খালেদ চৌধুরী
জন্ম ২০ ডিসেম্বর, ১৯১৯, শ্রীহট্ট জেলায়, এখন যা বাংলাদেশের অন্তর্গত। উল্লেখ্য, প্রাচীন ঐতিহ্যসমন্বিত শ্রীহট্ট, সিলেট নামেই জনপ্রিয় পরিচয় যার, বিংশ শতাব্দীতে উপহার দিয়েছে বাঙালির পক্ষে অহংকার করার মতো প্রতিভা সৈয়দ মুজতবা আলী, নির্মলেন্দু চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, গুরুসদয় দত্তের। শ্রীহট্ট হাসন রাজার দেশ, সুরমা আর মনু নদীর দেশ, বিল-বাঁওড়, উচ্চাবচ টিলা, চা বাগান আর নিজস্ব নাগরী লিপি উদ্ভাবনার দেশ। জন্মসূত্রে খালেদ নামে পরিচিত ছিলেন না তিনি, ছিলেন চিররঞ্জন। নামটি তাঁর পিতা চন্দ্রনাথ দত্তচৌধুরীর দেওয়া। এ নাম ১৯৪৩ থেকে কেন খালেদ-এ পরিণত হয়েছিল, তার বিধুর পশ্চাৎপটটি যথাসময়ে ব্যক্ত করা যাবে।
একশোটির ওপর নাটকের মঞ্চ স্থাপত্য সৃজিত হয়েছিল তাঁর। এবং দর্শকদের কাছে তা তুমুল অভিনন্দিত হয়েছিল, আর নাট্যসমালোচক, নাট্যবেত্তাদের কাছে এ জন্য তিনি সমসাময়িক নাট্যকার-নাট্য অভিনেতাদের পাশাপাশি সম্ভ্রান্ত অবস্থানে গুরুত্ব পান।
মাটি থেকে সাগরে
মাত্রই সতেরো বছর বয়সে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় খালেদ বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা চলে এলেন। তার আগে তাঁর সিলেট বাসপর্বটি কিন্তু তাঁর শিল্পীসত্তাকে প্রাথমিকভাবে উসকে দিয়েছে মূলত আইপিটিএ (IPTA, বাংলায় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা ভাগনাস)। IPTA নয়, বলা ভালো কমিউনিস্ট পার্টির কালচারাল স্কোয়াড। অল্প বয়স থেকেই ছবি আঁকার প্রবণতা ছিল তাঁর। পঞ্চাশের মন্বন্তর তখন, কিশোর খালেদ ছবি আঁকছেন দুর্ভিক্ষ নিয়ে। পার্টি তাঁকে দিয়ে প্রথমদিকে পোস্টার আঁকাতে শুরু করে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের উৎসাহে তিনি তাঁদের গণসংগীতের দলে যোগ দেন। শান্তা সেন, নির্মলেন্দু চৌধুরীরাও সে-সময়ে সমগ্র বাংলায় যে গণসংগীতের জোয়ার বইবে, তারই প্রস্ত্ততি নিচ্ছেন সিলেটে বসে। দুর্ভিক্ষ, বিশ্বযুদ্ধের রুদ্ধশ্বাস সময়, ঢাকায় নিহত হলেন সোমেন চন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রদায়িকতার বলি হতে হলো ছাত্রনেতা নাজিরকে, এহেন দুরূহ সময়কাল তখন। খালেদ এ সময় সিলেট ছেড়ে কলকাতায়। আইপিটিএ-র সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে এসে উঠলেন ৪৬, ধর্মতলা স্ট্রিটে, এখন যার নাম লেনিন সরণি। কলকাতায় কিছুদিন থেকে আবার সিলেটে ফিরে গিয়েছিলেন। দু-বছর পর ছবি আঁকার অভীপ্সা নিয়ে আবার তাঁর কলকাতায় আসা। চিত্রশিল্পী হবেন, তখনকার এই মানসিকতাই তাঁকে সেবার কলকাতায় আসতে প্রলুব্ধ করে। জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন, আমিনা (চিত্রী চিন্তামণি করের সঙ্গে পরবর্তীকালে বিয়ে হয় যাঁর), এই সব পূর্ববঙ্গীয় শিল্পীর তখন গঠনপর্ব চলছে কলকাতায়। এবারে খালেদ ঠাঁই পেলেন কমিউনে।
