জোতির্ম্ময়ী দেবী
স্মরণীয় থাকবেন বাংলা উপন্যাসের ভৌগোলিক পরিধি বিস্তার দানের জন্যে ; নারীদের চোখ দিয়ে পুরুষশাসিত সমাজের সনাতন রূপটিকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্যে ।স্বামী কিরণ চন্দ্র সেন ছিলেন পাটনা কোর্টের উকিল। ১৯১৮ সালে (শতবর্ষ আগে ঘটে যাওয়া ইতিহাস খ্যাত মহামারীতে) ইনফ্লুয়েঞ্জায় মৃত্যু হয় তাঁর। ২৫ বছর বয়সে সদ্য বিধবা যুবতী জ্যোতির্ময়ী ছ’ ছ টা ছেলে মেয়ে কোলে – পিঠে নিয়ে ফিরে আসেন জয়পুরে। পিত্রালয়ে। অকালবৈধব্যের নিঃসঙ্গতায় শুরু হয় আত্মসমীক্ষা – এ জীবন লইয়া কী করিব? নিবিড় পাঠাভ্যাস, কবিতা রচনা এবং সমকালীন রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে ঢেউ ভাঙার খেলায় মেতে ওঠেন তিনি।
জন্ম- ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে রাজস্থানের জয়পুরে। তাঁর পরিবার ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ হতেই রাজস্থানে ছিলেন। জয়পুর রাজ্যের দেওয়ান অবিনাশচন্দ্র সেন ছিলেন তাঁর পিতা আর পিতামহ সংসারচন্দ্র সেনের জ্যেষ্ঠপুত্র। পিতামহ সংসারচন্দ্র স্কুলশিক্ষক হয়ে জয়পুর আসেন এবং পরে জয়পুর রাজের দেওয়ান হয়ে যান। জ্যোতির্ময়ী জয়পুরের পরিবেশে নিজ পর্যবেক্ষণ শক্তিতে অল্প প্রথাগত শিক্ষা লাভ করেন। সে সময়ের রাজ পরিবারের মহিলা মহলে নারীদের অবস্থান আর সামাজিক পরিস্থিতি, রক্ষণশীলতা তার মনে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তবে তাদের প্রবাসী পরিবারে সেকালের নিয়মমতো রক্ষণশীলতা আর পর্দাপ্রথা থাকলেও বাড়িতে পড়াশোনার আবহাওয়া ছিল। পিতামহের গড়ে তোলা বিশাল গ্রন্থাগার ছিল তার অত্যন্ত প্রিয়। যা চাইতেন তাই পড়তে পারতেন। আর ফলে তিনি অনেক সারগ্রাহী জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছিলেন। ১০ বৎসর বয়সে হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার সাহিত্যপ্রেমী ও অভিজাত পরিবারের আইনজীবী কিরণচন্দ্র সেনের সঙ্গে তার বিবাহ হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে তার স্বামী ইনফ্লুয়েঞ্জায় মারা যান। ২৫ বৎসর বয়সে অকাল বৈধব্যে ছয় সন্তানের ( অমিয়, অনুভা, অরুণচন্দ্র, অশোকা, অমিতাভ ও অঞ্জলি) জননী এক সন্তানকে স্বামীর পরিবারে রেখে পিত্রালয়ে ফিরে আসেন। গোঁড়া হিন্দু বিধবার কঠোর নিয়মে জীবন যাপন করতে থাকেন এবং এতে সান্ত্বনা পেতে নতুন উদ্যমে পড়াশোনা শুরু করেন। পিতামহের সংগ্রহ হতে জন স্টুয়ার্ট মিলের লেখা " অন দি সাবজেক্টাসান অব উইমেন" বইটি মহিলাদের অধিকার সম্পর্কে লিখতে অনুপ্রাণিত করে। বাস্তবে নিজের আচরণে রক্ষণশীল হয়ে, তিনি সর্বদা তার পুত্র ও কন্যাদের সাথে সমান আচরণ করতেন। প্রতিবাদী, স্পষ্ট ভাষায় বহু ছোটগল্প রচনা করে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। রাজস্থান, দিল্লি এবং বাংলায় অবস্থান কালে তিনি নারীর চিরন্তন সমস্যা নিয়ে নানাদিক থেকে বিশদে ভেবেছেন, সহানুভূতিশীল হয়ে তিনি তার ছোটগল্প ও উপন্যাসে রূপ দিয়েছেন ঐকান্তিক নিষ্ঠায়। বিশেষত মহিলা ও দলিতদের অধিকার নিয়ে অ-কল্পকাহিনী রচনা করেছেন। লেখার জগতে তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছিলেন তার বন্ধু কবি কান্তিচন্দ্র ঘোষ। তার একটি কবিতা ও 'নারীর কথা' নামে একটি প্রবন্ধ কান্তিচন্দ্র 'ভারতবর্ষ' পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।(জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ়, ১৯২১) ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ হতে তার লেখা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। বাংলা সাহিত্যে তার প্রথম প্রবেশ কবিরূপেই। প্রথম জীবনে প্রচুর কবিতা লেখেন, পরবর্তীকালে গল্প। প্রথম দিকে "সুমিত্রা দেবী " ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন।
তার কবিতা ও ছোটগল্প সকলের বোধগম্যের জন্য সহজ ও সরল ভাষায় রচিত হয়েছে। কিন্তু প্রকাশের ভঙ্গি ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। তার রচনার কোথাও জটিল শব্দের প্রয়োগ নেই। এটিই ছিল তার রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। স্বামী বিবেকানন্দর বাণী সমূহ তার লেখায় যথাযথ স্থান পেয়েছে। বাস্তবের প্রেক্ষাপটে, অভিজ্ঞতা ও শিক্ষায় তার লেখা চিত্রিত হয়েছে। তার প্রথাগত শিক্ষার অপ্রতুলতা কিন্তু অন্তরায় হয় নি বরং অন্যদের কাছে এটি এক দৃষ্টান্তস্বরূপ। সাহিত্য সমালোচক শিশির কুমার দাশ উল্লেখ করেছেন- বহির্বাংলা, বিশেষত রাজস্থানের মানুষ ও সমাজের ছবি ছিল তার গল্পের প্রধান উপকরণ। বাংলা সাহিত্যের ভৌগোলিক সীমাকে তিনি যথার্থই প্রসারিত করেছেন - "সেই কারণে", তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, তার সাহিত্যকর্মকে
"অনন্য সাহিত্যকীর্তি বলে অভিহিত করতে পারি"
রচনাবলী
গ্রন্থগুলি হল :
চক্রবাল' (কবিতাগুচ্ছ)
'বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ' (উপন্যাস) (১৯৪৮)
'মনের অগোচরে' (উপন্যাস)(১৯৫২)
'আরাবল্লীর কাহিনী' (ছোটোগল্প)(১৯৬৫)
'এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা' (উপন্যাস) (১৯৬৮)
'সোনারূপা নয়' (ছোটোগল্প) (১৯৬৯)
'ছায়াপথ'
'রাজযোটক'
'আরাবল্লীর আড়ালে'
'ব্যান্ড মাস্টারের মা'
'সময় ও সুকৃতি'
'রাজারানীর যুগ'
'নারীর অধিকার'
'চিরন্তন নারী জিজ্ঞাসা'
'স্মৃতি-বিস্মৃতির তরঙ্গ'
ভারতের মাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থা দিল্লির ইন্ডিয়ান সার্টিফিকেট অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন তাদের মাধ্যমিক স্তরের বাংলা পাঠ্যপুস্তকে তার রচিত গল্প "ডাইনি" অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ ছাড়াও তার রচিত বহু গল্প ইংরাজী সহ অন্য ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
সম্মাননা ও পুরস্কার
তার সাহিত্য রচনার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক লাভ করেন।
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি গল্প সংগ্রহ "সোনা রূপা নয়" গ্রন্থের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ তাঁকে 'হরনাথ ঘোষ স্মৃতি পদক' প্রদান করে।
১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দ হতে তিনি আমৃত্যু কলকাতার শ্যামবাজারের বসবাস করতেন। তার এক কন্যা সমাজসেবী অশোকা গুপ্ত ছিলেন দাঙ্গা-পীড়িত নোয়াখালীতে মহাত্মা গান্ধীর পদযাত্রায় অন্যতম সঙ্গী। জ্যোতির্ময়ী দেবী ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর কলকাতায় প্রয়াত হন।
জ্যোতির্ময়ী নিজের জীবনে বাল্যবিবাহের কারণে যে স্ত্রী শিক্ষার অভাব অনুভব করেছেন, সেই স্বপ্ন গুলিকে সফল করতে বেছে নিয়েছেন সৃষ্ট স্ত্রী চরিত্র গুলিকে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ছায়াপথ’ এর নায়িকা সুপ্রিয়া সেই নবজীবনের চেতনায় উদ্ভাসিকা। পিতার অকাল মৃত্যুতে সুপ্রিয়ার পরিবার আর্থিক সংকটে পড়ে। তার পূর্ব প্রণয়ী অজিত তখন তাকে ছেড়ে বাবা-মার বাধ্য ছেলেটি হয়ে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করে। এবার সুপ্রিয়ার অন্তরাত্মা জেগে ওঠে। সে বিদ্রোহী হয়। বিরক্তি ও গ্লানিতে ভরে ওঠে তার মন:
আমাকে আর তোমরা সাজিয়ে গুজিয়ে কনে দেখিয়ে কিংবা বড়লোক, গহনাগাঁটির লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশ ভরা এরকম সৎপাত্র দেখিয়ে বিয়ে দিতে পারবে না। আমিই যদি কোনদিন বিয়ে করি, এরকম সৎপাত্রকে করবো না, পুরুষ মানুষকে করব। মনিকা হাসলে, ‘মানে ওরা কি সব মেয়ে মানুষ?’ সুপ্রিয়াও হাসলে, ‘না তারও চেয়ে বেশি, ওরা ছেলেমানুষ।’
‘বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ’ উপন্যাসের নায়ক নীতীশের মনে ব্যক্তিগত বঞ্চনা আর রাষ্ট্রিক বঞ্চনার মধ্যে সমান দরদের ঠাঁই করে নেয় – নারীর অবমাননাও। তাই গান্ধীজির ডান্ডি অভিযানে শামিল হওয়া কালো মেয়ে বীণা নীতিশের ‘নিরঙ্কুশ’ এবং ‘মুক্ত’ সঙ্গী হয়ে ওঠে। জীবনের অনেকটা সময় দুটি পর্যায়ে রাজস্থানে কাটিয়েছেন তিনি। স্বভাবতই তাঁর লেখায় বাংলাদেশের পাশাপাশি রাজপুতানার সমাজ, আচার-অনুষ্ঠান, সমস্ত সংসারে ভরা জীবনের জলছবি ফুটে উঠেছে। ‘বেটি কি বাপ’ ছোটগল্পের পরিণতি কি মর্মান্তিক!
পর পর পাঁচটি নাতনি হওয়ায় অসন্তুষ্ট ঠাকুমা নিজের ছেলের অসুস্থ শিশুকন্যা পদ্মিনীকে আফিম খাইয়ে মেরে ফেলে। ‘লালজী সাহেব’ গল্পটি কাহিনীর অভিনবত্বে অসাধারণ। রাজবাড়ীর দাসী বাঁদি রক্ষিতাদের গর্ভজাত পিতৃপরিচয়হীন সন্তানদের বলা হতো ‘লালজী’। বাকিটা উহ্য রাখা হল – প্রিয় পাঠক, পড়ে নিতে হবে মূল গল্পটি। আর একটি অপূর্ব গল্প ‘পিঁজরাপোল’। কাশীর বাঙালি বিধবা রমণীদের কথা। ‘মর্ত্যের অপ্সরা’ গল্পের শুরু ‘চাঁপাদাসী’র মৃত্যু দিয়ে।কিন্তু তার শবদেহ কেউ কাঁধে তুলবে না। যে পুরুষের যৌনপিপাসা সে মিটিয়েছে এতদিন, তাদের কাছে তার আজ অস্পৃশ্য – কেন না সে যে ছিল বেশ্যা!
={========={{=={{{=={{{==={{==
No comments:
Post a Comment