নরেন্দ্রনাথ মিত্র
"এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ঘটনার স্রোত বয়ে চলেছে। যুদ্ধ, হত্যা, কত দ্রুত রাজনৈতিক পরিবর্তন। সব খবরের কাগজে পড়ে যাই বড় বড় ছাপার অক্ষরে, কিন্তু মনে কোন ছাপ পড়ে না। সে সব দূরবর্তী দেশের কথা, চোখের আড়ালে যেখানে, ঘটনা তরঙ্গায়িত হয়ে চলেছে তার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু আমার চোখের সামনে, আমার চারপাশেও তো কত ছোট ছোট ঘটনার ঢেউ উঠেছে। সে সম্বন্ধেও তো কোন সচেতনতা নেই” (নরেন্দ্রনাথ মিত্র রচনাবলী, ২য় খণ্ড, বিশেষ সংস্করণ ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ৬৩০)
১৯১৬ খ্রীস্টাব্দের ৩০শে জানুয়ারী, ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত সদরদি ভাঙা গ্রামে নরেন্দ্রনাথের জন্ম হয়। পিতা, মহেন্দ্রনাথ, মা বিরাজবালা। নরেন্দ্রনাথ শৈশবেই হন মাতৃহারা।
তিনি বিমাতা জগমোহিনীর আশ্রয়েই মানুষ হন। শিশু নরেন্দ্রনাথের (ডাক নাম পন্টু) কাছে তিনিই আজন্ম মা-রূপে স্বীকৃত। পিতা বৈষয়িক কাজে দক্ষ ব্যক্তি, উকিলের সেরেস্তায় মুহুরী, কিন্তু গানে-অভিনয়ে-কাব্য উপন্যাস পাঠে এবং চিঠিপত্র লেখায় পারদর্শী ছিলেন। প্রথমে দারিদ্র্য তারপরে একান্নবর্তী পরিবারের দায়িত্বের বোঝা ইত্যাদির ফলে লেখাপড়া গান-বাজনার ইচ্ছা সত্ত্বেও সুযোগে বঞ্চিত হন। এই বাবা বাদে তার আর এক মামা চাকলাদার ঠাকুর্দা লেখকের শিশুমনে কিছুটা ছায়া ফেলেন। তবে খুড়তুতো ছোট ভাই কান্দুর তুলনায় নিজের অযোগ্যতা সম্পর্কে তিনি প্রথম থেকেই সচেতন ছিলেন : “শুধু বাবা নয়, আত্মীয়-স্বজন সবারই আচরণে আমি অনুভব করতাম আমি যেন কেমন কেমন। সবদিক থেকে আমি নিম্ন সাধারণ। সেই বোধ আমাকে পাঁচজনের সঙ্গ এড়াতে শেখাল। বুঝিয়ে দিল ঘরের কোণ আর নিজের মন ছাড়া তোমার কেউ নেই” (“স্মৃতি চিন্তা,” ‘বাবা’, নরেন্দ্রনাথ মিত্র রচনাবলী, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬০১)।
প্রথম লেখাপড়া গ্রামে অক্ষয় মাস্টারের কাছে, তারপর এম. ই. স্কুলে। পরবর্তী পর্যায়ে শিক্ষার অগ্রগতি থাকলেও ফলাফল সাধারণ মানের ১৩৫৩ সাল বা তার কিছুকাল আগে থেকে নরেন্দ্রনাথের পরিবারের নিশ্চিন্ত নিরাপদ জীবনের অবসান হয়। কারণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সারা বাংলা তখন বিধ্বস্ত, রাজনীতির চক্রান্তে দ্বিখণ্ডিত। পূর্ববঙ্গবাসীরা বিশেষভাবে হিন্দুদের জীবন তখন বিশেষভাবে বিপন্ন তারা সকলেই প্রায় ছিন্নমূল। পিতার মৃত্যুর ফলে সংসার আর্থিক দুর্গতির সম্মুখীন হয়।
নরেন্দ্রনাথের ন্যাশানাল ব্যাঙ্কে চাকরি নিয়ে কলকাতায় আগমন হয়। কিছুদিনের জন্য ব্যাঙ্কের জব্বলপুর শাখায় বদলি হন, পরে পুনরায় কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ায়, হিন্দু-মুসলমানের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় কলকাতা তখন বিধ্বস্ত। অনুজ ধীরেন্দ্রনাথকে নিয়ে নরেন্দ্রনাথের ৭/১, ব্রজদুলাল স্ট্রীটে এক সঙ্কীর্ণ গৃহে আশ্রয়গ্রহণ। এই পরিবেশেই শুরু হল সাহিত্যসাধনা। প্রকাশিত হল প্রথম উপন্যাস ‘হরিবংশ’ (নামান্তরে ‘দ্বীপপুঞ্জ’)। ব্যাঙ্কে চাকরি করার সময় নরেন্দ্রনাথ বিপদে পড়েন। এক অসাধু ডিপজিটরের জাল সইয়ের কারসাজি বুঝতে না পেরে সাত হাজার টাকা তছরুপের দায়ে ফৌজদারী মামলার আসামী হয়ে যান। চাকরি থেকে সাসপেণ্ড হন। কিন্তু হাইকোর্টের বিচারক মি. ব্ল্যাক জুরিদের সঙ্গে একমত হয়ে তাঁকে সসম্মানে মুক্তি দেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাস, ডাক্তার পশুপতি ভট্টাচার্য প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ তাঁকে এইসময় নানাভাবে সাহায্য করেন। পরে নরেন্দ্রনাথ ব্যাঙ্কের কাজে যোগ দিয়েই ইস্তাফা দেন। অস্থায়ী পদে চাকরী করেন ‘কৃষক’, ‘স্বরাজ’, ‘সত্যযুগ’, ‘মন্দিরা’ পত্রিকায়। শেষে ১৯৫২ খ্রীস্টাব্দে আনন্দবাজার পত্রিকায় স্থায়ী পদে যোগদান করেন কর্মসূত্রে বন্ধু হন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সাহিত্যিক বিমল কর, সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ এবং শাস্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিভিন্ন স্থানে চাকরির মত একাধিকবার বাড়ি বদলের দুর্ভোগও নরেন্দ্রনাথকে ভোগ করতে হয়। যেমন দ্বিতীয়বার সপরিবারে আশ্রয় নেন ১১৯বি, নারকেলডাঙ্গা মেন রোডের ব্রজদুলাল স্ট্রীটে একটি দেড়খানা ঘরে আটজন একত্রে, তারপর ৯৮, লিন্টন স্ট্রীটের এক বস্তি বাড়িতে, শেষে ১৯৫২ খ্রীস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে ২০/১/এ, রাজা মণীন্দ্র রোডের এক বড় বাড়িতে। তাঁর শেষ জীবন এখানেই অতিবাহিত হয়।
