সুরদাস (১৪৭৮-১৫৮৩)
জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কিত তথ্য এখনো রহস্যময়।মধ্যযুগীয় ভক্তিবাদী সন্তকবি। তিনি হিন্দি ভাষায় গান রচনা করতেন। তবে তিনি দিল্লির নিকটবর্তী সিরি নামক এক গ্রামে ১৪৭৮ সালে ৯ ই ডিসেম্বর এক সারস্বত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন (আনুমানিক)। তিনি ছিলেন জন্মান্ধ। অতি অল্পবয়সেই ঈশ্বরদর্শনের আকাঙ্ক্ষায় তিনি গৃহত্যাগ করে তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন। আঠারো বছর বয়সে তিনি মথুরার বিক্রমঘাটে উপস্থিত হন। এরপর তিনি মথুরা ও আগ্রার মধ্যবর্তী গৌঘাটে যমুনার তীরে চলে আসেন। সেখানে ১৫০৯-১০ সাল নাগাদ তার সঙ্গে বৈষ্ণব ধর্মগুরু বল্লভাচার্যের সাক্ষাৎ হয়।তিনি বল্লভাচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এরপর তিনি ব্রজ অঞ্চলের চন্দ্রসরোবরের নিকট পারসৌলী গ্রামে বসবাস শুরু করেন। মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গেও তার সাক্ষাৎ ঘটেছিল।পারসৌলী গ্রামেই তার জীবনাবসান ঘটে।
সুরদাসের শিক্ষা সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না।তিনি পদরচনা ও সংগীত বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। গ্রাম থেকে চার ক্রোশ দূরে বাস করে নির্জনে পদরচনা করতেন।ভক্তেরা তার রচিত পদ শোনার জন্য একত্রিত হত। তার প্রথম জীবনের পদগুলি ছিল বিনয় ও দীনভাবাশ্রিত।বল্লভাচার্যের সংস্পর্শে আসার পর থেকে তিনি এই জাতীয় পদ রচনা বন্ধ করে সখ্য, বাল্য ও মধুরভাবের পদ রচনা শুরু করেন।
ড. দীনদয়াল গুপ্ত সুরদাস রচিত পঁচিশটি গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে -
সুরসাগর, সুরসারাবলী, সাহিত্য-লহরী, সুরপচীসী, সুররামায়ণ, সুরসাঠী ও রাধারসকেলি বর্তমানে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। ভাগবত পুরাণ-এর অনুকরণে বারোটি স্কন্দে রচিত সুরসাগর ও দৃষ্টিকূট পদাবলি (প্রহেলিকা পদাবলি) সংগ্রহ সাহিত্য-লহরী তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি।অনেক গবেষক সুরসারাবলী গ্রন্থটিকে অপ্রামাণিক মনে করেন।
সুরদাসের কাব্যের প্রধান বিষয় কৃষ্ণভক্তি। সুরদাস কথিত ভক্তিমার্গটি হল "পুষ্টিমার্গীয় ভক্তি"। সুরদাসের মতে, ভগবানের নাম করাই পোষণ। এই ভক্তির দুই রূপ - সাধন ও সাধ্য। সাধ্যরূপে ভক্ত সবকিছু বিসর্জন দিয়ে ভগবানের শরণ নেয় এবং ভগবান স্বয়ং ভক্তের ভার গ্রহণ করেন।ভক্তির দার্শনিক দিকটিও সুরদাসের কাব্যে প্রস্ফুটিত হয়েছে।
গান দেবনাগরী লিপি বাংলা লিপি
प्रभू मोरे अवगुण चित न धरो ।
समदरसी है नाम तिहारो चाहे तो पार करो ॥
एक लोहा पूजा में राखत एक घर बधिक परो ।
पारस गुण अवगुण नहिं चितवत कंचन करत खरो ॥
एक नदिया एक नाल कहावत मैलो ही नीर भरो ।
जब दौ मिलकर एक बरन भई सुरसरी नाम परो ॥
एक जीव एक ब्रह्म कहावे सूर श्याम झगरो ।
अब की बेर मोंहे पार उतारो नहिं पन जात टरो ॥
প্রভু মোরে অবগুণ চিত ন ধরো।
সমদরসী হ্যায় নাম তিহারো চাহে তো পার করো॥
এক লোহা পূজা মেঁ রাখত এক ঘর বধিক পরো।
পারস গুণ অবগুণ নহি চিতওয়াত কঞ্চন করত খরো॥
এক নদীয়া এক নাল কহাওয়াত মৈলোঁ হি নীর ভরো।
জব দো মিলকর এক বরন ভই সুরসরী নাম পরো॥
এক জীব এক ব্রহ্ম কহাওয়ে সুর শ্যাম ঝগরো।
আব কি বের মাঁহে পার উতারো নাহি পন জাত টরো॥
দেবনাগরী লিপি বাংলা লিপি
अखियाँ हरि दर्शन की प्यासी ।
देखो चाहत कमल नयन को, निस दिन रहत उदासी ॥
केसर तिलक मोतिन की माला, वृंदावन के वासी ।
नेहा लगाए त्यागी गये तृण सम, डारि गये गल फाँसी ॥
काहु के मन की कोऊ का जाने, लोगन के मन हाँसी ।
सूरदास प्रभु तुम्हरे दरस बिन लेहों करवत कासी ॥
অখিয়া হরি দর্শন কী পিয়াসী।
দেখো চাহাত কমল নয়ন কো, নিশী দিন রহত উদাসী॥
কেসর তীলক মোতিন কী মালা, বৃন্দাবন কী বাসী।
নেহা লগায়ে ত্যাগী গয়ে তৃণ সম, দারি গয়ে গল ফাঁসী॥
কাহু কে মন কী কৌও কা জানে, লোগন কে মন হাঁসী।
সুরদাস প্রভু তুমহরে দর্শ বিন লেহো করবত কাসী॥
১.
সুরদাস ভক্তি আন্দোলনের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল - একটি ধর্মীয় আন্দোলন, যা একটি নির্দিষ্ট হিন্দু দেবতা যেমন কৃষ্ণ, বিষ্ণু বা শিবের জন্য গভীর ভক্তি, বা ভক্তির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল, যা 800-800 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতীয় ভাষায় প্রচলিত ছিল এবং বৈষ্ণববাদ প্রচার করেছিল । সুরদাসের রচনাগুলিও একটি স্থান খুঁজে পেয়েছে গুরু গ্রন্থ সাহেব , শিখদের পবিত্র বই।
২.
সুরদাসের কবিতামূলক রচনা -
যদিও সুরাদাস তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কাজের জন্য পরিচিত সুর সাগর তিনি লিখেছেন সুর-Saravali , যা জন্মের তত্ত্ব এবং হলির উৎসবের উপর ভিত্তি করে, এবং সাহিত্য-লাহিড়ী,পরম নিবেদিত ভক্তিমূলক গান। যেমন সূদাসরা কৃষ্ণের সাথে একটি রহস্যময় সংঘর্ষ অর্জন করেছিলেন, তেমনি রাধার সাথে কৃষ্ণের রোম্যান্স সম্পর্কে এই আয়াতটি রচনা করতে সক্ষম হয়েছিল, যেহেতু তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। হিন্দু ভাষার সাহিত্যিক মূল্য উত্তোলনকারী একটি সূরদাসের শ্লোককেও এমন একটি কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে, এটি একটি অশোধিত ভাষা থেকে একটি আনন্দদায়ক জিহ্বায় রূপান্তরিত করে।
৩.
সুরদাসের একটি গান: 'কৃষ্ণের কাজ'
কৃষ্ণের কাজের কোন শেষ নেই:তাঁর প্রতিশ্রুতি সত্য, তিনি গোকূলের মধ্যে দেবতাদের প্রভু এবং তাঁর ভক্তদের প্রতি সহানুভূতিশীল,তিনি নৃশংস হিসাবে এসেছিলেনএবং হিরণ্যকশিপকে পৃথক করে ফেলেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর
সুরদাসের প্রার্থনা
ঢাকো ঢাকো মুখ টানিয়া বসন,
আমি কবি সুরদাস।
দেবী, আসিয়াছি ভিক্ষা মাগিতে,
পুরাতে হইবে আশ।
অতি অসহন বহ্নিদহন
মর্মমাঝারে করি যে বহন,
কলঙ্করাহু প্রতি পলে পলে
জীবন করিছে গ্রাস।
পবিত্র তুমি, নির্মল তুমি,
তুমি দেবী, তুমি সতী--
কুৎসিত দীন অধম পামর
পঙ্কিল আমি অতি।
তুমিই লক্ষ্মী, তুমিই শক্তি
হৃদয়ে আমার পাঠাও ভক্তি--
পাপের তিমির পুড়ে যায় জ্বলে
কোথা সে পুণ্যজ্যোতি।
দেবের করুণা মানবী-আকারে,
আনন্দধারা বিশ্বমাঝারে,
পতিতপাবনী গঙ্গা যেমন
এলেন পাপীর কাজে--
তোমার চরিত রবে নির্মল,
তোমার ধর্ম রবে উজ্জ্বল,
আমার এ পাপ করি দাও লীন
তোমার পুণ্যমাঝে।
তোমারে কহিব লজ্জাকাহিনী
লজ্জা নাহিকো তায়।
তোমার আভায় মলিন লজ্জা
পলকে মিলায়ে যায়।
যেমন রয়েছে তেমনি দাঁড়াও,
আঁখি নত করি আমা-পানে চাও,
খুলে দাও মুখ আনন্দময়ী--
আবরণে নাহি কাজ।
নিরখি তোমারে ভীষণ মধুর,
আছ কাছে তবু আছ অতি দূর--
উজ্জ্বল যেন দেবরোষানল,
উদ্যত যেন বাজ।
জান কি আমি পাপ-আঁখি মেলি
তোমারে দেখেছিচেয়ে,
গিয়েছিল মোর বিভোর বাসনা
ওই মুখপানে ধেয়ে!
তুমি কি তখন পেরেছ জানিতে?
বিমল হৃদয়-আরশিখানিতে
চিহ্ন কিছু কি পড়েছিল এসে
নিশ্বাসরেখাছায়া?
ধরার কুয়াশা ম্লান করে যথা
আকাশ উষার কায়া!
লজ্জা সহসা আসি অকারণে
বসনের মতো রাঙা আবরণে
চাহিয়াছিল কি ঢাকিতে তোমায়
লুব্ধ নয়ন হতে?
মোহচঞ্চল সে লালসা মম
কৃষ্ণবরন ভ্রমরের সম
ফিরিতেছিল কি গুণ-গুণ কেঁদে
তোমার দৃষ্টিপথে?
আনিয়াছি ছুরি তীক্ষ্ণ দীপ্ত
প্রভাতরশ্মিসম--
লও, বিঁধে দাও বাসনাসঘন
এ কালো নয়ন মম।
এ আঁখি আমার শরীরে তো নাই,
ফুটেছে মর্মতলে--
নির্বাণহীন অঙ্গারসম
নিশিদিন শুধু জ্বলে।
সেথা হতে তারে উপাড়িয়া লও
জ্বালাময় দুটো চোখ,
তোমার লাগিয়া তিয়াষ যাহার
সে আঁখি তোমারি হোক।
অপার ভুবন, উদার গগন,
শ্যামল কাননতল,
বসন্ত অতি মুগ্ধমুরতি,
স্বচ্ছ নদীর জল,
বিবিধবরন সন্ধ্যানীরদ,
গ্রহতারাময়ী নিশি,
বিচিত্রশোভা শস্যক্ষেত্র
প্রসারিত দূরদিশি,
সুনীল গগনে ঘনতর নীল
অতি দূর গিরিমালা,
তারি পরপারে রবির উদয়
কনককিরণ-জ্বালা,
চকিততড়িৎ সঘন বরষা,
পূর্ণ ইন্দ্রধনু,
শরৎ-আকাশে অসীমবিকাশ
জ্যোৎস্না শুভ্রতনু--
লও, সব লও, তুমি কেড়ে লও,
মাগিতেছি অকপটে,
তিমিরতূলিকা দাও বুলাইয়া
আকাশ-চিত্রপটে।
ইহারা আমারে ভুলায়ে সতত,
কোথা নিয়ে যায় টেনে!
মাধুরীমদিরা পান করে শেষে
প্রাণ পথ নাহি চেনে।
সবে মিলে যেন বাজাইতে চায়
আমার বাঁশরি কাড়ি,
পাগলের মতো রচি নব গান,
নব নব তান ছাড়ি।
আপন ললিত রাগিণী শুনিয়া
আপনি অবশ মন--
ডুবাইতে থাকে কুসুমগন্ধ
বসন্তসমীরণ।
আকাশ আমারে আকুলিয়া ধরে,
ফুল মোরে ঘিরে বসে,
কেমনে না জানি জ্যোৎস্নাপ্রবাহ
সর্বশরীরে পশে।
ভুবন হইতে বাহিরিয়া আসে
ভুবনমোহিনী মায়া,
যৌবন-ভরা বাহুপাশে তার
বেষ্টন করে কায়া।
চারি দিকে ঘিরি করে আনাগোনা
কল্পমুরতি কত,
কুসুমকাননে বেড়াই ফিরিয়া
যেন বিভোরের মতো।
শ্লথ হয়ে আসে হৃদয়তন্ত্রী,
বীণা খসে যায় পড়ি,
নাহি বাজে আর হরিনামগান
বরষ বরষ ধরি।
হরিহীন সেই অনাথ বাসনা
পিয়াসে জগতে ফিরে--
বাড়ে তৃষা, কোথা পিপাসার জল
অকূল লবণনীরে।
গিয়েছিল, দেবী, সেই ঘোর তৃষা
তোমার রূপের ধারে--
আঁখির সহিতে আঁখির পিপাসা লোপ করো একেবারে।
ইন্দ্রিয় দিয়ে তোমার মূর্তি
পশেছে জীবনমূলে,
এই ছুরি দিয়ে সে মুরতিখানি
কেটে কেটে লও তুলে।
তারি সাথে হায় আঁধারে মিশাবে
নিখিলের শোভা যত--
লক্ষ্মী যাবেন, তাঁরি সাথে যাবে
জগৎ ছায়ার মতো।
যাক, তাই যাক, পারি নে ভাসিতে
কেবলি মুরতিস্রোতে।
লহ মোরে তুলি আলোকমগন
মুরতিভুবন হতে।
আঁখি গেলে মোর সীমা চলে যাবে--
একাকী অসীম ভরা,
আমারি আঁধারে মিলাবে গগন
মিলাবে সকল ধরা।
আলোহীন সেই বিশাল হৃদয়ে
আমার বিজন বাস,
প্রলয়-আসন জুড়িয়া বসিয়া
রব আমি বারো মাস।
থামো একটুকু, বুঝিতে পারি নে,
ভালো করে ভেবে দেখি--
বিশ্ববিলোপ বিমল আঁধার
চিরকাল রবে সে কি?
ক্রমে ধীরে ধীরে নিবিড় তিমিরে
ফুটিয়া উঠিবে না কি
পবিত্র মুখ, মধুর মূর্তি,
স্নিগ্ধ আনত আঁখি?
এখন যেমন রয়েছ দাঁড়ায়ে
দেবীর প্রতিমা-সম,
স্থিরগম্ভীর করুণ নয়নে
চাহিছ হৃদয়ে মম,
বাতায়ন হতে সন্ধ্যাকিরণ
পড়েছে ললাটে এসে,
মেঘের আলোক লভিছে বিরাম
নিবিড়তিমির কেশে,
শান্তিরূপিণী এ মুরতি তব
অতি অপূর্ব সাজে
অনলরেখায় ফুটিয়া উঠিবে
অনন্তনিশি-মাঝে।
চৌদিকে তব নূতন জগৎ
আপনি সৃজিত হবে,
এ সন্ধ্যাশোভা তোমারে ঘিরিয়া
চিরকাল জেগে রবে।
এই বাতায়ন, ওই চাঁপা গাছ,
দূর সরযূর রেখা
নিশিদিনহীন অন্ধ হৃদয়ে
চিরদিন যাবে দেখা।
সে নব জগতে কালস্রোত নাই,
পরিবর্তন নাহি--
আজি এই দিন অনন্ত হয়ে
চিরদিন রবে চাহি।
তবে তাই হোক, হেয়ো না বিমুখ,
দেবী, তাহে কিবা ক্ষতি--
হৃদয়-আকাশে থাক্-না জাগিয়া
দেহহীন তব জ্যোতি
বাসনামলিন আঁখিকলঙ্ক
ছায়া ফেলিবে না তায়,
আঁধার হৃদয়-নীল-উৎপল
চিরদিন রবে পায়।
তোমাতে হেরিব আমার দেবতা,
হেরিব আমার হরি--
তোমার আলোকে জাগিয়া রহিব
অনন্ত বিভাবরী।
=================================
No comments:
Post a Comment