Friday, 17 September 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। জগদানন্দ রায়। ১৮.০৯.২০২১. vol -499. The blogger in literature e-magazine.


জগদানন্দ রায়।

বিজ্ঞান কল্পকাহিনী, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী বা কল্পবিজ্ঞান আধুনিক কল্পসাহিত্যের একটি বিশেষ শাখা বা শ্রেণী, যাতে ভবিষ্যৎ বৈজ্ঞানিক বা প্রযুক্তিগত আবিষ্কার ও উদ্ভাবন এবং মানব সভ্যতাকে কেন্দ্র করে পটভূমি রচনা করা হয়। মানব সভ্যতা মধ্যযুগে থেকে আধুনিক যুগে প্রবেশের সময় যে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সৃষ্টি হয় তার অনিবার্য ফসল ছিল বিজ্ঞান কল্পকাহিনী। ইংরেজিতে একে “সাইন্স ফিকশন” বলা হয়। বাংলা ভাষায় প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখা শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে। বাংলা বিজ্ঞান কল্পকাহিনী সাহিত্যের অগ্রদূত বলা যায় জগদানন্দ রায়কে; তিনি শুক্র ভ্রমণ নামক একটি জনপ্রিয় বই লিখেছিলেন। অন্যান্য লেখকদের মধ্যে লীলা মজুমদার, ক্ষিতীন্দ্রনারায়ন ভট্টাচার্য, প্রেমেন্দ্র মিত্রসত্যজিত রায়অদ্রীশ বর্ধনসিদ্ধার্থ ঘোষ-এর নাম প্রাসঙ্গিক। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুও একটি কল্পবিজ্ঞান গল্প লিখেছেন পলাতক তুফান নামে।

একজন বাঙালি বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক। তিনি শুক্র ভ্রমণ নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এই বিজ্ঞান কল্পকাহিনীমূলক গ্রন্থ রচনার জন্যই মূলত তাকে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান কল্পকাহিনীমূলক সাহিত্য চর্চার অগ্রদূত হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।

 জগদানন্দ ১৮ই সেপ্টেম্বর ১৮৬৯ জন্মগ্রহণ করেন নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের একটি অভিজাত ও অবস্থাপন্ন পরিবারে। তার পড়াশোনা শুরু হয় একটি স্থানীয় মিশনারি স্কুলে। তখন থেকেই তার মধ্যে বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন মজার বিষয়ে লেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। এই আগ্রহের কারণে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশেষ দৃষ্টিতে পড়ে যান। ঠাকুর তখন সন্ধ্যা পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। রবী ঠাকুর তার লেখায় বিশেষ আগ্রহ বোধ করেন। জগদানন্দ যখন নিদারুণ ক্লেশের মধ্যে দিনাতিপাত করছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথ তাকে নিজের ভূ-সম্পত্তিতে একটি চাকরি জোগাড় করে দেন।ঠাকুর জানতেন যে চাকরিটি জগদানন্দের যোগ্যতাকে খাটো করে দেখা বই অন্য কিছু নয়। এ কারণে তিনি রায়কে নিজের ছেলেমেয়ের পড়াশোনার ভার দিয়েছিলেন। পরবর্তিতে যখন ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন তখন তিনি জগদানন্দকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন একজন শিক্ষক হিসেবে। তিনি সেই স্কুলের প্রথম সর্বাধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৩২ সালে অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত তিনি নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক হিসেবে কাজ করে গেছেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে গণিত শিক্ষাদান শুরু করে জীবন কাটেন।

বিজ্ঞান জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে তিনি বেশ কিছু বই লিখেছিলেন। বৈজ্ঞানিক সত্যকে সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরার তাগিদেই তিনি লিখা শুরু করেন আর লেখার আদল ছিল অনেকটা রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মত। এছাড়া বিজ্ঞান কল্পকাহিনী রচনাও শুরু করেন। তার শুক্র ভ্রমণ নামক গ্রন্থের বিষয় ছিল অন্য গ্রহে মানুষের ভ্রমণ কাহিনী। মানুষ অন্য গ্রহে যাতায়াতের মাধ্যমে ইউরেনাস গ্রহে ভিনগ্রহী জীবের সাক্ষাৎ লাভ করে। সেই ভিনগ্রহী জীবের বিবর্তনের সাথে আধুনিক বিবর্তনবাদী তত্ত্বের আশ্চর্য মিল লক্ষ্য করা যায়। ভিনগ্রহী জীবের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি যেসব বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন তা হল: তারা অনেকটা আমাদের পূর্বপুরুষ বানরদের প্রতিনিধিত্ব করে। তাদের শরীর ঘন কালো পশমে ঢাকা, শরীরের তুলনায় মাথা অস্বাভাবিক রকমের মোটা, লম্বা লম্বা নখ রয়েছে এবং তারা সম্পূর্ণ নগ্ন। তার এই বর্ণনা প্রকাশিত হয় এইচ জি ওয়েল্‌সের বিখ্যাত বিজ্ঞান কল্পকাহিনী দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস প্রকাশিত হওয়ারও আগে। এই বইয়েও এইচ জি ওয়েল্‌স মঙ্গল গ্রহে ভিনগ্রহী জীবের বর্ণনা দিয়েছিলেন।

রচনাবলী

  • প্রকৃতি পরিচয় (১৩১৮ )
  • আচার্য জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার (১৩১৯)
  • বৈজ্ঞানিকী (১৩২০ )
  • প্রাকৃতিকী ( ১৩২১ )
  • জ্ঞানসোপান (১৩২১)
  • গ্রহণক্ষত্র ( ১৩২২ )
  • বিচিত্র সন্দর্ভ( ১৩২৪ )
  • সাহিত্য সন্দর্ভ ( ১৩২৪ )
  • সুকুমার পাঠ (১৩২৫ )
  • কনক পাঠ ( ১৩২৫ )
  • চয়ন (১৩২৬ )
  • পোকামাকড় (১৩২৬)
  • বিজ্ঞানের গল্প (১৩২৭)
  • গাছপালা (১৩২৮)
  • সাহিত্য সোপান (১৩২৯)
  • আদর্শ স্বাস্থ্যপাঠ (১৩৩০)
  • আদর্শ কাহিনী ( ১৩৩০)
  • মাছ,ব্যঙ,সাপ (১৩৩০)
  • বাংলার পাখী (১৩৩১)
  • শব্দ (১৩৩১)
  • পাখী (১৩৩১ )
  • বিজ্ঞান-প্রবেশ (১৩৩২)
  • বিজ্ঞান-পরিচয় (১৩৩২)
  • আলো (১৩৩৩)
  • গদ্য ও পদ্য (১৩৩৩)
  • সাহিত্য সৌরভ (১৩৩৩)
  • সঞ্চয়ন (১৩৩৩)
  • বিজ্ঞান-প্রকাশ (১৩৩৩ )
  • স্থির বিদ্যুৎ (১৩৩৫)
  • চুম্বক (১৩৩৫)
  • তাপ (এলাহাবাদ, ১৩৩৫)
  • চল বিদ্যুৎ (১৩৩৬)
  • পর্যবেক্ষণ শিক্ষা (১৩৩৮)
  • নক্ষত্র চেনা ( ১৯৩১)


জগদানন্দ শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন শান্তিনিকেতনশিশুসাথী পত্রিকার সম্পাদকের ভূমিকা পালন করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। শুধুমাত্র শ্রমিকদের নয় তিনি বোলপুর সংলগ্ন ওই অঞ্চলের মানুষের নানান সমস্যায় সু পরামর্শ প্রদান করতেন।  গল্প লিখে তিনি কুন্তলীন পুরস্কার পেয়েছেন। 1925 সালে ইংরেজ সরকার তাকে রায়সাহেব উপাধি প্রদান করেন । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক তাঁকে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান এর পরীক্ষক নিযুক্ত করেছিলেন বাংলা ইতিহাসে বিরল সম্মাননা।  নৈহাটি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করেন জগদানন্দ রায়।
1 910 সালে ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয় এর অধ্যক্ষ  নিয়োজিত হন জগদানন্দ রায়। এই প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র একজন শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন না তিনি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক উপদেষ্টার কাজ করতেন। জগদানন্দ 1 921 সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত হলে তিনি সেখানকার সচিব পদ অলংকৃত করেছেন । শেষ জীবনে বোলপুর ইউনিয়ন বোর্ডের সদস্য এবং বোলপুর ইউনিয়নের তদারকি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন তিনি বিজ্ঞানের কাঠিন্যকে সহজ সরল ভাষায় লিখে প্রকাশ করতেন তিনি ভারতী, তত্ত্ববোধিনী ,ভারতবর্ষ, সাধনা পত্রিকা।


         মৃত্যু -  ২৫শে জুন ১৯৩৩ শান্তিনিকেতনে।



উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। 

শুক্র-ভ্রমণ

বাল্যকাল হইতে বিজ্ঞান-চর্চ্চায় আমার বড় আমোদ, এজন্য বহু চেষ্টায় কতকগুলি বিজ্ঞানগ্রন্থ এবং পুরাতন-দ্রব্য-বিক্রেতার দোকান হইতে দুই চারিটি জীর্ণ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রও সংগ্রহ করিয়াছিলাম। একটি ভগ্ন-পরকলা দাগী হাত-দূরবীণ, একটি ক্ষুদ্র আনিরয়েড্ ব্যারোমিটার্ এবং দুইটি ছোট বড় তাপমানযন্ত্র আমার বৈজ্ঞানিক গবেষণার অবলম্বন ছিল; এতদ্ব্যতীত একটি তন্ত্রিহীন বৈদ্যুতিক ঘন্টা, কয়েকটি কাচের নল, একটি সচ্ছিদ্র ইন্‌কান্‌ডেসাণ্ট বৈদ্যুতিক দীপ, একটি বুন্‌সেনের সেল্ এবং কয়েক হাত রেশমমোড়া তার ইত্যাদিও সংগ্রহ ছিল। আামার একটি বিজ্ঞানানুরাগী বন্ধুর সাহায্যে, দূরবীক্ষণটি মেরামতের জন্য পিন্ ঠুকিয়া এবং বৈদ্যুতিক দীপটি জ্বালাইবার জন্য নানা উপায় উদ্ভাবন করিয়া অবকাশ কাল বেশ সুখে অতিবাহিত হইত। এখন সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার পর সম্মুখে সুদীর্ঘ অবকাশ। এই সুদীর্ঘ দিন ক্ষেপণের জন্য পূর্ব্বোক্ত প্রকার একটা ব্যবস্থা করিতে ইচ্ছা হইল, কিন্তু বিজ্ঞানচর্চ্চায় আমার পূর্ব্বোক্ত বন্ধুর সাহায্য পাইব না, মনে পড়ায় সময়ক্ষেপণের কল্পিত উপায়টি যে বিশেষ সুখপ্রদ হইবে তাহা বড় আশা করিতে পারিলাম না।

 আমাদের বিজ্ঞানানুশীলন-কালে, বন্ধুবর এক অভিনব উপায়ে নৌকাচালনের যন্ত্র আবিষ্কার করিয়াছেন বলিয়া প্রচার করিয়াছিলেন, যন্ত্রটি পেটেন্ট করিবার আশায় ও বন্ধুগণের উত্তেজনায় একখানি নৌকা ও তদানুষঙ্গিক কল ইত্যাদিও বহুব্যয়ে নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ, কলসাহায্যে চালানো দূরের কথা, রজ্জুদ্বারা সাধারণ উপায়ে চালাইতে গিয়াও, তরীখানি নাকি, উল্‌টাইয়া বিপরীতভাবে চলিতে আরম্ভ করিয়াছিল। এই আবিষ্কার-বিভ্রাটের সমস্ত দোষ কাষ্ঠসংযোজক মূর্খ সূত্রধারের হইলেও, সেই দিন হইতে বন্ধুবরের উৎসাহের মাত্রাটা অধোগামী হইতে দেখা গিয়াছিল। এই ঘটনার কিছু দিন পরে, রাসায়নিক পরীক্ষাসময়ে, এক দিন আর একটা গুরুতর বিভ্রাটের ফলে, কিছুদিন বিজ্ঞানালোচনায় যোগদানে অসমর্থ হওয়ায়, বন্ধুবরের বিজ্ঞানানুরাগ এক কালে অন্তর্হিত হইয়াছিল। সেই সময় হইতে বহুচেষ্টাতেও বন্ধুকে আর বৈজ্ঞানিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করাইতে পারি নাই, কিন্তু সর্ব্বপ্রকার কথোপকথন কালে গম্ভীরভাবে দুই একটা বৈজ্ঞানিক বুখ্‌নি দেওয়া স্বভাবটা তাঁহার পূর্বব্বৎ ছিল—তাঁহার আকর্ণবিস্তৃত গুম্ফরাজিশোভিত চস্‌মাবৃত মুখমণ্ডল দেখিয়া, তিনি যে ভবিষ্যতে একজন উচ্চদরের লোক হইবেন, তাহাতে বড় কেহ সন্দেহ করিতে পারিত না।

