নিসর্গজাত কবি। স্বভাব কবিও বলা যায়। কাব্য প্রতিভা তাঁর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। কবিতাই ছিল তার আরাধনা বা আরাধ্য দেবতা। মনোজগতের আরাধ্য বেদিতে কবিতাকে ঠাঁই দিয়েছিলেন। ষাটের দশকের এ কবি মূলত প্রেম ও রোমান্টিকতা, নিসর্গ ও সৌন্দর্য চেতনায় নিমগ্ন ছিলেন। তিনি রোমান্টিক প্রেমের ও সৌন্দর্যচেতনার কবি হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। কাব্যের অনুষঙ্গ হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন নারী, নিসর্গ ও গ্রামবাংলার ঐতিহ্যকে। তার কবিতায় উপমা ও উৎপ্রেক্ষা অসাধারণ ও বিচিত্রতায় পরিপূর্ণ যা শিল্প মাধুর্যে ভরপুর। আপন মনে শিল্পীর আঁচড়ে তিনি কবিতাগুলোকে শিল্পমানে রূপ দিয়ে পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থ ৪১টি। ৩৮টি কাব্যগ্রন্থ, একটি ছড়ার বই ও দু’টি উপন্যাস। তিনি ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ কাব্যটি রচনার জন্য ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং কাব্য সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৭ সালে মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন।
কবির জন্ম ২০ অক্টোবর, ১৯৩৯ চরশিবরামপুর গ্রামে মাতুলালয়ে। পাবনা জেলার সদর উপজেলায়। পিতা মো. উজির আলী, মাতা আহ্লাদী খাতুন। পিতার নিবাস ছিল পাশেই পদ্মা নদীর কাছাকাছি চরঘোষপুর গ্রাম। গ্রামবাংলার প্রকৃতি ও পদ্মার নৈসর্গিক পরিবেশ কবির মনকে সর্বদা ব্যাকুল করে রাখত। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর কবি ৭৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
কর্মজীবনে তিনি একসময় ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার বার্তা বিভাগে সাব-এডিটর পদে কর্মরত ছিলেন। এই চাকরি ছেড়ে দিয়ে পাবনা শহরের মহিমচন্দ্র জুবিলি হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। এটাও ছেড়ে দিয়ে তিনি কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামাড়া কলেজে ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক পদে যোগদান করেন। তারপরও তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। পরবর্তীতে তিনি পাবনা শহরে অবস্থিত শহীদ বুলবুল কলেজে ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক পদে যোগদান করেন। এটি সরকারিকরণ হওয়ায় তিনি শেষ পর্যন্ত সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক (ইংরেজি) পদে উন্নীত হন। ১৯৯৯ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
