জীবনানন্দ দাশ
"সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি ; কবি—কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে, এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু' সকলকে সাহায্য করতে পারে না ; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয় ; নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।"
১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ অন্তর্গত বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষগণ বাংলাদেশের ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার নিবাসী ছিলেন। পিতামহ সর্বানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৩৮-৮৫) বিক্রমপুর থেকে বরিশালে স্থানান্তরিত হন। সর্বানন্দ দাশগুপ্ত জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন; পরে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। তিনি বরিশালে ব্রাহ্ম সমাজ আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেন এবং তাঁর মানবহিতৈষী কাজের জন্যে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হন। জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ দাশগুপ্ত সর্বানন্দের দ্বিতীয় পুত্র। সত্যানন্দ দাশগুপ্ত (১৮৬৩-১৯৪২) ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক।
জীবনানন্দের মাতা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন গৃহিণী, কিন্তু তিনি কবিতা লিখতেন। তাঁর সুপরিচিত কবিতা আদর্শ ছেলে (আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে) আজও শিশুশ্রেণির পাঠ্য। জীবনানন্দ ছিলেন পিতামাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান; তাঁর ডাকনাম ছিল মিলু। তাঁর ভাই অশোকানন্দ দাশ ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে এবং বোন সুচরিতা দাশ ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কম বয়সে স্কুলে ভর্তি হওয়ার বিরোধী ছিলেন বলে, বাড়িতে মায়ের কাছেই জীবনানন্দের বাল্যশিক্ষার সূত্রপাত।
অনিশ্চিত মধ্যবিত্ত জীবনের নানামাত্রিক অভিঘাতে জর্জরিত হয়ে একাকিত্ব এবং আধুনিক যুগযন্ত্রণা অবলম্বন করে কবিতাযাপনে ব্রতী ছিলেন তিরিশের প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশ। নিসর্গের মোড়কে স্বদেশ, সমাজ, সমকাল এবং অস্তিত্বের হাহাকার উপজীব্য করে কবিতার যে সুদৃঢ় সৌধ তিনি নির্মাণ করেছেন, সেখানে নির্জনতা প্রিয় শুদ্ধ মনীষাকেই কেবল আমন্ত্রণ জানানো হয় না; তার কবিতা সৌধে অবগাহনের মাধ্যমে জীবন স্পর্শও সহজতর হয়। তিনি বলেছেন, ‘শ্মশানের দেশে তুমি আসিয়াছ- বহুকাল গেয়ে গেছ গান/সোনালি চিলের মতো উড়ে আকাশের রৌদ্র আর মেঘে-/লক্ষ্মীর বাহন যেই স্নিগ্ধ পাখি আশ্বিনের জোসনা আবেগে/গান গায়- শুনিয়াছি রাখি পূর্ণিমার রাতে তোমার আহ্বান।’ (শ্মশানের দেশে তুমি আসিয়াছ/রূপসী বাংলা)- সকরুণ ও স্নিগ্ধ এই আহ্বানের ভেতর জীবনানন্দের প্রকৃত কবিসত্তা দুল্যমান। এক জীবন রহস্যময় কবিতার পথে একাকী হেঁটে হেঁটে নিরালম্ব জীবনের আকাঙ্ক্ষাকেই মূর্ত ও বেগবান করেছেন তিনি, এঁকেছেন শাশ্বত মৃত্যুর রূপ, সকরুণ ও নম্র সে স্বর।
‘কি এক ইশারা যেন মনে রেখে এক-একা শহরের পথ থেকে পথেঅনেক হেঁটেছি আমি; অনেক দেখেছি আমি ট্রাম-বাস সব ঠিক চলে;তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হ’য়ে চ’লে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে:........এক-একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব;তখন অনেক রাত- তখন অনেক তারা মনুমেন্ট মিনারের মাথানির্জনে ঘিরেছে এসে; মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব........উড়ে গেছে; বেবিলনে এক-একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতরকেন যেন; আজো আমি জানিনাকো হাজার-হাজার ব্যস্ত বছরের পর।’(পথ হাঁটা)