 বীতরাগী বন্ধুকে পুনরায় বিজ্ঞানালোচনায় প্রবৃত্ত করা দুরাশা জানিয়াও একদিন প্রাতে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম; যাহা দেখা গেল তাহাতে আমার উদ্দেশ্য-সিদ্ধিপক্ষে আরো সন্দেহ উপস্থিত হইল। সেদিন রবিবার, বন্ধুর আফিস বন্ধ—তাঁহার সেই ক্ষুদ্র সজ্জিত ঘরে, মেজের এক প্রান্ত অধিকার করিয়া কি লিখিতেছিলেন। আমাকে আসিতে দেখিয়াই তিনি স্মিতমুখে চেয়ার টানিয়া বসিতে বলিলেন। তাঁহার লিখিত বিষয়ের কথা জিজ্ঞাসা করিবার পূর্ব্বেই তিনি বলিলেন, “আজ কাল মাসিক পত্রাদিতে, বেশ ছোট ছোট গল্প দেখিয়া, একটা গল্প লিখ্‌তে চেষ্টা কর্‌ছিলুম, গল্পটা প্রায় লেখা শেষ হয়েছে, এখন শেষ মিলাতে গিয়ে বড় গোলযোগ হয়েছে।” বন্ধুর এই অস্বাভাবিক পরিবর্ত্তন ও অবৈজ্ঞানিক ব্যবহার দেখিয়া বড় বিস্মিত হইলাম; আমার জানা ছিল বৈজ্ঞানিকগণের কাব্যপ্রিয় হওয়া একটি ভয়ানক ফ্যাসান-বিরুদ্ধ কার্য্য, ঘোর ফ্যাসানানুরাগী বন্ধুর পূর্ব্বব্যবহার দ্বারা এ বিশ্বাস দৃঢ়ীভূত ছিল, কিন্তু তাঁহাকেই কাব্যসেবী দেখিয়া বিস্ময়ের সীমা রহিল না। তাঁহার পাঠগৃহের মেজের উপর যে বড় বড় বৈজ্ঞানিক পুস্তকরাশি সজ্জিত ছিল, এখন দেখিলাম তাহার সকলগুলিই আল্‌মারীবদ্ধ হইয়াছে; সেক্‌স্‌পীয়র, সেলী, টেনিসন, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্কিমের চক্‌চকে বাঁধানো পুস্তক টেবিল অধিকার করিয়াছে। বন্ধুবর সাগ্রহে তাঁহার লিখিত গল্পটি পড়িয়া শুনাইলেন। গল্পটির কথা এখান কিছুই মনে নাই, কিন্তু আমার স্মৃতিশক্তি নিতান্ত নিস্তেজ নয়, বোধ হয় বন্ধুর হঠাৎ পরিবর্ত্তন দেখিয়া তাঁহার সরস গল্পটির উপর মনঃসংযোগের অবসর পাই নাই; তবে গল্পপাঠান্তে শেষ মিলানো সম্বন্ধে আমার পরামর্শ চাহিলে, এটাকে ট্রাজিক্ করা ভাল বলিয়া যে একটা বড় “বেখাপ” উত্তর দিয়াছিলাম, তাহা বেশ মনে আছে, এবং বন্ধুবর এই উত্তর শুনিয়া তাঁহার পরামর্শদাতাকে নিতান্ত কাব্যরস-বর্জ্জিত ঠাহরাইয়া, যে দুই একটি সরস বাক্য প্রয়োগ করিয়াছিলেন, তাহাও ভুলি নাই। যাহা হউক, এই অবস্থার নবকাব্যানুরাগী বন্ধুকে বিজ্ঞানালোচনায় পুনঃপ্রবৃত্ত করা বড় সহজ হইবে না ভাবিয়া ভগ্ন-মনোরথ হইলাম; তবু মনোগত প্রকৃত ভাবটা আয়ত্ত করিবার ইচ্ছায়, তাঁর আফিসের কথা তুলিয়া শীঘ্রই একটা পাকা চাকুরী পাইবার সম্ভাবনা, বড় সাহেবের হঠাৎ বদ্‌লির কারণ ইত্যাদি পাড়িয়া এডিসনের নূতন ফোনোগ্রাফ-যন্ত্রের কথা উপস্থিত করিলাম। আমি ভাবিয়াছিলাম, বৈজ্ঞানিক প্রসঙ্গ উত্থাপিত হইলেই বন্ধুবর নিরুত্তর হইবেন, কিন্তু এ প্রসঙ্গেও তাঁহার বাক্যস্রোত পূর্ব্ববৎ সমান খরবেগে প্রবাহিত হইতে লাগিল, এবং এডিসনের যন্ত্র সর্ব্বাঙ্গসুন্দর হইতে যে এখনও অনেক গবেষণা ও চিন্তার আবশ্যক, তাঁহার স্বভাবসুলভ কল্পনা-সাহায্যে দুই একটি নূতন উদাহরণ দ্বারা তাহা বেশ বুঝাইতে লাগিলেন। সে যাহাই হউক, বৈজ্ঞানিক কথোপকথনে সোৎসাহে যোগ দিতে দেখিয়া, বন্ধুর মতি-পরিবর্ত্তনের ইহাই উপযুক্ত অবসর বুঝিয়া, ফোনোগ্রাফের কথা ও পারিস-পরিদর্শনীর ইফেল্ টাওয়ারের নির্ম্মাণ-কৌশলাদির বিবরণ শেষ হইলে আমার নিজের কথাটা উপস্থিত করিলাম। পুনরায় বিজ্ঞানালোচনায় যোগ দিতে হইবে শুনিয়া বন্ধু, বাঙ্গালীজাতির সর্ব্বাঙ্গীণ দুর্ব্বলতা ও ‘ওরিজিনালিটি’র হীনতা-সম্বন্ধে নানা কথার উত্থাপন করিলেন, পরে বহুমূল্য যন্ত্রাদির সাহায্য না লইয়া দরিদ্র বঙ্গসন্তানদিগের বিজ্ঞান-আলোচনার প্রয়াসটা যে, পূর্ণ বাতুলতা তাহাও বলিলেন; কিন্তু চক্ষু বুঁজিয়া নিশিদিন আজ্‌গবি চিন্তা আহ্বান করা অপেক্ষা এ পাগ্‌লামি কতক ভাল বলিয়া পীড়াপীড়ি করায়, বন্ধু অবশেষে আমার প্রস্তাবে স্বীকৃত হইলেন। কিন্তু অল্পদিন হইল হঠাৎ মাথার পীড়া উপস্থিত হওয়ায়, ডাক্তারেরা তাঁহাকে কিছুদিনের জন্য গভীর চিন্তা এককালে ত্যাগ করিতে উপদেশ দিয়াছেন—এজন্য যন্ত্রাদি লইয়া পরীক্ষা বা গবেষণাসাপেক্ষ প্রাক্‌টিকাল্ কার্য্য যে, তাঁহার দ্বারা আপাততঃ হইবে না, সে কথাও বন্ধু বলিয়া রাখিলেন। অনন্যোপায় হইয়া, কয়েকখানি নূতন বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ নির্দ্দিষ্ট করিয়া উভয়ে মিলিয়া তাহাই আলোচনা করিবার মনঃস্থ করিলাম।

 ইহার পর দুই দিনে, আমরা নির্দ্দিষ্ট পুস্তকগুলি পড়িয়া বেশ সময় ক্ষেপণ করিয়াছি। তৃতীয় দিবসে বন্ধুর আগমন প্রতীক্ষা করিতেছি এবং তিনি আপিসে গিয়াছেন কি না ভাবিতেছি, কারণ বিনা বেতনে আপ্রেন্টীসের কাজটা, গবর্ণমেন্টের উপর তাঁহার অনুগ্রহপ্রদর্শন বলিয়া ভাবিতেন, এবং সপ্তাহে ছয় দিনই যে তিনি অনুগ্রহ প্রকাশে বাধ্য, তাহা ন্যায়ানুগত বিবেচনা করিতেন না। যাহা হউক এমন সময়ে একখানি ছোট পুস্তক হস্তে বন্ধু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বন্ধু-আনীত পুস্তকখানি, জনৈক বিখ্যাত ইংরাজ-জ্যোতির্ব্বিদের রচনা—অবশ্য ইহাতে গ্রহ-উপগ্রহসম্বন্ধে অনেক নূতন জ্ঞাতব্য বিষয় আছে ভাবিয়া, সে দিন ঐ পুস্তকখানি পাঠের ব্যবস্থা করা গেল। বন্ধু পুস্তকখানির দুই চারি পাতা উল্‌টাইয়া শুক্রগ্রহের বিবরণ পড়িতে লাগিলেন। সে দিন বড় গরম; শুক্রগ্রহের বিবরণপাঠ সমাপ্ত হইলে, অপর এক নূতন বিষয় পাঠারম্ভে বড় ইচ্ছা হইল না; বন্ধুও সে দিন দুই একটি হাঁই তুলিয়া পার্শ্বের ইজিচেয়ারখানির আশ্রয়ে শুইয়া, পুস্তকের পাতাগুলি ঘন ঘন উল্‌টাইতে লাগিলেন এবং অবশেষে বন্ধ করিয়া রাখিয়া দিলেন—উভয়ের সম্মতিক্রমে সে দিন আর অধিক পড়া হইল না। বন্ধু ইজিচেয়ারে অর্দ্ধশায়িত অবস্থায় বসিয়া শুক্রগ্রহ-সম্বন্ধে নানা কথা বলিতে লাগিলেন—এবং গ্রহটি আমাদের পৃথিবীর ন্যায় জীববাসোপযোগী বলিয়া যে একটা কথা উঠিয়াছে, সে বিষয়েও তাঁহার মত প্রকাশ করিতে লাগিলেন, আমি চক্ষু মুদ্রিত করিয়া বন্ধুর কথা শুনিতে লাগিলাম।

 এই অবস্থার কত পরে মনে নাই, বোধ হইল যেন আমি বন্ধু-কথিত শুক্রগ্রহের অন্ধকার ভাগে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। রাত্রি দ্বিপ্রহরে পৃথিবীর জনহীন সুপ্ত প্রান্তর যে প্রকার শান্ত ও গম্ভীর দেখিয়াছি, ইহাও সেই প্রকার গাম্ভীর্য্য-পূর্ণ বলিয়া বোধ হইল। এই সময়ে একটা কথা মনে পড়িল—চন্দ্রের যেমন একাংশ সর্ব্বদাই আলোকিত ও অপরাংশ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে, শুনিয়াছি শুক্রগ্রহেরও সেই প্রকার একই অংশ চিরতামসাবৃত থাকে—এই অংশ কখন সূর্য্যালোকে আলোকিত হয় নাই, এবং হইবারও আশ নাই ভাবিয়া, রাত্রের নিস্তব্ধতা যেন দ্বিগুণ বলিয়া বোধ হইল। পৃথিবীর রাত্রির ন্যায়, এই চিরনিশাময় গ্রহের অন্ধকার, অতি নিবিড় নয়, আকাশে ভাসমান অনন্ত নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে অনেকগুলিই অত্যন্ত দীপ্তিসম্পন্ন দেখাইল। আকাশে দৃষ্টিনিক্ষেপ-কালে একটি বৃহৎ জ্যোতিষ্ক সহসা আমার নয়নগোচর হইল, ইহার নিকটে আর একটি ক্ষুদ্র নক্ষত্র দেখিলাম—এই জ্যোতিষ্কযুগল দেখিয়াই, ইহারা আমার চির-পরিচিত আবাসভূমি পৃথিবী ও তাহার উপগ্রহ চন্দ্র বলিয়া স্থির করিলাম, এবং আমাদের ধন-জন-পূর্ণ পৃথিবী, অনন্ত আকাশ ও অনন্ত সৃষ্টির তুলনায় কত ক্ষুদ্রতম পদার্থ তাই কল্পনা করিয়া বিস্ময়পূর্ণ হইতে লাগিলাম।

 আকাশে পৃথিবীর উচ্চতা এবং ইহার অবস্থানাদি দেখিয়া, গ্রহের কোন্ অংশে আমি উপস্থিত হইয়াছি, মনে মনে তাহার একটা স্থূল হিসাব করিলাম—দেখিলাম, ইহার অনালোকিত ভাগের পূর্ব্বাংশে প্রায় বিষুবরেখার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি, এস্থান হইতে আলোকিতাংশের ব্যবধান প্রায় ছয় শত ক্রোশ হইবে। শুক্রে উপস্থিত হইবামাত্র পরিচ্ছন্ন আকাশে নানা নূতন দৃশ্য দেখিয়া, গ্রহের উপরিস্থ কোন বিষয়ে মনঃসংযোগ করিতে পারি নাই, কিন্তু শীঘ্র এত অধিক শীত অনুভব করিতে লাগিলাম যে অনিচ্ছাসত্ত্বেও শীতনিবারণের চেষ্টা করিতে হইল। গায়ে মোটা কাপড় ছিল বটে, কিন্তু শীত এতই প্রবল বলিয়া বোধ হইল যে, তাহা দ্বারা শীতনিবারণ হইল না। এই প্রকার অবস্থায় নির্জীবভাবে দাঁড়াইয়া থাকা যুক্তিসিদ্ধ নয় ভাবিয়া, এই অপরিচিত প্রদেশের এক দিক্ লক্ষ্য করিয়া দ্রুতপদে চলিতে লাগিলাম। বেড়াইতে আরম্ভ করায় শরীর কিঞ্চিৎ উষ্ণ হইল বটে, কিন্তু আমার পদক্ষেপণের বিকট শব্দে বড়ই বিরক্ত হইয়া পড়িলাম—সে শব্দ এতই উচ্চ যে, ইহা পশ্চাদ্বর্ত্তী দুই তিনটি অশ্বের ক্ষুরধ্বনির ন্যায় প্রতীয়মান হইল। এতদ্ব্যতীত এই নূতন রাজ্যে আর একটি ব্যাপার বড়ই অদ্ভুত ঠেকিল—এই মহা শীতে কোন স্থানে তুষার বা বরফের চিহ্ন মাত্র দেখিতে পাইলাম না।

