মহাশ্বেতা দেবী
"আমি সর্বদাই বিশ্বাস করি যে, সত্যকারের ইতিহাস সাধারণ মানুষের দ্বারা রচিত হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সাধারণ মানুষ যে লোককথা, লোকগীতি, উপকথা ও কিংবদন্তিগুলি বিভিন্ন আকারে বহন করে চলেছে, তার পুনরাবির্ভাবের সঙ্গে আমি ক্রমাগত পরিচিত হয়ে এসেছি। ... আমার লেখার কারণ ও অনুপ্রেরণা হল সেই মানুষগুলি যাদের পদদলিত করা হয় ও ব্যবহার করা হয়, অথচ যারা হার মানে না। আমার কাছে লেখার উপাদানের অফুরন্ত উৎসটি হল এই আশ্চর্য মহৎ ব্যক্তিরা, এই অত্যাচারিত মানুষগুলি। অন্য কোথাও আমি কাঁচামালের সন্ধান করতে যাব কেন, যখন আমি তাদের জানতে শুরু করেছি? মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার লেখাগুলি আসলে তাদেরই হাতে লেখা. "
সেপ্টিসেমিয়া ও মূত্র সংক্রমণ রোগেও ভুগছিলেন.
পুরস্কার
১৯৭৯: সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (বাংলা): – অরণ্যের অধিকার (উপন্যাস)
১৯৮৬: সমাজসেবায় পদ্মশ্রী
১৯৯৬: জ্ঞানপীঠ পুরস্কার – ভারতীয় জ্ঞানপীঠ কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার
১৯৯৭: রামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার – সাংবাদিকতা, সাহিত্য ও সৃজনশীল যোগাযোগমূলক শিল্পকলা (“ভারতের জাতীয় জীবনে উপজাতিদের ন্যায়সম্মত ও সম্মানজনক স্থান অর্জনের দাবিতে শিল্পকলা ও আন্দোলনের মাধ্যমে সহানুভূতিপূর্ণ সংগ্রাম চালানোর” জন্য)
২০০৩: অফিসার দেল’ অর্ডার দেস আর্টস এত দেস লেটার্স
২০০৬: পদ্মবিভূষণ – ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা
২০০৭: সার্ক সাহিত্য পুরস্কার
২০০৯: ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন
২০১০: যশবন্তরাও চবন জাতীয় পুরস্কার
২০১১: বঙ্গবিভূষণ – পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা
১৯২৬ সালে ব্রিটিশ ভারতের ঢাকা শহরে মহাশ্বেতা দেবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার বাবা মণীশ ঘটক ছিলেন কল্লোল সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত খ্যাতনামা কবি ও ঔপন্যাসিক। তিনি ‘যুবনাশ্ব’ ছদ্মনামে লিখতেন। মণীষ ঘটকের ভাই ছিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। মহাশ্বেতা দেবীর মা ধরিত্রী দেবীও ছিলেন লেখক ও সমাজকর্মী। তার ভাইয়েরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ছিলেন। যেমন, শঙ্খ চৌধুরী ছিলেন বিশিষ্ট ভাস্কর এবং শচীন চৌধুরী ছিলেন দি ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি অফ ইন্ডিয়া পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। মহাশ্বেতা দেবীর বিদ্যালয়-শিক্ষা শুরু হয়েছিল ঢাকা শহরেই। ভারত বিভাজনের পর তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। এরপর তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠভবনে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
মহাশ্বেতা দেবী ১০০টিরও বেশি উপন্যাস এবং ২০টিরও বেশি ছোটোগল্প সংকলন রচনা করেছেন। তিনি মূলত বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন। তবে সেই সব রচনার মধ্যে অনেকগুলি অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার প্রথম উপন্যাস ঝাঁসির রানি ঝাঁসির রানির (লক্ষ্মীবাই) জীবনী অবলম্বনে রচিত। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৬ সালে। এই উপন্যাসটি রচনার আগে তিনি ঝাঁসি অঞ্চলে গিয়ে তার রচনার উপাদান হিসেবে স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে তথ্য ও লোকগীতি সংগ্রহ করে এনেছিলেন।
১৯৬৪ সালে মহাশ্বেতা দেবী বিজয়গড় কলেজে (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুমোদিত কলেজ) শিক্ষকতা শুরু করেন। সেই সময় বিজয়গড় কলেজ ছিল শ্রমিক শ্রেণির ছাত্রীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই সময় মহাশ্বেতা দেবী একজন সাংবাদিক ও একজন সৃজনশীল লেখক হিসেবেও কাজ চালিয়ে যান। তিনি পশ্চিমবঙ্গের লোধা ও শবর উপজাতি, নারী ও দলিতদের নিয়ে পড়াশোনা করেন। তার প্রসারিত কথাসাহিত্যে তিনি প্রায়শই ক্ষমতাশালী জমিদার, মহাজন ও দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি আধিকারিকদের হাতে উপজাতি ও অস্পৃশ্য সমাজের অকথ্য নির্যাতনের চিত্র অঙ্কন করেছেন।
উত্তর-ঔপনিবেশিক গবেষক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক মহাশ্বেতা দেবীর ছোটোগল্পগুলি ইংরেজিতে অনুবাদ করে তিনটি গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন। এগুলি হল ইম্যাজিনারি ম্যাপস (১৯৯৫, রুটলেজ), ওল্ড ওম্যান (১৯৯৭, সিগাল) ও দ্য ব্রেস্ট স্টোরিজ (১৯৯৭, সিগাল)।
বহুবার ভারতের উপজাতি মানুষদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন।[৩] ২০১৬ সালের জুন মাসে মহাশ্বেতা দেবীর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ঝাড়খণ্ড সরকার বিশিষ্ট আদিবাসী নেতা বিরসা মুন্ডার একটি মূর্তিকে শৃঙ্খলামুক্ত করে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের শাসনকালে গৃহীত শৃঙ্খলিত বিরসা মুন্ডার একটি আলোকচিত্রের ভিত্তিতে মূর্তিটি নির্মিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, বিরসা মুন্ডার জীবনকাহিনি অবলম্বনে ১৯৭৭ সালে মহাশ্বেতা দেবী অরণ্যের অধিকার উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন।
মহাশ্বেতা দেবী পশ্চিমবঙ্গের পূর্বতন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) (সিপিআই(এম))-নেতৃত্বাধীন সরকারের শিল্পনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিশেষত, তিনি কৃষকদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে উর্বর কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে তা অত্যন্ত স্বল্পমূল্যে শিল্পপতিদের দিয়ে দেওয়ার তীব্র সমালোচনা করেন। ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সমর্থন করেন। এই নির্বাচনে পরাজিত হয়ে সিপিআই(এম)-এর ৩৪ বছর ব্যাপী শাসনকালের অবসান ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনে তিনি প্রথম জীবনে কয়েক বছর অতিবাহিত করেছিলেন। সেই শান্তিনিকেতনের বাণিজ্যিককরণের বিরোধিতা করেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। নন্দীগ্রাম আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের বিতর্কিত জমি অধিগ্রহণ নীতির বিরুদ্ধে বহুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, লেখক ও নাট্যকর্মীকে একত্রিত করেন।
২০০৬ সালে ফ্রাঙ্কফুট বইমেলায় ভারত দ্বিতীয় বারের জন্য অতিথি দেশ নির্বাচিত হয়। ভারতই প্রথম দেশ হিসেবে এই মেলায় দুইবার অতিথি দেশ নির্বাচিত হয়। এই মেলার উদ্বোধনী ভাষণে মহাশ্বেতা দেবী রাজ কাপুরের বিখ্যাত চিত্রগীতি "মেরা জুতা হ্যায় জাপানি" থেকে পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে একটি আবেগময় ভাষণ দেন: {{cquote|সত্যই এটি এমন এক যুগ যেখানে ‘জুতা’টি (জুতো) জাপানি, ‘পাতলুন’টি (প্যান্ট) ‘ইংলিশস্তানি’ (ব্রিটিশ), ‘টোপি’টি (টুপি) ‘রুসি’ (রাশিয়ান), কিন্তু ‘দিল’... ‘দিল’টি (হৃদয়) সর্বদা ‘হিন্দুস্তানি’ (ভারতীয়)... আমার দেশ, ক্ষয়প্রাপ্ত, ছিন্নভিন্ন, গর্বিত, সুন্দর, উষ্ণ, আর্দ্র, শীতল, ধূলিধূসরিত, উজ্জ্বল ভারত। আমার দেশ।
১৯৪৭ সালে মহাশ্বেতা দেবী বিশিষ্ট নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যকে বিবাহ করেন। বিজন ভট্টাচার্য ছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পথপ্রদর্শক। ১৯৪৮ সালে তাদের পুত্র নবারুণ ভট্টাচার্যের জন্ম হয়। নবারুণ ভট্টাচার্য পরবর্তীকালে ঔপন্যাসিক ও রাজনৈতিক সমালোচক হয়েছিলেন। মহাশ্বেতা দেবী একটি ডাকঘরেও চাকরি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তার কমিউনিস্ট মনোভাবের জন্য তাকে সেখান থেকে বিতাড়িত করা হয়। এরপর তিনি জীবিকা নির্বাহের জন্য সাবান বিক্রয় এবং নিরক্ষরদের জন্য ইংরেজিতে চিঠি লিখে দেওয়ার মতো কাজও করেছেন। এরপর তার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৬২ সালে তিনি অসিত গুপ্তকে বিবাহ করেন।
উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি.
ঝাঁসির রানি (১৯৫৬, জীবনী)
দ্য কুইন অফ ঝাঁসি, মহাশ্বেতা দেবী (সাগরী ও মন্দিরা সেনগুপ্ত কর্তৃক অনূদিত)। এই বইটি হল রানি লক্ষ্মীবাইয়ের জীবনীগ্রন্থ। ঐতিহাসিক নথিপথ (প্রধানত রানির পৌত্র জি. সি. তাম্বে কর্তৃক সংগৃহীত) এবং লোককথা, কাব্য ও মুখে মুখে প্রচলিত কিংবদন্তিগুলি নিয়ে গবেষণার পর বইটি রচিত হয়। মূল বাংলা বইটি ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয়। ইংরেজি অনুবাদটি ২০০০ সালে সিগাল বুকস, ক্যালকাটা থেকে প্রকাশিত হয়।
হাজার চুরাশির মা (১৯৭৪, উপন্যাস)
অরণ্যের অধিকার (১৯৭৯, উপন্যাস)
অগ্নিগর্ভ (১৯৭৮, ছোটোগল্প সংকলন)
মূর্তি (১৯৭৯, ছোটোগল্প সংকলন)
নীড়েতে মেঘ (১৯৭৯, ছোটোগল্প সংকলন)
স্তন্যদায়িনী (১৯৮০, ছোটোগল্প সংকলন)
চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর (১৯৮০, ছোটোগল্প সংকলন)
চলচ্চিত্রায়ন
সংঘর্ষ (১৯৬৮), লায়লি আসমানের আয়না ছোটোগল্পটি অবলম্বনে নির্মিত হিন্দি চলচ্চিত্র
রুদালি (১৯৯৩)
হাজার চৌরাসি কি মা (১৯৯৮)
মাটি মায় (২০০৬),' 'দায়েঁ ছোটোগল্পটি অবলম্বনে নির্মিত মারাঠি চলচ্চিত্র।
গাঙ্গোর (২০১০), চোলি কে পিছে ছোটোগল্পটি অবলম্বনে নির্মিত ইতালীয় চলচ্চিত্র .
====[][[}}][[{[]✓==°{}{=׶{✓✓{}}[]]}]]]]]}]]]]]]}}
No comments:
Post a Comment