বাংলা আধুনিক কবিতায় জীবনানন্দ দাশ প্রেমেন্দ্র মিত্র বুদ্ধদেব বসু অচিন্ত্য সেনগুপ্ত অজিত দত্ত প্রমূখ কবিদের উত্তরসূরী হয়ে চারের দশকের দুই উল্লেখযােগ্য কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায় এবং নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। উভয় কবিই প্রায় বিংশ শতকের অজস্র উত্থান-পতন, যুদ্ধ ও শান্তি, প্রেম ও প্রতিবাদ, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও ফ্যাসিবিরােধী আন্দোলন, মৌলবাদ ও সাম্যবাদ, আদর্শ ও আদর্শবিচ্যুতি, স্বাধীনতার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, অসংখ্য নির্মাণ ও ধ্বংসের সাক্ষী হয়ে প্রগাঢ় অভিজ্ঞতা ও অনুভবকে কবিতার সহজ বিন্যাসে উচ্চারণ করেছেন।
কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর জন্ম ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে। তার পিতা ছিলেন ইংরাজি ভাষা-সাহিত্যের খ্যাতনামা অধ্যাপক। নীরেন্দ্রনাথের শৈশবশিক্ষা বাংলাদেশের গ্রামের পাঠশালায়। এর পর থেকেই তিনি কলকাতার অধিবাসী এবং বিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষাও কলকাতাতেই।
শিক্ষান্তে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন নীরেন্দ্রনাথ। 'দৈনিক প্রত্যহ', 'মাতৃভূমি', 'স্বরাজ', 'ভারত', 'সত্যযুগ' প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি বিভিন্ন সময় সাংবাদিকতার কাজ করেছেন। বিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭৬ থেকে তিনি 'আনন্দমেলা' পত্রিকার সম্পাদক হিসাবেও কাজ করেছেন দীর্ঘদিন।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'নীলনির্জন' প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া তার অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ 'অন্ধকার বারান্দা' (১৯৬১), 'প্রথম নায়ক' (১৯৬১), 'নীরক্ত করবী' (১৯৬৫), 'নক্ষত্র জয়ের জন্য' (১৯৬৯), 'কলকাতার যিশু' (১৯৬৯), 'উলঙ্গরাজা' (১৯৭১), 'খােলা মুঠি' (১৯৭৪), 'কবিতার বদলে কবিতা' (১৯৭৬), 'আজ সকালে' (১৯৭৮), ‘পাগলাঘণ্টি' (১৯৮১), 'ঘর দুয়ার' (১৯৮৩), 'সময় বড় কম' (১৯৮৩), 'যাবতীয় ভালবাসাবাসি’ (১৯৮৫), 'ঘুমিয়ে পড়ার আগে' (১৯৮৭), 'জঙ্গলে এক উন্মাদিনী' (১৯৮৯), 'আয় রঙ্গ' (১৯৯১), 'চল্লিশের দিনগুলি' (১৯৯৪), 'সত্য সেলুকাস' (১৯৯৫), 'সন্ধ্যারাতের কবিতা' (১৯৯৭), 'অন্য গােপাল' (১৯৯৯) ইত্যাদি। নীরেন্দ্রনাথের কবিপ্রতিভা বহুপ্রসারিণী-এটি তার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা দ্বারাই সুপ্রমাণিত। তিনি এখনও কবিতা রচনার মধ্যে সৃষ্টিশীলতার পরিচয় রেখে চলেছেন। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি 'উলঙ্গরাজা' কাব্যগ্রন্থের জন্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়াও তারাশঙ্কর পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন কবি। তার বিখ্যাত আলােচনা গ্রন্থ কবিতার কী ও কেন এবং বাংলা ছন্দের বই 'কবিতার ক্লাস'।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মার্কসবাদী নন, কিন্তু সমাজমনস্কতা, মানবতাবাদ, সাম্যবাদ ইত্যাদি বিষয়ে তিনি প্রগতিশীল মানসিকতার কবি, সে বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই।