নরেন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবন অন্যান্য সাহিত্যিকদের তুলনায় ছিল কিছুটা স্বতন্ত্র। তিনি কোন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কলম ধরেন নি। উল্টোরথ’ পত্রিকার লেখক শ্রীকিরণকুমার রায়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এবং চিঠিতে জানান তাঁর লেখক হওয়ার ইতিহাসঃ “কি করে লেখক হলাম, কেন লেখক হলাম তা এক কথা তো ভালো, একশ কথাতেও বলা যায় কিনা সন্দেহ। আমরা সাধারণ লোক সাধারণ লেখক সবসময় সচেতনভাবে বিশেষ একটা পরিকল্পনা নিয়ে কিছু হয়ে উঠিনে, কি কিছু করে বসিনে। কিছু হওয়ার পরে সেই হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করতে বসি। সব লেখকই আদিতে পাঠক, আমিও তাই ছিলাম। ছেলেবেলা থেকে বই পড়তে ভালোবাসতাম। বই যে লাইব্রেরী থেকে সংগ্রহ করতে হয় অল্প বয়সে আমার সে ধারণা ছিল না, বইয়ের জন্য পাড়ার সদ্য বিবাহিতা বউদিদের কাছে হাত পাততাম। পাঠক হিসেবে মেয়েদের সঙ্গে সেই যে আমার গোপন আত্মীয়তা হয়েছিল আজ লেখক হিসেবেও প্রায় তাই আছে। গভর্নমেন্ট অফ্ দি পিপল্, বাই দি পিপল, এ্যান্ড ফর দি পিপল-এর মত আমি মেয়েদের নিয়ে লিখি, মেয়েদের হয়ে লিখি, মেয়েদের জন্য লিখি। একথা বলতে আমার লজ্জা নেই। পুরুষ পাঠক যদি দু’ একজন মেলে তাকে ভাগ্য বলে মানি” (দ্রষ্টব্যঃ উদ্ধৃত, ‘তথ্যপঞ্জী ও গ্রন্থ পরিচয়', নরেন্দ্রনাথ মিত্র রচনাবলী, ২, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৩৬)।
এই পড়ার আগে শোনার শিক্ষা বাবার কাছে “আমার লেখক জীবন গঠনের মূলে একজন শক্তিবান ব্যক্তিত্ববান পুরুষ ছিলেন। তিনি আমার বাবা। তিনি আমাকে হাত ধরে লেখাননি কিন্তু মুখে মুখে পড়িয়েছেন। সেই যে ছন্দ দিয়ে ধ্বনি দিয়ে আরম্ভ সুর দিয়ে দিনের শুরু, জীবনের শুরু, তা কি ভুলতে পারি” (তথ্যপঞ্জী ও গ্রন্থপরিচয়', পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৩৬ ৬৩৭)। এই বাবা বাদে তাঁর ছোট ভাই ধীরেন্দ্রনাথ তাঁর লেখার প্রধান উৎসাহদাতা। লেখকের মতে, “তার সমালোচনা ও পরামর্শের প্রভাবে আমার বহু রচনাকে মার্জিত এবং নিয়ন্ত্রিত করেছে” (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৩৭)।
এছাড়া “বহু বন্ধুর উৎসাহ আনুকূল্য লেখক হিসেবে” তার জীবনে উৎসাহ ও প্রেরণাদাতা রূপে স্মরণীয়। মেসজীবন, একাধিক বাসাবদল, যুদ্ধ, দাঙ্গা, দেশবিভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা ইত্যাদি ঘটনাসমূহের অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হয় নরেন্দ্রনাথের লেখকজীবন। স্বভাবতই সংখ্যাধিক্যে এবং বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হয় তার সাহিত্যজগৎ।
নরেন্দ্রনাথের প্রথম আত্মপ্রকাশ কবি রূপে। ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দে ‘দেশ' পত্রিকায় ছাপা হয় ‘মূক’ নামে প্রথম কবিতা। তারপর ১৯৩৬-১৯৩৭ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ‘দেশ’-এ চারটি গল্প, ‘প্রবাসী-বিচিত্রা-বঙ্গশ্রী-পরিচয়’-এ চারটি গল্প প্রকাশিত হয়। প্রথম উপন্যাস ‘হরিবংশ' (১৯৪২) ‘দেশ’-এ মুদ্রিত, পরে 'দ্বীপপুঞ্জ' (১৯৪৬) নামে পরিবর্তিত হয়। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘রূপমঞ্জরী' (১৮৬০)।
