ছেলেটি সিটি কলেজের প্রাক্তনী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ‘স্যার’ হলেন তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে ‘টি.এন.জি’। ভারতীয় বৌদ্ধিক সমাজে যাঁর পরিচয় সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় হিসেবে।
প্রত্যক্ষ ছাত্র সৌমিত্র ছাড়াও বাঙালির বড় আপনজন আরও দু’জন মানুষের সঙ্গেও জড়িয়ে নারায়ণবাবু। ২২এ পটলডাঙা স্ট্রিটের (২০, পটলডাঙা নয়) বাড়িতে নারায়ণবাবু আর তাঁর স্ত্রী আশাদেবীর সংসার। ছেলে অরিজিৎ তখন বেশ ছোট।
এমনই একদিন বাড়িতে বিশেষ এক জন এসেছেন। খবরটা চাপা থাকল না। বাইরে ভিড় জমেছে। ওই আগন্তুককে ছুঁয়ে না দেখা পর্যন্ত নড়বে না জনতা। নারায়ণবাবু বাইরে এসে উপস্থিত ভিড়কে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। বিশেষ লাভ হল না। শেষমেশ পুলিশ ডাকতে হল।
আসলে বাড়িতে এসেছিলেন উত্তমকুমার। সিনেমার একটি চরিত্র বুঝতে। শুধু উত্তমই নন, এক বার নারায়ণবাবুকে যেতে হয় সুচিত্রা সেনের বাড়িতেও।
পঞ্চাননতলার বাড়ির বৈঠকখানায় বসে গল্পটা শুনিয়েছেন ছেলে অরিজিৎ। সেই সময় হরিসাধন দাশগুপ্তের ‘কমললতা’ সিনেমার শুটিং চলছে। নাম ভূমিকায় মহানায়িকা। তাই অনুরোধ নারায়ণবাবুকে, ‘যদি বাড়ি এসে কিছু খুঁটিনাটি বিষয় একটু বুঝিয়ে দেন।’ খানিক কথাবার্তার পরেই সুচিত্রার জিজ্ঞাসা, ‘দাদা, ঠিক হচ্ছে তো?’ জিজ্ঞাসাটা সুচিত্রা ঠিক মানুষকেই করেছেন। কারণ উত্তম-সুচিত্রার ওই সিনেমার কাহিনি বিন্যাস, সংলাপ ও চিত্রনাট্য রচনার গুরুদায়িত্ব যে নারায়ণবাবুরই।
এ ছাড়া ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘ইন্দিরা’, ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন’, ‘সাহারা’ প্রভৃতি অজস্র সিনেমায় নারায়ণবাবু চিত্রনাট্যকারের দায়িত্ব সামলেছেন। শুধু চিত্রনাট্যই নয়, ‘চারমূর্তি’, ‘নন্দিতা’, ‘সঞ্চারিণী’ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের পরিচালনায় ‘টোপ’— বহু বার নারায়ণবাবুর লেখা ফিরে এসেছে সিনেমার পরদায়। গানও লিখেছেন ‘ঢুলি’ ছবিতে।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ১৯১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার (বর্তমানে ঠাকুরগাঁও জেলা) বালিয়াডাঙ্গি উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রমথনাথ গঙ্গোপাধ্যায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস বরিশালের বাসুদেব পাড়া গ্রামে। তাঁর শিক্ষাকাল কাটে দিনাজপুর, ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ, বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ ও কলকাতায়। ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন এবং ডক্টরেট্ ডিগ্রি নেন ১৯৬০ সালে। এরপর তিনি জলপাইগুড়ি কলেজ, সিটি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।
