"আমাকে কিছু না কিছু লিখতেই হবে এবং লেখার মলম দিয়ে সব রকমের দুঃখের যত নিরাময় করতে হবে। লেখা আমার অস্থিমজ্জার সঙ্গে জড়িত। আমিই লেখা।’
অথবা
‘আমি যেভাবে থাকি না কেন তাতেই আমি খুশি এবং সেই পরিবেশেই আমাকে লিখতে হবে। লেখা আমার পানীয়ের সঙ্গে তালিকাভুক্ত। আর আমার লেখা সম্পর্কে যে যা খুশি বলুক তাতে আমি পরোয়া করি না। আমি স্থির জানি, আমার লেখা সমগ্র প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকবে- যেমন একাত্ম হয়ে আছি আমি এই প্রকৃতির সঙ্গে।’
(১৯২৭-২০০০) অজস্রপ্রসূ ও বহুমুখী প্রতিভাধর লেখক। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, নৃতাত্বিক গবেষক, ভাষাবিদ, অনুবাদক, শিশুতোষ সাহিত্য রচয়িতা, সম্পাদক, স্মৃতি কথক এমনকি কলাম লেখক ছিলেন। ইংরেজি ভাষাসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ভাষায় ছিলেন সুদক্ষ। বিশেষ করে আরবি, ফারসি, উর্দু, তুর্কি ভাষার ওপর তাঁর ছিল দখল। এসব ভাষার সাহিত্য থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে তিনি অনুবাদক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাছাড়া তার বাংলাদেশের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ওপর নৃতাত্বিক গবেষণা এক সমৃদ্ধ ভুবন হিসেবে দেশ-বিদেশ কর্তৃক বহু স্বীকৃত। তাই, এমন বিশাল প্রতিভাধর ব্যক্তি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করতে যাওয়া মোটেই সহজসাধ্য নয়। এ সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করেই বক্ষ্যমান প্রবন্ধের বিস্তার।
১৯৪৩ সালে ‘দৈনিক আজাদ’-এর ‘মুকুলের মাহফিলে’র পৃষ্ঠায় তার প্রথম ছড়া এবং ১৯৪৫ সালে ‘মাসিক মোহাম্মদী’তে প্রথম কবিতা দিয়ে তার যাত্রা। তারপর থেকে তিনি বিরামহীন লিখে গেছেন। সৃষ্টিশীলতা, গবেষণা, ভ্রমণ যখন যে বিষয় এবং উপলক্ষ হোক তিনি তার লেখনী চালিয়ে গেছেন। এভাবে লিখতে লিখতে তিনি শতাধিক গ্রন্থের প্রণেতা হয়েছেন। তার ভাষায়, ‘সবিনয়ে বলছি, বর্তমানে (১৯৯৭) আমার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১১৭।’ এটি রীতিমত অকল্পনীয় বৈকি! চাকরি, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব, সমাজ ও অন্যান্য বিষয়ে সম্পৃক্ততা রেখে কিভাবে এতগুলো গ্রন্থের প্রণেতা হলেন, তা কবির ভাষ্য থেকে আমরা জানতে পারি।
