Tuesday, 2 August 2022

বিশেষ প্রতিবেদন। বাউলের ব্যাকুলতায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাগ - রাগিনী। Vol -816. Dt -03.08.2022. ১৭ শ্রাবণ,১৪২৯. বুধবার। The blogger in literature


বাউলের ব্যাকুলতায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাগ - রাগিনী 

               রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋতু সৌন্দর্যের কবি। তাঁর ঋতু-সাহিত্যে যে বৈচিত্র্য দেখা যায়, তা শুধু আকাশে-বাতাসে, মেঘে-বর্ষণে, ফুলে-পল্লবেই প্রকাশ পায় এমন নয়, সে বৈচিত্র্য মানুষের শৈশব-কৈশোর, যৌবন-বার্ধক্যেও সমান। ঋতুর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ একদিকে দেখেছেন তার কঠোর রূপ, অন্যদিকে দেখেছেন রস-কোমলতা, সৃষ্টির স্নিগ্ধতা। দারুণ গ্রীষ্মে একদিকে যেমন ‘প্রখর তপন তাপে, আকাশ তৃষায় কাঁপে, বায়ু করে হাহাকার’, তার পরেই সেখানে আসে চাঁপাফুলের ছোঁয়া, বকুলমালার গন্ধ। বৈশাখের রুদ্রতা ও কোমলতা দিয়ে তিনি কামনা করেছেন সমস্ত গ্লানি দূর করে পবিত্র ও নির্মল এক পৃথিবীর।রবীন্দ্র-পূর্ব বাংলায় ষড়ঋতুর ব্যবহারিক দিকটাই তত্কালীন কবিদের কাব্যে প্রাধান্য পেয়েছিল, আলাদাভাবে ঋতুবৈচিত্র্য বর্ণনার প্রয়াস তেমন একটা দেখা যায়নি। রবীন্দ্রনাথ সেই বাঁধা পথে না গিয়ে ব্যক্তিগত অনুভূতির স্পর্শ নিয়ে এসেছেন। ফলে প্রকৃতিগাথা হয়ে উঠেছে জীবন্ত। রবীন্দ্রনাথের গানে প্রতিটি ঋতু যেন তাদের নিজ নিজ চিত্র, ধ্বনি, বর্ণ ও গন্ধ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। এ গানগুলো যেন বাংলার প্রকৃতির চিরকালের মর্মবাণী। তাঁর অন্যান্য গানের মতো প্রকৃতির গানেও তিনি বিশ্ববোধ ছড়িয়ে দিয়েছেন। ‘কুসুমে কুসুমে’ তিনি তাঁর অন্তরাত্মার ‘চরণচিহ্ন’ দেখেছেন, তাঁর আগমনে পৃথিবীর বুকে ‘আকুলতা ও চঞ্চলতা’ অনুভব করেছেন। ‘আকাশভরা সূর্য তারা’ এবং ‘বিশ্বভরা প্রাণের’ মাঝখানে ‘বিস্ময়ে’ নিজেকে আবিষ্কার করেছেন।প্রতিটি ঋতু একেকটি দার্শনিক তাত্পর্য নিয়ে রবীন্দ্রসংগীতে উপস্থাপিত হয়েছে। গ্রীষ্মের গানে দারুণ দাহনবেলার রসহীনতার চিত্র যেমন আঁকা হয়েছে, বৈশাখী ঝড়কে তেমনি জীর্ণতার অবসানে নতুনের আগমনের পূর্ব সংকেতরূপে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রভাবনায় বৈশাখী ঝড় কেবল বাইরের প্রকৃতিতেই আসে না, হৃদয়ের ভেতরেও সে ঝড় তোলে। গ্রীষ্মের মধ্যে তিনি একদিকে দেখেছেন এর কঠোর রূপ, বৈরাগীর বেশ, অন্যদিকে তার রস-কোমলতা ও সৃষ্টির স্নিগ্ধতায়ও মুগ্ধ হয়েছেন।গীতবিতানে গ্রীষ্মের গান ১৬টি, যা রবীন্দ্রনাথ তাঁর ৬০ থেকে ৭২ বছর বয়সের মধ্যে রচনা করেছেন। গীতবিতানে দেওয়া ক্রমানুসারে—

