Sunday, 30 January 2022

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য। শিবনাথ শাস্ত্রী। ৩১.০১.২০২২. Vol -632 .. The blogger in literature e-magazine.

সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সমাজ-সংস্কারক ও ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক 



আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রী 


সময়টাও ছিল একটু অন্যরকম। উনবিংশ শতক। ব্রিটিশরা গোটা দেশ অধিকার করে নিয়েছে। আর তার মধ্যেই শুরু হয়েছে ব্রাহ্মধর্মের প্রচার। এই ধর্মের মতবাদ, আদর্শ, একেশ্বরবাদ অনেককেই আকৃষ্ট করল তখন। বিশেষ করে, অল্পবয়সী যুবারা দলে দলে যোগ দিতে শুরু করলেন এখানে। সনাতন ধর্মের কুসংস্কার, গোঁড়ামিকে আক্রমণ করতে লাগলেন। সংস্কৃত কলেজের ওই যুক্তিবাদী তরুণ, শিবনাথ শাস্ত্রীও এই দলে ভিড়লেন। আর ছেলে ব্রাহ্মসমাজে যাচ্ছে, এমন কথা শুনে তেড়েফুঁড়ে উঠলেন বাবা। তাঁরা রক্ষণশীল ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ; এভাবে ধর্ম নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারেন! 

কিন্তু শিবনাথ যাকে বলে, নাছোড়বান্দা। ছোটো থেকে বাবার বদমেজাজ সহ্য করে এসেছেন তিনি। এবার তাঁর স্বাধীনতাতেও হস্তক্ষেপ করতে চান তিনি! শুরু হল বাবা-ছেলের যুদ্ধ। এমন যুদ্ধ তো সেই সময় কলকাতায় হরদম দেখা যেত। কিন্তু এখানে যে তরুণটির নাম শিবনাথ শাস্ত্রী! পরবর্তীকালে বাংলার ইতিহাসের খাতায় তাঁর নাম উঠে যাবে চিরকালের জন্য। যাই হোক, ছেলের যে কোনভাবে ‘মতি ফিরবে না’, সে কথা বুঝে গিয়েছিলেন বাবা হরানন্দ ভট্টাচার্য। যার অবশ্যম্ভাবী ফল, শিবনাথের ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করা। রবং তারপরই বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া… 



জন্ম ১৮৪৭ সালের ৩১ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশপরগনা জেলার চাংড়িপোতা গ্রামে (বর্তমানে সুভাষগ্রাম)  মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার মজিলপুরে। তাঁর পিতা পণ্ডিত হরানন্দ ভট্টাচার্য (১৮২৭-১৯১২) ছিলেন জয়নগর মজিলপুর পৌরসভার প্রথম পৌরপ্রধান। তাঁর মাতুল দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ (১৮১৯-১৮৮৬) ছিলেন তৎকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাপ্তাহিক পত্রিকা 'সোমপ্রকাশ'এর সম্পাদক।


শিবনাথ কলকাতার সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৮৬৬) এবং কলেজ থেকে এফ.এ (১৮৬৮), বি.এ (১৮৭১) ও এম.এ (১৮৭২) পাস করেন। পরে ঐ কলেজ থেকেই তিনি ‘শাস্ত্রী’ উপাধি লাভ করেন।

১৮৬৯ সালের ২২ আগস্ট শিবনাথ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। উপবীত ও মূর্তিপূজা ত্যাগ করেন। শিবনাথ, ছেদ করেন পরিবারের সঙ্গে সকল সম্পর্ক। পিতা হরানন্দ শিবনাথকে বাড়ি থেকে বের করে দেন, স্ত্রীকে নিয়ে শিবনাথও চিরকালের মতো বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। ক্রমে শিবনাথ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হনছাত্রাবস্থায়ই (১৮৬৯) শিবনাথ কেশবচন্দ্র সেনের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন। Indian Reforms Association-এ যোগ দিয়ে তিনি মদ্যপান নিবারণ ও নারীমুক্তি আন্দোলনে এবং শিল্প-সাহিত্য-কারিগরি বিদ্যার প্রচারে অংশগ্রহণ করেন। মদ্যপানের বিরোধিতা কল্পে তিনি ১৮৭০ সালে প্রকাশ করেন মদ না গরল শীর্ষক একটি মাসিক পত্রিকা। পরে তিনি সোমপ্রকাশ (১৮৭৩-৭৪) ও ধর্মবিষয়ক সমদর্শী পত্রিকা (১৮৭৪) এবং আরও পরে তত্ত্বকৌমুদী, ইন্ডিয়ান মেসেজ ও মুকুল (১৮৯৫) পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