নরেন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাসগুলি খ্যাত-স্বল্পখ্যাত বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, যেমন দেশ প্রবাসী বিচিত্রা বঙ্গশ্রী-পরিচয়-জনসেবক-গণবার্তা ইদানীং চতুষ্কোণ চতুরঙ্গ মানসী ভারতবর্ষ, বসুধারা, বসুমতী, সত্যযুগ, আনন্দবাজার পত্রিকা, বেতার জগৎ প্রভৃতি। সিনেমা, রেডিও এবং টি.ভি.-তে গৃহীত হয় তাঁর একাধিক গল্প উপন্যাস; যেমন ‘রস’ চলচিত্রে ‘সওদাগর’ নামে এবং ‘বিকল্প’, ‘অবতরণিকা’ ‘মহানগর’ নামে অভিনীত হয়।
সমালোচক ড. অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর আলোচনায় ('কালের প্রতিমা’, পৃষ্ঠা, ১৪০-১৪১) নরেন্দ্রনাথের উপন্যাস সমূহকে তিনটি পর্বে বিন্যস্ত করেছেন : প্রথম পর্ব (১৯৪৬ ১৯৫১ খ্রীঃ), দ্বিতীয় পর্ব (১৯৫২-১৯৫৬ খ্রীঃ), তৃতীয় পর্ব (১৯৫৭-১৯৭১ খ্ৰীঃ)।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের উপন্যাস : দ্বীপপুঞ্জ' (বঙ্গাব্দ ১৩৫৩), ‘অক্ষরে অক্ষরে’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৬), ‘দেহমন’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৭), ‘দূরভাষিণী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৯), 'সঙ্গিনী' (বঙ্গাব্দ ১৩৫৬), ‘চেনামহল’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬০), ‘গোধূলী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬০), 'অনুরাগিণী' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), ‘সহৃদয়া’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), ‘শুক্লপক্ষ' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), 'কন্যাকুমারী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৫), 'অনামিতা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৫), 'সুখ দুঃখের ঢেউ' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৫), 'কথা কও চোরাবালি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬, ১৩৬৭), 'হেডমাস্টার' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), 'জলপ্রপাত’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), 'উত্তরপুরুষ' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), 'একটি নায়িকার উপাখ্যান নায়িকা' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), তিন দিন তিন রাত্রি' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), ‘রূপমঞ্জুরী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), 'হারানো মণি হারানো মন’ কিশোর উপন্যাস (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), 'উপনগর' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), 'পরম্পরা' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৯), 'মহানগর' (বঙ্গাব্দ ১৩৭০), দ্বৈত সঙ্গীত' (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), 'মুগ্ধ প্রহর' (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), 'পতনে উত্থানে' (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), 'তমস্বিনী' (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), 'সেতুবন্ধন' (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), 'সূর্যসাক্ষী' (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), 'দয়িতা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৬), 'প্রতিধ্বনি' (বঙ্গাব্দ ১৩৭৭), 'উপছায়া’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৮), 'সুরের বাঁধনে' (বঙ্গাব্দ ১৩৭৮), ‘জল মাটির গন্ধ' (বঙ্গাব্দ ১৩৮০)।
(খ) নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্প সংকলন : 'অসমতল' (বঙ্গাব্দ ১৩৫২), 'হলদে বাড়ি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৩), ‘উল্টোরথ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৩), ‘পতাকা' (বঙ্গাব্দ ১৩৫৪), 'চড়াই উত্রাই' (বঙ্গাব্দ ১৩৫৬), ‘পাটরানী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৭), ‘শ্রেষ্ঠগল্প’ (বঙ্গাব্দ ১৩৫৯), 'কাঠ গোলাপ' (বঙ্গাব্দ ১৩৬০), ‘অসবর্ণস্ব’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬১), ‘ধূপকাঠি' (বঙ্গাব্দ ১৩৬১), ‘মলাটের রঙ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬২), 'রূপালী রেখা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), 'দীপান্বিতা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), ‘ওপাশের দরজা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), ‘একূল ওকূল’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩), 'বসন্ত পঞ্চম' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৪), 'মিশ্ররাগ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৪), 'উত্তরণ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৫), ‘পূর্বতনী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), ‘অঙ্গীকার’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), ‘দেবযানী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), 'রূপসজ্জা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), ‘সভাপর্ব' (বঙ্গাব্দ ১৩৬৬), ‘স্বরসন্ধি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), ‘ময়ূরী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), 'বিদ্যুৎলতা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), ‘পত্রবিলাস’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), ‘মিসেস গ্রীণ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), ‘বিন্দু বিন্দু’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৮), একটি ফুলকে নিয়ে’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৯), 'বিনি সুতার মালা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৯), ‘যাত্রাপথ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৯), ‘সুধা হালদার ও সম্প্রদায়’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৯), ‘অনধিকারিণী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৯), ‘রূপলাগি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭০), 'চিলে কোঠা' (বঙ্গাব্দ ১৩৭১), ‘প্রজাপতির রঙ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭২), 'অন্য নয়ন’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭২), ‘বিবাহবাসর’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৩), ‘চন্দ্রমল্লিকা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৪), ‘সন্ধ্যারাগ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৫), 'সেই পথটুকু' (বঙ্গাব্দ ১৩৭৬), ‘অনাগত' (বঙ্গাব্দ ১৩৮২), 'পালঙ্ক’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮২), 'উদ্যোগ পর্ব’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮২), ‘বর্ণবহ্নি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮৪), বিকালের আলো’ (১৯৮৩), ‘নাগরিক প্রেমের উপাখ্যান' (বঙ্গাব্দ ১৩৯০), ‘গল্পমালা-১' (১৯৮৬), ‘কিশোর গল্পসমগ্র' (বঙ্গাব্দ (১৩৯৫), 'গল্পমালা-২' (১৯৮৬), 'স্রোতস্বতী' (১৯৮৯), 'সাধ সুখ স্বপ্ন' (১৯৯০), ‘এইটুকু বাসা’ (১৯৯০), ‘গল্পমালা-৩’ (১৯৯২)।
(গ) নরেন্দ্রনাথ মিত্রের স্মৃতিমূলক রচনা : ‘আত্মকথা' (১৯৭২), ‘গল্প লেখার গল্প' (১৯৬৪), ‘আত্মচরিত’।
(ঘ) নরেন্দ্রনাথ মিত্রের কাব্য : 'জোনাকি', শ্রী বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য ও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সহ (বঙ্গাব্দ ১৩৪৫), 'নিবিবিলি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৩)।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সাহিত্যকর্মের মধ্যে যেগুলি চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে তার কয়েকটি - সত্যজিৎ রায়ের মহানগর, অগ্রগামীর 'হেডমাস্টার', 'বিলম্বিতলয়'; রাজেন তরফদারের 'পালঙ্ক'। 'রস' গল্পটির অমিতাভ বচ্চন অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্রের নাম 'সৌদাগর'.
পুরস্কার ও সম্মাননা
আনন্দ পুরস্কার (১৯৬২)
মৃত্যু- ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫.