 এই সকল অপার্থিব ও প্রকৃতিবিরুদ্ধ ব্যাপারের যথার্থ কারণ অবধারণার্থে কিছু ভাবিতে লাগিলাম, কিন্তু কেন বলিতে পারি না—কোনক্রমেই মনঃস্থির করিতে পারিলাম না। বোধ হয় একটা সৃষ্টিছাড়া অপার্থিব দেশে আসিয়া হঠাৎ আবির্ভূত হওয়ায়, অতীত জীবনের সুখস্বচ্ছন্দতার কথা আসিয়া মনে একটা উজান স্রোত উপস্থিত করিয়াছিল, তাহারি টানে মনে কোন কথাই স্থান পায় নাই। এই সময়ে সর্ব্বাপেক্ষা আমার বন্ধুর অভাবটা বড়ই তীব্ররূপে অনুভব করিতে হইয়াছিল—তিনি উপস্থিত থাকিলে, হয়ত উক্ত অপার্থিব ঘটনা দুইটির কারণাবিষ্কারের জন্য বিশেষ চিন্তিত হইতে হইত না, বিনা চিন্তায় অতি গুরুতর বৈজ্ঞানিক ব্যাপারেরও সিদ্ধান্ত খাড়া করা তাঁহার একটি বিশেষ গুণ ছিল।

 কিয়দ্দূর অগ্রসর হইলে সকল চিন্তাই একে একে অন্তর্হিত হইয়া গেল, এবং এই অপরিচিত প্রদেশে ভবিষ্যতে আমার কি হইবে—এই মহতী চিন্তা হঠাৎ উপস্থিত হইয়া আমার হৃদয়ে একটা মহাবিপ্লবের সূচনা করিয়া দিল। আমি অনন্যোপায় হইয়া ঝটিকাক্রান্ত তরীর ন্যায় ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে লাগিলাম। এই সময়ে নক্ষত্রের ক্ষীণালোকে কোন একটি জীব আমার পশ্চাদ্ধাবিত হইতেছে বুঝিতে পারিলাম—স্থির-দৃষ্টিতে দেখিয়া, যেন এক বৃহৎ কৃষ্ণবর্ণ পদার্থ দ্রুতবেগে আমার দিকে অগ্রসর হইতেছে বলিয়া বোধ হইল। শুক্রগ্রহে উপস্থিত হইয়া জীব-বাসের কোন নিদর্শন পাই নাই, হঠাৎ ইহা দেখিয়া বড়ই বিস্মিত হইলাম—কিছুদিন পূর্ব্বে জীবনিবাস কেবল পৃথিবীতেই সম্ভব বলিয়া বন্ধুর সহিত যে মহা তর্ক করিয়াছিলাম, সেটা মনে পড়িয়া গেল এবং সে বিষয়ে বন্ধুর অনুমানই যে সত্য তাহাতে আর সন্দেহ থাকিল না। দাঁড়াইয়া অতি অল্পকালমাত্র এই সকল বিষয় চিন্তা করিতে করিতে, মৎচিন্তিত জীব সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। ইহার আকতি দেখিয়া অত্যন্ত বিস্মিত হইলাম এবং কিঞ্চিৎ ভয়েরও সঞ্চার হইল। আমাদের বনমানুষের সহিত ইহার আকৃতিগত অনেক সাদৃশ্য আছে; সর্ব্বশরীর ঘনকৃষ্ণলোমাবৃত, শরীরের তুলনায় মস্তকটি অত্যন্ত বৃহৎ, এতদ্ব্যতীত হস্তপদাদি দীর্ঘনখযুক্ত ও দেহ সম্পূর্ণ উলঙ্গ। এই ভীষণ জীবটি আমার পুরোবর্ত্তী হইয়া, এত বিকট চীৎকার করিতে লাগিল যে, চিরসুপ্ত স্তব্ধ প্রান্তরও যেন সেই ভীষণ কোলাহলে কম্পিত হইতে লাগিল। এই অপূর্ব্ব জীবের অপূর্ব্ব গর্জ্জন আক্রমণের সূচনা বিবেচনা করিয়া আত্ম-রক্ষার জন্য প্রস্তুত হইলাম; কিন্তু আমার ন্যায় ক্ষীণদেহ পার্থিব-জীব, ইহার সুতীক্ষ্ণ বক্রদন্তের সহিত যে, এক মুহূর্ত্তকাল যুঝিবে, তাহা বিশ্বাস হইল না, অদৃষ্টফলের উপর নির্ভর করিয়া দৃঢ়পদে দাঁড়াইয়া রহিলাম! ক্রমেই তাহার উচ্চ গর্জ্জন মন্দীভূত হইতে লাগিল, ইহা দেখিয়া আমাকে আক্রমণ করা ব্যতীত ইহার অপর কোন উদ্দেশ্য আছে বলিয়া বোধ হইল এবং তাহার নানা অঙ্গভঙ্গী পরীক্ষা করিয়া, নিশ্চয়ই আমাকে সহগামী হইবার জন্য ভাবপ্রকাশ করিতেছে বুঝিলাম। বর্ত্তমান অবস্থায় তাহার মতের বিরুদ্ধে কার্য্য করা কিছুতেই যুক্তিসিদ্ধ নয় ভাবিয়া, তাহার নিকটবর্ত্তী হইবামাত্র, সে আমার পূর্ব্বাবলম্বিত পথ ত্যাগ করিয়া, আর এক নূতন পথে চলিতে আরম্ভ করিল; আমিও তাহার অনুগমন করিলাম। দেখিলাম শুক্রবাসী জীব অতি দ্রুত চলিতে পারে; আমি পূর্ব্বে যে তাহাকে দৌড়িতে দেখিয়াছিলাম, তাহা বাস্তবিক দৌড় নয়, তাহার সাধারণ পদক্ষেপ এতই দীর্ঘ যে, মানবপদক্ষেপণের দশগুণও ইহার সহিত সমান হয় না। আমি তাহার নির্দ্দিষ্ট পথে যথাসাধ্য দ্রুত চলিতে লাগিলাম। শুক্রগ্রহের এই দারুণ শীতে শরীর উষ্ণ রাখিয়া জীবন ধারণার্থে, স্বভাবতঃই ইহারা স্থূললোমাবৃত ও দ্রুতগমনশীল হইয়াছে বলিয়া বোধ হইল।

 আমার এই অদ্ভুত সহচরের সহিত কিয়দ্দূর অগ্রসর হইলে, আমাদের অনুসৃত পথের সম্মুখেই, নক্ষত্রের ক্ষীণালোকে, একটা বৃহৎ মৃত্তিকা-স্তূপ দেথা গেল। পথপ্রদর্শক জীবটি সেই স্তূপাভিমুখে চলিতে লাগিল, এবং আমরা অতি অল্পকাল-মধ্যেই তথায় উপস্থিত হইলাম। সমতল ভূমিতে এপ্রকার স্তূপ বড়ই অস্বাভাবিক ঠেকিল। শুক্রগ্রহে আমি নবাগত, সুতরাং তুচ্ছ পার্থিব জ্ঞান দ্বারা ইহার প্রাকৃতিক ব্যাপারের উপর মতামত প্রচার করা এবং বিধাতার অনন্ত সৃষ্টির প্রত্যেক ঘটনা পার্থিব বিজ্ঞানের ক্ষুদ্র সীমাভুক্ত করিবার চেষ্টা যে, স্বল্পবুদ্ধির পরিচায়ক তাহা বুঝিয়া এই স্তূপটি কি জানিবার জন্য বড় কৌতূহলাক্রান্ত হইলাম। আমার সহচর স্তূপের নিকটবর্ত্তী হইবামাত্র মহা চীৎকার আরম্ভ করিল; দুই একবার শব্দ করিবামাত্র, তাহার একাংশ আলোকিত হইয়া উঠিল এবং স্তূপগাত্রস্থ গহ্বর হইতে, আমার সহচরের ন্যায় আকৃতিবিশিষ্ট কয়েকটি জীব বহির্গত হইয়াই, আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া মহা কলরব আরম্ভ করিল—তাহাদের বিস্ময়পূর্ণ দৃষ্টি ও অঙ্গভঙ্গী দ্বারা বুঝিলাম, ইহারা আমার সম্বন্ধেই কথা বলিতেছে। তাহাদের অপূর্ব্ব ভাষায় কিয়ৎকাল এই প্রকার শব্দ করিয়া আবাসস্থানে প্রবেশের জন্য আমাকে ইঙ্গিত করিতে লাগিল, কিন্তু তাহাদের আগ্রহাতিশয় দেখিয়াও আমি তাহাদের অনুগমনে সাহসী হইলাম না। বাল্যকালে আরব্য উপন্যাসের যে-সকল গল্প শুনিয়াছিলাম এবং ঘোর বর্ষার সন্ধ্যায় ঠাকুরমার ক্রোড়ে মাথা রাখিয়া, মুদ্রিতনেত্রে রাক্ষসপুরী ও পিতৃভক্ত রাজপুত্রের রূপকথা শুনিয়া, নির্ম্মম রাক্ষসকুল ও বিপন্না রাজপুত্রী-সম্বন্ধে যে একটা কল্পনা খাড়া করিয়াছিলাম, এবং সেই রাক্ষসপুরীর করুণ কাহিনীর সহিত, জলপ্লাবিত পুষ্করিণীর আনন্দমত্ত ভেকের কোলাহল ও মৃদু গম্ভীর মেঘ-গর্জ্জনের এক বিশেষ সম্বন্ধ আছে ভাবিয়া, ঠাকুরমার কোলের নিকট ঘেঁসিয়া শুইয়াছিলাম, সেই সকল অতি পুরাতন স্মৃতি যেন সজীব হইয়া আমার গতিরোধ করিল; বোগ্‌দাদের বণিক্ পুত্র যদি পৃথিবীতে থাকিয়া এত বিপদাক্রান্ত হইতে পারে, আমি ক্ষুদ্র পার্থিবজীব, বিধাতার এক নূতনরাজ্যে আসিয়া তদনুরূপ বিপদ সংঘটন কেন অসম্ভব বিবেচনা করিব? শুক্রজীবগণের ব্যবহার আদর-ব্যঞ্জক হইলেও, তাহাদের আতিথ্যগ্রহণ সর্ব্বাংশে বিপদশূন্য বলিয়া বোধ হইল না—গুহাভিমুখে অগ্রসর হইতে পারিলাম না।