তার কবিতায় মানব-মানবীর ভালোবাসার বর্ণনা শিল্প মাধুর্যে ফুটে উঠেছে। তিনি ভালোবাসার পূজারি হয়ে ভালোবাসাকে অবলীলায় কাব্যসাহিত্যে তুলে ধরেছেন। ভালোবাসাকে অমৃতের ন্যায় পান করেছেন। ভালোবাসা নিয়ে খেলেছেন। ভালোবাসার সুধায় তিনি নিমগ্ন থাকতেন। সর্বদা ভালোবাসার জয়গানে উন্মুখ ছিলেন। কবির মন ভালোবাসায় কাতর। তিনি অকাতরে ভালোবাসার জন্য প্রেমিক সেজে নারীর কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। প্রিয়তম সেজে প্রিয়তমার কাছে শরীর, মন এবং সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে মধুর অনুভবে গ্রহণ করার জন্য আকুতি জানিয়েছেন। ভালোবাসা তো যেকোনো মানুষের কাছেই হৃদয়ের ধ্যান-জ্ঞান। কবি প্রেমিকাকে সবচেয়ে মধুর শব্দ যা একজন প্রেমিকের কাছে অতি প্রিয় শব্দ, সাধনা বা বাসনার শব্দ ‘প্রিয়তমা’ বলে হৃদয়ের সকল কিছু সমর্পণ করেছেন। তাইতো তিনি ‘সেই নারী তুমি’ কবিতায় অকপটে বলেন-
তুমি সেই নারী, যাকে পৃথিবীর একটি পুরু
ভালোবেসে ডেকেছিল, এসো, তুমি প্রিয়তমা হবে।
বলেছিল, ‘তুমি মোর ভালোবাসা তুলে নাও, নারী
তোমার শরীরে, মনে, সমস্ত মধুর অনুভবে
তিনি প্রেয়সীকে সাজাতে ভালোবাসেন। প্রেয়সীর গালে তিল থাকবে, সুকোমল ঠোঁট আর সুদীর্ঘ কালো চুল থাকবে আর কপালে টিপ পরবে। কপালে টিপ পড়লে প্রেয়সীকে আরও মিষ্টি ও সুন্দর দেখায়। সুদীর্ঘ কালো চুলে খোপা বাঁধবে। ফুল দিয়ে খোপা সাজাবে আর তখনই কবির সাধ জেগে উঠবে আলিঙ্গন করার। এই প্রেয়সী ছাড়া কবির সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার। আলোহীন পৃথিবী কবিকে নিরাশার অনলে দগ্ধ করবে। কবি প্রেমের অমর গীতি খুঁজে পাবে না। বিরহ-বেদনায় রাত্রি বিষাদে বিষাদে বিষের ন্যায় নীল হয়ে যাবে। এইসব সুখের দিন দুঃখে ভরে যাবে। সমস্ত আনন্দ, বেদনায় ভরে যাবে। তাই কবি ‘প্রেয়সী’ কবিতায় বলে ওঠে
তোমার কপালে টিপ, তাই তুমি অত্যন্ত সুন্দরী
……………………………………………
প্রিয়তমা, তোমার গালের তিলে, সুকোমল ঠোঁটে
বারবার চুমো খাই। তোমার সুদীর্ঘ কালো চু
বুলাই আমার হাত। ও-চুল সাজাও তুমি ফুলে
তোমার সুন্দর চোখ, সন্ধ্যার আকাশে তারা ফোটে
কবির হৃদয় ব্যাকুল কণ্ঠে কেঁদে ওঠেন। কেঁদে ওঠেন, পৃথিবীর নির্জনতা, নিস্তব্ধতা দেখে। আবার ব্যাকুল হয়ে পড়েন, কর্মের গতিকে অনুভব করে। তিনি বসে বসে ভাবেন, পৃথিবীতে এতো ফুল ফোটে, এতো পাখি ডাকে, এতো এতো ফল ধরে। কী কারণে! কীসের আশায়! নদীই বা বয়ে যায় কেন? এতো কিছু ভেবে ভেবে কবির মন স্তব্ধ হয়। কবির মনে ভাবনার সীমা পরিসীমা থাকে না। তখন একটাই উত্তর, অন্তরে ঘুরপাক খায়। সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে একজন নিয়ন্ত্রণ করেন। সে আর কেউ নন। মহান সৃষ্টিকর্তা। ফলের মতো, ফুলের মতো, প্রজাপতির মতো আমাদেরও শরীর নশ্বর। তাই কবি, ‘নশ্বর শরীর’ কবিতায় অন্তরের ভাবনার কথা নিমগ্নতায় আকুলভাবে তুলে ধরেছেন-
