সাহিত্যের অত্যাধুনিক শাখা গুলির মধ্যে জনপ্রিয় একটি ধারা হলো কল্পবিজ্ঞান। কল্পবিজ্ঞান : বিজ্ঞান ও কল্পনা জনিত সাহিত্যের অন্যতম রূপ। উভয়ের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী - সংযোজক সেতু। এই বিশেষ ধারা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমে যা বলতে হয় - "মানুষের সর্বপ্রথম অস্ত্রই ছিল মগজাস্ত্র"
সাহিত্য এবং বিজ্ঞানের মধ্যে বিজ্ঞান অবশ্যই যে আগে এসেছে এ বিষয়ে বিতর্কের কোনও অবকাশ আছে বলে মনে করি না। প্রকৃতিতে সমস্ত জীবকুলের মধ্যে মানুষ তার সূচনা পর্বেই এক অনন্য বৈশিষ্ট নিয়ে এসেছিল। আদিপর্বে মানুষ যত বলশালীই থাকুক না কেন তার থেকেও অধিক বলশালী প্রাণী বা জন্তু অবশ্যই ছিল এই পৃথিবীর বুকে। নাহলে অন্যান্য পশুরা যেখানে শিকার ধরার জন্যে কেবল মাত্র তাদের নখ আর দাঁতের ব্যবহার করত সেখানে মানুষকে গাছের মোটা ডাল বা পাথরের চাঙড় খুঁজে বেড়াতে হত কেন?
মানুষের সর্বপ্রথম অস্ত্রই হয়ত ছিল মগজাস্ত্র। এই দিয়েই গাছের ডাল পর্ব থেকে শিকার কাহিনীতে সে নিজেকে একে একে আদি প্রস্তর আর নব্য প্রস্তর যুগের নায়ক করে তুলেছিল। পরবর্তীতে আগুন আবিষ্কার মানুষের বিজ্ঞান চিন্তার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এরপর থেকে সে আর দাঁড়িয়ে থাকে নি কখনও। এগিয়েই গেছে আর এগিয়েই গেছে। এর একটাই কারণ আর সেটা হল অন্যান্য মানবেতর প্রাণীদের মগজ যেখানে কিছুদূর এগিয়েই থেমে যেতে বাধ্য হয়েছে সেখানে মানুষের মগজ ক্রমেই এগিয়ে গেছে, যাচ্ছে আর যাবে।
আদি মানুষের মুখে তখনও ভাষা আসে নি। সাহিত্য তো দূরস্থান। আকার আর ইঙ্গিত পর্ব চুকিয়ে সে ঢুকে গিয়েছিল মনের ভাষাকে ঠোঁটের আগায় তুলে আনার প্রচেষ্টায়। প্রকৃতি একেবারে গোড়া থেকেই মানুষকে এক অনন্য শ্রেণীতে ঠাঁই দিয়েছিল এটা তো আগেই বলেছি। শুধু যে দিয়েছিল উন্নত মস্তিষ্ক তাই নয়, দিয়েছিল সেই মগজকে ক্রম উন্নতির পথটাকেও। একমাত্র মানুষের মগজ যত উন্নতি লাভ করেছে আর করেই যাচ্ছে অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে তার ধারে কাছেও নয়।
শুধু উন্নত মগজই নয়, প্রকৃতির কাছে থেকে সে পেয়েছে উন্নততর অনুভূতিগুলিও। অন্য পশুরা যেখানে আদিপর্ব থেকে আজও বিনা পোশাকেই দিব্বি বিদ্যমান মানুষ কিন্তু আদি পর্ব থেকেই গাছের ছাল বা পাতায় নিজের লজ্জা নিবারণ করেছে। পশু জগতের অনেক সদস্য বিবর্তনের প্রকোপে আজ অবলুপ্ত আবার কেউ বা নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে।
বিজ্ঞানকে বলা যেতে পারে মানুষের জন্মসঙ্গী
মানব জাতি কিন্তু জাতি হিসেবে তার আবহমানতা দিব্যি রক্ষা করে চলেছে। অর্থাৎ চেতনা সে পেয়েছে একেবারে গোড়া থেকেই। সে লজ্জা নিবারণ হোক, যৌন চেতনা হোক বা সভ্যতা ও বিজ্ঞান চেতনার অন্য কোনও চেতনা। অর্থাৎ হুঁশ জিনিসটা মানুষের জন্মগত। এই হুঁশের নিরিখেই সে জাগিয়ে তুলেছে তার মানকে আর ক্রমেই হয়ে উঠেছে মানুষ।
দয়া, মায়া, ভয়, সাহস, বুদ্ধি ইত্যাদি সব কিছুই অনুভূতির অঙ্গ যা উন্নত মগজের কল্যাণে মানুষের অন্যান্য পশুদের থেকে অবিশ্বাস্যভাবে বেশি। মানুষের আবেগ বেশি, তার মনে রাখার ক্ষমতা বেশি আবার বেশি হল চিন্তাশক্তি আর কল্পনা শক্তি। এই যে অনুভূতিগুলো পোষা থাকে তার মন অর্থাৎ মগজের কুঠুরিতে তা কিন্তু বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে থাকে। মানুষের নাকি একটা দোষ আছে, অন্যান্য পশুরা যেখানে অল্পে সন্তুষ্ট মানুষ সেখানে কিছুতেই সন্তুষ্ট নয়। এটি মানুষের দোষ হতে পারে কিন্তু মস্ত একটা গুণও বটে। এই অসন্তুষ্টিই তাকে ক্রমান্বয়ে আবিষ্কার করে যেতে স্পৃহা জাগায়। এই অদম্য অনুভূতির জন্যেই মানুষের আবিষ্কারের স্পৃহা কিন্তু থেমে থাকে নি।
তাই বিজ্ঞানকে বলা যেতে পারে মানুষের জন্মসঙ্গী।এই বিজ্ঞানের দৌলতেই মানুষ তার মুখের উচ্চারিত শব্দগুলোকে ভাষার নির্দিষ্ট নিয়মের গন্ডীতে বেঁধে দিতে সে সক্ষম হয়েছে। মুখের ভাষা এসে মনের ভাব প্রকাশের পথ খুলে দিয়েছে। আগেই বলেছি মানুষ চিন্তাশীল। কারোর সে ক্ষমতা বেশি বা কারোর কম। এখানে কেবল গড় হিসেবে সমগ্র মানব জাতির কথাই বলা হচ্ছে।
মানুষের কল্পনাশক্তির বহিঃপ্রকাশ ভাষার মাধ্যমে ঘটে
মুখের ভাষাকে দীর্ঘ বা চিরস্থায়ী রূপ দিতে এসেছে লিপির প্রবর্তন আর লিখন প্রণালী। ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করেছে সাহিত্য। অর্থাৎ কল্পনার বহিঃপ্রকাশ।কিন্তু মনে রাখতে হবে উন্নত সাহিত্যের জন্যেও চাই চিন্তা আর ভাষা বিন্যাসের বিজ্ঞানগত পদ্ধতি। এই বিজ্ঞান কিন্তু আক্ষরিক অর্থে বিজ্ঞান নয়। জ্ঞানের উন্নয়ন বা মগজের উন্নয়ন অর্থাৎ চিন্তার উন্নয়ন সেটিই হল বিজ্ঞান।
ভাষা এবং সাহিত্য বিজ্ঞাননির্ভর হলেও বিজ্ঞান কিন্তু সাহিত্যনির্ভর নয়। বিজ্ঞান সত্যকে খুঁজে এনে প্রতিষ্ঠা করে উপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে। বিজ্ঞানের নিজের এক ভাষা আছে যা বোঝে বিজ্ঞান জগতের লোক। প্রেমকে কাব্য ও সাহিত্যের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে বা বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করা যায়। ব্যক্তিগত প্রতিভা, দক্ষতা কল্পনা আর ভাষা বিন্যাসের চাতুর্যে এটি বিভিন্ন সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাত্রায় পরিবেশিত হতে পারে।
কিন্তু বিজ্ঞানের একটি সূত্র বা ব্যাখ্যা এই ভাষাচাতুর্য বা সৌন্দর্যের প্রয়োগের ওপর নির্ভরশীল নয়। হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের বিক্রিয়া বা তড়িৎ কোষে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট আর সুবোধ্য হলেই যথেষ্ট। এখানে ভাষার কারিকুরির আলাদা কোনও মূল্যই নেই। বিজ্ঞান সর্বদাই তার নিজের ভাষাতেই কথা বলে আর অবশ্যই বলবে।
মানুষের নিত্য নতুন আবিষ্কার