শিবনাথ কেশব সেনের ভারত আশ্রমের বয়স্কা মহিলা বিদ্যালয় (১৮৭২), ভবানীপুর সাউথ সুবারবন স্কুল (১৮৭৪) এবং হেয়ার স্কুলে (১৮৭৬) শিক্ষকতা করেন। এক পর্যায়ে তিনি সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন (১৮৭৮)। নারীমুক্তি আন্দোলনে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে এবং বিধবাবিবাহের পক্ষে তিনি কেশবচন্দ্রের সহযোগী ছিলেন। তাঁদের বলিষ্ঠ প্রচেষ্টায় ১৮৭২ সালে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়সসীমা ১৪ বছর নির্ধারিত হয়।


১৮৭৭ সালে শিবনাথ ব্রাহ্ম যুবকদের ‘ঘননিবিষ্ট’ নামে একটি বৈপ্লবিক সমিতিতে সংগঠিত করে পৌত্তলিকতা ও জাতিভেদের বিরুদ্ধে এবং নারী-পুরুষের সমানাধিকার ও সর্বজনীন শিক্ষার পক্ষে সংস্কার আন্দোলনের সূচনা করেন। শিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি সিটি স্কুল ও স্টুডেন্টস সোসাইটি নামে একটি গণতান্ত্রিক ছাত্র সমিতি (১৮৭৯) এবং নারী শিক্ষার প্রসারের লক্ষ্যে মেয়েদের নীতিবিদ্যালয় (১৮৮৪) স্থাপন করেন। ব্রাহ্ম সমাজের পক্ষে ভারতের প্রথম কিশোর মাসিক পত্রিকা সখা (১৮৮৩) তার উদ্যোগেই প্রকাশিত হয়। ১৮৯২ সালে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন সাধনাশ্রম

  শিবনাথ মামার আদর্শে মানুষ। নরানাম্ মাতুলক্রমঃ। মামার মতোই জেদী। নিজে যা ভালো বোঝেন,তাই করেন। ব্রাহ্মধর্মের সংস্রব তাঁর পক্ষে ত্যাগ করা সম্ভব না। এই নিয়ে বাপছেলেতে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। ১৮৬৯ সালের ২২ আগস্ট শিবনাথ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। উপবীত ও মূর্তিপূজা ত্যাগ করেন শিবনাথ, ছেদ করেন পরিবারের সঙ্গে সকল সম্পর্ক। পিতা হরানন্দ শিবনাথকে বাড়ি থেকে বের করে দেন, স্ত্রীকে নিয়ে শিবনাথও চিরকালের মতো বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। ক্রমেশিবনাথ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হন। ইতোমধ্যে ১৮৬৮ সালেব্রাহ্ম-আন্দোলনের নেতা কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-৮৪) প্রতিষ্ঠা করেন IndianReforms Association। এসংস্থার উদ্দেশ্য ছিল মদ্যপান নিবারণ, শিক্ষা প্রসার, সুলভ সাহিত্য ও কারিগরিজ্ঞানের প্রচার, নারীশিক্ষা তথা নারীমুক্তি। এসব আদর্শের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেশিবনাথ যোগ দেন IndianReforms Association-এ।শিবনাথ কেশবচন্দ্রের প্রধান সহযোগী হিসেবে এসময় সমাজ সংস্কারমূলক অনেক কাজের সঙ্গেজড়িয়ে পড়েন। নারীশিক্ষার পক্ষে তিনি গ্রহণ করেন দৃঢ় অবস্থান, বিধবাদের বিয়ের পক্ষেতিনি উচ্চারণ করেন জোরালো বক্তব্য। কেশবচন্দ্রের অনুপ্রেরণায় এসময় শিবনাথ মদ্যপাননিবারণ এবং শিক্ষা-সাহিত্য-কারিগরি বিদ্যা প্রচারে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন।সমাজে মদ্যপানের ভয়াবহতা দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হন। তরুণ সমাজকে মদ্যপানের ছোবল থেকে রক্ষাকরার মানসে তিনি প্রকাশ করেন মদ না গরলশীর্ষক পত্রিকা।শিবনাথ শাস্ত্রী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু প্রমুখেরউদ্যোগে ১৮৭৬ সালে গঠিত হয় Indian Association’। এই সংস্থাই হলো ভারতীয় রাজনীতির প্রথম সংঘবদ্ধপ্রয়াস। এই সংস্থার অনুপ্রেরণাতেই ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস।দেশের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় ১৮৭৭ সালে শিবনাথ শাস্ত্রী গঠন করেন ‘গুপ্ত বৈপ্লবিকসমিতি’। এই সংস্থার প্রধান কর্মসূচি ছিল – জাতিভেদ অস্বীকার, সরকারি চাকরিপ্রত্যাখ্যান, সমাজে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, অশ্বারোহণ ও বন্দুকচালনা শিক্ষা, জাতীয়তামূলক ও সমাজ সংস্কারমূলক শিক্ষা এবং পূর্ণ রাষ্ট্রীয়স্বাধীনতা। এসব উদ্দেশ্য থেকেই শিবনাথ শাস্ত্রীর রাজনৈতিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।