অজস্র ফুলের শেষ কোথায় কি নিমিত্ত মৃত্তিকা
ধরায় অশেষ ফল, কি উদ্দেশ্যে বয়ে যায় নদী
আর উপলব্ধি করি, কেন বায়ু, রৌদ্রের ভ‚মিকা
আমার সম্মুখে স্পষ্ট হয় কোন শস্যের ঔষধি।
কবি নারীর সুরভিতে নিমগ্নতায় মেতে ওঠেন। তিনি গেয়ে ওঠেন, বিজয়ের জয়গান। নারীর দৃঢ় আলিঙ্গনে, মধুর চুম্বনে কবির আনন্দ জাগে। কবির মন তৃপ্ত হয়। ঠোঁটের মধুমদে কবি ভেসে যান অপার আনন্দের মধুরসে। নারীর সুরভি কবিকে অলস করে তোলে, নিশ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হয়, দেহে আলাদা শিহরণ জাগে। নিরিবিলি সুখময় রাতে নারীর আলিঙ্গন কবিকে এক আলাদা অনুভূতির জগতে নিয়ে যায়। কবির মনে কামনার আশা জাগে, বাসনা জাগে বুকের মাঝে স্বপ্নের ঢল নামে। রঙিন জগতের আশায় কবি জয়গানে মুখরিত হয়। তাইতো কবি ‘তোমার সুরভি’ কবিতায় বলে ওঠেন-
তোমার শরীর থেকে মধুর সুরভি ভেসে আসে,
আমার কাছেই তুমি রয়েছ দাঁড়িয়ে ঘন হয়ে,
তোমার সুরভি আনে অলসতা আমার নিশ্বাসে,
আমার শরীর কাঁপে শিহরণে, আনন্দের জয়ে।
কবি ওমর আলী অকাতরে জন্মভূমির প্রতি ভালোবেসেছেন। মনে-প্রাণে তিনি জন্মভূমিকে মায়ের সাথে তুলনা করেছেন। এই অপার সৌন্দর্যের দেশকে তিনি ব্যাকুলভাবে ভালোবেসেছেন। তিনি ভালোবেসেছেন আকাশ, নদী, বালুচর। এ দেশের সবুজ-শ্যামল রূপ যা কবির মনকে আকুল করে। কবি টুনটুনি, দোয়েল পাখি দেখে অবাক হয়। তিনি মনটাকে উজার করে দেখেন আর ভাবেন, আমন ধানের খেতে হাঁসগুলো কীভাবে যাওয়া আসা করে! কীভাবে তারা খেলে! কীভাবে সাঁতার কাটে! কীভাবে বাঁশের ঝাড়ে সন্ধ্যার সময় পাখিরা কিচির-মিচির করে। কী অপরূপ দৃশ্যে সন্ধ্যা নেমে আসে। এইভাবে জন্মভ‚মির প্রতি কবি অবাক বিস্ময়ে চোখ মেলে দেখেন। কবি উদাত্ত কণ্ঠে ‘জন্মভ‚মি’ কবিতায় বলে ওঠেন-
ভালোবাসি জন্মভূমি তোমায় আমি ভালোবাসি
মন ভুলানো আকাশ নদী এবং সবুজ রূপের রাশি।
এতো তোমার পাখির কণ্ঠ এতো তোমার ফুলের সুবাস
এতো তোমার গাছগাছালি চির সবুজ রয় বারো মাস।
হেমন্ত রিক্ততা ও শূন্যতার ঋতু। কিন্তু কবি ওমর আলীর কাছে এ ঋতুর মিঠে রোদ মন ভোলায় মনকে তৃপ্ত করে, আনন্দ বিলায়। কবি তার কোষাখালি গ্রামের হেমন্তের অপরূপ দৃশ্য নিখুঁতভাবে এঁকেছেন। হেমন্ত ঋতুতে কবি এ দেশের গ্রামের দৃশ্য বর্ণনা করেছেন। মানব মনের সাধ যেন এদেশের অপরূপ রূপ দেখে মেটে না। উঠোনে চাঁদের খিলখিল হাসি, কুয়াশা হিমেল সুখ, পথের পাশে বেড়ে ওঠা ঘাসের দেওয়াল, নূপুর কোমল মুঠো মুঠো পাখি সবই কবির মনকে আনন্দ দান করে। কবি তাই ‘এই তো আমার দেশ’ কবিতায় বলেন-
হেমন্তের মিঠে রোদ মমতা ছড়িয়ে দেয় কোষাখালি গ্রামে
পঁচিশ তিরিশ আর তারো বেশি বছর কেটে গেলেও যেন
মেটে না মনের সাধ বাঁশ আম কাঁঠাল বাগানে সাঁঝ নামে