মানুষ বিজ্ঞানের নিত্য নানা আবিষ্কার করে আর করেই চলেছে। অন্যান্য মানবেতর প্রাণীদের পক্ষে এটি সম্ভব নয় তাদের মগজের সীমিত ক্ষমতার জন্যে। আর তাই মানুষ যতটা স্বাবলম্বী অন্যান্যরা ততটা নয়। মানুষ যেখানে তার প্রয়োজনের মুখ্যভাগ নিজে জোটাতে সক্ষম অন্যান্যদের সেখানে প্রকৃতির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। ভাবুন তো একটি মানুষ তার নিজের শরীরের অভ্যন্তরস্থ যন্ত্রের আকার, অবস্থান আর কার্যপ্রণালী জানে। আবার জানে সেগুলো বিগড়ে গেলে কি হয় বা সেগুলোকে কি উপায়ে ঠিক রাখা যায়।
তাই মানুষ নিজেই নিজের অসুখ সারাতে পারে। অসুখ যাতে না হয় তার ব্যবস্থাও নিতে পারে। কিন্তু অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে সর্বদা তা সম্ভব নয়। সামান্য চিকিৎসা তারা প্রকৃতির কৃপায় করে নিতে পারে যেমন কিছু পাতা বা শেকড় চিবিয়ে খেয়ে বা অন্য কিছু ভাবে কিন্তু কঠিন রোগে তাকে মরতেই হয়। তাই তাদের আয়ুও কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া বেশ কম।
মানুষ শুধু চিন্তাশীল নয় সে কল্পনাবিলাসীও বটে
মানুষ শুধু চিন্তাশীল নয় সে কল্পনাবিলাসীও বটে। এমন কোনও মানুষ নেই যে চিন্তা বা কল্পনা কিছুই করে না। এই চিন্তা আর কল্পনার সীমা বাড়ে শিক্ষার নিরিখে। অর্থাৎ যতই মানুষের শিক্ষা বাড়ে ততই তার বাড়ে কৌতূহলও। চিন্তা আর কল্পনার সাহায্যে সে সেই জ্ঞানকে নিজের মধ্যে প্রসারিত করতে চায়। সবাই যে সমান ভাবে চিন্তা করে তা নয়। মস্তিষ্কের ক্ষমতা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, শিক্ষা এই সবই কিন্তু চিন্তা আর কল্পনার বিকাশ আর বিস্তারে সাহায্য করে। কেউ উদ্ভট কল্পনা করে আবার কেউ যুক্তিশীলতার ভিত্তিতে চিন্তা করে। তাই চিন্তার ফসল ভিন্ন জনের ভিন্ন। এই ফসল কারোর কাজে লাগে আবার হয়ত কারোর কাজে লাগে না।
কবি সাহিত্যিকেরাও কল্পনা করে আবার বিজ্ঞানীরাও। কবি সাহিত্যিকদের কল্পনা ভাষার ডানা মেলে কাব্য-সাহিত্যের আকাশে। আর বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের কল্পনা প্রোথিত করে কোনও আবিষ্কারের বীজকে বিজ্ঞানের জমিতে। প্রকাশিত হয় তার নিজস্ব ভাষায়। তবে কল্পনার স্থান কিন্তু আবিষ্কারের আগে। কিছু কিছু আবিষ্কার আবার আসে সম্পূর্ণ আচমকা নিজে নিজেই বা অন্য কিছু আবিষ্কারের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে। যেমন মাধ্যাকর্ষণ সূত্র, পরমাণুর গঠন, এক্স রশ্মি, তড়িৎ কোষ, আর্কিমিডিসের সূত্র, স্যাকারিন, বর্ণালী ইত্যাদি। উদাহরণ অবশ্যই অপ্রচুর নয়।
বিজ্ঞানের আবিষ্কার
বিজ্ঞানের আবিষ্কার সফল হতে গেলে তাকে অন্তত তিনটি ধাপ পেরোতে হয়। পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ আর সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত কিন্তু ইতিবাচক প্রমাণ সাপেক্ষ। কিন্তু হঠাৎ করে একজন বিজ্ঞানী কোনও পরীক্ষা করবেন কেন? কিভাবেই বা করবেন আবার কি নিয়ে আর কি দিয়েই বা করবেন। এর আগে থাকে কিছু ঘটনা বা দুর্ঘটনা অথবা কল্পনা। আর্কিমিডিসের আবিষ্কারের পেছনে কি আছে? শাসকের উদ্ভট খেয়াল- ঘটনা- বিজ্ঞানীকে শাস্তির ভয়- সেই থেকে প্রেরণা ও মানসিক চাপ- সেই থেকে একটি সামান্য ঘটনা মনে গেঁথে যাওয়া। সেই থেকে চিন্তা আর অবশেষে পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ আর সিদ্ধান্ত।
