যাত্রামেব জয়তে জয় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়
জন্ম পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর থানার 'মূল' গ্রামে ২৫ নভেম্বর ১৯৩৪ এ । মূলগ্রামেই তিনি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তবে কিশোর বয়স থেকে বাংলার গ্রামে অনুষ্ঠিত যাত্রার প্রতি প্রেম ও নিষ্ঠা তাঁকে যাত্রাশিল্পে আকৃষ্ট করেছিল। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দেই কলকাতার চিৎপুরের যাত্রাপালা জগতে প্রবেশ করেন। দাম্পত্য জীবন ছায়া গঙ্গোপাধ্যায় এ সঙ্গে। সন্তান -মেঘদূত গঙ্গোপাধ্যায়ও দেবদূত গঙ্গোপাধ্যায়।
তাঁর রচিত প্রথম যাত্রাপালা "নাচমহল" মঞ্চস্থ করে 'সত্যম্বর অপেরা'। প্রথম লেখা যাত্রাপালাতেই তিনি দর্শকদের সমাদর পান। এরপর একে একে বহু যাত্রাপালা রচনা করেন। তার রচিত যাত্রাপালার সংখ্যা প্রায় আড়াই-শো। পালা রচনার পাশাপাশি তিনি নির্দেশনার কাজেও হাত দেন। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজের নামে দল "ভৈরব অপেরা" গঠন করে প্রযোজনাও করেছেন। দরদী মনের মানুষ ছিলেন তিনি। গরীব সাধারণ মানুষের কথা, অন্যায় অবিচার অত্যাচারের কথা তার পালা লেখনীতে ফুটে উঠেছে। ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় যেমন একাধারে পালাকার, নির্দেশক ও প্রযোজক ছিলেন তেমনই ছিলেন গীতিকার ও সুরকার। যাত্রাপালার গানেও যথেষ্ট দক্ষতা ছিল।
জনপ্রিয় উল্লেখযোগ্য পালাগুলি :
- 'একটি পয়সা'
- 'পদধ্বনি'
- 'অচল পয়সা'
- 'পাগলা গারদ'
- 'রক্তে ধোয়া ধান'
- 'মাতৃঋণ'
- 'সাত টাকার সন্তান'
- 'দেবী সুলতানা'
- 'শ্রীচরণেষু মা'
- 'গান্ধারী জননী'
- 'ভীষ্ম জননী গঙ্গা'
- 'মা মাটি মানুষ'
- 'ঠিকানা পশ্চিমবঙ্গ'
- 'কুবেরের পাশা'
- 'দু টুকরো মা'
- 'ভিখারি ঈশ্বর'
- 'ঘরে ঘরে দুর্গা'
- 'জীবন এক জংশন'
- 'শান্তি তুমি কোথায়'
- 'স্বর্গের পরের স্টেশন'
- 'সত্যযুগ আসছে'
ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় সারা জীবন নিজেকে যাত্রাশিল্পের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত রেখে শিল্পের উন্নতির জন্য কাজ করে গেছেন। গ্রাম বাংলার সমাদর কুড়িয়েছেন আর অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে সরকারি উদ্যোগে তার গ্রামের বাড়িতে আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলা যাত্রাজগতের জনপ্রিয় যাত্রাপালার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ২৮ শে ডিসেম্বর (১৪০৬ বঙ্গাব্দের ১২ পৌষ) প্রয়াত হন।
পারিবারিক সাক্ষাৎকার: এসময়ে যাত্রা পালা
ক্রমেই আকর্ষণ কমছে যাত্রাপালার। রবিবার বর্ধমানের কৃষ্ণপুর হাইস্কুলে অনুষ্ঠিত যাত্রাশিল্পী ও পালাকার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের ৮০তম জন্মদিবস পালন অনুষ্ঠানে এমনই আক্ষেপ করলেন তাঁর মেজো ছেলে দেবদূত গঙ্গোপাধ্যায়। এ দিনের অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল যাত্রা এবং যাত্রাশিল্পীদের নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থা ‘যাত্রা জগতের ঠিকঠিকানা।’ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন পালাকার জ্যোতির্ময় দে, শেখ মোসলেম, রমাপতি হাজরা, ইদবক্স। ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের মেজো ছেলে দেবদূত গঙ্গোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “এখন শিক্ষিত লোকেরা গ্রামেও আর যাত্রা দেখতে আসছেন না। ফলে দলগুলি আকারে সংকুচিত হচ্ছে। যেখানে আগে অন্তত ২০-২২ জন অভিনেতা-অভিনেত্রী থাকতেন এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০-১২ জনে।” তিনি আক্ষেপ করেন, আগেগ্রামের মানুষ যাত্রাকে যে টাকা দিতেন, এখন আর তা দিচ্ছেন না। এতে যে শুধু যাত্রা দলগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাই নয়, মেকআপম্যান থেকে আলোর কারবারিরাও শিল্পটিকে ছেড়ে গিয়েছেন পেটের তাগিদে। তাঁরা এখন চাষবাসে মনোযোগী হতে বাধ্য হচ্ছেন। দেবদূতবাবুর মতে, যাত্রাপালাগুলির জায়গা নিয়েছে টিভি সিরিয়াল। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে যাত্রা বলে আর কিছু এ রাজ্যে থাকবে না। আয়োজক সংস্থার সভাপতি ও সম্পাদক মানোয়ার হোসেন বলেন, “হারিয়ে যাওয়া যাত্রাপালার ইতিহাস ধরে রাখতে আমরা একটি সংকলন তৈরি করছি। এই সংকলনে রাখা হবে বিভিন্ন যাত্রাজগতের ব্যক্তিত্বদের কথা। অতীতের শিল্পী শান্তিগোপাল, ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রকুমার দে, শেখর গঙ্গোপোধ্যায়, পান্না চক্রবর্তী, স্বপনকুমার, তরুণকুমার, তপনকুমার, রাখাল সিংহদের মত অভিনেতাদের সঙ্গে যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁদের লেখা ও সাক্ষাৎকার।”
==================================
আলোচনা :
মা সরস্বতীর মানস পুত্র পালাকার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়
গীতিকার অজয় আচার্য্য
বাংলার জীবন যাত্রা। আর যাত্রাকে যিনি বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি সরস্বতীর বর পুত্র পালাকার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়। আজও বঙ্গবাসী তাঁকে সমানভাবে শ্রদ্ধা জানায় নত মস্তকে। ১৩৪১ বঙ্গাব্দে বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বর থানার "মূল" গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই কালজয়ী পালাকার। আমাদের বরাহনগরে "অমৃত বিন্দু" ওনার বাসগৃহ। এখানে বর্তমানে ওনার সংগ্রহশালা করেছেন ওনার সুযোগ্য পুত্র পালাকার মেঘদূত গঙ্গোপাধ্যায়।।
কিশোর বয়স থেকে যাত্রার প্রতি প্রেম ও নিষ্ঠা ওনাকে এতো বড়ো পালাকার তৈরী করেছে। ভৈরব বাবুর লেখা প্রথম যাত্রাপালা "নাচ মহল"। এরপর একে-একে বহু উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালা রচনা করেন। ভৈরব বাবুর লেখা উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালাগুলো হলো-----
"একটি পয়সা", "পদধ্বণী", " অচল পয়সা", "সাত টাকার সন্তান", "গান্ধারী জননী ", "দেবী সুলতানা", "ঠিকানা পশ্চিমবঙ্গ", "পুত্র বধূঁর সিঁদুর চুরি", "বৌ হয়েছে রঙের বিবি", "স্বামী আগে না সিঁদুর আগে", "অগ্নিসাক্ষী সিঁদুর", " স্বর্গের পরের স্টেশন", "ভীষ্ম জননী গঙ্গা" এবং "পালকি ভাঙা বৌ" ইত্যাদি। এছাড়া আরো বহু উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালা রচনা করেছেন তিনি। আর এইসব পালাতে বিখ্যাত বরণীয় শিল্পীরা অভিনয় করেছিলেন।।
দরদী মনের মানুষ ছিলেন ভৈরব বাবু। আর গরীব সাধারণ মানুষের কথা বারেবারে ফিরে এসেছে ওনার লেখনীতে। যেখানেই অন্যায় - অবিচার-অত্যাচার দেখেছেন সেখানেই প্রতিবাদে ঝলসে উঠেছে তাঁর কলম। মসী ধরা দিয়েছে খাপ খোলা অসি রূপে।।
উনি শুধু পালাকারই ছিলেন না। উনি ছিলেন একাধারে পালাকার,নির্দেশক, গীতিকার ও সুরকার। গানের ব্যাপারে ওনার যথেষ্ঠ দক্ষতা ছিলো। মা সরস্বতীর বর পুত্র ভৈরব বাবুর লেখা দুটো পালায় আমার অভিনয় করার সুযোগ হয়েছিল। পালাদুটো হলো-- "স্বর্গের পরের স্টেশন" এবং "পুত্র বঁধূর সিঁদুর চুরি"।।
এমন দরদী মনের মরমী পালাকার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় ১৪০৬ বঙ্গাব্দের ১২ই পৌষ (ইংরাজী 28 ডিসেম্বর,1998) দেহত্যাগ করেন।।
উনি যাত্রার রস পিপাসু যাত্রা পাগল মানুষদের জন্য যে অমৃত কুম্ভ রেখে গেছেন,তার অমৃত পান করে আজও মানব হৃদয় হচ্ছে ধন্য। পৃথিবীতে যতদিন বাঙালী ও তার যাত্রাগান বেঁচে থাকবে ততদিনই অমর হয়ে থাকবে ওনার নাম। হৃদয়ের শ্রদ্ধাঞ্জলী অর্পণ করি প্রয়াত পালাকার সরস্বতীর মানস পুত্র ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়ের রাতুল চরণে।।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার::---ভৈরববাবুর সুযোগ্য পুত্র পালাকার মেঘদূত গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়ের করে কমলে ।
###############################
No comments:
Post a Comment