দ্বারকানাথই ছিলেন শিবনাথের সাংবাদিক জীবনের প্রধান অনুপ্রেরণা। ১৮৮৩ সালে শিবনাথ

শাস্ত্রীর সম্পাদনায় ব্রাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে সখা নামে ভারতের প্রথম কিশোর মাসিক প্রকাশিত হয়। অভিন্ন সময়ে তত্ত্বকৌমুদী (১৮৮২) এবং ইন্ডিয়ান মেসেজ (১৮৮৩) নামে দুটিক্ষণস্থায়ী পত্রিকা সম্পাদনা করেন শিবনাথ শাস্ত্রী। ১৮৯৫ সালে তাঁর সম্পাদনায়প্রকাশিত হয় বিখ্যাত কিশোর মাসিক মুকুল।

বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্য বিকাশে এই পত্রিকা পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। উল্লিখিত

পত্রিকাসমূহ সম্পাদনায় শিবনাথ শাস্ত্রী বিশেষ দক্ষতা ও কৃতিত্বের পরিচয় দেন।


রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের দুই প্রধান কান্ডারি –

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) এবং কেশবচন্দ্র সেন। প্রথম দিকে দেবেন্দ্রনাথ ও

কেশবচন্দ্রের মধ্যে ছির দারুণ সখ্য। ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা সভায় তাঁরা বসতেন

পাশাপাশি। কিন্তু ১৮৭০-এর দশকে তাঁদের দুজনের সম্পর্কে চিড় ধরে। ব্রাহ্ম হলেও

দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন অনেকটা প্রাচীনপন্থী। হিন্দুধর্মের আচার-অনুষ্ঠান অনেকটাই পালন

করেন তিনি, ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেন হিন্দুমতে, ব্রাহ্মণদের উপবীত ধারণে অনুমতি দেন।

পক্ষান্তরে কেশবচন্দ্র অনেক বেশি আধুনিক ও বিপ্লবী। ব্রাহ্মধর্মকে তিনি হিন্দুধর্ম

থেকে একেবারে আলাদা করতে চান। তাঁর মতে, ব্রাহ্মরা অ-হিন্দু। হিন্দুধর্মের সকল

প্রচার কুসংস্কারমূলক আচার-অনুষ্ঠান বর্জনের তিনি পক্ষপাতী। ক্রমে এই দুই

ব্রাহ্ম-নেতার বিরোধ ধারণ করে চরম রূপ। এসময় ব্রাহ্ম ধর্মসভায় নারীদের প্রকাশ্য

স্থানে উপাসনা করার পক্ষে ও বিপক্ষে মত প্রকাশে দেখা দেয় নতুন বিতর্ক। এ বিতর্কের

সূত্র ধরেই ১৮৭৮ সালে ভেঙে যায় ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ। এ সময় শিবনাথ শাস্ত্রীর

নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ (১৮৭৮)। অন্যদিকে কেশবচন্দ্র

প্রতিষ্ঠা করেন ‘নববিধান ব্রাহ্মসমাজ’ (১৮৭৮)। দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ছিল ‘আদি

ব্রাহ্মসমাজ’। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শিবনাথ শাস্ত্রী এসময় পালন

করেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। তাঁর নেতৃত্বগুণে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ দ্রুত কলকাতার

সমাজজীবনে প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হয়। ধর্ম প্রচার ছাড়াও সমাজ সংস্কার ও রাজনৈতিক

সংস্কার ছিল সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রধান কর্মসূচি। সমগ্র ভারতবর্ষ ভ্রমণ করে

শিবনাথ শাস্ত্রী সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের আদর্শ প্রচার করেন।


ইতোপূর্বেই শিক্ষাব্রতী হিসেবে শিবনাথ শাস্ত্রীর খানিকটা পরিচয় আমরা

জেনেছি। এ প্রসঙ্গে তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সিটি স্কুলের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ

করতে হয়। শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ১৮৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুল উত্তরকালে সিটি

