মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অলকা দেবী পুত্র সুভোগেন্দ্রনাথ ঠাকুর।সুভো ঠাকুরের জন্ম ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ৩রা জানুয়ারি কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। তবে ঠাকুরবাড়ির খ্যাতি ও ঐতিহ্যের বাতাবরণে জন্ম হলেও তিনি ছিলেন 'বিদ্রোহী'। ছোটবেলা থেকেই তার বিদ্রোহ ছিল নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে, উপনিষৎ পাঠরূপ ভগবৎ-ভজনা তথা সনাতন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, চলতি সাহিত্য এবং চিত্রকলার বিরুদ্ধে ‘ঠাকুর বাড়ির রক্ত’- বললেই রাগ করতেন। একবার তো লিখেই ফেললেন-
জোড়াসাঁকোতেই থাক?
বাবার খুড়ো যে হন শুনিয়াছি,
মোর কেহ হয় নাক। ....।’
সবাই চমকে গিয়েছিল সেদিন। মাত্র ২৬ বছর বয়সে বেড়িয়ে আসেন জোড়াসাঁকো থেকে। তারপর আর সে বাড়ির পানে ফিরে তাকাননি। সম্পাদক, শিল্পী, শিল্প রসিক হিসেবে সু-পরিচিত। চরিত্রে রং এবং তেজ দুই-ই ছিলো এক অসামান্য রসায়ন গুণে ভরপূর। এই সুভো ঠাকুরেরই এক অনবদ্য বই হল ‘প্যান্সি ও পিকো’। বলতে গেলে বাংলা সাহিত্যের এক নতুন মোচড়। সমাজকে তীব্র হানা। বই প্রকাশনের দিনক্ষণ, তারিখ, প্রকাশক পরিচিতিতে ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত অসাধারণ রসিকতাবোধ। প্রিন্টার্স লাইনে এ বই লেখার উদ্দেশ্য।
“যারা আমায় গাল পাড়ে –
তাদেরই বুকের বাট্ন্-হোলে
পরিয়ে দিলাম ‘প্যান্সি ও পিকোর’ বোকে।”
বই প্রকাশনের তথ্য দিচ্ছেন অসামান্য আত্ম জবানীতে –‘- সুভো ঠাকুরই ‘প্যান্সি ও পিকোর’ ছড়া কেটেছেন – আর তিনিই এর প্রথম ত্রিশ পাতা দুশো ঊনষাট নম্বর আপার চিৎপুর রোডের শ্রীকৃষ্ণ প্রিন্টিং ওয়ার্কস থেকে, আর বাকিটা এক নম্বর রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট এর শ্রীসরস্বতী প্রেস লিমিটেড থেকে ছাপিয়ে পঁয়ত্রিশ ঈ কৈলাস বসু স্ট্রিট এর ফিউচারিস্ট পাবলিশিং হাউস থেকে বের করেছেন।’ বইটির ঠিক তলায় বই প্রকাশের দিনক্ষণ লিখছেন একেবারে অন্য চালে। ‘প্যান্সি ও পিকো’ লেখা- পান্ডুয়ায়, ইংরিজি ঊনিশ্ শ’ তেত্রিশ ডিসেম্বরে। আর ছাপা - কোল্কাতায়, বাংলা তেরশ’ বেয়াল্লিশ, বৈশাখে।’
দাম্পত্য সঙ্গী নির্মলা ঠাকুর ও আরতি ঠাকুর
সন্তান চিত্রলেখা শুভম (কন্যা) ও সিদ্ধার্থ শুভম (পুত্র) ও সুন্দরশুভম (পুত্র)
ছবি আঁকায় পূর্ব আর পশ্চিমের স্টাইল মিলিয়ে নিজের দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বেঙ্গল স্কুল-এর শিল্পচিন্তা থেকে দূরে সরে এসে নীরদ মজুমদার প্রদোষ দাশগুপ্ত, গোপাল ঘোষ, পরিতোষ সেন, কমলা দাশগুপ্ত , রথীন মৈত্র, প্রাণকৃষ্ণ পাল প্রমুখ তরুণ শিল্পীদের নিয়ে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে গঠন করেছিলেন ক্যালকাটা গ্রুপ। দক্ষ কলাকুশলী শিল্পী বংশীচন্দ্র সেনগুপ্তকে তিনিই আবিষ্কার করেন কাশ্মীরে। আর্ট কলেজে পড়ার