পরিশেষে সাঁঝবেলায় জীবনের সবকিছু হিসেব-নিকেশ মিলাতে গিয়ে কবি জীবনকে তুষের আগুনের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি ফেলে আসা অনুষঙ্গগুলোকে আবার হেরে যাওয়া বা পরাজিত হওয়া বিষয়গুলোকে যোগ বিয়োগের খাতায় মেলাতে চেষ্টা করেন। এতে হেরে যান। কবি জীবনকে আঠা দিয়ে মুখ আটকানো খামের সাথে তুলনা করেছেন। সংগোপনে পোড়া, পিপাসার্ত নদী আবার পিছন ফিরে তাকানো কতো ছবির উদাহরণ এই জীবন। কবির হৃদয় তো আয়নার মতো স্বচ্ছ। তিনি তার অন্তর চোখ মেলে সবকিছু দেখতে পান যা সাধারণ মানুষ এগুলোকে দেখতে পায় না। কবি এই বিকেলবেলায় এসে ‘জীবন’ কবিতায় ঝাপসা চোখে কেঁদে ওঠেন আর বলে ওঠেন-
জীবন মানেতো তুষ ভরা আস্তে আস্তে গভীর ভিতরে
সংগোপনে পোড়া
জীবন মানেতো তুমি পিপাসার্ত নদী যৌবনের ভারে ক্লান্ত
শরীরে ও মনে
ফিরে যেতে চাইবে আর সকরুণ তাকাবে পিছনে…
কবি ওমর আলীকে দু-চারটি কথা দ্বারা মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে কবি ওমর আলীর কবিতা আমাদের জীবনের নানা ঘাত-অভিঘাতের দ্বারা অভিসিক্ত। তার কবিতাগুলো পড়লে আমরা জীবনের নানা দিক দেখতে পাই। কোনো এক মনীষী বলেছেন, ‘জীবনতো একটা নিস্তরঙ্গ জলধারার মতো নয়, প্রতি পদে পদে শৃঙ্খলিত। গতিই তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।’ এই কথার সত্যতা কবি ওমর আলীর কবিতায় স্পষ্ট। তার কবিতার প্রতিটি পঙক্তি মানবজীবনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। মানুষের জীবনে দুঃখ আছে, পশুবৃত্তি আছে, দাসত্ব আছে, ঘাত-অভিঘাত আছে, মিলনের আকাক্সক্ষা আছে, বিরহ আছে, প্রেম আছে, আদিম প্রবৃত্তি আছে, রতিক্রিয়া আছে। এসব কিছুই কবি ওমর আলীর কবিতায় স্থান পেয়েছে।
ওমর আলীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি প্রকাশিত হয় ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে।
কবিতাগ্রন্থ
"অরণ্যে একটি লোক" (১৯৬৬),
"আত্মার দিকে" (১৯৬৭),
"সোনালি বিকেল" (১৯৬৫),
"নদী""(১৯৬৯),
"নরকে বা স্বর্গে" (১৯৭৫),
"বিয়েতে অনিচ্ছুক একজন" (১৯৭৫),
"প্রস্তর যুগ তাম্র যুগ" (১৯৭৪),
"স্থায়ী দুর্ভিক্ষ সম্ভাব্য প্লাবন" (১৯৭৫),
"তেমাথার শেষে নদী" (১৯৭৪),
"নিঃশব্দ বাড়ি" (১৯৭৩),
"কিছুদিন" (১৯৮০),
"ডাকছে সংসার" (১৯৮৫),
"যে তুমি আড়ালে" (১৯৮৭),
"ফুল পাখিদের দেশ" (১৯৮৩),
"ফেরার সময়" (১৩৯৬),
"স্বদেশে ফিরছি" (১৯৭৯),
"একটি গোলাপ" ১৯৬৮,
"লুবনা বেগম" (১৯৯৩),
"প্রসারিত করতল" (১৯৯২),
"ছবি" (১৯৯০),
"শুধু তোমাকে ভালো লাগে" (১৯৯৪),
"তোমাকে দেখলেই" (১৯৯৫),
"ভালোবাসার দিকে" (১৯৯১),
"এখনো তাকিয়ে আছি" (১৯৮৭),
"ভালোবাসার প্রদীপ" (১৯৯৬),
"হৃদয় ছুঁয়ে আছে ঝড়" (১৯৯৮),
"গ্রামে ফিরে যাই" (১৯৯৮),
"আমার ভেতরে খুব ভাঙচুর হচ্ছে" (২০০১),
"শ্রেষ্ঠ কবিতা" (২০০২)।
উপন্যাস