১৯৪৩ সালে ‘দৈনিক আজাদ’-এর ‘মুকুলের মাহফিলে’র পৃষ্ঠায় তার প্রথম ছড়া এবং ১৯৪৫ সালে ‘মাসিক মোহাম্মদী’তে প্রথম কবিতা দিয়ে তার যাত্রা। তারপর থেকে তিনি বিরামহীন লিখে গেছেন। সৃষ্টিশীলতা, গবেষণা, ভ্রমণ যখন যে বিষয় এবং উপলক্ষ হোক তিনি তার লেখনী চালিয়ে গেছেন। এভাবে লিখতে লিখতে তিনি শতাধিক গ্রন্থের প্রণেতা হয়েছেন। তার ভাষায়, ‘সবিনয়ে বলছি, বর্তমানে (১৯৯৭) আমার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১১৭।’ এটি রীতিমত অকল্পনীয় বৈকি! চাকরি, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব, সমাজ ও অন্যান্য বিষয়ে সম্পৃক্ততা রেখে কিভাবে এতগুলো গ্রন্থের প্রণেতা হলেন, তা কবির ভাষ্য থেকে আমরা জানতে পারি।
তাঁর সরল উচ্চারণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় একজন কমিটেড লেখক সত্বা। তিনি জীবনের মৌল লক্ষ্য হিসেবে লেখাকে অবলম্বন করেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একাগ্র, নিষ্ঠাবান, সরলরৈখিক, সৎ এবং পরিশ্রমী। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তার মেধা, ধীশক্তি। সবচেয়ে বড় গুণটি ছিল, তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন অত্যন্ত পরিপাটি। গোছানো, নৈয়ায়িক এবং ধর্মভীরু। সাধারণত বড় লেখদের মধ্যে এসব গুণের উপস্থিতি কমই দেখা যায়। আরও একটি গুণপনা তার চরিত্রে ছিল, তা জনপ্রিয় করেছিল- তাহলো, হাস্যরসিক, রম্যবোধন ও তীক্ষè বুদ্ধিদীপ্ততা। তিনি সব সময় আনন্দময় থাকতেন, হাসি তার মুখ হতে কেউই কেড়ে নিতে পারতে না। যারাই কবি আবদুস সাত্তারের সাহচর্য পেয়েছেন তার সহজ সরল আন্তরিক ব্যবহার ও আকর্ষণ করার মত বাচনিকতায় মুগ্ধ না হয়ে পারেনি।
আগেই বলেছি, আবদুস সাত্তার বহুপ্রজ লেখক। এতদসত্ত্বেও তার যাত্রা হয়েছিল কবিতা দিয়ে এবং পঞ্চাশের দশকের অন্যতম কবি হিসেবে তার স্থানটি স্বীকৃত। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১০টি। তিনটি অনুবাদ কাব্যগ্রন্থও রয়েছে।
ষাটের দশকের সাহিত্য গবেষক কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের ভাষায় ‘বিচিত্রমুখী প্রবণতার মধ্যে আবদুস সাত্তার মুখ্যত কবি। পঞ্চাশের দশকের অন্যতম প্রধান কবি তিনি। গত চার দশক দরে তার উৎসারিত কবিতা এক জায়গায় থেমে থাকেনি- ক্রম পরিবর্তিত হয়েছে।’
আবদুস সাত্তারের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বৃষ্টিমুখর’ প্রকাশ হয় ১৯৫৯-এ। এ কাব্যগ্রন্থটি পরে ১৯৬৯ ও ১৯৭৫ তিনবার মুদ্রিত হয়। নিঃসন্দেহে একজন কবির জন্য একটি সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। তার অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলো যথাক্রমে-
১. বৃষ্টিমুখর,
২. আমার ঘর নিজের বাড়ী,
৩. অন্তরঙ্গ অনুভূতি,
৪. নামের মৌমাছি,
৫. দি ইনটিমেন ভয়েস (ইংরেজি),
৬. আমার বনবাস,
৭. আমার বাবা-মা’র ক্বাসিদা,
৮. পবিত্র নামের কাব্য,
৯. বিস্বিত স্বরূপ,
১০. আবদুস সাত্তার ও অন্যান্য কবিতা।
অনুবাদ কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে:
১. বালি ও ফেনা (আরবী),
আরবী কবিতা,
৩. আরবী ফারসী তুর্কী কবিতা।
কবি সম্পর্কে বিশিষ্টজনদের মধ্যে কয়েকজনের মত উল্লেখ করা হলো।
ড. আশরাফ সিদ্দিকী বলেন,
" কবির জন্ম টাঙ্গাইলের ‘ছায়া ঢাকা পাখি ডাকা’ গ্রামে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উদার আবেদন যে কবির কাব্যে একটি প্রধান স্থান হয়ে উঠেছে এ জন্য দায়ী তার এই পটভূমি। তারপর নাগরিক কালচার তার সেই মানস পলিমাটিতে নতুন ক্রিসানথিমাম ফুটিয়েছে। আর এটাই স্বাভাবিক ছিল। আবদুস সাত্তার যে মনে প্রাণে রোমান্টিক তা তার বহর সব কবিতাতেই দেখা যাবে।’
কবি ফজল শাহাবুদ্দীন বলেন,
‘... প্রকৃতির প্রতি কবির একটি বিশেষ পক্ষপাত আছে। আলোচ্য গ্রন্থের প্রায় সবগুলো কবিতাই আসলে প্রকৃতির কবিতা। মাঝে মাঝে প্রকৃতির বর্ণনায় আবদুস সাত্তার অপূর্ব পঙ্ক্তি রচনা করেছেন যা পাঠককে মুগ্ধ করে।
ফখরুজ্জামান চৌধুরী বলেন,
‘আবদুস সাত্তার মূলত চিত্রধর্মী কবি। কবিতায় তিনি চিত্র অঙ্গনের দিকেই বেশি মনোযোগী।’
আবদুস সাত্তারের মধ্যে একটা নস্টালজিক বোধ সব সময় সক্রিয় ছিল বটে তা শুধুমাত্র প্রকৃতি ঘনিষ্ট এমন নয়। ঐতিহ্য ও স্বধর্মপ্রীতিও অনেকটা জুড়ে ছিল তার মানসে। তার কাব্যে- বেড়ে ওঠা স্থান, মাতৃ পিতৃ ¯েœহ, নিজ সন্তান বাৎসল্য, ঐতিহ্যসমৃদ্ধ বিষয়-আশয়, আল্লাহ্ ও রাসূলের প্রতি ঈমান অত্যন্ত সাহজিক অথচ নান্দনিকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তার ‘আমার বাবা মা’র ক্বাসিদা। কাব্যগ্রন্থটিতে একক দীর্ঘ কবিতা স্থান পেয়েছে। যার ভেতর তিনি চিরকালীন ভালোবাসা, ঐতিহ্য ও মানবিকতার মৌল বিষয়সমূহ উত্থাপন করেছেন। উদ্ধৃতি:
"সেই ভালো ফিরে যাবো গ্রামের নিভৃতে
যেখানে মোমের মতো শিয়রে মায়ের ¯েœহ জ্বলে,
সিতার অনন্ত প্রেম বিস্তৃত মাঠের
শ্যামল শস্যের চারা, দিনে দিনে বাড়ে
ঘাসের সবুজে ঘন আকাশের নীল
আর প্রাণের সুষমা;
(সেই ভালো, বৃষ্টিমুখর)
আবদুস সাত্তার -
"একজন বিশ্বাসী হৃদয়ের কবি ছিলেন। আল্লাহ্র প্রতি ছিল তার অকুণ্ঠ আস্থা ও বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের কথা অকপটে তিনি কবিতায় ব্যক্ত করেছেন। তার অষ্টম কাব্যগ্রন্থ ‘পবিত্র নামের কাব্যে’ বাঙলা ভাষায় লিখিত ইসলামী আদর্শকেন্দ্রিক কাব্যগ্রন্থের সারিতে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। অধিকাংশ কবিতাই যেভাবে সনেট আঙ্গিকে আবদ্ধ তেমনি প্রতিটি কবিতায় ইসলামী চিন্তা-চেতনা-বিশ্বাস ও ঈমানী শক্তির উদ্বোধন ঘটেছে অত্যন্ত কাব্যিক গঠন রক্ষা করে।
উদ্ধৃতি:
ক . সৃষ্টিও সৃষ্টির এক সমন্বয় ‘আহমদ’ নামে
এবং এ নাম ঘিরে আল্লাহ্র তারিফ, সবকিছু;
সৃষ্টির প্রতীক মিম আহাদের কাছে হলে নীচু
সমগ্র সৃষ্টিই পাবে আহাদকে তাবিদের দামে।
(আহমদ, পবিত্র নামের কাব্যে)
খ. মিম যদি নতজানু তাহলে হাম্দ শুধু দেখে
হৃদয়ের আলো জ্বেলে সবখানে অলৌকিক নাম,
যে নামের গুণ গায় রাত্রি দিন পবিত্র কালাম-
সে কালাম সর্বক্ষণ সৃষ্টির রহস্যে লেগে।
(মুহম্মদ, পবিত্র নামের কাব্যে)
আবদুস সাত্তার যে বিষয়কে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি শ্রম ও সময় দিয়েছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি তা হলো- বাংলাদেশে বসবাসকারী ‘পাহাড়ি’ জনগোষ্ঠীর ওপর বিস্তৃত নৃতাত্ত্বিক গবেষণা। তিনি এ বিষয়ে একাডেমিক ছিলেন না। নিতান্ত চাকরির দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থানকালে উৎসাহী হন এদের ব্যাপারে কাজ করতে। তিনি যে কাজটি করেছেন, নৃতাত্বিক দৃষ্টিতে একটি মৌলিক গবেষণা হিসেবে নন্দিত। এ সংক্রান্ত তাঁর প্রথম সুপরিসর গ্রন্থ ‘আরণ্য জনপদে’ (১৯৬৬) ।
উপজাতিদের নিয়ে বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। ইংরেজি ও বাং!লা মিলিয়ে ১৯টি। এসব গবেষণাধর্মী গ্রন্থগুলো বাংলাদেশের উপজাতিদের সঙ্গে দেশে-বিদেশে জানার উপায় রয়েছে। এখনও পর্যন্ত তার গবেষণালব্ধ তথ্য ও তত্ব উৎসাহী গবেষকদের কাজে লাগছে।
আবদুস সাত্তার বলয়কেন্দ্রিক ছিলেন না। তিনি কোন রাজনৈতিক মতাদর্শে তাড়িত হননি। এর ফলে তাকে পাশ কেটে চলার প্রবণতা অনেকটা নিঃসঙ্গ করে তোলে শেষ বয়সে। আর মূল্যায়ন, পুরস্কার ইত্যাদির ক্ষেত্রেও তার পাতে টান পড়েছে বরাবর।
আবদুস সাত্তারের জীবনে সবচেয়ে যে পুরস্কারটি তার আনন্দ ও উৎসাহের উপলক্ষ হয়েছিল তা ‘অরণ্যে জনপদে’ গ্রন্থের জন্য ১৯৬৬-এ ‘দাদউদ সাহিত্য পুরস্কার’ প্রাপ্তি। গ্রন্থটি প্রকাশ করতে গিয়ে বন্ধুকবি জামালউদ্দিন মোল্লার জমি বিক্রি করা টাকায় সংকুলান না হওয়ায় কাবুলিওয়ালার কাছ থেকে চড়া সুদে ধার নিয়ে গ্রন্থটি প্রকাশ করতে হয়েছিল। ঐ পুরস্কারের টাকা দিয়ে ধার শোধ করে কবি পান নিস্তার কাবুলিওয়ালার নিগ্রহ থেকে।
পুরস্কার
বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৫),
আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮০), বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার (জাতিসংঘের সৌজন্যে ১৯৮৬),
আশরাফ ফাউন্ডেশন সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), টাঙ্গাইল জেলা সমিতি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬) প্রভৃতি.
এছাড়া পদক পেয়েছেন আলবার্ট আইনস্টাইন একাডেমি ব্রোঞ্জ পদক (১৯৯০),
ঢাকা পৌরসভা পদক (১৯৭৫),
তারুণি সাহিত্য শিল্পীগোষ্ঠী পদক (১৯৬৮) প্রভৃতি।
No comments:
Post a Comment