কলেজে রূপান্তরিত হয়। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজে উনিশ-বিশ

শতকের বহু আলোকিত মানুষ বিদ্যা লাভ করেন। সিটি স্কুল প্রতিষ্ঠায় শিবনাথ শাস্ত্রী

তাঁর ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু আনন্দমোহন বসু এবং সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামীর সহযোগ লাভ করেন।

অভিন্ন উদ্দেশ্যে এঁরা প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্টুডেন্ট সোসাইটি’ (১৮৭৯)। বস্ত্তত এটিই

হলো ভারতবর্ষের প্রথম ছাত্রসংগঠন।


১৮৮৮ সালে শিবনাথ শাস্ত্রী ইংল্যান্ড গমন করেন। ভারতবর্ষ ও ইংল্যান্ডের

সমাজকে তুলনামূলক দৃষ্টিতে বিচার করার মানসেই তাঁর বিলেত গমন। ছয় মাস তিনি বিলেতে

প্রবাসজীবন যাপন করেন। এ সময় তিনি ইংল্যান্ডের নানা স্থানে ভারতবর্ষের সমাজ ও

সংস্কৃতি, বিশেষত ব্রাহ্মধর্ম বিষয়ে বহু বক্তৃতা দেন এবং অর্জন করেন প্রচুর প্রশংসা।

ইংল্যান্ড ভ্রমণ শিবনাথ শাস্ত্রীর মনে গভীর রেখাপাত করে। ইংরেজদের মধ্যে তিনি লক্ষ

করলেন বহু সদ্গুণ। দেশে প্রত্যাবর্তন করে ওই সদ্গুণের চর্চা করার মানসে তিনি

প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাধনাশ্রম’ (১৮৮৯)। জনগণের মধ্যে উচ্চ আদর্শ ও সদ্গুণ প্রচারে

সাধনাশ্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


বাংলা সাহিত্যের একজন খ্যাতিমান লেখক হিসেবে শিবনাথ শাস্ত্রীর অবদান

বিশেষভাবে স্মরণীয়। সমাজ সংস্কারমূলক বিচিত্র কাজে ব্যস্ত থাকলেও তিনি

সাহিত্যসৃজনেও ছিলেন সমান উৎসাহী ও আন্তরিক। তাঁর লেখা কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ,

ইতিহাস, আত্মজীবনী বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। শিবনাথ শাস্ত্রী যেসব কাব্য

প্রকাশ করেন, তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য – নির্বাসিতের বিলাপ (১৮৬৮), পুষ্পমালা

(১৮৭৫), হিমাদ্রি কুসুম (১৮৮৭), পুষ্পাঞ্জলি (১৮৮৮), ছায়াময়ী

পরিণয় (১৮৮৯) ইত্যাদি। নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা শিবনাথ শাস্ত্রীর

কবিতার বিশিষ্ট লক্ষণ। সহজ-সরল হৃদয়বাণী গুণে শিবনাথের কবিতা সমকালে বিশেষ খ্যাতি

অর্জন করেছিল। তাঁর লেখা ‘আজি শচীমাতা কেন চমকিলে/ ঘুমাতে ঘুমাতে উঠিয়া বসিলে।’ –

পঙ্ক্তিদ্বয় তখনকার প্রতিটি ছাত্রের মুখে-মুখে উচ্চারিত হতো।


বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের ধারায় শিবনাথ শাস্ত্রীর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

একটি বিশিষ্ট আদর্শ তাঁর ঔপন্যাসিক চেতনায় সর্বদা থেকেছে ক্রিয়াশীল। নারীজীবনকে

তিনি সমাজে-সংসারে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন স্বমহিমায়। প্রাকৃতিক লৈঙ্গিক পরিচয়ে না

দেখে সামাজিক লৈঙ্গিক দৃষ্টিকোণে নারীকে বিবেচনার প্রাথমিক আভাস শিবনাথ শাস্ত্রীর

উপন্যাসে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। শিবনাথ শাস্ত্রীর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে আছে মেজবৌ

(১৮৭৯), নয়নতারা (১৮৮৯), যুগান্তর (১৯১৫), বিধবার ছেলে (১৯১৬) ইত্যাদি। প্রসঙ্গত

উল্লেখ্য যে, তাঁর যুগান্তর

উপন্যাস থেকেই উত্তরকালীন বিখ্যাত সংবাদপত্র যুগান্তরের নামকরণ করা হয়েছিল। উপন্যাসে ভাষা-ব্যবহারে শিবনাথ

শাস্ত্রী ছিলেন অতিসতর্ক। কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কথ্যভাষা ব্যবহার তাঁর

উপন্যাসের একটি বিশিষ্ট লক্ষণ। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের বিকাশের ধারায় শিবনাথ

শাস্ত্রীর অবদান যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে এখনো মূল্যায়িত হয়নি।


শিবনাথ কাব্য , উপন্যাস , প্রবন্ধ, জীবনী ইত্যাদি ধারায় অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর কয়েকটি অনুবাদ ও সম্পাদিত গ্রন্থও আছে। 

১) রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ (১৯০৪),

 ২) আত্মচরিত (১৯১৮) 

৩),History of Brahma Samaj ইত্যাদি 

তাঁর গবেষণামূলক আকরগ্রন্থ। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনা হলো:

 নির্বাসিতের বিলাপ (১৮৬৮), 

পুষ্পমালা (১৮৭৫),

 মেজ বৌ (১৮৮০),

 হিমাদ্রি-কুসুম (১৮৮৭), 

পুষ্পাঞ্জলি (১৮৮৮), 

যুগান্তর (১৮৯৫), 

নয়নতারা (১৮৯৯), 

রামমোহন রায়, ধর্মজীবন (৩ খণ্ড, ১৯১৪-১৬), বিধবার ছেলে (১৯১৬) ইত্যাদি। 

ব্রাহ্মসমাজের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কথা এলে শিবনাথ শাস্ত্রীও আসবেন অবধারিতভাবে। রাজা রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গেই তিনি উঠে আসেন সারিতে। প্রথমে আদি ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকৃষ্ট হলেও, পরে সেই আকর্ষণ চলে যায় কেশবচন্দ্র সেনের দিকে। যুক্তি, চিন্তা আর প্রশ্নের মাধ্যমেই আসল ব্যাপারগুলিকে বুঝতে চেষ্টা করছিলেন তিনি। একটা সময় মদ্যপানের বিরোধিতা করে বের করেছিলেন আস্ত একটি মাসিক পত্রিকা ‘মদ না গরল’। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে নানা সময় নানা আন্দোলন করেছেন। কেন একটি মেয়েকে নাবালিকা অবস্থাতেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে, তার কোনো যুক্তি খুঁজে পাননি। সেই বিবাহের বয়স যাতে ন্যুনতম ১৪ বছর হয়, তারই চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু যখন দেখলেন কেশবচন্দ্র সেন নিজেই তাঁর নাবালিকা কন্যাকে বিয়ে দিলেন, তখনই সরে এলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। ১৮৭৮ সালে তৈরি করলেন সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ। 

এ তো ছিল সমাজসংস্কারক শিবনাথ শাস্ত্রী। পাঠক, এবার আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করাব অন্য একটি দিকে। তিনি কবি শিবনাথ। তখন স্কুলের ছাত্র তিনি। ক্লাসেরই একটি ছাত্রের সঙ্গে বিশেষ বনিবনা ছিল না বাকিদের। ধনী পরিবারের সন্তান; কাজেই তার দেমাকও তেমন। পড়াশোনাতেও মন ছিল না একেবারে। সেই ছেলেই একবার প্রথম হয়ে গেল! ব্যস, আর পায় কে! অহংকার যাকে বলে আকাশে পৌঁছে গিয়েছিল। আর সেই ছাত্রটিকে জব্দ করার জন্যই কিশোর শিবনাথ একটা ফন্দি আঁটলেন। নিজের মনেই লিখে ফেললেন একটি কবিতা; অবশ্যই ব্যঙ্গাত্মক। আর যায় কোথায়! শিবনাথের সেই একটা কবিতাতেই বোমা ফাটল ক্লাসঘরে। জীবনের প্রথম কবিতা ওইখানেই।

তারপর থেকে মামা দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের পত্রিকা ‘সোমপ্রকাশ’-এই প্রকাশিত হতে লাগল তাঁর কবিতা। অবশ্য স্বনামে নয়; ছদ্মনামে। ‘শ্রীশ’ নামে ভরে উঠতে লাগল পত্রিকার পাতা। প্রায় সবই ব্যঙ্গাত্মক রচনা। কবিতার ছন্দের আড়ালে বসেই মেঘনাদের মতো সমাজকে দেখতে লাগলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। ওই লেখাগুলো থেকেই তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজ এবং সমাজ-সংস্কারের বিষয় চলে আসার ফলে ব্যস্ত হয়ে গেলেন তিনি। কবি শিবনাথ শাস্ত্রীকে আর সেভাবে দেখতেই পেল না বাংলা।


মৃত্যু - ১৯১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।


========================{========

No comments: