"বঙ্গবাসী মুসলমানদের দেশভাষা বা মাতৃভাষা “বাঙ্গালা”। মাতৃভাষায় যাহার আস্থা নাই, সে মানুষ নহে। বিশেষ সাংসারিক কাজকর্ম্মে মাতৃভাষারই সম্পূর্ণ অধিকার। মাতৃভাষায় অবহেলা করিয়া অন্য দুই ভাষায় বিখ্যাত পণ্ডিত হইলেও তাহার প্রতিপত্তি নাই। পরিবার, আত্মীয়স্বজন, এমনকি প্রাণের প্রাণ যে স্ত্রী, তাহার নিকটেও আদর নাই। অসুবিধাও বিস্তর। ইস্তক ঘরকন্নার কার্য্য নাগাদে রাজসংশ্রবী যাবতীয় কার্য্যে বঙ্গবাসী মুসলমানদের বাঙ্গালা ভাষার প্রয়োজন।
— মীর মশাররফ হোসেন ("আমাদের শিক্ষা" নামক প্রবন্ধ)
ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক। ১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার লাহিনীপাড়ায় তার জম্ন। পিতা মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন জমিদার। নিজ বাড়িতে মুনশির নিকট আরবি ও ফারসি শেখার মাধ্যমে তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি।পরে পাঠশালায় গিয়ে তিনি বাংলা ভাষা শেখেন। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় কুষ্টিয়া স্কুলে। পরে তিনি কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করে কলকাতার কালীঘাট স্কুলে ভর্তি হন; কিন্তু লেখাপড়া আর বেশি দূর অগ্রসর হয়নি। কর্মজীবনের শুরুতে মশাররফ হোসেন পিতার জমিদারি দেখাশুনা করেন।
পরে তিনি ফরিদপুর নবাব এস্টেটে চাকরি নেন এবং ১৮৮৫ সালে দেলদুয়ার এস্টেটের ব্যবস্থাপক হন। এক সময় এ চাকরি ছেড়ে তিনি লাহিনীপাড়ায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং পরে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় গিয়ে ১৯০৩-০৯ পর্যন্ত অবস্থান করেন।
তিনি প্রথম জীবনে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ (১৮৬৩) ও কবি ঈশ্বরগুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ (১৮৩১) পতিকায় টুকিটাকি সংবাদ প্রেরণ করতেন। এই সুবাদে কাঙাল হরিনাথের সঙ্গে তার হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল যা আমৃত্যু বহাল থাকে।
এ কারণেই তাকে কাঙাল হরিনাথের সাহিত্যশিষ্য বলা হয়। ১৮৯০ সালে তিনি পুনরায় লাহিনীপাড়া থেকে ‘হিতকরী’ নামে একখানি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এ পত্রিকার কোথাও সম্পাদকের নাম ছিল না। ‘হিতকরীর’ কয়েকটি সংখ্যা টাঙ্গাইল থেকেও প্রকাশিত হয়েছিল। এ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন কুষ্টিয়ার বিখ্যাত উকিল রাইচরণ দাস।
সাংবাদিকতা তার জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। আর এ কারণে তিনি সৃজনশীল লেখালেখিতে মনোযোগ দেন।
মশাররফ আজিজননেহার (১৮৭৪) ও হিতকরী (১৮৯০) নামে দুটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। মীর মোশাররফ ছিলেন বঙ্কিমযুগের অন্যতম প্রধান গদ্যশিল্পী ও উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের পথিকৃৎ। তিনি তার বহুমুখী প্রতিভার মাধ্যমে উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, কাব্য ও প্রবন্ধ রচনা করে আধুনিক যুগে মুসলিম রচিত বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধ ধারার প্রবর্তন করেন। সাহিত্যরস সমৃদ্ধ গ্রন্থ রচনায় তিনি বিশেষ কৃতিত্ব দেখান। কারবালার বিষাদময় ঘটনা নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’ তার শ্রেষ্ঠ রচনা। তার সৃষ্টিকর্ম বাংলার মুসলমান সমাজে আধুনিক সাহিত্য ধারার সূচনা করে। মুসলিম সাহিত্যিকদের পথিকৃৎ মীর মশাররফ হোসেন বিশুদ্ধ বাংলায় অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করে আরবি-ফারসি মিশ্রিত তথাকথিত মুসলমানী বাংলা ভাষা পরিত্যাগ করেছিলেন। তার ‘বিষাদ সিন্ধু’ বাংলার মুসলমান সমাজে ধর্মগ্রন্থের মতো শ্রদ্ধার সঙ্গে আজও পঠিত হয়। কারবালার করুণ ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে রচিত এই উপন্যাসখানি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। তার অপর গ্রন্থগুলো বাদ দিলেও মাত্র এই একখানি গ্রন্থ রচনার জন্য তাকে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখক আখ্যায়িত করা যায়।
বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫) উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার চার বছর পর মশাররফের প্রথম উপন্যাস রত্নবতী (১৮৬৯) প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি একে একে কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, আত্মজীবনী, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেন। মীর মশাররফ হোসেনের মোট ৩৬টি বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়; তার রচনা হলো : গোরাই-ব্রিজ অথবা গৌরী-সেতু (১৮৭৩), বসন্তকুমারী নাটক (১৮৭৩), জমিদার দর্পণ (১৮৭৩), এর উপায় কি (১৮৭৫), বিষাদ-সিন্ধু (১৮৮৫-১৮৯১), সঙ্গীত লহরী (১৮৮৭), গো-জীবন (১৮৮৯), বেহুলা গীতাভিনয় (১৮৯৮), উদাসীন পথিকের মনের কথা (১৮৯০), তহমিনা (১৮৯৭), টালা অভিনয় (১৮৯৭), নিয়তি কি অবনতি (১৮৮৯), গাজী মিয়ার বস্তানী (১৮৯৯), মৌলুদ শরীফ (১৯০৩), মুসলমানদের বাঙ্গালা শিক্ষা (দুই ভাগ ১৯০৩, ১৯০৮), বিবি খোদেজার বিবাহ (১৯০৫), হজরত ওমরেরধর্মজীবন লাভ (১৯০৫), মদিনার গৌরব (১৯০৬), বাজীমাৎ (১৯০৮), আমার জীবনী (১৯০৮-১৯১০), আমার জীবনীর জীবনী বিবি কুলসুম (১৯১০) ইত্যাদি। তার অমর কীর্তি বিষাদ সিন্ধু উপন্যাসে কারবালার বিষাদময় ঐতিহাসিক কাহিনী বিবৃত হয়েছে। তবে অনেক ঘটনা ও চরিত্র সৃষ্টিতে উপন্যাসসুলভ কল্পনার আশ্রয়ও নেওয়া হয়েছে। তার জমিদার দর্পণ নাটকটি ১৮৭২-৭৩ সালে সিরাজগঞ্জে সংঘটিত কৃষক-বিদ্রোহের পটভ‚মিকায় রচিত। তার গতিশীল গদ্য রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। নাটক ও আত্মজৈবনিক উপন্যাসগুলোতে তিনি সমকালীন সমাজের অসঙ্গতি ও সমস্যার ওপর তীক্ষ কটাক্ষপাত করেন। তিনি সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে মুক্ত ছিলেন। উদার দৃষ্টিকোণ থেকে ‘গোকুল নির্মূল আশঙ্কা’ প্রবন্ধ লিখে তিনি স্বসমাজ কর্তৃক নিগৃহীত হন। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
১৮৮৯ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয় তার লেখা প্রবন্ধ গো-জীবন। গো-জীবনের লেখক মূলত উপমহাদেশে গোরু কোরবানি নিয়ে হিন্দু মুসলমানের যে দ্বান্দ্বিক অবস্থান, তার ব্যাপারে মন্তব্য রাখেন নিজের। তাঁর মত ছিল, গোরু কুরবানির বদলে অন্য কিছু ( যেমনঃ ছাগল) কুরবানি দেওয়ার।
"খাদ্য সম্বন্ধে বিধি আছে যে খাওয়া যাইতে পারে-খাইতেই হইবে, গো-মাংস না খাইলে মোসলমান থাকিবে না, মহাপাপী হইয়া নরকযন্ত্রণা ভোগ করিতে হইছে….একথা কোথাও লিখা নাই।"
"এই বঙ্গরাজ্যে হিন্দু-মোসলমান উভয় জাতিই প্রধান। পরস্পর এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যে, ধর্ম ভিন্ন, কিন্তু মর্মে ও কর্মে এক-সংসার কার্যে, ভাই না বলিয়া আর থাকিতে পারি না। আপদে, বিপদে, সুখে দুঃখে, সম্পদে পরস্পরের সাহায্য ভিন্ন উদ্ধার নাই। সুখ নাই, শেষ নাই, রক্ষার উপায় নাই।..এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যাহাদের সঙ্গে, এমন চিরসঙ্গী যাহারা, তাহাদের মনে ব্যথা দিয়া লাভ কী?"
"আরবে কেহই গরু কোরবানি করে না। ধর্মের গতি বড় চমৎকার। পাহাড় পর্বত, মরুভূমি সমুদ্র, নদ-নদী ছাড়াইয়া মোসলমান ধর্ম ভারতে আসিয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে কোরবানি আসিয়াছে। এদেশে দোম্বা নাই-দোম্বার পরিবর্তে ছাগ, উঠের পরিবর্তে গো, এই হইল শাস্ত্রকারদিগের ব্যবস্থা।"
"গরু কোরবানি না হইয়া ছাগলও কোরবানি হইতে পারে। তাহাতেও ধর্ম রক্ষা হয়।"
এই প্রবন্ধ লেখার পর মীর মোশারাফ হোসেন প্রবল নিন্দার সম্মুখীন হন। তাঁর নামে ফতোয়া জারি হয়। ধর্মসভা ডেকে তাঁকে কাফের এবং তাঁর স্ত্রীকে হারাম জারি করা হয়। তাঁকে বলা হয় 'তওবা' করতে।
ক্ষুব্ধ লেখক প্রথমে একটি মামলা দায়ের করলেও পরে ব্যাপারটি আপসে মিটিয়ে নেন। কিন্তু গো-জীবন এর পরবর্তীকালে আর ছাপা হয়নি.
মাত্র আঠার বছর বয়সে তার পিতৃবন্ধুর কন্যা আজিজুন্নেসার সঙ্গে বিয়ে হয়। প্রথম স্ত্রী আজিজুন্নেসার গর্ভে কোনো সন্তান জম্নগ্রহণ করেনি। তার পাঁচটি পুত্র ও ছয়টি কন্যা সবাই বিবি কুলসুমের গর্ভজাত।
১৯১২ সালের ১৯ ডিসেম্বর নিজ বাড়ি রাজবাড়ী জেলার পদমদী গ্রামে মীর মশাররফ হোসেন মারা গেলে বিবি লসুমের কবরের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়।
গ্রন্থের তালিকাঃ-
জমীদার দপর্ন নাটক ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দ
বিষাদ সিন্ধু উপন্যাস ১৮৮৫-৯১ খ্রীষ্টাব্দ
বিবি খোদেজার বিবাহ কাব্যগ্রন্থ ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দ
হজরত ওমরের ধর্ম জীবন লাভ কাব্যগ্রন্থ ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দ
গাজী মিয়ার গুলি রসরচনা ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দ
হজরত আমীর হামজার ধর্ম জীবন লাভ কাব্যগ্রন্থ ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দ
হজরত বেলালের জীবনী কাব্যগ্রন্থ ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দ
মুসলমানের বাঙ্গালা শিক্ষা ১ম ভাগের ১ম অংশ পাঠ্য পুস্তক ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দ
মদিনার গৌরব কাব্যগ্রন্থ ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দ
মোসলেম বীরত্ব কাব্যগ্রন্থ ১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দ
মুসলমানের বাঙ্গালা শিক্ষা ২য় ভাগ পাঠ্য পুস্তক ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দ
এসলামের জয় প্রবন্ধোপন্যাস ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দ
হজরত ইউসোফ গল্পগ্রন্থ ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দ
আমার জীবনী আত্মজীবনী ১৯০৮-১৯১০ খ্রীষ্টাব্দ
ঈদের খোতবা গদ্যরচনা ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দ
বিবি কুলসুম বা আমার জীবনী কুলসুম জীবনী জীবনীমূলক রচনা ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দ
বৃহৎ হীরক খনি শিশুপাঠ্য গ্রন্থ ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দ
রত্নবতী রুপকথা ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দ
গোরাই ব্রীজ বা গৌরী সেতু কাব্যগ্রন্থ ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দ
বসন্ত কুমারী নাটক ১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দ
এর উপায় কি প্রহসন ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দ
সঙ্গীত লহরী প্রথম খন্ড গীতিকবিতার সংকরন ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দ
গো-জবীন প্রবন্ধ ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দ
বেহুলা গীতাভিনয় যাত্রা নাটক ১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দ
উদাসীন পথিকের মনের কথা আত্নজৈবনিক উপন্যাস ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দ
তহমিনা উপন্যাস ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দ
টালা অভিয়ন প্রসহন ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দ
নিয়তি কি অবনতি উপন্যাস ১৮৯৮-১৮৯৯খ্রীষ্টাব্দ
পঞ্চনারী পদ্য কাব্য গ্রস্থ ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দ
বাজীমাৎ নকসা জাতীয় কাব্য ১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দ
গাজী মিয়ার বস্তানী নক্সা ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দ
ফাঁস কাগজ প্রহসন ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দ
বাঁধাখাতা প্রহসন ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দ
ভাই ভাই এই তো চাই প্রসহন ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দ
একি প্রহসন ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দ
প্রেম পরিজাত গদ্য রচনা ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দ
রাজিয়া খাতুন উপন্যাস ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দ
মৌলুদ শরীফ ধমোর্পদেশ মূলক গদ্যে পদ্যে রচিত গ্রন্থ ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দ উপদেশ কাব্যগ্রন্থ
No comments:
Post a Comment