কুতুবপুরের হাসনা হেনা" (১৯৮২) এবং
খান ম্যানসনের মেয়ে" (১৯৬২)।[৪]
পুরস্কার
বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১)
বন্দে আলী মিয়া পুরস্কার]] (১৯৮৮)
আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১)
একুশে পদক (মরণত্তর) (২০১৭)
রক্ত-কান্না-লাশ-সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত প্রিয় এ স্বদেশভূমির করুণ এ অবস্থা কবিকে বেদনা ভারাক্রান্ত ও হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। স্বপ্নের কথাও আছে তাঁর কবিতায়। যে স্বপ্ন নিয়ে একদিন এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল। সকলের মতো তিনিও সেই স্বপ্ন দেখেন ‘সংসারের দেউড়ী থেকে পেছনের খিড়কি দুয়ার পর্যন্ত শুধু সুখ’। সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়েই তো এদেশ স্বাধীন হয়েছিল। সুখী-সমৃদ্ধ দেশ অর্জনের জন্যেই তো অনেক রক্ত আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে এদেশ কিনতে হয়েছে। কবিওতো এদেশের এক স্বপ্নবান মানুষ। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে সুন্দর সুফল সুখবতী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন।
আবেগ-প্রবণতা ওমর আলীর কবিতার একটি বিশেষ দিক। মানবিক-প্রবৃত্তি ও হৃদয়গত সম্পর্কে যে আবেগের মূল জায়গায় এ সত্য কবিও উপলব্ধি করেছেন। মানসপ্রিয়ার সবকিছুতেই আবেগ অনুভব করে প্রেমিকপুরুষ-হৃদয়তাড়িত হয়ে ওঠে-এক অন্যকেম ভালোলাগা যে তাকে মুগ্ধতায় বেঁধে রাখে-ওমর আলী কবিতায় সেই অপরিহার্য-আবেগ প্রবণতা উঠে এসেছে নানাভাবে।
ওমর আলী কবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত। বাংলা কাব্যসাহিত্যে তিনি জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদদীন ও বন্দে আলী মিয়ার যোগ্য অনুসারী হলেও তিনি নিজস্ব স্টাইল ও ইমেজ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর কবিতার বিষয়-বস্তু শব্দ অলঙ্কার বর্ণনায় মৌলিকত্বের শক্ত ছাপ রাখতে পেরেছেন। এ দেশের মাটির নিখাদ গন্ধ বুকে মেখে তিনি কবিতা সৃষ্টি করেছেন। তাঁর কবিতাও হয়ে উঠেছে নিখাদ মাটির গন্ধভরা। ওমর আলী এখানেই অনন্য ও বিশিষ্টতার দাবিদার।
ওমর আলীর কবিতার বিষয়বস্তু গ্রামীণ জীবন-সমাজ ও পরিবেশনির্ভর হলেও, চেতনাগতভাবে বহুমাত্রিকতা আছে। দৈনন্দিন বলা যেতে পারে ওমর আলী ত্রিশের যে স্রোত ত্রিশের সীমানা পেরিয়ে ষাটেও দিব্যি প্রভাব-রাজত্ব বিরাজ করে চলছিল, ওমর আলী সে-ধারা থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসা স্বতন্ত্রধারার এক কবি। যেখানে তাঁর দেশ-মাটি-মানুষই প্রধান ও আরাধ্য। তাঁর হাতেই এখান থেকে বাংলা কবিতা আর এক নতুন বাঁক পায়।
নিবিড় কবিতা পাঠ। (প্রেমের কবিতা)
১.
এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি
এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি
আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসি মাখা;
সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকায় রোদ্দুরে,
রূপ তার এদেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা।
সে শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে হরিণীর মতো
মায়াবী উচ্ছ্বাস দুটি চোখ, তার সমস্ত শরীরে
এদেশেরই কোনও এক নদীর জোয়ার বাঁধভাঙা;
হালকা লতার মতো শাড়ি তার দেহ থাকে ঘিরে।
সে চায় ভালোবাসার উপহার সন্তানের মুখ,
এক হাতে আঁতুড়ে শিশু, অন্য হাতে রান্নার উনুন,
সে তার সংসার খুব মনে-প্রাণে পছন্দ করেছে;
ঘরের লোকের মন্দ-আশংকায় সে বড় করুণ।
সাজানো-গোছানো আর সারল্যের ছবি রাশি রাশি
ফোটে তার যত্নে গড়া সংসারের আনাচে-কানাচে,
এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর এ ব্যাপারে খ্যাতি;
কর্মঠ পুরুষ সেই সংসারের চতুষ্পার্শ্বে আছে।
২.
আমি কিন্তু যামুগা
আমি কিন্তু যামুগা। আমারে যদি বেশি ঠাট্টা করো।
হুঁ, আমারে চেতাইলে তোমার লগে আমি থাকমু না।
আমারে যতই কও তোতাপাখি, চান, মণি, সোনা।
আমারে খারাপ কথা কও ক্যান, চুল টেনে ধরো।
আমারে ভ্যাংচাও ক্যান, আমি বুঝি কথা জানি না কো।
আমার একটি কথা নিয়ে তুমি অনেক বানাও।
তুমি বড় দুষ্টু, তুমি আমারে চেতায়ে সুখ পাও,
অভিমানে কাঁদি, তুমি তখন আনন্দে হাসতে থাকো।
শোবো না তোমার সঙ্গে, আমি শোবো অন্যখানে যেয়ে
আর এ রাইতে তুমি শুয়ে রবে একা বিছানায়,
দেখুম ক্যামন তুমি সুখী হও আমারে না পেয়ে,
না, আমি, এখনি যাইতেছি চলে অন্য কামরায়।
৩.
এখন পালাও দেখি
এখন পালাও দেখি! বন্ধ করে দিয়েছি দরোজা!
এ রাত্রিতে, আমার দু’হাত থেকে পারো না পালাতে।
বরং সেটাই মেনে নেওয়া ভালো, যা নির্ঘাত সোজা।
আমার আলিঙ্গনে বেঁধে থাকো এ সুন্দর রাতে।
মিছেমিছি কেন তুমি রাগ করে চলে যেতে চাও!
বেশ তো, আমার সাথে আজ রাতে কথা বলবে না।
হয়েছে তোমার রাগ, আলাদা কি হবে বিছানা?
অন্যখানে শুতে যাবে, কিছুতেই হবে না, হবে না!
চামেলী, মালতী আর রজনীগন্ধার সুরভিতে
তোমার বিত্ত্বল দেহ, সে সুরভি সারা ঘরময়,
আর সে সুরভি যেন কেঁপে ওঠে তোমার নাভিতে।
রাত্রিতে তোমাকে ছেড়ে একা থাকা… বড় কষ্ট হয়!
হে অভিমানিনী, আমি অসহায়, বড়ই কাতর,
প্রেয়সী, মিষ্টি হেসে ক্ষমা করো, তুমি নও পর।
৪.
