বন্দ্যোপাধ্যায় মানবেন্দ্র
"সে কোন কালের ঘটনা। তখনও অবধি দৌড় সরলা এরেন্দিরা আর পেদ্রো পারামো অবধি। বইয়ের তাকে এমন ভাবে সাজিয়ে রাখি বই দুটো যাতে কেউ বাড়িতে এলেই দেখতে পায়। অনুবাদ যিনি করেছেন, তাঁর বিভাগে পড়তে এসে এক রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তে তাঁকে দেখে বুঝলাম মানববাবুকে কল্পনা করা আমার দুঃসাধ্য ছিল। নিপুণ ফ্রেঞ্চ কাট। বাদামি কর্ডুরয়ের ট্রাউজ়ারের ওপরে টকটকে চে গেভারা টি শার্ট। একটা লম্বা বিদেশি ছাতার বাঁকানো বাট ওঁর বাঁ কাঁধে আটকে ঝুলছে। হাতে চোস্ত চুরুট (কিউবার, নিশ্চিত)। গালে মাছিটি বসলে পিছলে যায়। কসমোপলিটানিজ়মের হদ্দমুদ্দ কেতায় থ খেয়ে গেলুম।
তার পর বিভাগের লাইব্রেরিতে দেখি তাকের পর তাক। উনি। লাতিন আমেরিকার কবিদের, সাহিত্যিকদের অনুবাদ। গিফটের আলমারি বলে যে আলমারিটি, তাতে ওঁর বিভাগকে উপহার দেওয়া অগুনতি বই। প্রথম পাতায় কেনার স্থান। ভ্যাঙ্কুভার, মাদ্রিদ, প্রাহা। নীচে দস্তখত: মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি বাঙালি পাঠককে ‘আপনার মুখ আপুনি দেখ’ নামক হাত আয়নার ভিতরে একটার পর একটা দরজা খুলে নিয়ে যান সাহিত্যের এমন এক ‘জ্বলন্ত প্রান্তর’-এর দিকে, সেখানে উন্মোচিত হতে থাকে একটার পর একটা দেশ, মহাদেশ। বিপুল সাহিত্যবিশ্বের বহুত্বের মধ্যে আমাদের দিশেহারা হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় রইল না। আমরা ভেবে কূল পেলাম না, কী পরিমাণ মেধা থাকলে ও প্রাণিত হলে কারও পক্ষে এতগুলি দেশের ও মহাদেশের এত অগুনতি লেখকের ঠিকুজি কুলুজি জানা সম্ভব? অনুবাদ করার জন্য তাঁদের লিখনের ও রাজনীতির আঁতের ব্যাপার আত্মস্থ করা সম্ভব?" (ঈপ্সিতা হালদার)
তিনি খগেন্দ্র মিত্র স্মৃতিপুরস্কার পান ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে বিদ্যাসাগর পুরস্কারে ভূষিত করে। অনুবাদে তার কৃতিত্বের জন্য মূলত পাবলো নেরুদা, লাতিন আমেরিকার উপন্যাস সমূহ, হুয়ান রুলফোর কথাসমগ্র, শার্ল পেরোর রূপকথা, মিরোস্লাভ হলুবেরের কবিতা, নিকানোর পাররার কবিতা, পিটার বিকসেল, একাধিক স্প্যানিশ গল্প ইত্যাদি অনুবাদের জন্য ভারতীয় সাহিত্য একাদেমি তাঁকে অনুবাদ পুরস্কার-এ ভূষিত করেছিল।
গ্রন্থসমূহ
ভেদ বিভেদ (১ম ও ২য়)
দেশে ফেরার খাতা
লাতিন আমেরিকার উপন্যাস সংগ্রহ
লাতিন আমেরিকার গল্প সংগ্রহ
মুখোশ ও মৃগয়া
বাংলার ছয় মণীষী
মিরোস্লাভ হোলুভের শ্রেষ্ঠ কবিতা
খেলা অমনিবাস (১ম ও ২য় খন্ড)
খেলা সমাচার
আষাঢ়ে বই
এই শহরে চোর নেই
চারজনের চিহ্ন
ঘণ্টা বাজে দূরে
আত্মহত্যার অধিকার ও অন্যান্য
নিকানোর পাররার শ্রেষ্ঠ কবিতা ও প্রতিকবিতা
চেশোয়াভ মিউশ শ্রেষ্ঠ কবিতা
বাস্তবের কুহক ও কুহকের বাস্তব
গণ্ডি
কাঁচের ঘর
মৌচাক ঢিল
চন্দ্রাহত
হরবোলা
সোনার দুয়ার
রহস্যময় রোমাঞ্চকর
যে পুতুল পালিয়ে গেল
বিঙ্গো ও আকাট
আন্ডারসেনের গল্প
এক যে আছে মায়াপুরে
চোরকাঁটা
আত্মাহত্যার অধিকার এবং অন্যান্য সনদ
জুল ভের্ন অমনিবাস (৪ খণ্ড)
ল্যাম্পপোস্টের বেলুন
আলিবাবার গুহা
কুড়িয়ে ছড়িয়ে দেশ-বিদেশের লোককথা
কবিতা যারা পড়ে না তাদের জন্য কবিতা
স্রষ্টা যখন সর্বপ্রথম বানিয়েছিলেন প্রাণী
ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটে জয়ের প্রস্তুতি পর্ব.....