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরা পালক প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে। এর দীর্ঘ কাল পর ১৯৩৬-এ প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ধূসর পাণ্ডুলিপি। ইত্যবসরে কবির মনোজগতে যেমন পরিবর্তন হয়েছে তেমনি রচনাকৌশলও অর্জন করেছে সংহতি এবং পরিপক্বতা। তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ বনলতা সেন প্রকাশিত হয় ১৯৪২-এ। এটি "কবিতাভবন সংস্করণ" নামে অভিহিত। সিগনেট প্রেস বনলতা সেন প্রকাশ করে ১৯৫২-তে। বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের কবিতাসমূহ সহ পরবর্তী কবিতাগ্রন্থ মহাপৃথিবী ১৯৪৪-এ প্রকাশিত। জীবনানন্দর জীবদ্দশায় সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮)। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর কিছু আগে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা।
কবির মৃত্যু-পরবর্তী প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ হলো ১৯৫৭-তে প্রকাশিত রূপসী বাংলা এবং ১৯৬১-তে প্রকাশিত বেলা অবেলা কালবেলা। জীবনানন্দ দাশ রূপসী বাংলা'র পাণ্ডুলিপি তৈরি করে থাকলেও জীবদ্দশায় এর প্রকাশের উদ্যোগ নেন নি। তিনি গ্রন্থটির প্রচ্ছদ নাম নির্ধারণ করেছিলেন বাংলার ত্রস্ত নীলিমা। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশকালে এর নামকরণ করা হয় "রূপসী বাংলা।" তার অগ্রন্থিত কবিতাবলি নিয়ে প্রকাশিত কবিতা সংকলনগুলো হলো: সুদর্শনা (১৯৭৩), আলো পৃথিবী (১৯৮১), মনোবিহঙ্গম, হে প্রেম, তোমারে ভেবে ভেবে (১৯৯৮), অপ্রকাশিত একান্ন (১৯৯৯) এবং আবছায়া (২০০৪)।
কবির প্রকাশিত-অপ্রকাশিত গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত সকল কবিতার আঁকড় দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত জীবনানন্দ দাশের কাব্যসংগ্রহ সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে। অব্যবহিত পরে গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত সকল কবিতার পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে আবদুল মান্নান সৈয়দের উদ্যোগে। পরবর্তী কালে আবিষ্কৃত আরো কবিতা অন্তর্ভুক্ত করে ক্ষেত্র গুপ্ত ২০০১-এ প্রকাশ করেন জীবনানন্দ দাশের কাব্য সমগ্র। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ভূমেন্দ্র গুহ প্রতিক্ষণ প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করেন জীবনানন্দ দাশের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত-গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত সকল কবিতার আঁকড় গ্রন্থ পাণ্ডুলিপির কবিতা (১৪ খন্ড)।
গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাস
জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত হয় অজস্র গল্প ও উপন্যাস। এগুলোর প্রথম সংকলন জীবনানন্দ দাশের গল্প (১৯৭২, সম্পাদনা : সুকুমার ঘোষ ও সুবিনয় মুস্তাফী)। বেশ কিছুকাল পর প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৮৯, সম্পাদনা: আবদুল মান্নান সৈয়দ।
প্রকাশিত ১৪টি উপন্যাস হলো : মাল্যবান (১৯৭৩), সুতীর্থ (১৯৭৭), চারজন (২০০৪ : সম্পাদক : ভূমেন্দ্র গুহ ও ফয়সাল শাহরিয়ার)।
প্রবন্ধ
মূলত কবি হলেও সাহিত্যের অধ্যাপক কবি জীবনানন্দ দাশ জীবৎকালে কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছিলেন। ওগুলো প্রকাশিত হয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। এর একটি অংশ নিয়ে কবিতার কথা প্রবন্ধগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে। বাকি প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো দীর্ঘকাল অপ্রকাশিত ছিল। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম জীবনানন্দের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত-গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত সকল প্রবন্ধ এক মলাটে আবদ্ধ করে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধ সমগ্র। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে জীবনানন্দ দাশের জন্ম শতবর্ষে আরো কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ আবিষ্কৃত হলে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের অগ্রন্থিত প্রবন্ধ সমগ্র।