১. নাই রস নাই, দারুণ দাহনবেলা; 

২. দারুণ অগ্নিবাণে রে; 

৩. এসো এসো হে তৃষ্ণার জল; 

৪. হৃদয় আমার, ওই বুঝি তোর বৈশাখী ঝড় আসে; 

৫. এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ; 

৬. নমো নমো হে বৈরাগী; 

৭. মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি; 

৮. ওই বুঝি কালবৈশাখী; 

৯. প্রখর তপন তাপে; 

১০. বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া; 

১১. বৈশাখ হে মৌনী তাপস; 

১২. শুষ্কতাপের দৈত্যপুরে দ্বার ভাঙবে ব’লে; 

১৩. হে তাপস, তার শুষ্ক কঠোর রূপের গভীর রসে; ১৪. মধ্যদিনের বিজন বাতায়নে; 

১৫. তপস্বিনী হে ধরণী; 

১৬. চক্ষে আমার তৃষ্ণা। 

তাঁর প্রথম গ্রীষ্মের গান ৬০ বছর বয়সে রচিত ‘দারুণ অগ্নিবাণে রে’ এবং শেষ গান ৭২ বছর বয়সে রচিত ‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা’। এ ছাড়া অন্যান্য পর্যায়ের বেশ কিছু গানেও গ্রীষ্মের আবহ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সব সংগীত সৃষ্টিকে প্রেম, প্রকৃতি, পূজা প্রভৃতি পর্যায়ে ভাগ করলেও প্রায় সব গানকেই আত্মনিবেদনের গান বললে অত্যুক্তি হয় না। জীবনের যত দিক আছে, যত রকম অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা, রবীন্দ্রনাথের গানে তার প্রায় প্রতিটির প্রতিফলন রয়েছে। তাই আমাদের মন সব অবস্থায় আশ্রয় পায় তাঁর গানে। জীবনকে গানের মধ্য দিয়ে এমন করে উপলব্ধি করার অভিজ্ঞতা সম্ভবত আর কোনো রচয়িতার গানে অনুভব করা যায় না।।

রবীন্দ্রনাথের গানে দেশি আদর্শের সুস্পষ্ট ছাপ। তাঁর শিল্পীসত্ত্বা ও ব্যক্তিত্ব প্রায় অভিন্ন। জীবনের এক তীব্র মুহূর্তে হঠাৎ পেয়ে গেলেন আনুষ্ঠানিক সম্প্রদায়গত ধর্মাচরণের বাইরে এক সরল উদার আন্তরিকতার ধর্ম যা আত্মভোলা গানের সুরে নিজেকে অনায়াসে প্রকাশ করে। একে তিনি গ্রহণ করে আত্মস্থ করেছেন দীর্ঘ বছর দশেক কাল ধরে। তারপর হঠাৎ দেশব্যাপী প্রাণোচ্ছ্বাসের সঙ্গে একাত্মতাবোধের ঐকান্তিকতায় বাউল সুরাশ্রিত স্বদেশি গানের প্লাবনোচ্ছ্বাস। রবীন্দ্রনাথ যাকে তাঁর সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য বলে গ্রহণ করেছিলেন তার ধারা প্রধানত দুটি মার্গ বা ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীত এবং দেশ বা লোকসঙ্গীত। লোকসঙ্গীত সহজ ও সাবলীল। গানের ভাব প্রকাশিত হয় কথায়। সুর ও ছন্দ তাকে প্রাণবান করে তোলে। তাল সাধারণত সহজম সুর তিন থেকে সাতটি পর্দায় বিন্যস্ত। এর গায়কেরা পুঁথিগত বা সাঙ্গীতিক বিদ্যায় রীতিমত শিক্ষিত না-ও হতে পারেন। সাধারণত এঁরা যাকে বলে ‘গাইতে গাইতে গাইয়ে’।

বাউল সম্প্রদায়ের গান এক ধরনের আবেগময় একটানা সুর, মাঝে মাঝে বেশ ছন্দোবহুল সঙ্গে নৃত্যের আবেগ। বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলেছে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, সুফি ধর্ম। বৈষ্ণব সহজিয়া ধর্মের সঙ্গে মূল সাধনাঙ্গ এক হওয়ায় সহজিয়া মুসলমান ফকিরদের মিলনে ১৬২৫ খ্রীষ্টাব্দে তক বাউলধর্মের উদ্ভব। মুসলমান ফকিরাই বাউল সাধনার আদি প্রবর্তক বলে মনে করা হয়। অনেকের মতে বাউলসাধনা শিষ্টজন নিন্দিত ও ধর্মের নামে ইন্দ্রিয়সেবা মাত্র। কিন্তু উভয় বাংলায় বাউল গান ধর্মসঙ্গীত হিবাসেই পরিচিত। এই গানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। বিশিষ্ট বাউল কবি বা গীতিকারা হলেন লালন ফকির, মদন, পাগলা কানাই, ঈশান, গঙ্গারাম, দীনু, পাঞ্জু শাহ, যাদুবিন্দু। হাউড়ে বাউল, গগন, চণ্ডী বাউল, ফটিক, গোঁসাইচাঁদ, এরফান আলি, বাখের শাহ।

রবিঠাকুর মনে করতেন লোকসঙ্গীতের চেয়ে বাউল গান অনেক ছন্দবহুল। এর সুরের পার্থক্য দেখাযায় প্রথম কলির সঙ্গে দ্বিতীয় কলির। কীর্তন ও বাউলের সুর বৈঠকি গানের একেবারে গা ঘেঁষে গিয়েও তাকে স্পর্শ করে না। ওস্তাদের আইন অনুসারে এটা অপরাধ, কিন্তু বাউলের সুর যে একঘরে। রাগরাগিণী যতই চোখ রাঙাক, সে কীসের কেয়ার করে!


রবীন্দ্রনাথের গান প্রথম থেকেই কিছুটা কাব্যপ্রভাবিত এবং ওস্তাদিগানের তানকর্তব বা লয়বৈচিত্র্য তিনি প্রায় সজ্ঞানে পরিহার করেছেন। অর্থাৎ তাঁর গান প্রথম থেকেই অনেকটা দেশি আদর্শ অনুসারী। বাউল গান সম্পর্কে লিখিতভাবে রবীন্দ্রনাথের প্রথম আগ্রহের প্রকাশ দেখি ১২৯০ সালে(১৮৮৩-৮৪ খ্রিষ্টাব্দে) ভারতী পত্রিকায় যখন তাঁর বয়স মাত্র ২২ বছর। বাউল গানের একটি সংগ্রহ পুস্তক সমালোচনা প্রসঙ্গে তিনি দেশবাসীর দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করেন। তার আহ্বানে ভারতীতে কিছু গান ছাপাও হয়। কিন্তু তা শুধুই কথা, সুর ছাড়া। সাতাশ বছর বয়সের মধ্যে তার প্রায় ৪০০ গান রচনা হয়ে গেছে। এর মধ্যে মাত্র কয়েকটি দেশি সুরে অর্থাৎ কীর্তনের ও রামপ্রসাদী সুরে, যা তৎকালে কলকাতা অঞ্চলে যথেষ্ট পরিমাণে প্রচলিত বাউল সুর একটিও নেই। তারপর ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত দেশি সুরে যে সমস্ত গান রচিত হল তার মধ্যেও দেখি প্রধানত কীর্তন, রামপ্রসাদী ও বাংলাদেশে প্রচলিত বিভাস বা যোগীয়া বিভাস। বাউল সুর মাত্র দুটি গানে – ১) “তোমরা সবাই ভালো”,

 এবং

 ২) “খেপা, তুই আছিস আপন খেয়াল ধরে”। 

অন্য একটি সাক্ষ্য অনুসারে তাঁর প্রথম বাউল সুরের রচনা ‘বিসর্জন’ নাটকের (রচনা- পৌষ, ১২৯৬ সাল) “আমারে কে নিবি ভাই”।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন, এই সময় আকস্মিক বন্যার ন্যায় কয়েকদিনের জন্য কূল ছাপাইয়া গীতধারা উৎসারিত হইল এবং স্বদেশি যুগের এই গানগুলি অধিকাংশই হইতেছে বাউল সুরে বাঁধা। সাতাশ বছর বয়স পর্যন্ত কোনও বাউল সুরের গান নেই, তিরিশ থেকে চল্লিশ বছর পর্যন্ত মাত্র খান দুয়েক গান রচনা, তারপর বঙ্গভঙ্গের সময় বয়স যখন চুয়াল্লিশ বছর হঠাৎ অকস্মাৎ বন্যা - রহস্যটা কী? আমাদের ধারণা, ব্যাপারটা দেখতে যতোই আকস্মিক হোক, এর পিছনে অনেকগুলি ঘটনা ক্রিয়াশীল যার কিছুটা বিশ্লেষণ ছাড়া রহস্যের ব্যাখা অসম্ভব। রবীন্দ্রনাথের অন্তজীবন ও বহির্জগতের ঘটনা এবং তার প্রতিক্রিয়া সব কিছুই এর সঙ্গে জড়িত।

স্বদেশের জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে একটা সদাজাগ্রত ঔৎসুক্য থেকেই প্রথম যৌবনে বাউল গান বিষয়ে আগ্রহ- একথা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতামালায় ‘Religion of Man’ এর একটি স্থানে তাঁর অতীত অভিজ্ঞতায় বাউল সম্প্রদায় ও গান সম্পর্কে যে উল্লেখ পাচ্ছি, অত্যাশ্চর্য স্বীকারোক্তি হিসেবে এবং আমাদের প্রসঙ্গের দিক থেকেও তা অত্যন্ত মূল্যবান। তিনি বলছেন, পিতা কর্তৃক ব্রহ্মসমাজের সম্পাদক পদে নিযুক্ত হয়ে প্রধানত গান রচনা দ্বারা তিনি সমাজের উপাসনা পরিচালনা করছিলেন কিন্তু তৃপ্ত হচ্ছিলেন না । 

          After a long struggle with the feeling that I was using a mask to hide the living face of truth, I gave up my connection with our church. About this time one day I chanced to hear a song from a beggar belonging to the Baul sect of Bengal… it was alive with an emotional sincerity… Since then I have often tried to meet these people and sought to understand them through their songs’.


                বাউল সুরের গান “তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে”, “যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক”, “নিশিদিন ভরসা রাখিস”। বাউল সুরের গানগুলিতে প্রধানত পূর্ববঙ্গের বাউলদের প্রভাব স্পষ্ট। সাধারণ লোকসংগীতের মতো তিন চার বা পাঁচ সুরের গান এগুলি নয়। এতে পুরো সাতটি সুরই খেলা করছে এবং মধ্যে কোমল সুরেরো ব্যবহার দেখা যায়। স্বদেশি আন্দোলনের প্রেরণাতেই গানের সুরে বাউলের ব্যপক প্রয়োগ। কিন্তু সুরে বাউল হলেও কথায় আছে জাতীয় উদ্দীপনার বাণী, যা বাউল আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। কেবল মিলটুকু আছে সহজ সরল আন্তরিকতায়। তেমনি বাউল সুরের প্রয়োগ হচ্ছে একান্ত মানবিক প্রেমের গানে, ঋতুসঙ্গীতে, এমনকি গীতিনাট্যেরও গানে। আবার খাঁটি বাউল তত্ত্বাদর্শে রচিত গানও আছে। যেমন- “আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে”, “আমি তারেই খুঁজে বেড়াই”, “আমি কান পেতে রই”। এমনকি, আছে দেহতত্ত্ব-ভাবানুসারী গান। যথা- “নিত্য তোমার যে-ফুল ফোটে ফুল বনে”। বাউল গানের আর একটা বিষয়গত বৈশিষ্ট্য হল ‘মনের মানুষ’, যাকে  ‘মনোবেড়ি’ দিয়ে বাঁধতে হয়, যথা ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়’ অথবা ‘আমি কোথায় পাবো তার আমার মনের মানুষ যে রে।” রবীন্দ্রনাথের গানেও আছে- “আমার মন যখন জাগিল নারে, তোর মনের মানুষ এলো দ্বারে”। বাউলের ভাষায় দেখি- “তাই তুমিও বাঁধা, আমিও বাঁধা মুক্তি কোথায় পাই।” আড় রবীন্দ্রনাথে কবিতায় – “মুক্তি? ওরে মুক্তি কোথায় পাবি? মুক্তি কোথায় আছে? আপনি প্রভু সৃষ্টিবাঁধন পরে বাধা সবার কাছে।“ ভষায় বক্তব্য অসামান্য মিল। আর একটি বিখ্যাত বাউল গানে পাচ্ছি কবির যিনি পরমগুরু তিনি “যুগযুগান্তে ফুটায় মুকুল তাড়াহুড়া নাই।” এযেন রবীন্দ্রনাথেরই কথা , তাঁরই প্রতিধ্বনি। কবি নিজেকে বলতেন ‘কবি-বাউল’। তাঁর নানা নাটকে বাউল বারবার অবতীর্ণ নিজেই বাউলের অভিনয় করতে ভালো বাসতেন। বিভিন্ন প্রবন্ধে বাউলের অসংখ্য উল্লেখেও দেখি ঐ প্রভাবের উজ্জ্বল স্বাক্ষর।


রবীন্দ্রনাথের হাতে বাউল গানের ঢং অপেক্ষাকৃত বিচিত্র হয়ে উঠেছে। অস্থায়ী ও অন্তরা এবং তার পুনরাবৃত্তির বদলে মাঝে মাঝে দেখা দিয়েছে বাউল সুরে ধ্রুপদী আদর্শ অনুযায়ী চার ‘তুক’ বা অংশ বিভক্ত গান। অনেক বিশেষজ্ঞই স্বীকার করেছেন – রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চারী’ এক অতুলনীয় সৃষ্টি। বাউলসুর-প্রধান গানের সঞ্চারীতে তিনি প্রাচীন রাগ-রাগিণী বা কীর্তনের সাহায্য নিয়েছেন। উদাহরস্বরূপ,

 “বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা আষাঢ় তোমার মালা’ গানটির সঞ্চারীতে পাওয়া যাচ্ছে

 ‘দেশ’ রাগের রূপ। বিপরীত দৃষ্টান্তে-

 “তুমি একলা ঘরে বসে বসে কী সুর বাজালে।”

          গানটির কাঠামো মোটামুটি ‘কেদার রাগে। কিন্তু এর দ্বিতীয় পদে ‘বাউলের সুর লেগেছে, এনে দিয়েছে উদাস ভাবের করুণ বিহ্বলতা’। “রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এবার যাবার আগে” গানটি বাউল সুরের একটি বিশিষ্ট গান। এর মধ্যে লক্ষ্য করা যাবে- বাউলের সঙ্গে পিলু রাগিণী মিশ্রিত, আরম্ভে বাউল, গানের সুনির্দিষ্ট ভাগ নেই, সুরযোজনাও বাঁধাধরা নিয়মে হয়নি। কথা অনুযায়ী সুরের সন্নিবেশ প্রথম অংশ সুর বেদনা প্রকাশের অনুকূল, পরবর্তী অংশে উন্মাদনার ভা পরিস্ফুট। বাউলের মধ্যে ঝুমুরের প্রভাব- “ওরে বকুল পারুল।”

আর একটি গান “আমি কান পেতে রই” বাউল তত্ত্বাদর্শে রচিত। ভাষা ও সুরের অত্যাশ্চর্য সম্মিলন। সুরের দিক থেকেও বাউল ও সারির মিশ্রণ। 

রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টতই প্রথম দিকে বলেছেন যে তাঁর গান অবিকৃত ভাবে গাইতে হবে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপকুমারকে তাঁর গানে variation করার অনুমতি না দিয়ে এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘হিন্দুস্থানী সঙ্গীতকার, তাঁদের সুরের মধ্যকার ফাঁক গায়ক ভরিয়ে দেবে এটা যে চেয়েছিলেন।তাই কোনো দরবারী কানাড়া্র খেয়াল সাদামাটা ভাবে গেয়ে গেলে সেটা নেড়া-নেড়া না শুনিয়েই পারে না।কারণ দরবারী কানাড়া তানালাপের সঙ্গেই গেয়, সাদামাটা ভাবে নয়। আমার গানেতো আমি সেরকম ফাঁক রাখিনি যে সেটা অপরে ভরিয়ে দেওয়াতে আমি কৃতজ্ঞ হয়ে উঠব।’ (‘সঙ্গীতচিন্তা’) অর্থাৎ এখানে হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে নিজের গানের তফাৎ নির্দেশ করেছেন। হিন্দুস্থানী সঙ্গীতে স্বাধীনতা সঙ্গীতকার নিজেই দিয়ে রাখেন শিল্পী কে, যেহেতু তাঁর সৃস্টি একটি বিশেষ সুরসমষ্ঠির উপর ভিত্তি করে রচিত গান এবং যা দাঁড়িয়ে থাকে গায়ক বা গায়িকা কেমন করে সেই বিশেষ সুরের ধরনটিকে ফুটিয়ে তুলছেন তার ওপর। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দাবি ছিল যে তাঁর গানের প্রত্যেকটির নিজস্ব ও সম্পূর্ণ রূপ আছে। অন্যদিকে তিনি তাঁর ‘সঙ্গীতের মুক্তি’ প্রবন্ধে লিখছেন ‘এইখানে য়ুরোপের সঙ্গীত-পলিটিক্সের সঙ্গে আমাদের সঙ্গীত-পলিটিক্সের তফাত। সেখানে ওস্তাদকে অনেক বেশি বাঁধাবাঁধির মধ্যে থাকিতে হয়। গানের কর্তা নিজের হাতে সীমানা পাকা করিয়া দেন, ওস্তাদ সেটা সম্পূর্ণ বজায় রাখেন। তাঁকে যে নিতান্ত আড়ষ্ট হইয়া থাকিতে হইবে তাও নয়, আবার খুব যে দাপাদাপি করিবেন সে রাস্তাও বন্ধ। য়ুরোপে প্রত্যেক গান একটি বিশেষ ব্যক্তি, সে আপনার মধ্যে প্রধানত আত্মমর্যাদাই প্রকাশ করে। ভারতে প্রত্যেক গান একটি বিশেষ-জাতীয়, সে আপনার মধ্যে প্রধানত জাতিমর্যাদাই প্রকাশ করে।’ এই দুটি লেখা পাশাপাশি রেখে পড়লে তো মনে হয় গানের রূপায়ণের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ হয়ত য়ুরোপীয় রীতিকেই আদর্শ মানতে চেয়ে ছিলেন। প্রত্যেকটি গানের যে নিজস্ব একটি রূপ আছে, যা তাকে অন্য একটি গানের থেকে আলাদা করে এবং যা একটি composition হিসেবে স্বয়ং সম্পূর্ণ এবং যা কোন বিশেষ গোষ্ঠির সুরসমষ্টির মধ্যে পড়ে না। কিন্তু প্রত্যেক গানের অবিকৃত রূপের খোঁজ আমারা পাব কি করে? সহজ উত্তরটা হল স্বরলিপি দেখে। সেইটেই য়ুরোপীয় পদ্ধতি। কিন্তু রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সেখানে গন্ডগোল আছে। তার অনেকগুলি কারণ।

প্রথমতঃ একাধিক রবীন্দ্র সঙ্গীতের একটির বেশি স্বরলিপি চালু আছে। ধরুন ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ গানটি। এই গানটি একটি জনপ্রিয় গান। কিন্তু এর তিনটি স্বরলিপি বাজারে পাওয়া যায়। একটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের করা, একটি সরলা দেবীর(রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নি) করা এবং তৃতীয়টি দিনু ঠাকুরের করা। তিনটি স্বরলিপিতে সামান্য হলেও বিভেদ আছে। অতএব অবিকৃত একক রূপের নির্ধারণ করা এক্ষেত্রে সম্ভব নয়। সেইরকম আবার ‘তবু মনে রেখ’ গানটির ও চারটি স্বরলিপির খোঁজ মেলে। সেগুলি প্রায় এক হলেও হুবহু এক নয়। এবার ধরুন ‘এ পরবাসে রবে কে’ গানটি। এটির অনেকগুলি রেকর্ড বাজারে পাওয়া যায়। তার মধ্যে যদি কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের রেকর্ডটি শোনেন এবং অমিয়া ঠাকুরের গাওয়া গানটি (এটি সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির জন্য রেকর্ড করান) শোনেন, তা হলে দেখবেন, ‘কে রবে সংশয়ে’ এই অংশে, কণিকা ‘-শয়ে’-তে মধ্যম থেকে কোমল নিখাদ( ম-ণ) অবধি একটি মীড় টেনেছেন, স্বরলিপিতেও তাই আছে, কিন্তু অমিয়া ঠাকুর তা করেন নি। দুজনেই তো সমান মান্য। একজন শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতভবনে শৈলজারঞ্জনের শিষ্যা, আর অন্যজন ঠাকুরবাড়ির বউ, এবং রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তাঁর গান ভীষণ ভালোবাসতেন ও তাঁকে নিজে শিখিয়েছেন! এবারে দেখা যাক রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর অন্যান্য প্রিয় গায়ক-গায়িকারা কেমন করে গেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিকের লেখা গান, ‘স্বপন যদি ভাঙ্গিলে’ ( রামকেলী রাগে নিবদ্ধ), এই গানটি বিষ্ণুপুর ঘরানার বিখ্যাত গায়ক রাধিকা প্রসাদ গোস্বামী গেয়েছেন শুদ্ধ আকারে বিস্তার করে এবং তান করে, তবে রামকেলি রাগের রূপ অবিকৃত রেখে। সে গান রেকর্ডের অনুমতি তো রবি ঠাকুরই দিয়েছেন। এবং পরবর্তী কালে সেই গান শুনেই ওস্তাদ ভি ভি ঝলওয়ার গানটির স্বরলিপি করেছেন। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে, গান গাওয়া আগে, পরে স্বরলিপি এসেছে । কিন্তু, সেই বিস্তারের তো স্বরলিপি নেই! গোপেশ্বর বন্দোপাধ্যায়ের গাওয়া, নটমল্লার রাগে ‘মোরে বারে বারে ফিরালে’ গানটিতেও, স্বাধীন সুরবিহারের নজীর মিলবে। তেমনি আবার ‘বুঝি ঐ সুদুরে’ গানটির কোন স্বরলিপি প্রথমে ছিল না। রবীন্দ্রনাথ একবার বসন্ত উৎসবের জন্য গানটি লেখেন (সাহানা দেবীর কাছে একটি হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় গান শুনে) এবং সাহানা দেবীকে শেখান। এই গানটি পরে সাহানা দেবী রবীন্দ্রভারতীর জন্য রেকর্ড করে দেন, যা থেকে স্বরলিপি করা হয়। অর্থাৎ এখানেও আগে গাওয়া গানটি ও পরে তার স্বরলিপি। এদের সবাইকে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত পছন্দ করতেন এবং উচ্চশ্রেণীর সঙ্গীতশিল্পী বলে মনে করতেন। এইসব ক্ষেত্রে কিন্তু গানের রূপটি পুরোপুরি গায়ক বা গায়িকা নির্ভর হয়ে রইল । এবং রবীন্দ্রনাথ নিজেই দিলীপকুমারের সঙ্গেই আলোচনায় পরের দিকে বলছেন, ‘আমিতো একথা বলি নি যে, কোনো বাংলা গানেই তান দেওয়া চলে না। অনেক বাংলা গান আছে যা হিন্দুস্থানী কায়দাতেই তৈরী, তানের অলংকারের জন্য তার দাবি আছে। আমি এ রকম শ্রেণীর অনেক গান রচনা করেছি। সেগুলিকে আমি নিজের মনে কত সময়ে তান দিয়ে গাই।’(‘সঙ্গীতচিন্তা’) তাহলে কী উনি নিজেই নিজের বিরুদ্ধাচরণ করলেন? তা বোধহয় নয়। কারণ পরের দিকে আবার দিলীপ কুমারের সঙ্গে আলোচনায় উনি সে প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘শেষ কথা সুরবিহার সম্বন্ধে। ইংরেজী improvisation কথাটির তুমি বাংলা করেছ সুরবিহার-এও আমি ভালবাসি । এতে যে গুণী ছাড়া পায় তাও মানি । আমার অনেক গান আছে যাতে গুণী এরকম ছাড়া পেতে পারেন অনেকখানি। আমার আপত্তি এখানে মূলনীতি নিয়ে নয়। তার প্রয়োগ নিয়ে।


===={{{{{{{{{{{{{∆∆∆∆∆∆∆∆∆}}}}}}}}}}}====




No comments: