অমিতা ঠাকুর।
"লাবণ্যের মেয়েটি বেশ সুন্দর দেখতে হয়েছে। বেচারা অসুখে ভুগছে কিন্তু তবু তার প্রফুল্লতার অবসান নেই। তাকে নিয়ে আমার দাড়ি সামলানো ভারি শক্ত হয়েছে’। মীরা দেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের এই চিঠিতে যে শিশুকন্যার কথা বলা হয়েছে তিনি অমিতা ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য অজিতকুমার চক্রবর্তী ও লাবণ্যলেখা দেবীর কন্যা অমিতার জন্ম ১৯১১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি।
বাল্যবিধবা লাবণ্যলেখার পুনর্বিবাহ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অমিতার শৈশব, কৈশোর কেটেছে শান্তিনিকেতনে। কবির ছত্রছায়ায়। পাঠভবনে লেখাপড়া, দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে গান আর অভিনয়ের তালিম নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। মাত্র ষোল বছর বয়েসে তাঁর বিবাহ হয় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র অজীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। এই বিবাহ উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো’, ‘অনন্তের বাণী তুমি’ ইত্যাদি গানগুলি রচনা করেছিলেন।
শান্তিনিকেতনের আশ্রমকন্যা অমিতা নানান নাটকে অভিনয় করেছেন, গান গেয়েছেন ছোট থেকেই কিন্তু সঙ্কোচ কাটত না তাঁর। নন্দিতা কৃপালনীকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন সে কথা, ‘বহু কষ্টে অমিতাকে সুদর্শনার পালায় নামাতে পেরেছি। শেষ পর্যন্ত টিকলে হয়’। ‘নটীর পূজা’য় অমিতা করতেন মালতীর অভিনয়।
আকন্দ ফুলের মালা জড়ানো বেণী চুড়ো করে বেঁধে, গলায় কুঁচ ফলের মালায় সেজে যখন বলতেন ‘যার ডাকে আমার ভাই গেল চলে, যার ডাকে…’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়তেন তখন দর্শকদের চোখেও নামত জলের ধারা। ‘তপতী’ যখন হল অমিতা তখন জোড়াসাঁকোর বধূ। এই নাটকে তাঁর অভিনয় মুগ্ধ করেছিল রসিকজনেদের।
শান্তিনিকেতনের আর এক আশ্রমকন্যা, অমর্ত্য সেনের মা অমিতা সেন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “দেশে বিদেশে বহু প্রসিদ্ধ অভিনয় দেখেছি, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘তপতী’র মতো অভিনয় আর কোথাও দেখিনি”। ….অপূর্ব অভিনয় অমিতার, অপূর্ব অভিনয় রবীন্দ্রনাথের। এই অভিনয়ে আপ্লুত হয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথও, “অমিতা তপতী সেজে অগ্নিতে প্রবেশ করছে, সে এক অদ্ভুত রূপ। প্রাণের ভিতর গিয়ে নাড়া দেয়। আমি ‘তপতী’র সমস্ত ছবি এঁকে রেখেছিলুম। পরে যত অভিনয়ই হয়েছে আজকাল অমন আর দেখলুম না - সে সত্যি কথাই বলব”।
প্রথমে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ইতস্তত করেছিলেন অমিতাকে তপতীর ভূমিকা দিতে। দীনেন্দ্রনাথ বললেও কবি খুব নিশ্চিত হতে পারেননি। মহড়া দেখে অবশ্য মুগ্ধ হয়ে যান। এক মাসের ওপর মহড়া দিয়ে পরপর চারদিন অভিনীত হয়েছিল তপতী’। এই অভিনয়ের পর থেকেই রবীন্দ্রনাথ অমিতাকে ‘মহিষী’ সম্বোধন করতেন। কবি অমিতাকে এই নামে একটি পত্রলিপিও পাঠিয়ে ছিলেন।
মহিষী
তোমার দুটি হাতের সেবা
জানি না মোরে পাঠালো কেবা
যখন হল বেলার অবসান-
দিবস যখন আলোক হারা
তখন এসে সন্ধ্যা তারা
দিয়েছে তারে পরশ সম্মান।
বিক্রম।
সেবা অবশ্য অনেকই করেছেন অমিতা। রোগশয্যায় কবির সেবা করা ছাড়াও জীবনের শেষ পর্বে যখন কবি ডাক্তারের পরামর্শে আবার মাছমাংস খেতে শুরু করেছিলেন তখন একটা সময় তাঁর কোনকিছুই খেতে ভালো লাগছিল না। সেই সময়পর্বে কবি ছিলেন জোড়াসাঁকোয়, তখন অমিতা তাঁকে পাঁঠার মাংসের হালকা ঝোল করে দিলে তিনি তৃপ্তি করে খেয়েছিলেন। এর কিছুদিন পরে রবীন্দ্রনাথ গেলেন কালিম্পং।
প্রতিমা দেবী তখন সেখানে ছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, “কলকাতায় অমিতা নাতবৌয়ের হাতের মাংস রান্না অনেক দিন পরে মুখে ভালো লেগেছিল, বার বার বললেন…”। কবির কথা শুনে প্রতিমা দেবীও পাঁঠার মাংস রান্না করলেন। সুধাকান্ত রায়চৌধুরী তখন কবির কাছে ছিলেন। তিনি বললেন, “আজ বৌদি পাঁঠার মাংস রেঁধেছেন, খেয়ে দেখুন”। রবীন্দ্রনাথ তখনও অমিতার রান্নায় এতটাই আপ্লুত ছিলেন যে উত্তর দিয়েছিলেন, “নাতবৌয়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া শক্ত হবে”।
কালিম্পং-এই কবি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁকে নিয়ে আসা হল কলকাতায়। এই সময় টানা দু-মাস তিনি ছিলেন জোড়াসাঁকোয়। সেখানে যাঁরা তাঁর সেবা করেছিলেন তাঁদের অন্যতম অমিতা ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের সেবা করা সহজ কাজ ছিল না। প্রতিমা দেবীর মতে কবির মনের মতো সেবক হতে গেলে “সে ব্যক্তির স্পর্শ হবে কোমল, থাকা চাই তার ঈষৎ ইঙ্গিতেই সব বুঝে নেবার মতো প্রখর কল্পনাশক্তি এবং সে হবে সদাপ্রফুল্ল, হাতের কাজে নিপুণ, উপরন্তু রহস্যালাপের সমঝদার”।
রোগজর্জর অবস্থায় লেখা কিছু কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হল “রোগশয্যায়”। উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছিলেন, “রোগের সৌভাগ্য নিয়ে তাঁর আবির্ভাব/ দেখেছিনু যে দুটি নারীর / স্নিগ্ধ নিরাময় রূপে / রেখে গেনু তাদের উদ্দেশে / অপটু এ লেখনীর প্রথম শিথিল ছন্দোমালা”। এই “দুটি নারীর” একজন নন্দিতা কৃপালনী আর অন্যজন অমিতা ঠাকুর। নভেম্বর মাসে কবি ফিরে গেলেন শান্তিনিকেতনে।
কিছুদিন সেখানে থাকার পর নানান অসুস্থতায় জর্জরিত কবিকে ডাক্তারদের পরামর্শে ২৫ জুলাই শান্তিনিকেতন থেকে আনা হল কলকাতায়। কে জানত এই তাঁর শেষ আসা। সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিতেও ছিল সেই দিনটির কথা - “হাওড়া স্টেশন থেকে কর্তাবাবাকে গাড়িতে করে আনা হল জোড়াসাঁকোয় - ছ নম্বরের দোতলায় রইলেন।
নাতনী বুড়িদি (নন্দিতা কৃপালনী), অমিতা কাকী (অমিতা ঠাকুর), অমিয়া কাকী (অমিয়া ঠাকুর), রাণীদি (রাণী মহলানবিশ) ওঁর সেবা শুশ্রূষায় সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন”। প্রতিমা দেবী অসুস্থ থাকায় কবির সঙ্গে শান্তিনিকেতন থেকে আসতে পারেননি। অপারেশনের দিন স্থির হলে তিনি রবীন্দ্রনাথকে যে চিঠিটি লিখেছিলেন, সেটি পড়ে শুনিয়েছিলেন অমিতা ঠাকুর।
অসামান্যা সুন্দরী অমিতা শান্তিনিকেতনের একটি অন্যরকম অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের চীন ভ্রমণের সময় সু-সী-মো নামে একজন তরুণ সাহিত্যিক তাঁর দোভাষীর কাজ করেছিলেন। দেশে ফিরে কবি একদিন শান্তিনিকেতনের অধ্যাপকদের জাপানী প্রথায় চা-চক্রে আহ্বান করেছিলেন। সেই চা-অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছিল সু-সী-মো চা চক্র।
সেই অনুষ্ঠানে অমিতা দেবীকে জাপানী সাজে সাজানো হয়েছিল। অমিতা সেনের কথায়, “অমিতা চক্রবর্তী শোভন ধীর মন্থর জাপানী প্রথায় চা পরিবেশন করল। সেদিন তাকে সুন্দর জাপানী মেয়ে বলেই মনে হয়েছিল, এতই মানিয়েছিল তাকে জাপানী পোশাকে”।
অমিতার লেখার হাতটিও ছিল বড় সুন্দর। কবিতা অথবা গদ্য সবেতেই তার ছিল সহজ বিচরণ। “মহলের পর মহল গড়ে ওঠা বাড়িটিকে সাতমহলা বাড়িই বলা যায়। অন্ধকার সব চোরাকুঠুরি, গলিঘুঁজি, স্যাঁতসেঁতে ঘর, উঠোন কত যে আছে তা আর কী বলব! আর এইরকম সব গা-ছমছম করা নিস্তব্ধ নিঝুম জায়গাতেই যে ভূতেরা সংসার পাতে তা কে না জানে!” জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির এই ভূতের গল্পটি রহস্য, রোমাঞ্চ আর পারিবারিক স্মৃতির চমৎকার এক মেলবন্ধন।
অমিতার লেখা কবিতাও সহজ, সরল ও আন্তরিক। “অন্তহীন পাওয়া সে যে ঋতুতে ঋতুতে / বর্ষণে গানে বিচিত্রিতা মাঝে / শূন্য পাত্র পূর্ণ করি রাখে যে সদাই / তাই মোর দুঃখ কিছুই নাই”। অমিতার পুত্র অভীন্দ্রনাথের অটোগ্রাফ খাতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “হাবলুবাবুর মন পাব বলে/করি চকোলেট আমদানি / আজ শুধু মোর নাম দিয়ে / সাজালেম তার নামদানি”।
ভালো গানও গাইতেন অমিতা। অথচ মাত্র একটি রেকর্ডে ধরা আছে একটিমাত্র গান - “তোমার মোহন রূপে কে রয় ভুলে”। ১৯৯২ সালের মার্চ মাসের ৮ তারিখে রবীন্দ্রনাথের ‘মহিষী’ অমিতা ঠাকুর প্রয়াত হন।।
===={={{{{{{{{{{{={==============={{===
No comments:
Post a Comment