কমিউন, ভাগনাস, ফ্যাসিবিরোধী লেখক-শিল্পী সম্পর্কে এখানে কিছু জেনে নেওয়া জরুরি, যাতে খালেদ চৌধুরীর সামগ্রিক শিল্পীসত্তা, তাঁর জীবন-দর্শন, তাঁর যাবতীয় কাজের প্রবণতা জঁর, ইত্যাদি উপলব্ধিতে সহায়ক হবে। খালেদকে নির্মিতি দিয়েছে ভাগনাস।
১৯৩৬-এর ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ’ তার আদর্শ ও কর্মধারার ব্যাপ্তি ও প্রসারণ ঘটিয়ে ১৯৪২-এ ‘ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’ গঠন করে। এর পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল মূলত তৎকালীন ভারতীয় কমিউনিস্ট দল। এটি ছিল পার্টির সাংস্কৃতিক অঙ্গ। কমিউনিস্ট পার্টি ভারতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোড়ায় যুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বলে চিহ্নিত করলেও (ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ভারতে তখন পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত) ১৯৪১-এর জুনে হিটলার যখন সোভিয়েত দেশ আক্রমণ করেন ও তার প্রেক্ষিতে ব্রিটেন, আমেরিকা এবং সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে মহাজোট গঠিত হয়, সোভিয়েত-অনুবর্তী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এই যুদ্ধকে আখ্যা দেয় ‘জনযুদ্ধ’, এবং ভারতে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে যুদ্ধের প্রশ্নে সহযোগিতার ভূমিকা পালন করতে থাকে। ১৯৪৩-এ এরই সহযোগী সংস্থা তৈরি হলো ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’ নামে। এর জন্ম মুম্বাইয়ে, প্রগতি লেখক সংঘের চতুর্থ সমাবেশের সময়, যদিও সংঘের বীজ উপ্ত হয়েছিল ১৯৪১-এ বেঙ্গালুরুতে অনিল ডি সিলভার নেতৃত্বে। গোড়া থেকেই IPTA-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, বিষ্ণু দে, সুজাতা মুখোপাধ্যায়, বিনয় রায় প্রমুখ। অচিরেই এটি সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। নাটক, নৃত্যনাট্য, সংগীত, ছায়ানৃত্য ইত্যাদির মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার প্রসারণ ঘটাতে এটি ছিল এক অনবদ্য, তুলনারহিত মাধ্যম। দেশের নানা প্রান্তের শিল্পী, কলাকুশলী, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজ এখানে অচিরেই সমবেত হতে শুরু করেন। খালেদ চৌধুরী ১৯৪৫-এ এই ভাগনাস বা IPTA-তে যোগ দিয়েছিলেন। এর আগে সিলেটে থাকতেই তিনি একবার বিজন ভট্টাচার্যের জবানবন্দী নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তিনি IPTA-তে ছিলেন। এ সময় তাঁর কর্মকান্ড নিয়ে অতঃপর কিছু জানব আমরা। আর কেন তিনি এবং তাঁর অন্য শিল্পী বন্ধুরা IPTA ছাড়লেন, তা-ও.
খালেদ চৌধুরী পরবর্তীকালে মঞ্চ স্থাপত্যকেই তাঁর শিল্পমাধ্যম করে নেবেন। তার সূচনা আমরা দেখতে পাচ্ছি ১৯৪৭-এ, যখন শহীদের ডাক ছায়ানাট্যে তাঁকে সেট ডিজাইনাররূপে পাই। ১৯৪৯-এ দেবব্রত বিশ্বাস রক্তকরবী পরিচালনা করেছিলেন। সেখানেও খালেদ মঞ্চস্থপতি। ব্যালে স্কোয়াডে পার্কাশন বাজিয়ে ছিলেন, তাছাড়া ছিলেন শহীদের ডাক নাটকে অভিনেতারূপেও। দক্ষ বেহালাবাদক ছিলেন খালেদ, বাজাতে জানতেন সেতার, দোতারা ও আরো নানা রকমের বাদ্যযন্ত্র। বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী (‘রানার’-খ্যাত) শম্ভু ভট্টাচার্যের সঙ্গে একই মঞ্চে যুগ্মনৃত্যে দেখা গিয়েছে তাঁকে, আবার IPTA-তে গান গেয়েছেন নির্মলেন্দু চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গে। এই বহুমুখিতা নিয়েই খালেদ চৌধুরী। নাটকের প্রয়োজনেই খালেদ চৌধুরী একটি যন্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেন ও নাম দেন তার ‘ঘরঘরি’। লোকগান সংগ্রহের নেশা ছিল তাঁর, ছিল বংশীবাদনের দক্ষতা। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে তিনি নির্বাচন করে নিলেন মূলত মঞ্চস্থপতিকাররূপে তাঁর ভূমিকাকে, যার ফলশ্রুতিতে আমরা পাই রক্তকরবী থেকে ডাকঘর, পুতুলখেলা; অন্যদিকে কর্ণাবতী, আকরিক, নকশীকাঁথার মাঠ, চিলেকোঠার সেপাই। বিচিত্র সময়, বিষয়বস্ত্ত বিচিত্র, নাট্যদলের রুচি, সামর্থ্য এবং মঞ্চের বহু বিচিত্রতা, অন্যদিকে অনড়, অচপল তাঁর সংকল্প, প্রতিটি নাটককে তিনি সজ্জিত করলেন তাঁর অপরূপ শিল্পব্যঞ্জনায়। হিসেব মতো ১০৬টি নাটকের কথা জানি আমরা, যেখানে তাঁর প্রতিভায় দীপ্ত মঞ্চসজ্জা। সংখ্যাটা একদিকে যেমন বিশাল, তেমনি অন্য একটি কথা বিবেচনায় আনলে আমরা হতবাক না হয়ে পারি না যে, একই সঙ্গে তাঁকে একেবারেই দুই বিপরীতধর্মী নাটকের মঞ্চস্থাপত্যে ভাবিত হতে হচ্ছে, বাংলা ও হিন্দি নাটকের সমসময়ে তাঁর মঞ্চস্থাপত্য ভাবনায় ভাবিত তিনি, যে-দুই নাটকের দর্শককুল আলাদা, চরিত্রায়ন আলাদা, নাটমঞ্চের আয়তন আলাদা। আবার, এ-ও বিস্ময়কর, একই নাটকের হিন্দি ও বাংলা রূপান্তরকে দুই আলাদা মাত্রায় নিয়ে আসেন তিনি মঞ্চে, ‘বহুরূপী’র পুতুলখেলা এবং ওই একই নাটকের হিন্দি মঞ্চায়ন গুড়িয়াঘর, যে নাটকের প্রযোজক ‘রঙ্গকর্মী’ (মূল নাটকটি নরওয়েজীয় নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের লেখা)। একই নাটকের দুই দলের প্রযোজনায় দু-রকম মঞ্চসজ্জার নিরীক্ষা আছে তাঁর, রয়েছে একই দলের একই নাটকের পুনর্মঞ্চায়নে তাঁর দ্বিবিধ স্থাপত্য কারুকাজ। নাটকে আবহসংগীতের ব্যবহার এবং পাত্রপাত্রীর পোশাক পরিকল্পনার কাজেও তাঁর দক্ষতা তিনি প্রমাণ করে গেছেন। তাঁর মঞ্চস্থাপত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ইঙ্গিতধর্মিতা। বাংলা নাটকের বিগত দুইশো বছরের মঞ্চ পরিকল্পনার নিরিখে খালেদ চৌধুরীর অনন্যতা ঠিক কোনখানে অতঃপর তা জেনে নেব আমরা।
খালেদ চৌধুরী : কীর্তিনামা
খালেদ চৌধুরীর জীবনে এবং বাংলা নাটকের ইতিহাসে ১৯৫৪ সালে রক্তকরবীর আবির্ভাব যুগান্তর এনে দেয়। শম্ভু মিত্র নির্দেশিত নাটকটি প্রযোজনার ক্ষেত্রে যেমন চূড়ান্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী, তেমনি নাটকটির মঞ্চ পরিকল্পনায় অভাবিত অভিনবত্ব ও চমৎকৃতি নিয়ে এলেন খালেদ চৌধুরী। এর আগে রবীন্দ্রনাটক যেমন অভিনীত হয়েছে সাধারণ রঙ্গালয়ে, তেমনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহু নাটক নিজস্ব পরিচালনায় মঞ্চস্থ করেছেন। তাছাড়া এই রক্তকরবী-ই যখন ১৯৪৯-এ পরিচালনা করেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস, আমরা আগেই জানিয়েছি, তার মঞ্চপরিকল্পনার দায়িত্বেও ছিলেন খালেদ। এ কাজে সূর্য রায় তাঁর সহযোগী ছিলেন। রক্তকরবীর শম্ভু মিত্র অধ্যায় শুরু হবার আগে ‘বহুরূপী’ যখন ধর্মঘট মঞ্চস্থ করে, সে নাটকের সেট নির্মাণেও খালেদ অবদান রাখেন।
‘বহুরূপী’র প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই খালেদ চৌধুরী এ দলের সঙ্গে যুক্ত, যেমন যুক্ত ছিলেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য বা কুমার রায়। গোড়ায় দলটির নামকরণ হয়নি, ‘অশোক মজুমদারের দল’ নাম ছিল, যে অশোকবাবুর পরিকল্পনামাফিক কথাকলির আদলে মুখোশ তৈরি হয় দলটির পরিচায়ক তথা emblem হিসেবে। এই মুখোশে শেষ টানটি দিয়েছিলেন খালেদ, আর দলটির নামকরণ করেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। অশোক মজুমদার, প্রসঙ্গত, বেশিদিন ‘বহুরূপী’তে থাকেননি, যদিও দশচক্র ও চার অধ্যায় নাটকে মঞ্চনির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন।
প্রসঙ্গ রক্তকরবী, ঘরে বাইরে ও অন্যান্য
রক্তকরবী আর ম্যাকবেথ, দুই মহান নাট্যকারের অবিনশ্বর কৃতি, অভিনীত হয়েছিল বাংলার দুই স্বনামধন্য অভিনেতা-নাট্যনির্দেশক দ্বারা ঐতিহাসিক ১৯৫৪-তে (পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৫৫-তে আর এক বরেণ্য পরিচালকের আবির্ভাব হবে শিল্পের অন্য এক মাধ্যম চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। তিনি হলেন পথের পাঁচালীর সত্যজিৎ রায়)। শম্ভু মিত্র এবং উৎপল দত্ত।
এ নাটকে কী এমন মঞ্চসজ্জার বৈশিষ্ট্য, যার জন্য খালেদ চৌধুরী অদ্যাপি সম্মানার্হ হয়ে আছেন? চিত্রশিল্পকে শিরোধার্য করার ইচ্ছে নিয়ে আর্ট কলেজে ভর্তি হতে গিয়েছিলেন খালেদ। জয়নুল আবেদিন তাঁকে প্রতিহত করেন। কিন্তু চিত্রধর্মিতা তাঁর মঞ্চ নির্মাণে সর্বদা যে পুরোধা, তা রক্তকরবীর মধ্য দিয়েই প্রথম প্রকট হলো। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যাঁকে ভারতীয় চিত্রশিল্পে ত্রিমাত্রিক ছবি (Cubism. তবে এ মতটি ঘোর বিতর্কিত) অঙ্কনের পথিকৃৎ বলা হয়, রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকটির অলংকরণে জালের আড়ালে রাজা আঁকলেন। তা ছাড়া বইটির অলংকরণ করতে গিয়ে আরো সাতখানি ছবি আঁকা হলো। ‘বহুরূপী’র ওই নাটকটিতেও এই ছবিগুলির প্রভাব দুর্লক্ষ্য নয়। তবে খালেদ চৌধুরী জানতেন, স্থির ছবির দর্শনানুপাত (Perspective) আর মঞ্চের, আলাদা। তা ছাড়া মঞ্চের আয়তন, ঘনত্ব, মঞ্চে অনবরত কুশীলবদের প্রবেশ-প্রস্থানের জঙ্গমতা বনাম মঞ্চসজ্জার স্থবিরত্ব, এসব ব্যাপারে অবহিত থাকতে হয়েছিল তাঁকে।
নাটকের শুরুতেই স্বয়ং নাট্যকার মঞ্চ-নির্দেশনাটি দিয়ে দেন, যখন তিনি লেখেন, ‘এই নাট্যব্যাপার যে নগরকে আশ্রয় করিয়া আছে তাহার নাম যক্ষপুরী। এখানকার শ্রমিকদল মাটির তলা হইতে সোনা তুলিবার কাজে নিযুক্ত। এখানকার রাজা একটা অত্যন্ত জটিল আবরণের আড়ালে বাস করে। প্রাসাদের সেই জালের আবরণ এই নাটকের একটিমাত্র দৃশ্য। এই আবরণের বহির্ভাগে সমস্ত ঘটনা ঘটিতেছে।’ অর্থাৎ সমস্ত ঘটনা ঘটবে জালটিকে পশ্চাৎপটরূপে ব্যবহার করে। গগনেন্দ্রনাথের ছবিগুলিতে রবীন্দ্রনাথের মঞ্চনির্দেশনা মঞ্চভাবনার এই প্রশ্রয়। বইয়ের প্রচ্ছদে গগনেন্দ্রনাথ একটি কান্ড ঘটিয়েছেন। একেবারে নিচের দিকে শাদা ও ধূসরের সঙ্গে লাল মিশিয়েছেন, যাতে জালের মায়াজাল ছাড়িয়ে রক্তকরবীর স্বমহিমা ফুটে ওঠে, প্রাধান্য পায়। প্রচ্ছদটির শেষে খানিকটা স্থান ছেড়ে রাখা হয়েছে, যেখানে নাটক ও নাট্যকারের নাম লেখা, আর সে-ও লোহিত বর্ণে!
এই চমৎকারিত্বের উদাহরণ খালেদ চৌধুরীর সামনে ছিল। গগনেন্দ্রনাথের অলংকরণে বাকি ছবিগুলির দ্যোতনা তাঁর মাথায় ছিল। তার সঙ্গে যুক্ত হলো মঞ্চস্থপতির মনন। তাই মঞ্চের ফ্রেমে যখন বাঁধা হলো সমগ্র বিষয়টিকে, বিস্মিত হয়ে লক্ষ করা গেল দুটি খালেদ-পরিচায়ক বৈশিষ্ট্য। এক, গগনেন্দ্রনাথের ছবিতে যাকে অরূপ বলে প্রতিভাত হচ্ছিল, সেই জাল খালেদ চৌধুরীতে কোনো তোরণের চেহারায় উপস্থিত। দ্বিতীয়, পার্শ্ববর্তী গবাক্ষ, যা কিনা ঘর ও বাইরের, নন্দিনী ও রাজার যোগাযোগস্থল। মঞ্চপরিকল্পনায় আরো বহুতর দৃষ্টিগ্রাহ্য ও নান্দনিক অন্তর্ভুক্তি রয়েছে, যা আমাদের অভিনিবেশ এড়াতে পারে না। যেমন রাজার প্রতীক লাঞ্ছিত ধ্বজা, কুমিরের ভয়াল দংষ্ট্রা। শ্রমিক ও রাজকর্মচারীদের যাতায়াতের দুই ভিন্ন পথের সংস্থানও রেখেছেন খালেদ, দুই সমাজের অনৈকট্য বোঝাতে। সমগ্র মঞ্চপরিকল্পনায় দেশীয় রীতির ছাপ, পাশ্চাত্য অনুকৃতি দুর্লক্ষ্য। কৈফিয়ত হিসেবে স্বয়ং শম্ভু মিত্রই জানাচ্ছেন মঞ্চের সংহত ব্যবহার নিয়ে তাঁর ‘রক্তকরবী’ প্রবন্ধে, ‘… এমনভাবেও এর দৃশ্য সাজানো যেত যাতে রাজার দরজা, ফাগুলালের বস্তির দাওয়া, সর্দার ও চিকিৎসকের মন্ত্রণাকক্ষ, বিশু ও নন্দিনীর কথোপকথনের জন্য নিরালা একটা কোণ, সমস্তই টুকরো টুকরো করে একই মঞ্চের উপর একসঙ্গে দাঁড় করানো থাকতো। কিন্তু সেটা বিলেতিআনা হতো, তাতে সমস্ত দৃশ্যের ছন্দের বদলে বৈষম্যটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হতো, তাই ‘বহুরূপী’ সে কাজ করেনি। কারণ রবীন্দ্রনাথ একটা সমগ্র সমাজের চেহারা দিতে চেয়েছেন, এবং হাজার ঝগড়া বিবাদ সত্ত্বেও সমস্তটা মিলে কিন্তু একটাই সমাজ।’ দৃশ্যগতভাবে নাটকের মূলভাবকে হৃদয়ঙ্গম করে নিয়ে বাস্তব ও রূপকের দ্বৈততায় খালেদ চৌধুরী মঞ্চকে নির্মাণ দিয়েছিলেন, তদুপরি আবহসংগীতের ব্যবহারের মাধ্যমে নাটকের মূল সুরকে অপ্রতিহত গতি দিতে সমর্থ হয়েছেন। এই নাটকের সূত্র ধরেই ‘ঘরঘরি’সহ একাধিক স্ব-উদ্ভাবিত যন্ত্রের অপূর্ব ব্যবহার দেখি নাটকটির স্তর-স্তরান্তরে। যন্ত্রগুলির কোনোটির নাম ‘কাট্টকুটুম’, কোনোটির বা ‘ব্যানতারা’। এক সাক্ষাৎকারে খালেদ চৌধুরী রক্তকরবীতে তাঁর কৃতি নিয়ে বলছেন, ‘দিনের পর দিন রিহার্সাল দেখে দেখে চরিত্রগুলোকে বুঝতে চেষ্টা করতাম। কোনটা বাস্তব, কোনটা রূপক আর কোনটা প্রতীক চরিত্র আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে থাকল। … আসলে বর্তমান দুনিয়ার যে অগ্রগতি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিভিলাইজেশন সেইটাই কিন্তু এ নাটকে ব্যক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা এমন করে বলতে হবে যেন তা ক্রুড না হয়ে যায়। (এই সময় দৈনিকে প্রকাশিত, ৪.৫.১৪ রবি)।
খালেদ চৌধুরীর রক্তকরবী মঞ্চপরিকল্পনা নিয়ে বিশদ করে বলছি এ জন্যই যে একদিকে এই নাটকটির মাধ্যমে তিনি মঞ্চরূপকার রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন এবং দ্বিতীয়ত তাঁর শিল্পীসত্তার ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে এ নাটকটির প্রয়োগ-পরিকল্পনা আমাদের কাছে প্রতিনিধিত্বমূলক বলে বিবেচিত হবে। আরেকটা কথা। সাক্ষাৎকারে ওই যে তিনি বলেছেন ‘দেখে দেখে চরিত্রগুলিকে বুঝতে চেষ্টা’ করার কথা, তা ছিল আজীবনের অনুধ্যান খালেদের। কেবল রিহার্সাল দেখে দেখেই নয়, নিয়ত পাঠের মাধ্যমেও। এই পাঠ যে কতখানি অন্তরঙ্গ ও নিজস্বতামন্ডিত ছিল খালেদের, তার একটু পরিচয় নেওয়া যাক।
‘নাট্যরঙ্গ’ সংস্থা ২০১০-এ প্রয়োজনা করে রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে। নাটকটি দেখে সেটা নিয়ে লিখিত মতামত দিতে গিয়ে (‘স্যাস’, সংখ্যা ২৭, ১৪১৭) খালেদ চৌধুরী কেবল স্বপন সেনগুপ্ত পরিচালিত এবং সুরজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়ঋদ্ধ নাটকটির মঞ্চায়ন নিয়েই লেখেননি, লিখেছেন এ-উপন্যাসটির পাঠ-অভিজ্ঞতার কথাও। এবং সেখানে তাঁর অনন্য বিশ্লেষণ, উপন্যাসটি নিয়ে, আমাদের প্রত্যয়িত করে তিনি পাঠক হিসেবেও কতখানি সমীহযোগ্য। এ উপন্যাসে নিখিলেশের একমাত্রিক সাধুত্ব আর সন্দীপের নিপাট ভিলেনি যে রবীন্দ্রনাথ দেখাতে চাননি, তা ব্যাখ্যা করে এমনকি তিনি উপন্যাসটির চলচ্চিত্র রূপায়ণে সত্যজিৎ রায়কেও সমালোচনা করতে ছাড়েননি। খালেদের মতে, ‘সন্দীপ যদি নিছক ভিলেনই হবে নিখিলেশ তার বন্ধুত্ব স্বীকার করবে কেন?’ আবার বিমলা চরিত্রটি খালেদের বিবেচনায় এরকম, ‘দেশ যেভাবে তার মুক্তির দুই পথের সামনে দাঁড়িয়ে দ্বিধাগ্রস্ত, বিমলাকে ঠিক তেমনভাবেই উপন্যাসে দাঁড়াতে দেখি।’ এ নাটকের প্রযোজনায় ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটির বারবার ব্যবহারে বিচলিত নন খালেদ, বা প্রযোজনায় এই হিন্দুত্বের পৌনঃপুনিকতা যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয় তাঁর কাছে, কেননা ‘স্বাধীনতা আন্দোলনে তো সত্যি সত্যি হিন্দুত্বের মন্ত্রমূর্তি প্রধান করে তোলা হয়েছিল।’ বোঝা গেল, খালেদ নির্মোহ সমালোচক একজন, তন্ময় আর সনিষ্ঠ পাঠক একজন, যাঁর পাঠপ্রতিক্রিয়া একাধারে অনুপুঙ্খ এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যময়। তাই তাঁর সত্যজিৎ কৃত ঘরে বাইরের সমালোচনাটি বিবেচনাযোগ্য হয়ে ওঠে, এবং অন্তিমে হয়তো শিরোধার্যও, ‘… মিসকনসেপশন। সত্যজিৎবাবুর চিত্রনাট্যেও সন্দীপ নিছক এবং এক নিছক ভিলেন। নিখিলেশ দ্বন্দ্বহীন ভালো। সন্দীপের চরিত্রের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ বারংবার যে ‘কিন্তু’ শব্দের উল্লেখ করেছেন তার লেশমাত্র পাওয়া গেল না।’
এই ঘরে বাইরের জন্যও তো খালেদ স্মরণীয় তাঁর অতুলনীয় মঞ্চসজ্জার কারণে। না, ‘বহুরূপী’র নয়, এ ঘরে বাইরে শ্যামানন্দ জালানের হিন্দি রূপান্তর ঘর ও বাহার-এর। প্রসঙ্গত ‘বহুরূপী’তে এ নাটকের মঞ্চরূপকার ছিলেন কুমার রায়। নিজের কাজ বর্ণনা করতে গিয়ে খালেদ জানাচ্ছেন, ‘আমি ঘরে বাইরে-র যে সেট তৈরি করেছিলাম তাতে কালো আর গ্রে দিয়ে দাবার ছকের মতো দেওয়াল তৈরি করেছিলাম। তার মধ্যে একটা অংশ চিক দিয়ে আলাদা করেছিলাম। আলো পড়লে ভিতরটা দেখা যেত। ভিতরে আলো পড়লে বাইরেটা অন্ধকার থাকত। আর বিমলা মাঝেমাঝে প্রদীপ জ্বালাতে বা অন্য কারণে বাইরে আসলে বাইরের আলো জ্বলে উঠত। আরেকটা অংশ ছিল বাইরের। সেখানে রেখেছিলাম ক্যাকটাস। সেখানে বিমলার সঙ্গে সন্দীপের দেখা হত।’ (দ্র. বহুরূপী পত্রিকা, সংখ্যা ১১৪, ২০১০)।
শেষ হয়ে না হইল শেষ
বিমলা, নন্দিনী, পরবর্তী-মধ্যবর্তীতে আরো বহু নাটকের নায়িকা চরিত্রকে নিয়ে, যেমন পুতুলখেলার নোরা অথবা রাজা নাটকের সুরঙ্গমা, রাজা অয়দিপাউস-এর ইয়োকাস্তে নিয়ে যে ভাবনাবৃত্ত ছিল ‘চিরকুমার’ (খালেদের পিতৃদত্ত নাম ‘চিররঞ্জন’, আর পিতামহ বড় সার্থক নাম দিয়েছিলেন তাঁর, ‘চিরকুমার’। সার্থক এই অর্থে যে আজীবন অবিবাহিতই ছিলেন তিনি) খালেদ চৌধুরীর, তারই প্রতিফলন দেখি তাঁর মঞ্চস্থাপত্যে। আর হ্যাঁ, কখনো কখনো রূপসজ্জা করেছেন তিনি। এমনকি ‘রক্তকরবীতে নন্দিনীর মেকআপ নিয়মিত আমাকেই করতে হতো’ (দ্র. বহুরূপী পত্রিকা, সংখ্যা ১১৯, মে ২০১০)। নিয়মিত! আমাদের মনে হয়, রূপসজ্জা, পরিচ্ছদ-পরিকল্পনা, সংগীতের ব্যবহার, এ সমস্তই একজন শিল্প-নির্দেশকের অন্তর্গত হয়ে পড়ে, সামূহিক দৃষ্টিভঙ্গির এই ব্যাপ্তপ্রসারতা ছাড়া একজন মঞ্চনির্মাতার পরিতৃপ্তি আসতে পারে না। নিজের সম্পর্কে সর্বদা উদাসীন, উচ্ছ্বাসহীন মন্তব্য করলেও শম্ভু মিত্র, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ খালেদের রক্তকরবীর কারুময়তা নিয়েই যেসব মন্তব্য করেছেন, কেবল তাই দিয়েই একটি গ্রন্থ রচনা সম্ভব। আমরা কেবল বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য দিয়ে খালেদ চৌধুরীর রক্তকরবীর প্রয়োগবৈদগ্ধ্যের সমাপ্তি টানব, ‘গগনেন্দ্রনাথের ত্রিকৌণিক ছবির আদলে রাজার জাল, ওপরে শ্যেন চক্ষুর লাল নিষেধ, যন্ত্রের মকরের দাঁত, অন্যদিকে শ্বেতপাথরের শীতল কঠোরতা – এই প্রতীকী মঞ্চ পরিকল্পনা রক্তকরবী প্রযোজনার শক্তি ও লাবণ্যকে প্রকাশ করেছিল।’
শক্তি আর লাবণ্য, খালেদের মঞ্চ পরিকল্পনার নেপথ্যবিধান এই দুটি শব্দের মর্মোদ্ধারের মাধ্যমেই সম্ভব। আর এ জন্যই তাঁর সমসাময়িক মঞ্চস্থপয়িতা যাঁরা, বা তাঁর উত্তরসূরি যাঁরা, সেই রাধামোহন তপাদার, দেবাশিস মজুমদার, অভি দাস, পিনাক বিশ্বাস, রবি চট্টোপাধ্যায়, দেবাশিস চৌধুরী বা সঞ্চয়ন ঘোষদের মনে রেখেও খালেদ চৌধুরীর অনন্যতার কথা, স্বাতন্ত্র্যের কথা, মেধা ও মননের যুগলমিলনের যে বৈভব, তা দীর্ঘ, কৌতূহলী ও পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণাসাপেক্ষ।
খালেদ চৌধুরীর কথা শেষ করা গেল আপাতত। যদিও প্রকৃত শেষ নয়, শেষের সূচনামাত্র। পিতার অত্যাচারে ঘর ছেড়ে মুসলমান পরিবারে আশ্রয় নিয়ে স্বরচিত ‘খালেদ’ নামে পরিচিত হন। শাঁওলি মিত্র খালেদের স্মৃতিচারণায় জানান, শাঁওলিদের বাড়ির কচি আমপাতা দিয়ে বাঁশি বানিয়ে, সে বাঁশি বাজিয়ে অবাক করে দিতেন শাঁওলিকে। আজীবন সহজকে সুন্দরতা দিয়েছে খালেদের হাতের নিপুণ বাঁশি।
===={{{{{{{======={{{{{{======{{{{{{{====
No comments:
Post a Comment