মহারাজ নন্দকুমার
বাংলার গভর্নর-জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে ১৭৭৫ সালের ৫ই আগস্ট কলকাতায় বর্তমান বিদ্যাসাগর সেতুর নিকটে নন্দকুমারকে ফাঁসি দেওয়া হয়.
ওয়ারেন হেস্টিংস সেই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ঘটনাচক্রে স্যার এলিজা ইম্পে ছিলেন তাঁর স্কুলের বন্ধু। তাই বহু ঐতিহাসিক এই মত পোষণ করেন যে, মহারাজ নন্দকুমারকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছিল।নন্দকুমারের ফাঁসিকে বহু ঐতিহাসিক ‘আইনি হত্যা’ বলে থাকেন।
আকবরের সময় থেকে জমিদারি প্রথা চালু হয়। মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা তমলুকের জমিদারির মধ্যে থাকা তমলুক পরগনার অন্তর্গত ছিল বাসুদেবপুর এলাকা। প্রখ্যাত গবেষক যুধিষ্ঠির জানার (মালীবুড়ো) লেখা ‘বৃহত্তর তাম্রলিপ্তের ইতিহাস’ থেকে জানা যায়, ১৭৪০ সাল নাগাদ তমলুকের রাজা ছিলেন নরনারায়ণ রায়। নরনারায়ণের মৃত্যুর পরেই রাজপরিবারে গৃহবিবাদের জেরে মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা মুর্শিদাবাদের নবাবের দরবারে কয়েক বছরের খাজনা বাকি পড়েছিল তাম্রলিপ্তের রাজার। সে সময় মুর্শিদাবাদের নবাব মসনদি মহম্মদ খান তাঁর প্রিয় বন্ধু খোজা দিদার আলি বেগকে ১৭৫৭ সালে তমলুকের জমিদারির দায়িত্বভার তুলে দেন। দিদার আলি বেগ তমলুকের জমিদারির ভার নেওয়ার ফলে তমলুকের রাজবংশ পদুমবসানের সাবেকি রাজবাড়ি ছেড়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে বহিচবেড়ের গড়ে আশ্রয় নেন।
দিদার আলি বেগ ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তমলুকের জমিদারি পরিচালনা করেছিলেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের পরে মীর জাফর বাংলার নবাব হন। ১৭৬৫ সালে ইংরেজ কোম্পানী বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানি ভার পায়। এ সময় বাংলার শাসন কর্তা হয়ে এসেছিলেন লর্ড ক্লাইভ। এদিকে তমলুক রাজ পরিবারের সেই দুঃসময়ে রাজা নরনারায়ণের মহিষী রানি সন্তোষীপ্রিয়া, রাজা কৃপানারায়ণ রায়ের মহিষী কৃষ্ণপ্রিয়া যুক্তভাবে তাঁদের জমিদারি ফিরে পাওয়ার জন্য কোম্পানীর কাছে আবেদন করেছিলেন। তাঁদের এই কাজে তত্ত্বাবধান করেছিলেন মহারাজ নন্দকুমার ও গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ।
মীর জাফরের আমলে মহারাজা নন্দকুমার মহিষাদল পরগনার দেওয়ান নিযুক্ত হয়েছিলেন। মীরজাফরের চেষ্টায় দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে নন্দকুমার ‘মহারাজা’ উপাধি পেয়েছিলেন। লর্ড ক্লাইভও নন্দকুমারকে সুনজরে দেখতেন। মহারাজা নন্দকুমার ও গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের প্রচেষ্টায় রাণী সন্তোষপ্রিয়া ও রাণী কৃষ্ণপ্রিয়া ফের তমলুকের জমিদারি ফিরে পেয়েছিলেন।
নন্দকুমার ও গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের এই উপকারের পুরস্কারস্বরূপ তমলুকের রানিরা মহারাজা নন্দকুমারকে ছয়খানি ও গঙ্গাগোবিন্দ সিংহকে আটটি গ্রাম উপহার দেন। মহারাজা নন্দকুমার পান তালুক বাসুদেবপুর। এই বাসুদেবপুর তালুকের মধ্যে মহারাজা নন্দকুমার দু’টি শিব মন্দির তৈরি করেছিলেন ও একটি হাট বসিয়েছিলেন। হাটের পাশে একটি জলাশয় খনন করিয়েছিলেন। নন্দকুমার হাটের পাশে সেই পুকুর আজও ‘দেওয়ান পুকুর’ নামে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে এলাকার বাসিন্দাদের উদ্যোগে সেই হাটের সংলগ্ন এলাকাতেই গড়ে উঠেছে বাসুদেবপুর মহারাজা নন্দকুমার প্রাথমিক ও হাইস্কুল।
মহারাজা নন্দকুমারের স্মৃতি বিজড়িত বাসুদেবপুর এলাকার হাটটি ক্রমশ ‘নন্দকুমারের হাট’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। সেই নন্দকুমারের হাটকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে নন্দকুমার বাজার। নন্দকুমার ব্লক এলাকা নিয়ে গবেষণা করেছেন মেদিনীপুর কলেজের অধ্যাপক সুস্নাত জানা। সুস্নাতবাবুর মতে, ‘‘প্রাচীন এই জনপদের মধ্যেই রয়েছে তমলুক রাজবংশের বহিচবেড়গড় আর দেবী বর্গেশ্বরীর মন্দির। বাসুদেবপুর গ্রামে রয়েছে মহিষদল রাজপরিবারের খনন করা কাছারিপুকুর ও জোড়া শিবমন্দির।’’
ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা আনার জন্য এই এলাকার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। এলাকার সন্তান বিপ্লবী সুশীল ধাড়া, বরদাকান্ত কুইতি প্রমুখ ছিলেন তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের অন্যতম অগ্রণী। ১৯১৫ সালে বিপ্লবী বাঘা যতীন নন্দকুমার এলাকার কুমরআড়া গ্রামে হেমদা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন। নন্দকুমারের কল্যাণ চক হাইস্কুলের তিন ছাত্র ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে শহিদ হয়েছিলেন। বর্তমানে বাসুদেবপুর, খেজুরবেড়িয়া, প্রমহংসপুর, শ্রীধরপুর প্রভৃতি নন্দকুমার বাজার হিসেবে পরিচিত।
এখানে গড়ে উঠেছে নন্দকুমার থানা, ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ২০০৩ সালে তমলুক-দিঘা রেলপথ চালুর সাথে চালু হয় নন্দকুমার রেল স্টেশন। ২০০৭ সালে নন্দকুমারে গড়ে উঠেছে মহারাজা নন্দকুমার মহাবিদ্যালয়। ব্লকের সদর নন্দকুমার বাজার এলাকাকে ঘিরে গড়ে ওঠা জনবসতি দ্রুত বাড়ছে। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক তথা প্রাক্তন বিধায়ক ব্রহ্মময় নন্দের মতে, ‘‘পূর্বতন বাসুদেবপুর তালুকের এলাকাই বর্তমানে নন্দকুমার ব্লক এলাকা নামে পরিচিত। মহারাজা নন্দকুমারের স্মৃতি বিজড়িত মন্দির সহ নানা নিদর্শন এই অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে। এইসব ঐতিহাসিক নিদর্শনের সংরক্ষণ খুবই জরুরি।’’
রাজস্ব আদায়ের দেওয়ান থেকে তিনি নিজ দক্ষতার গুণে হয়েছিলেন ‘মহারাজা’। আর ব্রিটিশদের হাতে ফাঁসির শাস্তি পাওয়া সেই মহারাজা নন্দকুমারের স্মৃতিই বয়ে চলেছে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমার।
১৭০৫ সালে বর্তমান বীরভূম জেলার নলহাটি থানার ভদ্রপুর গ্রামে নন্দকুমার জন্মগ্রহণ করেন।
মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম ১৭৬৪ সালে নন্দকুমারকে ‘মহারাজা’ উপাধি প্রদান করেছিলেন।
তিনি রাধামোহন ঠাকুরের নিকট বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন।
তিনি অভিযোগ করেন যে, হেস্টিংস তাকে দশ লক্ষ টাকার এক-তৃতীয়াংশ ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন। তিনি এও দাবি করেন যে, হেস্টিংসের বিরুদ্ধে তার অভিযোগের প্রমাণস্বরূপ একটি চিঠি রয়েছে।
জেলা সদর তমলুক শহরের অদূরে এই এলাকার নন্দকুমার নামকরণের পিছনে লুকিয়ে আছে এক ইতিহাস। একদা বঙ্গোপসাগরের উপকূলে গড়ে ওঠা প্রাচীন তাম্রলিপ্ত বন্দরে ভিড়ত বাণিজ্যতরী। সে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। ধীরে ধীরে সমুদ্রের লোনা জলে প্লাবিত হয় গোটা এলাকা। তাম্রলিপ্তের পূর্ব দিকে রূপনারায়ণ আর পশ্চিমে কাঁসাই, হলদি নদীর মাঝের এই অঞ্চলে ক্রমশ জনবসতি গড়ে উঠতে থাকে। ইতিহাস গবেষকদের মতে, ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবর দিল্লির সিংহাসনে বসে সমগ্র বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা দখল করে নিজের অধিকারে আনেন। আর সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহের সময় তমলুক পরাধীন হয়।
মহারাজ নন্দকুমার সমাজে একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাই তার ফাঁসি স্থানীয় জনসাধারণের মনে আতঙ্কের সঞ্চার ঘটায়।এর ফলে বহু বাঙালি কলকাতা ছেড়ে বেনারসের মতো জায়গায় চলে যায়।[৩]
ঐতিহ্য
সম্পাদনা
তার জন্মস্থান বীরভূম জেলার ভদ্রপুর গ্রামে তার সম্মানে ভদ্রপুর মহারাজা নন্দকুমার হাই স্কুল স্থাপন করা হয়েছে।
ভদ্রপুর গ্রামের নিকটে অবস্থিত আকালি গ্রামে তিনি কালী মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এটি অত্যন্ত বিখ্যাত মন্দির এবং প্রতি বছর হাজার-হাজার দর্শনার্থী এখানে আসেন। এটি ব্রাহ্মণী নদীর তীরে অবস্থিত।
২০০৭ সালে পূর্ব মেদিনীপুরে তার সম্মানে মহারাজা নন্দকুমার মহাবিদ্যালয় নামে একটি কলেজ স্থাপন করা হয়েছে।
কলকাতার একটি রাস্তার নাম হল মহারাজা নন্দকুমার রোড।
পূর্ব মেদিনীপুরের একটি অঞ্চলের নামও হল নন্দকুমার।
রচনা কর্ম:
Sir James Stephen, The Story of Nuncomar (2 vols., 1885)
H Beveridge, The Trial of Nanda Kumar (Calcutta, 1886)
No comments:
Post a Comment