চল্লিশের দিনগুলি শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত বুকে নিয়ে। সেই সঙ্গে ফ্যাসিবাদবিরােধী অভিযানও সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষেও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। একদিকে ভারতছাড়াে আন্দোলন, স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের ওপর পুলিশি অত্যাচার, দুর্ভিক্ষ, লক্ষ লক্ষ মানুষের অনাহারে মৃত্যু, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, স্বাধীনতা-উত্তর স্বপ্নভঙ্গ—এই দ্বন্দ্বময় আলােড়িত যুগের বিষামৃত নিজ হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
স্বাধীনতা-পরবর্তী স্বপ্নভঙ্গ, জাতীয় নেতৃত্বের স্বার্থপরতা ইত্যাদি কবিকে যে বেদনা দান করেছিল, তা নীরেন্দ্রনাথের কবিতায় উঠে এসেছে। কবি এই স্বপ্নভঙ্গের দেশে থাকতে চান না—
এখানে ঢেউ আসে না, ভালােবাসে না কেউ, প্রাণে
কী ব্যথা জ্বলে রাত্রিদিন, মরুকঠিন হাওয়া
এখানে মন বড় কৃপণ, এখানে সেই আলাে
ঝরে না, ভেঙে পড়ে না ঢেউ—এখানে থাকব না” (ঢেউ)।
কেননা কবি সেই চল্লিশের দিনগুলির ভয়ংকরতাকে দেখেছেন—
“কী দেখিনি আমি এখানে?
সাফল্য, হতাশা, দারিদ্র্য, বৈভব, বােমা, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা
চল্লিশের সেই স্বপ্নে আর দুঃস্বপ্নে ভরা দিনগুলিতে
সবই আমি দেখেছি।” (চল্লিশের দিনগুলি)
আর্থ-সামাজিক অবক্ষয়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন চূর্ণ হয়ে যেতে দেখেছেন কবি। এখানে বহু সমভাবনাকে বিনষ্ট হয়ে যেতে দেখেছেন তিনি। জীবনের ইঁদুর-দৌড়ে কেউ কেউ হয়তাে শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু আদর্শবাদ আশ্রয় করে, কোনাে মানুষ সূর্যের মতাে জ্বলতে চায়, সে মানুষ যেন নিঃস্বতার সমুদ্রে হারিয়ে যায় অমলকান্তির মতাে—
"অমলকান্তি রােদুর হতে পারেনি।
সেই অমলকান্তি রােদ্দুরের কথা ভাবতে ভাবতে
যে একদিন রােদুর হয়ে যেতে চেয়েছিল।" ('অমলকান্তি')
এখন শুধু ছদ্ম-স্বদেশপ্রীতি, স্বদেশকে চেনা ও চেনানাের অন্তঃসারশূন্য আয়ােজন। দেশীয় নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক কৌশল চায় না সাধারণ মানুষ স্বদেশের যথার্থ পরিচয় জানুক। তাই দেশ চেনানাের ছদ্ম-অভিনয়ের আয়ােজন চলে দেশজুড়ে। কবি তাই শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন দেশের জল-মাটি-আকাশের নিবিড় সান্নিধ্যে। স্বদেশের স্বপ্নময় দিনগুলির স্মৃতি ও জল-মাটির গন্ধের-শব্দের ছবির ঘনিষ্ঠতায় তিনি চিনে নিতে চান তার স্বদেশকে।
"ঘুমিয়ে আছে দেশটা যখন রাত্রিবেলা
খুলেছ মানচিত্রখানি।
এইখানে ধান, চায়ের বাগান, এবং দূরে ওইখানেতে
কাপাস তুলাে, কফি, তামাক।
দম লাগানাে কলের মতাে হাজার কথা শুনিয়ে যাচ্ছ।
গুরুমশাই,
অন্ধকারের মধ্যে তুমি দেশ দেখাচ্ছাে।
কিন্তু আমরা দেশ দেখি না অন্ধকারে নৈশ বিদ্যালয়ের থেকে চুপি চুপি
পালিয়ে আসি জলের ধারে। ঘাসের পরে চিত হয়ে শুই, আকাশে নক্ষত্র গুনি,
ছলাত ছলাত ঢেউয়ের টানা শব্দ শুনি।"
কলকাতার যিশু' কবিতাটির মধ্যেও এই সাম্প্রতিক সমাজ এবং রাজনৈতিক চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। কলকাতার যিশু’ কাব্যগ্রন্থের নামকবিতা এবং 'চতুর্থ সন্তান' কবিতায় প্রচলিত রাজনীতির অন্তঃসারশূন্যতা এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভ উচ্চারিত। কিন্তু এখানে সেই নস্টালজিক বেদনাভারে কবি আর আক্রান্ত নন। তার পরিবর্তে সমাজের অবাঞ্ছিত অপাঙক্তেয় নিঃস্ব এক প্রজন্মের প্রতিরােধ ও প্রতিবাদে কবি ভেঙে পড়তে দেখেন এই ভ্রান্ত ব্যবস্থাকে। যেন এই ভেঙে পড়ার মধ্যেই কবির মনে সম্ভাবিত হয়ে ওঠে নতুন এক জীবনের বীজ—
মুহূর্তের ভ্রান্তির ফসল,
চতুর্থ সন্তান, তুমি কার ?
