বাংলার অবিভক্ত চব্বিশ পরগনা জেলার গোবরডাঙার নিকট খাঁটুরা গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৫ সালে ৫ মার্চ । তার পিতার নাম ছিল গোপাল চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। মাতা সুশীলাবালা দেবী। পিতা ছিলেন আইনজীবী। প্রভাবতী প্রথাগত শিক্ষা না পেলেও পিতার উৎসাহে দেশী বিদেশি কাব্য পড়তেন। কীটস, শেলী বায়রন প্রভৃতি কবির কাব্য পড়ে ফেলেন অল্প বয়েসে। মাত্র ৯ বছর বয়েসে তার বিবাহ হয় বিভূতিভূষণ চৌধুরীর সাথে। ব্রাহ্ম গার্লস ট্রেনিং কলেজ থেকে টিচার্স ট্রেনিং সার্টিফিকেট লাভ করে প্রথমে উত্তর কলকাতার সাবিত্রী বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজ নেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অনুরোধে কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছিলেন। তার বোন বিখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পী হাসিরাশি দেবী।
তিনি শিক্ষাব্রতী ছিলেন। নিজের বাল্যবিবাহের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাননি কিন্তু স্ত্রী শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন তিনি। খাঁটুরার বঙ্গ বালিকা বিদ্যালয়কে নিজের প্রতিভা ও কর্মদক্ষতায় তাকে খাঁটুরা বালিকা বিদ্যালয় নামে পুনরুজ্জীবিত করে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্বভার নেন। সমাজসেবা, দেশপ্রেম ও নারী প্রগতিতে উৎসাহী ছিলেন। ঐ অঞ্চলে সরোজ নলিনী নারী মঙ্গল সমিতির শাখা কেন্দ্রের সভানেত্রী ছিলেন।
১১ বছর বয়সে তার প্রথম কবিতা ‘গুরুবন্দনা’ প্রকাশ পায় তত্ত্বমঞ্জরী পত্রিকায়। প্রথম গল্প ‘টমি’ প্রকাশ পায় অর্চনা পত্রিকায় ১৯২২ সালে। জলধর সেন সম্পাদিত 'ভারতবর্ষ' মাসিক পত্রিকায় ১৩৩০ বঙ্গাব্দে তার প্রথম ধারাবাহিক উপন্যাস 'বিজিতা' প্রকাশিত হয়। এটি বাংলা, হিন্দি ও মালায়লম ভাষায় যথাক্রমে ভাঙাগড়া, ভাবী ও কূলদেবম নামে চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। তার উপন্যাস পথের শেষে 'বাংলার মেয়ে' নামে নাট্য রূপায়িত ও সাফল্যের সাথে অভিনীত হয়েছে। বাঁশরী, সারথি, উপাসনা, উদ্বোধন, সম্মিলনী, মোহাম্মদী ইত্যাদি পত্রিকায় লেখালিখি করতেন। ব্রতচারিণী, মহীয়সী নারী, ধুলার ধরনী, রাঙা বৌ, ব্যাথিতা ধরিত্রী, বিধবার কথা ইত্যাদি তার রচিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। সাবিত্রী বিদ্যালয়ে কাজ করার সময়ে তার সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আলাপ হয়। কবি তাকে সাহিত্য রচনায় উৎসাহ প্রদান করেন। তার লেখায় সামাজিক মূল্যবোধ, সনাতন আদর্শের কথা ফুটে উঠতো। শিশুদের জন্যে রচিত ইন্টারন্যাশনাল সার্কাস, কৃষ্ণা সিরিজ ছিল জনপ্রিয়। বাংলা গোয়েন্দা কাহিনী সাহিত্যে তিনিই প্রথম মেয়ে গোয়েন্দা কৃষ্ণা'র সৃষ্টি করেন। তিনি কিছু গানও রচনা করেছেন। তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে জামসেদপুরে নিখিল ভারত বঙ্গ-সাহিত্য সম্মেলনের পরিচালিকা ছিলেন।
নবদ্বীপ বিদ্বজ্জন সভা তার সাহিত্যসাধনার জন্যে তাকে সরস্বতী উপাধি প্রদান করেন। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে লীলা পুরস্কারে সম্মানিত হন।
১৪ মে, ১৯৭২ সালে গলব্লাডারের অসুখে তার জীবনাবসান হয় নিজ বাসগৃহ কলকাতায়।গলব্লাডারের অসুখে তিন মাস ভোগার পরে ১৯৭২ সালের ১৪ মে প্রয়াত হন সাহিত্যিক প্রভাবতী দেবী সরস্বতী। পরের দিন ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল— “সে যুগের জনপ্রিয় সাহিত্যিক শ্রীমতী প্রভাবতী দেবী সরস্বতী আজ দুপুর আড়াইটের সময় তাঁর পাতিপুকুরের বাসভবনে পরলোকগমন করেন।” কতটা জনপ্রিয়? প্রভাবতীর বইয়ে তাঁর সই-সহ পাঠকদের প্রতি একটি নিবেদন প্রকাশিত হত— “ইদানীংকালে বাজারে আমার নাম নকল করিয়া বহু উপন্যাস ও অন্যান্য রচনা প্রকাশিত হইতেছে বলিয়া সহৃদয় পাঠক-পাঠিকাগণ আমাকে জানাইতেছেন। পাঠক-পাঠিকা, প্রকাশক ও পৃষ্ঠপোষকগণের অবগতির জন্য তাঁহাদের আমি জানাইতেছি, আমার লিখিত উপন্যাস ও অন্যান্য রচনাদিতে আমার নাম সহি করা থাকিবে। যাহাতে তাঁহারা সতর্ক হইতে পারিবেন।”
প্রবীণদের কাছে শুনেছি, বিবাহবাসর, অন্নপ্রাশন, জন্মদিনের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে যখন বই উপহার দেওয়ার চল ছিল, তখন সেই তালিকায় একেবারে উপর দিকে থাকত প্রভাবতীর বই। পরে গ্রন্থাগারে পুরনো বই ঘাঁটতে গিয়েও দেখেছি, প্রায় সব বইয়ের প্রথম পাতাতেই উপহারের নামাঙ্কন। আরও জেনেছি, ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় যখন ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছেন তিনি, তখন চাহিদা এতই ছিল যে, একটি উপন্যাস শেষ হলে পরবর্তী উপন্যাসের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে দিতে হত। সে কালের বিজ্ঞাপন ঘাঁটলেও দেখা যায়, ‘মধুযামিনীর সর্ব্বশ্রেষ্ঠ উপহার’-এ তিন টাকা দামের উপন্যাসের তালিকায় বুদ্ধদেব বসু ও প্রতিভা বসুর ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দম্পতি’, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘ছিনিমিনি’, নারায়ণ ভট্টাচার্যের ‘অভিমান’, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রূপের ফাঁদ’, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘মধুযামিনী’, অনুরূপা দেবীর ‘স্ত্রী’, মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জানি তুমি আসবে’, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের ‘শুক্লবসনা সুন্দরী’, ‘তোমায় আমি ভালবাসি’ এবং প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর ‘আমি যারে চাই’, ‘সোনার প্রতিমা’, ‘পথের শেষে’ ও ‘দানের মর্য্যাদা’।
তিনশোরও বেশি বই লিখেছিলেন প্রভাবতী। উপন্যাস, গল্প, কবিতা, গান, গোয়েন্দা কাহিনি— সমস্ত সাহিত্যিক সংরূপ নিয়েই পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন।
তবু নির্মম সত্য, আজ তিনি একেবারে বিস্মৃত!
রমণীর কথা
১৯০৫। বাল্যবিবাহ তখন সমাজের প্রথা। সে বছর ৫ মার্চ গোবরডাঙা পুরসভার খাঁটুরা গ্রামে জন্ম প্রভাবতীর। কুলপ্রথা রাখতে মাত্র ন’বছর বয়সে গৈপুর গ্রামের বিভূতিভূষণ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যেতে কষ্ট হয়েছিল ছোট্ট প্রভাবতীর। কিন্তু সেই কষ্ট নিয়ে বিরূপ মন্তব্য আসে শ্বশুরবাড়িতে। ন’বছরের মেয়ে আর দ্বিতীয় বার ভাবেনি। সোজা মাঠঘাট ভেঙে বাপের বাড়িতে ফেরা। চিরতরে সম্পর্ক বিচ্ছেদ। বাবাও আর মেয়েকে ফেরানোর চেষ্টা করেননি।
‘পল্লীসখা’ পত্রিকায় এক প্রবন্ধে প্রভাবতী লিখছেন— “মেয়েদের শাসন আমাদের দেশে বড়ই কড়া। তাহাদের অতি শিশুকাল হইতেই কঠোর শাসনের তলে থাকিতে হয়। যে সময়টা বিকাশের, সে সময়টা তাহাকে বন্ধ করিয়া রাখা হয়। ...অন্য দেশে যে সময়টা বালিকাকাল বলিয়া গণ্য হইয়া থাকে, আমাদের দেশের মেয়েরা সেই সময়ে গৃহের বধূ, অনেক সময়ে সন্তানের মা।” নিজের ছোটবেলার জন্য কি বারবার আক্ষেপ হত প্রভাবতীর? লেখালেখির মধ্যে কিছু সূত্র ছড়িয়ে থাকলেও, এ সব প্রশ্নের উত্তর কালের গর্ভেই তলিয়ে গিয়েছে। ওই যে, মেয়েদের আবার লেখাপড়া!
বিজিতা
পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্ক অবশ্য ছিন্ন করেননি প্রভাবতী। ১৯২৯ সালে ব্রাহ্ম গার্লস ট্রেনিং কলেজ থেকে টিচার্স ট্রেনিং সার্টিফিকেট পেয়ে সেই স্কুলেই পড়াতে শুরু করেন। সেখানেই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্রী রমা দেবীর সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। আর রমা দেবীর উৎসাহে বাগবাজারে সাবিত্রী বিদ্যালয় স্থাপন করেন প্রভাবতী। পরে অবশ্য চাকরি নেন কর্পোরেশন স্কুলে। চাকরি সূত্রে কলকাতায় চলে এলেও শিকড়ের সঙ্গে যোগ বিচ্ছিন্ন করেননি কখনও। নিজের গ্রাম খাঁটুরায় ফিরেছেন, বিলুপ্তির পথ থেকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন বঙ্গ বালিকা বিদ্যালয়কে। সে সময়ে সরোজনলিনী নারীমঙ্গল সমিতির শাখা কেন্দ্রে সমাজসেবার কাজেও যুক্ত হন। পরে তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময়ে বোন হাসিরাশি দেবীর সঙ্গে মিলে কৃষকসভার হয়ে ত্রাণের কাজেও নেমেছিলেন।
নানা কাজের সূত্রে নানা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ। রমা দেবীর সূত্রে যাতায়াত জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে। নিজের ‘দারিদ্রের ইতিহাস’ বইটি প্রভাবতীকে উৎসর্গ করেন তিনি। প্রভাবতীর কথাবার্তা হত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেও। শোনা যায়, তাঁর ‘মাটির দেবতা’ উপন্যাসটি লেখার পিছনে নাকি রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ প্রভাব এবং উৎসাহ ছিল। সাহিত্য রচনায় উৎসাহ দিতেন রবীন্দ্রনাথ। পরে বোন হাসিরাশি দেবীকেও তাঁর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রভাবতী। হাসিরাশিও ভাল লিখতেন, ছবিও আঁকতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘চিত্রলেখা’।
=================================
No comments:
Post a Comment