Monday, 29 April 2024

শুভ জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি। সুধীন দাশ। সংগীতশিল্পী সুধীন দাশ। সংগীতবিশেষজ্ঞ, সুরকার, সংগীতপরিচালক, গবেষকসহ. বাংলা গানের ধ্রুবতারা কাজী নজরুল ইসলামের গানের স্বরলিপিকার। গানপাগল একজন। DT - 30.04.2024. Vol - 864. The blogger post in literary e magazine

              " দুর্গম গিরি কান্তার মরু......"
                                     কন্ঠে ও সুরে নজরুল সংগীতকে যিনি নজরুলগীতিতে উন্নীত করেছিলেন, তিনি কালজয়ী নজরুলগীতি শিল্পী - 

                           সুধীন দাশ 


সংগীতশিল্পী সুধীন দাশ। সংগীতবিশেষজ্ঞ, সুরকার, সংগীতপরিচালক, গবেষকসহ আরও এমন অনেক পরিচয়ে পরিচিত তিনি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যে পরিচয়—তিনি আমাদের বাংলা গানের ধ্রুবতারা কাজী নজরুল ইসলামের গানের স্বরলিপিকার। গানপাগল একজন. 

 কুমিল্লা শহরের তালপুকুরপাড়ের বাগিচাগাঁওয়ে জন্মেছিলেন তিনি। সেটা ১৯৩০ সালের কথা। তিন বোন আর ছয় ভাইয়ের পর মায়ের কোলজুড়ে এসেছিলেন; বাবা নিশিকান্ত দাশ ও মা হেমপ্রভা দাশের আদর-স্নেহের বড় একটা অংশই তাঁর নামে বরাদ্দ ছিল। বড় ভাইবোনদের আদরও কম পাননি। তাই অতি আদরে যা হয়, ‘বাউণ্ডুলে’ তকমাটা বেশ শক্ত করেই সেঁটে গিয়েছিল তাঁর নামের সঙ্গে! তবে বাউণ্ডুলে হলে হবে কী, ‘পড়াশোনায় বেশ ভালোই ছিলাম, প্রথম না হলেও ক্লাসরোল থাকত ওপরের দিকেই।’ স্মৃতিতে থাকা পাঠশালাজীবনের খেরোখাতাটা মেলে ধরেন সুধীন দাশ, ‘পড়াশোনার প্রথম হাতেখড়ি হয়েছিল বামচন্দ্র পাঠশালায়। এরপর তৃতীয় শ্রেণিতে উঠে চলে যাই ঈশ্বর পাঠশালায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে সেই পাঠশালাটা বন্ধ হয়ে যায়। কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হই ভিক্টোরিয়া কলেজে।’ কলেজের চৌহদ্দি পেরোলে আসে বিএ পরীক্ষার ডাক। তবে তত দিনে পড়াশোনার চেয়ে অন্য বিষয়ে বেশি মন দিয়েছেন তিনি। এ সময় দাবা খেলাটাও প্রায় নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। তাই পরীক্ষার বেঞ্চে বসেও বসা হয় না, ‘পরীক্ষাটা আর দেওয়া হলো না শেষমেশ! তবে ছেলেবেলা থেকে চঞ্চল প্রকৃতির হলেও গানের ব্যাপারে দারুণ আগ্রহ ছিল।’ দেয়ালে টাঙানো বড় ভাই প্রয়াত সুরেন দাশের ছবিটা দেখিয়ে বলেন, ‘আমার সংগীতের প্রতি ভালোবাসার বীজটা কিন্তু আমার ওই বড় দাদাই বপন করেছিলেন। তিনিই আমার সংগীতগুরু। প্রথম প্রথম গান শেখাতে চাইতেন না তিনি। মা বলতেন, ছেলেটা যখন গান শিখতে চাইছে, তুমি বারণ করছ কেন? দাদার উত্তর, আগে পড়ালেখাটা করতে দাও, তারপর দেখা যাবে। দাদা ছেলেমেয়েদের গান শেখাতেন, আমি ঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে শুনতাম। সব শুনে ফাঁক পেলেই মাঠে গিয়ে গলা সাধতাম। একদিন ছাত্ররা গান তুলতে পারছে না, দাদা রেগে গেলেন—এত চেষ্টা করেও তোমাদের শেখাতে পারছি না, অথচ ঘরের পেছনে যারা ঘুরঘুর করছে, তারা তো ঠিকই শিখে চলে যাচ্ছে! ব্যস, আর কী চাই, সেই কথাগুলোই ছিল আমার সংগীতজীবনের বড় প্রেরণা। এরপর দীর্ঘদিন দাদার কাছে উচ্চাঙ্গসংগীতের তালিম নিয়েছি। তিনি গত হয়েছেন আজ প্রায় ১৮-১৯ বছর হলো, কিন্তু তাঁর সেই ভালোবাসা আর শিক্ষাই আমার জীবনের পাথেয় হয়ে আছে।’

দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার
  কণ্ঠ ও সুর দিয়েছেন শ্রীসুধীন দাশ, গীতিকার ছিলেন শ্রীসত্যজিৎ সরকার. ‘১৯৪৮ সালের ৮ মার্চের ঘটনা সেটা। দুটি গান গেয়েছিলাম সেদিন। সেই শুরু। এরপর নিয়মিত বেতারে গাইতে শুরু করলাম। তখন শিল্পী ছিল হাতে গোনা। মাসে চার দিন গাওয়ার সুযোগ পেলাম। তিন অধিবেশন মিলিয়ে অনেক গানই গাইতে হতো। রবীন্দ্রসংগীতই বেশি হতো, পাশাপাশি আধুনিক গান এবং রাগপ্রধান গানও থাকত। গান গাওয়ার সম্মানী হিসেবে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হতো ১০ টাকার একটা চেক। তখনো ঢাকায় থিতু হইনি, কুমিল্লা থেকে যাতায়াত করি। আসা-যাওয়া ও অন্যান্য খরচ বাদে সে সময় হাতে থাকত চার টাকার মতো। বেতারে তখন শিল্পীর পাশাপাশি সুরকারেরও বেশ শূন্যতা। তাই সুরকার হিসেবেও চাহিদা বেড়ে গেল আমার। আয়-রোজগার নেহাত মন্দ হচ্ছিল না। একটা গানের সুর করলে পাঁচ টাকা।’ তবে নিয়মিত গান ও সুর করতে থাকলেও মনে একটা খচখচ ভাব থেকেই যেত। কেন? ‘তখন নজরুলসংগীত বলে আলাদা কিছু ছিল না। আধুনিক বাংলা গান কিংবা রাগপ্রধান গান হিসেবে নজরুলের গান গাওয়া হতো। এটা বেজায় কষ্টের ছিল। আরও বেশি কষ্টের ছিল, নজরুল যখন একসময় নিদারুণ অর্থকষ্টে ছিলেন, তখন তাঁকে দেখার কেউ ছিল না। অথচ তিনি যখন অসুস্থ হয়ে পড়লেন, নির্বাক অচৈতন্য অবস্থা। জাগতিক চাহিদা বলতে যখন কিছুই নেই তাঁর, তখনই তাঁকে নিয়ে শুরু হলো রশি-টানাটানি খেলা! এই বাংলায় ওই বাংলায় ধুমছে নজরুলের গান বাজতে লাগল। ১৯৫৪-৫৫ সালের দিকে পাকিস্তান রেডিওতে নজরুলের গান আলাদাভাবে মর্যাদা পেল “নজরুলগীতি” হিসেবে। সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে যায় নজরুলগীতি। তবে সর্বনাশের শুরুটাও সেখান থেকেই। বারোটা বেজে যায় নজরুলের গানের কথা ও সুরের! যাঁরা জীবনেও নজরুলের গান করেননি, তাঁরাও নজরুলগীতি গাইতে শুরু করলেন জনপ্রিয়তার মোহে।