তিনি ছেলেবেলা থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। তার প্রথম লেখা ছাপা হয় মাস পয়লা শিশু মাসিকে। সন্দেশ, মুকুল, পাঠশালা, শুকতারা প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখেছেন। সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় সুনন্দর জার্নাল লিখে সুখ্যাতি অর্জন করেন। বাঙালির জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, রোজকার সমস্যা ও রাজনীতি নিয়ে লেখা নিয়মিত এই জার্নাল অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল বাঙালি পাঠকের কাছে। এ সময় তিনি বড়দের জন্য আনন্দবাজার, বিচিত্রা, শনিবারের চিঠি ও চতুরঙ্গে লেখালেখি করেন। তার সাহিত্য জীবন শুরু হয় কাব্যচর্চা দিয়ে। পরে তিনি গল্প-উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। বড়দের জন্য রচিত প্রথম প্রকাশিত ‘উপনিবেশ’ ছাপা হয় মাসিক ভারতবর্ষে। ওটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে। তার উপন্যাস-গল্প রচনার অনুপ্রেরণা যোগান উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, সুধাংশুকুমার রায় চৌধুরী, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, মন্মথ সান্যাল, সজনীকান্ত দাস ও ফনীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
অমর খ্যাতি বড়দের জন্য রচিত উপন্যাস ও গল্পের জন্য। কিন্তু শিশু-কিশোর সাহিত্য রচনায় তার খ্যাতি বড়দের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। টেনিদা তার অনন্য সৃষ্টি। এছাড়াও শিশুদের জন্যে অজস্র ছোটগল্প লিখেছেন। তার রচিত পদ্মপাতার দিন, পঞ্চাননের হাতি, লালমাটি, তারা ফোটার সময়, ক্যাম্বের আকাশ, বাংলা গল্প বিচিত্রা, ঘণ্টাদার কাবলু কাকা, খুশির হাওয়া, কম্বল নিরুদ্দেশ, চারমূর্তির অভিযান, ঝাউবাংলার রহস্য ও ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যে নতুন সংযোজন।
বড়দের জন্য রচিত তার উলেস্নখযোগ্য বইগুলো হলো: একতলা, কালা বদর, কৃষ্ণপক্ষ, গন্ধরাজ, পন্নন্তর, ট্রফি, তিমির তীর্থ, দুঃশাসন, গদসঞ্চার, বনজ্যোৎন্সা, বিদিশা, বীতংস, বৈতালিক, ভাঙাবন্দর, চন্দ্রমুখর, মহানন্দা, রামমোহন, শিলালিপি, শ্বেতকমল, সাগরিকা, স্বর্ণ সীতা, সূর্যসারথী, সঞ্চারিণী, সম্রাট ও শ্রেষ্ঠী, সাপের মাথায় মণি, আশিধারা, ভাটিয়ালী, আগন্তুক, অমাবস্যার গান, বিদুষক, সাহিত্যে ছোটগল্প, বাংলা সাহিত্য পরিচয়, ছোটগল্পের সীমারেখা ও কথাকোবিদ রবীন্দ্রনাথ।
তিনি ছোট গল্প বিষয়ে ডি.লিট ডিগ্রি লাভ করেন।
রচনা কর্ম ;
উপন্যাস
উপনিবেশ -১
উপনিবেশ -২
উপনিবেশ -৩
সম্রাট ও শ্রেষ্ঠী
মন্দ্রামুখর
মহানন্দা
স্বর্ণসীতা
ট্রফি
লালমাটি
কৃষ্ণপক্ষ
বৈতালিক
শিলালিপি
অসিধারা
ভাটিয়ালী
পদসঞ্চার
আমাবস্যার গান
আলোকপর্ণা
নাটক
রাম মোহন
ভাড়াটে চাই
আগুন্তক
পরের উপকার করিও না
ভীম বধ
বারো ভূতে
কিশোর উপন্যাস ও ছোটগল্প সম্পাদনা
টেনিদা ও সিন্ধুঘোটক
চারমূর্তি
চারমূর্তির অভিযান
ঝাউবাংলোর রহস্য
অন্ধকারের আগন্তুক
পঞ্চাননের হাতি
রাঘবের জয়যাত্রা
জয়ধ্বজের জয়রথ
অব্যর্থ লক্ষভেদ
ছোটগল্প সংকলন
বীতংস (১৯৪৫)(প্রথম গল্প সংকলন)
দুঃশাসন (১৯৪৫)
ভোগবতী (১৯৪৭)
গবেষণা-গ্রন্থ
সাহিত্যে ছোটগল্প
মূলত ঔপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক, অধ্যাপক, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের একজন বিশিষ্ট লেখক। তাঁর ‘উপনিবেশ’, ‘সম্রাট ও শ্রেষ্ঠী’, ‘মহানন্দা’, ‘লালমাটি’, ‘স্বর্ণসীতা’ প্রভৃতি উপন্যাসের তিনি সার্থক শিল্পী। ‘সাহিত্যে ছোটোগল্প 'বাংলা গল্প বিচিত্র' প্রভৃতি বিখ্যাত গ্রন্থের প্রণেতা, সবার প্রিয় টেনিদা এবং সুনন্দন জার্নালের লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর যুগের একজন খ্যাত লেখক বলেই পরিচিত ছিলেন।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ছদ্মনাম। তাঁর আসল নাম তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর জন্ম হয় দিনাজপুরের বালিয়াডিঙ্গিতে ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তাঁর জন্মসাল নিয়ে বিতর্ক আছে। কেউ কেউ মনে করেন তিনি জন্মেছিলেন জানুয়ারি, ১৯১৭ সালে। তবে ১৯১৮ই তাঁর জন্মসাল বলে বিশেষ পরিচিত। তাঁর পিতার নাম প্রমথনাথ গঙ্গোপাধ্যায় আর মাতার নাম বিন্ধ্যবাসিনী দেবী। ১৯৭০-এর নভেম্বর মাসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন যথেষ্ট ক্রিয়াশীল।
গল্পে উপন্যাসে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের যথেষ্ট খ্যাতি হলেও তাঁর প্রথম প্রকাশিত সাহিত্য 'ডাক' নামে একটি কবিতা। প্রকাশিত হয়েছে ১৯২৯ সালে। তারপর তাঁর অনেক কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। 'নমস্কার' নামে নারায়ণের একটি কবিতা ‘দেশ’ পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছে ১৯৩৪ সালে। এছাড়া আরও কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর প্রথম গল্প ‘নিশীথের মায়া’ও দেশ পত্রিকায় ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম লেখা ‘রহস্য রোমাঞ্ছিত' একটি উপন্যাস। সচিত্র হাতে লেখা পত্রিকা ‘চিত্র বৈচিত্র্যে’র জন্য এই উপন্যাস লেখা হয়েছিল। তাঁর প্রথম গল্পের নাম ‘পাশাপাশি’। ফুলস্ক্যাপ কাগজের তিন পৃষ্ঠা। বিষয়বস্তু পাশাপাশি দুটি বাড়ি, একটিতে বড়োলোক আর একটিতে বাস করে দীন দরিদ্র। একদিন বর্ষার সন্ধ্যায় বড়োলোকের বাড়িতে যখন টি-পার্টি চলছে তখন গরীবের ছেলেটি বিনা চিকিৎসায় মারা গেল।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম মুদ্রিত সাহিত্যসৃষ্টি প্রথমে ‘মাসপয়লা' পত্রিকায়, তারপর সাপ্তাহিক ‘দেশ’-এ। এই পত্রিকার তাগিদেই তিনি লিখতে আরম্ভ করেন গল্প। প্রথম মুদ্রিত গল্পটির নাম ‘নিশীথের মায়া'। এই গল্প সম্পর্কে নারায়ণ লিখেছেন, “বয়সুলভ রোমান্টিকতার মায়াময় স্বপ্নময় অতীতের মধ্যে তলিয়ে গিয়ে গল্প আকারে একটা ফ্যান্টাসি খাড়া করে তুলেছিলাম।” তারপর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ৩৪/৩৫ বছর ধরে নারায়ণের লেখনীর স্রোেত প্রবল ধারায় বয়ে চলেছিল। বিচিত্রমুখী তাঁর প্রতিভা। অধ্যাপনা, বাগ্মিতা, কথকতা, গল্প-কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, জার্নাল, কিশোর সাহিত্য প্রভৃতি—সব বিভাগেই তাঁর স্বচ্ছন্দ গতি এবং স্বীকৃত প্রতিষ্ঠা। আশীর ঊর্ধ্বে তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা। সৃষ্টির এই ব্যাপকতা একদিকে যেমন তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম অন্যদিকে তেমনি তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতা এবং অসাধারণ কল্পনা ও মনন শক্তির পরিচয়.
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম গল্পগ্রন্থের নাম ‘বীতংস'। বীতংস তার অন্যতম শ্রেষ্ঠগল্প বলে বিবেচিত। এই গল্পেই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোটোগল্পের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। গল্পটির নায়ক আসামের চা বাগানের কুলি সংগ্রহের দালাল সুন্দরলাল। সেজন্য সাঁওতাল পরগণায় তার আবির্ভাব খচ্চরবাহন সন্ন্যাসীর বেশে। সন্ন্যাসী হলেও সে গেরুয়াধারী নয়। সন্ন্যাসীর মতো তার কতকগুলো বিষয়ে অদ্ভুত দক্ষতা। সে হাত দেখতে জানে, শিকড়-বাকড় দিয়ে কঠিন রোগ নিরাময় করতে পারে, ভূত ছাড়াতে পারে, গাঁজার কলকেয় দম চড়িয়ে সুর করে সে তুলসীদাসী রামায়ণ পড়ে। সুতরাং দু মাসের মধ্যেই সাঁওতালের কাছে সুন্দরলাল মহাপুরুষ বলে পরিচিতি লাভ করল। নিরীহ সাঁওতালদের সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে গাঁয়ে মড়ক লাগাবার ভয় দেখিয়ে সুন্দরলাল তাদের রক্ষা করবার নামে ঘরছাড়া করে নিয়ে চলল সাঁওতালদের সম্পূর্ণ অজানা এক পরদেশে—আসামের চা-বাগান। কেবল ঝড়ু সাঁওতালের মেয়ে বুধনীকে সে চা-বাগানের কুলী করতে চায় না। কারণ তার প্রতি সুন্দরলালের রোমান্টিক দুর্বলতা আছে। এই গল্পের ঘটনা অদ্ভুত। রস বীভৎস। গল্পের পটভূমি সভ্যতার আলো থেকে অনেক দূরে সাঁওতাল পরগণার শালবন ঘেরা এক অখ্যাত গ্রাম। সেখানে সাঁওতালদের বিশ্বাস অর্জন করবার জন্য সুন্দরলালের যেসব শারীরিক কসরৎ আছে তা বিস্ময়বহ। শিং বোঙার পূজোয় মুরগীর রক্ত হাতে মুখে মেখে মাতাল সুন্দরলালের মাদলের তালে তালে নাচ বীভৎস। এই গল্পের রহস্য রোমাঞ বর্ণনার মধ্যে নারায়ণের উদ্দাম রোমান্টিক কল্পনার গভীর পরিচয় আছে। পরিবেশ রচনার মধ্যে আছে কাব্যিক প্রাণতা। এই দুটিই তাঁর গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য। রোমান্টিক বলেই তাঁর গল্পের ঘটনা স্বাভাবিকতার সীমা অতিক্রম করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অদ্ভুতের মাত্রা স্পর্শ করেছে। এদিক থেকে নারায়ণ তারাশঙ্করের সমগোত্রীয়। উভয়ের কাল্পনিকতায় বহু অদ্ভুত ঘটনার যোগ দেখা যায়। গল্প রচনার কৌশলে উভয়ে সিদ্ধহস্ত। অজানা পরিবেশ, অদ্ভুত ঘটনা গল্পের উপাদান, কিন্তু সব মিলিয়ে অতি সহজে গল্পরসের মাদকতা সৃষ্টি হয়।
নারায়ণের গল্পগ্রন্থের সংখ্যাও বহু—‘রূপমতী’, ‘কালাবরার’, ‘গন্ধরাজ’, ‘ভাঙাবন্দর’, ‘গল্পসংগ্রহ',' ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’, ‘চারমূর্তি’, ‘দুঃশাসন’, ‘শ্বেতকমল’, ‘বীতংস’, ‘একজীবিশন’, ‘ঊর্বশী', ‘শিলাবতী’, ‘ভাটিয়ালী’, ‘জন্মান্তর’, ‘বনজোৎস্না’, ‘ভোগবতী’, ‘রাতের মুকুল’, ‘লক্ষ্মীর পা’, ‘শুভক্ষণ’, ‘সাপের মাথার মণি' ইত্যাদি।
শ্রেষ্ঠগল্পের ভূমিকায় পটভূমি, পরিবেশ এবং বিচিত্র মানুষের পরিচয় দিতে গিয়ে জগদীশ ভট্টাচার্য যথার্থই লিখেছেন, “পৃথিবীর প্রথম প্রাণশক্তির শ্যামায়িত আদিম প্রকাশ ডুয়ার্স টেরাই -আরাকানের হিংস্র অরণ্যভূমি থেকে নিম্নভূমির নদী মোহনায় সমুদ্রগর্ভ হতে সদ্যোখিত নোনামাটির চার মানুষের নতুন উপনিবেশ পর্যন্ত তাঁর দৃষ্টি সমভাবে প্রসারিত। কখনো পদ্মা-মেঘনা-কালাবদর-আড়িয়াল খাঁর তিমির তীর্থে জীবনতরঙ্গ উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে, কখনো আত্রাই-মহানন্দা-কাঞ্চন নদীর কূলে সম্রাট ও শ্রেষ্ঠীর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উচ্চকিত রয়েছে জীবনচেতনা। কখনো মহাস্থান-কোটিবর্ষ-পৌন্ড্র বর্ধনের ধ্বংসস্তূপ নবজীবনের তাণ্ডবে মন্দ্রমুখর, কখনো পুরাতন তাম্রলিপ্তের মাটিতে রচিত হচ্ছে নতুন যুগের বীরমল্লদের ইতিহাস। পশ্চিম সীমান্ত থেকে মহুয়ামদির গন্ধে ভেসে এসেছে নীল পাহাড়ে ঘেরা সাঁওতাল পরগণার অপূর্ব বনশ্রী, আবার উত্তর দিকচক্রবালে পায়ের তলায় দেখা দিয়েছে সিংহবাদের হিজলবন আর বরেন্দ্রভূমির লালমাটি।
এই বিচিত্র পটভূমিতে কত বিচিত্র মানুষেরই না আবির্ভাব ঘটেছে। আসামের চা বাগানের জন্য সাঁওতাল পরগণায় কুলি রিফ্রুটার সাধু সুন্দরলাল, পঞ্চাশের মন্বন্তরে মহানগরীর বুকে বসেও সিণ্ডালাও দ্বীপের কাটাবাটুর জংলী সর্দারের নিকট পাওয়া বলি দেওয়া কুমারী মেয়ের মন্ত্রসিদ্ধ হাড়ের অলস স্বপ্নে বিহ্বল মনোহর পুকুর পার্কের রায় বাহাদুর, গোলাপোড়া হাটের মহাজন আর আড়তদার ‘তুলসীবনের বাঘ' নিশিকান্ত, সারা বাংলার কুলবধূকে যারা বিবস্ত্র করেছে এ যুগের সে সব দুঃশাসনেরই প্রতিনিধিস্থানীয়— কাপড়ের ব্যবসায়ী দেবীদাস, টেরাই-এর প্রাগৈতিহাসিক হিংস্রতার রাজত্বে মানবশিশুর টোপ দিয়ে বাঘশিকারের রাজকীয় ব্যসনে উল্লসিত রায় গঙ্গা এস্টেটের রাজাবাহাদুর এন আর চৌধুরী, বিহার-শরীফের অতিথি বৎসল্য রহস্যময়ী তরুণী নিরু, ভারতবর্ষের বিধর্মীদের মধ্যে পবিত্র খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে এসে শিবের গাজনে ভোলানাথের তাণ্ডব নৃত্যে বেসালাম লাইপজিগ ইউনিভার্সিটির ব্লু–তরুণ পাত্রী হ্যানস, নগাধিরাজের আদিম গুহায় বিশ্বাসঘাতিনী মাইলি আর প্রভুভক্ত লাল্লুর প্রণয় প্রতিহিংসা কন্টকিত জান্তব জীবন সংগ্রামে পরাজিত অমানুষিক মানুষ গুস্ফালামা, 'মুম্বাই' শহরের আশিকবাঈ এর বিশ্বাসঘাতী প্রেমে দেওয়ান মিঞা-কে-টোড়ীর ঐন্দ্রজালিক সেতার শিল্পী উস্তাদ মেহরা খাঁ, ডুয়ার্সের জলঢাকা নদীর তীরে জ্যোৎস্নাপুলকিত রজনীতে পিতমের প্রতীক্ষায় স্বপ্নাচ্ছন্ন বাণবিদ্ধ হরিণী শিউকুমারী, দেশজোড়া পুরস্কার প্রকোপ থেকে সম্পন্ন মহাজন আর তালুকদারদের রক্ষামানসে শ্মশানকালীর প্রসাদ প্রার্থনায় পঞ্চমুণ্ডী আসনে উপবিষ্ট দক্ষিণালোভী পুরোহিত তর্করত্ন, অন্যের সুখের ঘরে অকারণে আগুন লাগিয়ে নিজের বিড়ম্বিত ভাগ্যের প্রতিশোধ গ্রহণের পৈশাচিক উল্লাসে পরিতৃপ্ত-মুখপোড়া শিক্ষয়িত্রী মিস ইন্দিরা চৌধুরী, কন্ট্রোল, কালোবাজার, ইনফ্লেশন আর স্পেকুলেশনের যুগে শ্মশানীভূত পল্লীর পরিত্যক্ত শিক্ষাতীর্থে আদর্শনিষ্ঠ অপ্রকৃতিস্থ, হেডমাস্টার, দিগন্ত বিস্তৃত বনতুলসীর জঙ্গলে কালো পাথরে তৈরি ভেনাসের মতো নিরাবরণা বন বালিকা, বিয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলনের তাম্রলিপ্তের উদ্বেলিত জনসমুদ্রে ফলেন এঞ্জেলের মতো নিজের একমাত্র পুত্রকে হারিয়েও নীলকণ্ঠের ন্যায় অনাসক্ত ঐতিহাসিক অমরেশ”–রাজনীতি সংক্ষুব্ধ, যুদ্ধ-দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তর-সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিধ্বস্ত চল্লিশ দশকের অত্যাশ্চর্য পরিচয়। অতি প্রত্যক্ষ দৈনন্দিন ঘটনা গল্পকারের হাতে অদ্ভুত রূপ এবং প্রকাশ লাভ করেছে।
কাল চেতনা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মনে নানাভাবে ক্রিয়শীল। দেশের মুক্তি, সাধারণ মানুষের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি নারায়ণের শিল্পীসত্তার কাছে ছিল এক প্রধান প্রেরণা। কিন্তু তা কোনো বিশেষ পথচিহ্নিত বা আদর্শবাহী ছিল বলে মনে হয় না। তাঁর বাল্য কৈশোরের সন্ধিস্থলে তাঁর অগ্রজ শেখর গাঙ্গুলি ছিলেন তৎকালীন বিপ্লবী আন্দোলনের গোপন পথিক। তাঁর জীবনবোধের ওপর অগ্রজের স্বাভাবিক প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। আবার, কিশোর নারায়ণের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কলেজের সহপাঠী অচ্যুত গোস্বামী লিখেছেন, নারায়ণ তখন ছিল রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের পরম অনুরাগী, গান্ধিজির নীতিতে বিশ্বাসী। যুবক সমাজের উন্নতির জন্য ঋজু কঠিন ব্রয়চর্যের আদর্শের প্রয়োজনীয়তায় বিশ্বাসী। তারপর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতির আন্দোলনের সময় অনেকের মতো নারায়ণও কমিউনিস্ট মতাদর্শের কাছাকাছি এসেছিলেন। পরে 'পরিচয়' পত্রিকাগোষ্ঠীর পরিচালক মণ্ডলীর একজন হয়েছিলেন। তাঁর রাজনীতি জিজ্ঞাসা ছিল, সমাজতন্ত্রে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু রাজনীতি ও সাহিত্যকে তিনি সর্বত্র সমন্বিত করেননি। কারণ তিনি স্বাধীনচিত্ততায় বিশ্বাসী ছিলেন। শিল্পীর স্বাধীনতা' বলে তাঁর মনে যা প্রচ্ছন্নভাবে ছিল সেটাই পরবর্তীকালে মুখর হয়ে উঠেছিল।” (দ্রঃ বাংলার গল্প ও ছোটোগল্প—ডঃ সরোজমোহন মিত্র), যুগের হাওয়ার সঙ্গে সমতাল রক্ষা করেই তিনি সাহিত্য রচনা করেছেন। সেজন্য তাঁর জীবিতকালে সংঘটিত নানা আলোড়নের নিদর্শন আছে তাঁর গল্প উপন্যাসের বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকে।
তবে সিনেমা নয়, নারায়ণবাবুর সবচেয়ে তৃপ্তি বোধহয় পড়ানোয়। পড়িয়েছেন জলপাইগুড়ি আনন্দচন্দ্র কলেজ, সিটি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্লাস নিয়েছেন সাউথ সিটি কলেজের (বর্তমান শিবনাথ শাস্ত্রী কলেজ) মর্নিং সেকশনেও। যদি সাহিত্য-অধ্যাপনার কোনও ইতিহাস রচনা করা যায়, তা হলে বোধ হয় বিশেষ একটি অধ্যায়ই ছাড়তে হবে নারায়ণবাবুর জন্য।
কেন এমনটা বলা?
বর্ণনাটা দিচ্ছেন শঙ্খ ঘোষ। এক স্পেশ্যাল ক্লাসের। অন্তত তিনশো পড়ুয়ার দাবি, স্যারের ক্লাস চাই। তা, শুরু হল ক্লাস। তিল ধারণের জায়গা নেই। এমন সময়ে ঢুকলেন অত্যন্ত গৌরবর্ণ নারায়ণবাবু। ছ’ফুট ছুঁই ছুঁই লম্বা। গায়ে ধুতি-পাঞ্জাবি। পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি। ক্লাসে তখনও পড়ুয়াদের অনেকে বসার জায়গা পাননি। পড়ানো শুরু করলেন নারায়ণবাবু। পড়ুয়াদের কেউ দেওয়ালে, কেউ বা অন্যের পিঠে খাতা রেখে ‘নোট’ নেওয়া শুরু করলেন। আনন্দে বোধ হয় খানিক উচ্ছ্বল হয়ে উঠলেন টি.এন.জি। বললেন, ‘আগে জানলে তো রিপোর্টারদের একটা খবর দিতাম, ছবি নিয়ে যেত।’
রিপোর্টার দরকার পড়েনি এমন অধ্যাপকের। কারণ তাঁর ছাত্র বাৎসল্য তো যে সে জাতের নয়।
তার প্রমাণ অন্তত দু’টি ঘটনা।
স্থান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ভাষাতত্ত্ব পড়াচ্ছেন এক শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক। এক ছাত্র ক্লাসের বদলে ফিসফিসিয়ে আড্ডাতেই বেশি মনোযোগী। সে দিকে তাকিয়েই অগ্নিশর্মা অধ্যাপকের নির্দেশ, ‘এমন একটি বাক্য বলো, যাতে বিদেশি ভাষা আছে।’
সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজের ত্রিসঙ্গমের এই শোভাযাত্রায় হাঁটতে হাঁটতেই হয়তো এল সেই দিনটা। ১৯৭০ সালের ৭ নভেম্বর। রাতের খাওয়া হয়েছে সবেমাত্র। পুত্র অরিজিৎ পাশের ঘরে বসে বাবারই দেওয়া শার্লক হোমসের গল্প পড়ছেন। এমন সময়ই মা আশাদেবীর চিৎকার, ‘বাবলু দ্যাখ, বাবা কেমন করছেন!’
বাবার ঘরে দৌড়ে গেলেন ছেলে। বাবাকে দেখেই ছুট দিলেন কাছে থাকা চিকিৎসক-সাহিত্যিক নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘উল্কা’ বাড়িতে। গেঞ্জি গায়েই এলেন কিরীটির স্রষ্টা। পরামর্শ দিলেন, ‘এখনই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।’ বেশ কয়েকটা বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরলেন অরিজিৎ। সব জায়গাতেই এক রা, ‘বেড নেই।’ পরে ভর্তি করানো হল এসএসকেএম-এ।
মাত্র একটা দিন। ৮ নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন বাঙালির প্রিয় সুনন্দ।
বাঙালির কাছে খবরটা হাহাকারের মতো। কিন্তু সুনন্দর কাছেও কি এটা আকস্মিক ছিল? বোধ হয় না। তা না হলে কী ভাবে ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘সুনন্দর জার্নাল’-এর শেষ জার্নাল ‘অসুস্থ শরীরের ভাবনা’য় সুনন্দ লিখবেন, ‘অসুস্থ শরীরে জার্নাল লিখতে লিখতে ভাবছি, পরের সংখ্যায় ‘সুনন্দের পাতাটি’ যদি না থাকে, তা হলে বুঝবেন, আর একটি কমন ম্যান বাঙালির অবলুপ্তি বা আত্মবিসর্জন ঘটল।’
ফুলে ফুলে সাজানো ট্রাকে চড়ে নারায়ণ চলেছেন শেষ যাত্রায়। সঙ্গী অগণিত ছাত্রছাত্রী, সংবাদমাধ্যম, নানা পত্রিকা, সংস্কৃতি জগতের বহু বিশিষ্ট মানুষ।
এমন মেঘলা আবহাওয়ায় আচমকা শোনা গেল, ‘জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে...’ নিজেকে সামলে কখন দরাজ কণ্ঠে গেয়ে উঠেছেন সুচিত্রা মিত্র।
================{{{{{{{{{{{{{{{∆∆∆∆}}}}=
No comments:
Post a Comment