…… ….. …..
হঠাৎ কখন তুমি ঘর থেকে উন্মাদের মতাে
রাজপথে বেরিয়ে এসেছ,
বন্দুক তুলেছ ওই বিদ্রুপের দিকে।
জনতা ও যানবাহন থেমে যায়, প্রতিষ্ঠানগুলি
আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে।
….. ….. …..
যে পৃথিবী তােমাকে চায় নি,
তুমিও অক্লেশে তাকে ঘাড়ে ধরে জাহান্নমে ঠেলে দিতে পারাে”।
কলকাতার উলঙ্গ নিরন্ন পথশিশুরাই যেন সেই চতুর্থ সন্তান, সভ্যতার অবাঞ্ছিত সর্বহারার প্রতিনিধি। 'কলকাতার যিশু' কবিতায় তারাই এই উদ্ধত সভ্যতার প্রতিস্পর্ধী হয়ে অনায়াসে সমস্ত কোলাহল গতিময়তাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে একদিন। সেই খণ্ডচিত্রের মধ্যেই কবি মেলে ধরেছেন এই শ্রেণিবিভক্ত উন্নাসিক সভ্যতার চরম পরিণতির প্রতীকী তাৎপর্য—
“ভিখারী-মায়ের শিশু,
কলকাতার যিশু,
সমস্ত ট্রাফিক তুমি মন্ত্রবলে থামিয়ে দিয়েছ
….. …… …….
দুদিকে উদ্যত মৃত্যু, তুমি তার মাঝখান দিয়ে
টলতে টলতে হেঁটে যাও।"
উলঙ্গ রাজা' কাব্যগ্রন্থে সভ্যতার অহংকার ও আড়ম্বরের প্রতি ক্ষোভ পরিণত হয়েছে। তীব্র শ্লেষে। এই কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতাটিও নীরেন্দ্রনাথের অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বহুপঠিত কবিতা। এখানেও এসেছে এক শিশু প্রতীক, যে স্বার্থহীন অনাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে অকুতােভয়ে সভ্যতার নেতৃত্বের ত্রুটিগুলির প্রতি ছুঁড়ে দিতে পারে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন রাজা তাের কাপড় কোথায় ?' যখন নগ্ন রাজার স্তাবকবৃন্দ ছদ্ম আদর্শ ও সেই বস্ত্রের সূক্ষ্মতা বিচার করে রাজার মহিমা প্রচারে এবং সেই সূত্রে আত্মস্বার্থসিদ্ধিতে তৎপর, সেই মুহূর্তে পথশিশু অকুণ্ঠ প্রশ্ন তুলে এই সাজানাে পৃথিবীর নগ্নতাকে প্রকট করে দিতে পারে।
কবি এই স্তাবকদের ভীড়ে সেই সৎ, সরল সত্যবাদী, স্বার্থচিন্তাহীন, সাহসী শিশুটিকে খুঁজে চলেন, যে অকুণ্ঠ গলায় প্রশ্ন তুলবে "রাজা তাের কাপড় কোথায়?"