৩৩ খণ্ড নজরুল সুরলিপির মধ্যে কণ্ঠশিল্পী নীলিমা দাশেরও নাম জড়িয়ে আছে একজন স্বরলিপিকার হিসেবে। তিনি ছিলেন সুধীন দাশের বড় ভাই সুরেন দাশের ছাত্রী। সেই সূত্রেই পরিচয় এবং ১৯৫৫ সালে তাঁর সঙ্গেই পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন সুধীন দাশ। ‘নীলিমা এখন খানিকটা অসুস্থ। সে এখনো গান নিয়েই আছে। গান গায়, শেখায়।’ বাসায় আর 
কে থাকেন? বাঁয়ের চোখটা পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেছে, ডানেরটাও ভালো নেই, পানি পড়ে সারাক্ষণ। চশমা খুলে পানি মুছতে মুছতে জানালার বাইরের জমাটবাঁধা অন্ধকারে তাকান সুধীন দাশ। বলেন, ‘বাসায় এখন আমি আর আমার স্ত্রী; তবে ছেলে মারা যাওয়ার পর মেয়েটা আমাদের সঙ্গেই থাকে। ওপরের তলায়।’ ছেলের স্মৃতিচারণা করেন তিনি, ‘খুব ভালো গিটার বাজাত নিলয়। গান শিখেছিল আমার কাছেই। নিজেই লিখত, সুর করত। একটা অ্যালবামও বেরিয়েছিল। ২০০৬ সালে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেল ছেলেটা।’ এরপর খানিকক্ষণের নীরবতা। একসময় নীরবতা ভেঙে মেয়ের কথাও বলেন, ‘মেয়ে সুপর্ণা দাশ। রবীন্দ্রসংগীতই গায় ও। ওর দুই ছেলেমেয়ে। একজন হলো সেই দস্যি, মানে দীপ আর আরেকজনের নাম ঐশী।’ এখনো, এই বয়সে ভোর চারটার দিকে ঘুম থেকে জাগেন সুধীন দাশ। উঠেই মিরপুরের বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন বোটানিক্যাল গার্ডেনের উদ্দেশে। দিব্যি চার-পাঁচ মাইল হেঁটে আসেন একা একা! এরপর পত্রিকা পড়ে, ক্রিকেট খেলা দেখে, নয়তো নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খুনসুটি করে কাটিয়ে দেন অবসর সময়গুলো। যদিও বেশির ভাগ সময়ই অবসর তাঁর কাছে অধরাই থেকে যায়। একসময় প্রচুর মাছ ধরেছেন। বলছিলেন, ‘ঘোর নেশা বলতে যা বোঝায়! সারা দিন হয়তো স্বরলিপি আর গান নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, ওদিকে সারাটা রাত দিয়ে দিতাম ধানমন্ডির লেকের মাছের পেছনে। হাতে ছিপ, পাশে হারিকেন। সঙ্গী-সাথিদের নিয়ে বসে থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর মাছেরাও হতাশ করত না তখন। বললে গল্প মনে হবে, কিন্তু সেই সময় ধানমন্ডি লেক থেকে ৩৬-৩৭ কেজি ওজনের মাছও ধরেছি আমি।


১৯৪৮ সালে বেতারে নিয়মিতভাবে নজরুল সংগীত গাইতে শুরু করেন সুধীন দাশ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তিনি মনোনিবেশ করেন নজরুল সংগীতের শুদ্ধ স্বরলিপি প্রণয়ণে। আদি গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে সেই স্বরলিপি উদ্ধারের কাজে তাকে সহায়তা করেন স্ত্রী নীলিমা দাশ।

১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে ২৫টি স্বরলিপি নিয়ে নজরুল সুরলিপির প্রথম খণ্ডটি প্রকাশ করে নজরুল একাডেমি। পরে নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে বের হয় আরও ৩৩টি খণ্ড. 

সুধীন দাশের স্ত্রী নীলিমা দাশ ছিলেন তার বড় ভাই সুরেন দাশের ছাত্রী। এই সূত্রেই তাদের দুজনের পরিচয় হয় এবং ১৯৫৫ সালে তারা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তার ছেলে নিলয় দাশ এবং মেয়ে সুপর্ণা দাশ দুজনেই সঙ্গীতশিল্পী। ২০০৬ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তার ছেলে।তিনি উচ্চাংগ সংগীত শিল্পী অলকা দাশ এবং নজরুল সংগীত শিল্পী মানস কুমার দাশের কাকা।

ছেলে মারা যাবার পর থেকে স্ত্রী, মেয়ে এবং দুই নাতি দীপ ও ঐশীকে নিয়ে সুধীন দাশ তার মিরপুরের বাসায় থাকতেন। তার জামাতার নাম হাসান মাহমুদ স্বপন

একুশে পদক, 
মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার আজীবন সম্মাননা 
নজরুল স্বর্ণ পদক
নাসিরউদ্দীন স্বর্ণ পদক
জেবুন্নেছা-মাহবুবুল্লাহ ট্রাস্ট স্বর্ণ পদক
শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদক [৫]
সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস

সুধীন দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের সমস্যাও ছিল তার। ২৬ জুন, ২০১৭ তারিখ রাতে তার জ্বর আসে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে নাপা ও প্যারাসিটামল খাওয়ানো হয়। রাতে জ্বর কমেনি, বরং ২৭ জুন সকালে অবস্থার আরও অবনতি হয়। এক পর্যায়ে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায়। তার মেয়ে তাকে কল্যাণপুরের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে নিলে ডাক্তাররা জানান, আইসিইউ খালি নেই। পরবর্তীতে অ্যাপেলো হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখেন। রাত ৮টার সময় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।


২৯ জুন সকালে নজরুল ইন্সটিটিউট,ঢাকা এবং শহীদ মিনারে সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে দুপুরে ঢাকাস্থ পোস্তগোলা মহাশ্মশানে অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী তার শেষকৃত্য সম্পাদন করেন তার ভাতিজা শ্রী প্রনব কুমার দাশ . 












@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@@

No comments: