Tuesday, 30 November 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি। রাধারাণী দেবী। ৩০.১১.২০২১. Vol -572. The blogger in literature e-magazine


রাধারাণী দেবী

২৪ নভেম্বর, ১৯২৯। সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের প্রতিষ্ঠান ‘রবিবাসর’ ভূমিষ্ঠ হয়েছে। সেখানেই একদিন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জলধর সেন, নরেন্দ্র দেব-সহ আরও অনেকে আড্ডায় মশগুল।আচমকা জলধরবাবু বললেন, ‘রাধাকে এ বার আমাদের সদস্য করে নিতে হবে।’ তীব্র আপত্তি জানালেন শরৎচন্দ্র। তাঁর দাবি, এই আসরে মহিলা সদস্যদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তা না হলে ‘পুরুষ’ সাহিত্যিকদের ‘জিভে লাগাম’ পরাতে হবে।

শরৎচন্দ্রের এ কথা শুনে ফোঁস করে উঠলেন ‘রাধা’ও। বললেন, ‘সাহিত্য সংস্থায় পুরুষ এবং মেয়ের যোগ দেবার অধিকার সমান।’ রাধা অর্থাৎ রাধারাণী দেবী। আড্ডা মোড় নিল তর্কে। শেষমেশ শরৎবাবুরই প্রস্তাব মতো ঠিক হল, ‘কবি’ যা বলবেন, সেই মতো সিদ্ধান্ত হবে।

এই ঘটনার প্রায় এক মাস বাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন জোড়াসাঁকোয় রয়েছেন। সেখানেই একদিন রাধারাণী পৌঁছলেন। দেখলেন, কবির ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন শরৎচন্দ্র। শরৎবাবুও দেখলেন রাধারাণীকে। ফের ঢুকলেন কবির ঘরে। খানিক বাদে বেরিয়ে এলেন একরাশ হাসি নিয়ে।একটু পরে রবীন্দ্রনাথ জানালেন তাঁর সিদ্ধান্ত, ‘না বাপু, আমিও শরতের সঙ্গে একমত। তোমরা ছেলেদের একটুও জিরোতে দেবে না, সব জায়গায় পাহারা দিয়ে হাজির থাকবে, এ হয় না।’ তখনকার মতো কবির সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন রাধারাণীও। কিন্তু বোধহয় সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন।

এলও সুযোগটা। শরৎচন্দ্রের অশ্বিনী দত্ত রোডের বাড়িতে ‘রবিবাসর’-এর আড্ডা বসবে। সেখানে আসবেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। শরৎবাবু আয়োজনের যাবতীয় দায়িত্ব দিলেন প্রিয় ‘রাধু’ ও নরেন্দ্র দেবকে। আয়োজন সম্পূর্ণ। কবিও চলে এসেছেন। কিন্তু এক ফাঁকে বাড়ি চলে গেলেন রাধারাণী। তাঁকে নিতে শরৎবাবু গাড়ি পাঠালেন। রাধারাণী চালককে বললেন, ‘বলে দিও কালী, ‘রবিবাসরে’ মেয়েদের যেতে নেই।’

ওই রাতেই নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে এক ঝুড়ি লুচি, পোলাও-সহ নানা খাদ্যসামগ্রী নিয়ে হাজির হলেন শরৎচন্দ্র। এ আসলে বোন রাধুর মান ভাঙাতে ‘বড়দা’ শরৎচন্দ্রের আসা। রাধারাণী খুবই লজ্জিত হলেন ঠিকই। কিন্তু তার পরেও লিখেছেন, ‘আমি ঐ সংস্থায় যোগ দিতে কখনও পারিনি।’

রাধারাণী এমনই। আত্মমর্যাদাবোধ, মাথা নত না করতে চাওয়ার জেদ, এই নিয়েই রাধারাণী। আর তাই তিনিই বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি যাপনের নিজস্ব ‘অপরাজিতা’। রাধারাণী এবং অপরাজিতা দেবী, একই ব্যক্তিত্ব। কিন্তু এই দু’টি নামের মধ্যে ‘ওরফে’ শব্দটি যোগ করা যায় না। কারণ, একই ব্যক্তিত্ব হলেও রাধারাণী ও অপরাজিতা সম্পূর্ণ আলাদা দু’টি সত্তা

                   জন্ম কলকাতায় ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে নভেম্বর। পিতা আশুতোষ ঘোষ ম্যাজিস্ট্রেট হয়েও ছিলেন শিক্ষানুরাগী, সাহিত্যপ্রিয় ও গভীর রবীন্দ্রভক্ত। তার ও নারায়ণী দেবীর দশম সন্তান ছিলেন রাধারাণী। তার শৈশব কাটে পিতার কর্মক্ষেত্র কোচবিহার জেলার দিনহাটায়। তিনি ছবিরউন্নিসা বালিকা বিদ্যালয় থেকে ছাত্রবৃত্তি ও মাইনর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর স্বশিক্ষায় সংস্কৃত, ইংরাজী ও ফরাসি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। পরিবারে শিক্ষার পরিবেশে তিনি শৈশব আনন্দেই কাটিয়েছেন। বাড়িতে প্রত্যেক সদস্যদের জন্য আসত 'প্রবাসী', 'শিশু', 'মৌচাক' , 'সন্দেশ', 'সোপান', 'ভারতবর্ষ' প্রভৃতি নানান পত্র পত্রিকা। তার সেজদার হাতে-লেখা ভাইবোনদের পত্রিকা 'সুপথ'-এ দশ বছর বয়সে লেখা দেন তিনি। তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় 'মানসী ও মর্মবাণী' পত্রিকায়। কিন্তু মাত্র তের বৎসর বয়সেই তার বিবাহ হয়ে যায় ইঞ্জিনিয়ার সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সাথে। কয়েক মাসের মধ্যেই আচমকা 'এশিয়াটিক ফ্লু' তে স্বামীর মৃত্যু হলে তিনি স্বেচ্ছায় কঠিন বৈধব্য পালন করেন।


সাহিত্যক্ষেত্রে কবিতা দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করতে লাগলেন রাধারাণী দত্ত নামে 'ভারতবর্ষ', 'উত্তরা','কল্লোল', 'ভারতী' প্রভৃতি পত্রিকায়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম গল্প ‘বিমাতা’ প্রকাশিত হয় ‘মাসিক বসুমতী’তে। প্রথম প্রবন্ধ ‘পুরুষ’ প্রকাশিত হয় ‘কল্লোল’-এ। এর পাঁচ বছর পরে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ -  ‘লীলাকমল’। এরপর 'সিঁথিমোর' ও 'বনবিহগী' কাব্যগ্রন্থ। 'বনবিহগী' র চিত্রাঙ্কন করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ও নন্দলাল বসু আর প্রুফ সংশোধন করেছিলেন রাজশেখর বসু। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে তার ও নরেন্দ্র দেবের যুগ্ম সম্পাদনায় বাংলা কাব্য সংকলন 'কাব্যদীপালি' প্রকাশিত হয়। একবার এক সান্ধ্য আড্ডায় রাধারাণীর রচনার পরিপেক্ষিতে প্রমথ চৌধুরী মন্তব্য করেন -

" ‘...আজ পর্যন্ত কোনও মেয়ের লেখায় তার স্বকীয়তার ছাপ ফুটে উঠলো না।’

এই অভিযোগের প্রতিবাদে তিনি 'অপরাজিতা দেবী' ছদ্মনামে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ছায়াপাতে শুরু করেন রচনা। তার কবিতার মধ্যে অন্তঃপুরের অন্তরঙ্গ জগত আত্মপ্রকাশ করেছে বিশ্বস্ততার সাথে। যেমন মাধুর্য ও কৌতুক, তেমনই প্রতিবাদ আর বিদ্রোহে সাহিত্যজগতে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, যা কিনা সেসময় যেকোনো মহিলা কবির কলমে প্রায় অসম্ভব ছিল। 

১৯৩০-৩৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হল - 

  • 'বুকের বীণা' (১৯৩০)
  • 'আঙিনার ফুল' (১৯৩৪)
  • 'পুরবাসিনী' (১৯৩৫)
  • 'বিচিত্ররূপিনী' 

তবে যখনই তিনি বুঝেছেন সাহিত্য অন্য খাতে বইতে শুরু করেছে এবং তার এ লেখা নতুনকালের জন্য নয় - সেই মুহূর্তে তিনি 'অপরাজিতা' র কলম থামিয়ে দিয়েছেন। অপরাজিতা দেবী রবীন্দ্রনাথকে পদ্যে চিঠি দিতেন, উত্তরও পেতেন পদ্যে। 'প্রহসিনী' গ্রন্থে সেসব কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্রনাথের অন্তঃপুর' হল তার এক উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ।

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ৩১ শে মে নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে বিবাহ হয়। তৎকালীন নাগরিক-বুদ্ধিজীবী সমাজে দেবদম্পতির বিশেষ সমাদর ছিল। তাঁদের কন্যা হলেন সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন। 

তাঁদের কলকাতার  হিন্দুস্থান পার্কের বাড়ি 'ভালো-বাসা'-য় নানা মনীষীর সমাগম ঘটেছে একসময়। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের সঙ্গে রাধারাণীর খুবই ঘনিষ্ঠ 'বড়দা' সম্পর্ক ছিল। তাঁদের 'ভালো-বাসা'য় তিনি প্রায় নিত্য আসতেন।শরৎচন্দ্রের অসমাপ্ত উপন্যাস 'শেষের পরিচয়' তিনিই সমাপ্ত করেন। ভালো বক্তাও ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে বড়দা'র জন্মশতবর্ষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যে 'শরৎচন্দ্র বক্তৃতামালা' দিয়েছিলেন তারই গ্রন্থরূপ তার একমাত্র প্রবন্ধ গ্রন্থ 'শরৎচন্দ্র: মানুষ ও শিল্প'। এই গ্রন্থটিতে শরৎপ্রতিভা বিশ্লেষণে তার গভীর অভিজ্ঞতা ও অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় মেলে। রাধারাণী ছোটদের জন্য লিখেছেন 'নীতি ও গল্প' এবং 'গল্পের আলপনা'। স্বামীর সম্পাদনায় ছোটদের জন্য মাসিক পত্রিকা 'পাঠশালা' প্রকাশে সহায়তা ছাড়াও যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন বাংলা গ্রন্থের সংকলন 'কথাশিল্প'। বিবাহের মন্ত্রগুপ্তির স্বচ্ছন্দ অনুবাদ করা তার বইটি হল 'মিলনের মন্ত্রমালা'। এছাড়া বারোয়ারি উপন্যাসও লিখেছেন।

১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক ও লীলা পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে 'অপরাজিতা রচনাবলী'র জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত করে।



রাধারাণী দেবী ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ৩০ শে নভেম্বর কলকাতায় নিজ বাসভবন 'ভালো-বাসা'য় প্রয়াত হন।



====={{{{{{{{{{{{{{{∆∆∆∆∆}}}}}}}}}}}}}}}}}}==

Monday, 29 November 2021

বিশেষ আলোচনা। দেশে বিদেশে - সৈয়দ মুজতবা আলি। ২৯.১১.২১. Vol -571 The blogger in literature e-magazine


সৈয়দ মুজতবা আলী

 সবচেয়ে বিখ্যাত ও তাঁর প্রথম বই, দেশে বিদেশে  রচনার নেপথ্যে দুটি ঘটনা নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল । ১.ভ্রাতুষ্পুত্রী জাহানারার প্রেরণা ও ২.বন্ধু বীরভদ্র রাও-এর প্ররোচনা।

একবার ঘটনাক্রমে সিলেটে মুজতবা আলীর সঙ্গে আবু সয়ীদ আইয়ুবের প্রথম পরিচয় হয়েছিল। তখন দুজনেই বয়সের দিক থেকে নিতান্ত কিশোর। ১৯৪৫ সালে কাবুল-জার্মানি ফেরতা ও বরোদার চাকরি ছেড়ে আসা মুজতবা আলী শুধু লেখালেখি করে জীবিকা নির্বাহের উদ্দেশ্যে কলকাতায় খানিক থিতু হওয়াতে দুজনের মধ্যে ফের একটি যোগাযোগ তৈরি হলো। বরোদা থেকে কলকাতায় আসার পর আইয়ুবের ৫ নম্বর পার্ল রোডের বাড়িতেই আশ্রয় নিলেন মুজতবা। তবে আইয়ুবের নিজের স্বাস্থ্যও তখন খুব ভালো যাচ্ছিল না। এর মধ্যে ছেচল্লিশের দাঙ্গা কলকাতা শহরকে তছনছ করে দিয়ে গেছে। এমন সময় আইয়ুবের দেহে যক্ষ্মা ধরা পড়লো। অতএব আইয়ুবের চিকিৎসার জন্য ছোটাছুটি আরম্ভ করতে হলো মুজতবাকেই। চিকিৎসকরা একসময় সুস্থতার জন্য হাওয়া বদলের পরামর্শ দিলেন। অস্থির পরিস্থিতির মধ্যেই মুজতবা বন্ধু আইয়ুবকে নিয়ে ছুটলেন দাক্ষিণাত্যের মদনপল্লীর বিখ্যাত স্যানেটোরিয়ামে। আইয়ুব সেখানকার উত্তম পরিবেশে কয়েকমাস থেকে আরোগ্য লাভ করলেন বেশ দ্রুততার সাথেই। সুস্থ হয়ে আইয়ুব কলকাতায় ফিরে গেলেও মুজতবা দক্ষিণ ভারত ভ্রমণের জন্য সেখানেই থেকে গেলেন। চললেন রমণ মহর্ষির অরুণাচল আশ্রমে। সেখানে বেশকিছু দিন থাকবার পর যান তাঁর আরেক বন্ধু, অন্ধ্রপ্রদেশের বীরভদ্র রাওয়ের বাড়িতে। তৎকালীন মাদ্রাজের এক সমুদ্রসৈকতের ধারে ছিল বীরভদ্রের গৃহ। সমুদ্রতটের চিত্র দেখে তাঁর দিন মন্দ কাটছিল না। ওই সময়ের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি এভাবে: ‘মাদ্রাজের বেলাভূমিতে…সমুদ্রের ওপারে চমৎকার সূর্যোদয় হয়। সূর্যাস্ত অবশ্য সমুদ্রগর্ভে হয় না। অর্থাৎ পূর্বাকাশে যে রঙে রঙে রঙিন চিত্রলেখা অঙ্কিত হয় সেটি কারো দৃষ্টি এড়াতে পারে না। আমি মাঝে মাঝে তারই বর্ণনা আপন ডাইরিতে লিখি। বীরভদ্র রাওকে মাঝে মধ্যে পড়ে শোনাই…।’

বীরভদ্র রাওকে সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর আপন খাতার লেখালেখি পড়ে শোনাচ্ছেন অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই– এই ঘটনার পরম্পরা থেকেই যে একদিন বাংলা সাহিত্যের একটি অমূল্য রত্ন প্রকাশের মুখ দেখবে তা কি কেউ জানতো? সমুদ্রতটের দৃশ্য পাশে রেখে একদিন মুজতবা ডায়েরি থেকে পাঠ করছিলেন, বীরভদ্র তা শুনতে শুনতে হঠাৎ একটি সুদৃশ্য খাতা ও একটি কলম তাঁকে এনে দিয়ে বললেন, ‘সূর্যোদয় সূর্যাস্তের স্কেচ অর্থাৎ বর্ণনা তো এঁকেছো বিস্তর; এবার একটি পূর্ণাঙ্গ কেতাব লেখো।’


মুজতবা তখনই তাঁর প্রথম বাংলা বই, মূলত তাঁর কাবুলবাসের স্মৃতি, দেশে বিদেশে লেখা আরম্ভ করলেন। লিখতে গিয়ে তাঁর মনে পড়লো ভাতিজি জাহানারার কথা। তাঁর বড়ভাইয়ের প্রথম সন্তান। তিনি নাকি বলতেন, তাঁর ছোট চাচা শুধু কথা বলাতেই ওস্তাদ, ‘মুখে হাই জাম্প আর লং জাম্প’ কিন্তু পারলে একখানা আস্ত বই লিখে যদি দেখাতেন! তাহলে না হয় বলা যেতো চাচা কিছু একটা করেছেন জীবনে। এই ভাতিজিটি মুজতবার বড় স্নেহের পাত্রী ছিলেন। তাঁর মেধার কদর করতেন তিনি। পাণ্ডুলিপি সমাপ্ত হবার পর তাঁকে দেখাবেন এই ভেবে সেটা সাথে নিয়ে চললেন সিলেট। কিন্তু ১৯৪৭-এর ২২ অক্টোবর সিলেটে পৌঁছানোর পর শুনলেন জাহানারা সেখানে এখন নেই। তাঁর স্বামী হামিদ আলী চৌধুরী সরকারি ম্যাজিস্ট্রেট, বদলির চাকরি, এবারে যেতে হবে কক্সবাজারে। চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে যাবার বন্দোবস্ত। দুদিন পর এলো এক ভয়াবহতম দুঃসংবাদ। কক্সবাজারে স্টিমার ডুবে গিয়ে জাহান আরা ও তাঁর স্বামী মৃত্যুবরণ করেছেন, সঙ্গে থাকা দুই শিশুপুত্রও প্রাণে বাঁচেনি। এমনকি তাঁদের মরদেহের সন্ধানও পাওয়া যায়নি। এই শোকে সৈয়দ মুজতবা আলী পাগলের মতো হয়ে পড়েছিলেন। পরে মুজতবা লিখেছিলেন, এই শোক তাঁর ‘কলিজায় এখনো তাজা দগদগে ঘা হয়ে আছে’। পরে বই আকারে প্রকাশিত হলে দেশে বিদেশে উৎসর্গিত হয় ‘জিন্নতবাসিনী জাহান-আরার স্মরণে’।

পরে কথাপ্রসঙ্গে তিনি জাহানারা ও দেশে বিদেশে প্রসঙ্গে দীর্ঘ স্মৃতিচারণ করেছিলেন গোলাম মোস্তাকীমের নিকট, সেই আলাপের কিছু অংশ এরকম:


‘সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে তার সঙ্গে আমার আলাপ-আলোচনা হতো। তার সঙ্গে তর্ক করে আমি কখনোই জিততে পারিনি। আমি সারা দুনিয়ায় দেশি-বিদেশি অনেক বুদ্ধিমতী মহিলা দেখেছি। কিন্তু তোমাকে আমি হলফ করে বলতে পারি জাহানারার মতো বুদ্ধিমতী মহিলা আমি জীবনে দুটি দেখিনি। ওর যদি অল্প বয়সে বিয়ে না হতো এবং তার যদি ঐরকম অকাল মৃত্যু না হতো তাহলে সে জীবনে অনেক কিছুই করতে পারতো। …আমার ভাইবোনদের মধ্যে কেউ কেউ বললেন, সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র দুর্ভাগ্যের কারণে জাহানারা কোনো কীর্তি রেখে যেতে পারল না। সবাই হয়তো একদিন তাকে ভুলে যাবে। কাজেই ‘দেশে বিদেশে ’ জাহানারাকে উৎসর্গ করলে এর পাঠক-পাঠিকারা অন্তত জাহানারাকে মনে রাখবে। কথাটা আমার মনে খুব লাগলো। ‘দেশে বিদেশে ’ জাহানারাকে উৎসর্গ করতে আমি সম্মতি দিলাম। কিন্তু মোটের উপর ইট ওয়াজ আ ফ্যামিলি ডিসিশান। …তবে আমার বলতে কোনো দ্বিধা কিংবা সংকোচ নেই যে, ‘দেশে বিদেশে’ লেখার পেছনে জাহানারা আমাকে খুব প্রেরণা জুগিয়েছিল। …কাজেই জাহানারা বেঁচে থাকলে বইটা লিখেই আমি দেশে ছুটে গিয়ে তাকে বলতাম, ‘এই দেখ আমি একটা বই লিখেছি। এবার দেখি তুই কী বলিস?’ কিন্তু জাহানারার অকাল মৃত্যু আমাকে সে সুযোগ দিলো না। জীবিতাবস্থায় আমি সবসময় তার কাছে হারতাম, মরেও সে আমাকে হারিয়ে দিয়ে গেল। এবং আমার বিশ্বাস ছোট চাচার বই ছাপা হতে দেখলে সে খুবই খুশি হতো।’

অন্তরে একরাশ শোক নিয়েই মুজতবা কলকাতা ফিরলেন। ফিরে দেশে বিদেশে র পাণ্ডুলিপি গুছিয়ে আনলেন অনেকটা। মাঝেমধ্যে পার্ল রোডের বাড়িতে আগত বন্ধু-সুহৃদ অনুজদের অংশবিশেষ পড়েও শোনাতেন। আবার প্রতিবেশী লেখিকা সুস্মিতা ইসলামকে ডেকে এনে তাঁকে অনুরোধ করতেন, দেশে বিদেশে থেকে পাঠ করে তাঁকে শোনাতে। কারণ তিনি মনে করতেন, অন্যের কণ্ঠে নিজের লেখা শুনলে নাকি পাণ্ডুলিপি সম্পাদনার ক্ষেত্রে সুবিধা হয়। পরে প্রস্তুত পাণ্ডুলিপি একদিন বন্ধু-সতীর্থ-শুভানুধ্যায়ীদের সবাইকে ডেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পড়ে শোনানোর আয়োজন করলেন ওই বাড়িতে, আবু সয়ীদ আইয়ুবের ফ্ল্যাটে। পাণ্ডুলিপি পড়ে শোনাবার পর বন্ধুরা যারপরনাই মুগ্ধ হয়েছিলেন।


এছাড়া এর আগেই তিনি পূর্ণাঙ্গ পাণ্ডুলিপি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর দুই বন্ধু–আবু সয়ীদ আইয়ুব ও ফজলুল হককে(৩৩ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন, মুজতবা তাঁর এই বন্ধুর প্রতিভার কদর করতেন খুব) পড়তে দিয়েছিলেন। এই দুজনের মতামতের ওপর মুজতবার খুব আস্থা ছিল। দুজনই পাণ্ডুলিপি পড়ে খুশি হয়েছিলেন, এবং তা দ্রুত ছাপানোর ব্যবস্থা করার জন্য তাগাদা দিয়েছিলেন । দেশে বিদেশে রচনা ও পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতের এই সময়কাল নিয়ে কথাসাহিত্যিক রশীদ করীমের ভাষ্য এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে(উল্লেখ্য, তিনি তখন কলকাতাতেই থাকতেন):


“দেশে বিদেশে লিখছেন মুজতবা সাহেব। প্রতিদিন কিছু লেখেন তিনি আর আমরা গোল হয়ে বসে শুনি। আইয়ুবও তাঁর সুনির্বাচিত গ্রন্থলোকের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে সেই পাঠসভায় বসতেন। বইয়ে পড়েছি, চার্লস ডিকেন্স স্বকণ্ঠে তাঁর উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি শোনাতেন এবং শ্রোতাদের জন্য তাই হয়ে থাকতো এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। কথাটা যে বিশ্বাসযোগ্য, মুজতবা সাহেবের শ্রোতারা তা জানেন।”

কানাইলাল সরকার এবারে বললেন, পাণ্ডুলিপিটি দেশ পত্রিকায়, সাগরময় ঘোষের কাছে পাঠাতে। পরে তিনি নিজ হাতে সাগরময় ঘোষের কাছে এই পাণ্ডুলিপি পৌঁছে দিয়েছিলেন। সাথে এই অনুরোধ জানিয়েছিলেন, যেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধারাবাহিক রচনা হিসেবে লেখাটি ছাপতে দেওয়া হয়।


যেদিন দেশে বিদেশে র পাণ্ডুলিপি পৌঁছায় সাগরময় ঘোষের হাতে, সময়টা ১৯৪৮ সালের মার্চ মাস, সেদিন তিনি লেখার গুণে মুগ্ধ হয়ে আক্ষরিক অর্থেই হুমড়ি খেয়ে সেটি পড়ছিলেন। তাতে করে আশেপাশের অভ্যাগতদের দিকে তেমন একটা মনোযোগ দিতে পারছিলেন না। এই দৃশ্য দেখে তখন তাঁর দপ্তরে উপস্থিত লেখক সুশীল রায় কিঞ্চিৎ শ্লেষোক্তি করে বলেছিলেন, ‘রাবীন্দ্রিক ধাঁচের হাতের লেখার পাণ্ডুলিপি কিনা, তাই এত মনোযোগ। আমাদের দিকে আর চোখ তুলে তাকাবার ফুরসত হচ্ছে না।’ তারপর এ কথা সে কথার মাঝে কথাশিল্পী বিমল মিত্র সাগরময় ঘোষের কাছে জানতে চাইলেন, ‘রাবীন্দ্রিক হাতের লেখার যে বিরাট পাণ্ডুলিপিটার উপর আপনি এতক্ষণ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন সে বস্তুটি কী জানতে পারি?’ সাগরময় চটজলদি উত্তর দিলেন এক শব্দে, ‘ভ্রমণকাহিনি’। সুশীল রায় তথ্যটি জেনে ফের ফুট কাটলেন, মূলত উপন্যাস-লেখক বিমল মিত্রের চিন্তা তাহলে কমলো, তাঁর অন্তত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী-প্রাপ্তির শঙ্কা নেই! সাগরময় ঘোষ এ কথা শুনে বললেন, ‘এ লেখার জাতি-পাঁতি স্বতন্ত্র। উপন্যাস এর ধারে কাছে লাগে না।’ এই কথা শুনে উপস্থিত সকলের বড় বড় চোখে একরাশ বিস্ময়ভরা প্রশ্ন জেগে উঠলো, লেখকটি কে?’ সাগরময় ঘোষ লেখকের পরিচয় জানালেন, এরপর আরো বললেন, মুজতবা শান্তিনিকেতনসূত্রে তাঁর অগ্রজ, তাই ‘সৈয়দদা’ বলে তাঁকে সম্বোধন করে থাকেন। সুশীল রায় ফের খোঁচা মারলেন, ‘তা হলে তো আর কিছু বলা যাবে না। একে রাবীন্দ্রিক হস্তাক্ষর তদুপরি শান্তিনিকেতনিক। এ লেখা তো অবশ্য প্রকাশিতব্য।’ সাগরময় ঘোষ চটে না গিয়ে জবাব দিলেন, ‘আগামী সপ্তাহ থেকেই লেখাটি প্রকাশিত হবে। আপনারাই তখন বিচার করবেন লেখাটি প্রকাশিতব্য কিনা। তবে এটুকু আপনাদের বলে রাখছি, এই এক বই লিখেই ইনি বাংলা সাহিত্যে পাঠকচিত্ত জয় করবেন। …এ লেখায় পাণ্ডিত্যের সঙ্গে সাহিত্যরসের অপূর্ব যোগাযোগ দেখতে পাবেন..।’

বলাই বাহুল্য, সাগরময় ঘোষের কথা সত্যি হয়েছিল বর্ণে বর্ণে। দেশ পত্রিকায় দেশে বিদেশে র প্রথম কিস্তি প্রকাশিত হয় ১৯৪৮-এর ১৩ মার্চ তারিখে। প্রকাশের সাথে সাথে বাঙালি পাঠকমহলের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো মুজতবা আলীর ওপর। সাগরময় ঘোষের কথায়, ‘এই এক লেখাতেই বাংলা সাহিত্যজগতে সৈয়দ মুজতবা আলীর আসন পাকা হয়ে গেল।’ আর এর শেষ কিস্তি প্রকাশ পায় একই বছরে, দেশ-এর ১৮ সেপ্টেম্বর সংখ্যায়। সম্পূর্ণ রচনাটি প্রকাশ হতে মোট ২৮ কিস্তি লেগেছিল। লেখাটির প্রকাশ সমাপ্ত হওয়াতে নিজের বেদনার কথা জানিয়ে এক পাঠক তাঁকে চিঠিও লিখেছিলেন, সেটি এরকম: ‘আপনার ‘দেশে বিদেশে ’ ‘দেশ’-এ শেষ হয়ে গেল দেখে অকস্মাৎ একটা শূন্যতা অনুভব করলাম। এরপর কয়েক সংখ্যা ‘দেশ’-এ আর আগ্রহ থাকবে কিনা সন্দেহ।…আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, আপনি রচনাটিকে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করুন। তাতে বাংলা সাহিত্যের গৌরব বাড়বে বৈ কমবে না।’

গ্রন্থাকারে দেশে বিদেশে প্রকাশের প্রাথমিক উদ্যোগ নেন পুনরায় সেই কানাইলাল সরকারই। মুজতবা প্রথমদিকে নিজের লেখা বই আকারে বের করতে খুব আগ্রহী ছিলেন না। মূলত কানাইলাল সরকারের নাছোড়বান্দা অনুরোধই তিনি শেষমেশ গ্রন্থ প্রকাশে সম্মতি দেন। ১৯৪৯ সালের এপ্রিলে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড থেকে প্রায় চারশ পাতার বইটি প্রকাশ পায়।


তবে দেশে বিদেশে প্রকাশ করতে গিয়ে পারিপার্শ্বিক কিছু ক্লেদাক্ত কারণে নিউ এজ প্রকাশনার কর্ণধার জানকীনাথ সিংহরায়কে মুশকিলে পড়তে হয়েছিল। পাণ্ডুলিপি তাঁর যারপরনাই পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু দেশভাগের প্রায় পর পর কলকাতার পরিস্থিতি অত্যন্ত উতপ্ত, দাঙ্গার রক্তাক্ত স্মৃতি জনমনে তখনও টাটকা, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের অশুভ ছায়া চারদিকে। এমন অবস্থায় বইটি ছাপার পর কলেজ স্ট্রিটের বই-ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ এসে তাঁকে শাসিয়ে যান। তাঁর কথিত ‘দোষ’ একটিই, তিনি কেন ‘কোথাকার কোন এক মুসলমানের লেখা বই’ প্রকাশ করেছেন! তবে শত হুমকি সত্ত্বেও জানকীনাথ সিংহরায় অবিচল ছিলেন। আর ওই সময় পাশে থেকে তাঁকে ভরসা জুগিয়েছিলেন কথাশিল্পী-কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘যতদিন পৃথিবীর কোথাও বাংলা ভাষায় মানুষ বই পড়বে, ততদিন এই বইয়ের মৃত্যু নেই।’ প্রকাশক অবিচল থাকায় প্রথম প্রথম বইটি সেভাবে বিক্রি না হলেও কিছুদিন ঘুরতেই তা বেস্টসেলারে পরিণত হয়। এবং এখনও, প্রথম প্রকাশের প্রায় আশি বছর পার হবার পর, দেশে বিদেশে বছরে হাজার হাজার কপি বিক্রি হয় ঢাকা-কলকাতা মিলিয়ে।

(সংগৃহীত)


========{{{{{{{{{{{{{{{==={{{{{{{===={{{===



Saturday, 27 November 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। শিশু সাহিত্যিক গোলাম রহমান। ২৮.১১.২০২১.Vol -570. The blogger in literature e-magazine


গোলাম রহমান 

১৯৩১ সালের ২৮ নভেম্বর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে কলকাতার মডার্ন স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন এবং ১৯৪৯ সালে কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ আইন কলেজে, ল ভর্তি হলেও পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) চলে আসেন। বাংলাদেশে এসে তিনি জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হলেও শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারেন নি। পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই তিনি সাংবাদিকতায় যুক্ত হন এবং দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক ইনসাফ পত্রিকায় শিশুদের পাতা ও সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনার কাজে যোগ দেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ছিলেন। সাংবাদিকতা ছাড়াও তিনি পুস্তক প্রকাশনা ও বিক্রয়ের ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন; নিউ মার্কেটে তার 'প্রিমিয়ার বুকস্‌' নামে তার একটি বইয়ের দোকান ছিলো। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে 'মধুবালা' নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন নিজস্ব সম্পাদনায়।


তিনি শিশুদের জন্য একাধারে উপন্যাস, গল্প, কবিতা প্রভৃতি যেমন রচনা করেছেন তেমনি সকল বয়সীদের জন্য লিখেছেন ছোট গল্প, নাটক, আত্মজীবনী। 

 অতিপরিচিত  গ্রন্থ :

  • রকমফের
  • পানুর পাঠশালা
  • বাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ি
  • আজব দেশে এলিস
  • বুদ্ধির ঢেঁকি
  • চকমকি
  • জ্যান্ত ছবির ভোজবাজি
  • রুশ দেশের রূপকথা
  • ঈশপের গল্প
  • নেতা ও রাণী,
  • আমাদের বীর সংগ্রামী
  • জীবনের বিচিত্রা
  • চেনামুখ (নাটক)

বাংলা একাডেমী থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবী প্রকল্পের অধীনে 'গোলাম রহমান রচনাবলী' (চার খণ্ডে) প্রকাশিত হয়েছে।


গোলাম রহমান ১৯৬৯ সালে শিশু সাহিত্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন।


১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি সকালে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়।তিনি এক আততায়ীর হাতে নিহত হন।



==============================={{{{

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ২৭.১১.২০২১. Vol -569. The blogger in literature e-magazine


রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর

তিনি ছিলেন নীরবকর্মী, মুখচোরা মানুষ। পিতৃচিন্তা এবং পিতার দেওয়া দায়িত্ব নিষ্ঠা ভরে পালন করাই ছিল তাঁর প্রধান কর্তব্য। সেই কর্তব্যের মাঝে চাপা পড়ে গেছে তাঁর শিল্পী-সাহিত্যিক-বৈজ্ঞানিক মনটি। কমে গেছে সৃজনশীলতার সময়। পত্নী মৃণালিনী এবং পুত্র শমীর অকালমৃত্যু কীভাবে যে রবীন্দ্রনাথকে দুঃখী ও অসুখী করে রেখেছিল, তা রথীন্দ্রনাথ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই কবিকে সমস্তরকমভাবে সুখী করাটাই ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কবির চাওয়াকেই নিজের চাওয়া বলে মেনে নিয়েছিলেন। 


 জন্ম ২৭ নভেম্বর ,১৮৮৮, কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শান্তিনিকেতনে। পরে আমেরিকা কৃষিবিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য যান। ১৯০৯ সালে কৃষিবিজ্ঞানে বি.এস. হয়ে দেশে ফিরে আসেন এবং পিতার সঙ্গে শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনে কৃষি ও শিল্পের উন্নতিসাধনে যত্নবান হন।১৯১০ সালে রথীন্দ্রনাথ শেষেন্দ্রভূষণ ও বিনোদিনী দেবীর বিধবা কন্যা প্রতিমা দেবীকে বিবাহ করেন।এই বিবাহই ছিল ঠাকুর পরিবারের প্রথম বিধবা বিবাহ। 


বিশ্বভারতী পরিচালনায় তিনিই রবীন্দ্রনাথকে সহায়তা করেন।১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হলে তিনি তার প্রথম উপাচার্য হন।কারুশিল্প, উদ্যানরচনা ও উদ্ভিদের উৎকর্ষবিধানে তার বিশেষ দক্ষতা ছিলেন। রথীন্দ্রনাথ চাইলে অনেক কিছুই হতে পারতেন। হতে পারতেন সাহিত্যিক। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই নির্মেদ, প্রাঞ্জল, সাবলীল ও সুললিত গদ্য লেখার দক্ষতা তাঁর ছিল। 'পিতৃস্মৃতি' এবং স্মৃতিমুখর 'On the Edges of Time'-তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পদ্যও তিনি কিছু রচনা করেছিলেন। রান্নায় অসম্ভব পটু ছিলেন। শান্তিনেকতনে আসা বিদেশি অতিথি-অভ্যাগতদের জন্য নিজের হাতে জ্যাম-জেলি তৈরি করতেন। প্রয়োজন পড়লে রান্না করতেন বিভিন্ন ধরনের স্বাদু পদ। সুগন্ধি পাউডার এবং ভালো সেন্ট তৈরি করতে পারতেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের আশ্রম বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রদের একজন। ভালো করে সংস্কৃত শিক্ষা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। অত্যন্ত সুন্দর ও প্রাঞ্জল বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’। চামড়ার ওপর সুন্দর নকশা করতে পারতেন। আর জানতেন বাটিকের কাজ। শান্তিনিকেতনে এই দুইয়েরই প্রবর্তন হয় তাঁর হাত ধরে। তিনি ছিলেন অসাধারণ এক দারুশিল্পী। নানা রঙের কাঠ সংগ্রহ করে, সেইসব কাঠের নিজস্ব রঙ অক্ষুন্ন রেখে খোদাই করে কত না অসামান্য শিল্পকর্ম করেছেন তিনি। আসবাবের অভিনব সব নকশা তৈরি করেছেন। বলতেন, ‘জন্মেছি শিল্পীর বংশে, শিক্ষা পেয়েছি বিজ্ঞানের; কাজ করেছি মুচির আর ছুতোরের।’ প্রথাগতশিক্ষায় স্থপতি না-হয়েও শান্তিনিকেতনের অজস্র বাড়ির নকশা তৈরি করেছেন। যন্ত্রসঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন। ছবি আঁকতে পারতেন। বিভিন্ন ফুলের ছবি আঁকায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তারপরও তিনি কৃষিবিজ্ঞানী হলেন রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেপূরণের জন্য।শেষজীবনে চিত্রাঙ্কণও করেছেন।

 গ্রন্থগুলি :

প্রাণতত্ত্ব (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), 

অভিব্যক্তি (১৩৫২ বঙ্গাব্দ)। 

অশ্বঘোষ রচিত

 বুদ্ধচরিত গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ,

 অন দি এজেস অফ টাইম (১৯৫৮)।

পিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে লেখেন 

পিতৃস্মৃতি



জীবন-সায়াহ্নে নিজের স্ত্রীকে ছেড়ে-ছুড়ে, সুদূর দেহরাদূনে ঘর বেঁধেছিলেন তিনি। বন্ধুপত্নীর সঙ্গে।


প্রশাসনিক নানা জটিলতায় শান্তি ছিল না রথী ঠাকুরের। স্ত্রী প্রতিমা দেবীর সঙ্গে সম্পর্কেও হয়তো কোনও উত্তাপ অবশিষ্ট ছিল না। ১৯৫৩ সালের অগস্টে শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যান রথী ঠাকুর। সঙ্গে বিশ্বভারতীর অধ্যাপক নির্মল চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীরা। তাঁর আদরের ‘মীরু’! এর ঢের আগেই অবশ্য মীরার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা নিয়ে কানাকানি চরমে ওঠে। উপাচার্য থাকতেই বন্ধুপত্নী মীরা চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে হাজারিবাগ গিয়েছিলেন, সেই হাওয়া-বদল সমালোচনার ঝড় বইয়ে দেয় শান্তিনিকেতনে। আবার উপাচার্যের লেটারহেডেই এক বার মীরা দেবীকে চিঠিতে লিখছেন: ‘ডাক্তার বাবু বলেছিলেন আজ sponging নিতে। সুপূর্ণা ঠিক পারে না— তাই তোমার যদি অসুবিধা না থাকে তবে কি একবার ১১টার কাছাকাছি এসে এটা করতে পারবে?’ এই প্রস্তাব একটু বিসদৃশ ও অস্বস্তিকর, হয়তো এই অনুমানেই চিঠির মাথাতেই ফের লিখে দিচ্ছেন: ‘যদি অভ্যাস না থাকে তো জানিও— আমি নিজে ম্যানেজ করে নেব। সঙ্কোচ কর না।’ কিন্তু সঙ্কোচের বিহ্বলতা যে দুজনেরই এত দ্রুত ও এত দূর পর্যন্ত কেটে যাবে, মুখরক্ষাই দায় হবে শেষমেশ, তা ঠাকুরবাড়ির লোকজন ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেননি। (সৌজন্যে আনন্দবাজার পত্রিকা)


এক প্রবল বর্ষণদিনে কবির নবাবিষ্কার : ‘… এই ঘোরতর বিপ্লবের সময়ে আমার পুত্রটি উত্তরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রেলিঙের মধ্যে তাঁর ক্ষুদ্র অপরিণত নাসিকাটি প্রবেশ করিয়ে দিয়ে নিস্তব্ধভাবে এই ঝড়ের আঘ্রাণ এবং আস্বাদ গ্রহণে নিযুক্ত আছেন। শেষে বৃষ্টি পড়তে লাগল আমি খোকাকে বললুম, ‘খোকা তোর গায়ে জলের ছাট লাগবে। এইখানে এসে চৌকিতে বোস’ — খোকা তার মাকে ডেকে বললেন, ‘মা তুমি চৌকিতে বোসো, আমি তোমার কোলে বসি’, বলে মায়ের কোল অধিকার করে নীরবে বর্ষাদৃশ্য সম্ভোগ করতে লাগল। খোকা যে চুপচাপ ঘরে বসে কী ভাবে এবং আপনমনে হাসে এবং মুখভঙ্গি করে এক এক সময়ে তার আভাস পাওয়া যায়।’ খোকা ওরফে রথীন্দ্রনাথের প্রকৃতিতে পরিতোষ প্রাপ্তির মধ্যে যে শৈল্পিক বীজ নিহিত ছিল তা যে শিল্পী রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়ায়নি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আর্টের একটা দিক প্রবন্ধে ‘ফুল আঁকা’ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে রথীন্দ্রনাথ এক গূঢ় সত্য উচ্চারণ করেছেন — ‘ছবির বিষয়বস্তুর সঙ্গে আর্টিস্ট যতক্ষণ না অভেদাত্মা হন, ততক্ষণ তাঁর সত্যিকার দেবার মতো কিছু থাকে না, তাঁর আঁকা ছবিতে সত্য ফুটে ওঠে না। কেবল তাই নয়। যিনি আর্টিস্ট, তাঁকে বাস্তব ছাড়িয়ে অধ্যাত্মজগতে দর্শকদের পৌঁছে দিতে হয়।সেই অধ্যাত্মবোধকেই আমরা শিল্পীর দৃষ্টি বলি।’ রথীন্দ্রনাথের আঁকা ফুলের ছবির মধ্যে ‘শিল্পীর দৃষ্টি’–র ছাপ অনুভব করা যায়। ছবি আঁকিয়ে হিসেবে রথীন্দ্রনাথের প্রথম ও প্রধান কৃতিত্ব ফুলের ছবি। সুশোভন অধিকারী সংকলিত রথীন্দ্রনাথের চিত্রপঞ্জির তালিকায় দেখা যায় তিনি ৫২টি ছবি এঁকেছেন। টেম্পেরা, জলরং, মোমরং, ক্রেয়ণ, পেনসিল, প্যাস্টেল, ওয়াশ ও টেম্পেরা, ভার্নিশের প্রলেপযুক্ত টেম্পেরা, অস্বচ্ছ জলরং ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের মাধ্যমের আশ্রয়ে আঁকা হয়েছে এই ছবিগুলো। তাঁর আঁকা ফুলের ছবি দেখলে তা ছবি বলে মনে হয় না, মনে হয় জীবন্ত সত্ত্বা। ফুলকে তিনি দেখেছেন যত কাছ থেকে ও যত সুন্দরভাবে, তেমনি করে তিনি তাঁর তুলিতে ফুটিয়ে তুলেছেন। দেখে মনে হয় এমন রিয়ালিস্টিক ছবি আদৌ সম্ভব! শিল্পী পিতা রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন তাই তাঁর প্রশংসাসূচক উক্তি — ‘ওর (রথীন্দ্রনাথের) ফুলের ছবিগুলো সত্যি ভাল, এত delicate করে আঁকে। ফুলের ছবিতেই ওর বিশেষত্ব।’ রথীন্দ্রনাথ যে ফুলের অন্তরে প্রবেশ করে তার সত্যিকার রূপ ফুটিয়ে তুলতে পারে তা রবীন্দ্রনাথ মৈত্রেয়ী দেবীর মংপুর বাড়িতে থাকাকালীন তাঁর আঁকা ‘জেরবেরা’ ফুলের ছবি দেখে বুঝতে পেরেছিলেন। উচ্ছ্বসিত কবি স্বীকার করে নিয়েছিলেন ‘রথীর মত এত নিপুণ করে আমি ফুলের ছবি আঁকতে পারি না।’ জীবনের প্রান্তলগ্নে দেরাদুনে ফুলের প্রতি তাঁর এই আদি–অকৃত্রিম ভালোবাসাই বুঝি উঠে এসেছিল শিল্পীমনের তুলিতে। ফুলের ছবির পাশাপাশি বিভিন্ন গাছ, ল্যাণ্ডস্কেপ, ফুলের টব, পাহাড়ের নৈসর্গিক দৃশ্য, বাগান, মাঝি, তিব্বতি মেয়ের মুখোশ রথীন্দ্রনাথের অঙ্কণশিল্পকে বিচিত্রতায় ভারিয়ে তুলেছিল। ভাবতে অবাক লাগে যাঁর রেখার গুণে ছবি এতই জীবন্ত হয়ে উঠেছে তিনি শিল্পী হিসেবে কোনো বিশেষ শিল্পগোষ্ঠীতে সামিল হতে চাননি, কোনো গুরুর কাছে তালিমও নেননি। তিনি শিল্পের প্রাথমিক রীতিনীতি সহজসরলভাবে অনুসরণ করেছেন।


মেনকা ঠাকুর তাঁর স্মৃতিচারণায় শিল্পী রথীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে একটি বাক্য ব্যবহার করেছেন — ‘রথীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন চারুশিল্পীর মন নিয়ে, কিন্তু হয়ে উঠেছিলেন কারুশিল্পী।’ রথীন্দ্রনাথ নিজে একে বলেছেন ‘ছুতোরের কাজ’। তাঁর কারু দুনিয়াটা যখের ধনের গুহাভ্যন্তরের মত। ওখানে প্রবেশ না করলে গোটা রথীন্দ্র ব্যক্তিত্বকে আমরা আবিষ্কার করতে পারব না।’ বিশ শতকের প্রারম্ভে শহরের কলকারখানার বাড়বাড়ন্তে গ্রামের শিল্পী সমাজ ভেঙে পড়েছিল সেদিন রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করেছিলেন শিল্পীকে মজুরে পরিণত করা হচ্ছে।গ্রামকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার যে স্বপ্ন রবীন্দ্রনাথ দেখতেন তা বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে হাতে কলমে কারুশিল্পের কাজ বিশ্বভারতীতে প্রথম শুরু হয় প্রতিমাদেবীর উদ্যোগে ১৯২২ সালে শান্তিনিকেতনের কলাভবন চত্ত্বরে। পরে সুনির্দিষ্ট কারণে রবীন্দ্রনাথ ১৯২৮ সালে এই চর্চাকে সরিয়ে শ্রীনিকেতন রেল কোম্পানীর এক পরিত্যক্ত বড়ো চালাঘরকে সারাই করে হল অফ ইন্ডাস্ট্রি নাম দিয়ে স্থানান্তরিত করেন এবং রথীন্দ্রনাথের উপর বিশ্বভারতীর গ্রামীণ শিল্পবিভাগটির গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেন। বস্তুত তাঁরই সুযোগ্য নেতৃত্বে গড়ে ওঠে শিল্পভবনের মজবুত ভিত এবং মূলত তাঁরই উদ্যোগে এদেশে সর্বপ্রথম জাতি–ধর্ম ভেদাভেদ উপেক্ষা করে গ্রামে গ্রামে প্রশিক্ষিত কারুশিল্পী নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন শিল্পে হাতেকলমে কাজ শেখানোর চেষ্টা শুরু হয়। রথীন্দ্রনাথ কারুশিল্পের দীক্ষা পেয়েছিলেন জাপানের কাছ থেকে। ১৯২৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি এই বিভাগটির কর্ণধার ছিলেন। মূলত রথীন্দ্রনাথের অক্লান্ত চেষ্টা ও পরিশ্রমে ‘শিল্পভবন’ একটি সার্থক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং ভারতবর্ষের কারুশিল্পের হৃত–গৌরব পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়। ধীরে ধীরে শ্রীনিকেতনের পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষদের নিকট শিল্পভবন রুজি–রোজগারের এক আকাঙ্খিত কর্মস্থল হয়ে ওঠে। আজকে যখন দেখি বাটিক শিল্প, সৌন্দর্যমন্ডিত চর্মশিল্প, স্থানীয় মৃত্তিকা নির্মিত গ্লেজ–পটারি ইত্যাদি নতুন নতুন ডিজাইনের হ্যান্ডলুম শাড়ি, বেডকভার, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, দরজা–জানালার পর্দা, মোড়া, বাঁশ, বেত, গালার কাজ, সৌখিন চামড়ার ব্যাগ, বাটিকের চাদর, পোড়ামাটির কাজ তখন মানসপটে ভেসে ওঠে রথীন্দ্রনাথ। এই সমস্ত জিনিসে যেন রথীন্দ্রনাথের হাতের স্পর্শ লেগে আছে। ভারতীয় কারুশিল্পে দেশ বিদেশে খ্যাত ও চাহিদাযুক্ত ‘শান্তিনিকেতনী রীতি’ প্রবর্তন করার মূলে ছিলেন শিল্পী ডিজাইনার রথীন্দ্রনাথ।

মুচিশিল্প’–কে কেউ যদি ভারতবর্ষে আমদানি করার দাবি করে থাকেন তবে তিনি রথীন্দ্রনাথ। ‘আজকে চামড়ার কাজ ভারতবর্ষ জুড়ে চলেছে, কিন্তু অনেকেই জানেন না যে এই শিল্প রথীদাই প্রথম বিদেশ থেকে শিখে এসে প্রচলন করেছিলেন’ — মৈত্রেয়ী দেবীর এই বক্তব্যের সাথে সহমত অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাণী চন্দ, বীরভদ্র রাওচিত্র। ১৯২৪ সালে ইউরোপ ভ্রমনই এর অনুপ্রেরণা। রাণী চন্দ তাঁর সব হতে আপন বইতে জানাচ্ছেন — ‘স্বামী–স্ত্রী বিদেশে কিছুদিন থেকে এই ক্রাফট অতি যত্নের সঙ্গে শিখে এসেছিলেন। উত্তরায়ণের জাপানি ঘরের লাগা দক্ষিণের বারান্দায় বৌঠান–রথীদা আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে চালু করলেন এই কাজ।’ চর্মশিল্প কাজে রথীন্দ্রনাথের অসাধারণ দক্ষতা ছিল। এই কাজে বহু পরীক্ষা–নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে ভারতীয় শিল্পকাজের ছাপ আনতে সক্ষম হন। চামড়াকে ট্যানিং করে তার ওপর ছবি ও নকশা মিলিয়ে কত না রঙে সাজিয়ে দৈনন্দিন শিল্প গড়ে তুললেন। হাতব্যাগ, ফাইল, ফোলিয়ো ব্যাগ, লেদার কেস, বাক্স — কত রকমের জিনিস গড়ে তুললেন। চামড়া শিল্পকে ডিজাইন প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত করে ব্যাপকভাবে বিপনন ব্যবস্থা গড়ে উঠল। এই কাজে স্থানীয় কারুশিল্পীরা উপকৃত হল। বিক্রি থেকে ভালো রোজগার এল। স্বনির্ভরতার আশা জেগে উঠতে লাগল। শান্তিনিকেতন ডিজাইন দেশে বিদেশের বাজারে ছড়িয়ে পড়ল। স্থানীয় চর্মশিল্পীদের সুবিধার্থে শিল্পসদন ও স্থানীয় চর্মশিল্পী গোষ্ঠীবৃন্দের যৌথ উদ্যোগে রথীন্দ্রনাথ উদ্ভাবিত ‘শান্তিনিকেতনী চর্মশিল্প’ গত ২০০৭–২০০৮ সালে ভারত সরকারের বিশেষ স্থানাঙ্কিত সম্পদ স্বরূপ ভৌগোলিক চিত্র (Geographical Identification) ব্যবহারের স্বীকৃতি আনানো একটি যুগান্তকারী ঘটনা। চর্মশিল্প আর বাটিক শিল্পের প্রবর্তক হিসাবে তাঁর কাছে এদেশ ঋণী রইবে চিরকাল।


রবীন্দ্রনাথ দেশীয় রাজ্য–তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন ‘… বিলাতি আসবাবখানার নিতান্ত ইতরশ্রেণীর সামগ্রীগুলি ঘরে সাজাইয়া আমাদের দেশের বড়ো বড়ো রাজারা নিতান্তই অশিক্ষা ও অজ্ঞতাবশতই গৌরব করিয়া থাকেন।’ উপযোগিতা ও সৌন্দর্য সাধনার ফসল সুলভে মানুষের নাগালের মধ্যে এনে দিয়ে একজন সার্থক ডিজাইনারের কাজ করে রথীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রক্ষোভ প্রশমিত করলেন। রথীন্দ্রনাথই প্রথম শিল্পসম্মত, সহজ–সরল অন্দরসজ্জা ও আসবাবপত্রের উৎপাদন ও বিস্তৃত প্রসারণের মাধ্যমে বিশ শতকে দেশের ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্ত থেকে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে আসবাবপত্রের সৌন্দর্য এনে হাজির করলেন।শুধু তাই নয়, আজকে যে স্থানসংকোচনশীল আসবাবপত্র লভ্য, তা এদেশে প্রথম চালু করেন রথীন্দ্রনাথই। ১৯২৫ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যকালীন সময়ে শান্তিনিকেতনে উত্তরায়ণ চত্ত্বরে নির্মিত গৃহগুলি এবং ঐ গৃহগুলির প্রয়োজনে নির্মিত আসবাব ও অন্দরসজ্জাগুলি মূলত রথীন্দ্রনাথ ও তাঁর দক্ষিণহস্ত সুরেন কর মহাশয়ের মস্তিষ্কপ্রসূত। চিত্রভানুতে, কোণার্কে, উদয়নে স্নানঘর ও স্নানঘর সংলগ্ন আসবাব–স্থাপত্য যখন নির্মাণ করলেন তখন ভারতীয় স্থাপত্যশৈলীর ফুল ও প্রকৃতিমুখী জ্যামিতিক ডিজাইন নতুন আস্বাদে ফিরে এল। আসবাবপত্রে জ্যামিতিক ছন্দের সঙ্গে ভারতীয় স্থাপত্যশৈলীর মিশেলের প্রমাণ উদয়নের বসবার ঘর, খাওয়ার, শোওয়ার ঘর, পাশে বিশ্রামের জায়গা। বুদ্ধদেব বসু উদয়ন দেখে মুগ্ধ হয়ে সবপেয়েছির দেশে–তে লিখেছেন ‘এই আসবাবপত্রগুলির বিশেষত্ব প্রথম দর্শনেই চোখে ঠেকে এবং এখানে তুচ্ছ–জ্ঞান কোনো প্রয়োজনের জিনিস দেখলাম না যা সুন্দর নয় …’


কাঠের কাজ রথীন্দ্রনাথের প্রাণের সম্পদ। আজীবনই নিজের হাতে কাঠের কাজ করে গেছেন তিনি। কাঠের জাত, কাঠের প্রকৃতি সম্বন্ধে তাঁর খুব ভাল ধারণা ছিল। যেমন কোন কাঠে কোন জিনিস ভাল দেখাবে, কোন কাঠে কোন ডিজাইন ভাল খুলবে সে সম্বন্ধে তিনি বিশেষ অভিজ্ঞ ছিলেন। কাঠের inlay ও কাঠের আসবাবপত্র যেমন চেয়ার, টেবিল, আলমারি ইত্যাদি তিনি খুব ভাল তৈরী করতে পারতেন।

রথীন্দ্রনাথ প্রথম শ্রেণীর একজন আর্কিটেক্ট ছিলেন অথচ ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা নিয়ে তিনি কখনও পড়েননি। এটা তাঁর সহজাত গুন। নানারকম বাড়ির ডিজাইন করা তাঁর অন্যতম হবি ছিল। আর্কিটেক্ট রথীন্দ্রনাথের শিল্পীমনের পরিচয় বহন করে শান্তিনিকেতনের বাড়িগুলো। রথীন্দ্রনাথ তাঁর বন্ধু সুরেন্দ্রনাথ করের সাথে শান্তিনিকেতনে যে ছোটো ছোটো হস্টেল এবং বাসগৃহের পরিকল্পনা করেছিলেন তার বিশেষ একটা চরিত্র ছিল। স্থপতি রথীন্দ্রনাথের এই দিকটি সুন্দরভাবে ধরা দিয়েছে এ্যান্ডুশ সাহেবের কলমে — ‘Rathi is writing poetry in bricks and mortar.’। স্থাপত্যকাজে এদেশে সর্বপ্রথম রথীন্দ্রনাথই আধুনিক ভারতীয় রীতি উদ্ভাবন করার উদোগ নেন। তাঁর ‘উদয়ন’ বাড়িটির তুলনা বোধহয় কোথাও নেই। উদয়নকে আশ্রমবাসীরা অনেকেই সুনজরে দেখেননি। ব্যঙ্গ করে তারা বলতেন রাজবাড়ি। কিন্তু তিনি ছিলেন সৌখিন স্বভাবের। তিনি গৃহ নির্মাণ শিল্পের একটি সুরম্য নিদর্শন হিসাবেই গৃহটি নির্মাণ করেছিলেন। উদয়ন গৃহ যে রথীন্দ্রনাথের ভোগলিপ্সার চেয়ে সৌন্দর্য লিপ্সার প্রকাশ তা স্যার মরিস গয়ারের চোখ এড়ায়নি। মরিস গয়ার উদয়নে খুঁজে পেয়েছেন ‘There is thought in every corner’। নন্দিনী দেবীর স্মৃতিকথায় দেখতে পাওয়া যায় রতনপল্লীতে ‘ছায়ানীড়’ বাড়িটির সমস্তকিছু পরিকল্পনা রথীন্দ্রনাথের। জাপানী কায়দায় নির্মিত উদয়নের বাগানে প্রতিমাদেবীর জন্য নির্মিত স্টুডিও চিত্রভানুর একতলায় রথীন্দ্রনাথের নিজের ওয়ার্কশপ গুহাঘরও তাঁর স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন।


১৯৫৩ সালে বিশ্বভারতীর উপাচার্যপদ ত্যাগ করে রথীন্দ্রনাথ স্বেচ্ছানির্বাসন নিলেন দেরাদুনে। রাজপুরে ‘মিতালি’ গড়ে তুললেন। এই মিতালিকে দেখলেই সহজে বোঝা যায় মিতালি হল উদয়নের পুনশ্চ বা postscript। মিতালির বসার ঘরে সবখানেই উদয়নের ছোঁয়া।

বাগান করা অভিজাতদের অন্যতম শখ। কিন্তু এক্ষেত্রে রথীন্দ্রনাথের শখ ও নেশা অভিজাত বন্ধুদের থেকে ভিন্ন ছিল। রসিক ও বিজ্ঞানীর এক অদ্ভুত সমন্বয় ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় সঠিক মূল্যায়ণ করেছেন — ‘রথীন্দ্রনাথের মেজাজটা ছিল বিজ্ঞানীর, মনটা ছিল আর্টিস্ট বা ভাবুকের’। শিল্পী রথীন্দ্রনাথকে যেমন পাওয়া যায় উত্তরায়ণের অট্টালিকায়, তেমনি তাঁর শৈল্পিক স্পর্শ লেগে আছে তাঁর নির্মিত উদ্যানে। সৌমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ‘কোলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেন–এর পরে সংগ্রহ বৈচিত্র্যে দেশের যে কটি ছোটখাটো উল্লেখযোগ্য উদ্যান আছে শান্তিনিকেতন সেগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য।’ স্বদেশ–বিদেশ, জংলি–পাহাড়ি শৌখিন, বুনো এবং পোশাকি নিত্যনতুন ফুলগাছের পারস্পরিক সম্মিলন (hybrid) নিয়ে সারাজীবন ধরেই তিনি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন এবং সন্তানস্নেহে তাঁদের লালন–পালন করেছেন। তাদের নিত্যনতুন অভিব্যক্তি তাঁকে হাসিয়েছে, কাঁদিয়েছে, মাতিয়েছে। এরা তাঁর হৃদয় জুড়ে বসেছিল। এদের সাথে নিত্য চলত তাঁর ভাব–বিনিময়, অব্যক্ত কথার মাধ্যমে হৃদয়ের আদানপ্রদান। গাছেদের সাথে আজন্ম একটা সংবেদনশীল বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন তিনি, সেই বক্তব্য কবিকন্যা মাধুরীলতার শিলাইদহে লেখা চিঠিতে স্পষ্ট — ‘রথী কি সেখানে গিয়ে কোনো Fern কী অন্য গাছপালা দিয়ে বাগান করেছে? এখন ওর দু’একটা গাছ ছাড়া সব মরে গেছে, ওকে বলো না ওর ভয়ানক কষ্ট হবে।’


শান্তিনিকেতনের কঙ্করময় জমিতে গোলাপ গাছ হতনা বললেই চলে। সেই জমিতে গোলাপবাগান করেছিলেন রথীন্দ্রনাথ। রথীন্দ্রনাথের সেই দুঃসাধ্যসাধন দেখে প্রত্যক্ষদর্শী গোলাপপ্রেমী কবির সন্তুষ্ট উচ্চারণ — ‘রথী, আমি জীবনে কখনই ভাবতে পারিনি এখানে গোলাপ ফুল দেখব। তুমি অসম্ভবকে সম্ভব করেছ।’


জীবনের উপান্তে দেরাদুনে উত্তরায়ণেরই মতো আশ্চর্যরকমের এক বাগান করেছিলেন তিনি। নানারকম ফুল ও ফলের গাছ ছিল। জুঁই, চামেলী, বেলি গন্ধরাজ ইত্যাদির সাথে সাথে তাঁর বাগানের শোভাবর্দ্ধন করেছিল বিদেশী ফুল জ্যাকাবান্ডা, বটলব্রাশ, অ্যাজেলিয়া, অ্যাকালিয়া, ম্যাগনোলিয়া। প্রত্যক্ষদর্শী ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণা তার সাক্ষ্যবহন করে। ‘তাঁর বাগানে অত্যাশ্চর্য রকমের ফুল–ফল ধরত। বিদেশী ফুলের ইয়াত্তা নেই। তাঁর সত্যই green hand ছিল।


শুধুমাত্র কারুশিল্প, চিত্রাঙ্কণ, স্থাপত্যবিদ্যা, উদ্যানবিদ্যা, চর্মশিল্পতে রথীন্দ্রনাথ তাঁর শিল্পমনের অনুশীলন ও অভিনিবেশের পরিচয় দিয়েছেন তা নয়, তাঁর উদ্যোগে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের লালবাড়িতে ‘বিচিত্রা’ ক্লাবের প্রতিষ্ঠা হয় ১২ জুলাই ১৯১৫। চিত্রকলায় বেঙ্গল স্কুলের বিকাশে এই ক্লাব বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। রন্ধনশিল্পে উৎসাহ ছিল, নানারকম আচার প্রস্তুতিতে তাঁর দক্ষতার কথা নানাজনের স্মৃতিচারণায় স্পষ্ট। প্রসাধনী দ্রব্য ও গন্ধদ্রব্যও বানাতে পারতেন। শেষ দিকে Arty Perfumes বলে কিছু প্রসাধনী দ্রব্য বাজারে ছেড়েছিলেন, ফটোগ্রাফি ছিল তাঁর চর্চা ও আগ্রহের ক্ষেত্র। তাঁর তোলা আলোকচিত্রের একটা বড়ো অংশ architectural photography-র পর্যায়ভুক্ত। Boat-Architecture-কে বিশ্বমানের করে তোলাটা ছিল রথীন্দ্রনাথের কর্মপরিণতি। বাহন এবং বাহকের সম্পর্কের সুতোকে মজবুত করতেই যেন রথীন্দ্রনাথ বিংশ শতকের তিনের দশকে চালু করলেন ইঞ্জিনচালিত বোট–স্থাপত্য। শিল্পের নানাদিকে ছিল তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ তবুও তিনি নিজেকে craftsman ভাবতেন, artist নয়। তিনি প্রকৃত অর্থেই ছিলেন ‘নিরহং শিল্পী’। শঙ্খ ঘোষ বলেছেন — ‘শিল্পী শব্দটির তাৎপর্য বহুদুর প্রসারিত হতে পারে। চলচ্চিত্রের, সংগীতের, নাট্যের, চিত্রের ভাস্কর্যের, সাহিত্যেরই নয়, শিল্পী কেউ হতে পারেন জীবনেরও, যাপনেরও।’ রথীন্দ্রনাথের মতো মানুষের কর্ম যেমন তাঁর শিল্পীসত্ত্বার পরিচয় বহন করে, তেমনি তাঁর জীবনযাপনও শৈল্পিক। শিল্প তাঁর কর্মে এবং মননে।


এল্ মহাস্ট লিখেছেন — ‘অভিজাতসুলভ তাঁর শান্ত মুখশ্রীর অন্তরালে ছিল শিল্পীর হৃদয়, কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ করবার সময়–সুযোগ তিনি কদাচিৎ পেয়েছেন। শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের নানা সমস্যা, বিশ্বভারতীর নানা আর্থিক ও আইনগত প্রশ্নের আলোচনায় তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। তাঁর স্টুডিও, তাঁর ছোটো কারখানা ঘর বা তাঁর উদ্যানচর্চার কাজে দেবার সময় তিনি সামান্যই পেয়েছেন।’ আসলে রথীন্দ্রনাথের জীবনে আবেদনের চেয়ে নিবেদন শিল্পই যেন বেশি। নানাসময় নানা কাজে পিতার ইচ্ছার কাছে আত্মবলি দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত বিশ্বভারতীর একজন বড়োমাপের ‘কেয়ারটেকার’–ই থেকে যেতে হয় তাঁকে। নীরব কর্মেই ছিল তাঁর আশক্তি ও মাহাত্ম্য। চিরজীবন তিনি উইংসের আড়ালেই রয়ে গেছেন, স্টেজে নামবার আকাঙ্খা প্রকাশ করেননি। তিনি ‘কর্মের উচ্চ দাম’ দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর মতো ‘কর্মীর নাম নেপথ্যেই’ রয়ে গেছে। সত্যজিৎ রায় বলেছেন — ‘শিল্পীরা সবসময় এক পথে চলতে ভালোবাসে না।’ জীবনের উপান্তে রথীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী ত্যাগ করে আকস্মিকভাবে স্বেচ্ছা–নির্বাসন নেন দেরাদুনে। কেউ বলেছেন ভুল বোঝাবুঝি, কেউ বলেছেন সরকারি নিয়মের বাঁধন ভালো লাগেনি, কেউ বলেছেন অবকাশ যাপনের আকাঙ্খা। কিন্তু কেউ বলেননি পিতার ছায়া থেকে দূরে ‘নিজের জীবন’ কাটাবার সে ছিল প্রয়াস। চিরকাল নেপথ্যচারী মানুষটির মৃত্যুও ঘটেছে জনতার দৃষ্টির আড়ালে। পিতার জন্মশতবর্ষের বিপুল কোলাহলের আড়ালে সহজেই চাপা পড়েছে কবিপুত্রের মৃত্যু সংবাদটি। এমনভাবে নিজেকে নিশ্চিহ্ন করতে পারাও কি আর্ট নয়?


মৃত্যু - ৩ জুুন, ১৯৬১. 


===={{{{{{{{{{{{{{∆∆∆∆∆∆}}}}}}}}}}}}}}}}====

Thursday, 25 November 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। মুহম্মদ আবদুল হাই। ২৬.১১.২০২১.Vol -568. The blogger in literature e-magazine


মুহম্মদ আবদুল হাই 


ইউরোপ এবং আমেরিকার বাইরে ভাষা ও ভাষা সংক্রান্ত বিবিধ বিষয় নিয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণার দরজা প্রথম উন্মুক্ত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাধারণের পরিচিত শাস্ত্রগুলির পাশাপাশি এই নতুন শাস্ত্রটিকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের অনেকের নামই আমাদের কাছে খুব পরিচিত। স্বাভাবিক ভাবে এঁরা অধিকাংশই বাঙালি, কারণ এই নতুন শাস্ত্রটির চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে প্রথম শুরু হয় কলকাতায়।


বাংলা ভাষার উৎপত্তি বিবর্তন নিয়ে যাঁরা প্রথম সারির গবেষণা করেছিলেন তাঁদের তিনজনের নাম বাঙালির সংস্কৃতি জগতে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এঁরা হলেন ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও সুকুমার সেন। এঁরা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ভাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সমসাময়িক আরও দুই বাঙালি ভাষাশাস্ত্র অধ্যয়ন ও গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন— বটকৃষ্ণ ঘোষ ও হেমন্তকুমার সরকার। তবে হেমন্তকুমার অল্প বয়সেই স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং ভাষাচর্চার পথ থেকে অনেকটাই দূরে সরে যান। সুনীতিকুমার ও তাঁর সমসাময়িক যাঁরা, তাঁদের যদি প্রথম প্রজন্মের ভাষাশাস্ত্রী বলে চিহ্নিত করা যায়, তা হলে দ্বিতীয় প্রজন্মের ভাষাশাস্ত্রীদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি হলেন মুহম্মদ আবদুল হাই। আজ আমাদের কাছে তিনি প্রায় বিস্মৃত।


তিনি ১৯১৯ সালের ২৬শে নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার রাণীনগর থানার মরিচা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবদুল গণি, মায়ের নাম ময়মুন্নেসা খাতুন। বাবা আবদুল গণি রাজশাহীর পোরেশা গ্রামে 'সাহু' পরিবারে শিক্ষকতা ও ইমামতি করতেন।

 মরিচা গ্রামের কাছেই অবস্থিত বর্ধনপুর জুনিয়র মাদ্রাসায় লেখাপড়া শুরু করেন এবং ১৯৩২ সালে কৃতিত্বের সাথে মাদ্রাসা সমাপ্ত রাজশাহী হাই মাদ্রাসায় ভর্তি হন। রাজশাহীতে তিনি বড় ভাই আবদুল আজিজের কাছে থাকতেন। ১৯৩৬ সালে উচ্চ মাদ্রাসা প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন এবং ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেন এবং প্রথম বিভাগে ষষ্ঠ স্থান লাভ করেন। আবদুল হাই ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রেরণায় ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রথম বর্ষ অনার্স শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৪১ সালে বিএ অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় এবং ১৯৪২ সালে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। তিনিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্র, যিনি বিএ ও এমএ উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ১৯৩৬ সালের ২৮ শে ডিসেম্বর ছাত্রাবস্থাতেই ১৭ বছর বয়সে মরিচা গ্রামের আনিসা বেগমের সাথে তার বিয়ে হয়। পরিবারের তিনটি ছেলে ও পাঁচটি মেয়ে ।


ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে এক মাস শিক্ষকতা করার মাধ্যমে মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের কর্মজীবনের শুরু। এরপর বেঙ্গল জুনিয়র এডুকেশন সার্ভিসে বাংলার লেকচারার পদে যোগ দেন এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কৃষ্ণনগর সরকারি মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৭ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর তিনি রাজশাহী সরকারী কলেজে লেকচারার হয়ে চলে আসেন।

১৯৪৯ সালের ২রা মার্চ হাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৫০ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অভ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে ভাষাতত্ত্বে গবেষণার জন্য যান। সেখানে অধ্যাপক জে আর ফার্থের নির্দেশনায় এ ফোনেটিক এন্ড ফোনোলোজিক্যাল স্টাডি অব নেইজালস অ্যান্ড নেইজালাইজেশন ইন বেঙ্গলি (বাংলায় নাসিকা ও নাসিকাকরণের স্বরবিষয়ক ও শব্দ-বিদ্যাগত গবেষণা) শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করেন এবং ১৯৫২ সালে ডিস্টিংশনসহ এমএ ডিগ্রী লাভ করেন।১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে প্রভাষক পদে ফিরে আসেন। ১৯৫৪ সালের ১৬ই নভেম্বর তিনি বিভাগের রিডার বা সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬২ সালে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে রিডার থেকে প্রফেসর পদে তার উন্নতি ঘটে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন।

 গ্রন্থবলী :

সাহিত্য ও সংস্কৃতি (১৯৫৪)

বিলাতে সাড়ে সাত শ' দিন (১৯৫৮)

তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা (১৯৫৯)

ভাষা ও সাহিত্য (১৯৬০)

এ ফোনেটিক এন্ড ফোনোলোজিক্যাল স্টাডি অব নেইজালস অ্যান্ড নেইজালাইজেশন ইন বেঙ্গলি [বাংলায় নাসিকা ও নাসিকাকরণের স্বরবিষয়ক ও শব্দ-বিদ্যাগত গবেষণা] (১৯৬০)

ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব (১৯৬৪)

বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (সৈয়দ আলী আহসান সহযোগে) (১৯৬৮)


ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দশ মাসের মেয়াদে ১৯৬৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার মিশৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন। কিন্তু এ যাত্রা তার জন্য সুখকর হয়নি। পাকিস্তানের সামরিক শাসনের অস্বস্তিকর রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে একটি কুচক্রী মহল তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুলে তখনকার পত্র-পত্রিকায় নানা কুৎসা ছড়ানো হচ্ছিল। কতক পরিচিত মুখ নেপথ্যে থেকে ইন্ধন জুগিয়েছিলেন। সংবাদ পেয়ে অধ্যাপক আবদুল হাই বিচলিত হয়ে পড়েন এবং কাজ অসমাপ্ত রেখে দেশে ফিরে আসেন। তার মতো অত্যন্ত ভদ্র ও শান্ত প্রকৃতির মানুষের কাছে বিষয়টি বজ্রপাততুল্য মনে হয়েছিল। তিনি অনেকের সাহায্য-সহযোগিতা চেয়েও পাননি। এতে তিনি অত্যন্ত নিঃসঙ্গ বোধ করেন এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। মনের এরূপ অবস্থায় ১৯৬৯ সালের ৩ জুন মধ্য-দুপুরে ঢাকা শহরে চলন্ত ট্রেনের ধাক্কায় আহত হয়ে তিনি লোকান্তরিত হন। তার মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা না অপঘাত­ এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে তার অকাল মৃত্যু সমাজ সহজভাবে মেনে নেয়নি। অনেকেই তার মৃত্যুর জন্য বৈরী সামাজিক প্রতিবেশকে দায়ী করেছে। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে যেভাবে মানুষের ঢল নেমেছিল, এটি তার প্রতি দেশের অগণিত সাধারণ মানুষের নিখাদ শ্রদ্ধার স্বীকৃতি। ঢাকার আজিমপুর গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।



প্রবন্ধ ও গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রণয়নের জন্য ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

=================================

Wednesday, 24 November 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। যাত্রাপালাকার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়। ২৫.১১.২০২১. Vol -567 The blogger in literature e-magazine

যাত্রামেব জয়তে জয় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ 



ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়

 জন্ম পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর থানার 'মূল' গ্রামে ২৫ নভেম্বর ১৯৩৪ এ । মূলগ্রামেই তিনি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তবে কিশোর বয়স থেকে বাংলার গ্রামে অনুষ্ঠিত যাত্রার প্রতি প্রেম ও নিষ্ঠা তাঁকে যাত্রাশিল্পে আকৃষ্ট করেছিল। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দেই কলকাতার চিৎপুরের যাত্রাপালা জগতে প্রবেশ করেন। দাম্পত্য জীবন ছায়া গঙ্গোপাধ্যায় এ সঙ্গে। সন্তান -মেঘদূত গঙ্গোপাধ্যায়ও দেবদূত গঙ্গোপাধ্যায়। 




 তাঁর রচিত প্রথম যাত্রাপালা "নাচমহল" মঞ্চস্থ করে 'সত্যম্বর অপেরা'। প্রথম লেখা যাত্রাপালাতেই তিনি দর্শকদের সমাদর পান। এরপর একে একে বহু যাত্রাপালা রচনা করেন। তার রচিত যাত্রাপালার সংখ্যা প্রায় আড়াই-শো। পালা রচনার পাশাপাশি তিনি নির্দেশনার কাজেও হাত দেন। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজের নামে দল "ভৈরব অপেরা" গঠন করে প্রযোজনাও করেছেন। দরদী মনের মানুষ ছিলেন তিনি। গরীব সাধারণ মানুষের কথা, অন্যায় অবিচার অত্যাচারের কথা তার পালা লেখনীতে ফুটে উঠেছে। ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় যেমন একাধারে পালাকার, নির্দেশক ও প্রযোজক ছিলেন তেমনই ছিলেন গীতিকার ও সুরকার। যাত্রাপালার গানেও যথেষ্ট দক্ষতা ছিল।  

জনপ্রিয় উল্লেখযোগ্য পালাগুলি :

  • 'একটি পয়সা'
  • 'পদধ্বনি'
  • 'অচল পয়সা'
  • 'পাগলা গারদ'
  • 'রক্তে ধোয়া ধান'
  • 'মাতৃঋণ'
  • 'সাত টাকার সন্তান'
  • 'দেবী সুলতানা'
  • 'শ্রীচরণেষু মা'
  • 'গান্ধারী জননী'
  • 'ভীষ্ম জননী গঙ্গা'
  • 'মা মাটি মানুষ'
  • 'ঠিকানা পশ্চিমবঙ্গ'
  • 'কুবেরের পাশা'
  • 'দু টুকরো মা'
  • 'ভিখারি ঈশ্বর'
  • 'ঘরে ঘরে দুর্গা'
  • 'জীবন এক জংশন'
  • 'শান্তি তুমি কোথায়'
  • 'স্বর্গের পরের স্টেশন'
  • 'সত্যযুগ আসছে'

ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় সারা জীবন নিজেকে যাত্রাশিল্পের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত রেখে শিল্পের উন্নতির জন্য কাজ করে গেছেন। গ্রাম বাংলার সমাদর কুড়িয়েছেন আর অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে সরকারি উদ্যোগে তার গ্রামের বাড়িতে আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 


বাংলা যাত্রাজগতের জনপ্রিয় যাত্রাপালার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ শে ডিসেম্বর (১৪০৬ বঙ্গাব্দের ১২ পৌষ) প্রয়াত হন।


পারিবারিক সাক্ষাৎকার: এসময়ে যাত্রা পালা 

ক্রমেই আকর্ষণ কমছে যাত্রাপালার। রবিবার বর্ধমানের কৃষ্ণপুর হাইস্কুলে অনুষ্ঠিত যাত্রাশিল্পী ও পালাকার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের ৮০তম জন্মদিবস পালন অনুষ্ঠানে এমনই আক্ষেপ করলেন তাঁর মেজো ছেলে দেবদূত গঙ্গোপাধ্যায়। এ দিনের অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল যাত্রা এবং যাত্রাশিল্পীদের নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থা ‘যাত্রা জগতের ঠিকঠিকানা।’ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন পালাকার জ্যোতির্ময় দে, শেখ মোসলেম, রমাপতি হাজরা, ইদবক্স। ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের মেজো ছেলে দেবদূত গঙ্গোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “এখন শিক্ষিত লোকেরা গ্রামেও আর যাত্রা দেখতে আসছেন না। ফলে দলগুলি আকারে সংকুচিত হচ্ছে। যেখানে আগে অন্তত ২০-২২ জন অভিনেতা-অভিনেত্রী থাকতেন এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০-১২ জনে।” তিনি আক্ষেপ করেন, আগেগ্রামের মানুষ যাত্রাকে যে টাকা দিতেন, এখন আর তা দিচ্ছেন না। এতে যে শুধু যাত্রা দলগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাই নয়, মেকআপম্যান থেকে আলোর কারবারিরাও শিল্পটিকে ছেড়ে গিয়েছেন পেটের তাগিদে। তাঁরা এখন চাষবাসে মনোযোগী হতে বাধ্য হচ্ছেন। দেবদূতবাবুর মতে, যাত্রাপালাগুলির জায়গা নিয়েছে টিভি সিরিয়াল। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে যাত্রা বলে আর কিছু এ রাজ্যে থাকবে না। আয়োজক সংস্থার সভাপতি ও সম্পাদক মানোয়ার হোসেন বলেন, “হারিয়ে যাওয়া যাত্রাপালার ইতিহাস ধরে রাখতে আমরা একটি সংকলন তৈরি করছি। এই সংকলনে রাখা হবে বিভিন্ন যাত্রাজগতের ব্যক্তিত্বদের কথা। অতীতের শিল্পী শান্তিগোপাল, ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রকুমার দে, শেখর গঙ্গোপোধ্যায়, পান্না চক্রবর্তী, স্বপনকুমার, তরুণকুমার, তপনকুমার, রাখাল সিংহদের মত অভিনেতাদের সঙ্গে যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁদের লেখা ও সাক্ষাৎকার।”

==================================

আলোচনা :

মা সরস্বতীর মানস পুত্র পালাকার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়

  গীতিকার অজয় আচার্য‍্য


             বাংলার জীবন যাত্রা। আর যাত্রাকে যিনি বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি সরস্বতীর বর পুত্র পালাকার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়। আজও বঙ্গবাসী তাঁকে সমানভাবে শ্রদ্ধা জানায় নত মস্তকে। ১৩৪১ বঙ্গাব্দে বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর থানার "মূল" গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই কালজয়ী পালাকার। আমাদের বরাহনগরে "অমৃত বিন্দু" ওনার বাসগৃহ। এখানে বর্তমানে ওনার সংগ্রহশালা করেছেন ওনার সুযোগ্য পুত্র পালাকার মেঘদূত গঙ্গোপাধ্যায়।।


      কিশোর বয়স থেকে যাত্রার প্রতি প্রেম ও নিষ্ঠা ওনাকে এতো বড়ো পালাকার তৈরী করেছে। ভৈরব বাবুর লেখা প্রথম যাত্রাপালা "নাচ মহল"। এরপর একে-একে বহু উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালা রচনা করেন। ভৈরব বাবুর লেখা উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালাগুলো হলো-----

   "একটি পয়সা", "পদধ্বণী", " অচল পয়সা", "সাত টাকার সন্তান", "গান্ধারী জননী ", "দেবী সুলতানা", "ঠিকানা পশ্চিমবঙ্গ", "পুত্র বধূঁর সিঁদুর চুরি", "বৌ হয়েছে রঙের বিবি", "স্বামী আগে না সিঁদুর আগে", "অগ্নিসাক্ষী সিঁদুর", " স্বর্গের পরের স্টেশন", "ভীষ্ম জননী গঙ্গা" এবং "পালকি ভাঙা বৌ" ইত্যাদি। এছাড়া আরো বহু উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালা রচনা করেছেন তিনি। আর এইসব পালাতে বিখ্যাত বরণীয় শিল্পীরা অভিনয় করেছিলেন।।


        দরদী মনের মানুষ ছিলেন ভৈরব বাবু। আর গরীব সাধারণ মানুষের কথা বারেবারে ফিরে এসেছে ওনার লেখনীতে। যেখানেই অন্যায় - অবিচার-অত্যাচার দেখেছেন সেখানেই প্রতিবাদে ঝলসে উঠেছে তাঁর কলম। মসী ধরা দিয়েছে খাপ খোলা অসি রূপে।। 


     উনি শুধু পালাকারই ছিলেন না। উনি ছিলেন একাধারে পালাকার,নির্দেশক, গীতিকার ও সুরকার। গানের ব্যাপারে ওনার যথেষ্ঠ দক্ষতা ছিলো। মা সরস্বতীর বর পুত্র ভৈরব বাবুর লেখা দুটো পালায় আমার অভিনয় করার সুযোগ হয়েছিল। পালাদুটো হ‌লো-- "স্বর্গের পরের স্টেশন" এবং "পুত্র বঁধূর সিঁদুর চুরি"।।


     এমন দরদী মনের মরমী পালাকার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় ১৪০৬ বঙ্গাব্দের ১২ই পৌষ (ইংরাজী 28 ডিসেম্বর,1998) দেহত্যাগ করেন।।


   উনি যাত্রার রস পিপাসু যাত্রা পাগল মানুষদের জন্য যে অমৃত কুম্ভ রেখে গেছেন,তার অমৃত পান করে আজও মানব হৃদয় হচ্ছে ধন্য। পৃথিবীতে যতদিন বাঙালী ও তার যাত্রাগান বেঁচে থাকবে ততদিনই অমর হয়ে থাকবে ওনার নাম। হৃদয়ের শ্রদ্ধাঞ্জলী অর্পণ করি প্রয়াত পালাকার সরস্বতীর মানস পুত্র ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়ের রাতুল চরণে।।


কৃতজ্ঞতা স্বীকার::---ভৈরববাবুর সুযোগ্য পুত্র পালাকার মেঘদূত গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়ের করে কমলে ।



###############################


Tuesday, 23 November 2021

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। রবি ঘোষ। ২৪.১১.২০২১. Vol - 566. The blogger in literature e-magazine.


"""জন্মটাই যেন অভিনয়ের জন্য। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই নাটকে অভিনয়ের হাতেখড়ি। তারপর যখন কলেজে ভর্তি হলেন তখন বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুললেন ‘বন্ধুমন’ নামে একটি নাটকের দল। মহড়া দিতেন আশুতোষ কলেজের ছাদে। কিন্তু, বাবা জীতেন্দ্রনাথ তা একেবারেই পছন্দ করতেন না। প্রায়ই স্ত্রী জ্যোৎস্না রানীকে বলতেন, “ অভিনয় কইরা সময় নষ্ট করে ক্যান ? তোমার পোলারে কয়া দিও ওই চেহারায় অভিনয় হয় না। সে ছিলো দুর্গাদাস বাঁড়ুজ্যে, হিরোর মতন চেহারা।”

                 তিনি ২৪শে নভেম্বর, ১৯৩১ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার। ১৯৪৯ সালে তিনি সাউথ সুবর্ধন মেইন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ইন্টারপাস করে তিনি আশুতোষ কলেজ-এ ভর্তি হন, গ্রাজ্যুয়েশনের জন্য। ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত তিনি বংশাল কোর্টে কাজ করেন। তিনি অভিনেত্রী অনুভা গুপ্তকে বিয়ে করেন। প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর দশ বছর পর তিনি ২৪শে নভেম্বর, ১৯৮২ সালে বৈশাখী দেবীকে বিয়ে করেন।
                     ১৯৫৯ সালে তিনি আহ্বান চলচ্চিত্রে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন। তপন সিনহার গল্প হলেও সত্যি তে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি সবার নজরে আসেন। ১৯৬৮ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা সত্যজিৎ রায় নির্মিত গুপী গাইন বাঘা বাইন চরিত্রে তাঁর অভিনয় চলচ্চিত্রজগতে একটি মাইলফলক। একে একে তিনি অভিযান (১৯৬২), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০), হীরক রাজার দেশে (১৯৮০), গুপী বাঘা ফিরে এলো (১৯৯১), পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯৩) সহ বেশকিছু উপমহাদেশখ্যাত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তিনি নিধিরাম সর্দার চলচ্চিত্রটি পরিচালনাও করেন। তিনি একজন বিখ্যাত থিয়েটার অভিনেতাও বটে। ১৯৭০ সালে তিনি গুপী গাইন বাঘা বাইন চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালেও অংশ নেন। তিনি চলাচল থিয়েটার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ৪ঠা ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
অভিনীত চলচ্চিত্রসমূহ :

কাহিনী (১৯৯৭)
বাক্স রহস্য (টেলিভিশন) (১৯৯৬)
বৃন্দাবন ফিল্ম স্টুডিওস (১৯৯৬)
পতঙ্গ (১৯৯৪)
পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯৩)
আগন্তুক (১৯৯১)
গুপী বাঘা ফিরে এলো (১৯৯১)
অন্তর্জালি যাত্রা (১৯৮৭)
মহাযাত্রা (১৯৮৭)
অমর গীতি (১৯৮৩)
বাঁচামরার বাগান (১৯৮০)
হীরক রাজার দেশে (১৯৮০)
পাকা দেখা (১৯৮০)
নৌকাডুবি (১৯৭৯)
চারমূর্তি (১৯৭৮)
জানা অরণ্য (১৯৭৬)
কোরাস (১৯৭৪)
মৌচাক (১৯৭৪)
সঙ্গিনী (১৯৭৪)
ঠগিনী (১৯৭৪)
বসন্ত বিলাপ (১৯৭৩)
মর্জিনা আব্দুল্লাহ (১৯৭৩)
আজকের নায়ক (১৯৭২)
পদি পিসির বার্মি বাক্স (১৯৭২)
সবসে বড়া সুখ (১৯৭২)
ধন্যি মেয়ে (১৯৭১)
অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০)
আরোগ্য নিকেতন (১৯৬৯)
আপনজন (১৯৬৮)
বাঘিনী (১৯৬৮)
গুপী গাইন বাঘা বাইন (১৯৬৮)
বালিকা বধূ (১৯৬৭)
কাল তুমি আলেয়া (১৯৬৬)
মণিহার (১৯৬৬)
দল গোবিন্দের কড়চা (১৯৬৬)
গল্প হলেও সত্যি (১৯৬৬)
উত্তরপুরুষ (১৯৬৬)
গৃহ সন্ধানে (১৯৬৬)
স্বপ্ন নিয়ে (১৯৬৬)
আরোহী (১৯৬৫)
মহাপুরুষ (১৯৬৫)
এতটুকু বাসা (১৯৬৫)
সুরের আগুন (১৯৬৫)
আরোহী (১৯৬৪)
লাল পাথর (১৯৬৪)
শুভ ও দেবতার গ্রাস (১৯৬৪)
মোমের আলো (১৯৬৪)
অবশেষে (১৯৬৩)
নির্জন সৈকতে (১৯৬৩)
কষ্টিপাথর (১৯৬৩)
শেষ প্রহর (১৯৬৩)
ছায়াসূর্য (১৯৬৩)
বিনিময় (১৯৬৩)
ন্যায়দন্ড (১৯৬৩)
পলাতক (১৯৬৩)
আগুন (১৯৬২)
অভিযান (১৯৬২)
হাঁসুলীবাঁকের উপকথা (১৯৬২)
মেঘ (১৯৬১)
কিছুক্ষণ (১৯৫৯)

পরিচালিত চলচ্চিত্রসমূহ :

নিধিরাম সর্দার (১৯৭৬)
সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা (১৯৭৪)

অভিনয় জীবনের ধারাপাত -

 “দিলাম ঝাঁপ। সে এক এক্সাইটিং ফিলিং। মনে হল পেঁজা তুলোর ওপর দিয়ে গড়িয়ে এলাম। কিন্তু হাত-পা স্টিফ। মানিকদা বললেন, ‘শিগগির ওদের ভ্যানে তোলো। আর গরম দুধ খাওয়াও।’ সব রেডিই ছিল। গাইড বলল, ‘খবরদার আগুনের কাছে যাবেন না। পা ফেটে যাবে। শুধু পা ঠুকুন। হাত পায়ের সাড় ফিরতে লাগল পাক্কা চব্বিশ ঘণ্টা।”
●“সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা। আমরা জুহুতে ‘পিকু’ ছবির শ্যুটিং করছি। সেটে রয়েছে ইরফান খান, দীপিকা পাড়ুকোন এবং অমিতাভ বচ্চন। সকাল থেকে ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে মিটিং করে শটটা প্ল্যান করেছি। টাইম মতো শ্যুটিং শুরু।হঠাৎ শটের মাঝখানে দেখি উনি দীপিকাকে বলছেন, “দীপিকা ডু ইউ নো দিস অ্যাক্টর কলড্ রবি ঘোষ?”
প্রশ্নটা করে উনি ইরফানের দিকেও তাকালেন। দীপিকা, ইরফান কেউই রবি ঘোষকে চিনতেন না। তার পর বলতে শুরু করলেন, ভারতবর্ষে রবি ঘোষের থেকে বড় কমিক টাইমিং আর কোনও অ্যাক্টরের না কোনও দিন হয়েছে, না কোনও দিন হবে। যখন বলছেন তখন আমি, ক্যামেরাম্যান, দীপিকা, ইরফান শুধু হাঁ করে ওঁকে দেখছি আর কথাগুলো শুনছি।
আমি তো জানতামই না উনি এত সূক্ষ্মতার সঙ্গে রবি ঘোষের অভিনয় দেখেছেন। শুনতে শুনতে সে দিন ভাবছিলাম, এত ডিটেলে রবি ঘোষকে অ্যানালাইজ করা বোধহয় শুধু ওঁর পক্ষেই সম্ভব।” 
"..একমাত্র তিনিই বলতে পারেন , 'কী দাপট!' তাঁর বসার ঘরে থাকত শতাব্দীর অবিস্মরণীয় বিদুষক চার্লি চ্যাপলিনের ছবি। ছোট্ট মানুষ - যাঁর অস্তিত্ব বেমানান বলেই আমরা খানিকটা আশ্রয়স্হল খুঁজে পাই। মনে পড়ে , শেক্সপিয়ারের রাজা লিয়রের সেই অবিস্মরণীয় উচ্চারণ - 'Thou art the thing itself : unaccomodated man...' রবি ঘোষ ( ১৯৩১-১৯৯৭ ) সেই উদবৃত্ত মানুষ ...
"তিনি তো আমাদের কাছে কৌতুকাভিনেতাই। হাসি আসলে আমাদের জীবনে খানিকটা অতিরিক্ততা , যেন পানপাত্রের উপচে পড়া ফেনা। যা দেখতে ভালো লাগে , তবু যার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। অন্তত আমাদেরই অনেকের তাই ধারণা। অথচ ছবিতে হাসি অনিবার্যই। হলিউড থেকে টালিগঞ্জ - এই বিস্তৃত মানচিত্র জুড়ে নানা সময়ে শুধু কৌতুকোচ্ছটা। দুঃখ এই যে আমরা চার্লি চ্যাপলিনকে মনে রাখি , হয়তো বাস্টার কিটনকেও , কিন্তু আমাদের কখনোই মনে থাকে না - পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে আমাদেরও তুলসী চক্রবর্তী বা রবি ঘোষের মতো অভিনেতা ছিলেন , যাঁরা নায়ক-নায়িকার সাহায্য ছাড়াই , গান ও রঙিন দৃশ্য ছাড়াই , হাড়হিম করা মস্তানি ছাড়াই একটা আস্ত ছবি টেনে নিয়ে যেতে পারতেন ....

... মহানায়ক উত্তমকুমার তাঁর প্রতি এক নম্র শ্রদ্ধার্ঘ রেখেছেন - 'ওঁর পাশে অভিনয় করতে ভয় হয় , আমরা হয়তো জাঁকিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছি , আর রবি মাত্র কয়েক সেকেন্ড থেকে এমন একটা কিছু করবে যাতে ও গোটা দৃশ্যটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাবে - লোকে হেসে গড়িয়ে যাবে.." ....

.... রবি ঘোষের জীবন নির্দিষ্ট হয়ে গেলো পঞ্চাশ দশকের শুরুতে - যখন তিনি এল.টি.জি তে উৎপল দত্তের সান্নিধ্য পেলেন। উৎপল দত্তের দীক্ষা তিনি কোনোদিনই ভোলেননি। উৎপল দত্ত যদি তাঁকে অভিনয়ের চোখ দিয়ে থাকেন , সত্যজিত রায় তাঁকে দিয়েছিলেন শিল্পবোধের শিক্ষা...

.... রবি ঘোষ কারুর মতোই হননি। বাঙালী দর্শককে শুধু একটু মাঝে মাঝে জীবনের দিকে তাকানোর পরামর্শ দিয়ে গেছেন..."

অভিনয়ের এমনই পোকা ছিলেন যে বাড়ি থেকে তাঁকে বের পর্যন্ত করে দেওয়া হয়েছিল। তবে মায়ের সমর্থন ছিলো পুরোপুরি। তাই তিনি সামনে এগোতে পেরেছিলেন। ভাগ্যিস মায়ের সমর্থন ছিল নইলে বাংলা চলচ্চিত্র এত শক্তিশালী চরিত্র - অভিনেতা পেত না। মহড়া সেরে গভীর রাতে বাড়ি ফিরতেন , চুপি চুপি , যাতে বাবা টের না পান। জীবনের কী সমাপতন ! মঞ্চে অভিনয়ের ঠিক পাঁচদিন আগে বাবা চলে গেলেন। মায়ের কাছে বললেন ছেলে‚ তাঁর দলের অনেক দেনা-কর্জ। শো বাতিল হলে মুশকিল। কালাশৌচের মধ্যেই প্রথম মঞ্চাবির্ভাব। অভিনয়ের প্রতি এই নিখাদ নিবেদন বজায় ছিল জীবনের শেষদিন অবধি। তখন তিনি প্রতিষ্ঠিত। আচমকা মৃত্যু ছোট বোন তপতীর। তার কয়েক ঘণ্টা পরে মঞ্চে বেদম হাসির নাটক " কনে বিভ্রাট " দেখে কেউ আঁচও করতে পারেনি সদ্য বোনকে হারানো রবি ঘোষের মনের মধ্যে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে --- সে যেন ছিল নিজের সঙ্গে নিজের প্রতি হাস্যকর অভিনয় !  তিনি অভিনেতা নয়, কমেডিয়ান নয় বরং চরিত্রাভিনেতা হিসেবে নিজেকে সব সময় পরিচয় দিতেন। বলতেন যেকোনো চরিত্রই ফুটিয়ে তোলা একজন চরিত্রাভিনেতার কাজ।

তিনি তাঁর অভিনয়ের গুরু বলে মানতেন চার্লি চ্যাপলিনকে। যে চ্যাপলিন বলেছিলেন, “Actors search for rejection. If they don’t get it they reject themselves.” এখন আর কমেডিয়ানদের যুগ নেই। সারা বছরে হয়তো গুটিকয়েক কমেডি ছবি মুক্তি পায়। একটিও বক্স-অফিস সাফল্য নয়। অনেকবছর আগে অনীক দত্তের ‘ ভূতের ভবিষ্যৎ ’ রমরমিয়ে চলেছিল বটে। তাও হাতেগুনে ওই একটিই। এখনকার কমেডি বাংলা ছবি জোর করে কাতুকুতু দিয়ে লোক হাসায়। কিন্তু রবি ঘোষকে কেউ ভোলেনি। ‘দ্য রিয়্যাল হিরো’ - কে ভুলে যাওয়া সহজ নয়। শুধু বডি - বডি করে না কাটিয়ে পড়াশোনাও করেছেন নিজের মতো। তাঁর পড়াশোনা, বিশ্বের বিভিন্ন ছবি দেখা কত সমৃদ্ধ, সবকিছুই বোঝা যাবে রবি ঘোষের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার শুনলে বা পড়লে । ভাগ্যিস তিনি অভিনয়ে এলেন ! নাহলে এই ক্ষুদ্র জীবন নতুন দর্শনের ভ্রমণে ঘুরতে পারতেন না।

বিশ্বখ্যাত পরিচালক - অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন বলেছিলেন, “ To truly laugh, you must be able to take your pain, and play with it.” 
তারপর আরও বলেছিলেন, “ Life is a tragedy when seen in close-up, but a comedy in long-shot.” -- এই অমোঘ সমস্ত কথাগুলির সঙ্গে দৃশ্যত মানিয়ে যায় আমাদের প্রত্যেকের পছন্দের এক অভিনেতার নাম -- তিনি হলেন রবি ঘোষ ! পুরো নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষদস্তিদার। আক্ষরিক ও ব্যবহারিক দু দিক দিয়েই মধ্যবিত্ত বাঙালির পক্ষে খুব ভারী নাম। সংক্ষেপ করে নিয়েছিলেন। বাদ পড়েছিল ইন্দ্র‚ নাথ ও দস্তিদার। যেটুকু ছিল সেটুকু ছোট‚ উচ্চারণেও সুবিধে - ছোট হলেও সে নামের ওজন ও অভিঘাত দুইই বড় সাঙ্ঘাতিক । কয়েক দশক ধরে বাংলা ছবিতে সে নামের  ‘ কী দাপট ‘ !  জন্ম পূর্ববঙ্গে ১৯৩১-এর ২৪শে নভেম্বর। 

আপাদমস্তক দক্ষিণ কলকাতার মহিম হালদার স্ট্রিটের বাসিন্দা। পড়তেন ভবানীপুরের সাউথ সাবার্বান স্কুলে। তারপর আশুতোষ কলেজ। বিজ্ঞান শাখায় পড়ছেন। বাবার আশা‚ ভবিষ্যতে ভদ্রস্থ চাকরি বাঁধা। কিন্তু ছেলেও মন বন্ধক দিয়ে দিয়েছেন থিয়েটারের কাছে । সেই সময় মাস্‌ল ফুলিয়ে, ছাতি চওড়া করে সিনেমায় ‘হিরো’ হওয়ার চল ছিল না। সুন্দর মুখ আর শক্তিশালী অভিনয়েই প্রত্যেকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে নিজের জাত চেনাতেন। তিনি একলব্য হলে তাঁর দ্রোণাচার্য উৎপল দত্ত। কলেজে পড়তে পড়তে শরীরচর্চা করতেন। পাখির চোখ - মঞ্চে অভিনয়। 



‘গল্প হলেও সত্যি’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘অভিযান’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ ছবিগুলিতে একের পর চুটিয়ে অভিনয় করে নিজের জাত চিনিয়ে ছিলেন ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা রবি ঘোষ। নায়কোচিত চেহারা না হলেও সে যুগের বাংলা ছবির সমস্ত পরিচালকের প্রিয়পাত্র ছিলেন রবি। তাঁর হাত ধরেই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কত কত সফল অভিনেতা ও  অভিনেত্রী এসেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে ! ১৯৫৩ সালে কলকাতা ব্যাঙ্কশাল কোর্টে চাকরি শুরু করলেও ১৯৬১-তে সেই পাট চুকিয়ে পাকাপাকি ভাবে অভিনয়কেই পেশা হিসেবে বেছে নেন রবি ঘোষ। অভিনয়ের সঙ্গে এতটাই একাত্ম হতেন যে যখনই কোনো নতুন মুখের দরকার পড়েছে তখনই এগিয়ে এসেছেন। ‘আকাশ কুসুম’-এর জন্য মৃণাল সেনের কাছে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে, ‘মহানগর’এর জন্য জয়া ভাদুড়িকে, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’- র জন্য সত্যজিত রায়ের কাছে শমিত ভঞ্জ ও শুভেন্দুকে নিয়ে গিয়েছেন।

সিনেমা দেখেন কিন্তু রবি ঘোষকে পছন্দ করেন না - এমন তো হতেই পারে না। ‘ বাঘা বাইন ’ আসলে রবি ঘোষ বরিশালের বাঙাল , যদিও বড় হয়েছেন কলকাতায়। জীবনের বড় অংশ জুড়েই আছে তাঁর সিনেমার গুরু সত্যজিৎ রায়, নাটকের গুরু উৎপল দত্ত ও কমলকুমার মজুমদার। চকলেটের লোভ দেখিয়ে জয়া ভাদুরিকে নায়িকা হতে রাজি করিয়েছিলেন রবি ঘোষ। বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে বিশেষ প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তবে বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে তিনি সবচেয়ে পরিচিত তাঁর হাস্যরসাত্মক চরিত্র রূপায়নের জন্য। চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি বাংলা নাট্যমঞ্চ এবং টেলিভিশন তথা ছোট পর্দায় অভিনয় করেছেন। রবি ঘোষের অভিনয়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্যই ছিল হাস্যরসের মাধ্যমে সামাজিক রূঢ় বাস্তবিক ঘটনাগুলিকে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা। অভিনয়ের আন্তরিকতা ও সংবেদনশীলতা তাঁর প্রতিটি চরিত্রকে নতুন আঙ্গিকে হাজির করেছিল। আজীবন বাংলা ছবির ‘কমেডিয়ান’ তকমা পেলেও তিনি ছিলেন এক অসাধারণ চরিত্র অভিনেতা ! 

অথচ পর্দায় যতই তিনি একজন কমেডিয়ান অভিনেতা হোন না কেন, বাস্তবে ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত। যিনি সময় পেলেই 'রামকৃষ্ণ কথামৃত' পড়তেন। পরচর্চা পরনিন্দা একবারে না-পসন্দ। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন সাঙ্ঘাতিক সিরিয়াস। প্রথম স্ত্রী অভিনেত্রী অনুভা গুপ্ত প্রয়াত হয়েছিলেন ১৯৭২-এ। তার ১০ বছর পরে বিয়ে বৈশাখী দেবীকে। এক বন্ধুর বাড়িতে প্রথম আলাপ। প্রথম দর্শনে বৈশাখী দেবী নাকি খুব হেসেছিলেন তাঁকে দেখে। পরে নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন বৈশাখী দেবী। আলাপের মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে বিয়ে। যখনই মজার সংলাপ শোনার আব্দার করতেন উল্টোদিক থেকে জবাব আসতো - কেন ! আমি কি জোকার ?
বাইরের কেউ না থাকলে কাজের লোকেদের, ড্রাইভার গণেশকে বসিয়ে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ শোনাতেন। যে জন্য বহুবার বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন, জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত তাতেই নিবিষ্ট করেছিলেন, তার নাম ‘অভিনয়’। বরিশালের এ হেন কুলীন বাবুটি হলেন রবি ঘোষ।

পাঁচের দশকে (১৯৫০-’৫১) ‘সাংবাদিক’ নাটক দিয়ে পথ চলা শুরু। উৎপল দত্তের পরিচালনায় এই নাটকে মাত্র তিরিশ সেকেন্ডের অভিনয় দেখে সে দিন মৃণাল সেন বুঝেছিলেন রবি ঘোষ কত বড় অভিনেতা। সাউথ সাবারবান মেন স্কুলে পড়াকালীন নাটকের মহড়া দিতেন বন্ধুদের ছাদে। সহপাঠী অভিনেতা তরুণ চট্টোপাধ্যায় সঙ্গে থাকতেন। ভবানীপুর আশুতোষ কলেজের নৈশ বিভাগে বি কম- পড়ার পাশাপাশি নিয়মিত শরীরচর্চায় মন দেন। কলেজই বন্ধুত্ব হয় সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এঁরই পরামর্শে পৌঁছে যান উৎপল দত্তের নাটকের দল ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপে’। ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৫৯ — উৎপল দত্তের পরিচালনায় মিনার্ভা থিয়েটারে লিটল থিয়েটার গ্রুপ নিবেদিত ‘অঙ্গার’ নাটকের প্রথম শো। 
সেদিন থেকে শেষ শো পর্যন্ত অভিনয় করেছিলেন তিনি। এই নাটকের জন্য ‘উল্টোরথ’ পুরস্কার পান। নাছোড় অভিনেতা-পুত্রের অভিনয় দেখার দিন ঠিক করেছিলেন শেষ পর্যন্ত বাবা জীতেন্দ্রনাথ। কিন্তু বিখ্যাত ‘অঙ্গার’ নাটকে ছেলের অভিনয় আর দেখা হয়নি। ২৫ ডিসেম্বর মারা যান তিনি। ‘অঙ্গার’ নাটকে সনাতনের ভূমিকায় একজন ছোটোখাটো চেহারার মানুষ খনি থেকে উঠে উচ্চ স্বরে বলে উঠেছিলেন ‘ আমি একজন ভূতপূর্ব লোক ’ ‑ যাঁরা সেই কন্ঠস্বর শুনেছিলেন তাঁরা আজীবন ভুলতে পারেননি।
ওঁর জীবনের অন্যতম প্রেরণা ছিলেন স্ত্রী অনুভাদেবী। অনুভা যখন একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী, তখন রবি ঘোষ একজন স্ট্রাগলিং অভিনেতা। অথচ কী সুন্দর ভাবে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ‘অঙ্গার’ নাটকের অভিনয় দেখে পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ‘কিছুক্ষণ’ ও তপন সিংহ ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’র জন্য ডাকেন। আর থেমে থাকতে হয়নি। তপন সিংহ তো রবিকে শুধু কমেডিয়ান হিসাবে দেখতেন না, দেখতেন চরিত্রাভিনেতা হিসাবে। তাঁর কথায়, “গোটা ভারতবর্ষে রবির মতো অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্রাভিনেতা বাস্তবিক খুঁজে পাওয়া কঠিন। ” 
‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’র পরেই প্রস্তাব আসে সত্যজিত রায়ের ‘অভিযান’-এর জন্য।

‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’ ছবি করার সময় থেকে অনুভাদেবীর সঙ্গে সম্পর্কের শুরু। সেই সময় রবি ঘোষ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে অনুভাদেবীর সেবায় সুস্থ হয়ে ওঠেন। নানা টানাপোড়েনের মধ্যে বিয়ে করলেও ১৯৭২-এ স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন রবি ঘোষ। প্রায় বছর দেড়েক অভিনয় জগত থেকে সরে ছিলেন। ফিরে আসেন ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’- এর মাধ্যমে। এর এক দশক পরে, ১৯৮২-তে বৈশাখীদেবীকে বিয়ে করেন। ৪৭ নম্বর মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন গলফ গ্রিনের ফ্ল্যাটে।

সময়ের ব্যাপারে খুব পাংচুয়াল ছিলেন রবি ঘোষ। ‘ঠগিনী’ শ্যুটিং-এ একদিন নির্দিষ্ট সময় পার করে ফ্লোরে এলেন। লাঞ্চের সময় জানালেন, মাকে দাহ করে এলেন, তাই দেরি। কর্তব্যপরায়ণ, দিলখোলা, আড্ডাবাজ, খাদ্যরসিক, বহুমুখী প্রতিভাধর অভিনেতা ছিলেন রবি ঘোষ। শুধু তা-ই নয়, রবি ঘোষ ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। এখানে তাঁর সম্পর্কে তাপস সেনের মূল্যায়নটি মনে রাখার মতো। তাঁর কথায়, “ বহু মানুষের নানা সমস্যায় রবি যে সাহায্য করেছিল তা তাদের সূত্রেই জানতে পারি। শুধু বড় শিল্পী নয়, তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মানুষ। ” লোকে বলতো, ‘রবি ঘোষ মানেই একাই একশো’। পরিচালক তপন সিংহ তাই বলেছিলেন, “গোটা ভারতবর্ষে রবির মতো অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্রাভিনেতা বাস্তবিক খুঁজে পাওয়া কঠিন। রবি ঘোষকে আমি সেই অর্থে কখনও কমেডিয়ান হিসেবে দেখিনি।”
" ওই চেহারার চোখদুটোই কথা বলে ! " যেমনটি বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়।
রবির অভিনয় সম্পর্কে একটা খাঁটি কথা বলেছিলেন উত্তমকুমার : “ আমরা হয়তো জাঁকিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছি, আর রবি হয়তো কয়েক সেকেন্ড থেকে এমন একটা কিছু করবে যে ও গোটা দৃশ্যটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাবে, লোকে হেসে গড়িয়ে পড়বে ”। আর বলিউডের প্রখ্যাত পরিচালক হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন,“ সব অভিনেতা, সব শিল্পী সব সময় আমার কাছে একশোয় একশো পায় না।  রবি পেয়েছিল। ”   

ওপরের দুটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি একে একে তিনি সত্যজিৎ রায়ের অভিযান (১৯৬২), মহাপুরুষ (১৯৬৫), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০), হীরক রাজার দেশে (১৯৮০), গুপী বাঘা ফিরে এলো (১৯৯১), আগন্তুক (১৯৯১) প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন। তিনি ‘নিধিরাম সর্দার’ নামে একটি চলচ্চিত্রও পরিচালনা করেন। ১৯৭০ সালে তিনি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও অংশ নেন। গৌতম ঘোষ পরিচালিত বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘পদ্মা নদীর মাঝি’-তেও অভিনয় করেন রবি ঘোষ। 
এসবের বাইরে রবি ঘোষ অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হচ্ছে ‘বসন্ত বিলাপ’(১৯৭৩), 'পদি পিসির বার্মি বাক্স’ (১৯৭২), ‘ধন্যি মেয়ে’ (১৯৭১), ‘বালিকা বধূ’ (১৯৬৭), ‘কাল তুমি আলেয়া’(১৯৬৬),
‘স্বপ্ন নিয়ে’(১৯৬৬), ‘মোমের আলো’ (১৯৬৪), হাঁসুলীবাঁকের উপকথা (১৯৬২) প্রভৃতি। 
প্রায় অর্ধশত বছরের অভিনয় জীবনে তিনি প্রায় একশর মতো ছবিতে কাজ করেছেন।

‘অভিযান’-এ ট্যাক্সি ক্লিনার, ‘জন অরণ্য’- এ ‘মিস্টার মিত্র’, ‘গল্প হলেও সত্যি’- তে ধনঞ্জয়, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’- তে আমিনুদ্দিন, অরণ্যের দিন রাত্রি’- তে শেখর, ‘আগুন্তুক’- এ রঞ্জন, ‘অন্তর্জলী যাত্রা’- য় জ্যোতিষী বা 'ধন্যি মেয়ে' চলচ্চিত্রে পুরুত কাম রেফারি সহ  বহু চরিত্র মানুষের মনে এক উজ্বল উপস্থিতি ছিল তাঁর। ১৯৫৯-১৯৯৪ পর্যন্ত ২০৬টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। হিন্দিতে ‘সত্যকাম’, ‘সব সে বড়া সুখ’, ‘আজ কি রবিন হুড’, ‘পতঙ্গ’ ছবিতে। ১৯৫২-১৯৯৫ প্রায় ৩৯টি নাটকে অভিনয়। ‘শ্রীমতী ভয়ঙ্করী’ ১০০০ রজনী, ‘কনে বিভ্রাট’ ৬৩৫ রজনী, আজও ইতিহাস হয়ে গিয়েছে। চলচ্চিত্র-নাটক ছাড়াও যাত্রা আর দূরদর্শনে সমান গতিতে এগিয়ে গিয়েছিলেন রবি ঘোষ। তবে শুধু অভিনেতা হিসেবে নন, পরিচালক হিসেবে রেখে গিয়েছেন কিছু নিদর্শনও। উৎপল দত্তই একদিন বলেছিলেন, স্টেজ ম্যানেজারের পদ ছেড়ে এবার নাটক পরিচালনা করো।  
তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ পাঠক। তাঁর সেই পাঠকসত্তাই তাঁকে করেছিল লেখক। কলম ধরেছিলেন রবি। লিখেছিলেন দশটি কৌতুক নকশা। ১৯৯৭-এর বইমেলায় প্রকাশিত হল তাঁর ‘হাসতে যাদের মানা’। বইমেলার ইতিহাসে স্মরণীয় ১৯৯৭। সে বছরই বিধ্বংসী আগুনে মেলা পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। তিনদিনের মাথায় ফের শুরু হয়েছিল মেলা। কিন্তু সেই বইমেলা বাঙালির জীবনে আরও একটি বিষাদময় ঘটনার জন্য স্মরণীয়। তাঁর বই প্রকাশিত হল, আর তিনিও চলে গেলেন। মেলা চলাকালীনই ৪ ফেব্রুয়ারি হঠাৎই প্রয়াত হলেন রবি ঘোষ। তাঁকে হারিয়ে তাঁর সঙ্গী ‘গুপী গাইন’ তপেন চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “ শনিবার জুটি ছিলাম, রবিবার একা হয়ে গেলাম। ”

বিভিন্ন সম্মানে নিজের অভিনয়ের মাঠ আলো করে গিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রত্যেকের জন্য ময়দান খালি আছে। যে যার নিজের রুচি অনুযায়ী সৃষ্টি করতে পারবে, সে-ই দৌড়তে পারবে। রোম্যান্টিক ছিলেন না বিশেষ। খুব কেয়ারিং ও স্নেহপ্রবণ ছিলেন। নিজে কম কথা বলতেন। পছন্দ করতেন মৃদুভাষীদের। আর ছিলেন সাধারণ জীবনযাপনে আগ্রহী। বাড়িতে তিনি সম্পূর্ণ সংসারী। বলিষ্ঠ অভিনেতার ছায়া অবধি সেখানে নেই। জীবনের উপান্তে এসে ইচ্ছে ছিল অভিনয় করা ছেড়ে অভিনয় শেখাবেন। লিখবেন আত্মজীবনী। সে আর হল না একদিন সিরিয়ালের অভিনয় করতে করতে বললেন‚ " এটাই আমার শেষ শট ! এরপর বাড়ি যাব ! " সত্যি চলে গেলেন তিনি চিরতরে ! ১৯৯৭-এর ৪ ফেব্রুয়ারি‚ ৬৫ বছর বয়সে ! " এ যেন ধনঞ্জয়ের ইচ্ছাশক্তি ! যখন প্রয়োজন, আসব , নারকোলের মালা দিয়ে সমাজের শ্যাওলা তুলব ! 

বাঘা বায়েন হয়ে শুন্ডি রাজার প্রাসাদের ফোয়ারায় কলার খোসা ফেলে দেখিয়ে দিয়েছিলেন - আভিজাত্য বনাম মেঠো সুর। অভিযানে গাড়ি ছোটাবো। মহাপুরুষের কাপুরুষতা দেখাবো। মেমারি গেমে অতুল্য ঘোষের নাম বলব। বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে ফুটবল খেলাব। অরণ্যে মিশেও একজন হয়ে উঠব। তারপর কাজ শেষ হয়েছে মনে হলে চলেও যাব। তারপর‚ হলিউড টালিগঞ্জকে বলবে‚ তুমি চার্লি চ্যাপলিনকে চেনো ? উত্তরে টালিগঞ্জ হলিউডকে বলবে‚ আপনি রবি ঘোষকে চেনেন ? 

চ্যাপলিনের ভাবশিষ্য তুলসী চক্রবর্তী‚ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়‚ অনুপকুমার‚ কিংবা রবি ঘোষদের হলিউড - বলিউড স্বীকৃতি বা পদ্মশ্রী-ভূষণ-বিভূষণ দরকার হয়না, তাঁদের প্রতিভাই শতদলের মতো বিকশিত। তবে সারাজীবনে নানা পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন। "গুপী গাইন বাঘা বাইন" চলচ্চিত্রে অভিনয় করে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিলেন। 
এছাড়া তিনি BFJA ও আনন্দলোক পুরস্কার পেয়েছিলেন অভিনয় জীবনের জন্য ! 

আলোচনা

'নাটক আমার স্ত্রী, সিনেমা আমার ফিঁয়াসে’ ::
****************************************************
তাঁকে কমেডিয়ান বললে ভীষণ রেগে যেতেন। বলতেন— কমেডিয়ান বলে আলাদা কোনও সংজ্ঞায় আমার বিশ্বাস নেই, আমি এক জন চরিত্রাভিনেতা। কথাগুলি রবীন্দ্রনাথ ঘোষদস্তিদারের— চলচ্চিত্র, মঞ্চ, যাত্রা ও টিভি সিরিয়ালখ্যাত এক অভিনেতা। সংলাপের সাহায্যে নয়, শারীরিক ভাবভঙ্গি দিয়ে যে হাস্যরস তৈরি হয়, সেই ‘স্ল্যাপস্টিক’ অভিনয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন। তাঁকেই গুরু মেনে এই অভিনেতা অতবড় নাম ছেঁটেকেটে বাংলা অভিনয় জগতে এলেন রবি ঘোষ নামে। 

অভিনয় ছিল তাঁর মজ্জায় মজ্জায়। তাই কোনও বাধাই তাঁর সেই ‘প্যাশন’কে দমিয়ে রাখতে পারেনি। আর পেশাদারিত্ব? ঠিক সময়ে কাজের জায়গায় পৌঁছনো ছিল তাঁর স্বভাব। ‘ঠগিনী’ ছবি তৈরির সময় এক দিন বেশ দেরি হল ফ্লোরে পৌঁছতে। দুপুরের ব্রেকের আগে পর্যন্ত নির্বিঘ্নে কাজ শেষ হলে জানা গেল তিনি সেই সকালেই মা-কে দাহ করে এসেছেন। তাই দেরি। অনেক সময় গাড়ির চালক না এসে পৌঁছলে, ট্যাক্সি ধরে বেরিয়ে পড়তেন, জানালেন তাঁর স্ত্রী বৈশাখি ঘোষ। পরিচালক সন্দীপ রায় বলছেন, “কমেডিয়ান হিসেবে তাঁর খ্যাতি হলেও আদতে তিনি ছিলেন চরিত্রাভিনেতা।” আসলে রবি ঘোষ এমনই একটা নাম, বাঙালি যাঁকে এক জন কমপ্লিট অভিনেতা হিসেবেই চেনে।

পর্দায় অভিনেতা রবি ঘোষের যে রূপ দেখা যায়, ব্যক্তি হিসেবে একেবারেই তিনি তার বিপরীতের। একটি গুরুগম্ভীর মানুষ, যিনি সময় পেলেই রামকৃষ্ণ কথামৃত পড়ে সময় কাটাতেন। আর পড়তেন প্রবন্ধ-নাটকের নানা বই। প্রথম জীবনে কমিউনিজিমে দীক্ষিত হয়েও পরবর্তী কালে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ পড়তেন। সে অর্থে নিজে পূজার্চনা না করলেও, অন্যের বিশ্বাস-ভক্তিকে কখনও ছোট করেননি। মাঝে মধ্যে অবশ্য কৌতুকের ভঙ্গিমায় বলতেন— আমাকে রসেবশে রাখিস মা! পরচর্চা-পরনিন্দা করে সময় নষ্ট করতেন না, এমনকী খারাপ শব্দও ব্যবহার করতেন না কখনও। “তবে, ‘মাইরি’ শব্দটা প্রায় প্রতি ক্ষণেই বলে ফেলতেন রবিদা।”, বললেন তাঁর এক সময়ের প্রতিবেশী ও পরম বন্ধু-চিত্রগ্রাহক নিমাই ঘোষ।

আড্ডাবাজ, পরোপকারী মানুষটি খেতে ভালবাসলেও খুবই পরিমিত আহারে অভ্যস্ত ছিলেন। প্রিয় খাবার ছিল লুচি ও পাঁঠার মাংস। ভালবাসতেন লোককে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে। তবে, গোল বাঁধত যখন তা বাড়িতে জানাতে ভুলে যেতেন। সন্ধে বা রাতে বাড়িতে অতিথি এসে উপস্থিত হলে খুবই গম্ভীর হয়ে তাঁদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলতেন। সময়ে-অসময়ে এ ভাবেই অবস্থার সামাল দিতেন এই ‘মজার’ মানুষটি। বৈশাখিদেবীর সঙ্গে একমত সন্দীপ রায়। তিনি শোনালেন আরও একটি ছোট্ট ঘটনা, বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ দেখানো হবে। সেই সূত্রে রবিকাকার বিদেশ যাওয়া, প্রথম বার। এক দিন রবিকাকা ও তপেনকাকাকে নিয়ে শপিং-এ বেরিয়েছি। জার্মানদের চেহারা লম্বা-চওড়া হয়। সেখানে কোনও জামাকাপড় রবিকাকার ফিট করছে না। শেষে এক জার্মান মহিলা ছোটদের বিভাগে নিয়ে গিয়ে জামাকাপড় কিনিয়ে দেন। অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে রবিকাকা কেনাকাটা করে ফিরে আসেন। 

২৪শে নভেম্বর, ১৯৩১। কোচবিহারে মামাবাড়িতে জন্ম হয় রবি ঘোষের। বাবা জীতেন্দ্রনাথ ঘোষদস্তিদার আদতে ছিলেন পূর্ব বাংলার বরিশালের গাভার বাসিন্দা। চাকরিসূত্রে তিনি থাকতেন কলকাতার মহিম হালদার স্ট্রিটে। মা জ্যোৎস্নারানি ছিলেন কোচবিহারের সুনীতি অ্যাকাডেমির বৃত্তি পাওয়া ছাত্রী ও বড়মামা ছিলেন শচীনকর্তার প্রিয় ছাত্র। পাঁচ ভাইবোনের দ্বিতীয় ছিলেন রবি। বড় দিদি সবিতা এবং ছোট দীনেন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ ও তপতী।

পড়াশোনার শুরু কোচবিহার জেনকিন্স স্কুলে। পরে ১৯৪৭ সালে কলকাতার সাউথ সাবার্বান মেন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। স্কুলে তাঁর সহপাঠী ছিলেন উত্তমকুমারের ভাই অভিনেতা তরুণ চট্টোপাধ্যায়। ভবানীপুর আশুতোষ কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ১৯৪৯ সালে এবং এই কলেজেরই নৈশ বিভাগে বি কম-এ ভর্তি হন। নিয়মিত শরীরচর্চার শুরু কলেজের ব্যায়ামাগারেই। পরবর্তী কালে ‘জিম’ না গেলেও, মর্নিং ওয়াক এবং বাড়িতেই নিয়মিত ব্যায়াম করতেন তিনি, জানালেন স্ত্রী বৈশাখি ঘোষ।প্রথম স্ত্রী অনুভা গুপ্তর সঙ্গে সম্পর্কের শুরু 
হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’ ছবি করার সময়। সেই সময় হঠাত্ই অসুস্থ হয়ে পড়েন রবি ঘোষ। অনুভাদেবীর শুশ্রুষায় সুস্থ হয়ে ওঠেন। নানা টানাপোড়েনের পর তাঁরা বিয়ে করলেও, ১৯৭২ সালে অনুভাদেবীর অকাল মৃত্যুতে সেই সম্পর্ক দীর্ঘ হয়নি। এই ঘটনার এক দশক পর ১৯৮২ সালে রবি ঘোষ বিয়ে করেন বৈশাখিদেবীকে। তখন তিনি মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছেন গল্ফগ্রিনের ফ্ল্যাটে। 

৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭ জীবনাবসান হয় এই চরিত্রাভিনেতার।

অভিনয়কে সঙ্গে নিয়েই জন্মেছিলেন রবি ঘোষ। এবং তার বিকাশ ঘটে স্কুলে পড়াকালীনই। ছাত্রজীবনে ‘বন্ধুমন’ নামে একটি নাটকের দল গড়ে মহড়া দিতেন আশুতোষ কলেজের ছাদে। নাটকের জন্য বহু বার বাড়ি থেকে বিতাড়িত হতে হয়। অভিনয় করা তাঁর বাবা জীতেন্দ্রনাথ একেবারেই পছন্দ করতেন না। প্রায়ই স্ত্রী জ্যোৎস্নারানিকে বলতেন, “রবি অভিনয় কইরা সময় নষ্ট করে ক্যান? তোমার পোলারে কয়া দিও ওই চেহারায় অভিনয় হয় না। সে ছিল দুর্গাদাস বাঁড়ুজ্যে, হিরোর মতো চেহারা।” বাবা না হলেও, মা ও বড়মামার সমর্থন ছিল পুরোপুরি।

১৯৫৩ সালে কলকাতা পুলিশকোর্টে (ব্যাঙ্কশাল) চাকরি শুরু করলেও ১৯৬১ সালে সে সব পাট চুকিয়ে পাকাপাকি ভাবে অভিনয়কেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। অভিনয় জীবন শুরু পাঁচের দশকে ‘সাংবাদিক’ নাটক দিয়ে। পরিচালক উৎপল দত্ত। নাটকে রবি ঘোষের চরিত্র ছিল এক জন সংবাদপত্র বিক্রেতার, মঞ্চের এক দিক দিয়ে ঢুকে অন্য প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া ছিল তাঁর ভূমিকা। মাত্র তিরিশ সেকেন্ডের অভিনয় দেখে পরিচালক মৃনাল সেন সে দিনই বুঝেছিলেন তাঁর অভিনয় দক্ষতা। সোভিয়েত নাট্যকার সিমোনোভের লেখা ‘দ্য রাশিয়ান কোয়েশ্চেন’ অবলম্বনে নাটকটি অনুবাদ করেছিলেন সরোজ দত্ত। কলেজের বন্ধু, অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরামর্শেই উৎপল দত্তের নাটকের দল লিট্ল থিয়েটার গ্রুপ-এর সংস্পর্শে আসা।

৩১ ডিসেম্বর, ১৯৫৯ সাল। উৎপল দত্তের পরিচালনায় মিনার্ভা থিয়েটারে এলটিজি-র নিবেদিত ‘অঙ্গার’নাটকের প্রথম শো। এবং সে দিন থেকে নাটকের শেষ রজনী পর্যন্ত তাতে অভিনয় করেন রবি ঘোষ। ১৯৫৯ সালের উল্টোরথ (শ্রেষ্ঠ মঞ্চাভিনেতা) পুরস্কারও লাভ করেন অঙ্গারের জন্য। উল্লেখ্য, প্রথম শো-এর পাঁচ দিন আগে, ২৫ ডিসেম্বর পিতৃহারা হন রবি। কিন্তু ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ সরিয়ে রেখে অভিনয়ের ডাকেই সাড়া দিয়েছিলেন তিনি। এমনই ছিল তাঁর পেশাদারিত্ব। 

উৎপল দত্ত পরিচালিত নাটক বাদ দিলে কেবলমাত্র অভিনেতা-বন্ধু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘ঘটক বিদায়’ নাটকে অভিনয় করেন রবি ঘোষ। স্টার থিয়েটারে প্রায় ‘পাঁচশো নাইট’ নাটকটি চলে রমরমিয়ে। চলচ্চিত্রে অবশ্য সত্যজিৎ রায়, উৎপল দত্ত, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, তপন সিংহ, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, মৃণাল সেন, গুরু বাগচি, অজয় কর, তরুণ মজুমদার, দীনেন গুপ্ত, শেখর চট্টোপাধ্যায়, অসিত সেন, দিলীপ রায়, গৌতম ঘোষ, শিবু মিত্র, বিমল কর, সলিল সেন, সন্দীপ রায়, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, সুখেন দাস, রাজা মিত্র, অঞ্জন চৌধুরী-সহ বহু পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন।

‘অঙ্গার’ নাটকে রবিবাবুর অভিনয় দেখেই পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ‘কিছুক্ষণ’ ও তপন সিংহ ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’র জন্য তাঁকে ডাকেন। এর পরেই প্রস্তাব আসে সত্যজিৎ রায়ের ‘অভিযান’-এর জন্য। থিয়েটার থেকে চলচ্চিত্রে এলেও দু’টি মাধ্যমের তফাত মাথায় রেখে একটার পর একটা বাংলা ছবির চরিত্রাভিনেতা হয়ে ওঠেন রবি ঘোষ।

মঞ্চাভিনেতা থাকাকালীন নিজের একটি নাটকের দল ‘চলাচল’ গড়ে তোলেন। ঠগ, অলীকবাবু, ছায়ানট-সহ ৮টি নাটক প্রযোজনা করে সেই দল। লিট্ল থিয়েটার গ্রুপ-এ থাকাকালীন ‘নবসংস্করণ’ ও ‘শোধবোধ’ নামে দু’টি নাটকের পরিচালকের কাজ করেন রবিবাবু। ‘সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা’ ও ‘নিধিরাম সর্দার’ নামে দু’টি সিনেমা পরিচালনার কাজও করেছেন এই রবি ঘোষ।
কর্মসূচি:
• ১৯৫৯-১৯৯৪ পর্যন্ত প্রায় ২০৬টি চলচ্চিত্র।
• ১৯৫২-১৯৯৫ পর্যন্ত প্রায় ৩৯টি নাটক করেছিলেন। উল্লেখ্য শ্রীমতী ভয়ঙ্করী ১০০০ রজনী, (বিজন থিয়েটারে ৯০০ ও সুজাতা সদনে ১০০)। কনে বিভ্রাট ৬৩৫ রজনী, (সারকারিনায় ৫৩৫ ও সুজাতা সদনে ১০০), নব সংস্করণ, শোধবোধ, ঠগ, ধনপতি গ্রেফতার, অলীকবাবু, ছায়ানট ইত্যাদি। 
• হিন্দিতে অভিনয় করেন সত্যকাম, সব সে বড়া সুখ, আজ কি রবিনহুড, পতঙ্গ।
• ১৯৮৭-১৯৯৬ পর্যন্ত যাত্রা ৪টি। পাল্কি চলে রে (নট্ট কোম্পানি), বিয়ে পাগলা বুড়ো, লাট সাহেবের নাতজামাই, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল (মুক্তলোক)
• ১৯৮৬-১৯৯৮ পর্যন্ত দূরদর্শনে ধারাবাহিক গোয়েন্দা ভগবান দাস (রবি ওঝা), হুতোমের নকশা (তপন সিংহ), ফেলুদা ৩০ (সন্দীপ রায়), গোপাল ভাঁড় (দেব সিংহ), মনোরমা কেবিন (জগন্নাথ গুহ), মৃত্যুসাক্ষী (হিন্দি, আশিস মিত্র), নেপোলিয়নের বিয়ে (সুভাষ চট্টোপাধ্যায়), রিপোর্টার এক্স (সোমনাথ বিশ্বাস), দে রে ও মনোরমা কেবিন (যীশু দাশগুপ্ত) সহ প্রায় ১৪টিতে। (যেগুলির মধ্যে কিছু কিছু এখনও অসমাপ্ত রয়েছে)।

সম্মান:
• ‘অঙ্গার’ নাটকের জন্য উল্টোরথ (শ্রেষ্ঠ মঞ্চাভিনেতা) পুরস্কার লাভ ১৯৬০-এ।
• মরিশাস সরকারের আমন্ত্রণে ‘সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র উৎসবে’ যোগদান। বাংলা চলচ্চিত্র প্রচার সংসদ কর্তৃক ‘সাবাস পেটো পাঁচু’ নাটকের জন্য শ্রেষ্ঠ মঞ্চাভিনেতার পুরস্কার।
• ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর জন্য রাষ্ট্রপতি পুরস্কার
• ‘গুপীবাঘা ফিরে এল’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার বিএফজে পুরস্কার।
• ‘নয়নতারা’র জন্য আনন্দলোক পুরস্কার।
• লায়ন্স ক্লাব থেকে শ্রেষ্ঠ নাট্যপরিচালকের পুরস্কার ‘হীরালাল পান্নালাল’ নাটকের জন্য।

মূল্যায়ন:

• হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়— সব অভিনেতা, সব শিল্পী সব সময় আমার কাছে একশোয় একশো পায় না। রবি পেয়েছিল।
• তপন সিংহ— গোটা ভারতবর্ষে রবির মতো অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্রাভিনেতা বাস্তবিক খুঁজে পাওয়া কঠিন। রবি ঘোষকে আমি সেই অর্থে কখনও কমেডিয়ান হিসেবে দেখিনি। 
• সত্যজিৎ রায়— রবির চোখ দুটোই কথা বলে।
• উৎপল দত্ত— স্টেজ ম্যানেজারের পদ ছেড়ে এ বার নাটক পরিচালনা কর।
• তাপস সেন— বহু মানুষের নানা সমস্যায় রবি যে সাহায্য করেছিল তা তাদের সূত্রেই জানতে পারি। শুধু বড় শিল্পী নয়, একটি খাঁটি মানুষ।
• উত্তমকুমার— রবির পাশে অভিনয় করতে সব সময় ভয় লাগে। আমরা হয়তো জাঁকিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছি, আর রবি মাত্র কয়েক সেকেন্ড থেকে এমন একটা কিছু করবে যে ও গোটা দৃশ্যটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাবে, লোকে হেসে গড়িয়ে পড়বে। 
• তপেন চট্টোপাধ্যায়— একনিষ্ঠ পাঠক দশটি কৌতূক নকশা নিয়ে কলম ধরেছিলেন ‘হাসতে যাদের মানা’ বইটির জন্য। ১৯৯৭-এর বইমেলাতে প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে তপেন চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, দেখছি রবিদা বইমেলায় কাদা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিমায় হাঁটছেন। শনিবার বইমেলায় জুটি ছিলাম, মঙ্গলবার একা হয়ে গেলাম। 
• কমলকুমার মজুমদার— রবির অঙ্গভঙ্গি বেশ ভাল।, ভাল করে অভিনয় শেখার চেষ্টা করলে এক জন ভাল অভিনেতা হতে পারবে।

স্মরণীয়_কিছু_ঘটনা:
• ১৯৭০: গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবির মুখ্য চরিত্র হিসেবে সালে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ।
• ১৯৭২ নেতাজি ইনস্টিটিউটে সমরেশ বসুও র উপন্যাস ‘বিবর’ এর নাট্যরূপ মঞ্চস্থ করা ও পেশাদারি নাট্য-পরিচালকরূপে আত্মপ্রকাশ। 
• ১৯৮৭ তে যাত্রায় যোগদান ও নট্ট কোম্পানির পালা ‘পাল্কি চলে রে’
• ১৯৯৫ স্বজন নাট্যগোষ্ঠীর অতিথি শিল্পী হিসেবে আমেরিকা ও ইউরোপ ভ্রমণ। 
• ১৯৯৬ শেষ বারের মতো যাত্রায় যোগদান। মুক্তলোকের ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’।
স্মৃতিকথা

বৈশাখি ঘোষ (স্ত্রী):
সারা ক্ষণ হাসিখুশি মানুষটি আসলে খুবই গুরুগম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন। আমাকে আড্ডা মারতে দেখলে খালি বলতেন, বাড়িতে এত ভাল ভাল বই আছে পড়লেই তো পার। বিয়ের পরে আমাকে ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ দিয়েছিলেন। ছোটবেলা মামাবাড়ি কোচবিহারে কাটলেও পরে কলকাতায় চলে আসেন। আমি উত্তর কলকাতার বাদুড়বাগানের মেয়ে। নাটক দেখতে খুবই পছন্দ করতাম। বিজন থিয়েটারে শ্রীমতী ভয়ঙ্করী-তে ওঁর অভিনয় দেখেছিলাম। মানিকদা অথবা বাবু (সন্দীপ রায়) ছবি তৈরির সময় নিয়ে যেতেন। যাত্রায় যাওয়াটা আমার পছন্দের ছিল না। কিন্তু উনি মাটির মানুষগুলোর কাছে মিশে যেতে চেয়েছিলেন। অর্থকষ্ট ছিল না তবুও যাত্রাটা পেয়ে বসেছিল। প্রযোজকরা বাড়িতে পড়ে থাকতেন। এত ‘জার্নি’ সঙ্গে পরিশ্রম ওঁর রক্তের শর্করা বাড়িয়ে দিয়েছিল। খুব আমুদে আর আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন। জয়া ভাদুড়ির লোকাল গার্জেন ছিলেন। ওই পরিবারেরও উনি একজন হয়ে উঠেছিলেন। তবে বরিশালের কুলীন কায়স্থ বলে খুব দেমাক ছিল! তাই লোকজন নেমতন্ন করে বাড়িতে জানাতে ভুলে যেতেন। কিছু বললে উত্তর আসত ওরকম একটুআধটু হয়েই থাকে। ম্যানেজ করে নিতে হবে।

মৃণাল সেন (পরিচালক):
মনে পড়ছে সেই ঘটনাটা। আমারও তখন কম বয়েস। ‘সাংবাদিক’ নাটকে কয়েক সেকেন্ডের একটা চরিত্রে মঞ্চের এক প্রান্ত দিয়ে ঢুকে অপর প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে রবি ঘোষ। অসাধারণ এক টুকরো ছবি আমার মন দখল করে নেয়। আমি একটা পত্রিকায় এক প্যারা লিখেওছিলাম। আজ রবি নেই বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। কত যে স্মরণীয় ছবি ও করে গেল। 

মনোজ মিত্র (অভিনেতা):
রবিদা ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম সারির মধ্যে কত-তম, আমি ব্যক্তিগত ভাবে সেটা বলতে পারব না। কিন্তু তাঁর একটা বিশেষত্ব ছিল, একটা অনন্যতা ছিল। তাঁর অভিনয়ের জায়গা ছিল ওঁর চোখ। তিনি নিজেই ছিলেন একটা ‘রকম’। উত্তমকুমারকে যেমন দেখা যায়নি কোনও খারাপ চরিত্রে অভিনয় করতে, ঠিক তেমনই রবিদাকে দেখা যায়নি এমন কোনও ছবিতে অভিনয় করতে যেটা দর্শক নিতে পারেনি। আমরা ‘হুতোমের নকশা’য় মামা-ভাগ্নে চরিত্রে অভিনয় করছিলাম। আমি মামা প্রাণবল্লভ ও রবিদা ভাগ্নে রাধাভল্লব। ছবি তৈরির সময়ই চলে গেল। ‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এ আমরা একসঙ্গে অভিনয় করি। ‘জীবনপুরের পথিক’ ছবিতেও আমরা দু’জন ছিলাম। রবিদা কাজের লোক আর আমি এক বদমায়েশ বাবু। নানা স্তরের মানুষের স্বর অনায়াসে নিজের গলায় আনতে পারতেন। অত্যন্ত বড় মাপের অভিনেতা ছিলেন।

মাধবী মুখোপাধ্যায় (অভিনেতা):
রবি ঘোষ যখন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে চাকরি করতেন তখন ওখানেও থিয়েটার করতেন। তখন থেকেই আমার সঙ্গে পরিচয়। পরে উৎপল দত্তের দলে যোগ দেন ও খুবই সফল হয়েছিলেন। ছবিতে যখন এলেন, সেই অর্থে ‘নফর সংকীর্তন’ ওঁর প্রথম চলচ্চিত্র হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ছবিটির কাজ শেষ না হওয়ায় ওই ছবিটি আর ওঁর করা ছবির তালিকায় প্রথম হল না। ‘কাউকে বোলো না’ ছবিতে আমি ও রবি ঘোষ স্বামী-স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করি। বহু ছবিতে অভিনয় করেছি একসঙ্গে। অসাধারণ মাপের অভিনেতা ছিলেন। একসঙ্গে থিয়েটার করেছি ‘ঘটক বিদায়’-এ। স্টেজ পুড়ে যাওয়ার পরে যেখানেই করেছি সেখানেই হাউসফুল হয়েছে।

চিন্ময় রায় (অভিনেতা):
উৎপল দত্তের ‘অঙ্গার’ নাটকে প্রথম আলাপ। তার পরে আমরা যে ছবিটি এক সঙ্গে করি সেটি ‘গল্প হলেও সত্যি’। এটি আমার প্রথম ছবি ও ছোট্ট একটা চরিত্র। রবিদা বললেন, চেহারাটা রোগা হলেও অভিনয়টা ছাড়িস না। পারলে বিকেলে আমার বাড়িতে চলে আসিস। সেই যে রবিদার বাড়িতে ঢুকলাম, সম্পর্ক ছিল শেষ দিন পর্যন্ত। রবিদার কালীঘাটের বাড়িতে জমিয়ে আড্ডার সঙ্গে সত্যজিৎ রায় ও বিদেশি নানা ছবির গভীর আলোচনা হতো। রবিদা এমন এক জন কমেডিয়ান ছিলেন যিনি ব্যাকরণ সম্মত অভিনয় করতেন। এমন কোনও ছবি নেই যেখানে তাঁকে বাড়াবাড়ি করতে দেখা গিয়েছে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, অনুপকুমার ও রবিদা— যে ক’জন কমেডিয়ান এসেছেন, রবিদার আসাটা যেন আবির্ভাব হয়ে দাঁড়ায়। ‘সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা’ ছবিতে রবিদার সঙ্গে অভিনয় করে খুব খুশি হয়েছি। ‘অপরূপা’-সহ প্রায় ৮টি ছবিতে এক সঙ্গে অভিনয় করি। কিন্তু এমনই ভাগ্য যে রবিদা যাত্রায় চলে যাওয়ায় পরের দিকে ওঁর সঙ্গে আর ছবি করা হয়ে ওঠেনি।

সন্দীপ রায় (পরিচালক):
রবিকাকা এমন এক জন মানুষ, এমন এক জন অভিনেতা যিনি প্রায় আমাদের পরিবারের এক জন হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৬২ সাল থেকে আমাদের পরিবারের সঙ্গে ওঁর পরিচয়। বাবা প্রথম দেখেন উৎপল দত্তের নাটকে। উৎপল দত্ত পরিচালিত ‘মেঘ’ ছবিতে রবিকাকার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। তাই বাবা ওঁকে নেন ‘অভিযান’-এর এক অদ্ভুত চরিত্র রামা-য়, যা দর্শক কোনও দিন ভুলবেন না। বাবার বিভিন্ন ছবিতে রবিকাকা ফিরে ফিরে এসেছেন নানা চরিত্রে। অনেক ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রেও অভিনয় করেছেন, কিন্তু তার কী বিন্যাস! ব্যক্তিগত ভাবে ভীষণ ‘মিস’ করি। আর গুপী-বাঘা সিরিজে সত্যি কথা বলতে বাঘাও যেমন গুপীও তেমন। এঁরা যেন একে অন্যের পরিপূরক। মানুষ হিসেবে অত্যন্ত খাঁটি ছিলেন।

বীরেশ চট্টোপাধ্যায় (পরিচালক):
১৯৭২-এ মুম্বইতে হৃষীদার কাছে কাজ করতে গিয়ে দেখি একটি হিন্দি ছবির কাজ চলছে। তাতে কলকাতার দু’জন অভিনেতা রয়েছেন— কালী বন্দ্যোপাধ্যায় ও রবি ঘোষ। ছবির নাম ‘সব সে বড়া সুখ’। অসাধারণ সেই ছবি। কলকাতায় যখন সহ-পরিচালকের ভূমিকায় কাজ করেছি তখন রবিদার অভিনয় দেখেছি, কিন্তু তেমন ভাবে চিনতাম না। ‘অভিযান’ দেখার পরে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি। তখনই মনে হয়েছে ওই রকম দুর্ধর্ষ অভিনেতার সঙ্গে কাজ করতেই হবে। ‘মোহনার দিকে’ রবিদাকে নিয়ে আমার প্রথম কাজ। দীপঙ্কর ও রবিদার সঙ্গে যে সিকোয়েন্স ছিল সেটায় যে দক্ষতা দেখিয়েছিলেন রবিদা, আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম।

দীপঙ্কর দে (অভিনেতা):
অভিযান-এ মোষের পিঠের উপর দিয়ে লাফ দিয়ে চলে গেল! শুধু কমেডিয়ান বললে মস্ত বড় ভুল থেকে যাবে। তিনি এক জন টোটাল আর্টিস্ট। এবং এটা একশো শতাংশ ঠিক। আর গুপী গাইন বাঘা বাইন-এর কথাই আলাদা। তাঁর আন্তর্জাতিক মানের অভিনয় ক্ষমতা়, কণ্ঠস্বর ছিল অদ্ভূত। সুবর্ণগোলক, মোহনবাগানের মেয়ে, বাঞ্ছারামের বাগান-সহ নানা ছবিতে অভিনয় করার সময় বুঝেছিলাম ‘টাইমিং’ ব্যাপারটা কী? কত বড় ও বিচক্ষণ অভিনেতা ছিলেন তিনি। কথায় কথায় উদ্ধৃতি দিতেন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত থেকে। এমন নয় যে তিনি খুব ধার্মিক ছিলেন, পড়াশোনা করতেন খুব গভীর ভাবে। নানা বিষয়ে নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা চলত। ফ্লোরে বা আড্ডায় কারওর সঙ্গে অন্য কারওর কোনও ঝামেলা হলে রবিদা গাইতেন ‘এক দিন কিনে নেবে তাঁরে’, পরে বলতেন, ‘তোর আর কিছু করার নেই। শুয়ে পড় শুয়ে পড়।’ এত রসবোধ ছিল! তাঁর নিজের দুঃখকষ্টকে কোনও দিন কারওর সামনে প্রকাশ করেননি। বার বার বলতেন বই পড়ার কথা। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-র কথায় যে মন ভাল হয়ে যায় তা বলতেন সব সময়। বেশির ভাগ জায়গায় ভৃত্য, গাড়ির ক্লিনার, রান্নার ঠাকুর, দালাল, গরিব উকিল, নায়কের রকে বসা বন্ধু, কোথাও বা বাজনদার বাঘা— এক একটি চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন টুকরো টুকরো বাক্য দিয়ে অথবা শব্দের বদলে নীরব অভিব্যক্তি দিয়ে। চোখ দিয়েই উতরে দিয়েছেন কত ছবি। বহু পরিচালক ওই গুণটাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। পুরো ছবিতে নিজের সংলাপ বলতে কিছুই নেই। শুধু অন্য চরিত্র যে কথা বলবে নির্বাক হয়ে তা শোনা আর তার শেষ শব্দটা আবার বলা— এখানে সেন্স অফ টাইমিং আর ডাবল টেক একটা বড় ফ্যাক্টর। এই গুণটা গুরু উৎপল দত্তের কাছ থেকে রপ্ত করেছিলেন।

সন্ধ্যা রায় (অভিনেত্রী):
রবিবাবু অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ মানুষ ছিলেন। তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে সাবলীল ও সরল ভাবে মিশতেন। ওঁর পড়াশোনা ছিল গভীর। চলচ্চিত্র ছাড়া নাটক, যাত্রা নিয়ে চর্চা ছিল মনে রাখার মতো। কুহেলি-র একটা দৃশ্য মনে পড়ছে। এক ভৃত্য কাজ করতে আসত ভূতের বাড়িতে। সন্ধের আগে ফিরে যেতে হত। অথচ কাজের তাগিদে, পেটের তাগিদে তাকে রোজ আসতে হতো সেই দূর পাহাড়ের ধার থেকে। সততার মধ্যে দিয়ে জীবন-সংশয়ের যে অভিব্যক্তি তিনি তুলে ধরেছিলেন সেখানে রবিবাবু একেবারেই স্বতন্ত্র এক অভিনেতা। কাজের ফাঁকে যে সব আলোচনা হতো তাতে তিনি বহু সময় খেদ প্রকাশ করতেন। এই গরিব দেশে সে সুযোগই তো নেই যে এমন ছবি হবে যার মধ্যে দিয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অমর হয়ে থাকবে। যদি গুপী গাইন বাঘা বাইন না হতো, তা হলে আমরা তাঁর অ্যাক্টিং রেঞ্জ জানতে পারতাম না। তিনি যে বহুমুখী প্রতিভা সম্পন্ন এক অভিনেতা সেটা আমাদের চোখে ধরাই পড়ত না। কোনও ছোট চরিত্রকেই কোনও দিন অবহেলা করেননি রবিবাবু।

(সৌজন্যে: আনন্দবাজার পত্রিকা, উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য )
=================================