নীরেন্দ্রনাথের কবিতায় চিত্রকল্প ও ছন্দের একটা মিঠে সুর আছে, আছে নস্টালজিয়ার উপকরণ অজস্র। কিন্তু তবু তার পাশাপাশি পরিণত বয়সে নীরেন্দ্রনাথের কবিতায় এই শ্লেষ ক্রমাগত তীব্র হয়েছে। রাজনৈতিক চাপান-উতাের, দেশনেতাদের ভণ্ডামি, দেশ ও মানুষ নিয়ে স্বার্থান্ধ ছিনিমিনি খেলা, স্তাবকতার পুরস্কার ইত্যাদি কবিকে ক্রমশ বিক্ষুদ্ধ করেছে, যা কার্যত শ্লেষকেই তীব্রতা দিয়েছে। যেমন মেরুদণ্ডহীন স্তাবকতা ধিকৃত হয়েছে 'অন্নদাস' কবিতায়—
“ভাঙো হাঁটু, দাঁতের ভিতরে ধরাে ঘাস
অন্নদাস,
এই তােমার খুলেছে চেহারা।"-('আন্নদাস')
একদিন যারা মহৎ আদর্শের স্বপ্ন দেখিয়ে দিনবদলের ও নতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল, আজ লােভ ও ক্ষমতা তাদের কীভাবে বিপথগামী করেছে, তা কবি দেখিয়ে দেন 'ঘােড়া' কবিতায়—
"ভেবেছিলুম, যে দিকে যাই, জ্বালতে জ্বালতে যাব
শহর-গঞ্জ-কারখানা-কল, কিন্তু এখন প্রাণে
অন্যরকম ভুজুং দিচ্ছে অন্যরকম হাওয়া।
.... …… …...
নজর করলে দেখতে পাবি রক্ত শুষে খাচ্ছে।
অশ্বমেধের ঘােড়ার পিঠে রাক্ষুসে এক মাছি।"-('ঘােড়া')
কবিতার বদলে কবিতা কাব্যগ্রন্থে তবু কবির স্বপ্ন ও আশা স্পষ্ট উচ্চারণে ভাষা পায়। তিনি বিশ্বাস করেন একদিন মানুষ শ্রয়কে খুঁজে পাবে, খুঁজে পাবে শাস্তি ও সাম্যের সঠিক ঠিকানা—
একদিন সমস্ত যােদ্ধ বিষন্ন হবার মন্ত্র শিখে যাবে।
একদিন সমস্ত বৃদ্ধ দুঃখহীন বলতে পারবে, যাই।
…… ……. …….
একদিন সমস্ত ধর্মযাজকের উর্দি কেড়ে নিয়ে
নিষ্পাপ বালক বলবে হা হা।"
আসলে নীরেন্দ্রনাথ আধুনিক কবিদের মধ্যে সেই বিরল কবিদের অন্যতম, যিনি জীবনের ছবি, অভিজ্ঞতা, অনুভবকে প্রায় নিরাভরণ সহজতায় প্রকাশ করতে জানেন। মননের বা পাণ্ডিত্যের অত্যধিক চাপে, বক্তব্যের মাত্রাতিরিক্ত মােচড়ে, ভাষার অস্বচ্ছতায় তাঁর কবিতা কখনাে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে না। আর এই সহজ ভাষা ও ছন্দের বেণীবন্ধনেই নীরেন্দ্রনাথের কাব্যসিদ্ধি।
সে যেমন আসে, ঠিক তেমনি চলে যায়।
গল্পে, গানে, ঠোঁট-ফোলানো অভিমানে, প্রকাণ্ড ঠাট্টায়
সব-কিছু ভাসিয়ে তার যাওয়া।
ভোরবেলার হাওয়া
দৌড়তে-দৌড়তে নিয়ে আসে
বৃষ্টির খবর। ঘাসে
দোলা লাগে, চর্তুদিকে বেজে ওঠে অশথ-পাতার
ঝর্ঝর গানের শব্দ, জানালার