সময় 'চতুরঙ্গ' পত্রিকার চার-পাঁচ সংখ্যা তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। ত্রিশের দশকে তার সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা 'ভবিষ্যৎ' ও সচিত্র সাপ্তাহিক পত্রিকা 'অগ্রগতি' তে তার নিজস্ব ধারার দুঃসাহসিক লেখা, ছবি, পরিকল্পনা ও অঙ্গসজ্জার অভিনবত্ব ও চমকপ্রদ ছিল। তবে সাময়িকপত্রের ইতিহাসে তার শ্রেষ্ঠ অবদান শিল্পকলা সংক্রান্ত পত্রিকা " সুন্দরম"। কবি হিসাবেও পরিচিতি লাভ করেন। কবিতায় 'অগ্রমিল ছন্দ' নামে এক নতুন ছন্দ করেছিলেন। অনেক সময় নিজেকে তৃতীয় ব্যক্তি হিসাবে ধরে নিয়ে লেখা শুরু করতেন। কারুশিল্পে আকৃষ্ট হয়ে তিনি এক বিশিষ্ট কারুশিল্প সংগ্রাহক হয়ছিলেন। [১] অনাদরে, অবহেলায় পড়ে থাকা জিনিস ছবি, মূর্তি, পট, পাটা থেকে পুরোনো আসবাব, ঝাড় লণ্ঠন, দোয়াত-কলম, দুষ্প্রাপ্য বিরল ইঙ্ক পট, মুঘল আমলের হুকা সিগারেট, চুরুটের পাইপ, পুরোনো মানচিত্র, মনীষীদের চিঠি — এরকম অদ্ভুত সব সংগ্রহে সমৃদ্ধ ছিল তার বাড়ি। কারুশিল্পের প্রতি আকর্ষণ ও অভিজ্ঞতার জন্য তিনি ভারত সরকার তাঁকে অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডিক্র্যাফস বোর্ডের পূর্বাঞ্চলের অধিকর্তা নিয়োগ করেন। কিন্তু তিনি তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ নিয়ে সংগ্রহশালা তৈরি করতে পারেননি। [৩] এবং এক সময় তাঁকে ও তার শিল্প নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে - 'আর্ট অব সুভো ঠাকুর' সংকলন গ্রন্থে। শান্তি চৌধুরী 'দ্য লোনলি পিলগ্রিম' নামে তার এক জীবনীচিত্র তৈরি করেন।
রচনা কর্ম :
মায়ামৃগ
নীলরক্ত লাল হয়ে গেছে
অলাতচক্র
অতন্দ্র আলতামিরা
প্যানসি ও পিকো ।
সুভো ঠাকুর ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ই জুলাই ৭৩ বৎসর বয়সে কলকাতায় প্রয়াত হন।
সাত দশকের জীবনকালে তার পরিচয় চিত্র শিল্পী, কবি, পত্রিকা সম্পাদক ও শিল্প সংগ্রাহক হিসাবে।
প্রাকৃতিক নিয়মে ঠাকুরবাড়ির দালানের থামগুলো কম্পিত না হলেও তিনি ভূমিকম্পের ন্যায় তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্যের ভিত কাঁপিয়ে বিদ্রোহের পতাকা নিয়ে নেমে এসেছিলেন পঁচিশ টাকা ভাড়ার ভবানীপুরে ইঁদুরের আরামের অধম অতি সামান্য এক ব্যারাক বাড়িতে। সমীর সেনগুপ্ত তাঁর রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন বইতে লিখেছেন সুভো ঠাকুর ‘তাঁর শেষ জীবনে লেখা স্মৃতিকথা বিস্মৃতিচারণা-য় প্রকাশ পেয়েছে ঠাকুরবাড়ির বিরুদ্ধে কুরুচিকর ক্ষোভ।’ সুভো ঠাকুরের ভাষায় ‘আত্মীয়স্বজনের দ্বারা বংশের কালাপাহাড় এই খ্যাতি চিহ্নের দাগ পড়েছিল তার শিড়দাঁড়ায়।’ সুভো ঠাকুরকে কেন ঠাকুরবাড়ির ‘কালাপাহাড়’ বা ‘ব্ল্যাকশিপ’ বলা হত তার উত্তর তাঁর বিস্মৃতিচারণা-র পাতাতে স্পষ্ট।
সরলাদেবী চৌধুরাণী তাঁর আত্মস্মৃতি জীবনের ঝরাপাতা বইতে লিখেছেন — ‘সেজমামার ছোটো ছেলে ঋতুদার অংশ একজন মাড়োয়ারির কাছে বিক্রিত। … এগারই মাঘের উপাসনা ও গান যখন চলছে ঠিক সেইসময় সেই অংশের ছাদ ও খড়খড়ি বেয়ে মাড়োয়ারি গিন্নির উনুন জ্বালানোর ধোঁয়া ও ফোড়নের গন্ধ উঠোনে চলে আসে। আর নিচের তলায় উঠোনের গা-সংলগ্ন বাড়ির ভিতরমুখো সব অন্ধকার ঘরগুলি খোট্টা ও দেশি-বিদেশী ভাড়াটেতে ভরা।’ সুভো ঠাকুরের এই কাজের পিছনে তাঁর যুক্তি হল তিনি তাঁর প্রপিতামহ মহর্ষির পদাঙ্ক অনুসরণ করে পিতৃঋণ থেকে মুক্ত হবার পরিকল্পনায় তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তাঁর অংশ হস্তান্তরিত করেছিলেন। পিতৃঋণ থেকে মুক্ত হওয়া ছাড়া এই কাজের পিছনে সুভো ঠাকুরের একটি দার্শনিক সুনিশ্চিত মতবাদও ছিল। তাঁর মতে একটা বাড়ি কিছুতেই বাঁচতে পারে না তার বাসিন্দাদের ব্যক্তিত্ব ব্যতিরেকে। কারণ কোনো বিখ্যাত বাড়ি ইঁট চুন সুরকির সমষ্টি মাত্র নয়। তার প্রাণধর্ম অপ্রতিহত রাখতে হলে অর্থাৎ তাকে জীবন্ত করে ধরে রাখতে হলে চাই সেইরকম সব মহান ব্যক্তিত্বপূর্ণ পুরুষ, যা সুভো ঠাকুরের মতে সেই সময়ের জোড়াসাঁকোতে ছ’নম্বরে নিঃশেষিত প্রায়।
সুভো ঠাকুরের ছবির জগতে আসার আগে তার জমি অনেক আগেই কর্ষণ করেছিলেন তাঁর পূর্বসুরীরা। সলতে পাকিয়েছিলেন এবং প্রদীপও জ্বালিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের নির্দেশিত ‘বাহুর জোরে ছবি’ এঁকেছিলেন গুণেন্দ্রনাথ, ‘ওরিন ঠাকুর ছবি লিখেছিলেন’, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং সর্বশেষ রবীন্দ্রনাথ যাঁর ছবি সম্পর্কে অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন — ‘ওগুলোতো ছবি নয়, যেন আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎসার।’ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতীয় চিত্রাঙ্কণ রীতির পুনরুদ্ধারে এবং ভারতীয় চিত্রশিল্পের নব জন্মদাতারূপে গণ্য হন। গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের ছোটবোন সুনয়নী দেবী আধুনিক শিল্পকলার অন্যতম প্রধান নারী চিত্রশিল্পী। রবীন্দ্রনাথ প্রায় প্রৌঢ় বয়সে আঁকা শুরু করেছিলেন এবং সর্বোপরি কোনো প্রথাগত শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে না থেকে আধুনিক ভারতীয় চিত্রাঙ্কণ ধারায় এক নতুন পথের পথিক। সুভো ঠাকুর তাঁর পূর্বসুরীদের শৈল্পিক জুতোতে পা গলায়েও তিনি ঠাকুর পরিবারের ঐতিহ্য ও পরম্পরায় এক বিদ্রোহী চিত্রশিল্পী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে প্রয়াসী ছিলেন। ছবি আঁকায় তাঁর নিজস্বতার স্বাক্ষর রয়েছে। পূর্ব আর পশ্চিম মিলিয়ে সম্পূর্ণ নতুন স্টাইল তাঁর। দু’বছর সরকারী আর্ট স্কুলে পড়েছেন। তাঁর মানসগুরু যামিনী রায়। আর এক গুরু ঈশ্বরীপ্রসাদ। চিত্রশিল্পী সুভো ঠাকুর শুধু ছবি আঁকেননি, পাশাপাশি শিল্পকলার ব্যবহারিক দিকেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। বস্ত্রবুননের মধ্যে চিত্রকলার রূপবন্ধনে এক অন্যমাত্রিকতায় তাঁর সৃষ্টিতে প্রকাশ পেতে থাকে। চিত্রশিল্পে এক নতুন প্রয়াসকে উপস্থাপন করেন — ‘ছোট ছোট বর্গাকার খণ্ড দিয়ে, প্রায় জ্যামিতিক শৃঙ্খলে প্রতিকৃতি রচনায় সফলকাম হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় পরম্পরায় কারুকলার সমঝদার। তাঁর ছবিতে এই কারুশিল্পীর শৃঙ্খলাবোধের সঙ্গে অলঙ্করণ প্রীতিও যুক্ত রয়েছে।’
বেঙ্গল স্কুল-এর শিল্পচিন্তা থেকে দূরে সরে এসে প্রদোষ দাশগুপ্ত, গোপাল ঘোষ, পরিতোষ সেন, কমলা দাশগুপ্ত প্রমুখ কয়েকজন তরুণ শিল্পী ১৯৪৩ সালে গঠন করেছিলেন ক্যালকাটা গ্রুপ । সুভো ঠাকুর এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। যদিও রামকিঙ্কর ছিলেন প্রধানতম, তবে তিনি ছিলেন গ্রুপের আমন্ত্রিত সদস্য। দক্ষ কলাকুশলী শিল্পী বংশীচন্দ্র সেনগুপ্তকে তিনিই আবিস্কার করেন কাশ্মীরে। এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠার পেছনে ব্যাপকভাবে সক্রিয় ছিল কলাশিল্পের ভাষাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার আলোকে শক্তিশালী করা এবং তার সম্প্রসারণ ঘটানো। যে সময় এই গ্রুপটির প্রতিষ্ঠা ১৯৪৩ সালে, সেই সময় চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পরাধীন ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে ব্যাপক রাজনৈতিক আন্দোলন। তৎকালীন সময়ের যে ভয়ানক খরা দেখা দেয় যা গ্রামগঞ্জের হাজারো মানুষকে সর্বসান্ত করে দিয়েছিল সেই খরার ভয়ানক রূপ দেখে জন্ম ক্যালকাটা গ্রুপ অব আর্টিস্ট । এই গ্রুপের সদস্যরা মানবিক আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এই গ্রুপের জীবৎকাল মাত্র দশবছর। ১৯৪৩ থেকে ১৯৫৩। তার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হলেও সুভো ঠাকুরের গ্রুপের প্রতি আকর্ষণ ও আস্থা হারানোর কারণ বোধ হয় প্রতিবাদী মানসিকতার এক শিল্পীর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র গৌণ হয়ে যাওয়া। প্রতিবাদী শিল্পী সুভো ঠাকুর চিরাচরিত পথে না হেঁটে আপন পথের সন্ধান করেছেন। তাঁর কাজ জওহরলাল, নেতাজি সুভাষ ও রবীন্দ্রনাথের সমকালীন বহু পরিচিত প্রতিকৃতিগুলিকে প্রকাশ করছিলেন বস্ত্র বুননের মাধ্যমে এক নতুন নিজস্ব আঙ্গিকে। সুভো ঠাকুরের তুলনা সুভো ঠাকুর নিজেই। শিল্প ইতিহাসবেত্তা ও. সি. গাঙ্গুলি যথার্থই বলেছেন — ‘Subho Tagore has made able attempts to recover Indian painting and to make it run on new paths. He has scrupulously avoided any imitation or repetition of the manners of Dr. Abanindra Nath Tagore. He has, therefore, been a Tagore without being a Tagorite, an Indian artist without the archaisms of old Indian art, yet without loving the aroma and flavor of it Indianness.’
=================================
No comments:
Post a Comment