শৈল চক্রবর্তী
আঁকা আয়ত্ত করতে তাঁর কোনও শিক্ষাগুরুর প্রয়োজন পড়েনি অথবা পা বাড়াতে হয়নি আর্ট কলেজের পথে। যেটা না থাকলেই নয়, সেই ‘অবজারভেশন’টাই ছিল তুখোড়। তা দিয়েই ১৯৩০-এর দিকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ইলাস্ট্রেশনের কাজ শুরু করেন। শুরুর দিকে ইলাস্ট্রেশনেই জোর দিয়েছিলেন তিনি। সেসময়ে বা তার আগে কমিক ছবির ক্ষেত্রে তাঁর মতো সফল কেউ ছিলেন না।
বাংলায় ‘স্ট্রিপ’ কার্টুনের প্রবর্তকও বলা চলে তাঁকে। একদিকে প্রতুলচন্দ্র লাহিড়ীর ‘খুড়ো’, অন্যদিকে শৈল চক্রবর্তীর ‘লিটল ডাকু’ –এই দু’টিই স্ট্রিপ কার্টুনের অগ্রগামী। টানা ষোল বছর ‘লিটল ডাকু’ অমৃতবাজারে জনপ্রিয়তা বজায় রেখেছিল। শোনা যায়, এই ‘ডাকু’র সঙ্গে তাঁর ছেলে অভিনেতা-সাংসদ-চিত্রশিল্পী চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী’র শৈশব-মুখাবয়বে নাকি বেশ মিল ছিল। নিজের সন্তানদের মধ্যে সুনিপুনভাবে শৈল্পিক সত্ত্বার বীজ বপন করে দিয়েছিলেন শৈশব থেকেই। সে বিষয়ে এক সংবাদপত্রের প্রবন্ধে চিরঞ্জিৎ নিজে লিখেছিলেন, এক একদিন হত আঁকার ওয়ার্কশপ। বাবা ফিঙ্গার পেন্টিং করতে দিতেন আমাদের। পেনসিল, তুলি এ সব নিয়ে আঁকা মোটেই মুখের কথা নয়, তাই বলতেন ও সব নয়, ফিঙ্গার পেন্টিং করো। এটাও ছিল মায়ের জন্য আর এক ঝামেলার দিন। সে দিন মাকে এক হাঁড়ি অ্যারারুটের আঠা বানাতে হত। প্লেটে রং থাকত। সেই রং ওই আঠার সঙ্গে মিশিয়ে, আঙুলে নিয়ে গাছ, ফুল, পাখি আঁকা চলত। সত্যি, বাবার কাছ থেকে কত কী যে শিখেছি!
জন্ম ০৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯০৯ পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার আন্দুল মৌরিগ্রামে। পিতা উদয়নারায়ণ চক্রবর্তী ছিলেন আন্দুল হাইস্কুলের শিক্ষক। মাতার নাম রানি চক্রবর্তী। আন্দুল হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও হাওড়ার নরসিংহ কলেজ থেকে গণিতে অনার্স সহ বি.এসসি পাশ করেন। কোন আর্ট স্কুল বা কলেজে ভর্তি না হয়ে নিজের চেষ্টায় শিল্পকলায় স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠেন তিনি।
পড়াশোনা শেষ করে বাড়িতে প্রসাধন তৈরির একটা ছোট কারখানা বানিয়ে সাবান,আলতা, সিঁদুর তৈরি করে বাড়ি-বাড়ি বিক্রি করতেন প্রথমদিকে। কিন্তু তার সে ব্যবসা চলেনি। কলেজে পড়ার সময় থেকে কলকাতার পত্রপত্রিকা এবং লেখক শিল্পীদের সাথে তার যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। বন্ধু হিসাবে পেয়েছিলেন পরিমল গোস্বামী, সমর দে এবং প্রমথ সমাদ্দারকে। তাঁদের সাহচর্যে 'সচিত্র ভারত','যষ্টি মধু','যুগান্তর' প্রভৃতি পত্রিকায় তার আঁকা চিত্র প্রকাশিত হয় এবং অল্পদিনের মধ্যেই রসিকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। দৈনিক বসুমতীর রবিবারের পাতায় শিবরাম চক্রবর্তীর কলম 'বাঁকা চোখে' তে তার কার্টুন ছিল পত্রিকার বড়ো আকর্ষণ। অমৃতবাজার,যুগান্তর, অমৃতবাজার, বসুমতী প্রভৃতি পত্রিকার সাময়িকী ও বিশেষ সংখ্যাগুলিতে দীর্ঘদিন ধরে ইলাসট্রেশনের কাজ করেছেন ফ্রিল্যান্সার হিসাবে। তিনিই একমাত্র শিল্পী যিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশায় তার গল্পের - "ল্যাবরেটরি" র ইলাসট্রেশন করেন। ১৩৪৭ বঙ্গাব্দের শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকায় সেটি প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের আর একটি গল্প ‘প্রগতি সংহার’-এরও ইলাসট্রেশন করেছিলেন তিনি । এছাড়াও সত্যজিৎ রায়ের প্রথম মুদ্রিত গল্প - 'বর্ণান্ধ' র ছবিও এঁকেছিলেন তিনি। শিবরাম চক্রবর্তীর বিভিন্ন গ্রন্থের অজস্র চরিত্রের চিত্রকর ছিলেন তিনি। শৈল চক্রবর্তীর তুলিতে শিবরাম চক্রবর্তীর সৃষ্ট চরিত্র 'গোবর্ধন' ও 'শিবরাম' ছবিতে এসেছে। অমৃতবাজার পত্রিকায় "Alias" নামে দীর্ঘদিন রবিবারের পাতায় 'কমিক স্ট্রিপ' পরিবেশ করেছেন। এতেই দেশি গল্প নিয়ে 'কমিক স্ট্রিপ' রচনার সম্ভাবনার পথ তিনিই দেখিয়েছিলেন। তার 'লিটিল ডাক' ছাড়াও স্ট্রিপ 'ডাকু সিরিজ' বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। আনুষ্ঠানিক শিল্পের পাঠ তার না থাকলেও তিনি তার পর্যবেক্ষণ শক্তি অর্থাৎ অবজারভেশন পাওয়ারের গুণে সুদীর্ঘকাল ব্যঙ্গচিত্র এঁকে গেছেন। এরপর তিনি কাহিনি সচিত্রকরণের কাজে হাত দেন। পুস্তক অলংকরণে তিনি দক্ষ ছিলেন। মধ্য যৌবনে ভাস্কর্যে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। রীতিমতো তালিম নিয়ে মূর্তি গড়া শিখেছিলেন। পুতুল তৈরি করে তাদের নিয়ে নাটক রচনা শুরু করেন এবং গড়ে তোলেন সংস্থা 'পুতুলরঙ্গম'। এর মাধ্যমে পুতুলনাটিকা মঞ্চস্থ করা শুরু করেন। একসময় তিনি বেঙ্গল গভর্নমেন্টের ডাইরেক্টরেট অব পাবলিক ইনফরমেশন বিভাগের আর্টিস্ট হিসাবে কাজ করেছেন। লেখক হিসাবেও তিনি কৃতি ছিলেন। 'যুগান্তর' পত্রিকায় তার মজাদার লেখা সায়েন্স ফিকশন প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল -
"মানুষ এল কোথা থেকে'
'গাড়িঘোড়ার গল্প'
'ছোটদের ক্রাফ্ট'
তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় পঁচিশ।
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলির হল -
'বেজায় হাসি’
‘চিন্তাশীল বাঘ’
‘ঘটোৎকচ বিজয়’
‘স্বর্গের সন্ধানে মানুষ’
‘কার্টুন’
‘কৌতুক’
‘যাদের বিয়ে হল’
‘যাদের বিয়ে হবে’
‘আজব বিজ্ঞান’
‘চিত্রে বুদ্ধজীবন কথা’
‘বেলুন রাজার দেশে’
'গল্পকথার দেশে'
‘কালোপাখি’
‘টুলটুলির দেশে’
‘কৃপণের পরিণাম’
শেষ বয়সে তিনি জল ও তেল রং কে নিয়ে পেন্টিংয়ের দিকে ঝুঁকেছিলেন এবং এই সময় তার বিষয় ছিল প্রকৃতি। ছবি নিয়ে বিদেশে গেছেন দুবার তার একক প্রদর্শনীর জন্য। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রাজিলের রিও-ডি-জেনেরো তে এবং ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার নিউ জার্সি তে।
'ছোটদের ক্রাফট' বইটির জন্য শৈল চক্রবর্তী শিশু সাহিত্যে ভারত সরকারের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার লাভ করেন।
শৈল চক্রবর্তী ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে র ১৪ অক্টোবর কলকাতায় প্রয়াত হন।
সেসময় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ সান্যাল, রমেন মল্লিক প্রমুখ গুণীজনদের ‘রবিবাসয়ীয়’ নামে একটি ক্লাব ছিল। তাঁরা মাঝে মাঝে সভা করতে আসতেন শৈল চক্রবর্তীর বাড়িতে। শৈলবাবু সেখানে পাপেট শো করতেন। তাঁকে সমগ্র দেশের মর্ডান পাপেট্রির অগ্রণী বলা চলে। মন্দার মল্লিক এবং তিনি এ দেশে প্রথম ‘চ্যাঙা ব্যাঙা’ নামে একটি কার্টুন ফিল্ম বানিয়েছিলেন। শুরুতে যেমন ইলাস্ট্রেশন-এ জোর দিয়েছিলেন, তেমনই শেষের দিকে মন দিয়ে কাজ করতে চাইতেন পাপেট্রি নিয়ে। নিজেই বানাতেন পেপিয়ামেশি পুতুল(কাগজের পুতুল)। বাজনার সঙ্গে তালমিলিয়ে পুতুল নাচের প্রবর্তন শৈল চক্রবর্তীর হাত ধরেই হয়। ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয় তাঁর পাপেট্রি। গড়ে তোলেন নিজের দল ‘পুতুল রঙ্গম’।
চক্রবর্তী ও চক্রবর্তী
শিবরামের গল্পশৈলী আর শৈলর চিত্রশৈলী ছিল সহোদর।
দুজনের নামের শুরু ‘শ’ আর পদবি ‘চক্রবর্তী’ হওয়ায় অনেকেই ভাবতেন এই দু’জন মানুষ বুঝি দুই ভাই।
শুধু তাই নয় শিবরাম চক্রবর্তীর যে কার্টুন প্রতিকৃতি শৈল চক্রবর্তী এঁকেছিলেন, সেটাই শিবরামের পরিচিত প্রতিকৃতি। মজার কথা হল, এক সঙ্গে কাজ করতে করতে শৈল চক্রবর্তীরও শিবরামের মতো ‘পান’-এর দোষ এসে গিয়েছিল।
তেমনই এক বর্ণনা আছে এক জায়গায়।
একদিন সকালে তিনি গেছেন শিবরামের মেসে। গিয়ে দেখেন শিবরাম যথারীতি তক্তপোশো উপুড় হয়ে শুয়ে। আর ঘরে নতুন আমদানি হয়েছে একটি ইজি চেয়ার।
শৈল শিবরামকে ডেকে তুলে বললেন, ‘‘এই ইজি চেয়ার বস্তুটি কী ভাবে আমদানি হল দাদা?’’
‘‘আহা ওটা ইজি চেয়ার নয়, মোস্ট আনইজি চেয়ার।’’
শিবরামের উত্তরে সেই চেয়ারের সামনে গিয়ে শৈল দেখলেন সত্যিই তাই। চেয়ারের মাঝখানে বসার জায়গাটার কাপড় ছিঁড়ে ফর্দাফাঁই। তাই কেউ দিয়ে গেছে বোধ হয়। আর শিবরামও অম্লানবদনে নিয়ে নিয়েছেন।
শৈলর দিকে তাকিয়ে শিবরাম বললেন, ‘‘দেখলেন তো ওটার পিঠস্থানটাই শুধু সুস্থ আছে।’’
শৈল উত্তর করলেন, ‘‘হ্যাঁ তবে সিটস্থান একেবারে শূন্য।’’
শিবরামের অনেক শিবরামীয় ঘটনার সাক্ষী ছিলেন শৈল চক্রবর্তী।
একবারের ঘটনা।
সাতসকালে শিবরাম এসে হাজির শৈলর বাড়িতে। হাতে একগোছা কাগজ। কাগজের বান্ডিলটা শৈলর সামনে নামিয়ে দিলে শিবরাম বললেন, ‘‘এই নিন, আমার পরের বইয়ের পাণ্ডুলিপি। সবকটা গল্পের ছবি করে দিন।’’
শৈল বললেন, ‘‘ঠিক আছে রেখে দিন, করে রাখব।’’
‘‘না না, আমার আজই চাই। আপনি করতে থাকুন। আজ আমি আপনার বাড়িতেই থাকব,’’ বলে শিবরাম নিশ্চিন্তে শৈলর স্ত্রীকে বললেন, ‘‘কই বউদি, এখন এক বাটি তৈলচর্চিত মুড়ি দিন। আর আমার দুপুরের আহারও এখানেই।’’
বেচারা শৈল গল্প পড়ে কাজ করতে শুরু করলেন। আর শিবরাম তেল দিয়ে মুড়ি মাখা খেয়ে তারপর স্নান করে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে শৈলরই বিছানায় টেনে ঘুম।
বিকেলে কাজ শেষ হল।
ছবিগুলো হাতে দিয়ে শৈল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আচ্ছা শিবরামবাবু, আপনি নিজেই গল্পগুলো নিয়ে এলেন কেন? এগুলো তো প্রকাশকের কাজ।’’
‘‘আহা বোঝেন না কেন, আমার গল্প হল ছিপ আর আপনার ছবি হল চার। এবার তো প্রকাশক টপ করে গিলবে। আর ফেরাতে পারবে না। একেবারে নগদ বিদায় নিয়ে ছাড়ব।’’
শুনে শৈল হেসে অস্থির। আর শিবরাম রওনা দিলেন প্রকাশকের দফতরে।
=================================
No comments:
Post a Comment