আজ কবি র জন্মদিন।
"স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ"
বিষ্ণু দে।
দেশের ও কালের বর্তমান যান্ত্রিক জীবনের হতাশা ও বেদনার পাশাপাশি সংগ্রামী চেতনা ও আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিস্ফুটন আলোচ্য অংশ। তিনি আধুনিক জীবনকে 'নরক' বলে মনে করেন।
কাব্যগ্রন্থটি অন্নদাশঙ্কর রায় কে উৎসর্গ করেন। কাব্যগ্রন্থের কবিতার সংখ্যা ১০২ টি। সমকালীন মানব জীবনের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত নিয়েই "স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ"লেখা মনে হয়েছে।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বইটির জন্য ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার জ্ঞানপীঠ লাভ করেন। কাব্য গ্রন্থটি ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয়। স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ নামের কবিতাটি অবশ্য ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত । বিষ্ণু দের স্বকীয় রচনাভঙ্গি ও চিন্তাদর্শে এটি তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ।
প্রচ্ছদ শিল্পী হলেন যামিনী রায়।
আমাদের জীবনের অতীত, বর্তমান, আর ভবিষ্যৎ নিয়েই হল "স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ"। কবি তাঁর আত্মসত্তার অন্বেষণ করেছেন বারে বারে এই কাব্যে। গ্রিক পুরাণ কাহিনী বিবৃত হয়েছে "অয়রিডিকে" কবিতায়। কবি চন্ডীদাসকে স্মরণ করে লিখেছেন "নান্নুরে" কবিতা। কবি চন্ডীদাসের রাধিকা মানবী না দেবী, এই নিয়ে যা আলোচনা চলছে, তা দেখে কবি বিদ্রুপ করে বলেছেন, ---
'পদাবলী কেঁদে মরে, রাধা ভোলে আপন কান্নুরে
প্রেম ভয়ে দেশ ছাড়া, ভুলে যায় প্রেমের ইতিহাস।'
এই কাব্যেও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রত্যক্ষ প্রেরণাদাত্রী হিসাবে গ্রহণ করেছেন, ---
'সমুদ্রে পাহাড় বেঁধে সাজাবে না বাংলার আঙিনা?
শতাব্দীর সূর্যে এসো অভীপ্সার তীব্র মেঘে তুমি।'
কবি ঘোষণা করেছেন, ---
'কৌনিকে নয়, বৃত্তের পরিপূর্ণে
শিল্পের শেষ শান্তি।
সেই শান্তি আছে প্রেমের জগতে।' (''কৌনিকে নয়")
"প্রথম কদম ফুল" কবিতায় কবি বলেছেন, ---
'নটরাজ বুঝি নামল নীলিম শুরু
বাহুর ভঙ্গে গৌরীর বর অঙ্গে।'
কবি বর্তমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে স্মৃতির জগৎ, অর্থাৎ অতীত জগৎ ও ভবিষ্যৎ জগতকে অন্বেষণ করেছেন এই কাব্যগ্রন্থের আর একটি বিখ্যাত কবিতা হল "দামিনী", যেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চরিত্রকে নতুনভাবে ব্যাখা করেছেন।
কবি যেন আত্মসত্তার অন্বেষণ করেছেন তার কাব্যগ্রন্থে। আর তার এই অন্বেষণের প্রেরণায় ছিলেন শতাব্দীর সূর্য - "রবীন্দ্রনাথ"। নিজস্বতা, ছন্দের প্রবাহ আর চিন্তা-মনীষা-আবেগের সমন্বয়ে কাব্যগ্রন্থটি সমুজ্জ্বল।
কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেছেন-
"এটি পরিণত বয়সের শ্রেষ্ঠ রচনা"
কবি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র কাব্যগ্রন্থটির কিছু কবিতায় সুরারোপ করেন।
স্মৃতি সত্তা ভবিষ্য্যত
তোমরা নবীন, এ উদাস
বিষাদ কি তোমাদেরও চেনা ?
স্মৃতি হানে আদি মহীদাস,
ভূমিদাস স্মৃতির যন্ত্রণা
আমাদের চৈতন্যে আকাশ।
তোমরা নবীন, আনাগোনা
কালান্তরে বাঁধে কি চেতনা ?
বিশ-বাইশের ইতিহাস
করেছে কি কালের গণনা
তোমাদের সদ্য সুখে মানা ?
তোমরা নবীন, জানাশোনা
তাই বুঝি হয়নি প্রবাস ?
নিজবাস একান্ত অজানা,
আজন্মপ্রবাসী, তাই নানা
স্বদেশীয় স্মৃতির বিলাস ?
দুনিয়ার হাটে-হাটে কেনা
আধাচেনা প্রবল উচ্ছ্বাস,
অনাত্মীয় নব্য প্রতিভাস-
তবু জেনো আমারই চেনা।
হঠাৎ উঠেছে দেখো ষোলোতলা,
হয়তো পনেরো হতে পারে কে জানে সতেরো,
আকাশকে মাটিকে তামাশা,
জিরাফ তুলেছে যেন গলা কিংবা এক টিরানোসাস,
আশেপাশে জলহস্তী, কুমীর, গোখুরা, হায়েনা, শেয়াল
পেতেছে দপ্তর গদি গোমস্তা ফরাস খাসা,
বেখাপ্পা বেয়াড়া বিশ্রী,
কলকাতার কপালের গেরো।
এইদিকে নকল গথিক ঐদিকে করিন্থী আয়ন ডোরীয়
কেলসনের ইংরাজী খেয়াল।
তবুও যাহোক কালের পলিতে আহাম্মক সাহেবী সখের গায়ে
পড়েছিল অভ্যাসের কিছুটা প্রাসাদ,
বাঙালের হাইকোর্ট, গাঁওয়ারের জাদুঘর,
এমন-কি লাটনী-প্রাসাদ এসেছিল চোখে সয়ে,
এবং চোরাই সাম্রাজ্যের দেশজ রাস্তায়
অলিতে গলিতে আজগবি ঘিনজির বাহারে
জমেছিল নয়নে না হোক কিছু মনোহর
আলালে দুলালের হুতোমের বুড়ো-বুড়ো শালিকের কাটারায়
পক্ষীবাবুদের কায়দায় কেতায় স্বচ্ছলতা অসচ্ছলতায়।
সরু ফালি কলকাতার জোলো মাটি দিয়েছিল তবু কিছু রস কিছু রৌদ্র
শচীশকে বিনয়কে, তবু গোরা আরো বহু স্বদেশী ছেলেরা
কলকাতাকে চিনেছিল, সুস্থ হতে চেয়েছিল সম্পূর্ণ স্ববশ।
আজ শুধু একদিকে মুমূর্ষু বিকার
আর অন্যদিকে নাটুকেপ্রলাপ নির্বোধ নিষ্ঠুর অমানুষিক অভদ্র।
কে দেবে ধিক্কার কাকে আঠারো তলায়
সারাদেশে চতুর্দিকে যত অবান্তর
উন্মাদ বিলাসী খেলা!
রৌদ্র হানো, বান দাও, হে সূর্য, হে চৈতন্য-আকাশ
এই নিত্য অপঘাত দূর করো,
এর চেয়ে দগ্ধদিনে এনে দাও সালানপুরের যুগান্তের ভূশন্ডী প্রান্তর।
প্রাণ খুলে যে ঘৃণা করব এমন দেখি উপায় নেই,
প্রাণের পাড়ায় নেই তো তার ঠাঁই,
চোরাগলিতে ঘোরে যখন তখন বুঝি দেখি তাকেই,
ঘরে কিংবা সভায় সে নয় চাঁই!
শহরবনে হঠাৎ যবে দেখি সে অমানুষিক চোখ
মানতে হবে চমকে উঠি ভয়ে,
তাই বলে যে ঘৃণা করব এমন আমার সাধ্যে নেই,
হার কোথায় বন্য পরাজয়ে ?
জন্তুই তো জন্তুটা সেই, যতই তার হোক-না রোখ্,
মনের বিশ্বে কোথায় তার ঠাঁই ?
মৃত্যুর তার নখরে বটে অর্থহীনতায় অসহ,
আকস্মিক, জয়ও তাই চাই।
জয়ের ছবি তাই তো মনে, জয়ের গান তাই তো রটে,
ঘোচাতে চাই আকস্মিকের পাপ।
তাই বলে কি করব ঘৃণা সমানে সমান বিনা ?
পায়ের পাশে ঘুরতে পারে সাপ,
আশেপাশে চৌকাঠে বা ঘরের কোণেও বিছা বা জোঁক,
প্রাণের লোকে নাই থাকুক বাসা,
এটাও ঠিক যে সাপ মাড়ালে ঘৃণায় শরীর রীরী করে,
পড়তে পারে জুতার চরম চাপ,
তাই বলে কি বিছাটাকেই বসতে দেব ঘৃণার আসন,
জোঁককে শেষে ডাকব সভাঘরে ?
ঘৃণার পাতা হাওয়ার ঝরে, ঘৃণার মাটি প্রখর ভালোবাসা
সেই শিকড়ে জীবন বাঁধি, তাই-
মানুষ তো ছার, সিংহও নয়, মানব কাকে, শিরদাঁড়া নেই,
দেব না ওকে ঘৃণারও অভিশাপ।
এ নরকে
মনে হয় আশা নেই জীবনের ভাষা নেই,
যেখানে রয়েছি আজ সে কোনো গ্রামও নয়, শহরও তো নয়,
প্রান্তর পাহাড় নয়, নদী নয়, দুঃস্বপ্ন কেবল,
সেখানে মজুর নেই, চাষা নেই
যেখানে রয়েছি আজ মনে হয় আশা নেই,
বাঁচবার আশা নেই, বাঁচবার ভাষা নেই,
সেখানে মড়ক অবিরত
সেখানে কান্নার সুর একঘেয়ে নির্জলা আকালে
মরমে পশে না আর, সেখানে কান্নাই মৃত
কারণ কারোই কোনো আশা নেই
অথবা তো এত কম, যে কোনো নিরাশা নেই।
চৈতন্যে মড়ক।
এখানে অভাব মৃত্যু অনাহার অপঘাত সকালবিকাল
মাসে মাসে মারীর চড়ক,
এখানে অরণ্য নেই, হিংস্র নেই, নেই আদিম মানুষ
বানপ্রস্থবাসী উদাসী সন্ন্যাসী নেই,
এখানে সভ্যতা নেই, হৃদয় শুকানো দীঘি,
বুদ্ধি মজা খাল, চোখ-কান সব বোধ চোরাইমালের চেয়ে বাসি,
এখানে হয়তো নেই আপামর কোনোই নরক।
কেউ-বা হিন্দির হন্যে, কেউ ইংরেজির হাঙর
নানা অবান্তর নানা শিকারীশিকার
অথচ সবটা গৌণ অচেতন বা অর্ধচেতন
নরকেরও ব্যঙ্গচিত্র, মৃত্যুরও বিকার।
নরকের দাহ দাও নরকের আত্মগ্লানি হে যম জীবন
অশ্রু দাও প্রাসাদে-প্রাসাদে বসতিতে মজ্জায়-মজ্জায় অবসাদে
যন্ত্রণার বাণী দাও মর্মে দাও সজল শিকড় ফুলে ফলে শাখায় পল্লবে
রূপান্তরে প্রাণ দাও অভ্যন্তরে তিক্তের ক্ষুব্ধের
চৈতন্যের ক্ষুরধার ক্ষিপ্র প্রতিবাদে স্পষ্টবাক
জীবনমৃত্যুর এ গোধূলিই স্বচ্ছতা পাক
বৈশাখী রৌদ্রের আর কালবৈশাখীর আন্দোলিত রবে।
রাজার মেয়ে আজ আপিসে খাটে
রাজার ছেলে খোঁজে কাজ,
ভালোই জানে তারা রাজ্যপাটে
কিছুই নয় তারা আজ।
তবুও বয়সের উষার সংকটে
ছেলেটি ভাবে ধাপে বসে,
মেয়েটি সত্যিই রাজার মেয়ে বটে
রাজার ছেলে নয় তো সে।
পার্কে বেঞ্চিতে অথবা পথে শানে
দুজনে বলে প্রায়ই কথা,
বহুরই ভাগ্যে যা বর্তমানে
তাদেরই বেলা অন্যথা।
তাই তো মাঝে-মাঝে রাজার ছেলে
মিছিল করে কলরবে।
রাজার মেয়ে তাই হৃদয় দেয় মেলে
ধর্মঘটে গৌরবে।
এরা যে ভালোবাসে, তাই তো ঘৃণাতে
আগুনে জ্বালে দেহমন।
এদের অভাবের অগ্নিবীণাতে
জীবন পেল যৌবন।
ক্লান্তিতে কিসের ভয় ?
ক্লান্ত হব দিনের কিনারে,
কলঘরের কাজ সেরে তুরপুন র্যাঁদার কিংবা তাঁতের
মিহি, মোটা হাতের সন্তোষ
সম্পূর্ণ দিন ক্লান্তি।
ধ্যান আর বাস্তবের খেয়াপারাপারে
সম্মিলিত এক দলে
আদিগন্ত মাঠে ট্রাকটরের দীর্ঘ অভিসারে
মাটির যেমন ক্লান্তি আসন্ন ফসলে
সেই ক্লান্তি আমাদের আকাঙ্ক্ষিত, মহাশয়!
তারপরে সূর্যের আত্মীয় যেন সূর্যের মতন ফেরা ঘরে।
বাঁধের পথের বাঁয়ে, হাসপাতাল ডানপাশে ছাড়িয়ে,
মাসে-মাসে ভিন্ন-ভিন্ন ঝরা ফুল ঝরা পাতা আলতো মাড়িয়ে,
পাহাড়ের মুখোমুখি দিনের কিনারে,
পাখির সংগীতে পরিতৃপ্ত ক্লান্তিভরে যে যার সংসারে,
কেউ গান কেউ অন্য আমোদপ্রমোদে,
বিজলি আলোয় পাঠে কিংবা শুধু স্নিগ্ধ অবসরে।
হয়তো-বা বারান্দায় বসে কিংবা শুয়ে, খাটে তক্তাপোশে
চাঁদের বিকাশ দেখা দিকচক্রবাল থেকে আকাশের বুকে-
কেমন কাস্তের চাঁদ অমাবস্যা পূর্ণিমায় পঞ্চদশী প্রাকৃত কৌতুকে।
ক্লান্তিতে কিসের ভয় ? মহাশয় এই ক্লান্তি নয়,
ভবঘুরে সমাজের বেকসুর গ্রামশহরের শ্রান্তি বড়ো ক্লান্তিকর;
জ্ঞানে ও বাস্তবে এক বিন্যস্ত জীবনে কর্মে ক্লান্তি নেই, আমরা সবাই ওরে ভাই
চাই সেই ক্লান্ত অবসর।
রবীন্দ্রনাথের গল্প সবাই জানেন
সকলই প্রস্তুত, মেরাপবাঁধানো উঠান প্রাঙ্গণ,
ভিয়েনে আগুন জ্বলে, দেউড়িতে সানাই
বাতাস ভরপুর করে বিশ্বব্যাপ্ত শুদ্ধ সুরে সুরে,
ভাঁড়ারে বোঝাই ভোজ্য, নানা সাজ আয়োজনে
অন্দরের ঘর ভরা যৌতুক বিস্তর,
আত্মায় পড়শী সব মুখর অস্থির,
বহু শিশু খেলে ঘোরে, নিশ্চয় পাত্রীরও বুক দুরু দুরু
আবেগে আগ্রহে বিবাহের সকলই প্রস্তুত।
এমন-কি বরযাত্রী এসে গেছে, সভায় জমাট,
শাঁখ প্রায় বাজে-বাজে, হুলুধ্বনি
এয়োদের পানরাঙা মুখে-মুখে সমুদ্যত,
শুধু বর নেই-
রবীন্দ্রনাথের গল্প, আশ্চর্য রূপক দিয়ে এঁকেছেন কবি
আমাদের সকলের জীবনের ছবি,
মর্মভেদী ভীষণ অদ্ভুত-
বিবাহের সকলই প্রস্তুত,
এমন-কি বরযাত্রী এসে গেছে, শুধু বর নেই-
কিংবা হয়তো-বা ওরা বরযাত্রী নয়, সব বরযাত্রী নয়,
ওই ভিড়ে আছে চোর, জুয়াচোর, গণ্যমান্য অথবা নগণ্য,
ভিখারীও নানান রকম, কেউ বাবু, কেউ-বা সাহেব,
আত্মার দুয়ারে, মনের রাস্তায়
সমাজের আস্তাকুঁড়-সাফাই লরিতে সত্তার ভিখারী,
দুঃস্থ, তবে বস্তিবাসী নয়, গদীয়ান আড়তে দপ্তরে,
দেহে মনে প্রাণে দুঃস্থ, হয়তো-বা অর্থে নয়, ক্ষমতায় নয়-
বরযাত্রী নানান রকম, শুধু বর নেই।
বর খুঁজে ফেরে সত্তা আত্মপরিচয়
মাঠে গঞ্জে শহরে বন্দরেখোঁজে সে আপন।সত্তা, সনাক্তিকরণ
দশের দর্শনে, সমাজের আতশী ফলনে
পায় না আপন সত্তা, যা শুধু ফুলের মতো
ফুটে ওঠে রৌদ্রজলে ছায়ায় মাটিতে
শিকড়ের শাখার পাতার প্রাকৃতিক অর্কেষ্ট্রায়
সত্তা যার নিহিত মাটিতে রৌদ্রজলে শিকড়ে শাখায়,
এমন কি ফুলদানিতে সাজানো হলেও।
তাই আজ আমাদের সত্তা নেই, ঘরে সঙ্ঘে বৈঠকে বা চাখানায়,
ফুলদানির মননেও হাজার চেষ্টায়।
এ উপমা বহুমুখ, স্তরে-স্তরে প্রয়োগে সরল ব্যক্তিতে, সমাজে, দেশে।
দেশ, ভাবো, সুজলা সুফলা এই মলয়শীতলা মাতা দেশ,
ছিন্নভিন্ন, অথচ প্রাচীন পরিচয়ে সত্তার চৈতন্যে ধনী
প্রজ্ঞায় সংহত স্মৃতির শিকড়ে ধন্য কালের বাগানে।
অথচ বিচ্ছিন্ন ছারখার, হাজার দাগায় আহত বিকল
যেন বা দেহের সব আছে, শুধু স্নায়ু স্নায়ুকোষ,
অভুক্ত, অসুস্থ, কাটা, পঙ্গু শত-শত স্নায়ু স্নায়ুকোষ,
তাই আমাদের মনে, বাস্তবজীবনে কবন্ধের ছড়াছড়ি,
বাংলায় হাজার রূপের হাজার রাক্ষস, বহু ছল ক্ষমতার হরেক কৌশল।
তাই আত্মপরিচয় নেই, ব্যক্তি নেই সত্তা নেই,
লালনীলকমলের দেশে আজ বর নেই,
বিধবার দেশে অরক্ষণীয়ার সুন্দরীর বর নেই, সত্তা নেই,
যে সত্তার স্বপ্ন দেখে মানবসভ্যতা চিরকাল
আদিম গোষ্ঠীর যুগ থেকে সাম্রাজ্য অবধি।
এরই ব্যথা এনে দেয় মিথ্যা লোভ, ভুল আত্ম-অভিমান,
অসামান্য ক্ষমতার পায়ে, যেমন সাম্রাজ্যমরিয়া জার্মানি
রিলকের নিঃসঙ্গ যুগে করেছিল নাৎসিদের দুঃস্বপ্নের পায়ে,
সেই সব লোক যারা যন্ত্রণায় লিখেছিল দুর্জয় সুন্দর সিমফনি কোআর্টেট
যন্ত্রণাবধির কত বেঠোফেন,
উন্মাদ বরণ করে নিয়েছিল কত না নীটশে কত হোয়লডেরলিন
কত শত হাখ্নারের আর্ত নাট্যনাদে
এরই লোভে সেকালের ইতিহাসে দেখা যায় বিলাতে গড়েছে
বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যের কল্পতরু ছায়ার একতা।
কল্পতরু আজ শুকনো, তাই ইংল্যন্ডের উত্তরে পশ্চিমে স্বায়ত্তশাসন চায়,
তাই অনেকেরই মনে হয় জনন মৈথুন মৃত্যু এই তিনে ইংলন্ডে শান্তি নেই,
ভাবে তারা হরিজন, উদ্বাস্তু বা নির্বাসিত, দায় নেই দায়িত্বও নেই।
অন্যপক্ষে, আজ তাই দেখা যায় সত্তার সমস্যা,
সংহতির সীমিত সত্যের, সাম্যের সখ্যের মহাদেশে
এদেশে ওদেশে, দেশের দশেরমধ্যে ব্যক্তির মুকূলে।
আমরা সম্রাট নই, বিলাতেরবনেদী দুর্গতি
স্বপ্নেও কপালে নেই, এমন-কি ফরাসীস্ মান্দারিন-মন্য সুখ
নির্দিষ্ট যা মোটামুটি এক শয্যা থেকে অন শয্যার বিলাসে
আলজীরীয় অবসাদে অস্তিত্বের কাকবিষ্ঠা খোঁজা,
তাও নিতান্ত অসার এই পাপপুণ্যহীন দেশে
দগ্ধ দিনে বিষণ্ণ রাত্রিতে।
আমরা নরকে আছি, অথচ সে জ্ঞান নেই মনে,
তাই বিবাহসভায় প্রচ্ছন্ন নরকে আজ বর নেই,
অথচ রাজার মেয়ে এবং রাজার ছেলে নরকের দেউড়িতে
রাস্তায় প্রস্তুত আছে স্বাগতের প্রতীক্ষায়,
শুধু স্বভাবে প্রতিষ্ঠা চায় প্রতিবাদে
প্রাণ মান চায় বরাভয়, তারাই যে বরকনে।।
প্রশ্নোত্তর আলোচনা –
১) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটি কোন কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে ?
✒️ স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ
২) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’ কাব্যটির প্রচ্ছদ কে অঙ্কন করেছেন ?
✒️ যামিনী রায়
৩) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’ কাব্যটি কাকে উৎসর্গ করা হয় ?
✒️ অন্নদাশঙ্কর রায়কে
৪) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটির প্রথম প্রকাশ কোন পত্রিকায় ?
✒️ সাহিত্যপত্রিকা, ১৯৬৩ সালে
৫) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কাব্যটির জন্য বিষ্ণু দে কোন পুরস্কার পেয়েছিলেন ?
✒️ জ্ঞানপীঠ পুরস্কার, ১৯৭১ খ্রি:
৬) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটির চরণ সংখ্যা কত ?
✒️ ২২৮
৭) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটির স্তবক সংখ্যা কত ?
✒️ ২৫
৮) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটিতে ‘স্মৃতি’ কথাটি কতবার আছে ?
✒️ ৪ বার
৯) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটিতে ‘সত্তা’ শব্দটি কতবার আছে ?
✒️ ১১ বার
১০) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটিতে দ্বিরুক্ত শব্দ কটি আছে ?
✒️ ১৩টি
১১) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথের কোন উপন্যাসের প্রসঙ্গ আছে ?
✒️ চতুরঙ্গ ও গোরা
১২) বিষ্ণু দের কোন কোন কবিতাতে রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ আছে ?
✒️ ২৫শে বৈশাখ, গান, স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ
১৩) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটিতে একটি প্রহসনের প্রসঙ্গ আছে , নাম কী ?
✒️ বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ
১৪) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটিতে একটি সাপের নাম উল্লেখ আছে , সেটি কী ?
✒️ গোখুরা
১৫) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটিতে একটি অবলুপ্ত প্রাণীর নাম আছে , উল্লেখ করো।
✒️ টিরানোসরাস বা ডাইনোসরস
১৬) “_ ইতিহাস” – ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতা অনুযায়ী উল্লেখ করো।
✒️ বিশ-বাইশের
১৭) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটিতে কতরকমের জন্তুর উল্লেখ আছে ?
✒️ ১২ রকম
১৮) “হঠাৎ উঠেছে দেখো _ তলা” – ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটিতে কী উল্লেখ অছে ?
✒️ ষোলোতলা
১৯) “কে দেবে ধিক্কার কাকে _ তলায়” – ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতা অনুযায়ী পূরণ করো।
✒️ আঠারো
২০) ‘দুজনে বলে প্রায়ই কথা’ – ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটিতে কারা কথা বলে ?
✒️ রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে
২১) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটিতে আদিগন্ত মাঠে কীসের দীর্ঘ অভিসারের উল্লেখ আছে ?
✒️ ট্রাকটরের
২২) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথের গল্পে কী বাঁধানো উঠান প্রাঙ্গণের উল্লেখ আছে ?
✒️ মেরাপ
২৩) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের গল্প অনুযায়ী স্তম্ভ –
ভিয়েনে – আগুন
দেউড়িতে – সানাই
ভাঁড়ারে – ভোজ্য
অন্দরে – যৌতুক
২৪) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটিতে উল্লখ্য বর সংক্রান্ত শব্দসংখ্যা –
বর – ৭
বরযাত্রী – ৫
বর নেই – ৬
আজ বর নেই – ২
শুধু বর নেই – ৩
২৫) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটিতে কাদের মধ্যে প্রাকৃতিক অর্কেষ্ট্রা চলে ?
✒️ শিকড় – শাখা – পাতা
২৬) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতায় কোন তিনে ইংল্যন্ডে শান্তি নেই ?
✒️ জনন, মৈথুন ও মৃত্যু
২৭) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতায় উল্লেখিত পাশ্চাত্য কবির নাম কী ?
✒️ রিলকে
২৮) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতায় বাস্তব জীবনে কীসের ছড়াছড়ি ?
✒️ কবন্ধ
২৯) কবন্ধ শব্দের অর্থ কী ?
✒️ মস্তকবিহীন
৩০) আলালের ঘরের দুলাল, হুতোম প্যাঁচার নকশার প্রসঙ্গ ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটির কোন স্তবকে আছে ?
✒️ ৬ঠ স্তবকে
৩১) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতায় ভুশুন্ডী প্রান্তর কোথায় অবস্থিত ?
✒️ সালানপুরে
৩২) চৈতন্যে মড়ক, চৈতন্যে আকাশ, চৈতন্যে ধনী, চৈতন্যের ক্ষুরধার ক্ষিপ্র প্রতিবাদ – ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতা অনুযায়ী ক্রম নির্দেশ করো
✒️ চৈতন্যে আকাশ – চৈতন্যে মড়ক – চৈতন্যের ক্ষুরধার ক্ষিপ্র প্রতিবাদ – চৈতন্যে ধনী
৩৩) বাঁচবার আশা, বাঁচবার ভাষা, কান্নার সুর, জীবনের ভাষা – ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতা অনুযায়ী ক্রম নির্দেশ করো।
✒️ জীবনের ভাষা – বাঁচবার আশা – বাঁচবার ভাষা – কান্নার সুর
৩৪) ঘৃণার পাতা, ঘৃণার অভিশাপ, ঘৃণার আসন, ঘৃণার মাটি – ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতা অনুযায়ী ক্রম নির্দেশ করো
✒️ ঘৃণার আসন – ঘৃণার পাতা – ঘৃণার মাটি – ঘৃণার অভিশাপ
৩৫) নরকের দাহ, নরকের দেউড়ি, নরকের আত্মগ্লানি, নরকের ব্যঙ্গচিত্র, প্রচ্ছন্ন নরক –
‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতা অনুযায়ী ক্রম নির্দেশ করো
✒️ নরকের ব্যঙ্গচিত্র – নরকের দাহ – নরকের আত্মগ্লানি – প্রচ্ছন্ন নরক – নরকের দেউড়ি
৩৬) বাঙালের হাইকোর্ট, কলকাতার কাক, গাঁওয়ারের জাদুঘর, ইংরেজি খেয়াল – কোন শব্দগুচ্ছটি ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতায় নেই ?
✒️ কলকাতার কাক
৩৭) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতায় বর কোথায় কোথায় আপন সত্তা খোঁজে – সঠিক ক্রমে উল্লেখ করো।
✒️ মাঠে – গঞ্জে – শহরে – বন্দরে
৩৮) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতায় কোন পাখির উল্লেখ আছে ?
✒️ শালিক
৩৯) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটির প্রথম লাইন উল্লেখ করো
✒️ তোমরা নবীন, এ উদাস
৪০) ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত’ কবিতাটির শেষ লাইন উল্লেখ করো।
✒️ প্রাণ মান চায় বরাভয়, তারাই যে বরকনে ।।।
No comments:
Post a Comment