জন্ম ১৯৩৮ সালে ২৫ এপ্রিল
অধুনা বাংলাদেশের সিলেটে। তুলনামূলক সাহিত্য, ভারতীয় নন্দনতত্ত্ব, ললিতকলার ইতিহাস নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেছেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয় ও পোল্যান্ডের ভাসভি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি প্রথম অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন মায়ানমারের রেঙ্গুনে। পরে পড়াতে আসেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে।
কবিতা, শিশুসাহিত্য, উপন্যাস,ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস প্রভৃতি বহুক্ষেত্রেই প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের ইতিহাসে তার অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রায় একক প্রচেষ্টায় দক্ষিণ আমেরিকা ও পূর্ব ইউরোপের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। তিনি ১৯৭০ সালে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখা কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না, সরলা এরেন্দিরা অনুবাদ করেন। লাতিন আমেরিকার কবিতা ও ছোটগল্প এবং রুশ সাহিত্য অনুবাদ করেছেন তিনি। মৌলিক রচনার পাশাপাশি এডগার অ্যালেন পো, আর্থার কন্যান ডয়েল, জুল ভের্ন অনুবাদ করে বাংলা শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখেন তিনি।
এ ছাড়া মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদনার কাজও করেছেন। তার সম্পাদিত 'হরবোলা' ও 'জিয়নকাঠি' প্রভৃতি ছোটদের গল্প সংকলন ছাড়াও দেশবিদেশের শিশুসাহিত্য নামক গ্রন্থমালায় তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের শিশুসাহিত্যকে বাংলায় উপস্থিত করেছেন।
বিশ্বসাহিত্যের হদিশ পেতে বাঙালিকে আর ইংরেজির দ্বারস্থ হয়ে থাকতে হয়নি, মানববাবুর অসীম কর্মক্ষমতায় বাংলা ভাষাতেই সেই চর্চা সম্পন্ন করা গিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই অনুবাদের মধ্য দিয়ে তিনি তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য বলে একটা রাজনৈতিক মেল সন্ধান করার পথ দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন, কী ভাবে লাতিন আমেরিকার বা আফ্রিকার নানা দেশের লেখক ও কবিরা লিখেছেন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মধ্যে, মিলিটারি শাসনে, সেন্সরশিপের নিগড়ের মধ্যে, নির্বাসনে বসে। কী পরিমাণ অধ্যবসায় ও মনন থাকলে এ হেন সৃষ্টিশীলতা সম্ভব, এই ভেবে চমকে ওঠা যায় বার বার। মাঝে মাঝে কেউ কেউ আসেন, অনায়াস মেধায় গড়ে দিয়ে যান সম্ভার, যাতে কয়েক প্রজন্ম পাঠক ও গবেষক রসদ পেয়ে যান।
মানববাবু শুধু অনুবাদক ছিলেন না। তাঁর অনুবাদে নিহিত ছিল সুতীব্র সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বীক্ষা, অনূদিত সাহিত্য ও অনূদিত লেখক-কবিকে তার সামাজিক পটভূমি-সহ পেশ করার অ্যাকাডেমিক গভীরতা, অজানা লেখার কৃৎকৌশলকে পেশ করার বিশ্লেষণী ধরতাই। মানববাবু বাঙালি পাঠকের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন, তাঁর অনাবিল, স্বাদু, মেধাবী, শ্লেষাত্মক ও মমত্বসম্পন্ন এক নতুন বাংলা ভাষা, যে ভাষা তাঁর অনুবাদের। লেখক থেকে লেখকে বদলে যাওয়া কাহিনি ফাঁদার কৃৎকৌশল তিনি ধরে ফেলছেন অবলীলায়। আবার যার মধ্য দিয়ে এক উপনিবেশিত দেশের মানুষ আমরা, লাতিন আমেরিকা আর আফ্রিকার উপনিবেশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারি, যাতে তৈরি হয় এক তুলনামূলকতার বোধ, জীবনে ও সাহিত্যে। মার্কেস তাঁর নোবেল পুরস্কার ভাষণে লাতিন আমেরিকার নিঃসঙ্গতার কথা বলেছিলেন, যা মানববাবুই অনুবাদ করেন বাংলায়। মানববাবু বিশ্বাসই করাতে চেয়েছিলেন যে, সাহিত্যে সাহিত্যে যোগ ছাড়া এই নিঃসঙ্গতা কাটানো সম্ভব নয়।
একই দর্শনে বাঙালি পাঠকের হাতে এসেছে, পাঁচ খণ্ড অনুবাদ, আধুনিক ভারতীয় গল্প এই শিরোনামে, মানববাবুর সম্পাদনায়। তাতে আত্মতৃপ্ত বাঙালির ভাষা সাহিত্যের কূপমণ্ডূকতা তছনছ করে নানান ভারতীয় ভাষায় নানা মহান লেখকের তাক লাগানো সব ছোট গল্পই শুধু এসে পৌঁছয়নি, এ বিষয়ে মনন চর্চার হদিশ তিনি রেখে গিয়েছেন প্রতিটি খণ্ডে। সেই দিক থেকে দেখলে এই খণ্ডগুলি ভারতীয় তুলনামূলক সাহিত্যের দিকে যাওয়ার একটি ধাপ তো বটেই। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকেই আধুনিক ভারতীয় সাহিত্য মানববাবুর বিশেষ উৎসাহে তুলনামূলক সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে। যার ফলে তামিল, তেলুগু, মালয়ালম, কন্নড়, গুজরাতি, অহমিয়া ইত্যাদি সাহিত্যের সমাহার হয়ে দাঁড়ায় ভারতীয় সাহিত্য। ভারত বলতে তখন ভাষার সঙ্গে ভাষার যোগ, কথোপকথন। একক ভাষার সাহিত্য বলে বিচ্ছিন্ন কোনও অভিব্যক্তিকে পড়ার আর উপায় থাকে না। কোনও গোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্ন ও পৃথক করে দেখার উপায় থাকে না।
===={={{{}}}}}}}={}}{={}[}°^^=^৳√π°^°=°====
No comments:
Post a Comment