নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়।
শোক-সংবাদের শেষের কথাটি কী সিনেমায়, কী সাহিত্যে এখনও অব্দি ধ্রুব সত্যি; তাঁর 'লিখনভঙ্গি' এখনও 'অননুকরণীয়'। তাই তো তিনি কায়িক মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর আজও একান্ত স্মরণীয়...
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি :
গরমিল
উত্তরফল্গুনী
সংলাপ ও চিত্রনাট্যের উল্লেখযোগ্য ছবিগুলি হলো-
বিচার
স্বামীজি
শাপমোচন
শশীবাবুর সংসার
দাদাঠাকুর
সাত পাকে বাঁধা প্রভৃতি।
কলকাতা বেতারের সাথে আদিযুগ হতে যুক্ত ছিলেন। 'বিদ্যার্থীমণ্ডল', 'পল্লীমঙ্গল আসর' এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। দীর্ঘদিন দাদামণি নামে জনপ্রিয় গল্পদাদুর আসর' পরিচালনা করেছেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রথম পুরী থেকে সরাসরি রথযাত্রার বেতার ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন। তিনি গল্পভারতী নামক মাসিক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাকালীন (১৯৪৫ - ৫২) সময়ের সম্পাদক ছিলেন তিনি। [২] কল্লোল পত্রিকার সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। মৌলিক ও অনুবাদ রচনা নিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রচুর। আবেগদীপ্ত ছন্দময় ভাষায় জন্য তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন।
এছাড়া ও
মহীয়সী মহিলা
সান ইয়াৎ সেন
শতাব্দীর সূর্য
মা ( গোর্কির উপন্যাস- অনুবাদ)
সেক্সপীয়ারের কমেডি
সেক্সপীয়ারের ট্রাজেডি
নূতন যুগের নূতন মানুষ
কুলী ( মুলকরাজ আনন্দের উপন্যাস-অনুবাদ)
নানাকথা
এইচ জি ওয়েলসের গল্প
মজার গল্প (ছোটগল্প-১৯২৮)
জনক জননী (উপন্যাস-১৯৪৮)
প্রভৃতি।
এছাড়া জয়দেব-রচিত গীতগোবিন্দ -এর বঙ্গানুবাদ করেছিলেন তিনি এবং এটি পাঠকসমাজে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে।
ব্যক্তিজীবন
জন্ম ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জানুয়ারি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জয়নগর ২ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের ফুটিগোদা গ্রামে। পিতা প্রফুল্লচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা সুশীলা দেবী। প্রাথমিক পড়াশোনা গ্রামের স্কুলেই। পরে কলকাতায় এসে বেলেঘাটার বঙ্গবাসী স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ এবং সেখান থেকেই ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিক পাশ করেন। পরে সিটি কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে কলেজের অধ্যক্ষ ও ইংরাজী সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপক হেরম্বচন্দ্র মৈত্রর সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হওয়ায় বার্ষিক পরীক্ষায় বসতে পারেননি। ফলে তার প্রথাগত ছাত্রজীবন শেষ হয়।
বড় হয়ে ওঠার সময়কালে নৃপেন বাবাকে দেখে বাবার আদর্শকেই নিজের আদর্শ-পথ বলে গ্রহণ করতে লাগলেন। স্বপ্ন দেখতে লাগলেন শিক্ষক হবার, সমাজের জন্য কিছু করার। সেই শিক্ষকতার পাঠ শুরু করে দিলেন ম্যাট্রিক পাশ করার পর নিজের খরচ নিজে চালানোর ব্রত হিসেবে। শুরু করলেন গৃহশিক্ষকতা। ভর্তি হলেন সিটি কলেজে। গৃহশিক্ষকতা ও পড়াশোনার পাশাপাশি বাঙালির ছেলের যেটা জন্মগত বিদ্যে, টুকটাক সেই সাহিত্যের চর্চাও চলতে লাগল।
কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর সন্তানদের পড়াতে তাঁর বাড়িতে যেতেন নৃপেন। সেখানেই একদিন আলাপ হয়ে গেল কাজী নজরুলের সঙ্গে। আলাপে বেরিয়ে এল নৃপেনের লেখালেখির প্রতি আসক্তির কথা। নজরুল তখন 'ধূমকেতু' নামে এক বৈপ্লবিক পত্রিকা বের করতে শুরু করেছেন। তার মধ্য দিয়ে মানুষকে সচেতন করছেন, অধিকার আদায়ের মন্ত্র দিচ্ছেন, যুব সমাজের মধ্যে বিপ্লবের আগুন জ্বালানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। কথায় কথায় বুঝলেন নৃপেনের মধ্যেও সেই আগুন আছে। ব্যস, তাঁর ইচ্ছেয় নৃপেন ধূমকেতু-গোষ্ঠীর একজন হয়ে গেলেন, লিখতে শুরু করে দিলেন 'দিকশূল' ছদ্মনামে।
সিটি কলেজে বিএ পড়তে পড়তে আলাপ হল সহপাঠী শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বন্ধুত্ব হল। 'কল্লোল' পত্রিকা যখন বাংলা সাহিত্যে নতুন বন্দর তৈরি করার উদ্যোগ নিল, তখন বন্ধু শৈলজার সূত্রে নৃপেনও সেখানে এসে ভিড়লেন। শিক্ষকতার স্বপ্নের বিবর্তন ঘটল। শুরু হয়ে গেল তাঁর পরিপূর্ণ সাহিত্য-জীবন। 'দেবব্রত বসু' ছদ্মনামে অনুবাদ করলেন ম্যাক্সিম গোর্কির যুগান্তকারী উপন্যাস 'মা'। অনুবাদটি বাংলা সাহিত্যে বেশ সাড়া ফেলে দিল। উৎসাহিত হয়ে এরপর একে একে অনুবাদ করলেন মূলক রাজ আনন্দের 'কুলী' ও 'দুটি পাতা একটি কুঁড়ি'-র মতো বিতর্কিত ও বহু আলোচিত দুটি উপন্যাস। অনুবাদ সাহিত্যে তিনি নিয়ে এলেন নতুন জোয়ার। শুরু করলেন বিতর্কিত, বৈপ্লবিক এবং মেহনতি মানুষের কথা বলা বিশ্ব সাহিত্যের অনুবাদের কাজ। বিদেশি সাহিত্যকে স্বদেশি ছাঁচে ঢেলে তার ভাবে ও ভাষায় নিয়ে এলেন সুখপাঠ্য-সাবলীলতা। এই সুখপাঠ্য-সাবলীলতাই হয়ে উঠল তাঁর নিজের লেখারও বৈশিষ্ট্য।
এ-সময় শৈলজানন্দ সাহিত্য থেকে বাংলা সিনেমার জগতে পদার্পণ করলেন। 'ছায়া' নামের সিনেমাসংক্রান্ত পত্রিকা প্রকাশ করে শৈলজা হলেন সম্পাদক, নৃপেনকে করলেন তাঁর সহযোগী। এবং এর মধ্য দিয়েই নৃপেনও পা রাখলেন বাংলা সিনেমার জগতে। ১৯৪২ সালে নীরেন লাহিড়ী পরিচালিত 'মহাকবি কালিদাস' ছায়াছবিতে কালিদাসের ভূমিকায় অভিনয় করে ফেললেন। অভিনয় প্রশংসিত হল। কিন্তু, তার চেয়েও বেশি প্রশংসিত হল এই সময় লেখা তাঁর 'কাশীনাথ' নামের চিত্রনাট্য। বাংলা ছায়াছবির জন্য এটাই তাঁর প্রথম লেখা চিত্রনাট্য।
বাংলা ছায়াছবির কাহিনি, সংলাপ ও চিত্রনাট্য তাঁর হাতে পড়ে সাবলীল, সুন্দর, সুষ্ঠু, নির্মেদ, চরিত্রপযোগী এবং যুগোপযোগী হয়ে উঠল। 'রাণী রাসমণি', 'দুই ভাই', 'শেষ পর্যন্ত', 'সাত পাকে বাঁধা', 'ত্রিধারা', 'উত্তর ফাল্গুনী'-র মতো কালজয়ী ছবিগুলো তারই উজ্জ্বল স্বাক্ষর। তাঁর চিত্রনাট্যে নির্মিত 'দাদাঠাকুর' ও 'ভগিনী নিবেদিতা' ছবি দুটি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেল।
শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেন। ছোটদের জন্য সম্পাদনা করলেন 'গল্পভারতী' পত্রিকা। তাদের জন্য লিখলেন 'মহিয়সী মহিলা', 'শতাব্দীর সূর্য', 'সেক্সপীয়রের ট্রাজেডী', 'সেক্সপীয়রের কমেডী', 'রাক্ষস খোক্কস'-এর মতো অত্যন্ত জনপ্রিয় গ্রন্থমালা। এছাড়া 'শেলী', 'সুভাষচন্দ্র', 'জওহরলাল', 'জয়দেব' প্রভৃতি বরেণ্য সাহিত্যিক ও দেশনেতার জীবনী রচনার মধ্য দিয়েও সমৃদ্ধ করলেন শিশু সাহিত্যের ভাণ্ডার।
আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ আমৃত্যু। সেখানেও তিনি রাখলেন স্বকীয় এবং উল্লেখযোগ্য অবদান। ছোটদের জন্য 'বিদ্যার্থী মণ্ডল' এবং 'গল্পদাদুর আসর' এই দুটি অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও উপস্থাপনা তাঁরই কীর্তি। সদিচ্ছে থাকলে বিনোদনের বেতারকে যে ছোটদের কাছে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয় করে তোলা যায়, এটা তিনি প্রমাণ করে দিলেন। হয়ে উঠলেন ছোটদের সবার প্রিয় 'গল্পদাদু'।
নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ গল্প, উপন্যাস প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন এবং তার বিচরণ ছিল বিজ্ঞান, ইতিহাস ধর্ম ইত্যাদি নানা বিষয়ে। বিশেষকরে শিশুসাহিত্যের ক্ষেত্রে তার অবদান স্মরণীয়। ছোটদের জন্য বিশ্বের ক্লাসিক কাহিনির অসাধারণ বঙ্গানুবাদ করেছিলেন। চলচ্চিত্র জগতে অনেকগুলি বাংলা চলচ্চিত্রের অসামান্য চিত্রনাট্য রচনা ছাড়াও, অনেকগুলির কাহিনী, সংলাপ এমনকি গীতিকার, অভিনেতারূপে কাজ করেছেন। একাধারে ছিলেন ভারতীয় বাঙালি চিত্রনাট্যকার, কাহিনিকার, গীতিকার, চিত্রপরিচালক ও অভিনেতা এবং অন্য দিকে অনুবাদক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, শিশু সাহিত্যিক এবং বেতারের অনুষ্ঠান সঞ্চালক। বিশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার সংস্কৃতিজগতে অন্যতম বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তি ছিলেন তিনি। শিশু সাহিত্যে তার অবদান ছিল বিশেষভাবে স্মরণীয়।
No comments:
Post a Comment