অর্থাৎ এক বিজ্ঞানীর মনে তার আবিষ্কারকে ঘিরে সর্বদাই কিন্তু চিন্তা থেকেই যায়।অনুক্ষণ তাকে ব্যস্ত করে মারে সত্যটাকে জানার, প্রতিষ্ঠা করার আর মানব হিতে তাকে প্রয়োগ করার চেষ্টা। প্রকৃতির সাধারণ ঘটনাগুলোকে সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক ঘটনা বলে যখন ধরে নেয় বা বিশ্বাস করে তখন বিজ্ঞানীরা তাতে কখনোই সন্তুষ্ট থাকে না। সর্বদাই অজস্র ‘কেন’ বা ‘কেন নয়’ এই শব্দ বা শব্দবন্ধের পেছনে তারা ধাওয়া করেই চলেন। আর সেই চিন্তা থেকেই জন্ম নেয় কল্পনার।
এই যে এতগুলো কথা বলা হল সেগুলোকে ধান ভানতে শিবের গীতের মত মনে হলেও আসলে তা তাই নয়। অর্থাৎ ঘটনা বা দুর্ঘটনা যেমন বিজ্ঞানীর চিন্তাশীলতাকে চাঙ্গা করে তুলে কিছু আবিষ্কারে উদবুদ্ধ করতে পারে তেমনি অন্য কিছু। মানুষ আগে কল্পনা করেছিল, ইস আমার যদি পাখির মত ডানা থাকত
তবে আমি বেশ বিনা বাধায় বা অল্প বাধায় এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যেতে পারতাম। যেমন পাখিরা বা পতঙ্গরা যায়। এরোপ্লেন আবিষ্কারের আগে তো এটি একটা উদ্ভট কল্পনা মাত্র ছিল। কিন্তু সেই উদ্ভট কল্পনাই প্রেরণা জুগিয়েছিল বিজ্ঞানীদের। প্ররোচিত করেছিল এই কল্পনাটিকে সত্য করে তোলা যায় কিনা দেখতে। সত্য জিনিসটা বড়ই আপেক্ষিক। তাই আজ যে জিনিসটাকে নিতান্ত উন্মাদের উদ্ভট কল্পনা বলে মনে হচ্ছে অদূর কিংবা সুদূর ভবিষ্যতে তাই সত্যে রূপান্তরিত হতে পারে।
আর্কিমিডিসের সূত্রের সাহায্যে বেরিয়ে এল সাবমেরিন
ভাবুন তো জলের নিচে দিয়ে মাছেদের মত যেতে কার না ইচ্ছে জাগে? সাবমেরিন আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত এটি কি একটা উন্মাদের উদ্ভট কল্পনা ছিল না? এই উদ্ভট কল্পনাকে বিজ্ঞানীরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছিলেন। তাঁরাও অন্য মানুষের মত রঙীন কল্পনায় মেতে উঠতে পারেন। তাই তো চিন্তা শুরু হয়ে গেল জলের ভেতরে মাছেরা কিভাবে যাতায়াত করে বা জলের বিভিন্ন গভীরতায় কিভাবে তারা নিজেদের নিয়ে যেতে পারে সেই চিন্তায়। সেই চিন্তাই তাকে প্ররোচিত করল মাছের পেটের পটকা আর তার আকার পর্যবেক্ষণের দিকে। প্রথমে আবিষ্কার হল মাছ জলের ভেতরে এমন কাজ করে কি করে। তারপর আর্কিমিডিসের সূত্রের সাহায্যে বেরিয়ে এল সাবমেরিন নামে এক অপূর্ব জিনিস। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা কল্পনাকে কিন্তু অত্যন্ত চমৎকার এক মাত্রা দিয়ে রেখেছেন। কল্পনা না থাকলে পরিকল্পনাও আসে না। আসে না আবিষ্কারও।
=={{{{{{{{{{{{{∆∆∆∆∆∆∆∆∆}}}}}}}}}}}}}}}}}==
No comments:
Post a Comment