বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়
"খোয়াই বাদ দিও না। খোয়াই আর তাতে একটা সলিটারি তালগাছ। ব্যস। আমার স্পিরিট, আমার জীবনের মূল ব্যাপারটা যদি কোথাও পেতে হয়, ওতেই পাবে। বলতে পার, ওটাই আমি।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেইজকে আমরা সবাই চিনি। কিন্তু বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে? নন্দলালের শিষ্য হয়েও রামকিঙ্করের মতোই যিনি নিজের প্রয়াসে ভারতীয় আধুনিক চিত্রকলার সূচনা করেছিলেন। কিন্তু এতটাই অ-পরিচয় ছিল যে, জীবন সায়াহ্নে পৌঁছেও শান্তিনিকেতন সমাজের বাইরে কেউ তাঁকে বিশেষ চেনেনি। বিস্তীর্ণ খোয়াইয়ের মধ্যে একলা দাঁড়িয়ে থাকা একটি তালগাছের মধ্যেই তাঁকে খুঁজে নিতে বলেছিলেন ছাত্র সত্যজিৎ রায়কে ।
তিনি সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। যেমন
১ ) ভারত সরকার ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে ‘পদ্মবিভূষণ’ ২) বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
৩) পশ্চিমবঙ্গ সরকার 'চিত্রকর' গ্রন্থটির জন্য ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে মরণোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কার ভূষিত করে ।
৪) তাঁর জীবনী, কাজ আর অন্ধত্বকে জয় করে বাঁচা নিয়ে বিশ্ব বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে তথ্যচিত্র তৈরি করেন - "দ্য ইনার আই "।
জন্ম কলকাতার বেহালায় ৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯০৪. অবশ্য আদি বাড়ি ছিল হুগলির গরলগাছায়। পিতা বিপিন বিহারী মুখোপাধ্যায়। মায়ের নাম অপর্ণা। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে বিনোদ বিহারী ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ । পরিবারের অন্য সদস্যরা ছিলেন - ব্রজবিহারী (বড়দা), বিমানবিহারী (ছোড়দা), বনবিহারী (মেজদা), বঙ্কুবিহারী (সেজদা), বিজনবিহারী (ন’দা) । একমাত্র বোন শৈল। বাড়ির পরিবেশ ছিল উদার, সংস্কারমুক্ত, প্রগতিবাদী । রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন পরিবারের সবাই। চোখের গভীর সমস্যা নিয়ে জন্মেছিলেন। এক চোখে ছিল ক্ষীন দৃষ্টিশক্তি আর অন্য চোখে কিছুই দেখতে পেতেন না। । শৈশবে বিনোদ বিহারীর শারীরিক দুর্বলতা, জীবন-সংশয়ের ভয় গ্রাস করছিল গোটা পরিবারকে। ডাক্তারের পরামর্শে ছোট্ট বিনোদের খাওয়াদাওয়া, চলাফেরা ছিল নিয়ন্ত্রিত। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেও তিনি ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তির শিকার হয়েছিলেন। সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল, মডার্ন ইনস্টিটিউশন, ব্রাহ্ম বয়েজ-এর মতো স্কুলে ভর্তি হলেও বেশি দিন টিকে থাকেননি। পরীক্ষা দিয়ে পাশ করার সুযোগও পাননি। ইংরেজি, বাংলা শেখা শুরু বাড়িতে। বই পেলেই পড়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু ইংরেজ ডাক্তার মেনার্ড সাহেব চোখ পরীক্ষা করে নিদান দিলেন, লেখাপড়া করলে চোখের যেটুকু আছে, তাও থাকবে না। সুতরাং, চোখের সমস্যা ও শারীরিক দুর্বলতার কারণে বিনোদবিহারীকে স্কুলের নিয়ম থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছিল। বিকেল হলে মাঠে খেলতে যাওয়ার বদলে বেড়াতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। পড়াশোনার বদলে কেবল ছবি আঁকাই ছিল তার কাজ। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে পড়তে যান। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে কলাভবনে ভর্তি হন। অবনীন্দ্রনাথ ও নন্দলাল বসুর প্রিয় শিষ্য ছিলেন বিনোদ বিহারী। রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মনীন্দ্রভূষণ গুপ্ত, রামকিঙ্কর বেইজ প্রমুখেরা বিনোদ বিহারীর সমসাময়িক ছিলেন ।
১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কলাভবনের শিক্ষক এবং সেই সঙ্গে এখানকার ছোটো মিউজিয়ামের কিউরেটর ও লাইব্রেরিয়ান হন। টেমপেরা তার প্রিয় মাধ্যম হলেও তেল রং ও ম্যুরালেও দক্ষতা ছিল।
" আমি নির্লজ্জের মতো সারাটা জীবন কাগজের ওপর রঙ লেপ্টেই কাটালাম। আসল কথা, আমার স্বভাব এমন যে কোনো সামাজিক দায়িত্বের সঙ্গে আমি নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারিনি। পাকিস্তান-হিন্দুস্তানের ইতিহাস তৈরি হয়েছে আমার চোখের সামনে। দুর্ভিক্ষ, বন্যা, ভূমিকম্প ঘটেছে— এর সঙ্গে কোনো ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আমার ছিল না। এ বিষয়ে কোনো ছবিও আমি করিনি। শিল্পী জীবনের পরাকাষ্ঠাই আমার চিরদিনের লক্ষ্য। আমি নিজেকে জানতে চেয়েছি এবং সেই জানার জন্যই অন্যকে জানতে চেষ্টা করেছি। আমি সাধারণের একজন, একথা আমি কখনো ভুলিনি।”
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতন বাসের এই পর্বে বিনোদবিহারী এক দিকে যেমন ছাত্রী লীলা মনসুখানিকে বিয়ে করেছেন, তেমনই শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয় জীবন ও তার চার দিক নিয়ে তার সেরা ছবিগুলি এঁকেছেন। সন্তোষালয়, শান্তিনিকেতন বাড়ি, কলাভবনের ছাত্রাবাস, পুরনো অতিথিশালা, চীন ও হিন্দিভবনে এমন সব ভিত্তিচিত্র (মুরাল) সৃষ্টি করেছেন, যা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হিসেবে গণ্য হয়। এর মধ্যেই ১৯৩৭ - ৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি জাপান ভ্রমণ করেন। ভারতীয় শিল্পকলায় জাপানি ভাবধারা আনয়নে বিনোদ বিহারী পথিকৃৎ । তার শিল্পপ্রতিভার কিছু নিদর্শন আছে শান্তিনিকেতনের কলাভবনে ও হিন্দিভবনের ফ্রেস্কোগুলিতে (frescoes)। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে কলাভবন ছেড়ে নেপাল সরকারের অনুরোধে ওই দেশের শিক্ষা বিভাগের উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে কাঠমান্ডু যান। সেখানকার সরকারি মিউজিয়ামের কিউরেটর ও ছিলেন তিনি । পরে ১৯৫১ - ৫২ খ্রিস্টাব্দে মুহূর্তে একটি শিল্পশিক্ষাকেন্দ্র ও শিশুশিক্ষা নিকেতন গড়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে চোখের ছানি কাটাতে গিয়ে চিকিৎসা বিভ্রাটের কারণে সম্পূর্ণভাবে অন্ধ হয়ে যান। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে আবার কলাভবনে ফিরে আসেন। এখানে কিছুদিন অধ্যাপনার পর অধ্যক্ষ পদে বৃত হন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে এমেরিটাস অধ্যাপক হিসাবে কিছু দিন কলাভবনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । শেষ জীবনে সম্পূর্ণ নির্জনবাস করেছেন।
১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের ১১ নভেম্বর দিল্লির একটি নার্সিংহোমে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়।
তিনি ‘শিল্পসর্বস্বতাবাদী’ বা ‘আঙ্গিকীকরণবাদী’ ছিলেন না। শিল্পের বিষয় হিসেবে গুরু অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলালের মতো ধর্মীয় এবং পৌরাণিক ক্ষেত্রকে বেছে না নিয়ে তিনি চোখ রেখেছিলেন তাঁর চারপাশের দৃশ্যমান প্রকৃতি, প্রান্তর, প্রাণী, মানুষ আর বিপুল প্রজ্ঞার জগতের উপরে। কারণ, তাঁর আসল গুরু যে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ! নিজেই বলেছেন, “আমার ছবি না দেখলে আমার জীবনের বৈশিষ্ট দেখতে পাওয়া যাবে না।”
এক ধরনের অভিজ্ঞতাও বিনোদবিহারীকে ঋদ্ধ করেছিল। তা হল, রবীন্দ্রনাথকে জানা। যদিও তাঁর খুব কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ বিনোদবিহারীর বিশেষ হয়নি, তবে বিদ্যালয়ের ছাত্র বা পরবর্তী কালে কর্মী হওয়ার সুবাদে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রায়ই দেখা হত। এখানেও তিনি সেই একলব্য। শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের অনুমতিতে। তার পরে কলাভবনে যোগ দিয়ে তিনি যখন নন্দলালের বিরক্তির কারণ হয়েছেন, একদিন রবীন্দ্রনাথ কলাভবনে এসে নন্দলালকে বলেছিলেন, “যদি ও নিয়মিত আসনে বসে এবং মনোযোগ দিয়ে কাজ করে তবে ওকে স্থানচ্যুত কোরো না। ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা কোরো না। সকলকে নিজের পথ খুঁজে নিতে দাও।” শিল্পীর পথ খুঁজতে রবীন্দ্রনাথই তাঁকে পরোক্ষে সাহায্য করেছিলেন।
দারিদ্র্য আর একাকিত্ব বিনোদবিহারীকে আজীবন ছায়ার মতো অনুসরণ করেছে। শান্তিনিকেতন আবাসিক জীবনেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবু তারই মধ্যে তাঁর শিল্পী-পরিচয় নন্দলাল, অবনীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ একটু একটু করে পেয়েছিলেন। তাই নন্দলালই একদিন ছাত্র বিনোদকে পাঠিয়েছিলেন কলকাতার জোড়াসাঁকোয়, সেই পর্যায়ে আঁকা তাঁর কিছু ছবি অবনীন্দ্রনাথকে দেখাতে। জোড়াসাঁকোয় গিয়ে তিনি দেখা করেছিলেন তিন ভাই অবনীন্দ্র, গগনেন্দ্র ও সমরেন্দ্রর সঙ্গে। এক সময়ে অবনীন্দ্রনাথ প্রদর্শনীতে তাঁর নিজের ছবির পাশে ছাত্র বিনোদের ছবি ঝুলিয়ে তাঁকে বুঝতে সাহায্য করেছিলেন, কোথায় কোন ত্রুটি রয়েছে। তার পরে অবশ্য অবনীন্দ্রনাথ চিনে ফেলেছিলেন তরুণ এই শিল্পীকে। তাই অবলীলায় বিনোদবিহারীর প্রথম দিকের আঁকা ‘শীতের সকাল’ ছবিটি তিনি প্রবাসীতে ছাপিয়েছিলেন তাঁর ‘ত্রয়ী’ ছবির সঙ্গে।
====================[=====[[======
No comments:
Post a Comment