Friday, 22 October 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। কবি শামসুর রহমান। ২৩.১০.২১. Vol -534. The blogger in literature e-magazine.


বাবা-মা ধার্মিক ছিলেন কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। এক ধরনের সুস্থ ও সেকুলার পরিবেশে কেটেছে কবির শৈশব-কৈশোর।১৬ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি ছিলেন মাহুতটুলির নানার বাড়িতে। তারপর থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ছিলেন পুরনো ঢাকার কাজী আওলাদ হোসেন লেন বা আশোক লেনে।আশির দশকের শেষ দিকে তিনি চলে আসেন শুক্রবাদের কাছে তল্লাবাগের ভাড়া বাসায়। পরবর্তী শ্যামলী ১ নম্বর রোডের ৩/১ নম্বর বাড়িতে- আমৃত্যু এ বাড়িতেই ছিলেন।

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার অন্যতম প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘পোগজ স্কুলে’ ভর্তি হন শামসুর রাহমান। তিনি যখন ঐ স্কুলে ভর্তি হন তখন ৮০০জন ছাত্রের মধ্যে মাত্র ১০জন ছিলেন মুসলমান। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন তিনি। এ বছরই ভর্তি হন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে আইএ পাস করেন। উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে- ইংরেজি অনার্স কোর্সে।
 
উক্ত কোর্সেও ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি তিনি। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে পাস কোর্সে বিএ পাস করে এমএ-তে ভর্তি হন ইংরেজি বিষয়ে। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলেও শেষ পর্বের পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি তাঁর। সমাপ্তি ঘটে শিক্ষাজীবন। 
।১৯৫৫ সালের ৮ই জুলাই শামসুর রাহমান জোহরা বেগমকে বিয়ে করেন। কবির তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। তাদের নাম সুমায়রা আমিন, ফাইয়াজ রাহমান, ফাওজিয়া সাবেরিন, ওয়াহিদুর রাহমান মতিন ও শেবা রাহমান।
 কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘দৈনিক মর্নিং নিউজ’-এ সাংবাদিক হিসেবে। ১৯৫৭-৫৯ পর্যন্ত তিনি ছিলেন রেডিও পাকিস্তানের অনুষ্ঠান প্রযোজক। ১৯৬০-৬৪ পর্যন্ত ছিলেন ‘দৈনিক মর্নিং নিউজ’র সিনিয়র সহ সম্পাদক। ১৯৬৪-৭৭ পর্যন্ত ‘দৈনিক পকিস্তান’/ ‘দৈনিক বাংলা’য় সহকারী সম্পাদক হিসেবে এবং ১৯৭৭-৮৭ পর্যন্ত ‘দৈনিক বাংলা’য় ও ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’য় সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ বছর বয়স থেকে শামসুর রাহমানের কাব্যচর্চা শরু। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘ঊনিশশ ঊনপঞ্চাশ’। নলিনীকিশোর গুহ সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক সোনার বাংলা’য় এটি প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে। 


শামসুর রাহমান প্রধানত কবি। তাঁর বিশাল কাব্যসম্ভারে ওঠে এসেছে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, মৌলবাদী আগ্রাসন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, স্বদেশপ্রেম, নাগরিক চেতনা ও ঢাকা শহর, নৈঃসঙ্গচেতনা, গণচেতনা, প্রেম, কবি ও কবিতা বিষয়ে কাব্যচর্চা। তাঁর কবিতায় বারবার ওঠে এসেছে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন শাহ, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সমর সেনদের নাম। পাশাপাশি দেখা যায় হোমার, বোদলেয়ার, লোরকা তাঁদের নামও তাঁর কবিতায় পাওয়া যায়।

তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ বেরোয় ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে। এ কাব্যে অধিকার করে আছে মৃত্যুভারাতুর নির্জনতা, নৈঃসঙ্গ, বিষাদ, স্বপ্নসৌন্দর্য স্পৃহা। এ কাব্য প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদ লিখেন, চল্লিশের দশক থেকে আধুনিকতা ও আধুনিক কবিতার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্যে স্খলন, পতন ভরা যে শ্রমসাধনা করে আসছিলেন বাঙালি মুসলমান কবিমণ্ডলী, তা ব্যাপক সাফল্য আয় করে ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’তে।

শামসুর রাহমান প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত না থাকলেও তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন কবি। প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতি তাঁর সমর্থন ছিল। তাঁর কবিতা প্রেরণা দিয়েছে এ দেশের মানুষকে। ‘নিজ বাসভূমে’ কাব্যগ্রন্থের ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’য় তিনি লিখেন-
‘উনিশ শো’ বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা। ’

১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে তিনি লিখেন-
‘আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া
থরে থরে রে শহরের পথে
কেমন নিবিড় হয়ে।
কখনো মিছিলে কখনো বা
একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়-ফুল নয়, ওরা
শহীদের কলুষিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।
একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের
চেতনারই রঙ। ’ ( ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’। ‘শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা’। )

এ সময়ে রচিত অন্যান্য কবিতা ‘হরতাল’, ‘আসাদের শার্ট’, ‘মা’-প্রভৃতি দেশপ্রেমমূলক কবিতা। একাত্তরের দিনগুলি নিয়ে তাঁর কিছু কবিতা মানুষের মুখে মুখে, শিক্ষার্থীদের আবৃত্তির প্রথম সারিতে অবস্থান নেয়। এর মধ্যে ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’, ‘একাত্তরে রচিত পংক্তিমালা’, ‘গেরিলা’, ‘রক্তসেচ’, ‘অস্থি’ অন্যতম।
‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?
-নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা। ’ -(“তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা”। )

শামসুর রাহমানের কবিতার আরেক বিষয়বস্তু প্রেম। ব্যক্তিজীবনে রোম্যান্টিক স্বভাবের মানুষ হওয়ার কারণে প্রেমের কবিতাবলি সার্থক ও যথার্থ হয়েছে। “প্রেমের কবিতা” কাব্যগ্রন্থের ‘প্রমাণ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
‘তুমি বারবার বলো ঘুরে ফিরে সেই একই কথা
তাহলে প্রমাণ দাও, সত্যি ভালোবাসো কি না। ’ বুঝি
ব্যাকুলতা
কেন সে দখল করে তোমাকে এভাবে। ’

শামসুর রাহমান রোম্যান্টিক স্বভাবের মানুষ হলেও নৈঃসঙ্গচেতনা জড়িয়ে আছে তাঁর কিছু কিছু কবিতায়। মহাকাব্য রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডেসিতে যেমন নৈঃসঙ্গপীড়িত মানুষের সন্ধান মেলে তেমনি মেলে এলিয়ট, কীটস, বায়রন, মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশসহ ত্রিশোত্তর অনেক কবির কবিতায়। শামসুর রাহমানের কবিতায় তা নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে-
‘কোনও কোনও দিন মনে হয়, একজন
করুণ উদ্বাস্তু আমি, সম্বলহীন। ’ -(‘ঘরবাড়ি’, ভস্মস্তূপে গোলাপের হাসি। )
‘ভাঙ্গাচোরা চাঁদমুখ কালো করে ধুঁকছে’ কবিতায়ও ধরা পড়েছে নৈঃসঙ্গচেতনা।

শামসুর রাহমান ছিলেন সমাজ ও রজনীতি সচেতন। সমাজ, স্বদেশ, গণ-আন্দোলন তাই স্থান পেয়েছে তাঁর কবিতায়। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় তাঁর ‘অন্ধ সুন্দরী কাঁদে’, ‘বর্ণমালা দিয়ে গাঁথা’, ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’, ‘গর্জে ওঠো স্বাধীনতা’ প্রভৃতি কবিতা আন্দোলনকে করেছে বেগবান। ‘বুক তাঁর বাংলাদেশের হৃদয়’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
‘সারারাত নূর হোসেনের চোখ এক ফোঁটা ঘুমও
শিশিরের মত
জমেনি, বরং তার শিরায় শিরায়
জ্বলছে আতশবাজি সারারাত, কী এক ভীষণ
নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়। ’

শামসুর রাহমান বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে অনেক কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর কবিতায় এসেছে মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। পাশাপাশি এসেছে মধ্যযুগের কবি চন্ডীদাস, মুকুন্দরাম, ত্রিশের দশকের কবি জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসু, সমর সেন, বোদলেয়ার, অরাগ ও লোরকাদের নামও। মাইকেল মধুসূদন কে নিয়ে তিনি অনেক কবিতা লিখেছেন। তাঁর কাছে শামসুর রাহমান সাহিত্যের ভাণ্ডার খুঁজে পান। বিশ্বজিৎ ঘোষ-এর মতে, ‘রাহমানের কাছে মাইকেল বিশাল এক সাহিত্য-অর্ণব, প্রাচীন রাজার সুবিশাল কোনো তৈলচিত্র যেন। ’ ‘আমিও তোমার মতো’ কবিতায়-
‘আমিও তোমারই মতো রাত্রি জাগি, করি পায়চারী
ঘরময় প্রায়শই, জানালার বাইরে তাকাই
হাওয়ায় হাওয়ায় কান পাতি, অদূরে গাছের পাতা
মর্মরিত হলে ফের অত্যন্ত উৎকীর্ণ হই, দেখি
রাত্রির ভেতরে অন্য রাত্রি, তোমার মতোই হু হু। ’

মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দে মুগ্ধ শামসুর রাহমান। তাইতো তাঁর কবিতায় ফুটে ওঠে-
‘তোমার অমিত্রাক্ষর নব্যতন্ত্রী দীপ্র বঙ্গভূমি
তোমার অমিত্রাক্ষর উন্মত্থিত উনিশ শতক। ’

শামসুর রাহমান সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ দ্বারা। তাই অনেক কবিতা সরাসরি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আবার কিছু কবিতায় বিভিন্ন উপমা ও প্রতীকে রবীন্দ্রনাথের নাম এসেছে। ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’, ‘কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি’, ‘দাঁড়িয়ে আছেন এক দেবমূর্তি’ কবিতা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। আবার ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’, ‘তুমি বলেছিলে’, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’, ‘বাইবেলের কালো অক্ষরগুলো’, ‘চতুর্থভাষা’, ‘শিরোনাম মনে পড়েনা’, ‘ভাড়াটে’, ‘দুঃখিনী সাথিরা’, ‘মোমবাতি’, ‘আমার মাতামহের টাইপরাইটার’ কবিতাগুলিতে রবীন্দ্রনাথের নাম এসেছে। ‘দাঁড়িয়ে আছেন এক দেবমূর্তি’ কবিতায় তিনি লিখেন-
‘আমি বিহবলতা কাটিয়ে চেয়ার ছেড়ে
উঠে দাঁড়ালাম, আমার সত্তায় সশ্রদ্ধ মুদ্রা। রবীন্দ্রনাথ
আমার কাঁধে চাপ দিয়ে বসতে বললেন আমাকে।
‘লেখো তুমি, কবির ধ্যানে বিঘ্ন ঘটাতে চাইলে,
তিন অক্ষরের একটি শব্দের জন্য আবার সতৃষ্ণ হয়ে উঠি। ’

কাজী নজরুলকে নিয়ে তাঁর ‘দেখা হলোনা’, ‘সমস্বরে বলছে’ প্রভৃতি কবিতা। নজরুলকে দেখার পর শামসুর রাহমানের উক্তি-
“তোমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে, কী আশ্চর্য,
আমার মনে পড়লো ডেনমার্কের যুবরাজের উক্তি-
‘এই করোটির ভেতরে ছিলো জবান
এবং একদা সে গান গাইতে পারতো’। ”

মওলানা ভাসানীকে নিয়ে তিন যেমন কবিতা লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন শেখ মুজিবকে নিয়ে। ‘সফেদ পাঞ্জাবি’, ‘বাইবেলের কালো অক্ষরগুলো’ প্রভৃতি কবিতায় ভাসানীর নাম এসেছে। ‘সফেদ পাঞ্জাবি’তে তিনি লিখেন-
‘সবাই এলেন ছুটে পল্টনের মাঠে, শুনবেন
দুর্গত এলাকা প্রত্যগত বৃদ্ধ মৌলানা ভাসানী
কী বলেন।
দৃশ্যাবলিময়, শোনালেন কিছু কথা, যেন নেতা
নন, অলৌকিক স্টাফ রিপোর্টার। ’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে তাঁর কবিতাগুলো হলো-‘ইলেক্ট্রার গান’, ‘ধন্য সেই পুরুষ’, ‘বাইবেলের কালো অক্ষরগুলো’। ‘ধন্য সেই পুরুষ’ কবিতায় তিনি লিখেন-
‘ধন্য সেই পুরুষ, যার নামের উপর পতাকার মতো
দুলতে থাকে স্বাধীনতা,
ধন্য সেই পুরুষ যার নামের উপর ঝরে
মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি। ’

শামসুর রাহমান জন্মেছেন ঢাকায়। আমৃত্যু তিনি ঢাকাতেই অবস্থান করেছেন। তাই তাঁর কাব্যে ঢাকা শহর এসেছে বিচিত্রভাবে। নাগরিক চেতনা, নাগরিক যন্ত্রণা, ঢাকার ঐতিহ্য এসেছে তঁর কবিতায়। তাঁর ‘এ শহর’, ‘আমার এ শহরের চোখ’, ‘শৈশবের বাতিঅলা আমার’, ‘জর্নাল’, ‘আত্মজীবনীর খসড়া’, ‘সেই ঘোড়াটা’, ‘দুঃসময়ের মুখোমুখি’, ‘দশ টাকার নোট এবং শৈশব’, ‘বিউটিবোর্ডিং’, ‘ওরা চলে যাবার পরে’, ‘হরতাল’, ‘দরজার কাছে’, ‘অলৌকিক বানভাসি’, ‘বুদ্ধদেব বসুর চিঠি’, ‘তোমাকে পাঠাতে চাই’, ‘পরিবর্তন’, ‘আশেক লেনের বাড়ি’সহ বিভিন্ন কবিতায় ঢাকা শহর এসেছে। এসেছে তাঁর ঢাকাকে নিয়ে শৈশব স্মৃতি। ‘ওরা চলে যাবার পরে’ কবিতায় তিনি লিখেন -
‘এবারও আমি ওদের নিরাশ করলাম।
যখন আমার ভাই-বোনরা বললো, ক’দিনের জন্যে
আমরা সবাই পাড়াতলী
যাচ্ছি, চলো, তুমিও যাবে
গা ঢাকা দিয়েছিলাম, তারপর থেকে
একবারও আর আমার আমাদের গ্রামে
যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ’

আধুনিক কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আবু সয়ীদ আইয়ুব লিখেছেন, ‘কালের দিক থেকে মহাযুদ্ধ পরবর্তী এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত, অন্তত মুক্তিপ্রয়াসী কাব্যকেই আমরা আধুনিক কাব্য বলে গণ্য করেছি। ’

দিপ্তী ত্রিপাঠী তাঁর ‘আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয়’ গ্রন্থে আধুনিক বাংলা কবিতার তিনটি লক্ষণ চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো- ১. কালের দিক থেকে আধুনিক কবিতা প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তী ২. ভাবের দিক থেকে তা রবীন্দ্র প্রভাব থেকে মুক্তিলাভের প্রয়াসী এবং ৩. সৃষ্টির দিক থেকে তা নবতম সুরের সাধক। এছাড়া আরও ১২ টি লক্ষণের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন।
 
আধুনিক কবিতার উপর্যুক্ত লক্ষণগুলো বিবেচনা করে এবং শামসুর রাহমানের কবিতা বিশ্লেষণ করে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, তাঁর কবিতাগুলো আধুনিক কবিতা। তিনি আধুনিক কবি। তবে গবেষকেরা বলে থাকেন, তাঁর কবিতা যতো না শিল্পসমৃদ্ধ তার চেয়ে বেশি গণমুখী। তাঁর কবিতার ভাব, ভাষা, ছন্দ, আঙ্গিক বিশ্লষণে বলা যায়, তিনি সময় ও সমাজসচেতন একজন কবি ছিলেন।
কাব্যগ্রন্থ -
 ৬৬( * ''প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে'' (১৯৬০) * ''রৌদ্র করোটিতে'' (১৯৬৩) * ''বিধ্বস্ত নিলীমা'' (১৯৬৭) * ''নিরালোকে দিব্যরথ'' (১৯৬৮) * ''নিজ বাসভূমে'' (১৯৭০) * ''বন্দী শিবির থেকে'' (১৯৭২) * ''দুঃসময়ে মুখোমুখি'' (১৯৭৩) * ''ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাটা'' (১৯৭৪) * ''আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি'' (১৯৭৪) * ''এক ধরনের অহংকার'' (১৯৭৫) * ''আমি অনাহারী'' (১৯৭৬) * ''শূন্যতায় তুমি শোকসভা'' (১৯৭৭) * ''বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে'' (১৯৭৭) * ''প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে'' (১৯৭৮) * ''প্রেমের কবিতা'' (১৯৮১) * ''ইকারুসের আকাশ'' (১৯৮২) * ''মাতাল ঋত্বিক'' (১৯৮২) * ''উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে'' (১৯৮৩) * ''কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি'' (১৯৮৩) * ''নায়কের ছায়া'' (১৯৮৩) * ''আমার কোন তাড়া নেই'' (১৯৮৪) * ''যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে'' (১৯৮৪) * ''অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই'' (১৯৮৫) * ''হোমারের স্বপ্নময় হাত'' (১৯৮৫) * ''শিরোনাম মনে পড়ে না'' (১৯৮৫) * ''ইচ্ছে হয় একটু দাঁড়াই'' (১৯৮৫) * ''ধুলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ'' (১৯৮৫) * ''এক ফোঁটা কেমন অনল'' (১৯৮৬) * ''টেবিলে আপেলগুলো হেসে উঠে'' (১৯৮৬) * ''দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে'' (১৯৮৬) * ''অবিরল জলভূমি'' (১৯৮৬) * ''আমরা ক'জন সঙ্গী'' (১৯৮৬) * ''ঝর্ণা আমার আঙুলে'' (১৯৮৭) * ''স্বপ্নেরা ডুকরে উঠে বারবার'' (১৯৮৭) * ''খুব বেশি ভালো থাকতে নেই'' (১৯৮৭) * ''মঞ্চের মাঝখানে'' (১৯৮৮) * ''বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়'' (১৯৮৮) * ''হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো'' (১৯৮৯) * ''সে এক পরবাসে'' (১৯৯০) * ''গৃহযুদ্ধের আগে'' (১৯৯০) * ''খন্ডিত গৌরব'' (১৯৯২) * ''ধ্বংসের কিনারে বসে'' (১৯৯২) * ''হরিণের হাড়'' (১৯৯৩) * ''আকাশ আসবে নেমে'' (১৯৯৪) * ''উজাড় বাগানে'' (১৯৯৫) * ''এসো কোকিল এসো স্বর্ণচাঁপা'' (১৯৯৫) * ''মানব হৃদয়ে নৈবদ্য সাজাই'' (১৯৯৬) * ''তুমিই নিঃশ্বাস তুমিই হৃৎস্পন্দন'' (১৯৯৬) * ''তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি'' (১৯৯৭) * ''হেমন্ত সন্ধ্যায় কিছুকাল'' (১৯৯৭) * ''ছায়াগণের সঙ্গে কিছুক্ষণ'' (১৯৯৭) * ''মেঘলোকে মনোজ নিবাস'' (১৯৯৮) * ''সৌন্দর্য আমার ঘরে'' (১৯৯৮) * ''রূপের প্রবালে দগ্ধ সন্ধ্যা রাতে'' (১৯৯৮) * ''টুকরা কিছু সংলাপের সাঁকো'' (১৯৯৮) * ''স্বপ্নে ও দুঃস্বপ্নে বেচে আছি'' (১৯৯৯) * ''নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে'' (২০০০) * ''শুনি হৃদয়ের ধ্বনি'' (২০০০) * ''হৃদপদ্মে জ্যোৎস্না দোলে'' (২০০১) * ''ভগ্নস্তূপে গোলাপের হাসি'' (২০০২) * ''ভাঙাচোরা চাঁদ মুখ কালো করে ধুকছে'' (২০০৩) * ''গন্তব্য নাই বা থাকুক'' (২০০৪) * ''কৃষ্ণপক্ষে পূর্ণিমার দিকে'' (২০০৪) * ''গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান'' (২০০৫) * ''অন্ধকার থেকে আলোয়'' (২০০৬) * ''না বাস্তব না দুঃস্বপ্ন'' (২০০৬)
উপন্যাস - ৪টি ‘অক্টোপাশ’ (১৯৮৩), ’অদ্ভুত আঁধার এক’ (১৯৮৫), ‘নিয়ত মন্তাজ’ (১৯৮৫), ‘এলো সে অবেলায়’ (১৯৯৪),
প্রবন্ধগ্রন্থ - ‘আমৃত্যু তাঁর জীবনানন্দ’ (১৯৮৬), ‘কবিতা এক ধরনের আশ্রয়’ (২০০২)
শিশু কিশোর সাহিত্য,
আত্মস্মৃতি,
অনুবাদ কবিতা - ৩টি,
অনুবাদ নাটক - ৩টি

জীবদ্দশায় তাঁর ৬৬টি কাব্যগ্রন্থ, ৪টি উপন্যাস, ১টি প্রবন্ধগ্রন্থ, ১টি ছড়ার বই ও ৬টি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তিনি অর্জন করেছেন আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক, জীবনানন্দ পুরস্কার, আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার, মিৎসুবিসি পুরস্কার (সাংবাদিতার জন্য), স্বাধীনতা পদক, আনন্দ পুরস্কার। ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে এই মহান কবিকে।সম্মাননা ও পুরস্কার সম্পাদনা
আদমজী সাহিত্য পুরস্কার,
বাংলা একাডেমি পুরস্কার,
একুশে পদক,
নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক,
জীবনানন্দ পুরস্কার,
আবুল মনসুর আহমেদ স্মৃতি পুরস্কার,
মিতসুবিসি পুরস্কার (সাংবাদিতার জন্য),
স্বাধীনতা পদক,
আনন্দ পুরস্কার
ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। তার ৮৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গুগল তাদের হোমপেজে শামসুর রাহমানের গুগল ডুডল প্রদর্শন করে তার জন্মদিন উদ্‌যাপন করে। গুগল ডুডলটিতে দেখা যায় সবুজ পাঞ্জাবি পরা শুভ্র চুলের শামসুর রাহমান লেখালেখি করছেন।

কবি শামসুর রাহমান ২০০৬ সালের ১৭ই আগস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা বেজে ৩৫ মিনিটে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার ইচ্ছানুযায়ী ঢাকাস্থ বনানী কবরস্থানে, নিজ মায়ের কবরের পাশে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।

কবিতা 
১.
একটি কবিতার জন্য 

বৃক্ষের নিকটে গিয়ে বলি ;
দয়াবান বৃক্ষ তুমি একটি কবিতা দিতে পারো ?
বৃক্ষ বলে আমার বাকল ফুঁড়ে আমার মজ্জায়
যদি মিশে যেতে পারো, তবে
হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা !

জীর্ণ দেয়ালের কানে বলি ;
দেয়াল আমাকে তুমি একটি কবিতা দিতে পারো ?
পুরোনো দেয়াল বলে শ্যাওলা-ঢাকা স্বরে,
এই ইঁট সুরকির ভেতর যদি নিজেকে গুঁড়িয়ে দাও, তবে
হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা !
 
একজন বৃদেধের নিকট গিয়ে বলি, নতজানু,
হে প্রাচীন দয়া ক’রে দেবেন কি একটি কবিতা ?
স্তব্ ধতার পর্দা ছিঁড়ে বেজে ওঠে প্রাজ্ঞ কণ্ঠে – যদি
আমার মুখের রেখাবলী
তুলে নিতে পারো
নিজের মুখাবয়বে, তবে
হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা।

কেবল কয়েক ছত্র কবিতার জন্যে
এই বৃক্ষ, জরাজীর্ণ দেয়াল এবং
বৃদ্ধের সম্মুখে নতজানু আমি থাকবো কতোকাল ?
বলো কতোকাল ?

২.
স্বাধীনতা তুমি

স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
স্বাধীনতা তুমি
ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।
স্বাধীনতা তুমি
রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।
স্বাধীনতা তুমি
মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশী।
স্বাধীনতা তুমি
অন্ধকারের খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।
স্বাধীনতা তুমি
বটের ছায়ায় তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীর
শানিত কথার ঝলসানি-লাগা সতেজ ভাষণ।
স্বাধীনতা তুমি
চা-খানায় আর মাঠে-ময়দানে ঝোড়ো সংলাপ।
স্বাধীনতা তুমি
কালবোশেখীর দিগন্তজোড়া মত্ত ঝাপটা।
স্বাধীনতা তুমি
শ্রাবণে অকূল মেঘনার বুক
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।
স্বাধীনতা তুমি
উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন।
স্বাধীনতা তুমি
বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ।
স্বাধীনতা তুমি বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার।
স্বাধীনতা তুমি
গৃহিণীর ঘন খোলা কালো চুল,
হাওয়ায় হাওয়ায় বুনো উদ্দাম।
স্বাধীনতা তুমি
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,
খুকীর অমন তুলতুলে গালে
রৌদ্রের খেলা।
স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান,
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।

৩. 
বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা

নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।
মমতা নামের প্রুত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়
ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে
শিউলিশৈশবে ‘পাখী সব করে রব’ ব’লে মদনমোহন
তর্কালঙ্কার কী ধীরোদাত্ত স্বরে প্রত্যহ দিতেন ডাক। তুমি আর আমি,
অবিচ্ছিন্ন পরস্পর মমতায় লীন,
ঘুরেছি কাননে তাঁ নেচে নেচে, যেখানে কুসুম-কলি সবই
ফোটে, জোটে অলি ঋতুর সংকেতে।

আজন্ম আমার সাথী তুমি,
আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গ’ড়ে পলে পলে,
তাইতো ত্রিলোক আজ সুনন্দ জাহাজ হয়ে ভেড়ে
আমারই বন্দরে।
গলিত কাচের মতো জলে ফাত্না দেখে দেখে রঙিন মাছের
আশায় চিকন ছিপ ধরে গেছে বেলা। মনে পড়ে কাঁচি দিয়ে
নক্সা কাটা কাগজ এবং বোতলের ছিপি ফেলে
সেই কবে আমি হাসিখুশির খেয়া বেয়ে
পৌঁছে গেছি রত্নদীপে কম্পাস বিহনে।

তুমি আসো আমার ঘুমের বাগানেও
সে কোন্ বিশাল
গাছের কোটর থেকে লাফাতে লাফাতে নেমে আসো,
আসো কাঠবিড়ালির রূপে,
ফুল্ল মেঘমালা থেকে চকিতে ঝাঁপিয়ে পড়ো ঐরাবত সেজে,
সুদূর পাঠশালার একান্নটি সতত সবুজ
মুখের মতোই দুলে দুলে ওঠো তুমি
বার বার কিম্বা টুকটুকে লঙ্কা ঠোঁট টিয়ে হ’য়ে
কেমন দুলিয়ে দাও স্বপ্নময়তায় চৈতন্যের দাঁড়।
আমার এ অক্ষিগোলকের মধ্যে তুমি আঁখিতারা।
যুদ্ধের আগুণে,
মারীর তাণ্ডবে,
প্রবল বর্ষায়
কি অনাবৃষ্টিতে,
বারবনিতার
নূপুর নিক্কনে
বনিতার শান্ত
বাহুর বন্ধনে,
ঘৃণায় ধিক্কারে,
নৈরাজ্যের এলো-
ধাবাড়ি চিত্কারে,
সৃষ্টির ফাল্গুনে

হে আমার আঁখিতারা তুমি উন্মিলিত সর্বক্ষণজাগরণে।

তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার ?
উনিশ শো’ বাহন্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।
সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হ’লে আমার সত্তার দিকে
কতো নোংরা হাতের হিংশ্রতা ধেয়ে আসে।
এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি,
এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস !
তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,
বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।

৪.
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?

তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,

সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিত্কার করতে করতে
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে ব’লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে ব’লে, বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভূর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।

তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুড়ো
উদাস দাওয়ায় ব’সে আছেন – তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের
দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে
নড়বড়ে খুঁটি ধ’রে দগ্ধ ঘরের।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে।
তোমার জন্যে,
সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী ব’লে নৌকা চালায় উদ্দান ঝড়ে
রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুড়ে বেড়ানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হ’তে চলেছে —
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,
মতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।

৫.
তুমি বলেছিলে

দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার।
পুড়ছে দোকান-পাট, কাঠ,
লোহা-লক্কড়ের স্তূপ, মসজিদ এবং মন্দির।
দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার।

বিষম পুড়ছে চতুর্দিকে ঘর-বাড়ি।
পুড়ছে টিয়ের খাঁচা, রবীন্দ্র রচনাবলি, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার,
মানচিত্র, পুরনো দলিল।
মৌচাকে আগুন দিলে যেমন সশব্দে
সাধের আশ্রয় ত্যাগী হয়
মৌমাছির ঝাঁক,
তেমনি সবাই
পালাচ্ছে শহর ছেড়ে দিগ্বিদিক। নবজাতককে
বুকে নিয়ে উদ্ভ্রান্ত জননী
বনপোড়া হরিণীর মত যাচ্ছে ছুটে।
অদূরে গুলির শব্দ, রাস্তা চষে জঙ্গী জীপ। আর্ত
শব্দ সবখানে। আমাদের দু’জনের
মুখে খরতাপ। আলিঙ্গনে থরো থরো
তুমি বলেছিলে,
’আমাকে বাঁচাও এই বর্বর আগুন থেকে, আমাকে বাঁচাও,
আমাকে লুকিয়ে ফেলো চোখের পাতায়
বুকের অতলে কিংবা একান্ত পাঁজরে
আমাকে নিমেষে শুষে নাও
চুম্বনে চুম্বনে।’
দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে নতুন বাজার,
আমাদের চৌদিকে আগুন,
গুলির ইস্পাতী শিলাবৃষ্টি অবিরাম।
তুমি বলেছিলে
আমাকে বাঁচাও।
অসহায় আমি তাও বলতে পারিনি।
========∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆∆========






No comments:

শুভ জন্মদিন শ্রদ্ধাঞ্জলি। পশুপতি ভট্টাচার্য । খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। Dt -15.11.2024. Vol -1053. Friday. The blogger post in literary e magazine

পশুপতি ভট্টাচার্য  ১৫ নভেম্বর ১৮৯১ -  ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৮   একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাহিত্যিক। জন্ম  বিহার রাজ্যে পিতার কর্মস্থল আরায়। তাদ...