 আমার এই অনিচ্ছার ভাব দেখিয়া, তাহাদের মধ্যে একজন ত্বরিতপদে গুহাপ্রবেশ করিল এবং অতি অল্প সময় মধ্যে এক অদ্ভুত দীপহস্তে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া গুহা-দ্বারে দাঁড়াইল। এবার গুহাবিবর হইতে অপর একটি জীব বহির্গত হইল,—এটি আমার পূর্ব্ব-পরিচিত শুক্রবাসীর জাতীয় নয়, তাহা স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম। অনতি-উজ্জ্বল দীপালোকে, তাহার দেহ শুভ্র বস্ত্রাবৃত দেখাইল এবং বাহ্য আকৃতি ও চালচলন সকলই মনুষ্যের ন্যায় দেখিলাম। জগদীশ্বরের এই অদ্ভুত রাজ্যে, আমার ন্যায় আর একটি দুর্ভাগা মনুষ্যসন্তান দেখিয়া বিস্মিত হইলাম—বিস্ময় ও আনন্দে ক্ষণিক কর্ত্তব্যজ্ঞানশূন্য হইয়া, এক বিপুল-আবেগপূর্ণ হৃদয়ে দৌড়িয়া তাহার নিকট উপস্থিত হইলাম। সেখানে গিয়া যাহা দেখিলাম তাহাতে আর বিস্ময়ের সীমা থাকিল না—এক ভয়ানক চীৎকার করিয়া তাঁহাকে আলিঙ্গন করিলাম। আমার জীবনে এই প্রকার উচ্ছ্বাস ও আবেগপূর্ণ আলিঙ্গন কখনও করি নাই এবং এ প্রকার অব্যক্ত কঠোর-চীৎকার আর কখনও আমার কণ্ঠ-নিঃসৃত হইয়াছে বলিয়া মনে পড়ে না,—আলিঙ্গন-বদ্ধ এই ব্যক্তি আমার সেই বৈজ্ঞানিক বন্ধু! বন্ধুর আজানুলম্বিত ঢোলা কামিজ দেখিয়া দূর হইতেই তাঁহাকে চেনা উচিত ছিল। কিন্তু তাঁহাকে কখন বিমর্ষ ও নিরুৎসাহ দেখি নাই, এখন এই দুইটা মিলিয়া তাঁহাকে এমনি রূপান্তরিত ও অস্বাভাবিক করিয়া তুলিয়াছিল যে, অতি অল্পদুর হইতেও তাঁহাকে চিনিতে পারি নাই। আমার বাহুবদ্ধ হইয়াও বন্ধুর মৃত্তিকাসংলগ্ন দৃষ্টি উত্তোলিত হইল না—তাঁহার স্থির প্রশান্ত মূর্ত্তি প্রস্তরবৎ নিশ্চলই থাকিল। কয়েকবার নাম ধরিয়া ডাকাডাকি করায় মস্তক উত্তোলন করিলেন এবং আমাকে দেখিবামাত্র তাঁহার নিরুৎসাহব্যঞ্জক বিমর্ষ বদনমণ্ডলে বিস্ময়ের ছায়া আসিয়া পড়িল। বোধ হয় তিনি আমার অস্তিত্বের উপর সন্দিহান হইয়া, সকলই এই অদ্ভুতরাজ্যের মায়ার খেলা ভাবিয়াছিলেন। যাহা হউক আমি যে শুক্রবাসিগণের মায়া-প্রসূত নহি এবং প্রকৃতই তাঁহার চিরপরিচিত পার্থিব সুহৃদ্ তাহা নানা উপায়ে বিশ্বাস করাইয়া দিলাম—বিশ্বাসসংস্থাপনে অবশ্য কিঞ্চিৎ ক্লেশ স্বীকার করিতে হইয়াছিল। এক জন বন্ধুকে এই প্রকার সন্দেহ করায়, পরে তিনি বড়ই লজ্জিত হইয়াছিলেন, এবং তাঁহার ন্যায় একজন পূর্ণ জড়বাদীর পক্ষে প্রত্যক্ষ মানুষটাকে, একেবারে মায়ার রচনা বলিয়া উড়াইয়া দিবার কল্পনাটাও যে একটি গুরুতর অপরাধ, তাহা পরে স্বীকার করিয়াছিলেন।

 আমার শুক্রে গমনের বিবরণাদি বিবৃত করিয়া বন্ধুর আকস্মিক লোকান্তর আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম; তিনি বলিলেন—“ভাই, তোমার বৈঠকখানা ঘরে সেই আারাম-কেদারায় শুইয়া আল্‌বোলার নলটি মুখে রাখিয়া সদ্য-আলোচিত গ্রহ প্রকৃতই জীবাবাসোপযোগী হইলে, কি প্রকার জীব সেস্থানে বাস করিতে পারে, তাহার বিষয় ভাবিতেছিলাম; এবং অল্প চিন্তার পর একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হইবার উদ্যোগও করিয়াছিলাম; কিন্তু এই সিদ্ধান্ত যে কতদূর অগ্রসর হইয়াছিল এবং উদ্গারিত ধূম নলটিই বা কখন ওষ্ঠচ্যুত হইয়াছিল, তাহা কিছুই মনে নাই। তাহার কিঞ্চিৎ পরেই, কি এক অদ্ভুত কুহকে আমার কল্পিত অধিবাসিগণের দুর্গন্ধময় গহ্বরে নীত হইয়াছি—এ প্রকার বিস্ময়জনক ঘটনার কথা কখন শুনি নাই; কোন দেশের কোন বিজ্ঞানবিৎ এই অদ্ভুত উপায়ে জ্যোতিষিক আবিষ্কার করিয়াছেন শুনিয়াছ কি?” আমি নানা প্রকারে বন্ধুকে প্রফুল্ল করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম, এবং সকলকেই যে একই নির্দ্দিষ্ট উপায়ে আবিষ্কার করিতে হইবে তাহার কোন বাঁধা নিয়ম নাই, তাহা হইলে লোভেরিয়রের নূতন গ্রহাবিষ্কার ব্যাপারটা একবারে উড়াইয়া দিতে হয়—এ সকল কথাও তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিলাম। আমার আশ্বাসবাণীতে, বন্ধুর বিষাদাঙ্কিত গম্ভীর মুখমণ্ডলে ঈষৎ হাস্যরেখা ফুটিষাছিল কি না দেখি নাই। নিকটবর্ত্তী শুক্রবাসিগণ পরস্পর মহা কলরব আরম্ভ করিয়াছিল—দৃষ্টি সেই দিকে আকৃষ্ট ছিল।

 আমাদিগকে গুহা প্রবেশ করাইবার জন্য শুক্রবাসিগণ বড়ই আগ্রহ প্রকাশ করিতে লাগিল। বন্ধু যখন অক্ষত শরীরে গুহানিষ্ক্রান্ত হইয়াছেন, তখন ভয়ানক শীতে জীবনধারণ অপেক্ষা তাহাদের আতিথ্যগ্রহণ যে বিশেষ বিপদসঙ্কুল, তাহা বিবেচনা হইল না, বন্ধুরও গুহাপ্রবেশে অমত ছিল না। আমার খর্ব্বদেহ পূর্ব্ব সহচরটি এবারও পথপ্রদর্শক হইয়া দীপহস্তে সর্ব্বাগ্রে গুহাপ্রবেশ করিল, আমরা পশ্চাৎ চলিলাম। শুক্রবাসীর ন্যায় বর্ব্বর জাতির ক্ষুদ্র গার্হস্থ্য সুখের প্রয়োজনীয় সকল বস্তুই গুহায় সজ্জিত দেখিলাম। গুহাটি বেশ গরম; শুক্রের অন্ধকার-অংশে সূর্য্যকিরণাভাবে, বৃক্ষাদি জন্মিতে পারে না, কাজেই কাষ্ঠ কয়লা ইত্যাদি দাহ্য পদার্থও তথায় এককালীন উৎপন্ন হয় না, এজন্য শুক্রের জীবগণ এক প্রকার নিকৃষ্ট প্রাণীর বসা সংগ্রহ করিয়া অগ্নি উৎপন্ন করে। দেখিলাম, শীত নিবারণার্থে গুহার দুই অংশে বসা-অগ্নি জ্বলিতেছে, এবং গুহাটি বেশ আলোকিত হইয়াছে।

 বন্ধু শুক্রগ্রহে উপনীত হইয়া, ইহার অধিবাসীদের অনেক গার্হস্থ্য ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন, তাঁহার নিকট শুনিলাম—ইহারা প্রায়ই উদ্ভিজ্জভোজী; মৃত্তিকা খনন করিয়া শুক্রগর্ভের অতি নিম্ন প্রদেশে উদ্ভিদাদি উৎপন্ন করে; সৌরতাপাভাবে ইহাদের উৎপত্তির কোন অনিষ্ট হয় না—শুক্রের আভ্যন্তরীণ তাপ দ্বারা সূর্য্যতাপের কার্য্য সাধিত হয়। কি পরিমাণ তাপে কোন্ উদ্ভিদ্ ভাল উৎপন্ন হইবে, ইহা তাহারা বেশ বুঝে এবং তাপের আবশ্যকতা অনুসারে, উদ্ভিদ-ক্ষেত্রের গভীরতা নির্দ্দিষ্ট করিয়া থাকে। এতদ্ব্যতীত ইহারা বসা-সংগ্রহের জন্য যে সকল পশু হত্যা করে, তাহাদের মাংস মধ্যে মধ্যে সিদ্ধ করিয়া আহার করে, এবং লোমশ চর্ম্ম, শয্যা ও বস্ত্রাচ্ছাদনরূপে প্রস্তুত রাখে।

 আমরা অগ্নি-পার্শ্বে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া গল্প করিতে লাগিলাম—এই অবকাশে এক শুক্রবাসী আহার প্রস্তুত করিয়া আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হইল। হিসাব করিয়া দেখিলাম আমরা প্রায়, দশ ঘণ্টা শুক্রগ্রহে উপস্থিত হইয়াছি, নানা উৎকণ্ঠা ও আবেগের আবর্ত্তে পড়িয়া রসনেন্দ্রিয় তৃপ্তি ও উদর-সেবার কথাটা মনে স্থান পায় নাই—কিন্তু এখন এই গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করায় শারীরিক অবসাদ বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলাম এবং আহারেচ্ছাটাই অতি প্রবল বলিয়া বোধ হইয়াছিল—আহার্য্যের সদ্ব্যবহারে আমার মোটেই অমত ছিল না। অজ্ঞাত-ব্যবহার বর্ব্বরজাতির প্রদত্ত আহার্য্য নির্ব্বিবাদে গ্রহণ করা অদূরদর্শিতার পরিচায়ক বলিয়া, বন্ধুবর প্রথমে আহারে অনিচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন, কিন্তু শেষে আমার সহিত যোগদান করা আপত্তিকর বিবেচনা করেন নাই। বোধ হয় তাঁহার দার্শনিক হৃদয়টাও উদরের কুহকে ঠিক্ থাকিতে পারে নাই। আহারান্তে পকেটবদ্ধ চুরুট বাহির করিয়া ধূম-পান করিতে লাগিলাম। বন্ধু চুরুট-ধূম-পানের বিশেষ পক্ষপাতী ছিলেন না, তিনি নিকটস্থ চর্ম্মশয্যা আশ্রয় করিয়া, আমাদের শুক্রপরিভ্রমণ ও গুহাত্যাগাদি-সম্বন্ধে নানা কল্পনা করিতে লাগিলেন। বন্ধুর বিষাদকালিমাঙ্কিত মুখমণ্ডল যেন ক্রমেই প্রফুল্লভাব ধারণ করিতে লাগিল, তাঁহার প্রশান্ত দৃষ্টি যেন জগতের অতি গুহ্য জটিলতত্ত্বেরও মর্ম্মস্থলে আঘাত করিতে উদ্যোগী; আমার মুখনিঃসৃত কুণ্ডলিত ধূম স্থিরদৃষ্টে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন—তুচ্ছ ফুৎকারজাত ধূমের ক্ষণিক উত্থান-পতনে বন্ধু কোনও গভীর দার্শনিক তত্ত্বাবিষ্কারের সুযোগ পাইয়াছিলেন কিনা জানি না।

 আমরা কিঞ্চিৎ বিশ্রামান্তে গুহার বাহিরে আসিলাম। অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্রভূষিত আকাশের নীচে শান্ত প্রকৃতি বড়ই মনোরম বলিয়া বোধ হইল। অনতিকৃষ্ণ প্রান্তরের সহিত অনন্ত আকাশের আলিঙ্গন আরো মধুর; ক্ষীণ নক্ষত্রালোকে শুক্রগ্রহটিকে একটি অনন্ত বিষাদে পূর্ণ করিয়া রাথিয়াছে, এটা যেন সৃষ্টিকর্ত্তার ছেলেখেলার উদাহরণ, অনন্ত শক্তির আধার বিশাল নক্ষত্র ও নানা ঋতুসম্পন্ন গ্রহাদি নির্ম্মাণ করিতে করিতে বালসুলভ চাপল্য বশতঃ তিনি যেন কি গড়িতে কি গড়িয়া ফেলিয়াছেন, কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, ভাগ্যবান্ ভ্রাতাদের সহিত চিরদগ্ধ ও বিষাদাবগুণ্ঠিত শুক্রগ্রহটিও জগৎ-নিয়ন্তার কীর্ত্তিগাথার অনন্ত তানে, একটি ক্ষীণ-স্বর যোজনায় ভুলে নাই—দিগদিগন্তের নক্ষত্র, যেন মুগ্ধদৃষ্টিতে তাহাদের এক হতভাগ্য দুর্ব্বল ভ্রাতার ঐকান্তিকতা চাহিয়া দেখিবে। তখনও আমাদের পৃথিবী ক্ষুদ্র চন্দ্রের সহিত দিগন্তে প্রকাশিত ছিল, আমরা কিঞ্চিৎ অপেক্ষা করিয়া পৃথিবীর অস্তগমন দৃশ্য দেখিতে লাগিলাম। অসীম স্তব্ধ আকাশের এক প্রান্তে পৃথিবী মিট্ মিট্ জ্বলিতে ছিল—অনন্ত বিশ্বের তুলনায় পৃথিবী কি এতই ক্ষুদ্র? তবে পৃথিবীর ক্ষুদ্র জীব মানুষই বা কত ক্ষুদ্র এবং তাহাদের আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ ও বাসনাই বা কত ক্ষুদ্র! বড়ই ক্ষোভের কথা, এই সুমহান্ দৃশ্যের মধ্যে বিশ্ব-মহিমার সার তত্ত্বটুকু প্রত্যক্ষ করিয়াও আধ্যাত্মিকতার চরমোৎকর্ষ হিন্দু-সন্তানটির মনে, একটুও বৈরাগ্যের ভাব উদিত হয় নাই,—গগন-প্রান্তের ক্ষুদ্র আলোকবিন্দুটি, আমার সেই মধুর গৃহ মনে করিয়া দিয়াছিল—বহুদূর স্থিত ছায়ারাজ্যের এক ক্ষুদ্র অংশ অধিকার করিয়া যে ক্ষুদ্র বাগানটি আছে, তাহাতে বান্ধব-সমাগম ও সান্ধ্য-আলাপন যে কত মধুর তাহাই কেবল মনে জাগিতেছিল; এই সুদীর্ঘ মরুব্যবধান উত্তীর্ণ হইয়া কখন সেই অতুল সৌন্দর্য্যময় জীবজগতের প্রাত্যহিক জীবনোৎসবে যোগ দিতে পারিব, কেবল তাহাই ভাবিতেছিলাম। বন্ধু ত আত্মহারা—চন্দ্র অস্তে গিয়াছে, পৃথিবী তখনও দিগন্তপ্রান্তে স্নিগ্ধোজ্জ্বল শেষ কিরণ বর্ষণ করিয়া অস্ত গমনোন্মুখ—বন্ধু এই দৃশ্যে যে কত বড় কবিত্ব আবিষ্কার করিয়াছিলেন জানি না, তবে ইহার মধ্যে তিনি যে একটু কিছু সূক্ষ্ম দেখিতেছিলেন, তাঁহার অচটুল নয়নযুগল ও স্থিরমূর্ত্তিতে, তাহা বেশী প্রতিভাত হইতেছিল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নক্ষত্র গ্রহাদির অস্তদৃশ্য শুক্রগ্রহে বাস্তবিকই এক নূতন ঘটনা। পৃথিবীর আকাশ সর্ব্বদা জলীয় বাষ্পে পূর্ণ থাকায়, ক্ষুদ্র জ্যোতিষ্কগণ দিগন্তবর্ত্তী হইবামাত্রই বাষ্পাবরণে অদৃশ্য হইয়া যায়, ইহাদের ক্ষীণ জ্যোতি বাষ্পরাশি ভেদ করিয়া ধরা-পৃষ্ঠে পৌঁছিতে পারে না; কিন্তু শুক্রের অন্ধকার-অংশে কোন সময়েই সূর্য্য উদিত হয় না, এজন্য তাপাভাবে জলীয় বাষ্প উৎপন্ন হইতে না পারায় আকাশ পরিচ্ছন্ন থাকে ও প্রত্যেক ক্ষুদ্র নক্ষত্রটিও মানব-চক্ষে দীপ্তিশালী দেখায়। এই ভয়ানক শীতে, শুক্র-পৃষ্ঠে বরফতুষারাদি অভাবের কারণ বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করায়, ইহাও সৌরতাপাভাবের কারণ বলিয়া স্থির করিলেন; কথাটা প্রকৃত বলিয়াই বোধ হইল; সূর্য্যকিরণাভাবে শুক্রগর্ভনিহিত জলরাশি বাষ্পে পরিণত হইতে পারে না—কাযেই মেঘ বৃষ্টি, নদী তুষারাদি উৎপন্ন হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব।

 অসভ্য শুক্রবাসিগণের আতিথ্য গ্রহণ করিয়া আমরা অনেক কাল গুহাবাস করিলাম। শুক্রগ্রহে সময়নিরূপণ ব্যাপারটা বড় কঠিন, আমাদের রাত্রিদিনের মত ইহাতে একটা বড় সময়বিভাগের কোন উপায়ই নাই। আমার পকেটে একটি ঘড়ি ছিল, তাহাতে কেবল বার ঘণ্টার হিসাব চলিত, তাহার পর সকলই গোলযোগ হইয়া যাইত। একই অংশ সূর্য্যালোকে উন্মুক্ত রাখিয়া আমাদের ২২৪ দিন ১৮ ঘন্টায়, শুক্র সূর্য্যপ্রদক্ষিণ করে জানিতাম, কাযেই পৃথিবী স্বীয় কক্ষপ্রদক্ষিণ-কালে অর্থাৎ এক বৎসর পরে, যে-সকল জ্যোতিষ্কগণের উদয়াস্ত প্রত্যক্ষ করে, শুক্র হইতে তদপেক্ষা অল্পকাল ২২৪ দিনে, ঠিক সেই সকল জ্যোতিষ্কগণের উদয়াস্ত দেখা যাইবে—একথাটা হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল; নির্দ্দিষ্ট নক্ষত্ররাশির উদয়াস্তকাল পরীক্ষা করিয়া, সেই সময়টি শুক্রবর্ষ ২২৪ দিনের কত অংশ, তাহা হিসাব করিয়া সময়নিরূপণ করিতে লাগিলাম। এই প্রকারে দেখা গেল, আমরা প্রায় দুই সপ্তাহ গুহাবাস করিতেছি। শুক্রগ্রহে আগমনকাল হইতে আমাদের একটি বড় আশ্চর্য্য পরিবর্ত্তন লক্ষিত হইয়াছিল—ক্ষুধাদমন শক্তিটা আমাদের অসম্ভব বৃদ্ধি পাইয়াছিল। যে উদরের কুমন্ত্রণায় পৃথিবীতে নিশিদিন ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইয়াছি, শুক্রে পদার্পণের কিছুকাল পর হইতেই তাহার অস্তিত্বের চিহ্নমাত্রও জানিতে পারি নাই, এই দুই সপ্তাহের মধ্যে আমরা কেবল তিনবার আহার করিয়াছিলাম, কিন্তু ইহাতে দুর্ব্বলতা বা শারীরিক অবনতির লেশমাত্র অনুভব করি নাই। শুনিয়াছি দেবতারা অমৃতপানে অমর ও ক্ষুধারহিত হইয়াছেন; যদি আহার-লিপ্সাহীনতা দেবত্বের একটা অঙ্গ হয়, তাহা হইলে শুক্রগ্রহে আসিয়া যে আমরা ঈশ্বরত্বের একটা বড় সোপানে আরোহণ করিয়াছিলাম, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। আমাদের পৌরাণিক স্বর্গ যে কতকটা শুক্রগ্রহের ন্যায়, বন্ধুবর তাহা ইহা হইতে সপ্রমাণ করিয়াছিলেন। যাহা হউক আমাদের অসম্ভব ক্ষুধানিরোধ-শক্তির প্রকৃত কারণ আবিষ্কারের জন্য বন্ধুকে অনেক পরিশ্রম করিতে হইয়াছিল; এই গবেষণায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমি বন্ধুকে কিঞ্চিৎ সাহায্য করিয়াছিলাম। অনেক পরীক্ষা করিয়া শুক্রবাসীদিগের প্রধান থাদ্য এক জাতীয় শাক সর্ব্বাপেক্ষা পুষ্টিকর দেখা গেল; কেবল একবার মাত্র ইহা আহার করিলে প্রায় দশ দিবস পর্য্যন্ত সামান্য ক্ষুধারও উদ্রেক হয় না। এই উদ্ভিজ্জাহারই যে আমাদের ভোজনস্পৃহা নিরোধের একমাত্র কারণ, তাহাতে আর সংশয় রহিল না।

 বহুকাল একস্থানে থাকিয়া মন বড় অস্থির হইল, বন্ধু বলিলেন—“শুক্রের অন্ধকার-অংশে যাহা দেখিবার ছিল, সকলই দেখা গেল, এখন ইহার সূর্য্যকিরণোন্মুক্ত অপরার্দ্ধে কি আছে দেখা যাক্”। বন্ধুর কথায় আমার অণুমাত্র অমত ছিল না; আমি প্রসঙ্গক্রমে দুই একবার এবিষয়ে প্রস্তাব করিয়াছিলাম, কিন্তু তাঁহার গুহাত্যাগে অনিচ্ছার লক্ষণ দেখিয়া, কথাটা স্পষ্ট প্রকাশ করি নাই। যাহা হউক, আমরা শীঘ্রই শুক্রের অপরার্দ্ধ ভ্রমণার্থে উদ্যোগ করিতে লাগিলাম। পথে শীত নিবারণোপযোগী লোমশ চর্ম্ম, এবং দুই মাসের আহারোপযোগী পূর্ব্ববর্ণিত ক্ষুধানাশক শাক ইত্যাদি কয়েকটি পদার্থ সঙ্গে লইবার ব্যবস্থা করা গেল। আমরা শীঘ্রই গুহাত্যাগ করিতেছি শুনিয়া, শুক্রবাসিগণ মধ্যে এক ঘোর আকুলতা আসিয়া পড়িল—অসভ্য শুক্রজীবদের নিকট প্রীতি আমরা আশা করি নাই; আমার প্রথমপরিচিত শুক্রবাসী ঘটোৎকচ গুহাত্যাগের উদ্যোগ দেখিয়া আমাদের সঙ্গে যাইবার জন্য বড়ই অনুরোধ করিতে লাগিল। আমাদের সহচর হইলে পথ প্রদর্শন ও অপর অনেক কার্য্যে ইহার সহায়তা পাইব দেখিয়া, তাহাকে সঙ্গে লইবার আমাদের আপত্তি হইল না। সংগৃহীত পশুচর্ম্মে গাত্রাচ্ছাদন করিয়া, ঘটোৎকচের মস্তকে আহার্য্য উদ্ভিজ্জাদির ভার রাখিয়া, আমরা গুহা তাাগ করিলাম।

 নক্ষত্রপর্য্যবেক্ষণ দ্বারা দিক্‌নির্ণয় করিয়া, আমরা শুক্রের বিষুবরেখার সমান্তরাল পথে পূর্ব্বাভিমুখে চলিতে লাগিলাম। গণনা করিয়া দেখা গেল, আমাদের অবলম্বিত পথানুক্রমে ছয় শত ক্রোশ চলিলে শুক্রের আলোকিতাংশে উপস্থিত হওয়া যাইবে। শুক্রের আকাশ সর্ব্বদাই মেঘহীন ও পরিচ্ছন্ন; এজন্য পর্য্যবেক্ষণকার্য্যের কোনও অসুবিধা হইত না। পথিমধ্যে আমাদের সমবেত চেষ্টায় শুক্রের একটি অপ্রাকৃতিক ঘটনার মীমাংসা হইয়াছিল, ভ্রমণকালে আমাদের পদোদ্ভূত অশ্বক্ষুরধ্বনিবৎ উচ্চ শব্দের প্রকৃত কারণ বহুচিন্তাতেও অনেকক্ষণ স্থির করিতে পারি নাই, পরে শুক্রপৃষ্ঠে তাপের অল্পাতিরেক না থাকায় বায়ুর স্থিরতা ও ইহার গুরুত্বের সমতাই, এই অদৃষ্টপূর্ব্ব ঘটনার কারণ বলিয়া বোধ হইল। আমাদের পদক্ষেপণে স্তব্ধ বায়ুরাশি এতই অন্দোলিত হয় এবং তজ্জাত শব্দতরঙ্গ এত অধিককাল স্থায়ী হয় যে, তাহা হইতেই পূর্ব্বোক্ত শব্দ শ্রুত হইয়া থাকে।

 আমরা সোৎসাহে চলিতে লাগিলাম। অধিক শীতার্ত্ত বা পরিশ্রান্ত হইলে শুক্রপৃষ্ঠস্থ সুগভীর ফাটাল আশ্রয় করিয়া সুস্থ হইতাম। শুক্রপৃষ্ঠে এপ্রকার আশ্রয় গ্রহণোপযোগ্য স্থান প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায়। আমরা যে অংশে পরিভ্রমণ করিতেছিলাম, তথায় জীববাসের সামান্য লক্ষণও দেখা গেল না, দিগন্তবিস্তৃত বিশাল সমতল প্রান্তরের ভীষণ দৃশ্যটা মধ্যে মধ্যে হৃদয়ে এমন হাহাকার উত্থিত করিত যে, পদক্ষেপণের সামর্থ্যটুকু পর্য্যন্ত ক্ষণকালের জন্য লয়প্রাপ্ত হইত। যাহা হউক বন্ধুর দার্শনিক মনটি বড়ই সুশিক্ষিত বলিতে হইবে—বিজ্ঞানের কথা তুলিলেই এই ঘোর নৈরাশ্যের মধ্যেও মনকে একবারে বৈজ্ঞানিক ব্যাপারে নিয়োজিত করিতে পারিতেন, নিজেই যুক্তি-উত্থাপন ও তাহার খণ্ডন করিয়া, উপস্থিত বিপদের কথা ভুলিয়া মহানন্দ উপভোগ করিতেন।

 কিছুকাল এই প্রকারে অগ্রসর হইয়া হিসাব করিয়া দেখিলাম, আমরা এক সপ্তাহ চলিতেছি এবং ইতিমধ্যে একশত ক্রোশেরও অধিক পথ অতিক্রম করিয়াছি। এই সময়ে আমাদের পথের অনতিদূরে একটি উচ্চ স্তূপ দৃষ্ট হইল; আমরা কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া ইহার নিকটে গেলাম। দূর অন্ধকারে ইহাকে উচ্চভূমি বলিয়া বোধ হইয়াছিল, কিন্তু দেখিলাম বাস্তবিক তাহা নয়, ইহা একটি বৃহৎ অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ মাত্র। এই প্রাণিহীন মহামরু-মধ্যে অট্টালিকার চিহ্ন দেখিয়া আমরা বড় বিস্মিত হইলাম—সেই ভগ্ন অট্টালিকার নির্ম্মাণকৌশল ও স্থপতিবিদ্যার চরমোৎকর্ষতার লক্ষণ যথার্থই বিস্ময়জনক। কলাবিদ্যার বিপুল কীর্ত্তিস্তম্ভ এই অট্টালিকা যে আমাদের পরিচিত শুক্রবাসিগণের হস্তপ্রসূত নয়, তাহা আমরা বিলক্ষণ জানিতাম; বন্ধু অনুমান করিলেন, শুক্রের এই অংশে নিশ্চয়ই এককালে অতি উন্নত জীবের বসতি ছিল, সেই সময় বোধ হয় পৃথিবীর ন্যায় এখানেও নিয়মিতরূপে দিবারাত্রি হইত; পরে কোন দুর্ঘটনা বশতঃ ইহা চিরান্ধকারাবৃত হইয়া উন্নতজীবাবাসের সম্পূর্ণ অনুপযোগী হইয়া গিয়াছে এবং কালে সেই সকল উন্নত জীবগণের বংশ লোপ হইয়াছে, এই ভগ্ন অট্টালিকা কেবল প্রাণিহীন তামসাচ্ছন্ন প্রান্তরে দাঁড়াইয়া তাহাদের লুপ্ত গৌরবের সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে। বন্ধুর অনুমান সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত বলিয়া বোধ হইল।

 এই ঘটনার পর কিছুদূর অগ্রসর হইয়া, এক সময়ে আমাদের পুরোবর্ত্তী পূর্ব্বাকাশে ঈষৎ আলোকচিহ্ন দেখা গেল—নির্ম্মল শুক্রাকাশে এই দৃশ্য বড়ই প্রীতিকর বলিয়া বোধ হইল। এই ভয়ানক অন্ধকারময় রাজ্যে আসিয়া পর্য্যন্ত এমন স্নিগ্ধমধুর আলোক চক্ষুর্গোচর হয় নাই, ঊষাগমনের পূর্ব্বে পার্থিব গগনে যে ক্ষীণালোকের বিকাশ দেখিয়াছি, ইহা ঠিক তদনুরূপ। ইহা যে সূর্য্যোদয়ের চিহ্ন নয়, তাহা আমরা বিলক্ষণ জানিতাম; শুক্রে অদিম অবস্থা যাহাই থাকুক, এখন ইহার একাংশ যে এককালে সূর্য্যালোকরহিত ও অপরাংশ সর্ব্বদাই সৌর-কিরণোন্মুক্ত, তাহাতে আর আমাদের সন্দেহ ছিল না। গণনা করিয়া দেখিলাম, আমরা তথনও শুক্রের আলোকিতাংশ হইতে প্রায় সার্দ্ধ চারিশত ক্রোশ ব্যবধানে অবস্থিত; এতদূর হইতে সূর্য্যালোক-চিহ্ন প্রত্যক্ষ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। বন্ধু বলিলেন, আমরা পৃথিবীতে সূর্য্য-উদয়ের অনেক পূর্ব্বে যেমন রশ্মি সকলের পথপরিবর্ত্তন দ্বারা বহুদূরস্থিত সূর্য্যের আলোক দেখিতে পাই, এখানেও হয়ত সেই প্রকারে শুক্রবায়ুরাশিতে দূরস্থিত সূর্য্যরশ্মি প্রবেশ করায়, তাহার পথ পরিবর্ত্তিত হইয়া, এই বহুদূরবর্ত্তী স্থানও আলোকিত করিতেছে। বন্ধুর কথাটা বৈজ্ঞানিক যুক্তিসঙ্গত হইলেও উপস্থিত বিষয়ে তাহা প্রযুজ্য বলিয়া বোধ হইল না। বায়ু-আবরণে আলোকপথ পরিবর্ত্তন ইহার কারণ হইলে, গুহাবাসকালে আমরা আলোক দেখিতে পাইতাম, শুক্রবায়ুরাশির গভীরতা ও ইহার রশ্মিপথ-পরিবর্ত্তনক্ষমতা (Index of Refraction) বোধ হয় পৃথিবীর বায়ু অপেক্ষা অল্প, এজন্য গুহাবাসকালে পার্থিব সান্ধ্যালোকের (Twilight) ন্যায় কোন আলোক নয়নগোচর হয় নাই; উপস্থিত বিষয়টির কোন মীমাংসা হইল না, এ সময় আমার ক্ষুদ্র আনিরয়েড্ ব্যারোমিটারটির কথা মনে হইল, সেটি সঙ্গে থাকিলে অনেক কাযে লাগিত।

 আমরা অপ্রতিহত গতিতে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। শুক্রের এই অংশ তত বন্ধুর ছিল না, বেশ সমতল পরিচ্ছন্ন পথ; এই সুযোগে আমরা পূর্ব্বাপেক্ষা অধিকবেগে চলিতে লাগিলাম। যতই অগ্রসর হইতে লাগিলাম, পূর্ব্বাকাশের ক্ষীণালোক ক্রমেই স্পষ্টতর হইয়া ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। শুক্রের অনিবিড় অন্ধকার তাড়িত হইয়া, এক মধুর উজ্জ্বলতা চারিদিকে বিকশিত হইল। পূর্ব্ব গগনের তারকা সকল ক্রমেই জ্যোতিহীন হইয়া একে একে নিবিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে এই আলোক এতই উজ্জ্বল হইয়া উঠিল যে, আমাদের ছায়া পর্য্যন্ত স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম। এই অভাবনীয় পরিবর্ত্তন বড়ই প্রীতিপ্রদ হইয়াছিল। আমরা প্রায় নয় দশ ক্রোশ অগ্রসর হইলে, আর এক নূতন দৃশ্য নয়নগোচর হইল—পূর্ব্বগগনপ্রান্তে এক স্থূলোজ্জ্বল লোহিত রেখা আমরা হঠাৎ দেখিতে পাইলাম, বন্ধু ইহা দেখিয়া প্রথমতঃ সূর্য্য বলিয়া ভ্রম করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহার পর হিসাব করিয়া দেখা গেল, সূর্য্যদর্শনলাভে এখনও কিঞ্চিৎ বিলম্ব আছে, তবে ইহা যে আশু সূর্য্য-উদয়-জ্ঞাপক লক্ষণ তাহাতে আর সংশয় থাকিল না। আমাদের অনুগত সহচর ঘটোৎকচ এই ভয়ানক উৎকণ্ঠা ও চিন্তার সময়ে একটি বড় কৌতুকাবহ ঘটনার অবতারণা করিয়াছিল; সে পূর্ব্বোক্ত দূরবর্ত্তী আলোক দেখিয়াই, এমন কোলাহল ও আহ্লাদ-সূচক লম্ফঝম্প করিতে লাগিল যে, তাহার অসাধারণ প্রফুল্লতার কারণ দেথিতে না পাইয়া, এ সকল নিশ্চয়ই তাহার বিকৃত বুদ্ধির পরিচায়ক বিবেচনা করিয়াছিলাম, এবং শেষে এই বর্ব্বর আমাদের কোন অনিষ্ট করে, এজন্য যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বনেরও চেষ্টা দেখিয়াছিলাম। কিন্তু পরে যখন সে আমাদের পদতলশায়ী হইয়া, তাহার অদ্ভুত জাতীয়ভাষায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতে লাগিল, তখন পূর্ব্বোক্ত ব্যবহার বাস্তবিকই বিকৃত মস্তিষ্কজ নয় বলিয়া স্থির করিলাম। বন্ধু, গুহাবাসকালে শুক্রবাসিগণের সহিত অধিকাংশ সময়ই থাকিয়া, তাহাদের ভাযাটা কতক আয়ত্ত করিয়াছিলেন; ঘটোৎকচের ঘোর চীৎকার হইতে সারসংগ্রহ করিয়া বন্ধু বলিলেন—“পূর্ব্বাকাশের এই লোহিতালোক শুক্রবাসীদের বড় পূজ্যসামগ্রী; যে ভাগ্যবান্ শুক্রবাসী জীবনে একবার মাত্রও, এই মহাতীর্থ দর্শন করিয়াছে, সে সমাজে বড়ই আদরণীয় ও স্বয়ং অতুল আত্মপ্রসাদ উপভোগ করে; আমাদের দ্বারা ঘটোৎকচের সেই মহাতীর্থ দর্শন হইল বলিয়া, সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছে।”

 এখন দিক্-নির্ণয় ও পথভ্রান্তি-নিবারণের জন্য আর নক্ষত্র পর্য্যবেক্ষণাদির আবশ্যক হয় না; আবশ্যক হইলেও তাহার উপায় ছিল না, পূর্ব্বগগনের আলোকে পশ্চিমাকাশের দুই একটি শুভ্রকান্তি নক্ষত্র ব্যতীত অপর কোন জ্যোতিষ্কই দৃষ্টিগোচর হইত না। আমরা আকাশপ্রান্তস্থ পূর্ব্বোক্ত লোহিতালোক লক্ষ্য করিয়া চলিতে লাগিলাম। কিছুকাল গত হইল কিন্তু উক্ত আলোকের বিশেষ কোন পরিবর্ত্তন লক্ষিত হইল না। এক দিবস স্থিরনেত্রে পরীক্ষা করিতে করিতে আলোকমধ্যে যেন এক শ্বেতবর্ণ পদার্থ দেখা গেল। পদার্থটি কি প্রথমে আমরা কিছুই স্থির করিতে পারি নাই, উভয়ে নানা পরীক্ষাদি করিয়া শেষে ইহা তুষারাবৃত কোন পর্ব্বতশৃঙ্গ বলিয়া স্থির করিলাম। আমরা আকাশে যে আলোক দেখিয়াছিলাম, তাহা যে বাস্তবিকই প্রত্যক্ষ সূর্য্যকিরণ নয়, এখন ইহা বুঝা গেল—তুষার-পর্ব্বতে সূর্য্যকিরণ প্রতিফলিত হইয়া যে, আকাশ রঞ্জিত হইয়াছে, তাহাতে আর সন্দেহ থাকিল না। দূরস্থ পর্ব্বত দেখিয়া আমরা সোৎসাহে প্রবলবেগে চলিতে লাগিলাম; প্রায় কুড়ি ঘণ্টার মধ্যে আমরা এতদূর অগ্রসর হইলাম যে, তুষার-ধবল পর্ব্বতের আমূল সকলই আমাদের দৃষ্টিগোচর হইল। আর কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়া আমরা সেই পর্ব্বতের তুষার-মণ্ডিত পাদদেশে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। নিকটেই একটি অনতিউচ্চ পাহাড় ছিল, আমরা বহুযত্নে পাহাড়ে উঠিলাম—তথা হইতে পর্ব্বতের সুমহান্ গম্ভীর দৃশ্য অতি সুন্দর দেখা যাইতে লাগিল। আমরা অন্য বিষয়ে মনোনিবেশ না করিয়া পর্ব্বতারোহণের সুযোগ অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলাম। বন্ধু কিয়ৎকাল চতুর্দ্দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, “এ পর্ব্বত উল্লঙ্ঘন-চেষ্টা বড়ই বিপদ্‌সঙ্কুল হইবে—এই পর্ব্বত শিলাময় নহে, ইহা একটা বৃহৎ তুষারপর্ব্বত।” বন্ধুর কথাটা তাঁহার পূর্ব্ব-প্রচারিত নানা আজ্‌গবি সিদ্ধান্তের অন্যতম ভাবিয়া, ইহাতে বড় মনোনিবেশ করি নাই; কিন্তু যখন দেখিলাম, এ পর্য্যন্ত পর্ব্বতে একখণ্ডও ক্ষুদ্র শিলা দৃষ্ট হয় নাই, তখন বন্ধুর কথা জোর করিয়া মিথ্যা বলার কোন কারণ নাই বিবেচনা করিলাম এবং পরক্ষণেই পর্ব্বত-শৃঙ্গোপরি ভাসমান লোহিতাভ মেঘখণ্ড সকল দেখিয়া, তাঁহার অনুমান যে সম্পূর্ণ সত্যমূলক, তাহাতে আর সন্দেহ রহিল না। আমরা উভয়ে বিষয়টির আলোচনা করিয়া, এই তুষারপর্ব্বতের উৎপত্তির কারণ পর্য্যন্ত আবিষ্কার করিয়াছিলাম। শুক্রের সূর্য্যকিরণোন্মুক্ত অংশ হইতে মেঘ সকল আসিয়া শীতল অন্ধকারাংশে প্রবেশ করিলে, শৈত্যাধিক্যে সকলই বরফ ও তুষারে পরিণত হইয়া, আলোক-আঁধারের সন্ধিস্থলে পতিত হয়; বহুকাল হইতে এই প্রকারে তুষার সঞ্চিত হইয়া, এক মহা পর্ব্বতের উৎপত্তি হইয়াছে; পার্থিব জ্যোতির্ব্বিদ্‌গণ দূরবীক্ষণ দ্বারা শুক্রমণ্ডল পরিদর্শন কালে, ইহার প্রান্তে যে উজ্জ্বল রেখা দেখিয়া থাকেন, তাহা যে এই তুষার পর্ব্বতই সূর্য্যকিরণোদ্ভাসিত হইয়া উৎপন্ন করে, তাহাও বুঝা গেল।

 এখন এই ভীষণ হিমপর্ব্বত উত্তীর্ণ হইয়া কি প্রকারে আমাদের গন্তব্যস্থান শুক্রের আলোকিতাংশে উপনীত হইব, তাহাই ভাবিতে লাগিলাম। ঘটোৎকচ পর্ব্বতারোহণ-কার্য্যে আমাদের বিশেষ সাহায্য করিয়াছিল—তাহার দীর্ঘ নখযুক্ত হস্তপদ দ্বারা অনায়াসে মসৃণ তুষারপর্ব্বত আরোহণ করিতে লাগিল, এবং তুষারে স্খলিতপদ হইবামাত্র, আমাদিগকে হইতে সাহায্য করিয়া উপরে তুলিতে লাগিল। মধ্যে মধ্যে পর্ব্বতের উচ্চ প্রদেশ মহা শব্দে বৃহৎ বরফখণ্ড পড়িতে লাগিল, তাহার বজ্রকর্কশ ধ্বনিতে আমার কর্ণ বধির ও সংজ্ঞা লোপের উপক্রম হইল। ঘটোৎকচের অবিরাম পর্ব্বতারোহণ-চেষ্টা ও বন্ধুর উৎসাহবাক্যে চালিত হইয়া, পর্ব্বতের অনেক উপরে উঠা গেল; এই সময়ে সুবর্ণ-গোলকের ন্যায় স্থির সূর্য্য আমরা প্রথমে নীলাকাশে উদিত দেখিয়াছিলাম; কিন্তু সেই মহা-শীতে ও আসন্ন মৃত্যুর সম্মুখে প্রথম সূর্য্যদর্শনের কবিত্বটুকু অনুভব করিতে পারি নাই—কখন্ একখণ্ড বরফ বজ্রনিনাদে অসিয়া তুষার-সমাধিতে চিরশায়িত করিবে, এই চিন্তায় তথন হৃদয় পূর্ণ ছিল। কত উচ্চে উঠিয়াছিলাম হিসাব করি নাই, তবে বহুকাল আরোহণ করিয়া আমরা যে একটি অপেক্ষাকৃত অল্পোচ্চ পর্ব্বতশিখরে আসিয়াছিলাম তাহা বেশ মনে আছে। আমরা সেই স্থানে দাঁড়াইয়া পর্ব্বতের অপর পার্শ্বে দৃষ্টিপাত করিলাম, নিম্নে বিশাল সমুদ্র ও ভাসমান বৃহৎ বরফস্তূপ ব্যতীত অপর কিছু দৃষ্টিগোচর হইল না। আমরা তুষার পর্ব্বতের যে স্থানে দণ্ডায়মান ছিলাম, তথা হইতে পর্ব্বতের পার্শ্বদেশ ক্রমনিম্ন হইয়া মৃত্তিকায় মিলিত হইয়াছে, তুষার পর্ব্বতের এই পিচ্ছিল ঢালু পার্শ্ব দিয়া স্থির পদে অবরোহণ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব বলিয়া বোধ হইল; আবার সে স্থান পরিত্যাগ করারও উপায় নাই দেখিলাম। আমাদের প্রিয় সহচর ঘটোৎকচও যেন এই অবস্থায় পড়িয়া কিছু ব্যতিব্যস্ত হইয়াছিল। আমরা অনুমান করিয়া দেখিলাম, পর্ব্বতশিখর হইতে শুক্রের আলোকিতাংশের সমুদ্র প্রায় অর্দ্ধ মাইল দূরে অবস্থিত। এই ক্রমনিম্ন পিচ্ছিল ব্যবধান উত্তীর্ণ হইবার জন্য, বন্ধুবর এক উপায় আবিষ্কার করিলেন—ঘটোৎকচের নিকট আমাদের একখানি বড় ছুরিকা ছিল, তাই দ্বারা মসৃণ বরফে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র খনন করিবার কৌশল, তাহাকে শিখাইয়া দিলেন; ঘটোৎকচ উপদেশ মত সেই প্রকারের ক্ষুদ্র সোপানাবলী নির্ম্মাণ করিয়া অবতরণ করিতে লাগিল; আমরা হস্তপদ দ্বারা সেই ছিদ্র অবলম্বন করিয়া নামিতে লাগিলাম। অত্যন্ত ভীত দেথিয়া, আমাকে অগ্রে নামাইয়া সর্ব্বপশ্চাৎ বন্ধু স্বয়ং অবতরণ করিতে লাগিলেন। এই প্রকারে কিয়দ্দূর অবরোহণ করিয়া হঠাৎ আমার সর্ব্বশরীর কম্পিত হইয়া পদস্খলন হইল; এই ভয়ানক বিপদে, আসন্ন মৃত্যুমুখ হইতে উদ্ধারের উপায়ন্তর না দেখিয়া, বন্ধুর পদদ্বয় অবলম্বন করিয়া পুনরায় ছিদ্রে পদ স্থাপন করিব ভাবিয়া, দৃঢ়মুষ্টিতে বন্ধুর পদযুগল জড়াইয়া ধরিলাম, কিন্তু বন্ধু আমার ভার বহন করিয়া দৃঢ়পদে থাকিতে পারিলেন না, তিনিও স্খলিতপদ হইলেন। আমরা উভয়ে এই প্রকারে জড়াজড়ি করিয়া, ক্রমনিম্ন পিচ্ছিল পর্ব্বত-গাত্র দিয়া পড়িতে লাগিলাম এবং পতনের সহিত আমাদের গতিও ভয়ানক বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইল। আমাদিগকে তদবস্থায় দেখিয়া ঘটোৎকচ ভয়ানক চীৎকার আরম্ভ করিয়াছিল, কিন্তু কিয়ৎকাল পরে বায়ুর শন্ শন্ শব্দ এতই বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়াছিল যে, অপর কোন শব্দই আর শুনিতে পাই নাই। প্রায় এক মিনিট এই প্রকারে নামিয়া আমরা সমুদ্রজলে পতিত হইলাম—পর্ব্বততলে বরফ বা শিলাদি কোন কঠিন পদার্থ ছিল না, নচেৎ আমরা সেই ভয়ানক বেগে পতিত হইয়া যে এককালে ধূলিসাৎ হইতাম তাহাতে আর সন্দেহ ছিল না। আমরা উভয়েই বিলক্ষণ সন্তরণ-পটু ছিলাম, পতনের পর অল্পায়াসেই অদূরবর্ত্তী এক বৃহৎ বরফখণ্ডে আশ্রয় গ্রহণ করিলাম।

 এই অভাবনীয় উপায়ে আমাদের জীবনরক্ষা হওয়ায়, আমরা একান্ত মনে জগদীশ্বরকে ধন্যবাদ প্রদান করিতে লাগিলাম; পা ধরিয়া টানিয়া বন্ধুকে এই মহা বিপদের সঙ্গী করায় আমি তাঁহার নিকট বড়ই লজ্জিত হইয়াছিলাম। ঘটোৎকচ যে প্রকার পর্ব্বতারোহণ-পারদর্শী তাহাতে শীঘ্র তাহার বিপদের কোনও সম্ভাবনা নাই জানিয়াও এখন সে কি প্রকার অবস্থায় আছে, আমরা তাহাই ভাবিতে লাগিলাম। এই সময়ে আমাদের নিকটেই উচ্চ কণ্ঠস্বর শ্রুত হইল। এই প্রাণিহীন তুষারপ্রদেশে কোথা হইতে শব্দ উৎপন্ন হইল দেখিবার জন্য চতুর্দ্দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করায় আমাদের পশ্চাতে, একখানি নৌকারোহণ করিয়া কয়েকটি লোক তীরবেগে আমাদিগকে লক্ষ্য করিয়া আাসিতেছে দেখিতে পাইলাম। মুহূর্ত্ত মধ্যে নৌকাখানি আমাদের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল; আরোহিগণ আমাদিগকে দেখিয়া বড়ই বিস্মিত হইয়া তাহাদের জাতীয় ভাষায় আমাদিগকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল; আমরা তাহাদের ভাষা কিছুই জানিতাম না, কাজেই কোন কথারই উত্তর দিতে পারিলাম না। অধিক বিলম্ব না করিয়া তাহারা আমাদিগকে নৌকায় উঠাইয়া, পর্ব্বতপ্রমাণ ভাসমান বরফের মধ্যস্থ সঙ্কীর্ণপথ দিয়া চলিতে লাগিল এবং অতি অল্প সময় মধ্যে অনতিদূরবর্ত্তী এক বৃহৎ জাহাজে উঠাইল। জাহাজস্থ ব্যক্তিমাত্রেই আমাদিগকে দেখিয়া মহা বিস্মিত হইল, জাহাজের চালক আমাদের সিক্তবসনাদি পরিবর্ত্তন ও আহারাদির ব্যবস্থা করিয়া দিলেন। এই শুক্রবাসিগণকে দেখিয়া আমরাও অতীব বিস্মিত হইয়াছিলাম; তাহাদের শারীরিক গঠনাদি সকলই মনুষ্যের ন্যায়, বরং ইহাদের ন্যায় কৃষ্ণকেশ উজ্জ্বলচক্ষু ও সুশ্রী মুখমণ্ডলযুক্ত মনুষ্য পৃথিবীতে প্রায়ই দুর্লভ বলিয়া বোধ হইল। কার্য্যতৎপরতা ও চালচলন দেখিয়া তাহারা যে, এক উদ্যমশীল উন্নতজাতিসম্ভূত, তাহা স্পষ্ট জানা গেল। জাহাজের প্রত্যেক কামরায় শীতনিবারণার্থ অগ্নি রক্ষিত হইয়াছে এবং আরোহিগণের সকলেরই শরীর স্থূল পশমী বস্ত্রে আবৃত আছে দেখা গেল। ইহারা যে কোন উষ্ণতর প্রদেশবাসী আমরা তাহা দ্বারা অনুমান করিলাম।

 এই শুক্রবাসিগণ কি কারণে বরফাবৃত সমুদ্রে আসিয়াছে, জানিবার জন্য আমরা চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু প্রথমে কৃতকার্য্য হইতে পারি নাই, পরে শুনিয়াছিলাম, আমাদের উল্লঙ্ঘিত তুষার পর্ব্বত ভেদ করিবার উপায়াবিষ্কারার্থে ইহার রাজব্যয়ে সমুদ্রযাত্রা করিয়াছে। আমরা আশ্রয়গ্রহণ করার কিছু পরেই জাহাজ ছাড়িবার আয়োজন হইতে লাগিল; কিন্তু কয়েকজন আরোহীসহ একখানি নৌকা তখনও প্রত্যাবর্ত্তন করে নাই বলিয়া, কিঞ্চিৎ বিলম্ব হইতে লাগিল। আমি এক সুসজ্জিত কামরায় অগ্নিপার্শ্বে বসিয়া আমাদের ভয়াবহ অতীত জীবনের কথা বন্ধুর সহিত আলোচনা করিতে লাগিলাম—ইতিমধ্যে জাহাজের বাহিরে এক মহা গোলযোগ উপস্থিত হইল, আমরা তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিয়া দেখিলাম, কয়েকটি শুক্রবাসী নৌকায় করিয়া আমাদের আজ্ঞাবহ ভৃত্য ঘটোৎকচকে লইয়া আসিতেছে এবং সে মহা চীৎকার করিতেছে। তাহাকে লইয়া সকলেই মহা ব্যতিব্যস্ত। আমাদিগকে দেখিয়াই ঘটোৎকচ একবারে আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হইল এবং পদতলে পড়িয়া মহোল্লাস প্রকাশ করিতে লাগিল। এই অদ্ভুত জীবটিও আমাদের সহচর জানিয়া জাহাজের চালক তাহার থাকিবার পৃথক ব্যবস্থা করিয়া জাহাজ ছাড়িয়া দিলেন। পরে শুনিলাম, ভ্রমণকারীদিগের মধ্যে কয়েকটি নৌকারোহণে তুষার পর্ব্বত পরীক্ষা করিতে গিয়া ঘটোৎকচকে একখণ্ড বরফে দাঁড়াইয়া চীৎকার করিতে দেখিয়াছিলেন এবং দুর্দ্দশা দেখিয়া ইহাকে তুলিয়া আনিয়াছিলেন।

 জাহাজ দ্রুতবেগে বরফমধ্যস্থ সঙ্কীর্ণ পথ দিয়া চলিতে লাগিল। এই দুর্গম প্রদেশেও সুন্দর জাহাজ-পরিচালন কৌশল দেখিয়া ইহারা অসাধারণ নৌবিদ্যাকুশল বলিয়া বোধ হইল। পরে অনুসন্ধান করিয়া দেখিলাম, এই সুবৃহৎ জাহাজ একটি যন্ত্র দ্বারা কেবল বৈদ্যুতিকশক্তি-প্রভাবে চালিত হইতেছে, এবং অধিক ভারগ্রহণোপযোগী করিবার জন্য ইহা আলুমিনিয়ম্ বা অপর কোন স্বল্পভার-ধাতু দ্বারা গঠিত হইয়াছে। সমুদ্রযাত্রার উপযোগী নানা অজ্ঞাতব্যবহার যন্ত্রাদি দেখিয়া, ইহারা যে বিশেষ সভ্য ও উন্নতজাতিভুক্ত তাহাতে আর সন্দেহ থাকিল না এবং সংসারের দৈনিক কার্য্যসাধনার্থে প্রাকৃতিক শক্তি নিয়োগে, ইহারা যে ধরাবাসী মনুষ্য অপেক্ষাও সিদ্ধহস্ত তাহাও বুঝিলাম। চালক আমাদের বড়ই যত্ন করিতে লাগিলেন, তাঁহার বিনীত ব্যবহার ও শিষ্টাচার কখনই ভুলিতে পারিব না। ঘটোৎকচের সুখস্বচ্ছন্দতার প্রতিও তাঁহার বিশেষ যত্ন দেখা গেল। বন্ধু এক সময়ে কথাপ্রসঙ্গে বলিলেন, ইহারা যে আমাদের পাইয়াই জাহাজ ছাড়িয়া দিয়াছে এবং তাহার পর এত যত্ন করিতেছে, ইহার একটি অতি গূঢ় কারণ আছে; আমাদের ন্যায় অদৃষ্টপূর্ব্ব জীব হস্তগত করিয়া, স্বদেশে উপস্থিত করিতে পারিলে, ইহারা বিশেষ পুরস্কৃত হইবে; তুষার পর্ব্বত ভেদোপায় আবিষ্কার অপেক্ষা এই অদ্ভুত জীবাবিষ্কার বোধ হয় তাহাদের নিকট অধিকতর সম্মানজনক। বন্ধুর এই অনুমান বড় অমূলক বলিয়া বোধ হইল না—আমাদের জন্য ভবিষ্যতের ক্রোড়ে আর যে কত বিপদ সঞ্চিত আছে, তাহাই ভাবিতে লাগিলাম।

 আমরা যখন তুষারসমুদ্র দিয়া চলিতে লাগিলাম, জাহাজের চালক প্রায়ই অবকাশ-কালে আমাদের নিকট আসিয়া বসিতেন, কিন্তু পরস্পর আমরা ভিন্নভাষাজ্ঞ হওয়ায় ব্যাক্যালাপে সুযোগ হইত না। নিশ্চেষ্ট হইয়া বসিয়া নানা দুশ্চিন্তার প্রশ্রয় দেওয়া আপেক্ষা ইহাদের ভাষা শিক্ষা করিবার বড় ইচ্ছা হইল; চালকও আমাদের বিশেষ বিবরণ জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। উভয়ের সমধেত যত্নে আমরা শীঘ্রই শুক্রবাসিগণের ভাষা আয়ত্ত করিলাম।

 ভাষাজ্ঞান-বৃদ্ধির সহিত শুক্রবাসিগণের সভ্যতা ও বৈজ্ঞানিক উন্নতির অনেক পরিচয় পাইতে লাগিলাম এবং বিজ্ঞানের অনেক অংশে ইহারা আধুনিক পাশ্চাত্য বিজ্ঞান অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর বলিয়া বোধ হইল। শুক্রবাসিগণ জ্যোতির্ব্বিদ্যায় মনুষ্য অপেক্ষা অনেক হীন দেখা গেল। শুক্রের এই অংশে সর্ব্বদাই স্থিরপ্রায় সূর্য্য বিকশিত থাকে বলিয়া, আলোকাধিক্য প্রযুক্ত গ্রহনক্ষত্রাদি পরিদর্শনের কোনই সুবিধা হয় না; বোধ হয় ইহাই তাহাদের এই হীনতার প্রধান কারণ। এতদ্ব্যতীত গগনমণ্ডল অধিকাংশ সময়ই যেরূপ ঘোর কৃষ্ণামেঘাচ্ছন্ন থাকে, তাহা দেখিয়া নিকৃষ্ট জোতিষিক জ্ঞানের জন্য, ইহাদের বুদ্ধিবৃত্তির উপর কোন দোষারোপ করা গেল না। জ্যোতিষ্ক-পরিদর্শনের এ প্রকার প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দেখিলাম ইহাদের দূরবীক্ষণ যন্ত্র আছে এবং তৎসাহায্যে তাহারা শুক্রকক্ষাভ্যন্তরস্থ বরুণগ্রহের (Mercury) গতি ও ইহার উপগ্রহণাদি (Transit) সম্বন্ধে নানা তত্ত্বও আবিষ্কার করিয়াছে। শুক্রগ্রহ সূর্য্যের নিকটবর্ত্তী হওয়ায় দেখিলাম পার্থিব বৈজ্ঞানিকগণ অপেক্ষা ইহারা সৌর-ব্যাপারের অনেক গূঢ় রহস্য সমাধান করিয়াছে, কিন্তু পৃথিবীর ন্যায় শুক্রের উপগ্রহ না থাকায়, ইহারা সূর্য্যগ্রহণ দেখিতে পায় না, কাজেই পূর্ণগ্রহণজাত সূর্য্যের ছটামুকুটই (Corona) বা কি পদার্থ সে বিষয়ে তাহারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ।

 শুক্রবাসিগণের এই জ্যোতিষিক অজ্ঞতাবশতঃ আমাদিগকে বড়ই কষ্ট পাইতে হইয়াছিল। শুক্রের ন্যায় পৃথিবী নামে একটা গ্রহ যে, সৌর-পরিবার মধ্যে আছে, ইহারা তাহা জানিত না এবং দেখাইবার কোন উপায়ও ছিল না। আমরা ঘটোৎকচের সহিত যে তুষার পর্ব্বত উল্লঙ্ঘন করিয়া এ প্রদেশে উপস্থিত হইয়াছি, তাহা বরং ইহাদের বিশ্বাস্য হইয়াছিল, কিন্তু আমরা যে বহুদূরস্থিত ধরাবাসী দুইটি জীব, তাহা কিছুতেই বিশ্বাস করাইতে পারি নাই। বহু বাক্‌বিতণ্ডায় আমরা যে শুক্রের আলোকিতাংশের জীব নহি, ইহা তাহারা বিশ্বাস করিয়াছিল, এবং আমরা যে অন্ধকারাচ্ছন্ন শুক্রবাসী, ইহা তাহারা স্পষ্ট বুঝিয়াছিল। যাহা হউক, আমরা যে অন্ধকারাবৃত শুক্রবাসী নহি, এবং ইতিপূর্ব্বে যে আমরা অনেকবার সূর্য্যমুখ দর্শন করিয়াছি, সৌর কৃষ্ণচিহ্নের (Dark spots) উল্লেখ করিয়া, তাহাদিগকে বুঝাইয়া দিলাম; আমরা যে, বরুণগ্রহের ন্যায় কোন একটি গ্রহের অধিবাসী অবশেষে তাহা ইহারা স্বীকার করিয়াছিল।

 শুক্রের আলোকিতাংশের অধিবাসিবর্গের পূর্ব্বোক্ত স্থূল বিবরণ জানিয়া এই অসাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন উন্নতজাতির আবাসস্থান ও তাহাদের প্রাত্যহিক কার্য্যকলাপ দেখিবার জন্য বড় উৎসুক হইলাম। এখন আর আমরা নিতান্ত নিরানন্দ ও ম্রিয়মাণ হইয়া থাকি না, অনেক সময়েই অহাজের চালক ও কর্ম্মচারীদের সহিত আমোদআহ্লাদে যোগ দিয়া সময় বেশ নির্ব্বিবাদে কাটিয়া যায়। কিন্তু বন্ধু যেন ক্রমেই বিমর্ষ হইতে লাগিলেন, বোধ হয় আমাদের এই আমোদআহ্লাদ তাঁহার সেই সাংসারিক সুখের স্মৃতি উত্তেজিত করিয়া দিয়াছিল। আপনি একদিন আমাদের নির্দ্দিষ্ট ক্ষুদ্র ক্যাবিনে আহারান্তে মুদ্রিত চক্ষে বিশ্রাম করিতেছি, বন্ধুবর ধীরপদে আসিয়া আমার নিকট উপবেশন করিলেন, এবং মুদ্রিতনয়ন হইলেও আমাকে সজাগ জানিয়া, শুক্রবাসীদের আচার-ব্যবহারাদি সম্বন্ধে নানা কথা বলিতে লাগিলেন। সেদিন বিমর্ষতার মাত্রাটা কিছু অধিক দেখিয়া প্রসঙ্গক্রমে তাঁহার এই হঠাৎ পরিবর্ত্তনের কথা জিজ্ঞাসা করায়, বন্ধুবর স্পষ্টই বলিলেন, “শুক্রের উভয়াংশে যাহা কিছু জ্ঞাতব্য বিষয় ছিল সকলই জানা গিয়াছে—শুক্রের তামসাচ্ছন্ন মহা প্রান্তর পরিভ্রমণকালে যে উৎসাহ ছিল তাহা আর কিছুই নাই, এখন যেন একটা ভয়ানক নিরুদ্যম ও অবসাদ আসিয়া হৃদয় আচ্ছন্ন করিয়াছে এবং সকলই যেন ঘোর নিরানন্দময় ও একঘেয়ে বলিয়া বোধ হইতেছে—”। বন্ধুর কথা শেষ না হইতে, কাম্‌রার বাহিরে এক মহা কোলাহল শুনা গেল, যেন কয়েকজন লোকে উচ্চৈঃস্বরে পরস্পর বিবাদ করিতেছে বলিয়া বোধ হইল। ব্যাপারটা কি দেখিবার জন্য কৌতূহলাবিষ্ট হইয়া চক্ষু খুলিয়া যেমন উঠিয়াছি, দেখিলাম আমার সেই ক্ষুদ্র বৈঠকখানা ঘরের কৌচের নিকট দাঁড়াইয়া রহিয়াছি! বুঝিলাম, আমি এ পর্য্যন্ত কৌচেই শায়িত ছিলাম; নীচের ঘরে আমার এক উড়িয়া বেহারার সহিত এক দেশীয় ভৃত্যের মহা ঝগড়া আরম্ভ হইয়াছে। উভয়েই যথাসাধ্য চীৎকার করিতেছে। যদিও উভয় ভৃত্যই এক নির্দ্দিষ্ট হারে বেতন পাইত, তথাপি প্রাধান্য লইয়া তাহাদের মধ্যে প্রায়ই বিবাদ হইত, এবং প্রত্যেকে অপরের উপর যথাসাধ্য প্রভুত্বস্থাপনের প্রয়াস পাইত; আজও যে সেই পুরাতন প্রাধান্য-প্রশ্নের মীমাংসার জন্য এই গোলযোগ, এবং এই গোলযোগই যে আমার সুখস্বপ্ন ভঙ্গের কারণ তাহা বুঝিতে পারিলাম। তথম রাত্রি আট্‌টা বাজিয়া গিয়াছে। ঘরের মেজের উপর মিট্ মিট্ করিয়া সেজ জ্বলিতেছিল। বন্ধুর অনুসন্ধানে পার্শ্বে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিলাম, তাঁহার অধিকৃত কেদারা খানি শূন্য পড়িয়া রহিয়াছে। স্বপ্নদর্শনকালে বন্ধু কি প্রকার অবস্থায় ছিলেন জানিবার জন্য অত্যন্ত উৎসুক হইলাম, বিলম্ব না করিয়া তাঁহার বাড়ী গেলাম। দেখিলাম বন্ধু বড় ব্যস্ত এবং তাঁহার স্বভাবগম্ভীর মুখমণ্ডল অত্যন্ত প্রফুল্ল, তিনি স্বপ্ন-সম্বন্ধে কোন কথাই জানেন না দেখিয়া দুই এক কথার পর তাঁহার নিকট বিদায় গ্রহণ করিলাম, এবং পরদিবস উভয়ে মিলিয়া স্বপ্নদৃষ্ট ব্যাপারের আলোচনা করিব বলিয়া স্থির করিলাম। সে রাত্রে আর নিদ্রা হইল না, গৃহিণী অবশ্যই আসন্ন অসুখের আশঙ্কা করিয়াছিলেন, কিন্তু দিবসে বিলক্ষণ নিদ্রা হইয়াছিল বলিয়া কোন অসুখই হয় নাই। প্রাতে শুনিলাম একটি অস্থায়ী চাকুরীর পরোয়ানা পাইয়া, বন্ধু সেই রাত্রেই বিদেশযাত্রা করিয়াছেন। রাত্রে আমার সহিত সাক্ষাৎ হইলে এ শুভসংবাদ আমাকে বলেন নাই ভাবিয়া মনে একটু খট্‌কা থাকিল। যাহা হউক সেই অবধি এই অদ্ভুত স্বপ্নের কথা কাহাকেও বলি নাই।

                 সম্পূর্ণ

========∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆======







No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। পশুপতি ভট্টাচার্য । খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। Dt -15.11.2024. Vol -1053. Friday. The blogger post in literary e magazine

পশুপতি ভট্টাচার্য  ১৫ নভেম্বর ১৮৯১ -  ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৮   একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। জন্ম  বিহার রাজ্যে পিতার কর্মস্থল আরায়। তাদ...