। কিন্তু সেই বিতর্কই উল্টে দর্শককে প্রেক্ষাগৃহে আকৃষ্ট করে। সিনেমা হলের সামনে মানুষের মধ্যে লিফলেট বিলি করতেন অজিতেশ ও অসিত। আর তার পরের নাটক ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’ (আন্তন চেখভের ‘চেরি অর্চার্ড’-এর বাংলা নাট্যরূপ) তো নান্দীকারকে বাংলা নাট্যজগতে বিদেশি নাটকের বঙ্গীয়করণের ক্ষেত্রে সুউচ্চ আসন দিয়েছিল। নিন্দুকদের অভিযোগও ছিল, নান্দীকার কেবল বিদেশ-নির্ভর নাটক ছাড়া করতে পারে না। অজিতেশের সাফ বক্তব্য-‘বিদেশ থেকে নেওয়া এই নাট্য-অভিজ্ঞতাগুলি আমাদের নাট্যজগতে নতুন কোনও বোধের দিকে নতুন কোনও পরীক্ষার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না কি? নিছক অনুবাদেই থমকে না থেকে যদি তাকে মিলিয়ে দেওয়া যায় নিজেদেরই প্রতিবেশীর মধ্যে?’
না, যাত্রার ধারা অজিতেশ বদলাতে পারেননি। তাঁকে নিজেকেই সরে আসতে হয়েছিল যাত্রার পৃথিবী থেকে। কিন্তু তাঁর আপসহীন ব্যক্তিত্বের সার্থক পরিস্ফুটন এই ঘটনায় অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তবে এক্ষেত্রে হয়ত বলতে হবে তাঁর লেখাদের কথাও। যে মানুষের কলম থেকে উদ্ধত চাবুক বেরিয়ে আসে - ‘দেশের প্রায় সবাই এখন সাদাপোশাকে ঘুরছে/লাথি খেয়ে বলছে/তবু তো প্রাণটা রক্ষে পাচ্ছে/ধীরে ধীরে এ লাথিও অভ্যাস হয়ে যাবে।’, আবার সেই তিনিই লিখে ফেলেন - ‘রেল লাইনের প্রত্যেকটি পাথর আমার শৈশব।/কোনটা সেজকাকার বকুনি, কোনটা বা রমার চোখ/কোনটা মায়ের কড়ি আঙুল, বন্ধুর মুখ থেকে শোনা/প্রথম অশ্লীল শব্দ বা।’ আসলে, দীর্ঘদেহী মানুষটির ব্যক্তিত্বের বিশালত্ব তাঁকে কখনও থেমে যেতে শেখায়নি।
১৯৮৩-র ১৪ই অক্টোবরের মধ্যরাত। দুর্গাষ্টমীর উৎসবমুখর কলকাতা। সপ্তমীর সন্ধেয় সুজাতা সদনে ‘এই অরণ্যে’-র দুটো শো করে বাড়ি ফিরে নৈশভোজ সেরেছিলেন। বুকের যন্ত্রণার পর কয়েকটা মিনিট। অকালবোধনের অষ্টমীর রাত বড় অকালেই যেন টেনে নিয়েছিল সদ্য পঞ্চাশ-অতিক্রান্ত তাঁকে। ওই বোধহয় একবারই থেমেছিলেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।
"আসলে আমরা সকলেই কিলার। আমরা সকলেই সকলকে খুন করি। কিন্তু এটুকুই বলার, যে হি ওয়াজ় আ জায়ান্ট অ্যামং আস!’’
যার ছায়াটা হয়তো সরে যায়, ছোট হয় না!" (রুদ্রপ্রসাদ )
১৩ অক্টোবর, ১৯৮৩ সালে কলকাতায় আকস্মিকভাবে মারাা যান।
===========∆∆∆∆∆=========
No comments:
Post a Comment