পর্দাটা সরালে
দেখা যায় জামরুলের ডালে
খেলা করছে তিনটে-চারটে-পাঁচটা-ছটা পাখি।
আমি তাকে ডাকি,
বলি, চলো, কলকাতায় যাই,
পাতাল-রেলের জন্যে মাটি খুঁড়ি, সুরঙ্গ বানাই,
রাস্তা করি চওড়া, তাতে ছাড়ি
আরও পাঁচশো বাঘমার্কা দোতলা হাওয়াগাড়ি,
পরিচ্ছন্ন করে তুলি মানিকতলার খাল,
হটাই জঞ্জাল
রাস্তা ও ফুটপাথ থেকে,
সদর-দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ি, গৃহস্থকে ডেকে
প্রত্যেকটা বাড়ির কলি
ফেরাই, প্রত্যেকটা কানাগলি
দৃষ্টি পাক,
সন্ধ্যায় প্রত্যেকে তার নিজস্ব নারীর কাছে ফিরে যাক
নিরুদ্বেগ শান্ত মনে।
এখনও নিতান্ত অকারণে
গঙ্গার কিনারে আছে দ্বিধাগ্রস্ত ভঙ্গিতে যে ঝুঁকে,
চলো, সেই দ্বিতীয় সেতুকে
ঘাড়ে ধরে হাওড়ায় পৌঁছিয়ে দিয়ে আসি।
চুরাশি-অষ্টাশি
অব্দি কে অপেক্ষা করবে। ধেত্তেরিকা, অদ্দিন কি বাঁচব নাকি?
স্পষ্ট করে এক্ষুণি জানিয়ে রাখি,
পঞ্চাশ পেরুলে
দেখা যায়, মাথার কলকব্জা গেছে খুলে,
কাঠ খেয়েছে ঘুণে আর ইঁট খেয়েছে নোনা।
তোমরা থাকো, আমি আর অপেক্ষা করব না।
পুরনো বিশ্বাসগুলি ধুঁকে মরছে,
পুরনো ঘরবাড়িগুলি মুহুর্মুহু ধসে পড়ছে,
কয়লা পুড়তে পুড়তে হচ্ছে ছাই।
আমার যা-কিছু চাই, এই মুহূর্তে চাই।
যেটা প্রাপ্য, এক্ষুনি তা পাব,
যা-কিছু বানানো হয়নি, এক্ষুনি বানাব।
শুধুই কি রাস্তা, সেতু, ঘড়বাড়ি ও যানবাহন?
তিপান্ন কাহন
সমস্যার খুলতে হবে জট।
চতুর্দিকে আমূল পাল্টাতে হবে দৃশ্যপট।
বৃদ্ধ যাতে ভোলে শোক,
হাসতে-হাসতে খেলতে-খেলতে বেড়ে ওঠে সমস্ত বালক,
ভিটেবাড়ি কোত্থাও না-করে যাতে খাঁ-খাঁ,
না-ভাঙে কোত্থাও কারও শাঁখাঁ,
আর মাছি না-পড়ে কারও ভাতে,
তারই জন্যে দিনে-রাতে
ছুটতে হবে গ্রামে, গঞ্জে, সমস্ত জায়গায়।
আয়,
এই আমার শেষবারের মতো ছুটে যাওয়া।
ভোরবেলার হাওয়া
পাগলা-ঘণ্টি বাজাতে-বাজাতে এসে বলল, তুমি কাকে
ডাকছ, সে তো সুবর্ণরেখার বাঁকে
কাল রাতে মিলিয়ে গেছে, আমরাই ক’জন
তাকে নিয়ে তরঙ্গে দিয়েছি বিসর্জন,
তার প্রগল্.ভ হাসি আর বাজবে না কক্ষনো কোনোখানে।
শ্রাবণের বৃষ্টিধারা আনে
অশত্থ-পাতার
ঝর্ঝর গানের শব্দ, জানালার
পর্দাটা সরালে
দেখা যায় জামরুলের ডালে
খেলা করছে তিনটে-চারটে-পাঁচটা-ছ’টা পাখি।
তবু ডাকি। আজও ডাকি। আসবে না জেনেও তাকে ডাকি।
No comments:
Post a Comment