"""জন্মটাই যেন অভিনয়ের জন্য। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই নাটকে অভিনয়ের হাতেখড়ি। তারপর যখন কলেজে ভর্তি হলেন তখন বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুললেন ‘বন্ধুমন’ নামে একটি নাটকের দল। মহড়া দিতেন আশুতোষ কলেজের ছাদে। কিন্তু, বাবা জীতেন্দ্রনাথ তা একেবারেই পছন্দ করতেন না। প্রায়ই স্ত্রী জ্যোৎস্না রানীকে বলতেন, “ অভিনয় কইরা সময় নষ্ট করে ক্যান ? তোমার পোলারে কয়া দিও ওই চেহারায় অভিনয় হয় না। সে ছিলো দুর্গাদাস বাঁড়ুজ্যে, হিরোর মতন চেহারা।”
তিনি ২৪শে নভেম্বর, ১৯৩১ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার। ১৯৪৯ সালে তিনি সাউথ সুবর্ধন মেইন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ইন্টারপাস করে তিনি আশুতোষ কলেজ-এ ভর্তি হন, গ্রাজ্যুয়েশনের জন্য। ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত তিনি বংশাল কোর্টে কাজ করেন। তিনি অভিনেত্রী অনুভা গুপ্তকে বিয়ে করেন। প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর দশ বছর পর তিনি ২৪শে নভেম্বর, ১৯৮২ সালে বৈশাখী দেবীকে বিয়ে করেন।
১৯৫৯ সালে তিনি আহ্বান চলচ্চিত্রে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন। তপন সিনহার গল্প হলেও সত্যি তে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি সবার নজরে আসেন। ১৯৬৮ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায় নির্মিত গুপী গাইন বাঘা বাইন চরিত্রে তাঁর অভিনয় চলচ্চিত্রজগতে একটি মাইলফলক। একে একে তিনি অভিযান (১৯৬২), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০), হীরক রাজার দেশে (১৯৮০), গুপী বাঘা ফিরে এলো (১৯৯১), পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯৩) সহ বেশকিছু উপমহাদেশখ্যাত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তিনি নিধিরাম সর্দার চলচ্চিত্রটি পরিচালনাও করেন। তিনি একজন বিখ্যাত থিয়েটার অভিনেতাও বটে। ১৯৭০ সালে তিনি গুপী গাইন বাঘা বাইন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালেও অংশ নেন। তিনি চলাচল থিয়েটার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ৪ঠা ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
অভিনীত চলচ্চিত্রসমূহ :
কাহিনী (১৯৯৭)
বাক্স রহস্য (টেলিভিশন) (১৯৯৬)
বৃন্দাবন ফিল্ম স্টুডিওস (১৯৯৬)
পতঙ্গ (১৯৯৪)
পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯৩)
আগন্তুক (১৯৯১)
গুপী বাঘা ফিরে এলো (১৯৯১)
অন্তর্জালি যাত্রা (১৯৮৭)
মহাযাত্রা (১৯৮৭)
অমর গীতি (১৯৮৩)
বাঁচামরার বাগান (১৯৮০)
হীরক রাজার দেশে (১৯৮০)
পাকা দেখা (১৯৮০)
নৌকাডুবি (১৯৭৯)
চারমূর্তি (১৯৭৮)
জানা অরণ্য (১৯৭৬)
কোরাস (১৯৭৪)
মৌচাক (১৯৭৪)
সঙ্গিনী (১৯৭৪)
ঠগিনী (১৯৭৪)
বসন্ত বিলাপ (১৯৭৩)
মর্জিনা আব্দুল্লাহ (১৯৭৩)
আজকের নায়ক (১৯৭২)
পদি পিসির বার্মি বাক্স (১৯৭২)
সবসে বড়া সুখ (১৯৭২)
ধন্যি মেয়ে (১৯৭১)
অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০)
আরোগ্য নিকেতন (১৯৬৯)
আপনজন (১৯৬৮)
বাঘিনী (১৯৬৮)
গুপী গাইন বাঘা বাইন (১৯৬৮)
বালিকা বধূ (১৯৬৭)
কাল তুমি আলেয়া (১৯৬৬)
মণিহার (১৯৬৬)
দল গোবিন্দের কড়চা (১৯৬৬)
গল্প হলেও সত্যি (১৯৬৬)
উত্তরপুরুষ (১৯৬৬)
গৃহ সন্ধানে (১৯৬৬)
স্বপ্ন নিয়ে (১৯৬৬)
আরোহী (১৯৬৫)
মহাপুরুষ (১৯৬৫)
এতটুকু বাসা (১৯৬৫)
সুরের আগুন (১৯৬৫)
আরোহী (১৯৬৪)
লাল পাথর (১৯৬৪)
শুভ ও দেবতার গ্রাস (১৯৬৪)
মোমের আলো (১৯৬৪)
অবশেষে (১৯৬৩)
নির্জন সৈকতে (১৯৬৩)
কষ্টিপাথর (১৯৬৩)
শেষ প্রহর (১৯৬৩)
ছায়াসূর্য (১৯৬৩)
বিনিময় (১৯৬৩)
ন্যায়দন্ড (১৯৬৩)
পলাতক (১৯৬৩)
আগুন (১৯৬২)
অভিযান (১৯৬২)
হাঁসুলীবাঁকের উপকথা (১৯৬২)
মেঘ (১৯৬১)
কিছুক্ষণ (১৯৫৯)
পরিচালিত চলচ্চিত্রসমূহ :
নিধিরাম সর্দার (১৯৭৬)
সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা (১৯৭৪)
অভিনয় জীবনের ধারাপাত -
“দিলাম ঝাঁপ। সে এক এক্সাইটিং ফিলিং। মনে হল পেঁজা তুলোর ওপর দিয়ে গড়িয়ে এলাম। কিন্তু হাত-পা স্টিফ। মানিকদা বললেন, ‘শিগগির ওদের ভ্যানে তোলো। আর গরম দুধ খাওয়াও।’ সব রেডিই ছিল। গাইড বলল, ‘খবরদার আগুনের কাছে যাবেন না। পা ফেটে যাবে। শুধু পা ঠুকুন। হাত পায়ের সাড় ফিরতে লাগল পাক্কা চব্বিশ ঘণ্টা।”
●“সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা। আমরা জুহুতে ‘পিকু’ ছবির শ্যুটিং করছি। সেটে রয়েছে ইরফান খান, দীপিকা পাড়ুকোন এবং অমিতাভ বচ্চন। সকাল থেকে ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে মিটিং করে শটটা প্ল্যান করেছি। টাইম মতো শ্যুটিং শুরু।হঠাৎ শটের মাঝখানে দেখি উনি দীপিকাকে বলছেন, “দীপিকা ডু ইউ নো দিস অ্যাক্টর কলড্ রবি ঘোষ?”
প্রশ্নটা করে উনি ইরফানের দিকেও তাকালেন। দীপিকা, ইরফান কেউই রবি ঘোষকে চিনতেন না। তার পর বলতে শুরু করলেন, ভারতবর্ষে রবি ঘোষের থেকে বড় কমিক টাইমিং আর কোনও অ্যাক্টরের না কোনও দিন হয়েছে, না কোনও দিন হবে। যখন বলছেন তখন আমি, ক্যামেরাম্যান, দীপিকা, ইরফান শুধু হাঁ করে ওঁকে দেখছি আর কথাগুলো শুনছি।
আমি তো জানতামই না উনি এত সূক্ষ্মতার সঙ্গে রবি ঘোষের অভিনয় দেখেছেন। শুনতে শুনতে সে দিন ভাবছিলাম, এত ডিটেলে রবি ঘোষকে অ্যানালাইজ করা বোধহয় শুধু ওঁর পক্ষেই সম্ভব।”
"..একমাত্র তিনিই বলতে পারেন , 'কী দাপট!' তাঁর বসার ঘরে থাকত শতাব্দীর অবিস্মরণীয় বিদুষক চার্লি চ্যাপলিনের ছবি। ছোট্ট মানুষ - যাঁর অস্তিত্ব বেমানান বলেই আমরা খানিকটা আশ্রয়স্হল খুঁজে পাই। মনে পড়ে , শেক্সপিয়ারের রাজা লিয়রের সেই অবিস্মরণীয় উচ্চারণ - 'Thou art the thing itself : unaccomodated man...' রবি ঘোষ ( ১৯৩১-১৯৯৭ ) সেই উদবৃত্ত মানুষ ...