দ্বিতীয় মহাসমরকালে নরেন্দ্রনাথ মিত্র লিখতে শুরু করেন। কবিতায় তাঁর অভিষেক হলেও কথাশিল্পেই তাঁর শিল্পীমানসের বিকাশ এবং প্রতিষ্ঠা। চল্লিশের দশকের আগে যাঁরা যুক্ত হয়েছেন এবং চল্লিশের দশকে সাহিত্যের নির্মাতা হিসেবে কাজ করেছেন, তাঁদেরও অনেকেই চল্লিশের দুঃসময়াক্রান্ত হয়ে যুদ্ধ-মন্বন্তর-দেশভাগজনিত কষ্টের ছায়ায় ছোটগল্প লিখেছেন। সে বিষয়ানুগ গল্প নরেন্দ্রনাথ মিত্রও লিখেছেন। তাঁর গল্পে দেশবিভাগ-দাঙ্গা-মন্বন্তর-যুদ্ধোত্তর বিপর্যস্ত অর্থনীতি—সবকিছুই উঠে এসেছে। তবে তিনি যে রূপায়ণে এ প্রসঙ্গকে ছোটগল্পে চিত্রিত করেছেন তা সদর্থক। জীবন কখনো একক দুঃখের কিংবা একক সুখের সমষ্টি নয়, নিরবচ্ছিন্ন দুঃখময় জীবনেও সুখের আভাস বিদ্যমান। তাঁর গল্পের ভূমিতে থোকা থোকা কষ্ট ফুটে থাকে, দুঃখের বিদীর্ণ প্রান্তর তাঁর গল্পভূমি, দুঃসহ জীবনের রেখাপাত তাঁর একেকটি সৃষ্টি, সেই দুঃখসমুদ্র থেকে তিনি তুলে আনেন বিন্দু বিন্দু সুখের ছটা। সেই সুখের উদ্ভাস তিনি গল্পের পরিণতিতে এমনভাবে তুলির আঁচড়ে এঁকে দেন, যা পাঠকচিত্তকে জয় করতে কালবিলম্ব হয় না। গল্পগুলোকে তিনি পরিকল্পিতভাবে কদর্যপূর্ণ জীবনের বিপ্রতীপে উপস্থাপন করেন। তাঁর নিজের এ প্রবণতার পক্ষে ‘গল্প লেখার গল্প’ নিবন্ধে তিনি বলেছেন—’কিন্তু পিছন ফিরে তাকিয়ে বই না পড়ে নিজের গল্পগুলির কথা যতদূর মনে মনে পড়ে আমি দেখতে পাই ঘৃণা বিদ্বেষ ব্যঙ্গ বিদ্রূপ বৈরিতা আমায় লেখায় প্রবৃত্ত করেনি। বরং বিপরীত দিকের প্রীতি প্রেম সৌহার্দ্য, স্নেহ শ্রদ্ধা ভালোবাসা, পারিবারিক গণ্ডির ভিতরে বাইরে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচিত্র সম্পর্ক, একের সঙ্গে অন্যের মিলিত হবার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা বার বার আমার গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে।’ নরেন্দ্রনাথ মিত্রকে তাঁর গল্পগুলোতে আমরা তাঁর নিজের এই উক্তির ছায়া হিসেবে পাই।
‘পালঙ্ক’ গল্পে একটি পালঙ্ককে ঘিরে আবর্তিত গল্পের কাহিনি। গল্পে রাজমোহনের অশেষ মানসিক যন্ত্রণা লক্ষ করা যায়। সন্তানের প্রতি অভিমানে তিনি পালঙ্ক বিক্রি করেন। দেশবিভাগের সময়ে পরিবারের সকলেই দেশ ছেড়ে গেলেও তিনি কলকাতায় যানানি। বিক্রিত পালঙ্ক ফিরে পেতে তিনি একদিকে নিরন্তর চেষ্টা চালাতে থাকেন। অন্যদিকে ক্রেতা মকবুল না খেয়ে দিনাতিপাত করলেও পালঙ্ক ফেরত দিতে সম্মত নয়। একটি পালঙ্ককে কেন্দ্র করে গল্পের ঘটনা পরম্পরা দ্রুতই জটিল রূপ ধারণ করে। রাজমোহন যখন মৃত্যুপথযাত্রী, তখনো জ্বরে পুড়ে যাওয়া দুর্বল শরীর নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে রাতের অন্ধকারে বৃষ্টিতে ভিজে সেই পালঙ্ক ফেরত চাইতে গিয়েছিলেন। মকবু্ল যখন পালঙ্ক ফেরত দিতে সম্মত হয়। তখন সেই পালঙ্ক আর ফেরত নেয়না সে। পালঙ্কের ওপর মকবুলের সন্তানদের দেখে তার অনুভূতি বদলে যায়। সে তখন পরম তৃপ্ত। নরেন্দ্রনাথ মিত্র গল্প জুড়ে রাজমোহনের যে সীমাহীন আকুতি তুলে ধরেছেন তা মুহূর্তে প্রশমিত হয়। আর সেখানেই এ গল্পকারের স্বাতন্ত্র্য। ক্রমশ সিঁড়ি বেয়ে দুঃখের শীর্ষে পৌঁছাতেই যেন অকস্মাত্ সুখের সকাল ধরা দেয়।
‘হেডমাস্টার’ গল্পের হেডমাস্টার কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকার চরিত্রটি একজন টিপিক্যাল শিক্ষকচরিত্র। অর্থনৈতিক সংকট তার জীবনের নিত্য সঙ্গী। তারপরও শেখানোর এক অদম্য চেষ্টায় রত। দেশবিভাগের পর শিক্ষকতার আয় দিয়ে
সংসার চলছিল না। সে জন্য শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে এসে এক শিক্ষার্থীর কাছে ব্যাংকের চাকুরি নেয়। অফিসে গিয়ে তার কর্তা ব্যক্তি থেকে শুরু করে সকলের ভুল সংশোধন করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে তার চাকরি হারানোর অবস্থা তৈরি হলেও তিনি দীর্ঘকালের শিক্ষকতা স্বভাব ভুলতে পারেন না। হেডমাস্টারের নিজের পরিবারের এবং কর্মক্ষেত্রের প্রতিকূল বাস্তবতা সত্ত্বেও গল্পের শেষে পাহারাদারদের নিয়ে তার যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্নে জীবনকে সুন্দর করে দেখার প্রবণতা সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকারের জীবনে যে কষ্টঘন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তা থেকে সম্পূর্ণরূপে উত্তরণ হয় না। কিন্তু মানুষকে নিয়ে কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকারের স্বপ্ন গল্পটিকে শুভজীবনের মানদণ্ডে উন্নীত করে।
রস’ গল্পে মোতালেফ-মাজুখাতুন-ফুলবাণু তিনটি চরিত্রের যোজন-বিয়োজনের মধ্য দিয়ে গল্পটির পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছে। রসাবহপূর্ণ জীবন পিয়াসী এরা সকলেই। মোতালেফ খুঁজেছে দেহগত সৌন্দর্য, গুড় তৈরিতে দক্ষ মাজুখাতুন খুঁজেছে জীবনের নিরাপত্তা, ফুলবাণু খুঁজেছে নিরাপত্তা ও সৌন্দর্য। তিনটে চরিত্রের মধ্যেই সুখাবহ সৃষ্টির পরিবর্তে নেমে আসে দুঃখময় মুহূর্ত। মোতলেফ মাজুখাতুনকে গ্রহণ করেছিল ফুলবাণুকে পাওয়ার জন্য। যখন মাজুখাতুন মোতালেফের ঘরে তখন সে ভালোবেসেছে ফুলবাণুকে আর যখন ফুলবাণু ঘরে তখন সে ভালোবেসেছে মাজুখাতুনেকে। রূপের মোহে ফুলবাণু আর গুণের গুণে মাজুখাতুন মোতালেফের প্রিয় হয়েছিল। রূপের মোহ কেটে গেলেও গুণের প্রতি তার আসক্তি অটুট থাকে। মাজুখাতুনকে ত্যাগ করলে মাজুখাতুন পুনরায় বিয়ে করে। মোতালেফ একদিন কিছু রস নিয়ে গুড় বানানোর কৌশল শেখার জন্য মাজু খাতুনের কাছে গেলে সে লক্ষ করে মাজুখাতুন তখনো তাকে ভালোবাসে। মোতালেফের প্রতি মাজু খাতুনের অনিঃশেষ ভালোবাসা গল্পটির সকল কষ্ট ভুলে যেতে সাহায্য করে। গল্পটির সমাপ্তিও সেখানেই। ফলে গল্পের পরিণতিতে সুখানুভূতির পরিণত রূপ গল্পটিকে যে ব্যঞ্জনা দান করে তা ইতিবাচক জীবনের।
‘চাঁদমিঞা’ গল্পে কয়েক স্তরের কষ্ট রয়েছে। নশরত্ আলীর চার-পাঁচ স্ত্রী মারা গেছে, ঘরে আছে আর চারজন। তার শেষ স্ত্রী রাবেয়া নশরত্ আলীর ঘোড়ার সহিস চাঁদমিঞাকে ভালোবাসে। নশরত্ আলী বুঝতে পেরে একদিন চাঁদমিঞাকে নির্মমভাবে আঘাতে আঘাতে মৃতপ্রায় করে তোলে এবং রাবেয়াকে গলা টিপে হত্যা করে। গল্পের প্রত্যেকটি স্তর এখানে কষ্টের ভিতের ওপর দণ্ডায়মান। অথচ, গল্পপাঠ সমাপ্তিতে সকল দুঃখবোধ ম্লান হয়ে যায় শেষাংশের গুণে। গল্পের শেষ দৃশ্যে জানা যায়, শেষ জীবনে নশরত্ আলী এবং চাঁদমিঞার মধ্যে ভীষণ হূদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেন হয়েছে, কীভাবে হয়েছে এ নিয়ে বিস্ময় সৃষ্টি হলেও পরস্পরের বন্ধুত্ব ছিল ঘনিষ্ঠ পর্যায়ের। এমনকি মালিক-ভৃত্য সম্পর্ক উঠে গিয়ে বন্ধুত্বের পর্যায়ে উন্নীত হয় তাদের সম্পর্ক। নরেন্দ্রনাথ মিত্র গল্প বয়নে সাবধানতার সাথে সমাজের প্রকৃত অবস্থা উপস্থাপন করেন এবং গল্পের শেষে ক্লেদাক্ত সময়ে পরাজিত আশাবাদী ভাবনাকে যুক্ত করে দেন তাঁর গল্পে; যে অংশে নরেন্দ্রনাথ মিত্র স্বয়ং যুক্ত হন।
‘কাঠগোলাপ’ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশবিভাগজনিত কারণে স্বদেশত্যাগীদের করুণ জীবনের আখ্যান হলেও গল্পের শেষে সেই করুণ আর্তি আর থাকেনি। নীরদ আর অণিমার জীবনের করুণ চিত্র গল্পটিকে আলো দান করলেও শেষ পর্যন্ত সেই চিত্রকে ছাড়িয়ে যায় গল্পের শুভ সমাপ্তি। দেশভাগের পর কলকাতায় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বাঙালিদের জীবনবাস্তবতা ছিল খুবই করুণ। নরেন্দ্রনাথ মিত্র এ গল্পে সেই সত্যের প্রতিচ্ছবি অঙ্কনে কোনো দ্বিধা-সঙ্কোচ করেননি, কিংবা সেখানে আরোপিত কোনো রং লাগাননি। তিনি জীবনের শুভ দিকের পক্ষপাতি বলে গল্পে সুখী মানুষের আনয়নও করেননি। তিনি তাঁর স্বতন্ত্র রংয়ের আলতো আঁচড় গল্পের পরিসমাপ্তিতে দুঃখবোধ থেকে পাঠকের উত্তরণ ঘটান। বাস্তবতাবিমুখ অণিমার বাস্তব ভূমিতে নেমে আসা এবং প্রতীকী অর্থে তার এ প্রচেষ্টাকে একটি ফুলের সাথে তুলনা করার মধ্য দিয়ে কষ্টের নিগড়ে পড়ে থাকা জীবনের মধ্যে যেন আশার উপ্ত বীজের সন্ধান পাওয়া যায়।
‘চোর’ গল্পে নরেন্দ্রনাথ মিত্র অমূল্যের চৌর্যবৃত্তির অপরিহার্যতা তুলে ধরেছেন। অমূল্যের স্ত্রী রেণু স্বামীর চৌর্যবৃত্তির প্রতি অশেষ ঘৃণা পোষণ করে। রেণুর ঘৃণার প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে অমূল্য। শুধু তা-ই নয় ওপরতলা থেকে কাঁসার বাটি চুরি করার পরামর্শ দেয় স্ত্রীকে। একটি দোকানে কাজ করত অমূল্য। চুরির দায়ে চাকরি চলে যায়। তবু তার চুরি বন্ধ হয় না। চুরি না করলে উপোস করে থাকতে হতো বলেই চুরি করে অমূল্য। গল্পকার অমূল্যের চোরজীবনের যে আখ্যান গল্পে এনেছেন, এরচেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ রেণুর চোর হয়ে ওঠার অংশটুকু। একদিকে অর্থসংকট অন্যদিকে চোর স্বামীসঙ্গ রেণুকে চোর হিসেবে গড়ে তোলে। গল্পের বুনন, সংলাপ, নিম্নবিত্তের স্বরূপ, নারীর অসহায়ত্ব সবকিছুর মধ্য দিয়ে গল্পটি পাঠক চিত্তে স্থান করে নেয়। নরেন্দ্রনাথ মিত্র যেহেতুে জীবনকে ইতিবাচক করে দেখেন তাই গল্প সমাপ্তিতে শেষ রেখা টেনেছেন সুস্থ জীবনের দিকে ইঙ্গিত করে। নিজে চুরি করলেও চুরি পেশার প্রতি অমূল্যেরও যে ঘৃণা রয়েছে তার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। সেখানে অমূল্য মহান হয়ে ওঠে। গল্পটি হয়ে ওঠে সদর্থক জীবনের গল্প।
‘সোহাগিনী’ গল্পে ত্রিকোণ প্রেমের পরিণতিতে তুফানীর মৃত্যু হয়। তুফানীর স্বামী বনমালী স্ত্রীকে মতি মিঞার বাড়ি থেকে আসতে দেখে নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা তুফানীকে বেদম প্রহার করলে তার মৃত্যু হয়। সেই রাতেই শ্মশানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। গল্পটি এখানে শেষ হলে দুঃখাবহ পরিণতি হতে পারত। কিন্তু, গল্পের শেষে দেখা যায়, শেষকৃত্য শেষে বনমালী এবং মতি মিঞা দুজনেই বর্ষরাতে তুফানীর শ্মশানে গিয়ে উপস্থিত। দুজনই অনুশোচনায় দগ্ধীভূত। নরেন্দ্রনাথ মিত্র এভাবেই গল্পের শেষ মোড়কে জীবনের আলো ছড়িয়ে দেন।
‘আবরণ’ গল্পের চাঁপা মন্বন্তরের জ্বলজ্বলে প্রতিনিধি। চাঁপার ন্যূনতম কাপড় নেই, যা দিয়ে নিজের শরীর আবৃত করতে পারে। চাঁপার করুণ অবস্থা নিবারণ করতে স্বামী বংশী গত্যন্তর না দেখে যৌনকর্মীর কাপড় আনার চেষ্টা করেছিল। বর্ণনাতীত এই দুঃসহ জীবনের মধ্যে স্ত্রীর জন্য বংশীর কাপড়ের চেষ্টায় এবং যৌনকর্মী সুখদার দগদগে ক্ষতবিশিষ্ট বুকের দিকে তাকিয়ে কাপড় ফেরত দেওয়ার মধ্যে নরেন্দ্রনাথ মিত্রের স্বকীয়তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কারণ সেখানেই শুভ জীবনের উন্মোচন।
‘পালঙ্ক’ গল্পের রাজমোহন-মকবুল, ‘চাঁদমিঞা’ গল্পের চাঁদমিঞা-নশরত্ আলী, ‘চোর’ গল্পের অমূল্য-রেণু, ‘কাঠগোলাপ’ গল্পের নীরদ-অণিমা, ‘রস’ গল্পের মোতালেফ-মাজুখাতুন, ‘হেডমাস্টার’ গল্পের কৃষ্ণপ্রসন্ন সরকার, ‘সোহাগিনী’ গল্পে বনমালী-মতিমিঞা, ‘আবরণ’ গল্পের চাঁপা-বংশী, ‘ভুবন ডাক্তার’ গল্পের ভুবন ডাক্তার—এরা সকলেই কোনো না কোনোভাবে দুঃখভারাক্রান্ত পর্বে বিন্যস্ত। তারা প্রত্যেকেই যন্ত্রণাবিদ্ধ। কখনো ব্যক্তিগত ব্যর্থতা, কখনো সময়-সমাজের অনিবার্য দুর্লঙ্ঘনীয় বাস্তবতার নিষ্পেষণ তাদের জীবনকে বিষময় করে তুলেছিল। নরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর গল্পে সেই নিষ্পেষণে পীড়িত জীবনছবি চিত্রায়ণের সমাপ্তিতে বেঁচে থাকার স্বপ্ন যুক্ত করেন; যেখানে বেজে ওঠে মধুর সুরধ্বনি। জীবনের সীমাহীন কদর্থক অনুষঙ্গের আড়াল থেকে উঠে আসে তার প্রধান প্রবণতা—আশাবাদী জীবনের আলাপন।
তাঁর জন্ম ১৯১৬তে। অর্থাৎ তার বাল্যাবস্থাতেই কল্লোল-কালিকলম-প্রগতি-যুগের সাহিত্য প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। সেই নতুন ভাবধারার কথাসাহিত্যিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জগদীশ প্রমুখেরা। বাস্তবের রূঢ়তা ও রুক্ষতা তাদের গল্পে-উপন্যাসে নির্মোহ ভঙ্গিতে উপস্থাপিত। তার কিছু পরবর্তীকালে আরাে কয়েকজন কথা-সাহিত্যিকের আবির্ভাব, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আলােড়নে আলােড়িত, নাগরিক সভ্যতার কঠিন সত্যকে দেখে এবং চিনে তারা সভ্যতার স্বরূপ সম্বন্ধে আরাে বেশি নির্মোহ। কথাশিল্পী নরেন্দ্রনাথ মিত্র (১৯১৬-১৯৭৫) এই যুগের প্রতিনিধি.
=================================
No comments:
Post a Comment