পত্র
দীপেনকুমার রায়-এর উদ্যোগে ও সম্পাদনায় জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলী প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৮৫ সনে। পরবর্তী কালে আবদুল মান্নান সৈয়দ জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলী প্রকাশ করেন ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে। ১০১টি চিঠির সংকলন জীবনানন্দ দাশের চিঠিপত্র (আইএসবিএন ৯৭৮ ৯৮৪ ৫০২ ২৫৫ ২) প্রকাশিত হয় ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে।
কবিতার রহস্যময় পথে হাঁটতে হাঁটতে জীবনানন্দ দাশ কালক্রমে হয়ে উঠেছেন সুদূরপ্রসারী এক নির্জন পথের অভিযাত্রী। কেননা, ‘পথ’ মানবজাতির জীবনযাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। ‘পথ’ কেবল চলার মাধ্যম নয়, পথ লক্ষ্যে পৌঁছারও উপায়। ‘অনেক হেঁটেছি আমি’, ‘একা-একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব;’ কিংবা, ‘বেবিলনে এক-একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর’- কবির এমন উচ্চারণের মধ্য দিয়ে উপলব্ধ হয়, পথ বহুমাত্রিক, তারও শাখাপ্রশাখা রয়েছে। অনুসন্ধানী সব সময় শতপথের ঠিকানা প্রত্যাশী। জীবনানন্দ দাশ শুধু শহর পরিক্রমণই নয়, গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গশোভায় হেঁটে সঞ্চয় করেছেন মানবপ্রেম, বিষণ্নতা, বিপন্ন মানবতার বেদনা এবং হতাশাবোধ। যাপনের এসব অনুষজ্ঞ যুথবদ্ধ হয়েছে জীবনানন্দের বোধে আর প্রকাশিত হয়েছে কবিতায়। তবে পরিবর্তমান কাল, অতীত, বর্তমান এবং ইতিহাসের রূপকাশ্রয়ী বিষাদময় প্রকাশও তার কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। জীবনানন্দের কবিতা চেতনাকে এমনভাবে হরণ করে নেয় যে, জীবনের যাবতীয় কোলাহল-মুখরতা যেন নিমেষেই নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
জীবনানন্দ দাশের কবিতার প্রকাশ স্নিগ্ধ, যার অন্তঃস্থলে কোমল ও গভীর চেতনা অনুরণিত হয় সম সময়। এতে পাঠক মোহাবিষ্ট হন। তার কবিতার নান্দনিক সৌন্দর্যে আকণ্ঠ অবগাহনের মাধ্যমে পাঠকের ঘোরগ্রস্ত না হয়ে কোনও উপায় থাকে না। কবির আত্মানুসন্ধান, বিষয়ভাবনা ও নির্মাণকৌশলের ভিন্নতাও স্বতন্ত্র। আপাত পর্যবেক্ষণে অত্যন্ত সহজ ও সরল শব্দের গাঁথুনিতে তার কবিতা মূর্ত হলেও জীবন চেতনার অন্তর্গত অসুখ ও হাহাকারের ক্রমবর্ধিষ্ণু ধারাটি এখানে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। ফলে তার কবিতা হয়ে ওঠে মানবজীবনের গভীর বোধ পরিগ্রহ করে সমাজ সচেতন এবং নগর জীবনের দ্বান্দ্বিকতার সাক্ষ্যবাহী। ‘বোধ’ কবিতায় তিনি বলেন- ‘আলো-অন্ধকারে যাই- মাথার ভিতরেস্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়- ভালোবাসা নয়,হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;আমি তারে পারি না এড়াতে,সে আমার হাত রাখে হাতে,সব কাজ তুচ্ছ হয়- পণ্ড মনে হয়,সব চিন্তা- প্রার্থনার সকল সময়শূন্য মনে হয়,শূন্য মনে হয়।’অস্বীকারের উপায় নেই যে, শিল্পের অর্থ বহুরৈখিক। ভাবনা বা দর্শনের ডালপালা মেলে দেয়া তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মানুষের যাপিত জীবনে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা নানান অর্থ তৈরি করে। যাপনের বাইরেও জীবনের আরও অনেক অর্থ থাকে যা বিশ্লেষিত হতে হতে বহু বিস্তৃত ক্ষেত্রকে স্পর্শ করার সুযোগ ঘটে। এভাবেই কেন্দ্রমুখী সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে জীবনানন্দ দাশ এমন এক ঋদ্ধ অনুভূতিতে পৌঁছান, যেখানে ব্যক্তিক নৈঃসঙ্গ মহৎ শিল্পে স্ফূর্তি লাভ করে। জীবনানন্দের ‘বোধ’ কবিতাটিই এর অনন্য উদাহরণ। বৈশ্বিক চেতনা স্পর্শ করে এ কবিতায় যে বাঁক পরিলক্ষিত হয় তা জীবনের সম্পূর্ণ অভিজ্ঞানকে পরিপূরক করে। তিনি যখন আবারও বলেন-‘সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারেসহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথাকে বলিতে পারে আর; কোনো নিশ্চয়তাকে জানিতে পারে আর?’
সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!’- এই বিস্ময়বোধক অভিব্যক্তি, ‘আলোয় আঁধারে’র বিপরীতমুখী অবস্থান থেকেই সৃষ্ট। মানুষের কাজ ও বাস্তবতাজ্ঞানই তাকে চিন্তা বা উপলব্ধির দিক থেকে সজাগ করে। চিন্তা মানসিক উপাদান, তাই তাকে এড়ানো সহজ নয়। জীবনানন্দ এটা বোঝেন এবং সঙ্গত কারণে মানেন বলেই তার পরিভ্রমণ চলতে থাকে প্রাত্যহিক বাস্তবতার ভেতর। জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই এটা উপলব্ধিতে এনে এক সময় তিনি শূন্যতার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এই ‘শূন্য’ একদিকে জীবনের উদ্ভাসন এবং অপরদিকে নির্বাণের উৎস হিসেবে কবির বোধে প্রকট হয়। ‘বোধ’ কবিতায় তিনি উল্লেখ করেছেন:‘নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মনএক দিন;এই সব সাধজানিয়াছি একদিন- অবাধ- অগাধ;’
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় অস্তিত্ববাদী চেতনাও স্পষ্ট। বলাই বাহুল্য, ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্ব বিষয়গত সত্য নয় বরং বিষয়ীগত বা ‘Subjective Truth’. ব্যক্তি-অস্তিত্ব চরমে পৌঁছালে জন্ম হয় ‘Paradoxical Situation’-এর। ফলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পিছিয়ে পড়লে চলে না। দার্শনিক কিয়ের্কেগার্দ ঈশ্বরপ্রেম ও দার্শনিক তত্ত্বে এভাবেই ব্যক্তিমানুষের অস্তিত্বকে বড় করে দেখেছেন। ঈশ্বরকে অস্বীকার করেননি। জীবনানন্দ দাশও তার ঈশ্বরকে অস্বীকার না করে অস্তিত্ববাদী দার্শনিক তত্ত্বের কাব্যিক প্রয়োগ করেছেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পুরাণ থেকে আদিম দেবতাদের স্বরূপ তুলে ধরেছেন। ফলে ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে প্রকৃতির মিশ্রণ ঘটেছে কবিতায়। তিনি লিখেছেন-
‘আগুন বাতাস জল: আদিম দেবতারা তাদের সর্পিল পরিহাসে তোমাকে দিল রূপ- কী ভয়াবহ নির্জন রূপ তোমাকে দিল তারা; তোমার সংস্পর্শের মানুষের রক্তে দিল মাছির মতো কামনা।’ (আদিম দেবতারা: মহাপৃথিবী)
জীবনানন্দ জানতেন, ‘কবিতা কালজ্ঞানশূন্য প্রপঞ্চ নয়; সময়কে আশ্রয় করে হয়ে ওঠা ব্যক্তির আবেগ ও প্রজ্ঞার সততাপূর্ণ স্মারক’- যে কারণে তিনি ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘কেউ কেউ কবি’। এ উক্তিটি জীবনানন্দ দাশ একজন প্রকৃত কবির স্বাতন্ত্র্যকে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করেছেন। বলেছেন, কবিকে তার স্বতন্ত্র ‘সারবত্তা’র কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয়। ‘সারবত্তা’ শব্দটি মৌলিক, সুনির্বাচিত এবং অসাধারণ। শব্দটি গবেষণালব্ধ। জীবনানন্দ বলেছেন ‘উপমাতেই কবিত্ব’। ‘উপমা’ নিজেই অন্যতম সারবত্তা। ‘উপমা’ কবিতা রচনার অন্যতম উপকরণ বা শিল্পগত উপায়। উপমার ব্যবহারে এমন অনেক কবিতা আছে যা আমাদের পরিচিত এবং বহুল পঠিত হয়ে থাকে। সে সূত্রে উপমার ব্যবহার শুধুমাত্র কবির ক্ষেত্রেই সম্ভব যেহেতু তিনি বুঝে কবিতা লেখেন। জীবনানন্দ দাশ নিজের প্রতিভা ও প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রটিকে নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করেছেন। তার প্রায় সব কবিতায় দ্বিধাহীনভাবে যাপিত সত্যের উদ্বোধনও লক্ষ্যণীয়। আবার-
‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতনসন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজনতখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;সব পাখি ঘরে আসে- সব নদী- ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।(বনলতা সেন)
জীবনানন্দ দাশ ছিলেন প্রবল ধ্বনিসচেতন কবি। পাঠকের চেতন-অনুভূতিতে নাড়া দেবার প্রত্যাশায় তিনি ধ্বনি নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন। এ কবিতায় অশ্রবণীয় শিশির-পতনের শব্দ আর মৃত্যুর নিঃশব্দ আগমন-বার্তার মধ্য দিয়ে নীরব-অন্ধকার হাজির হয়; যেন, কবি অনুভব করেন প্রকৃতির নিয়মতান্ত্রিক চালচিত্র, জীবজন্তুর নিয়তিতাড়িত জীবনযন্ত্রণা। মানুষের বাধ্যবৃত্তিজনিত এই অসহায়ত্বের আড়ালে এই কবিতায় নির্মিতি পায় আশ্বাস-বারতা আর সবশেষে নিথর পৃথিবীর ভয়াবহ নির্জনতা। অন্ধকারে মুখোমুখি নিরালাপ দাঁড়িয়ে থাকার নিষ্প্রয়োজনীয়তার বোধও প্রকারান্তরে পাখা মেলে।
তবে ‘বোধ’ কবিতায় তিনি আমিত্ব ও বহুত্বের ব্যাপকতায় জীবনের প্রকৃত ‘বোধ’কে নানান ক্ষুদ্র বোধের সমষ্টিরূপে সম্পূর্ণ শিল্পে রূপান্তরিত করে তুলেছেন। যে বোধ থেকে প্রতিমুহূর্তে মানুষের নবজাগরণ ঘটতে পারে। সত্য যে, বোধ থেকে মানুষের মুক্তি নেই। কেননা, ইন্দ্রিয়জ উপলব্ধিগুলোকে কিছুতেই এড়ানো যায় না। তিনি যে চেতনে কিংবা অবচেতনে অত্যন্ত নিরীক্ষাপ্রবণ, তাও এ কবিতাটিতে স্পষ্ট। ‘বোধ’ কবিতায় কবির ‘অবাধ’ ও ‘অগাধ’ জীবনের সূক্ষ্ম, গভীর বা বহুমাত্রিক অধ্যায়ের প্রত্যক্ষ দৃশ্যময়তা অনেক নতুন জিজ্ঞাসার উপাদানকেই তুলে ধরে। জীবনের এই মৌলিক বোধ উপলব্ধিতে আসে বলেই কবি নির্দ্ধিধায় উচ্চারণ করতে পারেন- ‘নক্ষত্রের তলে ঘুমায়েছে মন’। এছাড়া এ কবিতায়, ‘আমি থামি- সেও থেমে যায়’- কবির এই বক্তব্যকে জীবনের পরিসমাপ্তিতে মৃত্যুর সঙ্গে ‘বোধ’ সমাপ্তির নির্দেশক হিসেবেও বিবেচনা করা যায়।
নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে পরিবর্ধিত সিগনেট সংস্করণ বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থটি বাংলা ১৩৫৯-এর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বিবেচনায় পুরস্কৃত করা হয়। কবির মৃত্যুর পর ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪) সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করে।
==={===={{{{{{{{{{{{========}}}}}}}}}}}====
No comments:
Post a Comment