"তিনি তো আমাদের কাছে কৌতুকাভিনেতাই। হাসি আসলে আমাদের জীবনে খানিকটা অতিরিক্ততা , যেন পানপাত্রের উপচে পড়া ফেনা। যা দেখতে ভালো লাগে , তবু যার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। অন্তত আমাদেরই অনেকের তাই ধারণা। অথচ ছবিতে হাসি অনিবার্যই। হলিউড থেকে টালিগঞ্জ - এই বিস্তৃত মানচিত্র জুড়ে নানা সময়ে শুধু কৌতুকোচ্ছটা। দুঃখ এই যে আমরা চার্লি চ্যাপলিনকে মনে রাখি , হয়তো বাস্টার কিটনকেও , কিন্তু আমাদের কখনোই মনে থাকে না - পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে আমাদেরও তুলসী চক্রবর্তী বা রবি ঘোষের মতো অভিনেতা ছিলেন , যাঁরা নায়ক-নায়িকার সাহায্য ছাড়াই , গান ও রঙিন দৃশ্য ছাড়াই , হাড়হিম করা মস্তানি ছাড়াই একটা আস্ত ছবি টেনে নিয়ে যেতে পারতেন ....
... মহানায়ক উত্তমকুমার তাঁর প্রতি এক নম্র শ্রদ্ধার্ঘ রেখেছেন - 'ওঁর পাশে অভিনয় করতে ভয় হয় , আমরা হয়তো জাঁকিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছি , আর রবি মাত্র কয়েক সেকেন্ড থেকে এমন একটা কিছু করবে যাতে ও গোটা দৃশ্যটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাবে - লোকে হেসে গড়িয়ে যাবে.." ....
.... রবি ঘোষের জীবন নির্দিষ্ট হয়ে গেলো পঞ্চাশ দশকের শুরুতে - যখন তিনি এল.টি.জি তে উৎপল দত্তের সান্নিধ্য পেলেন। উৎপল দত্তের দীক্ষা তিনি কোনোদিনই ভোলেননি। উৎপল দত্ত যদি তাঁকে অভিনয়ের চোখ দিয়ে থাকেন , সত্যজিত রায় তাঁকে দিয়েছিলেন শিল্পবোধের শিক্ষা...
.... রবি ঘোষ কারুর মতোই হননি। বাঙালী দর্শককে শুধু একটু মাঝে মাঝে জীবনের দিকে তাকানোর পরামর্শ দিয়ে গেছেন..."
অভিনয়ের এমনই পোকা ছিলেন যে বাড়ি থেকে তাঁকে বের পর্যন্ত করে দেওয়া হয়েছিল। তবে মায়ের সমর্থন ছিলো পুরোপুরি। তাই তিনি সামনে এগোতে পেরেছিলেন। ভাগ্যিস মায়ের সমর্থন ছিল নইলে বাংলা চলচ্চিত্র এত শক্তিশালী চরিত্র - অভিনেতা পেত না। মহড়া সেরে গভীর রাতে বাড়ি ফিরতেন , চুপি চুপি , যাতে বাবা টের না পান। জীবনের কী সমাপতন ! মঞ্চে অভিনয়ের ঠিক পাঁচদিন আগে বাবা চলে গেলেন। মায়ের কাছে বললেন ছেলে‚ তাঁর দলের অনেক দেনা-কর্জ। শো বাতিল হলে মুশকিল। কালাশৌচের মধ্যেই প্রথম মঞ্চাবির্ভাব। অভিনয়ের প্রতি এই নিখাদ নিবেদন বজায় ছিল জীবনের শেষদিন অবধি। তখন তিনি প্রতিষ্ঠিত। আচমকা মৃত্যু ছোট বোন তপতীর। তার কয়েক ঘণ্টা পরে মঞ্চে বেদম হাসির নাটক " কনে বিভ্রাট " দেখে কেউ আঁচও করতে পারেনি সদ্য বোনকে হারানো রবি ঘোষের মনের মধ্যে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে --- সে যেন ছিল নিজের সঙ্গে নিজের প্রতি হাস্যকর অভিনয় ! তিনি অভিনেতা নয়, কমেডিয়ান নয় বরং চরিত্রাভিনেতা হিসেবে নিজেকে সব সময় পরিচয় দিতেন। বলতেন যেকোনো চরিত্রই ফুটিয়ে তোলা একজন চরিত্রাভিনেতার কাজ।
তিনি তাঁর অভিনয়ের গুরু বলে মানতেন চার্লি চ্যাপলিনকে। যে চ্যাপলিন বলেছিলেন, “Actors search for rejection. If they don’t get it they reject themselves.” এখন আর কমেডিয়ানদের যুগ নেই। সারা বছরে হয়তো গুটিকয়েক কমেডি ছবি মুক্তি পায়। একটিও বক্স-অফিস সাফল্য নয়। অনেকবছর আগে অনীক দত্তের ‘ ভূতের ভবিষ্যৎ ’ রমরমিয়ে চলেছিল বটে। তাও হাতেগুনে ওই একটিই। এখনকার কমেডি বাংলা ছবি জোর করে কাতুকুতু দিয়ে লোক হাসায়। কিন্তু রবি ঘোষকে কেউ ভোলেনি। ‘দ্য রিয়্যাল হিরো’ - কে ভুলে যাওয়া সহজ নয়। শুধু বডি - বডি করে না কাটিয়ে পড়াশোনাও করেছেন নিজের মতো। তাঁর পড়াশোনা, বিশ্বের বিভিন্ন ছবি দেখা কত সমৃদ্ধ, সবকিছুই বোঝা যাবে রবি ঘোষের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার শুনলে বা পড়লে । ভাগ্যিস তিনি অভিনয়ে এলেন ! নাহলে এই ক্ষুদ্র জীবন নতুন দর্শনের ভ্রমণে ঘুরতে পারতেন না।
বিশ্বখ্যাত পরিচালক - অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন বলেছিলেন, “ To truly laugh, you must be able to take your pain, and play with it.”
তারপর আরও বলেছিলেন, “ Life is a tragedy when seen in close-up, but a comedy in long-shot.” -- এই অমোঘ সমস্ত কথাগুলির সঙ্গে দৃশ্যত মানিয়ে যায় আমাদের প্রত্যেকের পছন্দের এক অভিনেতার নাম -- তিনি হলেন রবি ঘোষ ! পুরো নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষদস্তিদার। আক্ষরিক ও ব্যবহারিক দু দিক দিয়েই মধ্যবিত্ত বাঙালির পক্ষে খুব ভারী নাম। সংক্ষেপ করে নিয়েছিলেন। বাদ পড়েছিল ইন্দ্র‚ নাথ ও দস্তিদার। যেটুকু ছিল সেটুকু ছোট‚ উচ্চারণেও সুবিধে - ছোট হলেও সে নামের ওজন ও অভিঘাত দুইই বড় সাঙ্ঘাতিক । কয়েক দশক ধরে বাংলা ছবিতে সে নামের ‘ কী দাপট ‘ ! জন্ম পূর্ববঙ্গে ১৯৩১-এর ২৪শে নভেম্বর।
আপাদমস্তক দক্ষিণ কলকাতার মহিম হালদার স্ট্রিটের বাসিন্দা। পড়তেন ভবানীপুরের সাউথ সাবার্বান স্কুলে। তারপর আশুতোষ কলেজ। বিজ্ঞান শাখায় পড়ছেন। বাবার আশা‚ ভবিষ্যতে ভদ্রস্থ চাকরি বাঁধা। কিন্তু ছেলেও মন বন্ধক দিয়ে দিয়েছেন থিয়েটারের কাছে । সেই সময় মাস্ল ফুলিয়ে, ছাতি চওড়া করে সিনেমায় ‘হিরো’ হওয়ার চল ছিল না। সুন্দর মুখ আর শক্তিশালী অভিনয়েই প্রত্যেকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে নিজের জাত চেনাতেন। তিনি একলব্য হলে তাঁর দ্রোণাচার্য উৎপল দত্ত। কলেজে পড়তে পড়তে শরীরচর্চা করতেন। পাখির চোখ - মঞ্চে অভিনয়।
‘গল্প হলেও সত্যি’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘অভিযান’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ ছবিগুলিতে একের পর চুটিয়ে অভিনয় করে নিজের জাত চিনিয়ে ছিলেন ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা রবি ঘোষ। নায়কোচিত চেহারা না হলেও সে যুগের বাংলা ছবির সমস্ত পরিচালকের প্রিয়পাত্র ছিলেন রবি। তাঁর হাত ধরেই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কত কত সফল অভিনেতা ও অভিনেত্রী এসেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে ! ১৯৫৩ সালে কলকাতা ব্যাঙ্কশাল কোর্টে চাকরি শুরু করলেও ১৯৬১-তে সেই পাট চুকিয়ে পাকাপাকি ভাবে অভিনয়কেই পেশা হিসেবে বেছে নেন রবি ঘোষ। অভিনয়ের সঙ্গে এতটাই একাত্ম হতেন যে যখনই কোনো নতুন মুখের দরকার পড়েছে তখনই এগিয়ে এসেছেন। ‘আকাশ কুসুম’-এর জন্য মৃণাল সেনের কাছে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে, ‘মহানগর’এর জন্য জয়া ভাদুড়িকে, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’- র জন্য সত্যজিত রায়ের কাছে শমিত ভঞ্জ ও শুভেন্দুকে নিয়ে গিয়েছেন।
সিনেমা দেখেন কিন্তু রবি ঘোষকে পছন্দ করেন না - এমন তো হতেই পারে না। ‘ বাঘা বাইন ’ আসলে রবি ঘোষ বরিশালের বাঙাল , যদিও বড় হয়েছেন কলকাতায়। জীবনের বড় অংশ জুড়েই আছে তাঁর সিনেমার গুরু সত্যজিৎ রায়, নাটকের গুরু উৎপল দত্ত ও কমলকুমার মজুমদার। চকলেটের লোভ দেখিয়ে জয়া ভাদুরিকে নায়িকা হতে রাজি করিয়েছিলেন রবি ঘোষ। বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে বিশেষ প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তবে বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে তিনি সবচেয়ে পরিচিত তাঁর হাস্যরসাত্মক চরিত্র রূপায়নের জন্য। চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি বাংলা নাট্যমঞ্চ এবং টেলিভিশন তথা ছোট পর্দায় অভিনয় করেছেন। রবি ঘোষের অভিনয়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্যই ছিল হাস্যরসের মাধ্যমে সামাজিক রূঢ় বাস্তবিক ঘটনাগুলিকে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা। অভিনয়ের আন্তরিকতা ও সংবেদনশীলতা তাঁর প্রতিটি চরিত্রকে নতুন আঙ্গিকে হাজির করেছিল। আজীবন বাংলা ছবির ‘কমেডিয়ান’ তকমা পেলেও তিনি ছিলেন এক অসাধারণ চরিত্র অভিনেতা !
অথচ পর্দায় যতই তিনি একজন কমেডিয়ান অভিনেতা হোন না কেন, বাস্তবে ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত। যিনি সময় পেলেই 'রামকৃষ্ণ কথামৃত' পড়তেন। পরচর্চা পরনিন্দা একবারে না-পসন্দ। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন সাঙ্ঘাতিক সিরিয়াস। প্রথম স্ত্রী অভিনেত্রী অনুভা গুপ্ত প্রয়াত হয়েছিলেন ১৯৭২-এ। তার ১০ বছর পরে বিয়ে বৈশাখী দেবীকে। এক বন্ধুর বাড়িতে প্রথম আলাপ। প্রথম দর্শনে বৈশাখী দেবী নাকি খুব হেসেছিলেন তাঁকে দেখে। পরে নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন বৈশাখী দেবী। আলাপের মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে বিয়ে। যখনই মজার সংলাপ শোনার আব্দার করতেন উল্টোদিক থেকে জবাব আসতো - কেন ! আমি কি জোকার ?
বাইরের কেউ না থাকলে কাজের লোকেদের, ড্রাইভার গণেশকে বসিয়ে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ শোনাতেন। যে জন্য বহুবার বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন, জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত তাতেই নিবিষ্ট করেছিলেন, তার নাম ‘অভিনয়’। বরিশালের এ হেন কুলীন বাবুটি হলেন রবি ঘোষ।
পাঁচের দশকে (১৯৫০-’৫১) ‘সাংবাদিক’ নাটক দিয়ে পথ চলা শুরু। উৎপল দত্তের পরিচালনায় এই নাটকে মাত্র তিরিশ সেকেন্ডের অভিনয় দেখে সে দিন মৃণাল সেন বুঝেছিলেন রবি ঘোষ কত বড় অভিনেতা। সাউথ সাবারবান মেন স্কুলে পড়াকালীন নাটকের মহড়া দিতেন বন্ধুদের ছাদে। সহপাঠী অভিনেতা তরুণ চট্টোপাধ্যায় সঙ্গে থাকতেন। ভবানীপুর আশুতোষ কলেজের নৈশ বিভাগে বি কম- পড়ার পাশাপাশি নিয়মিত শরীরচর্চায় মন দেন। কলেজই বন্ধুত্ব হয় সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এঁরই পরামর্শে পৌঁছে যান উৎপল দত্তের নাটকের দল ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপে’। ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৫৯ — উৎপল দত্তের পরিচালনায় মিনার্ভা থিয়েটারে লিটল থিয়েটার গ্রুপ নিবেদিত ‘অঙ্গার’ নাটকের প্রথম শো।
সেদিন থেকে শেষ শো পর্যন্ত অভিনয় করেছিলেন তিনি। এই নাটকের জন্য ‘উল্টোরথ’ পুরস্কার পান। নাছোড় অভিনেতা-পুত্রের অভিনয় দেখার দিন ঠিক করেছিলেন শেষ পর্যন্ত বাবা জীতেন্দ্রনাথ। কিন্তু বিখ্যাত ‘অঙ্গার’ নাটকে ছেলের অভিনয় আর দেখা হয়নি। ২৫ ডিসেম্বর মারা যান তিনি। ‘অঙ্গার’ নাটকে সনাতনের ভূমিকায় একজন ছোটোখাটো চেহারার মানুষ খনি থেকে উঠে উচ্চ স্বরে বলে উঠেছিলেন ‘ আমি একজন ভূতপূর্ব লোক ’ ‑ যাঁরা সেই কন্ঠস্বর শুনেছিলেন তাঁরা আজীবন ভুলতে পারেননি।
ওঁর জীবনের অন্যতম প্রেরণা ছিলেন স্ত্রী অনুভাদেবী। অনুভা যখন একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী, তখন রবি ঘোষ একজন স্ট্রাগলিং অভিনেতা। অথচ কী সুন্দর ভাবে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ‘অঙ্গার’ নাটকের অভিনয় দেখে পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ‘কিছুক্ষণ’ ও তপন সিংহ ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’র জন্য ডাকেন। আর থেমে থাকতে হয়নি। তপন সিংহ তো রবিকে শুধু কমেডিয়ান হিসাবে দেখতেন না, দেখতেন চরিত্রাভিনেতা হিসাবে। তাঁর কথায়, “গোটা ভারতবর্ষে রবির মতো অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্রাভিনেতা বাস্তবিক খুঁজে পাওয়া কঠিন। ”
‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’র পরেই প্রস্তাব আসে সত্যজিত রায়ের ‘অভিযান’-এর জন্য।
‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’ ছবি করার সময় থেকে অনুভাদেবীর সঙ্গে সম্পর্কের শুরু। সেই সময় রবি ঘোষ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে অনুভাদেবীর সেবায় সুস্থ হয়ে ওঠেন। নানা টানাপোড়েনের মধ্যে বিয়ে করলেও ১৯৭২-এ স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন রবি ঘোষ। প্রায় বছর দেড়েক অভিনয় জগত থেকে সরে ছিলেন। ফিরে আসেন ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’- এর মাধ্যমে। এর এক দশক পরে, ১৯৮২-তে বৈশাখীদেবীকে বিয়ে করেন। ৪৭ নম্বর মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন গলফ গ্রিনের ফ্ল্যাটে।
সময়ের ব্যাপারে খুব পাংচুয়াল ছিলেন রবি ঘোষ। ‘ঠগিনী’ শ্যুটিং-এ একদিন নির্দিষ্ট সময় পার করে ফ্লোরে এলেন। লাঞ্চের সময় জানালেন, মাকে দাহ করে এলেন, তাই দেরি। কর্তব্যপরায়ণ, দিলখোলা, আড্ডাবাজ, খাদ্যরসিক, বহুমুখী প্রতিভাধর অভিনেতা ছিলেন রবি ঘোষ। শুধু তা-ই নয়, রবি ঘোষ ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। এখানে তাঁর সম্পর্কে তাপস সেনের মূল্যায়নটি মনে রাখার মতো। তাঁর কথায়, “ বহু মানুষের নানা সমস্যায় রবি যে সাহায্য করেছিল তা তাদের সূত্রেই জানতে পারি। শুধু বড় শিল্পী নয়, তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মানুষ। ” লোকে বলতো, ‘রবি ঘোষ মানেই একাই একশো’। পরিচালক তপন সিংহ তাই বলেছিলেন, “গোটা ভারতবর্ষে রবির মতো অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্রাভিনেতা বাস্তবিক খুঁজে পাওয়া কঠিন। রবি ঘোষকে আমি সেই অর্থে কখনও কমেডিয়ান হিসেবে দেখিনি।”
" ওই চেহারার চোখদুটোই কথা বলে ! " যেমনটি বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়।
রবির অভিনয় সম্পর্কে একটা খাঁটি কথা বলেছিলেন উত্তমকুমার : “ আমরা হয়তো জাঁকিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছি, আর রবি হয়তো কয়েক সেকেন্ড থেকে এমন একটা কিছু করবে যে ও গোটা দৃশ্যটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাবে, লোকে হেসে গড়িয়ে পড়বে ”। আর বলিউডের প্রখ্যাত পরিচালক হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন,“ সব অভিনেতা, সব শিল্পী সব সময় আমার কাছে একশোয় একশো পায় না। রবি পেয়েছিল। ”
ওপরের দুটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি একে একে তিনি সত্যজিৎ রায়ের অভিযান (১৯৬২), মহাপুরুষ (১৯৬৫), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০), হীরক রাজার দেশে (১৯৮০), গুপী বাঘা ফিরে এলো (১৯৯১), আগন্তুক (১৯৯১) প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন। তিনি ‘নিধিরাম সর্দার’ নামে একটি চলচ্চিত্রও পরিচালনা করেন। ১৯৭০ সালে তিনি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও অংশ নেন। গৌতম ঘোষ পরিচালিত বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘পদ্মা নদীর মাঝি’-তেও অভিনয় করেন রবি ঘোষ।
এসবের বাইরে রবি ঘোষ অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হচ্ছে ‘বসন্ত বিলাপ’(১৯৭৩), 'পদি পিসির বার্মি বাক্স’ (১৯৭২), ‘ধন্যি মেয়ে’ (১৯৭১), ‘বালিকা বধূ’ (১৯৬৭), ‘কাল তুমি আলেয়া’(১৯৬৬),
‘স্বপ্ন নিয়ে’(১৯৬৬), ‘মোমের আলো’ (১৯৬৪), হাঁসুলীবাঁকের উপকথা (১৯৬২) প্রভৃতি।
প্রায় অর্ধশত বছরের অভিনয় জীবনে তিনি প্রায় একশর মতো ছবিতে কাজ করেছেন।
‘অভিযান’-এ ট্যাক্সি ক্লিনার, ‘জন অরণ্য’- এ ‘মিস্টার মিত্র’, ‘গল্প হলেও সত্যি’- তে ধনঞ্জয়, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’- তে আমিনুদ্দিন, অরণ্যের দিন রাত্রি’- তে শেখর, ‘আগুন্তুক’- এ রঞ্জন, ‘অন্তর্জলী যাত্রা’- য় জ্যোতিষী বা 'ধন্যি মেয়ে' চলচ্চিত্রে পুরুত কাম রেফারি সহ বহু চরিত্র মানুষের মনে এক উজ্বল উপস্থিতি ছিল তাঁর। ১৯৫৯-১৯৯৪ পর্যন্ত ২০৬টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। হিন্দিতে ‘সত্যকাম’, ‘সব সে বড়া সুখ’, ‘আজ কি রবিন হুড’, ‘পতঙ্গ’ ছবিতে। ১৯৫২-১৯৯৫ প্রায় ৩৯টি নাটকে অভিনয়। ‘শ্রীমতী ভয়ঙ্করী’ ১০০০ রজনী, ‘কনে বিভ্রাট’ ৬৩৫ রজনী, আজও ইতিহাস হয়ে গিয়েছে। চলচ্চিত্র-নাটক ছাড়াও যাত্রা আর দূরদর্শনে সমান গতিতে এগিয়ে গিয়েছিলেন রবি ঘোষ। তবে শুধু অভিনেতা হিসেবে নন, পরিচালক হিসেবে রেখে গিয়েছেন কিছু নিদর্শনও। উৎপল দত্তই একদিন বলেছিলেন, স্টেজ ম্যানেজারের পদ ছেড়ে এবার নাটক পরিচালনা করো।
তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ পাঠক। তাঁর সেই পাঠকসত্তাই তাঁকে করেছিল লেখক। কলম ধরেছিলেন রবি। লিখেছিলেন দশটি কৌতুক নকশা। ১৯৯৭-এর বইমেলায় প্রকাশিত হল তাঁর ‘হাসতে যাদের মানা’। বইমেলার ইতিহাসে স্মরণীয় ১৯৯৭। সে বছরই বিধ্বংসী আগুনে মেলা পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। তিনদিনের মাথায় ফের শুরু হয়েছিল মেলা। কিন্তু সেই বইমেলা বাঙালির জীবনে আরও একটি বিষাদময় ঘটনার জন্য স্মরণীয়। তাঁর বই প্রকাশিত হল, আর তিনিও চলে গেলেন। মেলা চলাকালীনই ৪ ফেব্রুয়ারি হঠাৎই প্রয়াত হলেন রবি ঘোষ। তাঁকে হারিয়ে তাঁর সঙ্গী ‘গুপী গাইন’ তপেন চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “ শনিবার জুটি ছিলাম, রবিবার একা হয়ে গেলাম। ”
বিভিন্ন সম্মানে নিজের অভিনয়ের মাঠ আলো করে গিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রত্যেকের জন্য ময়দান খালি আছে। যে যার নিজের রুচি অনুযায়ী সৃষ্টি করতে পারবে, সে-ই দৌড়তে পারবে। রোম্যান্টিক ছিলেন না বিশেষ। খুব কেয়ারিং ও স্নেহপ্রবণ ছিলেন। নিজে কম কথা বলতেন। পছন্দ করতেন মৃদুভাষীদের। আর ছিলেন সাধারণ জীবনযাপনে আগ্রহী। বাড়িতে তিনি সম্পূর্ণ সংসারী। বলিষ্ঠ অভিনেতার ছায়া অবধি সেখানে নেই। জীবনের উপান্তে এসে ইচ্ছে ছিল অভিনয় করা ছেড়ে অভিনয় শেখাবেন। লিখবেন আত্মজীবনী। সে আর হল না একদিন সিরিয়ালের অভিনয় করতে করতে বললেন‚ " এটাই আমার শেষ শট ! এরপর বাড়ি যাব ! " সত্যি চলে গেলেন তিনি চিরতরে ! ১৯৯৭-এর ৪ ফেব্রুয়ারি‚ ৬৫ বছর বয়সে ! " এ যেন ধনঞ্জয়ের ইচ্ছাশক্তি ! যখন প্রয়োজন, আসব , নারকোলের মালা দিয়ে সমাজের শ্যাওলা তুলব !
বাঘা বায়েন হয়ে শুন্ডি রাজার প্রাসাদের ফোয়ারায় কলার খোসা ফেলে দেখিয়ে দিয়েছিলেন - আভিজাত্য বনাম মেঠো সুর। অভিযানে গাড়ি ছোটাবো। মহাপুরুষের কাপুরুষতা দেখাবো। মেমারি গেমে অতুল্য ঘোষের নাম বলব। বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে ফুটবল খেলাব। অরণ্যে মিশেও একজন হয়ে উঠব। তারপর কাজ শেষ হয়েছে মনে হলে চলেও যাব। তারপর‚ হলিউড টালিগঞ্জকে বলবে‚ তুমি চার্লি চ্যাপলিনকে চেনো ? উত্তরে টালিগঞ্জ হলিউডকে বলবে‚ আপনি রবি ঘোষকে চেনেন ?
চ্যাপলিনের ভাবশিষ্য তুলসী চক্রবর্তী‚ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়‚ অনুপকুমার‚ কিংবা রবি ঘোষদের হলিউড - বলিউড স্বীকৃতি বা পদ্মশ্রী-ভূষণ-বিভূষণ দরকার হয়না, তাঁদের প্রতিভাই শতদলের মতো বিকশিত। তবে সারাজীবনে নানা পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন। "গুপী গাইন বাঘা বাইন" চলচ্চিত্রে অভিনয় করে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিলেন।
এছাড়া তিনি BFJA ও আনন্দলোক পুরস্কার পেয়েছিলেন অভিনয় জীবনের জন্য !
আলোচনা
'নাটক আমার স্ত্রী, সিনেমা আমার ফিঁয়াসে’ ::
****************************************************
তাঁকে কমেডিয়ান বললে ভীষণ রেগে যেতেন। বলতেন— কমেডিয়ান বলে আলাদা কোনও সংজ্ঞায় আমার বিশ্বাস নেই, আমি এক জন চরিত্রাভিনেতা। কথাগুলি রবীন্দ্রনাথ ঘোষদস্তিদারের— চলচ্চিত্র, মঞ্চ, যাত্রা ও টিভি সিরিয়ালখ্যাত এক অভিনেতা। সংলাপের সাহায্যে নয়, শারীরিক ভাবভঙ্গি দিয়ে যে হাস্যরস তৈরি হয়, সেই ‘স্ল্যাপস্টিক’ অভিনয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন। তাঁকেই গুরু মেনে এই অভিনেতা অতবড় নাম ছেঁটেকেটে বাংলা অভিনয় জগতে এলেন রবি ঘোষ নামে।
অভিনয় ছিল তাঁর মজ্জায় মজ্জায়। তাই কোনও বাধাই তাঁর সেই ‘প্যাশন’কে দমিয়ে রাখতে পারেনি। আর পেশাদারিত্ব? ঠিক সময়ে কাজের জায়গায় পৌঁছনো ছিল তাঁর স্বভাব। ‘ঠগিনী’ ছবি তৈরির সময় এক দিন বেশ দেরি হল ফ্লোরে পৌঁছতে। দুপুরের ব্রেকের আগে পর্যন্ত নির্বিঘ্নে কাজ শেষ হলে জানা গেল তিনি সেই সকালেই মা-কে দাহ করে এসেছেন। তাই দেরি। অনেক সময় গাড়ির চালক না এসে পৌঁছলে, ট্যাক্সি ধরে বেরিয়ে পড়তেন, জানালেন তাঁর স্ত্রী বৈশাখি ঘোষ। পরিচালক সন্দীপ রায় বলছেন, “কমেডিয়ান হিসেবে তাঁর খ্যাতি হলেও আদতে তিনি ছিলেন চরিত্রাভিনেতা।” আসলে রবি ঘোষ এমনই একটা নাম, বাঙালি যাঁকে এক জন কমপ্লিট অভিনেতা হিসেবেই চেনে।
পর্দায় অভিনেতা রবি ঘোষের যে রূপ দেখা যায়, ব্যক্তি হিসেবে একেবারেই তিনি তার বিপরীতের। একটি গুরুগম্ভীর মানুষ, যিনি সময় পেলেই রামকৃষ্ণ কথামৃত পড়ে সময় কাটাতেন। আর পড়তেন প্রবন্ধ-নাটকের নানা বই। প্রথম জীবনে কমিউনিজিমে দীক্ষিত হয়েও পরবর্তী কালে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ পড়তেন। সে অর্থে নিজে পূজার্চনা না করলেও, অন্যের বিশ্বাস-ভক্তিকে কখনও ছোট করেননি। মাঝে মধ্যে অবশ্য কৌতুকের ভঙ্গিমায় বলতেন— আমাকে রসেবশে রাখিস মা! পরচর্চা-পরনিন্দা করে সময় নষ্ট করতেন না, এমনকী খারাপ শব্দও ব্যবহার করতেন না কখনও। “তবে, ‘মাইরি’ শব্দটা প্রায় প্রতি ক্ষণেই বলে ফেলতেন রবিদা।”, বললেন তাঁর এক সময়ের প্রতিবেশী ও পরম বন্ধু-চিত্রগ্রাহক নিমাই ঘোষ।
আড্ডাবাজ, পরোপকারী মানুষটি খেতে ভালবাসলেও খুবই পরিমিত আহারে অভ্যস্ত ছিলেন। প্রিয় খাবার ছিল লুচি ও পাঁঠার মাংস। ভালবাসতেন লোককে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে। তবে, গোল বাঁধত যখন তা বাড়িতে জানাতে ভুলে যেতেন। সন্ধে বা রাতে বাড়িতে অতিথি এসে উপস্থিত হলে খুবই গম্ভীর হয়ে তাঁদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলতেন। সময়ে-অসময়ে এ ভাবেই অবস্থার সামাল দিতেন এই ‘মজার’ মানুষটি। বৈশাখিদেবীর সঙ্গে একমত সন্দীপ রায়। তিনি শোনালেন আরও একটি ছোট্ট ঘটনা, বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ দেখানো হবে। সেই সূত্রে রবিকাকার বিদেশ যাওয়া, প্রথম বার। এক দিন রবিকাকা ও তপেনকাকাকে নিয়ে শপিং-এ বেরিয়েছি। জার্মানদের চেহারা লম্বা-চওড়া হয়। সেখানে কোনও জামাকাপড় রবিকাকার ফিট করছে না। শেষে এক জার্মান মহিলা ছোটদের বিভাগে নিয়ে গিয়ে জামাকাপড় কিনিয়ে দেন। অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে রবিকাকা কেনাকাটা করে ফিরে আসেন।
২৪শে নভেম্বর, ১৯৩১। কোচবিহারে মামাবাড়িতে জন্ম হয় রবি ঘোষের। বাবা জীতেন্দ্রনাথ ঘোষদস্তিদার আদতে ছিলেন পূর্ব বাংলার বরিশালের গাভার বাসিন্দা। চাকরিসূত্রে তিনি থাকতেন কলকাতার মহিম হালদার স্ট্রিটে। মা জ্যোৎস্নারানি ছিলেন কোচবিহারের সুনীতি অ্যাকাডেমির বৃত্তি পাওয়া ছাত্রী ও বড়মামা ছিলেন শচীনকর্তার প্রিয় ছাত্র। পাঁচ ভাইবোনের দ্বিতীয় ছিলেন রবি। বড় দিদি সবিতা এবং ছোট দীনেন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ ও তপতী।
পড়াশোনার শুরু কোচবিহার জেনকিন্স স্কুলে। পরে ১৯৪৭ সালে কলকাতার সাউথ সাবার্বান মেন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। স্কুলে তাঁর সহপাঠী ছিলেন উত্তমকুমারের ভাই অভিনেতা তরুণ চট্টোপাধ্যায়। ভবানীপুর আশুতোষ কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯৪৯ সালে এবং এই কলেজেরই নৈশ বিভাগে বি কম-এ ভর্তি হন। নিয়মিত শরীরচর্চার শুরু কলেজের ব্যায়ামাগারেই। পরবর্তী কালে ‘জিম’ না গেলেও, মর্নিং ওয়াক এবং বাড়িতেই নিয়মিত ব্যায়াম করতেন তিনি, জানালেন স্ত্রী বৈশাখি ঘোষ।প্রথম স্ত্রী অনুভা গুপ্তর সঙ্গে সম্পর্কের শুরু
হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’ ছবি করার সময়। সেই সময় হঠাত্ই অসুস্থ হয়ে পড়েন রবি ঘোষ। অনুভাদেবীর শুশ্রুষায় সুস্থ হয়ে ওঠেন। নানা টানাপোড়েনের পর তাঁরা বিয়ে করলেও, ১৯৭২ সালে অনুভাদেবীর অকাল মৃত্যুতে সেই সম্পর্ক দীর্ঘ হয়নি। এই ঘটনার এক দশক পর ১৯৮২ সালে রবি ঘোষ বিয়ে করেন বৈশাখিদেবীকে। তখন তিনি মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছেন গল্ফগ্রিনের ফ্ল্যাটে।
৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭ জীবনাবসান হয় এই চরিত্রাভিনেতার।
অভিনয়কে সঙ্গে নিয়েই জন্মেছিলেন রবি ঘোষ। এবং তার বিকাশ ঘটে স্কুলে পড়াকালীনই। ছাত্রজীবনে ‘বন্ধুমন’ নামে একটি নাটকের দল গড়ে মহড়া দিতেন আশুতোষ কলেজের ছাদে। নাটকের জন্য বহু বার বাড়ি থেকে বিতাড়িত হতে হয়। অভিনয় করা তাঁর বাবা জীতেন্দ্রনাথ একেবারেই পছন্দ করতেন না। প্রায়ই স্ত্রী জ্যোৎস্নারানিকে বলতেন, “রবি অভিনয় কইরা সময় নষ্ট করে ক্যান? তোমার পোলারে কয়া দিও ওই চেহারায় অভিনয় হয় না। সে ছিল দুর্গাদাস বাঁড়ুজ্যে, হিরোর মতো চেহারা।” বাবা না হলেও, মা ও বড়মামার সমর্থন ছিল পুরোপুরি।
১৯৫৩ সালে কলকাতা পুলিশকোর্টে (ব্যাঙ্কশাল) চাকরি শুরু করলেও ১৯৬১ সালে সে সব পাট চুকিয়ে পাকাপাকি ভাবে অভিনয়কেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। অভিনয় জীবন শুরু পাঁচের দশকে ‘সাংবাদিক’ নাটক দিয়ে। পরিচালক উৎপল দত্ত। নাটকে রবি ঘোষের চরিত্র ছিল এক জন সংবাদপত্র বিক্রেতার, মঞ্চের এক দিক দিয়ে ঢুকে অন্য প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া ছিল তাঁর ভূমিকা। মাত্র তিরিশ সেকেন্ডের অভিনয় দেখে পরিচালক মৃনাল সেন সে দিনই বুঝেছিলেন তাঁর অভিনয় দক্ষতা। সোভিয়েত নাট্যকার সিমোনোভের লেখা ‘দ্য রাশিয়ান কোয়েশ্চেন’ অবলম্বনে নাটকটি অনুবাদ করেছিলেন সরোজ দত্ত। কলেজের বন্ধু, অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরামর্শেই উৎপল দত্তের নাটকের দল লিট্ল থিয়েটার গ্রুপ-এর সংস্পর্শে আসা।
৩১ ডিসেম্বর, ১৯৫৯ সাল। উৎপল দত্তের পরিচালনায় মিনার্ভা থিয়েটারে এলটিজি-র নিবেদিত ‘অঙ্গার’নাটকের প্রথম শো। এবং সে দিন থেকে নাটকের শেষ রজনী পর্যন্ত তাতে অভিনয় করেন রবি ঘোষ। ১৯৫৯ সালের উল্টোরথ (শ্রেষ্ঠ মঞ্চাভিনেতা) পুরস্কারও লাভ করেন অঙ্গারের জন্য। উল্লেখ্য, প্রথম শো-এর পাঁচ দিন আগে, ২৫ ডিসেম্বর পিতৃহারা হন রবি। কিন্তু ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ সরিয়ে রেখে অভিনয়ের ডাকেই সাড়া দিয়েছিলেন তিনি। এমনই ছিল তাঁর পেশাদারিত্ব।
উৎপল দত্ত পরিচালিত নাটক বাদ দিলে কেবলমাত্র অভিনেতা-বন্ধু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘ঘটক বিদায়’ নাটকে অভিনয় করেন রবি ঘোষ। স্টার থিয়েটারে প্রায় ‘পাঁচশো নাইট’ নাটকটি চলে রমরমিয়ে। চলচ্চিত্রে অবশ্য সত্যজিৎ রায়, উৎপল দত্ত, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, তপন সিংহ, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, মৃণাল সেন, গুরু বাগচি, অজয় কর, তরুণ মজুমদার, দীনেন গুপ্ত, শেখর চট্টোপাধ্যায়, অসিত সেন, দিলীপ রায়, গৌতম ঘোষ, শিবু মিত্র, বিমল কর, সলিল সেন, সন্দীপ রায়, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, সুখেন দাস, রাজা মিত্র, অঞ্জন চৌধুরী-সহ বহু পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন।
‘অঙ্গার’ নাটকে রবিবাবুর অভিনয় দেখেই পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ‘কিছুক্ষণ’ ও তপন সিংহ ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’র জন্য তাঁকে ডাকেন। এর পরেই প্রস্তাব আসে সত্যজিৎ রায়ের ‘অভিযান’-এর জন্য। থিয়েটার থেকে চলচ্চিত্রে এলেও দু’টি মাধ্যমের তফাত মাথায় রেখে একটার পর একটা বাংলা ছবির চরিত্রাভিনেতা হয়ে ওঠেন রবি ঘোষ।
মঞ্চাভিনেতা থাকাকালীন নিজের একটি নাটকের দল ‘চলাচল’ গড়ে তোলেন। ঠগ, অলীকবাবু, ছায়ানট-সহ ৮টি নাটক প্রযোজনা করে সেই দল। লিট্ল থিয়েটার গ্রুপ-এ থাকাকালীন ‘নবসংস্করণ’ ও ‘শোধবোধ’ নামে দু’টি নাটকের পরিচালকের কাজ করেন রবিবাবু। ‘সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা’ ও ‘নিধিরাম সর্দার’ নামে দু’টি সিনেমা পরিচালনার কাজও করেছেন এই রবি ঘোষ।
কর্মসূচি:
• ১৯৫৯-১৯৯৪ পর্যন্ত প্রায় ২০৬টি চলচ্চিত্র।
• ১৯৫২-১৯৯৫ পর্যন্ত প্রায় ৩৯টি নাটক করেছিলেন। উল্লেখ্য শ্রীমতী ভয়ঙ্করী ১০০০ রজনী, (বিজন থিয়েটারে ৯০০ ও সুজাতা সদনে ১০০)। কনে বিভ্রাট ৬৩৫ রজনী, (সারকারিনায় ৫৩৫ ও সুজাতা সদনে ১০০), নব সংস্করণ, শোধবোধ, ঠগ, ধনপতি গ্রেফতার, অলীকবাবু, ছায়ানট ইত্যাদি।
• হিন্দিতে অভিনয় করেন সত্যকাম, সব সে বড়া সুখ, আজ কি রবিনহুড, পতঙ্গ।
• ১৯৮৭-১৯৯৬ পর্যন্ত যাত্রা ৪টি। পাল্কি চলে রে (নট্ট কোম্পানি), বিয়ে পাগলা বুড়ো, লাট সাহেবের নাতজামাই, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল (মুক্তলোক)
• ১৯৮৬-১৯৯৮ পর্যন্ত দূরদর্শনে ধারাবাহিক গোয়েন্দা ভগবান দাস (রবি ওঝা), হুতোমের নকশা (তপন সিংহ), ফেলুদা ৩০ (সন্দীপ রায়), গোপাল ভাঁড় (দেব সিংহ), মনোরমা কেবিন (জগন্নাথ গুহ), মৃত্যুসাক্ষী (হিন্দি, আশিস মিত্র), নেপোলিয়নের বিয়ে (সুভাষ চট্টোপাধ্যায়), রিপোর্টার এক্স (সোমনাথ বিশ্বাস), দে রে ও মনোরমা কেবিন (যীশু দাশগুপ্ত) সহ প্রায় ১৪টিতে। (যেগুলির মধ্যে কিছু কিছু এখনও অসমাপ্ত রয়েছে)।
সম্মান:
• ‘অঙ্গার’ নাটকের জন্য উল্টোরথ (শ্রেষ্ঠ মঞ্চাভিনেতা) পুরস্কার লাভ ১৯৬০-এ।
• মরিশাস সরকারের আমন্ত্রণে ‘সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র উৎসবে’ যোগদান। বাংলা চলচ্চিত্র প্রচার সংসদ কর্তৃক ‘সাবাস পেটো পাঁচু’ নাটকের জন্য শ্রেষ্ঠ মঞ্চাভিনেতার পুরস্কার।
• ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কার
• ‘গুপীবাঘা ফিরে এল’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার বিএফজে পুরস্কার।
• ‘নয়নতারা’র জন্য আনন্দলোক পুরস্কার।
• লায়ন্স ক্লাব থেকে শ্রেষ্ঠ নাট্যপরিচালকের পুরস্কার ‘হীরালাল পান্নালাল’ নাটকের জন্য।
মূল্যায়ন:
• হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়— সব অভিনেতা, সব শিল্পী সব সময় আমার কাছে একশোয় একশো পায় না। রবি পেয়েছিল।
• তপন সিংহ— গোটা ভারতবর্ষে রবির মতো অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্রাভিনেতা বাস্তবিক খুঁজে পাওয়া কঠিন। রবি ঘোষকে আমি সেই অর্থে কখনও কমেডিয়ান হিসেবে দেখিনি।
• সত্যজিৎ রায়— রবির চোখ দুটোই কথা বলে।
• উৎপল দত্ত— স্টেজ ম্যানেজারের পদ ছেড়ে এ বার নাটক পরিচালনা কর।
• তাপস সেন— বহু মানুষের নানা সমস্যায় রবি যে সাহায্য করেছিল তা তাদের সূত্রেই জানতে পারি। শুধু বড় শিল্পী নয়, একটি খাঁটি মানুষ।
• উত্তমকুমার— রবির পাশে অভিনয় করতে সব সময় ভয় লাগে। আমরা হয়তো জাঁকিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছি, আর রবি মাত্র কয়েক সেকেন্ড থেকে এমন একটা কিছু করবে যে ও গোটা দৃশ্যটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাবে, লোকে হেসে গড়িয়ে পড়বে।
• তপেন চট্টোপাধ্যায়— একনিষ্ঠ পাঠক দশটি কৌতূক নকশা নিয়ে কলম ধরেছিলেন ‘হাসতে যাদের মানা’ বইটির জন্য। ১৯৯৭-এর বইমেলাতে প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে তপেন চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, দেখছি রবিদা বইমেলায় কাদা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিমায় হাঁটছেন। শনিবার বইমেলায় জুটি ছিলাম, মঙ্গলবার একা হয়ে গেলাম।
• কমলকুমার মজুমদার— রবির অঙ্গভঙ্গি বেশ ভাল।, ভাল করে অভিনয় শেখার চেষ্টা করলে এক জন ভাল অভিনেতা হতে পারবে।
স্মরণীয়_কিছু_ঘটনা:
• ১৯৭০: গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবির মুখ্য চরিত্র হিসেবে সালে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ।
• ১৯৭২ নেতাজি ইনস্টিটিউটে সমরেশ বসুও র উপন্যাস ‘বিবর’ এর নাট্যরূপ মঞ্চস্থ করা ও পেশাদারি নাট্য-পরিচালকরূপে আত্মপ্রকাশ।
• ১৯৮৭ তে যাত্রায় যোগদান ও নট্ট কোম্পানির পালা ‘পাল্কি চলে রে’
• ১৯৯৫ স্বজন নাট্যগোষ্ঠীর অতিথি শিল্পী হিসেবে আমেরিকা ও ইউরোপ ভ্রমণ।
• ১৯৯৬ শেষ বারের মতো যাত্রায় যোগদান। মুক্তলোকের ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’।
স্মৃতিকথা
বৈশাখি ঘোষ (স্ত্রী):
সারা ক্ষণ হাসিখুশি মানুষটি আসলে খুবই গুরুগম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন। আমাকে আড্ডা মারতে দেখলে খালি বলতেন, বাড়িতে এত ভাল ভাল বই আছে পড়লেই তো পার। বিয়ের পরে আমাকে ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ দিয়েছিলেন। ছোটবেলা মামাবাড়ি কোচবিহারে কাটলেও পরে কলকাতায় চলে আসেন। আমি উত্তর কলকাতার বাদুড়বাগানের মেয়ে। নাটক দেখতে খুবই পছন্দ করতাম। বিজন থিয়েটারে শ্রীমতী ভয়ঙ্করী-তে ওঁর অভিনয় দেখেছিলাম। মানিকদা অথবা বাবু (সন্দীপ রায়) ছবি তৈরির সময় নিয়ে যেতেন। যাত্রায় যাওয়াটা আমার পছন্দের ছিল না। কিন্তু উনি মাটির মানুষগুলোর কাছে মিশে যেতে চেয়েছিলেন। অর্থকষ্ট ছিল না তবুও যাত্রাটা পেয়ে বসেছিল। প্রযোজকরা বাড়িতে পড়ে থাকতেন। এত ‘জার্নি’ সঙ্গে পরিশ্রম ওঁর রক্তের শর্করা বাড়িয়ে দিয়েছিল। খুব আমুদে আর আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন। জয়া ভাদুড়ির লোকাল গার্জেন ছিলেন। ওই পরিবারেরও উনি একজন হয়ে উঠেছিলেন। তবে বরিশালের কুলীন কায়স্থ বলে খুব দেমাক ছিল! তাই লোকজন নেমতন্ন করে বাড়িতে জানাতে ভুলে যেতেন। কিছু বললে উত্তর আসত ওরকম একটুআধটু হয়েই থাকে। ম্যানেজ করে নিতে হবে।
মৃণাল সেন (পরিচালক):
মনে পড়ছে সেই ঘটনাটা। আমারও তখন কম বয়েস। ‘সাংবাদিক’ নাটকে কয়েক সেকেন্ডের একটা চরিত্রে মঞ্চের এক প্রান্ত দিয়ে ঢুকে অপর প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে রবি ঘোষ। অসাধারণ এক টুকরো ছবি আমার মন দখল করে নেয়। আমি একটা পত্রিকায় এক প্যারা লিখেওছিলাম। আজ রবি নেই বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। কত যে স্মরণীয় ছবি ও করে গেল।
মনোজ মিত্র (অভিনেতা):
রবিদা ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম সারির মধ্যে কত-তম, আমি ব্যক্তিগত ভাবে সেটা বলতে পারব না। কিন্তু তাঁর একটা বিশেষত্ব ছিল, একটা অনন্যতা ছিল। তাঁর অভিনয়ের জায়গা ছিল ওঁর চোখ। তিনি নিজেই ছিলেন একটা ‘রকম’। উত্তমকুমারকে যেমন দেখা যায়নি কোনও খারাপ চরিত্রে অভিনয় করতে, ঠিক তেমনই রবিদাকে দেখা যায়নি এমন কোনও ছবিতে অভিনয় করতে যেটা দর্শক নিতে পারেনি। আমরা ‘হুতোমের নকশা’য় মামা-ভাগ্নে চরিত্রে অভিনয় করছিলাম। আমি মামা প্রাণবল্লভ ও রবিদা ভাগ্নে রাধাভল্লব। ছবি তৈরির সময়ই চলে গেল। ‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এ আমরা একসঙ্গে অভিনয় করি। ‘জীবনপুরের পথিক’ ছবিতেও আমরা দু’জন ছিলাম। রবিদা কাজের লোক আর আমি এক বদমায়েশ বাবু। নানা স্তরের মানুষের স্বর অনায়াসে নিজের গলায় আনতে পারতেন। অত্যন্ত বড় মাপের অভিনেতা ছিলেন।
মাধবী মুখোপাধ্যায় (অভিনেতা):
রবি ঘোষ যখন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে চাকরি করতেন তখন ওখানেও থিয়েটার করতেন। তখন থেকেই আমার সঙ্গে পরিচয়। পরে উৎপল দত্তের দলে যোগ দেন ও খুবই সফল হয়েছিলেন। ছবিতে যখন এলেন, সেই অর্থে ‘নফর সংকীর্তন’ ওঁর প্রথম চলচ্চিত্র হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ছবিটির কাজ শেষ না হওয়ায় ওই ছবিটি আর ওঁর করা ছবির তালিকায় প্রথম হল না। ‘কাউকে বোলো না’ ছবিতে আমি ও রবি ঘোষ স্বামী-স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করি। বহু ছবিতে অভিনয় করেছি একসঙ্গে। অসাধারণ মাপের অভিনেতা ছিলেন। একসঙ্গে থিয়েটার করেছি ‘ঘটক বিদায়’-এ। স্টেজ পুড়ে যাওয়ার পরে যেখানেই করেছি সেখানেই হাউসফুল হয়েছে।
চিন্ময় রায় (অভিনেতা):
উৎপল দত্তের ‘অঙ্গার’ নাটকে প্রথম আলাপ। তার পরে আমরা যে ছবিটি এক সঙ্গে করি সেটি ‘গল্প হলেও সত্যি’। এটি আমার প্রথম ছবি ও ছোট্ট একটা চরিত্র। রবিদা বললেন, চেহারাটা রোগা হলেও অভিনয়টা ছাড়িস না। পারলে বিকেলে আমার বাড়িতে চলে আসিস। সেই যে রবিদার বাড়িতে ঢুকলাম, সম্পর্ক ছিল শেষ দিন পর্যন্ত। রবিদার কালীঘাটের বাড়িতে জমিয়ে আড্ডার সঙ্গে সত্যজিৎ রায় ও বিদেশি নানা ছবির গভীর আলোচনা হতো। রবিদা এমন এক জন কমেডিয়ান ছিলেন যিনি ব্যাকরণ সম্মত অভিনয় করতেন। এমন কোনও ছবি নেই যেখানে তাঁকে বাড়াবাড়ি করতে দেখা গিয়েছে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, অনুপকুমার ও রবিদা— যে ক’জন কমেডিয়ান এসেছেন, রবিদার আসাটা যেন আবির্ভাব হয়ে দাঁড়ায়। ‘সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা’ ছবিতে রবিদার সঙ্গে অভিনয় করে খুব খুশি হয়েছি। ‘অপরূপা’-সহ প্রায় ৮টি ছবিতে এক সঙ্গে অভিনয় করি। কিন্তু এমনই ভাগ্য যে রবিদা যাত্রায় চলে যাওয়ায় পরের দিকে ওঁর সঙ্গে আর ছবি করা হয়ে ওঠেনি।
সন্দীপ রায় (পরিচালক):
রবিকাকা এমন এক জন মানুষ, এমন এক জন অভিনেতা যিনি প্রায় আমাদের পরিবারের এক জন হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৬২ সাল থেকে আমাদের পরিবারের সঙ্গে ওঁর পরিচয়। বাবা প্রথম দেখেন উৎপল দত্তের নাটকে। উৎপল দত্ত পরিচালিত ‘মেঘ’ ছবিতে রবিকাকার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। তাই বাবা ওঁকে নেন ‘অভিযান’-এর এক অদ্ভুত চরিত্র রামা-য়, যা দর্শক কোনও দিন ভুলবেন না। বাবার বিভিন্ন ছবিতে রবিকাকা ফিরে ফিরে এসেছেন নানা চরিত্রে। অনেক ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রেও অভিনয় করেছেন, কিন্তু তার কী বিন্যাস! ব্যক্তিগত ভাবে ভীষণ ‘মিস’ করি। আর গুপী-বাঘা সিরিজে সত্যি কথা বলতে বাঘাও যেমন গুপীও তেমন। এঁরা যেন একে অন্যের পরিপূরক। মানুষ হিসেবে অত্যন্ত খাঁটি ছিলেন।
বীরেশ চট্টোপাধ্যায় (পরিচালক):
১৯৭২-এ মুম্বইতে হৃষীদার কাছে কাজ করতে গিয়ে দেখি একটি হিন্দি ছবির কাজ চলছে। তাতে কলকাতার দু’জন অভিনেতা রয়েছেন— কালী বন্দ্যোপাধ্যায় ও রবি ঘোষ। ছবির নাম ‘সব সে বড়া সুখ’। অসাধারণ সেই ছবি। কলকাতায় যখন সহ-পরিচালকের ভূমিকায় কাজ করেছি তখন রবিদার অভিনয় দেখেছি, কিন্তু তেমন ভাবে চিনতাম না। ‘অভিযান’ দেখার পরে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি। তখনই মনে হয়েছে ওই রকম দুর্ধর্ষ অভিনেতার সঙ্গে কাজ করতেই হবে। ‘মোহনার দিকে’ রবিদাকে নিয়ে আমার প্রথম কাজ। দীপঙ্কর ও রবিদার সঙ্গে যে সিকোয়েন্স ছিল সেটায় যে দক্ষতা দেখিয়েছিলেন রবিদা, আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম।
দীপঙ্কর দে (অভিনেতা):
অভিযান-এ মোষের পিঠের উপর দিয়ে লাফ দিয়ে চলে গেল! শুধু কমেডিয়ান বললে মস্ত বড় ভুল থেকে যাবে। তিনি এক জন টোটাল আর্টিস্ট। এবং এটা একশো শতাংশ ঠিক। আর গুপী গাইন বাঘা বাইন-এর কথাই আলাদা। তাঁর আন্তর্জাতিক মানের অভিনয় ক্ষমতা়, কণ্ঠস্বর ছিল অদ্ভূত। সুবর্ণগোলক, মোহনবাগানের মেয়ে, বাঞ্ছারামের বাগান-সহ নানা ছবিতে অভিনয় করার সময় বুঝেছিলাম ‘টাইমিং’ ব্যাপারটা কী? কত বড় ও বিচক্ষণ অভিনেতা ছিলেন তিনি। কথায় কথায় উদ্ধৃতি দিতেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত থেকে। এমন নয় যে তিনি খুব ধার্মিক ছিলেন, পড়াশোনা করতেন খুব গভীর ভাবে। নানা বিষয়ে নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা চলত। ফ্লোরে বা আড্ডায় কারওর সঙ্গে অন্য কারওর কোনও ঝামেলা হলে রবিদা গাইতেন ‘এক দিন কিনে নেবে তাঁরে’, পরে বলতেন, ‘তোর আর কিছু করার নেই। শুয়ে পড় শুয়ে পড়।’ এত রসবোধ ছিল! তাঁর নিজের দুঃখকষ্টকে কোনও দিন কারওর সামনে প্রকাশ করেননি। বার বার বলতেন বই পড়ার কথা। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-র কথায় যে মন ভাল হয়ে যায় তা বলতেন সব সময়। বেশির ভাগ জায়গায় ভৃত্য, গাড়ির ক্লিনার, রান্নার ঠাকুর, দালাল, গরিব উকিল, নায়কের রকে বসা বন্ধু, কোথাও বা বাজনদার বাঘা— এক একটি চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন টুকরো টুকরো বাক্য দিয়ে অথবা শব্দের বদলে নীরব অভিব্যক্তি দিয়ে। চোখ দিয়েই উতরে দিয়েছেন কত ছবি। বহু পরিচালক ওই গুণটাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। পুরো ছবিতে নিজের সংলাপ বলতে কিছুই নেই। শুধু অন্য চরিত্র যে কথা বলবে নির্বাক হয়ে তা শোনা আর তার শেষ শব্দটা আবার বলা— এখানে সেন্স অফ টাইমিং আর ডাবল টেক একটা বড় ফ্যাক্টর। এই গুণটা গুরু উৎপল দত্তের কাছ থেকে রপ্ত করেছিলেন।
সন্ধ্যা রায় (অভিনেত্রী):
রবিবাবু অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ মানুষ ছিলেন। তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে সাবলীল ও সরল ভাবে মিশতেন। ওঁর পড়াশোনা ছিল গভীর। চলচ্চিত্র ছাড়া নাটক, যাত্রা নিয়ে চর্চা ছিল মনে রাখার মতো। কুহেলি-র একটা দৃশ্য মনে পড়ছে। এক ভৃত্য কাজ করতে আসত ভূতের বাড়িতে। সন্ধের আগে ফিরে যেতে হত। অথচ কাজের তাগিদে, পেটের তাগিদে তাকে রোজ আসতে হতো সেই দূর পাহাড়ের ধার থেকে। সততার মধ্যে দিয়ে জীবন-সংশয়ের যে অভিব্যক্তি তিনি তুলে ধরেছিলেন সেখানে রবিবাবু একেবারেই স্বতন্ত্র এক অভিনেতা। কাজের ফাঁকে যে সব আলোচনা হতো তাতে তিনি বহু সময় খেদ প্রকাশ করতেন। এই গরিব দেশে সে সুযোগই তো নেই যে এমন ছবি হবে যার মধ্যে দিয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অমর হয়ে থাকবে। যদি গুপী গাইন বাঘা বাইন না হতো, তা হলে আমরা তাঁর অ্যাক্টিং রেঞ্জ জানতে পারতাম না। তিনি যে বহুমুখী প্রতিভা সম্পন্ন এক অভিনেতা সেটা আমাদের চোখে ধরাই পড়ত না। কোনও ছোট চরিত্রকেই কোনও দিন অবহেলা করেননি রবিবাবু।
(সৌজন্যে: আনন্দবাজার পত্রিকা, উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য )
=================================