বৈশাখে তোমাকে ভালোবাসি
বৈশাখে আবার আমি তোমাকে ভালোবাসি।
স্বপ্নে চলে যাই আমার সুদূর ভেনিসে,
গণ্ডোলায় বসি মুখোমুখি সারারাত,
ধুয়ে যাচ্ছে পৃথিবী জ্যোৎস্নায়
ধুয়ে যাচ্ছি তুমি আর আমি।
ফিরে আসি, আবার আমরা ফিরে আসি চট্টগ্রামে,
কর্ণফুলীতে খুলে দিই একটি নতুন সাম্পান,
বৈঠা আমার হাতে আর তুমি দুটো হাত
রেখেছো আমার দুই কাঁধে,
বাতাসে তোমার রাত্রি কালোচুলের বিপুল সুগন্ধ।
যুগল চাঁদের ছবি খুলে যায়
তোমার বুকে।
বৈশাখের চাঁদ মুখ টিপে হাসে আমাদের
দুজনের মাথার উপরে।
তুমি আমার গান, তুমি আমার সুমধুর সুর,
তোমার ভালোবাসার ফিসফিস কথাগুলো
একবার গণ্ডোলায় একবার সাম্পানের পাটাতনে,
পানির সিম্ফনিতে কী যে মিষ্টি বেজে ওঠে,
জার্মানির বেটোফেন এই সুর সৃষ্টি করেছেন।
চাকমা ইটালিয় যুবতীর খিলখিল হাসি।
বৈশাখে তোমাকে আমি ধুয়ে মুছে
সাফ সুতরো করে
আবার নতুন করে ভালোবাসি।
আবার আমাদের ভালোবাসা শুরু করি
নতুন বঙ্গাব্দে,
কালবৈশাখী যাতে আমাদের এই ভালোবাসা
ভেঙে না ফেলে, যাতে উড়িয়ে না-নেয়, উপড়ে না-ফেলে,
আমরা নতুন খুঁটি লাগাই আমাদের ভালোবাসার চারপাশে।
শেষ পর্যন্ত চাঁদ ডুবে যাবে, নক্ষত্র ডুববে আকাশে,
ভালোবাসার সাম্পান গণ্ডোলা ডুববে না।
এই শুভ কামনায় তোমার ঠোঁটের মিষ্টি
আমার দু’ঠোঁটে।
৫.
কবিতা ঝরে বৃষ্টি ঝরে
কবিতা ঝর ঝর করে ঝরে, সাদা নুড়ির মতো ঝর্ণা
টিএস এলিয়ট, মালার্মে, রবীন্দ্রনাথ, ওমর আলীর হাতের ওপরে কবিতা ঝরে বৃষ্টি ঝরে
কবিতা মনের মধ্যে এক খণ্ড সীমানা চৌহদ্দির জমির ওপরে
ঝরে যায় বহুক্ষণ ঝরে যায় বৃষ্টি
ওপরে মেঘ বিজলির চমক বজ্রপাত হতে থাকে
বিরহী যক্ষ কৈলাসগিরি থেকে মেঘদূত প্রেরণ করেন প্রিয়ার উদ্দেশে
আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে
কবিতা ঝর ঝর করে ঝরে শিশির মুক্তা হোমারের মনের ওপর
অন্ধ হোমার গেয়ে যান ইলিয়াড ও ওডিসি
সুন্দরী হেলেনকে নিয়ে যান প্যারিস প্রিয়ামের পুত্র
ট্রয়ের যুদ্ধ হয় কাঠের ঘোড়া তৈরি হয় হেক্টর মারা যান
অ্যাকিলিস মারা যান
পৃথিবী কোটি কোটি বছর ঘুরতে থাকে নিয়মমতো
এক মুহূর্তের জন্যও থামে না।
মানুষের জন্ম হয় মৃত্যু হয় কবি স্যাফোর জন্ম-মৃত্যু হয়
খলিল জিবরানের জন্ম-মৃত্যু হয়
কবিতা ঝর ঝর করে ঝরে শাদা নুড়ির মতো ঝর্ণা
টিএস এলিয়ট, মালার্মে, র্যাঁবো, বোদলেয়র, রবীন্দ্রনাথ,
কালিদাস, ওমর আলীর হাতের ওপর
কবিতা ঝরে... বৃষ্টি ঝরে...
=========∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆===========
No comments:
Post a Comment